সম্পাদকীয়
এ ভূখণ্ডের মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক লড়াইয়ের ইতিহাস এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায়, তার মধ্যে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ অতুলনীয়, অনন্য। ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় আমাদের একটি স্বাধীন দেশ ও একটি নতুন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে। বিজয় অর্জনের মাত্র এক বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে কার্যকর হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান। মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে যে-যুদ্ধ, সে-যুদ্ধের মাত্র ১ বছরের মাথায় একটি নতুন সংবিধান কার্যকর করা ছিল নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়। বাংলাদেশ বিস্ময়েরই দেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি ঘোষণাপত্র ছিল। সে-ঘোষণায় ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক’ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যাঁরা তৈরী করেছিলেন আর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব যাঁদের উপর ন্যাস্ত হয়েছিল তাঁদের আকাক্সক্ষার মধ্যে পার্থক্য ছিল। তা সত্ত্বেও সংবিধানের যে অংশে সাধারণভাবে রাষ্ট্রের ধরণ-ধারণ, চারিত্র্য, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বিবরণ থাকে, সে-অংশে অনেক সুন্দর ভাষায়, অনেক অধিকার ও অকাক্সক্ষার বিবরণ দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ভূমিকায়, ১ম, ২য় এবং ৩য় অধ্যায়ে সেসব অধিকার ও আকাক্সক্ষার বিবরণ যেভাবে দেয়া হয়েছে, সেগুলো কার্যকর করার অংশ অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা-কাঠামোর অংশ (৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) যদি প্রথম অংশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা যেতো, তাহলে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ বাস্তবায়নের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে পারতো। আমাদের দুর্ভাগ্য, তা করা হয়নি।
উপনিবেশিক শিক্ষায় ও মানসিকতায় আচ্ছন্ন কতিপয় জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি এ সংবিধানে উকালতি প্যাঁচ কষে জনগণের ক্ষমতাকে এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত করার মোসাহেবী পায়তারায় সফল হয়েছে। ফলে, দৃশ্যত সংবিধানটিকে গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণমুখী ও প্রগতিশীল মনে হলেও কার্যত তা একব্যক্তি-কেন্দ্রিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এবং উপনিবেশিক শাসনতন্ত্রেই পর্যবসিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাষ্ট্র-কাঠামোটি আমরা দেখতে পাই তা ব্রিটিশদের গড়া। বলাবাহুল্য, ব্রিটিশেরা এদেশ দখল করার পর তাদের লুণ্ঠন, শোষণ এবং শাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্যই এ রাষ্টকাঠামোটি গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, বিচার-আচার, আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, নির্বাচন, সংসদ, রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় তথা বজেট, সর্বোপরি রাষ্ট্রনৈতিক- ব্যবস্থাকে তারা এমনভাবে বিন্যস্ত করেছিল যাতে তা সর্বতোভাবে শাসকশ্রেণী এবং তাদের দালালদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
এ দেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের মেনে নেয়নি। জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি দেশের জন্ম দিয়ে তাদেরই হাতে-গড়া দুটি রাজনেতিক দল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছে দুদেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যায়।
যদিও পাকিস্তান অর্জন করার মূল শক্তি-ভিত ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলা, তথা এই ভূখণ্ডের নাগরিকগণ, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন-প্রক্রিয়ায় তাদের তেমন কোনো স্থান ছিল না। শোষণ, লুণ্ঠন এবং নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় যে বাঙ্গালীরা ব্রিটিশদের এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য লড়াই করেছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা উপলব্ধি করলো পুরনো সবকিছুই আরো শক্তভাবে চেপে বসেছে তাদের উপর নতুনভাবে––স্বাধীনতা, পাকিস্তান ও ইসলামের নামে।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রায় পুরো সময়টা জুড়ে এদেশের মানুষ তাই লড়াই করেছে। যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব লড়াই হয়েছে, আশা করা গিয়েছিল সেইসব অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পর ‘স্বাধীন দেশে’ কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, ব্রিটিশের সকল আইন-কানুন যেমন পাকিস্তান বহাল রেখেছিল, তেমনি বাংলাদেশও পরিচালিত হচ্ছে পরিত্যাক্ত সেইসব ব্রিটিশ আইন-কানুন দিয়ে। ফলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যেমন লুণ্ঠন, নির্যাতন, দমন আর পাচার করেছে অবাধে, যা অব্যাহত ছিল পাকিস্তানী শাসনকালে, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও একই লুণ্ঠন আর পাচার, দমন আর নির্যাতন বহাল আছে, মাত্রায় বরং অনেকক্ষেত্রে বেড়ে চলেছে।
৭১ সালে এদেশের মানুষ যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ, একটি নতুন রাষ্ট্র আর জাতি হিসেবে বাঙালীদের বিশ্বের দরবারে একটা পরিচিতি এনে দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও আমরা পরবর্তী প্রজন্ম স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদ জীবন দিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায় বিচার’ ভিত্তিক যে রাষ্ট্রব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠার দায় আমাদের দিয়ে গেছে আমরা তা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এমন একটি সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের সংবিধান, আইন, আদালত, পুলিশ, মিলিটারী, প্রশাসন, সংসদ, বাজেট, নির্বাচন, তথা গোটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা-কাঠামোর কি কি পরিবর্তন করতে হবে––
বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আমরা সেই আলোচনা শুরুই করতে পারিনি–– তেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো অনেক দূরের কথা।
গোটা পৃথিবীকে উপনিবেশ করে রাখার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের প্রধান তিনটি হাতিয়ার ছিল শিক্ষাব্যবস্থা, আইন এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি। যেসব দেশ তারা দখল করেছিল প্রথমেই তাদের সবার বুনিয়াদী শিক্ষাকে ভেঙে নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেছিল। ব্রিটিশ শিক্ষায় যারা পাঠ নিয়েছে তারা প্রথমে নিজদেশের যা কিছু মৌলিক তার সম্পর্কে একটা হীনম্মন্যতায় ভুগেছে এবং ব্রিটিশদের অনুকরণ করার মধ্যেই নিজেদের সভ্য এবং আধুনিক হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে। নিজ দেশের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্বেষ পোষণ করা––অতি আধুনিকতা প্রকাশের উপায় হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর বাইরে ছিল তথাকথিত আইনের শাসন। সবাই এটা মুখস্থ করেছে যে, ‘আইনের চোখে সবাই সমান’, ‘আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নেবে না’ ইত্যাদি। আইনের চোখে সমতার মজার তত্ত্ব আছে––‘ইকুয়ালিটি এমঙ্গষ্ট দ্যা ইকুয়াল’ অর্থাৎ সমতা সমানদের মধ্যে। পুলিশ আর মানুষতো এক না, তাই পুলিশের জন্য যে আইন মানুষের জন্য তো সেই একই আইন হতে পারে না! এসব নীতির আড়ালে তারা এমন সব আইন প্রণয়ন করেছে, আর আইন সম্পর্কে এমন শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে যা শাসক, শাসন, লুটপাট ইত্যাদিকে আইনের ঊর্দ্ধে, প্রশ্নের ঊর্দ্ধে স্থাপন করেছে। আর এইসব ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে জারী রাখার জন্য এমন একটি পলিটিক্যাল (রাষ্ট্রনৈতিক) ব্যবস্থা তারা ক্রমে গড়ে তুলেছে যা দৃশ্যত জনগণের স্বার্থঘেষা, কিন্তু কার্যত লুণ্ঠক-নির্যাতক আর পাচারকারীদের রক্ষাকবচ। বিষয়গুলি এ পরিসরে স্পষ্ট করা সম্ভব নয়; কিন্তু আমাদের যদি একটি জনস্বার্থঘেষা, মানবিক, জাতীয়স্বার্থ রক্ষাকারী কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়, তাহলে প্রাথমিক এই বিষয়গুলি সম্পর্কে স্পষ্ট হওয়ার কোনো বিকল্প নাই।
এবারের বিজয় দিবস থেকে আমরা সেই অতি প্রয়োজনীয় কাজটির প্রতি সাধ্যানুসারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ প্রকাশনাটি শুরু করেছি।
রাষ্ট্র কোনো স্থির, অপরিবর্তনীয়, প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান নয়। এক-এক দেশে, এক-এক কালে, সে-দেশের সামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী ক্ষমতাবানেরা রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে; সময়ে সময়ে ভেঙেছে, পরিবর্তন করেছে, আবার নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। বর্তমান বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষও এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সংখ্যায় প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচরিত্র বিষয়ক দুটি লেখা সংকলিত হয়েছে। এই লেখা দুটি পূর্বপ্রকাশিত। আমরা এ দুটি লেখা পুনর্মদ্রণ করতে আগ্রহী হয়েছি এ কারণে যে, এখানে প্রতিষ্ঠিত চিন্তার বাইরে থেকে প্রাচীন ভারত এবং প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোকে বোঝবার ও আবিষ্কারের চেষ্টা আছে।
রাষ্ট্র-বিষয়ক আলোচনা অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের চিন্তার জগৎ এবং সক্রিয় রাজনীতির একটা বড়ো স্থানই দখল করে রেখেছিল। তবে এসব ধারার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ধারা হিসেবে সক্রিয় ছিল এনার্কিষ্ট আর মার্ক্সিষ্টরা। মার্ক্সবাদীদের রাষ্ট্রচিন্তা এ অঞ্চলের বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তকদের কারণে অনেকটাই পরিচিত। এঙ্গেলস-এর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ কিংবা মার্ক্সের ‘গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা’ বা ‘এ ক্রিটিক অব দ্যা হেগেল’স ফিলোসফি অন রাইট’––এসব লেখা মার্ক্সবাদীদের অবশ্য পাঠ্যের তালিকাভুক্ত। তবে সেই তুলনায় এনার্কিষ্টদের লেখা এ অঞ্চলে পড়া হয়েছে খুবই কম। এসব বিবেচনায় রেখে প্রখ্যাত এনার্কিষ্ট এমা গোল্ডম্যানের একটি বহুল প্রচারিত লেখার অনুবাদ করা হলো। অন্যদিকে মার্ক্সের রাষ্ট্রচিন্তার উপর লেখা এখনো অনুবাদ হয়নি––এমনটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেই দুষ্কর কাজটি করেছেন মার্ক্সের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্রের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে––এমন একটি লেখাও এ সংখ্যায় স্থান পেয়েছে।
‘রাষ্ট্রচিন্তা’র এ সংখ্যাটি হয়তো মানসম্মত করা গেল না। কিন্তু আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ, প্রয়োজনীয় লেখা পাওয়া গেলে প্রতি তিনমাসে আমরা এ প্রকাশনা অব্যাহত রাখবো। আমরা আশাবাদী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ লেখকের লেখা আমরা পাবো। রাষ্ট্রপ্রশ্ন এখন এদেশের মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন। আর কে না জানে, তারুণ্যই সকল সীমাবদ্ধতা আর বন্ধ্যাত্যকে অতিক্রম করার পথ বের করে।
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
বিজয় দিবস ২০১৬, ঢাকা
সম্পাদনা পর্যদের পক্ষে
হাসনাত কাইয়ূম