বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খসড়া নোট

বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খসড়া নোট

হাসনাত কাইয়ূম
হাবিবুর রহমান

ভূমিকা

ক. ইতিহাস সাক্ষী এ দেশের জনগণ তার প্রতিটি অধিকার অর্জন করেছে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে। ভাষার লড়াই থেকে জমির লড়াই, কথা বলার অধিকার থেকে ভোটের অধিকার––প্রতিটি অধিকার আদায়ের জন্যই এ দেশের জনগণ অকাতরে জীবন দিয়েছে। গত ১০০ বছরে তারা স্বাধীনতার লড়াই করেছে ২ বার এবং বিজয়ী হয়েছে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের ১ বছরের মাথায় তাদেরকে ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। তারপর থেকে শিক্ষার অধিকার, ভোটের অধিকার, চাকরী-বাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণের অধিকারসহ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের জন্য পদে পদে লড়াই করেছে এ দেশের জনগণ। অবশেষে একটি ভয়াবহ রক্তাক্ত সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর একটি স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

খ. একটি রাষ্ট্রের চরিত্র কি হবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রটি কোন পথে পরিচালিত হবে, এর সরকার-ব্যবস্থা কেমন হবে, কিভাবে সরকার নিযুক্ত হবে, আইন-কানুন কেমন হবে, কারা আইন-কানুন তৈরী করবে, কারা এইসবের প্রয়োগ করবে, রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের উৎস কি হবে, কারা, কিভাবে এইসবের হিসাব রাখবে, মালিকানার ধরন কি হবে, জনগণের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কটি কেমন হবে, এক জাতির সাথে আর এক জাতির সম্পর্ক কেমন হবে, অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, এক নাগরিকের সাথে অপর নাগরিকের সম্পর্কের ভিত্তি কি হবে, এক ধর্মের সাথে অপর ধর্মের সম্পর্ক কেমন হবে, নির্বাচন কেমন হবে, কারা কিপথে নির্বাচিত হতে পারবে, বিচার-আচার-আইন-আদালত এইসবের চরিত্রই-বা কি হবে––এই ধরনের মৌলিক প্রায় সকল ধরনের দিকনির্দেশনা থাকে রাষ্ট্রের সংবিধানে বা শাসনতন্ত্রে। আমাদের রাষ্ট্রও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার ১ বছরের মধ্যে আমাদের সংবিধান গৃহীত এবং কার্যকর হয়।

গ. আমাদের জনগণ ১৯৭১ সালের আগে থেকে যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, যেইসব অধিকারের নির্বিঘœ চর্চা করার জন্য একটি নতুন ও স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’, ’প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ এই তিনটি অধ্যায়ে অনেকাংশেই তা প্রতিফলিত হয়েছে।

উপরোক্ত তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে যেসব আকাক্সক্ষা ব্যক্ত রয়েছে সংবিধানের মৌল ক্ষমতা কাঠামোকে যদি তা বাস্তবায়নের উপযোগী করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই পৃথিবীতে ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান’-এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারত।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, ৪র্থ অধ্যায়সহ সংবিধানের বাকী অংশ অর্থাৎ সংবিধানের যে অংশে ক্ষমতার বণ্টন করা হয়েছে, তা এতটাই ‘এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক’ যার নজীর পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই পাওয়া যাবে না। এ সংবিধান অনুযায়ী সকল কিছুই সংবিধানের অধীন, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী (প্রধানমন্ত্রী) ছাড়া। প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সংবিধানের ঊর্ধ্বে বা কোনোপ্রকার জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে শুধু নয়, সংবিধান তার ইচ্ছাধীন। যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন এবং তার দলের যদি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তাহলে তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা চর্চার অধিকার একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত করা এবং ঔপনিবেশিক সকল আইন-কানুনকে বৈধতা দেয়ার ফলে, যেই অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ এত দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছে তা অর্জন করতে পারেনি, শুধু অর্জন করেছে গণতান্ত্রিক চেহারার একটি অগণতান্ত্রিক সংবিধান।

ঘ. বাংলাদেশের মানুষ এই সংবিধানের অধীনে গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বহু ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সরকার-ব্যবস্থা দেখার সুযোগ পেয়েছে। বহুদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার, সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় ও প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন-ব্যবস্থার সরকার, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন এবং সামরিক শাসনের অধীনে সামরিক সরকার, সামরিক সরকারের বেসামরিক চেহারায় পরিবর্তিত হওয়া সরকার, সামরিক ফরমানে বহুদলীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন, পুনঃসামরিক আইন, পুনঃবেসামরিককরণ, গণআন্দোলন, আন্দোলনকারী সংস্থাসমূহের অধিকাংশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল, পুনঃআন্দোলন, সংবিধান সংশোধন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল, নির্বাচন, সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই ‘রায়ের আলোকে’ সংবিধান সংশোধন, পুনরায় তত্ত্বাবধায়কের দাবীতে আন্দোলন এবং পুনরায় সংবিধান সংশোধনের দাবি––এতসব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সুযোগ এদেশের মানুষের হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বিরল।

ঙ. এইসব সরকার এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। কেবল গত ৪০ বছরের সংগ্রামের ধরন দেখলেই বোঝা যায় অহিংস-সহিংস, সশস্ত্র-নিরস্ত্র, নির্বাচনমুখী-নির্বাচনবিরোধী, অর্থাৎ আন্দোলন-সংগ্রামের যত রূপ থাকতে পারে তার প্রায় সব রূপ নিয়েই এদেশের মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এবং এইসব আন্দোলন-সংগ্রামে বেশ কয়েকবার তারা শাসকগোষ্ঠী ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে পরাস্তও করেছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই হতাশ হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, ব্যক্তি, দল বা পোশাকের পরিবর্তন হলেও যে ব্যবস্থা পরিবর্তনের আশায় তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন দিয়েছে, তা অর্জিত হয়নি।

চ. একথা দুঃখজনক হলেও সত্য গত ৪০-৪২ বছরের আন্দোলনে সংবিধানের মধ্যে ‘অগণতান্ত্রিকতার যে প্রাণভোমরাটি’ রয়েছে তাকে আমরা কখনও প্রশ্ন করিনি, চ্যালেঞ্জ করিনি, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াইনি, জনগণকে এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিইনি, বরং বিপরীতে ‘অগণতান্ত্রিকতার প্রাণভোমরা সমেত’ সংবিধানটিকেই ক্রমাগত উপরে তুলে ধরেছি, একে বহাল করার জন্য লড়াই করেছি এবং এই পথে নিজেদের আন্দোলনের ফসল দ্বারাই নিজেদেরকে ক্রমাগত পিষ্ট, চূর্ণ, দলিত এবং নির্যাতিত হতে দেখেছি।

ফলে যত বদল তত বেশী নিপীড়ন––এই অভিজ্ঞতায় বর্তমানে সকল কিছু থেকে জনগণ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ক্ষমতালোভীরা পরিবর্তন অসম্ভব ভেবে, ক্ষমতাসীনদের পদলেহীতে পরিণত হয়েছে। আর প্রতিবাদী তারুণ্য সকল ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যক্তিবাদী, ভোগবাদী, সফলতাবাদী, বা বড়জোর মানবতাবাদী বা পরিবেশবাদী প্রচেষ্টার মধ্যে উটপাখির মতো মুখ গোঁজার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছে না।

এদেশের শাসকশ্রেণীর লুটপাট আর নিপীড়ন ছাড়া অন্য কোনো সফলতা নেই, তাদের শাসন-শোষণকে অব্যাহত রাখার জন্য সফলতার কোনো প্রয়োজনও হয়নি। তারা শুধু অত্যন্ত চতুরতা ও সফলতার সাথে একের পর এক ‘নন-ইস্যুকে’ জনগণের ‘ইস্যু’ হিসেবে বিশ^াসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেতে পেরেছে এবং জনগণকে এমনসব তৎপরতার মধ্যে যুক্ত রাখতে পেরেছে যাতে সেসব তৎপরতার বিজয় হলেও জনগণের প্রকৃত বিজয় না হয়।

ছ. দেশ, জাতি, জনগণ, প্রকৃতি-পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজšে§র সুস্থতার জন্য এ অবস্থার দ্রুত অবসান প্রয়োজন। ব্যক্তিতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের বদলে প্রকৃতপক্ষেই জনগণের একটি রাষ্ট্র এবং সংবিধানের রূপরেখা কি হতে পারে এবং জনগণের পক্ষে তা কিভাবে অর্জন করা সম্ভব, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দেশে সেই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা কয়েকটি প্রস্তাবনা সকলের বিবেচনার জন্য খসড়া আকারে উপস্থাপন করছি, সকলের সম্মিলিত আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে এ প্রস্তাবটি পূর্ণতা পাবে বলে আমাদের একান্ত বিশ^াস।

প্রস্তাবনা-১

সংবিধান বর্ণিত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির সাথে ক্ষমতাকাঠামোকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে এমনভাবে তা পরিবর্তন/সংশোধন করতে হবে যাতে কোনো ‘এক ব্যক্তি’ নয়, ক্ষমতার মালিকানা জনগণের কাছে থাকে, এবং রাষ্ট্রের সকল শীর্ষ পদাধিকারীরা সংবিধান অনুযায়ী জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকে।

সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৭(১) বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।” লক্ষণীয়, বাক্যটি এখানে শেষ হয়নি, বাক্যের মধ্যে একটি ‘;’ চিহ্ন দিয়ে বলা হচ্ছে “এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ, কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে”। পুরো অনুচ্ছেদটি পাঠ করলেই বোঝা যায়, ক্ষমতার মালিকানা জনগণের হলেও প্রয়োগের মালিকানা নিয়ে কিছু নির্দেশনা আছে এবং তা এই সংবিধানেই দেয়া আছে। সংবিধানটি একটু ভালোভাবে দেখলে দেখা যাবে, মূলত চতুর্থ ভাগ থেকেই নির্দিষ্টভাবে এই ক্ষমতা, অর্থাৎ ‘জনগণের ক্ষমতা’––কে, কতটা, কিভাবে ভোগ করবে তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

তার মধ্যে প্রথম দিকেই অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)-এ বলা হচ্ছে যে ৫৬(৩) অনুযায়ী “কেবল… প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।” তার মানে হলো সাধারণভাবে সংবিধান পাঠ করলে যে মনে হয় রাষ্ট্রপতি কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর দণ্ড মওকুফ করে দিতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৪৯), তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১), তিনি প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগদান করেন (অনুচ্ছেদ ৬৪ ও ৯৫), কিংবা তিনি নির্বাচন কমিশন (অনুচ্ছেদ ১১৮), মহা হিসাব নিরীক্ষক (অনুচ্ছেদ ১২৭) বা কর্ম কমিশন প্রতিষ্ঠা ও নিয়োগের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ১৩৭) তার কিছুই কার্যত স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

অনুচ্ছেদ ৫৬(৩) রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের যে ক্ষমতা দিয়েছে তাও আসলে কথার মারপ্যাঁচ। এ ক্ষমতাও তার নয়, এ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের।

সংবিধান মূলত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত যাবতীয় ক্ষমতা এবং তার বাইরে যা কিছু নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে তার সবটুকু প্রয়োগের ক্ষমতাই তুলে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে (অনুচ্ছেদ ৫৫)। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ ও নিয়োগের অবসান, মন্ত্রিসভার আকার-আয়তন তার সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন [অনুচ্ছেদ ৫৬(১) ও অনুচ্ছেদ ৫৮(২)]। অনুচ্ছেদ ৫৫(৩) অনুযায়ী যদিও মন্ত্রিপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার কথা, কিন্তু অনুচ্ছেদ ৭০ দেখলেই বোঝা যায়, গোটা সংসদই দলীয় প্রধানের কাছে দায়বদ্ধ শুধু নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যখন যে ধরনের আইন প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করবেন জাতীয় সংসদ তখন সেই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য। অনুচ্ছেদ ৭০ অনুযায়ী কোনো সাংসদ যদি তার নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয় তবে তার সদস্য পদ বিলুপ্ত হবে। আইন প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে না থাকাকালীন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশও জারী করিয়ে নিতে পারেন। অনুচ্ছেদ ৭০ এবং ১৪২ মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে যে, যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন, আর তার দল যদি জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখাগরিষ্ঠতা লাভ করে তাহলে তিনি এমন অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী হবেন, যা পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী কল্পনাও করতে পারে না। এছাড়া যে সমস্ত পদ বা প্রতিষ্ঠানকে সাংবিধানিক পদ বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার সবই কার্যত প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন। সংবিধানের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ‘রুলস অব বিজনেস’ এবং সংসদীয় কার্যপ্রণালীবিধি মিলিয়ে পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা তার সবই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত।

এইভাবে এক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তুলে দেয়ার যে সংবিধান তাকেই গণতান্ত্রিক সংবিধান বিবেচনা করে এর পরিপূর্ণ প্রয়োগের জন্য এ দেশের জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক দল বলে পরিচিত দলসমূহ, ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে, এবং তা আজ অবধি জারী আছে।

প্রথমত এই বিভ্রম থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে। এক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার যে সংবিধান তার পরিপূর্ণ প্রয়োগ মানে নাগরিকদের আরো বেশী ক্ষমতাহীন করা।

অনুচ্ছেদ ৪৮(৩), ৭০, ১৪২ এবং অনুরূপ অপরাপর অনুচ্ছেদসমূহের তাই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সকল পদাধিকারীদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।

প্রস্তাবনা-২

বিদ্যমান সাধারণ নির্বাচন-ব্যবস্থার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন-ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছরে একবার নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তারিখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যবস্থায় সমগ্র দেশকে ৩০০টি সাধারণ আসনে ভাগ করে, প্রতি আসনের জন্য দলীয় বা নির্দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পান তাকে নির্বাচিত এবং এইভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের (অর্থাৎ ন্যূনতম ১৫১ জন সদস্য) সিদ্ধান্তে সরকার গঠিত হয়।

এই ব্যবস্থায় সাধারণভাবে/অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিপরীতে সংখ্যালগিষ্ঠ নাগরিকের প্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করার সুযোগ পায়। বিগত সকল সংসদের ভোটের হিসাব থেকে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচিত দলসমূহ ৩০% থেকে ৪০% ভোট পেয়েই সরকার গঠন করেছে। ৬০% থেকে ৭০% ভোটার রয়ে গেছে বিরোধী শিবিরে। এইভাবে নির্বাচিত সরকার শুরু থেকেই জনপ্রিয়তার বিচারে দুর্বল থাকার কারণে অধিক মাত্রায় প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং দলীয় বলপ্রয়োগের পথ ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাধ্য হয়।

এছাড়া প্রতি আসনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার বিধান থাকায় রাজনৈতিক দলসমূহ, দলের নিবেদিত এবং পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বদলে এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে বাধ্য হয়, যাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। ফলে নির্বাচনে অবৈধ অর্থ, অস্ত্র, পেশীশক্তি, আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, প্রশাসনকে প্রভাবিত করা অর্থাৎ নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে অন্তত এক ভোট বেশী পাবার জন্য যে ধরনের অপশক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব তার সকল পদ্ধতির সৃজনশীল প্রয়োগ হয়। ফলে কখনোই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হয় না এবং পরাজিত প্রার্থী ও দলসমূহ কখনোই নির্বাচনের ফলাফলকে সুষ্ঠু বলে মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নির্বাচন প্রশ্ন। এইভাবে অবৈধ অর্থ এবং ক্ষমতার মালিকদের অধিক হারে রাজনৈতিক দলসমূহে মনোনয়ন দেয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে লাভজনক ব্যবসার আওতায় ফেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অধিক মুনাফা তুলে নেয়ার ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করায় সরকার ও রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত গণবিরোধী হয়ে উঠেছে।

বর্তমান সংবিধানের আওতায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এবং ক্ষমতাসীন হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ামক এ পদ্ধতি এমন প্রাণঘাতী ও আকাশচুম্বী বিনিয়োগের মৃগয়ায় পরিণত হয়েছে যে তা প্রধান ২টি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং এই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিসমূহ নিজেদের দলের বাইরের সমমনা ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীসমূহকে ভিড়িয়ে এক ধরনের জোটবদ্ধতার চর্চা শুরু করেছে। দেশ ও জনগণ যে দ্বিদলীয় বা দ্বিজোটীয় বিষচক্রে বন্দী হয়ে পড়েছে, তার মূল শিকড় এই অগণতান্ত্রিক মাফিয়া নির্ভর নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রোথিত।

এই নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপরীতে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ক্রম গুরুত্বের ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করে নির্বাচনে অংশ নেবে এবং প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে প্রাপ্ত আসনের বিপরীতে প্রার্থী তালিকার ক্রমানুসারে তালিকাভুক্তরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবেন। এ পদ্ধতিতে আমাদের ৩০০ আসনের বিপরীতে কোনো দল যদি এক শতাংশ ভোট পায় তাহলে তারা সংসদে তিনটি আসন পেতে পারেন এবং এভাবে প্রাপ্ত ভোটের কমপক্ষে ৫১ শতাংশের যারা প্রতিনিধিত্ব করবেন তারাই সরকার গঠন করবে আর বাকীরা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। ফলে সরকার এবং বিরোধী দল মিলে তারাই সংসদে থাকবে যারা জনগণের প্রতিনিধি। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোট নষ্ট হওয়ার পদ্ধতি বিতাড়িত হবে। জনগণ যোগ্য প্রার্থী এবং দলের ভূমিকা বিবেচনা করে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। রাজনৈতিক দলসমূহ তখন অবৈধ অর্থ এবং পেশীশক্তির বিপরীতে ন্যায়নিষ্ঠ, প্রকৃত জনদরদী, দেশপ্রেমিক, নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মীদেরকে মনোনয়ন দেয়ার জন্যে খুঁজে বের করতে বাধ্য হবে।

প্রস্তাবনা-৩

গুম-খুন-নির্যাতনকারী, জনসম্পদ-জনঅধিকার ও জাতীয় সম্পদ লুটপাটকারীদের মদদ দেয়ার ঔপনিবেশিক আইন নয়, প্রবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা এবং জনগণের সম্পদের পাহারাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করার গণতান্ত্রিক আইন ও বিচার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় মিথ্যাচারগুলির অধিকাংশ আইন নিয়ে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। জনপ্রিয় মিথ্যচারের সাথে এদেশে ব্যাপক অধিকাংশের মধ্যে আইন সম্পর্কে রয়েছে চরম বিভ্রান্তি। এমনকি দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত এবং ‘সচেতন’ মানুষও আইন বলতে প্রথমত মারামারি-খুনোখুনি কিংবা জমিজিরাতের বিরোধের সাথে সম্পর্কিত ফৌজদারী বা দেওয়ানী আইনকে ‘আইন’ এবং এ সংক্রান্ত বিচার-আচারের ব্যবস্থাকেই মূলত ‘বিচার ব্যবস্থা’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রত্যেকটি বিষয়ই যে আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হয়, অত্যন্ত সুকৌশলে তা জনগণের কাছ থেকে আড়াল করা হয়। যারা ‘আইন প্রণয়নকারী’ তারাও যে আইনের দ্বারাই ক্ষমতাপ্রাপ্ত, কিংবা যারা আচার-বিচার করেন তাদের আচার-বিচারের ক্ষমতা ও পদ্ধতি কিংবা বিচারক হওয়া বা থাকা ইত্যাদিও যে আইনের দ্বারা নির্ধারিত; কিংবা যেসব পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, মিলিটারী দেশের আইন-শৃঙ্খলা, সীমানা আর সার্বভৌমত্বের পাহারাদার, তাদেরও যে আইন অনুযায়ীই এইসব করার কথা; রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় কি হবে, এর হিসাব-কিতাব কিভাবে রক্ষিত হবে; ব্যাংক-বীমা কিভাবে চলবে; দেশের জনগণের সম্পদ আর ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে কোনটা কারা রক্ষা করবে; কিভাবে দেশের সম্পদ বিদেশীদের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া যাবে; সরকার কোন পথে চলবে, আর সরকারী কর্মকর্তারাই-বা কিভাবে চলবে; দেশের শিক্ষা আর শিক্ষক, রোগী আর ডাক্তার কার কতটুকু দায়িত্ব বা অধিকার; ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা কিভাবে কাদের জন্য মওকুব করে দেয়া হবে; কিভাবে কম দামের দ্রব্যাদি বেশী দাম দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানী করা হবে; কিভাবে যত মূল্যেই যা কিছু কেনা হোক না কেন তার জন্য ক্রেতাদের রেয়াত (ঊীবসঢ়ঃরড়হ) দিয়ে দেয়া যাবে; কারা এইসব সুবিধা পাবে, কারা তা নির্ধারণ করবে––তার সবই যে নির্ধারিত হয় আইনের দ্বারা তা জনসাধারণকে বুঝতে দেওয়া হয় না।

আইনের ক্ষেত্রে আর একটি বড় বিভ্রম তৈরী করা হয় তার প্রয়োগ নিয়ে। সব সময় এটা প্রচার করা হয় যে, আমাদের আইন আছে এবং সব আইনই ভালো কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। এইভাবে ‘আইন প্রয়োগের যে আইন’ অর্থাৎ পদ্ধতিগত আইনের যে সমস্যা তাকে আড়াল করা হয় এবং ওইসব পদ্ধতিগত সমস্যা থেকে সুবিধাপ্রাপ্তরা যাতে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সদা-সর্বদা সুবিধা ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থাকে জারী রাখা হয়।

আইন সম্পর্কে এইসব ব্যবহারিক বিভ্রান্তি ছাড়া অনেক তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিও তৈরী করা হয়। এর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ন্যায়পরায়ণতা’ এবং বৈধতাকে গুলিয়ে ফেলার অপকৌশল। প্রায়শই ‘আইনের বিচার’ আর ‘ন্যায় বিচারকে’ সমার্থক হিসেবে এমনভাবে প্রচার করা হয়, যাতে যারা বিদ্যমান সমাজ এবং আইনের তীব্র সমালোচক তারাও এর থেকে মুক্ত হতে পারেন না।

আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেকটি আইনই হয় ব্রিটিশ, না হলে পাকিস্তানীদের দ্বারা প্রণীত। পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ প্রণীত সকল আইনকেই আমাদের সংবিধান ১৪৯ অনুচ্ছেদ মারফত বৈধতা দিয়েছে। বিদ্যমান ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ীই রাষ্ট্র যাকে ইচ্ছা তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিতে পারে, আর রাষ্ট্রপতি পারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও অব্যাহতি দিতে (উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী)। বিগত ৪০-৪২ বছরে এ দেশে যত আইন তৈরী হয়েছে তাও ব্রিটিশ বা পাকিস্তান অনুসৃত পদ্ধতিতেই হয়েছে।

ব্রিটিশদের প্রণীত আইনের দর্শন ছিল দমন এবং শাসনের দর্শন। ‘অপরাধকারীদের রাষ্ট্র দমন করবে’––সাধারণ মানুষের এই অভিপ্রায়কে কৌশলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য রাষ্ট্র ও আইনের বিরোধিতাকারীদেরকে প্রথমে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যাতে দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষাবলম্বনকারীদের যাতে রক্ষা করা যায়, সেইভাবেই প্রবলের পক্ষ হয়ে দুর্বলের বিরুদ্ধে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার দর্শনই হলো ঔপনিবেশিক আইনের দর্শন। সেই একই দর্শনের উপরই আমাদের রাষ্ট্র এবং আইন-ব্যবস্থা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

একটি স্বাধীন দেশের আইন, একটি পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে চলতে পারে না। এদেশের আইনের দর্শনের মূল কথা হবে, ‘রাষ্ট্রের মালিক হলো জনগণ’। আইন-কানুন, অফিস-আদালত, পুলিশ, মিলিটারী, আমলা-বিচারক প্রত্যেকেই জনগণের সেবক এবং জনগণ যাতে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা হলো জনগণ ও রাষ্ট্রের সেবকদের দায়িত্ব।

রাষ্ট্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো জনঅধিকার রক্ষা করা, রাষ্ট্রীয় (জনগণের সম্পদ) সম্পদ পাহারা দেয়া, সকল প্রকার ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসের হাত থেকে তা রক্ষা করা, যারা একে রক্ষা করার উদ্যোগ নেয় তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে তেমন প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা।

যারা বিপথগামী-অসহিষ্ণু এবং যারা জনগণের স্বাভাবিক জীবন-যাপন এবং জানমালের নিরাপত্তা নষ্ট করে তাদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে তারা তা থেকে বিরত হয়। এইসব গণবিরোধী পথ থেকে যাতে তারা সহজেই মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে ফেরত আসতে পারে তার ব্যবস্থা করাই হবে আইনের লক্ষ্য।

প্রবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করা এবং অন্যায়ের কবল থেকে ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করার নীতিকে আইন প্রণয়নের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

বিচারের ‘পণ্য-চরিত্র’ বদল করে ‘ন্যায়-ভিত্তিক’ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।

সাক্ষ্যপ্রমাণের বিদ্যমান ব্যবস্থা (সামাজিক সত্যের ক্ষেত্রে গাণিতিক সত্যের মানদণ্ড ব্যবহারের ব্যবস্থা) পরিবর্তন করে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সামাজিক সত্যকে সামাজিক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং অপরাধে অংশগ্রহণের অনুপাতে সাজার মেয়াদের ব্যবস্থা করা যায়। এভাবে আইনী ব্যবস্থার ধারাবাহিক এমন রূপান্তর ঘটানো যাতে মৃত্যুদণ্ডের মতো বর্বর ব্যবস্থা বাতিল করা যায়।

শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে সকল অপরাধের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধ তদন্তে পুলিশের বাইরে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

বিশেষত উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিদ্যমান দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা পদ্ধতির পরিবর্তে স্বাধীন, যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগের পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।

প্রস্তাবনা-৪

সংসদের কাছে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সকল শীর্ষ পদাধিকারীদের দায়বদ্ধ এবং সংসদকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদের ভূমিকা হলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা, নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে জনগণের পক্ষে আইন প্রণয়ন করা।

বাংলাদেশের সংসদ এই তিনটির কোনোটাই পালন করতে সক্ষম নয়। সংসদ সদস্যদের যদিও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা কিন্তু কার্যত তারা তার বদলে মনোনয়ন প্রদানকারী দলের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এবং এটা করতে তারা সাংবিধানিকভাবেই বাধ্য (অনুচ্ছেদ-৭০)।

নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার কোনো উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতাও সংসদের নেই। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিপরিষদ বা কেবিনেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী। সংসদ সদস্যরা যেহেতু পূর্বে উল্লেখিত ৭০ অনুচ্ছেদের জন্য প্রধানমন্ত্রী তথা দলীয় প্রধানের কাছে দায়বদ্ধ, তাই তাদের পক্ষে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ নাই। বরং সংসদ সদস্যরাই তাদের সদস্যপদ বহাল রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য। তাই রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সকল প্রকার জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। প্রধানমন্ত্রী যা কিছুই করুক না কেন তাকে অপসারণ (ইমপিচমেন্ট) করার কোনো ব্যবস্থা আক্ষরিকভাবেই অনুপস্থিত এই সংবিধানে।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের আইন ও বাজেট প্রণয়নের দায়িত্বও সংসদের। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮০ থেকে ৯২ পর্যন্ত এইসব বিধিবিধানের বিবরণ দেয়া আছে। আইন ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অকার্যকর বাধানিষেধের কথা বলা থাকলেও অর্থ বিষয়ক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা অকল্পনীয়ভাবে নিরঙ্কুশ। এটাকে আরেকটু ব্যাখা করা প্রয়োজন। সংবিধান রাষ্ট্রপতির জন্য কোনো ক্ষমতাই বরাদ্দ করেনি। সংসদ যদি কোনো বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে, রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করুক বা না করুক, ১৫ দিন পর তা আপনাতেই আইনে পরিণত হবে, যেন তিনি তা অনুমোদন করেছেন। এ হেন রাষ্ট্রপতিকে অনুচ্ছেদ ৮০(৩)-এ একটু ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে তিনি কোনো বিল বা তার অংশবিশেষ বা কোনো প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন, সংসদ তা বিবেচনা করতে পারে, নাও করতে পারে। রাষ্ট্রপতির এই যে বাধ্যবাধকতাহীন পুনর্বিবেচনার অনুরোধের ক্ষমতা তা কিন্তু ‘অর্থবিল’ ব্যতীত। অর্থাৎ সরকারের অর্থবিষয়ক সিদ্ধান্ত এতটাই নিরঙ্কুশ যে রাষ্ট্রপতির বাধ্যবাধকতাহীন পুনর্বিবেচনার প্রস্তাবও এ ক্ষেত্রে সহনীয় নয়। অনুচ্ছেদ ৮১-তে অর্থবিলের বিবরণ আছে, কিন্তু সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি আছে ৮১(৩) অনুচ্ছেদে, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে সম্মতির জন্য পাঠানোর সময়ে প্রত্যেকটি অর্থবিলে স্পীকারের একটি সার্টিফিকেট থাকবে যে এটি অর্থবিল এবং স্পীকারের এই স্বাক্ষর চূড়ান্ত এবং এ বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। গোটা সংবিধানে অন্য কোথাও এমন বাধানিষেধ এবং এমন ভাষা আর ব্যবহার করা হয়নি। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় নির্ধারিত হয় যার মাধ্যমে সেই অর্থবিল, লুটেরা শাসক-শোষকদের লুটপাটকে বৈধভাবে অব্যাহত রাখার মূলসূত্রটি যেখানে লুক্কায়িত, সংবিধান সেই অংশটুকুকে স্বাভাবিকভাবেই সবচাইতে বেশী সুরক্ষা দিয়েছে। সামাজিক বা রাজনৈতিক গণতন্ত্র, যদি কোথাও কিছু পরিমাণে বরাদ্দ করা কালেভদ্রে সমীচীন মনে হয়, কিছুটা না হয় করা যাবে কিন্তু ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ অসম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত একটি সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলে তার বাস্তব অর্থ দাঁড়ায়, প্রধানমন্ত্রী যেরূপ ইচ্ছা পোষণ করেন সংসদ তেমন আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য। ফলে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীও যে ধরনের আইন প্রণয়ন করেনি, বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে তার চাইতেও অনেক নৃশংস, নির্যাতনমূলক এবং গণবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে। সংসদের কার্যক্রমের উপরে যারা গবেষণা পরিচালনা করেন তারা তাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন গত ২০১৪ সালের জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ২টি বিল পাস করতে মন্ত্রীদের বক্তৃতার বাইরে সংসদ সময় নিয়েছে মাত্র ৬ মিনিট। কোনো সংসদ সদস্যই বিলের উপর কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ, প্রশ্ন উত্থাপন, কোনো ধরনের কোনো সংশোধনী কিংবা কোনো প্রস্তাব উত্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেনি। ফলে প্রকৃত উন্নয়নের বদলে দলীয় অনুগতদের জন্য অবাধ ও নিরঙ্কুশ লুটপাট নিশ্চিত করা যায় এমন প্রকল্প প্রণয়ন, জনগণের সম্পদ বিভিন্ন কৌশলে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও পাচারকারীচক্রের হাতে তুলে দেয়ার বাজেট পাশ, কিংবা দেশী-বিদেশী লুটেরাদের হাতে দেশের সম্পদ, প্রকৃতি তথা জাতীয় স্বার্থ তুলে দিতে আইন প্রণয়নে ন্যূনতম বাধার মুখেও পড়তে হয় না এদেশের ক্ষমতাসীন সরকারসমূহের।

সম্ভবত সংসদ সদস্যদেরকে ক্ষমতাহীন করে রাখার উপঢৌকন হিসেবেই, আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক দায়িত্বের বদলে, সরকারের বিভিন্ন স্তরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অংশীদার করা হয় তাদেরকে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান সংসদের সদস্য হিসেবে যারা আছেন তাদের ৬৯% ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ আছেন মাত্র ৬ শতাংশ।

সংসদের অপর একটি বড় দিক হলো এর অগণতান্ত্রিক কার্যপ্রণালী বিধি। সাধারণভাবে আমাদের আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতদের অনেকেই এ রকম একটি ধারণা প্রচার করে থাকেন যে আমাদের বিরোধীদলীয় সাংসদরা সংসদে উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ না নেয়ায় সংসদ কার্যকর হয় না। উনারা কার্যকর সংসদ বলতে আদতে কি বোঝাতে চান তা স্পষ্ট নয়। তবে বিদ্যমান কার্যপ্রণালী বিধির আওতায় সংসদে আলোচনা করতে চাইলেই অলোচনা করা যায় বলে যারা বিশ^াস করেন তারা হয় কার্যপ্রণালী বিধি পাঠ করেননি অথবা পাঠ করলেও অনুধাবন করেননি।

যারা বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে সংসদকে সার্বভৌম করতে চায়, কিংবা সংসদকে ক্ষমতা-চর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবী তোলে, যারা সাংবিধানিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ সংসদের হাতে আনতে চায়, তারা জেনে বা না জেনে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকেই আরো সম্প্রসারিত করতে চায় বা প্রকৃতপক্ষে ‘নন-ইস্যু’কে ‘ ইস্যু’ করে জনগণকে আরো কিছুদিন বিভ্রান্ত করতে চায়। সাধারণভাবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে সারা দুনিয়ায় এবং আমদের দেশের পণ্ডিত তথা বিদ্বৎসমাজের মধ্যে যেসব ধারণা কাজ করে বাংলাদেশের সংসদ সম্পূর্ণত এই ধারণার বিপরীত। ফলে সংসদকে মুক্ত না করে সংসদের হাতে যত ক্ষমতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকে তা ততই সম্প্রসারিত করবে।

সংসদকে এই ক্ষমতাচক্র থেকে বের করে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল, নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রক এবং জনগণের পক্ষের আইন ও অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদাধিকারীদেরকে সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। আর সংসদকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হবে।

রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের বিধান জারী করার আগে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক মতামত গ্রহণের জন্য স্বাধীন আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাজেটে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিকে গণতান্ত্রিক করতে হবে। নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগণের দ্বারা সমর্থিত কোনো প্রস্তাব/বিলকে সংসদে আলোচনায় নেয়ার ব্যবস্থা-সম্বলিত বিধান করতে হবে। সংসদীয় কমিটিসমূহের প্রধানের পদ বিরোধীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। মহা হিসাব নিরীক্ষক, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদিসহ সাংবিধানিক পদসমূহে নিয়োগ অনুমোদনের ক্ষমতা সংসদীয় কমিটির কাছে ন্যস্ত করতে হবে। সংসদকে জনগণের ক্ষমতা চর্চা এবং সকল রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

প্রস্তাবনা-৫

রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনমান রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

আইনের পরিভাষায় ‘দুর্নীতি’ বলতে যা বোঝায় ভারতবর্ষে তার অনুপ্রবেশ এবং লালনপালন ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে। লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লুটপাট ও দুর্নীতি এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যাতে ১৭৬৯-১৭৭০ সালে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে/ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পর্যন্ত এর তদন্ত করতে বাধ্য হয়। কোম্পানীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য জারী হয় ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট।

সহায়-সম্পদহীন বখাটে বেকার ক্লাইভ, যে ভারতে এসেছিল অসহায় অবস্থায়, সে (পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে লর্ড উপাধি কিনে নেয়) ভারত থেকে প্রথমবার ইংল্যাণ্ড যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় তৎকালীন দুই লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউণ্ড সমমূল্যের সম্পদ। এই সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে শুনানী চলছিল তখন সে যে ভাষায় তার লুটপাটের সপক্ষে বক্তব্য রেখেছিল তা পাঠ করলে আমাদের বর্তমান লুটেরাদের লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ আর অবশিষ্ট থাকবে না। অবশ্য ঐ সময়ে খুব দ্রুত ভারতীয় ভাষার ‘লুট’ শব্দটি ইংল্যাণ্ডে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে একটি দুর্নীতিহীন সমাজ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে আমাদের সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত সম্পদ আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।” রাষ্ট্রের এই মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সংবিধানের ৮ম ভাগ, যেখানে ‘মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক’-এর নিয়োগ, কার্যপরিধি, দায়িত্ব-কর্তব্য ইত্যাদির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি এই পদে নিয়োগ দেবেন বলা হলেও অনুচ্ছেদ ৫৭(৩) অনুযায়ী এ নিয়োগের মূল কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর। তিনি তার পছন্দসই লোককে এ পদে মনোনয়ন দেয়ার একচ্ছত্র অধিকারী। হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির কথা বলা হলেও এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির বদলে প্রকৃত সন্তুষ্টি প্রধানমন্ত্রীরই। সংবিধান অনুযায়ী যদিও মহা হিসাব নিরীক্ষক পদটি সাংবিধানিক পদ বিধায় স্বাধীন কিন্তু কার্যত ১৯৭৪ সালের ‘কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল এডিশনাল ফাংশনস অ্যাক্ট’ নামক আইনটিকে ১৯৮৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে মহা হিসাব নিরীক্ষককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত করা হয়েছে। এছাড়া সাংবিধানিকভাবে হিসাব নিরীক্ষকের অবস্থান বিচারপতিদের সমপর্যায়ের হলেও ‘রুলস অব বিজনেস’ অনুযায়ী তার অবস্থান বিচারপতিদের ৬ ধাপ নীচে। প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি সাপেক্ষে আর বিচারপতিদের ৬ ধাপ নীচে থেকে নির্বাহী বিভাগ এবং আদালতের হিসাব পর্যালোচনা করে তার রিপোর্ট প্রদান কতটা সম্ভব তা বলাই বাহল্য।

এছাড়া মহা হিসাব রক্ষকের অফিস চলে ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ আইনানুযায়ী। আজ পর্যন্ত কোনো ‘নিরীক্ষা আইন’ তৈরী হয়নি। ফলে মহা হিসাব নিরীক্ষকদের ক্ষমতা শুধু রিপোর্ট প্রদান পর্যন্ত। কিছুতেই কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের নিজেদের জন্যও কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই, ফলে প্রত্যেকে তার কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন। একই অবস্থা সংসদীয় কমিটিরও, তারাও অনিয়ম পেলে শুধু পরামর্শ দেয়ার অধিকারী, ব্যবস্থা নেয়ার নয়। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৯৮০টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিবেচনার জন্য গৃহীত হলেও (যা প্রকৃত অনিয়মের সামান্য মাত্র) সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে মাত্র ৩৩২টির উপর।

টিআইবি পরিচালিত সমীক্ষায় উঠে এসেছে মহা হিসাব নিরীক্ষক অফিসে চাকরী, পোষ্টিং, মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষা পরিচালনা, অভিযোগ থেকে অব্যাহতি––প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ঘুষ ও অনিয়ম একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে জনবল ঘাটতি, বাজেট ঘাটতি, জীবনধারণের উপয়োগী বেতন কাঠামোর অভাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণের অভাব, সর্বোপরি যুগোপযোগী আইনের অভাব এবং ঊর্ধ্বতনদের রোষানলে পড়ার ভীতি––সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে প্রতিনিয়ত কার্যকর আছে।

জনগণের অর্থ আত্মসাৎ এবং সেই আত্মসাতের প্রকৃত চিত্র যাতে দেশবাসী জানতে না পারে সেজন্য যে ধরনের দুর্বল, দলীয় অনুগত এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা প্রয়োজন তেমনভাবে যাতে পরিচালনা করা যায়, তার যাবতীয় আইনী কাঠামো অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই তৈরী ও রক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যেখানে কোনো প্রকৃত অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং সাজা দেয়া প্রায় অসম্ভব, সেখানে সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী যারা সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার এবং আইনগত বিশেষ দায়মুক্তি ভোগকারী, বিদ্যমান আইনে তাদের অপরাধের বিচার হবে, ব্রিটিশরা আর যা-ই করুক তেমন করে আইন তৈরী করেননি। অমাদের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী, জজ-ব্যারিষ্টার-উকিল-মোক্তাররা যে কথায় কথায় কারণে-অকারণে ব্রিটিশ-আইন ব্যবস্থার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তার একটি বড় কারণ এ ব্যবস্থাটি বিনা ব্যতিক্রমে তাদের সেবা দিয়ে গেছে, এবং যাচ্ছে।

‘স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন’ বলে যা তৈরী করা হয়েছে তা যে প্রকৃত দুর্নীতিগ্রস্তদের দুর্নীতিমুক্তির ছাড়পত্র দেয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার আর একটি বৈধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তারও আসল ভিত্তি রয়েছে এর গঠন এবং পরিচালনার আইনের মধ্যেই।

এদেশের পুলিশ, জনপ্রশাসনে জড়িত কর্মকতা ও কর্মচারীবৃন্দ, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, সরকারী সংস্থা, সরকারের মালিকানা আছে এমন ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, পরিবহন-যোগাযোগ বা নির্মাণ প্রকৌশল অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রায় সকল স্তরের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং ক্রমশ তা বৃদ্ধি পাওয়ার বিবরণ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এমনকি খোদ সরকারের দায়িত্বশীল কোনো কোনো মহল কর্তৃক স্বীকৃত হলেও তা নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত আলোচনা বা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ ।

আমাদের দেশের অন্যান্য কর্মকর্তা বা কর্মচারী তো দূরের কথা, মহা হিসাব নিরীক্ষক অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গবেষণাপত্রসহ ‘টিআইবি’র মতো প্রতিষ্ঠান অভিযোগ উত্থাপন করার পরও তার কোনো সুরাহা হয়নি।

আমাদের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ, মহা হিসাব নিরীক্ষক বা তার অফিস এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ও তাদের কর্মকর্তাবৃন্দ কিংবা আমাদের সেবা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ সংসদ সদস্য বা মাননীয় মন্ত্রীদের কারোরই তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব বিবরণী এবং বছরওয়ারী আয়ের বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

আমরা বিশ্বাস করি এই সব দুর্নীতি বন্ধে প্রথমত বিদ্যমান আইনের যে সমস্ত ত্রুটি উল্লেখ করা হয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমে প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার জড়িত কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাবে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে, উপরোক্ত তিনটি বিভাগের কর্মকতা- কর্মচারীরাই জনগণকে সাথে নিয়ে অপরাপর দুর্নীতিবাজ অপরাধীদের প্রতিরোধ করার পথ অবিষ্কার করতে সক্ষম হবে।

প্রস্তাবনা-৬

স্থানীয় শাসন নয়, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সংবিধানের ৫৯ এবং ৬০ নং অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের একটি ধারণা দেয়া আছে। এই ধারণার বিপরীতে স্থানীয় সরকারের ধারণা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে জাতীয় ও স্থানীয় দুই স্তরে বিভক্ত করে জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য, সীমারেখা ইত্যাদির স্পষ্ট রূপরেখা গড়ে তুলতে হবে।

স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংসদকে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া আছে। কিন্তু ‘সংসদ’ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তো দূরের কথা, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা যাতে গড়ে না ওঠে তার জন্য বিভিন্ন প্রকার আইনকানুন প্রণয়ন করেছে এবং তা বহাল রেখেছে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্থানীয় শাসনের বদলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করা এবং স্থানীয় সরকারকে জনগণের কাছে সরাসরি জবাবদিহিতে বাধ্য করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ‘রি-কল’-এর ব্যবস্থা করতে হবে।

স্থানীয় সরকারের কাছে স্থানীয় জনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় করারোপ ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। উপরোক্ত দায়িত্বের বাইরে স্থানীয় বিরোধ মীমাংসার আইনী ও বিচারিক দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের উপর ন্যস্ত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণসহ স্থানীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনের আইনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় সরকারের বাজেট প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের তদারকি ও অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

প্রশাসনিক এককাংশের প্রতিটি পর্যায়কেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।

উপসংহারের বদলে: উপরে যে কয়েকটি বিয়য়ে আলোকপাত করার চেষ্টা হয়েছে, এদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবীতে একটি অর্থবহ গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি নিয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে আলোচনা ও পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন–– প্রাথমিকভাবে এইটুকু যারা মনে করেন তাদের সাথে আরো অলোচনার জন্য যোগাযোগ গড়ে তোলা যেতে পারে। একই সাথে, কোন পথে বা কি পদ্ধতিতে এই আন্দোলনে ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়েও আলোচনার সূত্রপাত করা প্রয়োজন।