অনলাইন ক্লাস: সমাধান, নাকি নতুন সংকট?

লেখক: নিশাত জাহান নিশা

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৭ মার্চ দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ ঘোষণা করা হলো, তখন নীতিনির্ধারকদের কারোই হয়ত ধারণা ছিলো না ঠিক কতদিন অব্দি বন্ধ রাখা হবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। যদি ছুটি দীর্ঘায়ত করতে হয়, সেক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে ঠিক কি উপায় অবলম্বন করা হবে, সে ব্যাপারেও কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছিলো না তাদের। কিন্তু প্রথমে ঘোষিত ছুটি যখন বাড়াতে হলো এবং ঠিক কবে নাগাদ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে, সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিল, তখন এর ফলে সৃষ্ট সেশনজট দূর করতে কোনো প্রকার পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছাড়াই ‘অনলাইন ক্লাস’ শুরু করা হলো। এপ্রিলের শুরুতেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ‘অনলাইন ক্লাসের’ জন্য শিক্ষার্থীদের চাপ দিতে থাকে এবং শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা তোয়াক্কা না করে ‘অনলাইন ক্লাস’ জারি রাখে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশানুযায়ী, দেশের অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘অনলাইন ক্লাস’ চালু করে।

এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হয়ে যাওয়া বিশ্ব, শিক্ষাব্যবস্থাকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি থেকে বাঁচাতে ‘অনলাইন শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু রেখেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিকূলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষকেরা। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একাধিক নিবন্ধে এসব সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

এর মাঝে শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর প্রথম শর্ত হলো একটা ডিভাইস যাতে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ আছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ওপর এ ব্যবস্থা তাই চাপ তৈরি করেছে। কারণ অনেক শিক্ষার্থীর এ ব্যবস্থায় পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার মত প্রয়োজনীয় ডিভাইস (ল্যাপটপ/ফোন) নেই। অনেকের নেই প্রয়োজনীয় উচ্চগতির ইটারনেট, অনেকক্ষেত্রে থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল। অনেকক্ষেত্রে পরিবারের সবাই মিলে ডিভাইস এবং ইন্টারনেট শেয়ার করে। এছাড়া অনলাইনে ক্লাস করার জন্য যেরকম নিরিবিলি পরিবেশ দরকার হয়, তাও অনেক শিক্ষার্থীদের নেই কারণ বহু শিক্ষার্থী পরিবারের সদস্যদের সাথে রুম ভাগাভাগি করে থাকেন এবং সদস্য বেশি হওয়ায় নিরিবিলি জায়গা পাওয়াও তাদের জন্য কষ্টকর।

ডিজঅ্যাবলড শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অনলাইন ক্লাস’ বেশ চ্যালেন্জিং কারণ এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সরাসরি কোনো ইন্টার‍্যাকশন হচ্ছে না। অনলাইন ক্লাসে পড়ার বিষয় বোঝা, তাদের পক্ষে বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য অনলাইনের ভিডিও থেকে, শুধুমাত্র ঠোঁটের নড়াচড়া ও চোখের এক্সপ্রেশন দেখে টপিক বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য। অটিস্টিক শিক্ষার্থীরা নতুন প্রবর্তিত এই ব্যবস্থায় তীব্র  মানসিক চাপের মাঝে আছে।

শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের নিরাপত্তা ‘অনলাইন ক্লাসের’ একটি প্রধান বিবেচনার বিষয়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও আলোচনার কেন্দ্র, তাই ক্লাসে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারেন এবং শিক্ষার্থীরাও তাদের মতামত প্রদান করতে পারেন এবং এটাই স্বাভাবিক। এসব বিষয় সবসময়ই যে রাষ্ট্রের পছন্দ হবে তা ভাবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু মানুষ, সমাজ, সময় ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এসব আলাপ জারি রাখা ভিন্ন উপায় নাই। তবে চলমান অনলাইন ক্লাসের এসব আলাপের ওপর রাষ্ট্র এখন চাইলেই নজরদারি করতে পারবে। বর্তমানের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো যেখানে বিভিন্নভাবে নাগরিকদের ওপর নজরদারি চালায়, সেখানে এই অনলাইন ক্লাস তাতে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করবে। কোনো শিক্ষক তার ক্লাসে রাষ্ট্রের এবং সমসাময়িক স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে, এবং শিক্ষার্থীরা তাতে নিজেদের মন্তব্য দিলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মোটকথা, এই অনলাইন ক্লাসগুলো না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিচ্ছে, না তাদের চিন্তা ও তথ্যের নিরাপত্তা দিচ্ছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন বহু আগে থেকেই ক্লাসে পড়ানো জিনিসের ওপর নজরদারি করে, সেক্ষেত্রে এই অনলাইন ক্লাস শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর খুব ভালোভাবেই নজরদারি করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ তাদের মতামত ও চিন্তাভাবনা এমনভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে যার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সমস্যার একটা বড় কারণ হলো, এসব অনলাইন ক্লাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মাইক্রোসফটের মত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যারা শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরেই গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে আর স্বাধীনভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছে না। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর  শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত তথ্যের ওপর নজরদারি করার এখতিয়ার তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেনেই হোক বা না জেনেই হোক, নজরাদারিতে সাহায্য করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন কোনো সফটওয়্যার তৈরি করতে পারতো যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত এবং তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করবে রাষ্ট্রের নজরদারি থেকে। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না, ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থাকছে। এছাড়া অনলাইন প্রোক্টর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নড়াচড়া,  তাকানো, ঠোঁট নাড়ানো থেকেও তাকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করতে পারে। এর চেয়ে বড় শঙ্কার আর কি আছে, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর শুধু এক্সপ্রেশন দেখে তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? এমনকি এটি শিক্ষার্থীদের ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে ফেলতে পারে, গতিবিধি ট্রেস করতে পারে, তার গোপনীয়তার তোয়াক্কা না করে।

Freedom of Opinion and Expression, Stephff, Cartoon Movement

এছাড়া এর ফলে শিক্ষকদের গবেষণা ও পড়ানোর কাজটিও আর শঙ্কামুক্ত থাকছে না। কর্পোরেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের কাজের ওপর নজরদারি করতো সবসময়ই। একজন শিক্ষকের গবেষণা কাজ এবং তিনি কি পড়ছেন সেসবের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়  নজরদারি করতো আগে থেকেই। এখন অনলাইন শিক্ষার ফলে কর্পোরেশন এবং রাষ্ট্রের নজরদারি  বাড়বে, শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে। শুধুমাত্র লেকচার এবং এসাইনমেন্ট নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ইন্টার‍্যাকশন এখন ট্রেস করা যাবে। এছাড়া লেকচার পাইরেসির শঙ্কা বাড়ছে বৈ কমছে না এতে।

রাষ্ট্রের নজরদারির পথ অবমুক্ত করা, পাইরেসির সম্ভাবনা বাড়ানো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার পাশাপাশি, অনলাইন শিক্ষা ভঙ্গুর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোয় থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য তীব্র চাপের সৃষ্টি করছে এবং তাদের ঝরে পড়ার হার বাড়াবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে, অনলাইন শিক্ষায় এসব শিক্ষার্থীদের ভালো করার হার স্বাভাবিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করার মত প্রয়োজনীয় ডিভাইস কেনার জন্য আর্থিক লোন দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এমনকি সমস্ত সমস্যার সমাধানও নয়। এছাড়া এই আর্থিক লোনগুলো এত সামান্য এবং তা পরিশোধ করাটাও এত কঠিন যে, এ সমাধানে নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়।

এসমস্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে আলাপ তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বিগ্ন শিক্ষকেরা। বাংলাদেশের মত ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার একটি রাষ্ট্রে এই আলাপগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বেশি বৈ কম নয়। বিশেষ করে যেদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী আসে মফস্বল শহর এবং গ্রামাঞ্চল থেকে যার মাঝে প্রান্তিক কৃষক, দিনমজুর, জেলে এমনকি ভিক্ষুকের সন্তানও রয়েছে, সেখানে অনলাইন ক্লাস চালু রাখতে গেলে সম্ভাব্য সবগুলো সংকট খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটুকু স্বাধীন এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ-মুক্ত সে প্রশ্ন এসময়ে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র যেখানে “Digital Security Act” জারি রেখে সমস্ত ভিন্নমত দমন করছে, এমনকি ভিন্নমতের শাস্তিস্বরূপ জেল, জরিমানা, চাকরীচ্যুত করছে, সেখানে অনলাইন ক্লাসের ফলাফল কি হতে পারে? তবে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চিত অনলাইন ক্লাস গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কারোই ভিন্নমত প্রকাশের সম্ভাবনা নেই? রাষ্ট্র যেখানে ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নজরদারি করছে, সেখানে এই অনলাইন ক্লাস শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে তো?

এ সমস্ত সংকট খতিয়ে দেখে ভাবা যেতে পারে, সব মোকাবেলা করে অনলাইন ক্লাস চালু রাখার সিদ্ধান্ত ঠিক কতটুকু বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক। এই মহামারী এবং সংকটকালে এও হয়ত নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে, জীবনের সাথে যোগহীন মুনাফা তৈরির শিক্ষা নাকি মানবিক শিক্ষা, কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে?

*লেখক: শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি

দোহাই:

১) গার্ডিয়ান, ৪ মে ২০২০: If universities shift online, we risk more poorer students dropping out, Chris Skidmore
২) গার্ডিয়ান, ৪ মে ২০২০: ‘I can’t get motivated’: the students struggling with online learning
৩) গার্ডিয়ান, ২০ মে ২০২০: Universities beware: shifting classes online so quickly is a double-edged sword ,Shreya Atrey
৪) দ্য ক্রনিকল অফ হাইয়ার এজুকেশন, ১৪ এপ্রিল ২০২০: Will the Pandemic Usher in an Era of Mass Surveillance in Higher Education?, Alexander C. Kafka,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *