সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন

সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন

শামসুজ্জোহা মানিক

১. সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের চরিত্র

আজ যখন আমরা রাষ্ট্র-শাসনের একটা আদর্শ রূপ সন্ধান করি তখন আমি পাশ্চাত্যের অনুকরণের পরিবর্তে যে দিকে দৃষ্টি দিতে বেশী আগ্রহ বোধ করি সেটা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা। যত দিন যাচ্ছে যত চিন্তা করছি তত আমার কাছে সিন্ধু সভ্যতার নম্রতা ও মানবিকতা এবং সেই সঙ্গে তার গণতান্ত্রিকতার দিক অধিকতর জোরালো হয়ে দেখা দিচ্ছে। কেন, একটু ব্যাখ্যা করলেই বোধ হয় আমার চিন্তা স্পষ্ট করতে পারব।

তবে সেই আলোচনায় যাবার আগে বলি, আমাদের উপমহাদেশ হিসাবে ভারতবর্ষের সমাজ বা সমাজসমূহের এমন কিছু অভিন্ন সমস্যা, বৈশিষ্ট্য বা ধরন ও গতিপ্রকৃতি আছে যেগুলির উৎস সন্ধানে সিন্ধু সভ্যতায় উপস্থিত হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়া ও মিসরের সমসাময়িক এই সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার নগর হিসাবে প্রথম হরপ্পা আবিষ্কৃত হবার কারণে সিন্ধু সভ্যতা হরপ্পান সভ্যতা হিসাবেও কথিত হয়। প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে সিন্ধুর নগর সভ্যতার যাত্রা শুরু। রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী চার হাজার ছয় শত বছর পূর্বে। মিসর ও মেসোপটেমিয়ার প্রত্যেকটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আয়তন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতা আজ অবধি নানাভাবে বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষাকে প্রভাবিত করে রেখেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রভাব অনেক গভীর  এবং প্রবল।

সিন্ধু সভ্যতা যখন অনাবিষ্কৃত ছিল তখন ভারতবর্ষের দূর অতীত ছিল নানান অতিকথা, কল্পনা আর রহস্যের জালে ঢাকা। কিন্তু বিগত শতাব্দীর বিশের দশকে সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের পর থেকে ক্রমে ভারতবর্ষের দূর অতীতের অনেক অজানা রহস্য কিছু করে হলেও উšে§াচিত হতে শুরু করে। জানবার এখনও অনেক বাকী আছে, বুঝবারও। তা সত্ত্বেও প্রায় শতাব্দী কালের উৎখননের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করা যায়। এটা ঠিক যে, যে পরিমাণে নগর ও বসতি আবিষ্কার হয়েছে সে তুলনায় খননকার্য হয়েছে খুব সামান্য। প্রায় দেড় হাজার বসতির সন্ধান পাওয়া গেলেও উৎখনন করা নগর ও বসতিসমূহের সংখ্যা একশতেরও নীচে। দশ থেকে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটারব্যাপী (কোনো কোনো হিসাবে ১.২৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বা সাড়ে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার) বিস্তৃত একটা সভ্যতা সম্পর্কে ব্যাপক উৎখনন ছাড়া ধারণা করাও কঠিন। সর্বোপরি সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার আজ অবধি না হওয়ায় সভ্যতার বহু কিছুই এখনও কল্পনা নির্ভর হয়ে আছে।

তা সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু প্রতœতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছে তা থেকে তার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগে¦দ আমার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক একটি দলিল হিসাবে দেখা দিয়েছে। কারণ ঋগে¦দ পাঠ করে আমি তাকে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয় এবং ধ্বংসের সময়ে সংগঠিত জনপ্রিয় একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের দলিল হিসাবে চিনতে পেরেছি। সুতরাং আমার বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত বা কথিত ভাষায় ঋগে¦দ রচিত হয়েছিল। তা না হলে এটা জনবোধ্য এবং সেহেতু জনগ্রাহ্য হতো না। আবার এটাই যুক্তিযুক্ত যে, যে ভাষায় ঋগে¦দ রচিত হয়েছিল জনসমাজের ভিতর থেকে উঠে আসা সভ্যতা হিসাবে সেটাই ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা।

সিন্ধু সভ্যতায় বৈদিক আন্দোলনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি জনপ্রিয় ধর্মসংস্কার হয়, যার দলিল হচ্ছে আমাদের নিকট সাধারণভাবে পারসিক হিসাবে পরিচিত ধর্মসম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’। ঋগে¦দ যে ভাষায় লিখিত সেই একই ভাষায় এটিও লিখিত হয়। তবে ইরানে পারসিক ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়ায় মূল আবেস্তার বৃহত্তর অংশ যেমন হারিয়ে গেছে তেমন সামাজিক উলটপালটের প্রক্রিয়ায় ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার মূল ভাষাও অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। তবু পণ্ডিতদের আবেস্তার ভাষাকে বৈদিক ভাষার সমগোত্রীয় হিসাবে চিনতে কষ্ট হয় না। যা-ই হোক, বৈদিক ও আবেস্তান আন্দোলন, ধর্ম এবং ভাষার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্কের বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। এ নিয়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা আছে।১

উপরোক্ত গ্রন্থের অনেক বিষয়বস্তুর সঙ্গে যোগসূত্র থাকলেও এই প্রবন্ধে আমার আলোচনার বিষয় অনেকখানি ভিন্ন। এখানে আমি খুব সংক্ষেপে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের দর্শন ও স্বরূপ সন্ধানের চেষ্টা করছি।

সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ সন্ধানে ঋগে¦দ যতটা না সহায়ক তার চেয়ে অনেক বেশী সহায়ক সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি। ঋগে¦দের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ধর্মসংস্কার ও যুদ্ধের উপর। সুতরাং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি কম পড়েছে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পড়ে নাই। এ ক্ষেত্রে বরং সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতত্ত্ব আমাদের জন্য অনেক বেশী সহায়ক হয়। নগর পরিকল্পনা, বসতির বিন্যাস, বিরাট কোনো প্রাসাদের অনুপস্থিতি, বাড়িঘর ও তৈজসপত্রের বণ্টনের ধরন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে নরকঙ্কালে পুষ্টিমানের সমতার উপস্থিতি ইত্যাদি থেকে সিন্ধু সভ্যতার একই সঙ্গে সমৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। তাই এই সভ্যতা যে প্রাচীন অন্য সমস্ত সভ্যতার মতো প্রধানত বলপ্রয়োগ ও দাস প্রথানির্ভর ছিল না সে-সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত টানা যায়। বলপ্রয়োগ কিংবা দাসত্ব একেবারে ছিল না সেটা ভাবা ভুল হতে পারে। কিছু গৌণ রূপে দাসপ্রথাও হয়তো ছিল। তবে বিশালায়তনে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতায় যে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গৌণ সে কথা প্রতœতাত্ত্বিক সকল নিদর্শন থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ ব্যাপারে প্রায় সকল পণ্ডিতই একমত।

অস্ত্রশস্ত্রের নিম্নমান এবং স্বল্পতা থেকে কোনো কোনো পণ্ডিত এমনও মনে করেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল না। কারণ তাদের ধারণা যে সেখানে স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। আর সেনাবাহিনী না থাকলে কীভাবে রাষ্ট্র থাকতে পারে তা তাদের ধারণাবহির্ভূত। এই অবস্থায় সভ্যতা গঠন ও পরিচালনার সম্ভাব্য ধরন সম্পর্কে তাদের আলোচনাও আছে।২

আমার মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র গঠন বা উদ্ভব ও পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে একটা যৌক্তিক অনুমান করতে পারলে ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের বহু রহস্যই উন্মোচিত হবে। শুধু তাই নয়, সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, ক্ষমতা ও সম্পদের মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম বণ্টনভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের অবয়ব সম্পর্কে আমরা যে কল্পচিত্র নির্মাণ করতে পারি তা থেকে আজকের পৃথিবীর এই বলপ্রয়োগ, হিংস্রতা, প্রতারণা, বঞ্চনা ও যুদ্ধনির্ভর সভ্যতার বিপরীতে তুলনায় একটি অধিকতর মানব কল্যাণমুখী সভ্যতা নির্মাণের পথ খুঁজে পেতে পারি। এটা বুঝি যে, কোনো ব্যবস্থাই মানুষকে চিরস্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। কাল পরিক্রমায় মানুষের দেহের মতো সভ্যতাকেও বার্ধক্য এবং মৃত্যু গ্রাস করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুস্থ, সবল, প্রবল ও দীর্ঘ জীবনের কল্পনার মতো সভ্যতার দীর্ঘস্থায়িত্ব, মানবিকতা, ন্যায়নীতি, প্রাণশক্তি ও প্রাবল্যের সম্ভাব্যতার কল্পনা আমাদেরকে নব নির্মাণের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে।

সুতরাং আজ নতুন করে সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি ফিরাতে হয়। এই রকমটা মনে হয় যে আজকের মতো করে না হলেও সিন্ধু সভ্যতা পরিচালিত হতো এক ধরনের গণতান্ত্রিক রীতিতে। আজকের পাশ্চাত্য গণতন্ত্র তার অনেক অবদান সত্ত্বেও শুধু যে যুদ্ধ, পররাজ্য গ্রাস এবং অধীনস্ত, দুর্বল ও পশ্চাৎপদ পরজাতিগুলির উৎপাদন লুণ্ঠন ও শোষণের প্রক্রিয়ায় অনেকাংশে বিকশিত হয়েছে তাই নয়, অধিকন্তু আজও তার গণতন্ত্র যে অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি-মালিকানাভিত্তিক পুঁজিবাদের অস্তিত্বের একটি প্রধান শর্ত হয়ে আছে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ এবং এই যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে বিভিন্ন কায়দায় যুদ্ধ রপ্তানী করা। এই যুদ্ধ রপ্তানী কখনও করা হয় গণতন্ত্রের নামে, কখনও করা হয় গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের নামে। আবার নানান কৌশলে পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধের উত্তেজনা জিইয়ে রেখে অস্ত্র ব্যবসাকে চাঙ্গা রাখা হয়। মূল বিষয় হলো যুদ্ধ ব্যবসার মাধ্যমে অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত ও যুদ্ধনির্ভর ব্যক্তি-পুঁজিবাদকে রক্ষা ও প্রসার করা। বিশেষত পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক এই গণতন্ত্র অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে, পৃথিবীর যে প্রান্তের হোক, দুর্বল ও অসহায় মানুষের লাশের উপর। গত কয়েক শত বৎসর যাবৎ ইউরোপ-আমেরিকার ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়।

সভ্যতা, রাষ্ট্র, সমাজ ও গণতন্ত্র নির্মাণে সিন্ধু সভ্যতা এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চিত্র উপস্থিত করে। সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতবর্ষ বহির্ভূত সমাজগুলির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না বলে সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল না এমন ধারণাকে আমি সঠিক মনে করি না। কারণ রাষ্ট্র ছাড়া সভ্যতা নির্মাণ হতে পারে না। আর রাষ্ট্র মানে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। শুধু যে রাষ্ট্রের ভিতরে বিদ্রোহ বা ভাঙ্গন ঠেকাবার জন্য বলপ্রয়োগ বা যুদ্ধের প্রয়োজন হতে পারে তা-ই নয়, উপরন্তু বহিঃশক্তির আক্রমণ ও আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্যও তার প্রয়োজন হতে পারে। আত্মরক্ষার শক্তি বা ব্যবস্থা না থাকলে সেই রাষ্ট্র কয়দিন টিকতে পারে? যুদ্ধের শক্তি বা প্রস্তুতি ছাড়া অধীনস্থ রূপ নিয়ে সমাজ টিকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র পারে না।

সুতরাং প্রতœতত্ত্ব দ্বারা সিন্ধু সভ্যতায় উন্নত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কিংবা যুদ্ধনির্ভরতার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও সেখানে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্র যে সামরিক শক্তিকে রক্ষা করত এটা ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। প্রতœতত্ত্বের সাক্ষ্য দুর্বল হলেও সাহিত্য থেকে আমরা তার সাক্ষ্য পাই। আমরা অনুমান করতে পারি, সিন্ধুর নগর সভ্যতার দিকে যাত্রাকালে বৃহৎ ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে সমাজে যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তার মীমাংসার জন্য বৃহদায়তনে একটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের শক্তি জয়ী হয়। এই যুদ্ধের ঘটনাকে অবলম্বন করে পরবর্তী কালে পৌরাণিক মহাকাব্য হিসাবে ‘মহাভারত’ রচিত হয় বলে ধারণা করি।৩

সিন্ধু সভ্যতায় সামরিক বা যুদ্ধশক্তির অস্তিত্ব এবং যুদ্ধের অপর একটি সাক্ষ্য আমরা পাই ঋগে¦দ থেকে। এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নাই। শুধু এইটুকু উল্লেখ করি যে আমার অনুমান সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নে সমাজে যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ ঘটে সেটি প্রথমে একটি ধর্ম সংস্কার এবং অতঃপর একটি গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। এই সংস্কার ও গৃহযুদ্ধের প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার একদল ঋষি যে সকল মন্ত্র রচনা করেন সেগুলিই ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঋগে¦দে সংকলিত হয়।

সুতরাং ঋগে¦দকে মনে হতে পারে যুদ্ধনির্ভর একটি সমাজের দলিল। যুদ্ধনির্ভরতার দিকটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি সাময়িক ঘটনা, একটি বিশেষ প্রয়োজন সম্ভূত। বৈদিক আন্দোলন যে লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল সেই লক্ষ্য অর্জিত হবার পর বৈদিক ধর্মের প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ ক্রমে তার নিজস্ব শান্তির ধারায় অনেকাংশেই ফিরে গেছে। এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা ঘটতে দেখি পরবর্তী হিন্দু ধর্ম ও সমাজে। ঋদ্বেদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের প্রতি সাড়ম্বর আনুগত্য ঘোষণা করলেও পরবর্তীকালে বিকশিত হিন্দু ধর্ম ও সমাজ বৈদিক ধর্মের আদর্শ কতটুকু পালন করে  সেটা মনে হয় যারা বেদ ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না। বস্তুত এখানেই ভারতীয় সামাজের নিজস্ব ধারার বৈশিষ্ট্য ও শক্তি নিহিত।

অবশ্য বৈদিক ধর্মের সহিংসতা এবং আরও কিছু উপাদান পরবর্তী হিন্দু সমাজে আমরা লক্ষ্য করি। যুদ্ধ এবং সহিংসতার চর্চা সমাজে আমরা লক্ষ্য করি। যুদ্ধ এবং সহিংসতার চর্চা থেকেছে তবে ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির উদ্ভব ঘটিয়ে সেটাকে সামজের ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ও যুদ্ধনির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সমাজ মূলত অহিংসার আশ্রয় নিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। সুতরাং বর্ণজাতি হিসাবে ক্ষত্রিয়রা উদ্ভূত হলো যুদ্ধের ও যুদ্ধনির্ভর রাষ্ট্রের শাসকের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সমাজের বাকী অংশ রইল নিরস্ত্র।

যাই হোক, এতে কোনোই সন্দেহ নাই যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সিন্ধু সভ্যতার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা বিশৃঙ্খলার ভয় বা বিপদ যদি স্বল্পমাত্রায়ও থেকে থাকে তবু রাষ্ট্র, বিশেষ করে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যেমন ধরনের হোক প্রতিরক্ষার শক্তি মজুত রাখত। কারণ যুদ্ধকে যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনোকিছু দিয়েই মোকাবিলা করা যায় না। হয়তো বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে বিশাল সভ্যতার প্রান্তে প্রতিরক্ষার এমন ব্যবস্থা ছিল যার রূপ এখন পর্যন্ত আমাদের অজানা রয়েছে। তবে সভ্যতায় যুদ্ধ যে একেবারে অজ্ঞাত ছিল তার প্রমাণ বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে যুদ্ধের শক্তিকে যুক্ত করা বা প্রাধান্যে নিয়ে আসা। একইভাবে পাশাপাশি আবেস্তান সংস্কার দ্বারাও এই কাজ করা হয়। অর্থাৎ যত গৌণ কিংবা ক্ষীণ আকারে হোক সমাজ ও রাষ্ট্রে পূর্ব থেকে যুদ্ধের উপাদান ছিল বলে ধর্ম বা সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে তাকে প্রাধান্যে আনা গিয়েছিল। তবে এটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধ ও সহিংসতার উপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা শেষ করার পূর্বে এইটুকু বলি যে, কোনো সভ্যতাই যুদ্ধনির্ভর ও সহিংস হলে সর্বক্ষণ যুদ্ধ করে বেড়াবে ব্যাপারটা তেমন নয়। তেমনি কোনো সভ্যতা অহিংস হলেও একান্ত প্রয়োজনে বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হলেও যুদ্ধ ও সহিংসতার চর্চা করবে না ব্যাপারটা এমনও হতে পারে না। আসলে সভ্যতার মূল প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে আমরা সেই সভ্যতাকে সহিংস নাকি অহিংস বলব সেটা। সেদিক থেকেই নির্দ্বিধায় সিন্ধু সভ্যতাকে আমরা মূলত অহিংস ও শান্তিপূর্ণ সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি।

২. শাসন ব্যবস্থার রূপ

পুনরায় আমরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থার দিকটিতে দৃষ্টি দিই। একটু আগে বলেছি যে, প্রতœতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে গোটা সভ্যতাকে মূলত শান্তিপূর্ণ বা অহিংস মনে হয়। তা থেকে মনে হয় সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্র নির্মাণে যুদ্ধ ও জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের তুলনায় শান্তি ও স্বেচ্ছাসম্মতির ভূমিকা ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা কীভাবে সম্ভব যদি রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনে সাধারণ মানুষেরও কোনো না কোনো ধরনের অংশগ্রহণ বা মত প্রতিফলনের সুযোগ না থাকে? প্রতœতাত্ত্বিকদের অধিকাংশের মতে সিন্ধু নগর সভ্যতার অবসান বা ধ্বংস শুরু হয় মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে এবং পুরাপুরি অবসান বা ধ্বংস হয় খ্রীষ্টপূর্ব ১৭ শতকে। সেই হিসাবে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক বা পৌনে এক হাজার বছরব্যাপী এমন এক রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। যার ভিত্তি ছিল প্রায়  সকল মানুষের স্বেচ্ছাসম্মতি।

হয়তো বলা হবে এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসম্মতির মধ্যে গণতন্ত্রের কিছু নাই। কারণ ধর্মের প্রভাবে মানুষ শাসকদের সব সিদ্ধান্তকে নীরবে মাথা মেনে নিত। কিন্তু ধর্মের প্রভাবেও যে মানুষ সবকিছুকে মেনে নেয় না তার প্রমাণ মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতা। যারা এই দুই সভ্যতা সম্পর্কে কিছু জানেন তারা জানেন যে, ধর্ম ভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও জবরদস্তি, যুদ্ধ এবং নিষ্ঠুরতা এই দুই সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই সঙ্গে ছিল মুষ্টিমেয়ের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের অতি কেন্দ্রীভবন, যা সিন্ধু সভ্যতায় ছিল অকল্পনীয়।

এমন একটি সিদ্ধান্ত আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা নীতি বা শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনের একটি উৎস হচ্ছে সমাজের সাধারণ মানুষদের রাষ্ট্রের পরিচালনা ব্যবস্থায় কোনো না কোনো প্রকারে ভূমিকা রাখার কিংবা মত প্রতিফলনের সুযোগ। ফলে রাষ্ট্র জনগণের প্রয়োজন, ইচ্ছা ও চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে বাধ্য হয়েছে। আবার একই সঙ্গে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্ত টানতে হয় যে জনগণকেও কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই রকম অহিংস রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযোগী করে নেওয়া হয়েছিল। সহিংসতায় অভ্যস্ত জনগণকে যদি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে সেই রাষ্ট্রের কী দশা হতে পারে তা বোধ হয় ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে আমরা যে ধরনের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপ কল্পনা করতে পারি সেটা একমাত্র সেখানেই সম্ভব যেখানে শাসক ও শাসিত উভয়েই পারস্পরিক সম্মতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই ধরনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।

যাই হোক, আমরা কি সিন্ধুর রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো অনুমান করতে পারি? আমার মনে হয় প্রত্যক্ষভাবে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার ধারণকারী ভারতবর্ষের সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলে সিন্ধু সভ্যতার সেই শাসন ব্যবস্থার একটা অস্পষ্ট ও আংশিক ছায়া আমরা খুঁজে পাব ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বকাল পর্যন্ত বিদ্যমান পঞ্চায়েতমূলক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে, যা ছিল জনসমাজের স্বশাসনের নিজস্ব ভারতীয় রূপ। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে কয়েক হাজার বছর যাবৎ, বিশেষত গ্রাম সমাজে নিজস্ব শক্তি রক্ষায় পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল অপরিমেয়।

এটা বোঝা যায় সিন্ধু সভ্যতায় কল্পস্বর্গীয় সাম্যবাদ ছিল না। তাহলে সভ্যতা নির্মাণ করা যেত না। কিন্তু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি দ্বারা এটাও স্পষ্ট যে, সভ্যতায় শ্রেণী-বিভাজন ও বৈষম্য থাকলেও ক্ষমতা এবং সম্পদের বৈষম্য খুব বেশি প্রকট বা ভারসাম্যহীন ছিল না। অন্তত নগরগুলির চিত্র থেকে সেটা স্পষ্ট। বাসগৃহের আকার-আয়তনে কিছু পার্থক্য থাকলেও হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোসহ সব নগরে প্রতিটা মানুষ থাকত ছোট বা বড়, যেমন হোক ইটের তৈরী পাকা বাড়িতে। সভ্যতার নিদর্শন থেকে সম্পদের আড়ম্বর কিংবা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করে এমন কোনো বিরাটায়তন এবং আকাশচুম্বী নির্মাণ বা মহানির্মাণের চিহ্ন আমরা কোথাও দেখি না।

অথচ মিশরীয় সভ্যতায় ছিল রাজাদের সমাধি হিসাবে বিশাল বিশাল পিরামিড, বিরাটায়তন রাজপ্রাসাদ ও মন্দির, দেবদেবীদের বিরাট    প্রতিমা এবং সেই সঙ্গে সম্রাট বা ফারাওদের বিরাট সব মূর্তি বা প্রতিকৃতি। একইভাবে মেসোপটেমিয়ার নগর-রাষ্ট্রগুলি যে মন্দির বা জিগ্গুরাটগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত সেগুলিও হতো বিরাটায়তন এবং সেই সঙ্গে পুরোহিত-রাজাদের জন্য নির্মিত হতো বিরাট সব প্রাসাদ।

কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় সেই ধরনের বৃহৎ নির্মাণের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে দেওয়া হয়েছে কিভাবে নাগরিক বা জনসাধারণের জন্য সর্বাধিক ব্যবহারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধার বন্দোবস্ত করা যায় সেই দিকে। যেন এক সভ্যতা তার মানুষদের নিত্যদিনের প্রয়োজন কীভাবে পূরণ করবে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই সতর্ক ও কৃপণ বণিকের মতো প্রতি পাই-পয়সার নিপুণ হিসাব করে ব্যয় করেছে। এত বিশালায়তনব্যাপী বিস্তৃত উন্নত রাষ্ট্র ও সভ্যতা! অথচ তা না করেছে তার শৌর্য ও সামর্থ্য প্রকাশের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন, না করেছে তার শাসক বা নেতাদের জন্য চোখে পড়ার মতো কোনো বিরাট ও দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ। এমনকি ধর্মমন্দির হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন অতিকায় কোনো গৃহও নেই। প্রতিটি নগরে আছে হয় ঢাকনাযুক্ত ড্রেন যা দিয়ে মানুষের দেহের বর্জ্য নগর থেকে দূরে নদীতে নিষ্কাশন করা হতো, নয় নল দিয়ে মাটির নীচে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য অন্য কোনো ধরনের নিপুণ ব্যবস্থা। সকল নাগরিকের জন্য আছে পানীয় অথবা ব্যবহার্য জল লাভের ব্যবস্থা। রাস্তা, বাসগৃহ ইত্যাদি নির্মাণের মধ্য দিয়েও বেরিয়ে আসে বিস্ময় জাগানিয়া নগর পরিকল্পনা। আসলে বেরিয়ে আসে সভ্যতার নায়ক বা শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী।

আমার কাছে সিন্ধু সভ্যতা কতটা অহিংস বা সহিংস তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সকল নাগরিক বা সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের প্রতি সভ্যতার মনোযোগ কতটা সেইটা। সেই দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতাকে আধুনিককালের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসে এক অতুলনীয় সভ্যতার মর্যাদা দিতে হয়।

এটা ঠিক যে, নগর ও গ্রামের মধ্যে ছিল ব্যবধান তথা বৈষম্য। সেটা যে বড়রকম ছিল সেটা মনে করার কারণও আছে। কিন্তু প্রতœতত্ত্ব থেকে সেটাকেও চরম পর্যায়ের বলে এখন পর্যন্ত আমরা মনে করতে পারি না। যতদূর মনে হয় সমাজের সর্বস্তরে কম অথবা বেশি একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখবার উপর রাষ্ট্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিত। যার একটা প্রমাণ ধনী-দরিদ্র সব ধরনের মানুষের কঙ্কালে পুষ্টিমানের সমতার উপস্থিতি, যা এ সংক্রান্ত গবেষকদের বিস্মিত করেছে। অথচ অন্য সব সভ্যতায় ধনী এবং দরিদ্রদের কঙ্কাল থেকে পুষ্টিমানে বিরাট ধরনের পার্থক্যের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ফলে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কৃত সব নিদর্শন শাসকসহ সকলের জীবনাচরণে নম্রতা ও সংযমের দিকে যেমন ইঙ্গিত করে তেমনি সম্পদের প্রদর্শনে সংযমের দিকেও ইঙ্গিত করে। এটা কিন্তু আর একটা দিকে ইঙ্গিত করে সেটা হচ্ছে এক হাতে সব ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন না হওয়া। মনে হয় তুলনায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী একজন কোনো শাসকও ছিল না এবং ক্ষমতা ছিল ভারসাম্যপূর্ণভাবে বণ্টিত। এটাও মনে হয় শাসক বা রাষ্ট্র সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছে থেকে শ্রম পাবার জন্য কিছুটা নম্র বা নমনীয় পদ্ধতি যেমন উদ্ভাবন করেছিল তেমন বিনিময়ে তাদেরকে যতটা সম্ভব সুবিধা দেবারও চেষ্টা করেছিল। ফলে এক ধরনের সমতা ও মর্যাদা সাধারণ নাগরিক বা মানুষেরা ভোগ করত এমনটা অনুমান করার কারণ আছে।

সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে এখন একটা গুরুতর প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে পেতে হচ্ছে, তা হলো এই যে সভ্যতার সর্বত্র সমরূপতা বা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল। বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত একটা সভ্যতা, কাল প্রেক্ষিতে যাকে মহাসভ্যতা হিসাবে উল্লেখ করা যায়, সেখানে সর্বত্র নগর পরিকল্পনায় এত সমরূপতা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? তাছাড়া একই মাপের ইট, একই মাপ, একই ওজন, এক ধরনের লিপি ও সিলের ব্যবহার ছিল সভ্যতার সর্বত্র। সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বিষয়ে ভিন্নতা বা স্থানীয় বৈশিষ্ট্য থাকাটা স্বাভাবিক এবং সেটা ছিলও। কিন্তু বহু বিষয় বা জিনিসের অভিন্ন ধরন কিংবা সমরূপতা বিস্ময় জাগায়। বিভিন্ন দ্রব্য ও বৈশিষ্ট্যের এই সমরূপতা দিয়ে সহজেই  সভ্যতার সীমা নির্ধারণ করা যায়।

এখানে একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে আছে কিভাবে এই সমরূপতা অর্জন সম্ভব যদি একটা কেন্দ্রীভূত একক নেতৃত্ব সমগ্র সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ না করে থাকে? কাজেই সেটা ছিল। কিন্তু সমগ্র সভ্যতার বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী এমন দৃঢ় ঐক্য বা সমরূপতা আনবার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান হাতিয়ার কি ছিল? পুরাতত্ত্ব বলে এটা বলপ্রয়োগ ছিল না। আর যদি সেটা বাস্তবে থেকেও থাকে তবে সেটা যে সভ্যতার অন্তত প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুতরাং অনেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান ধর্মে। একটু আগে এ সম্পর্কে বলেছি। আসলে ধর্ম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। কিন্তু সেটাও অহিংস উপায়ে সভ্যতাকে এভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর হতে পারে না।

এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে পেয়েছি নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে। জলকপাট ও বাঁধ সংযুক্ত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির বস্তুগত উৎস। এ সম্পর্কে এখানে আলাদাভাবে আলোচনা করার অবকাশ নাই। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য়। সেখানে যে কথা আমরা বলেছি সেটাই এক কথায় বললে বলতে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতা যারা গড়ে তুলেছিল তারা সুদীর্ঘকাল ধরে বাঁধ, জলকপাট বা সøুইসগেট যুক্ত ব্যারেজের সাহায্যে নদী শাসনের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই নদী শাসন ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের মূল বস্তুগত হাতিয়ার। সুতরাং নদী ও সেচ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা গোটা সভ্যতাকে অনেকখানি শান্তিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল।

কিন্তু এটা একটা উপকরণ মাত্র। শুধু একটা উপকরণ দিয়েই এভাবে একটা সভ্যতার দীর্ঘস্থায়িত্ব, স্থিতিশীলতা, অভিন্নতা ও ঐক্য আনা সম্ভব হয় না। সেখানে আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে যে প্রক্রিয়ায় এই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল সেটিকে এবং এই রাষ্ট্রের উপর যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল সেটিকে। এই প্রক্রিয়াকে বুঝলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলায় তার সাফল্যের কারণকেও বোঝা যাবে। তখন শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠনের রহস্যও হয়তো উšে§াচিত হবে।

কারণ সভ্যতা যতই অহিংস হোক, রাষ্ট্র রাষ্ট্রই। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার মর্মে ধারণ করবেই যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের শক্তি। এ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র যেমন গড়ে উঠতে পারে না, তেমন তা বাঁচতেও পারে না। আর রাষ্ট্র না থাকলে সেটা কার সভ্যতা হবে? কাজেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী রাষ্ট্র সিন্ধু সভ্যতার ভিত্তি ছিল যার হাতে ছিল যুদ্ধেরও ক্ষমতা অথচ যার ব্যবহারে তা ছিল অত্যন্ত সংযত। এখন আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে সেই সামাজিক শক্তিকে যা নিজে নিরস্ত্র হলেও সিন্ধু সভ্যতায় বিপুল ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রটিকে নম্র শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল। এর ফলে রাষ্ট্রের সামরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অসামরিক বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছিল।

এ থেকে আমরা আর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রের মর্মে ছিল এমন একটি বেসামরিক আমলাতন্ত্র যা সামাজিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে থেকে পরিচালিত হতো। রাষ্ট্রের এমন কিছু কাজ থাকে যা পেশাদারিত্ব ছাড়া করা সম্ভব হয় না। যখন-তখন যাকে-তাকে দিয়ে এসব কাজ করাতে গেলে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়বে। সুতরাং রাষ্ট্র চালাতে আমলাতন্ত্র লাগবেই। বোঝা যায় সিন্ধু সভ্যতায় এমন একটা শক্তিশালী আমলাতন্ত্র ছিল যার সামরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অসামরিক বেশিষ্ট্য ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। এই সঙ্গে এটাও বোঝা যায় এই আমলাতন্ত্রের মাথার উপর ছিল সামাজিক শক্তি। এরা হয়তো আজকের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বা শাসকদের আদিরূপ।

পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে গড়ে ওঠা বর্ণজাতিভেদমূলক বিভাজন যে সিন্ধু সভ্যতায় ছিল না সেটাও আমরা নগরগুলির বিন্যাস ও সভ্যতার মান থেকে বুঝতে পারি। বর্ণজাতিভেদের মতো নিদারুণ বৈষম্য ও বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত কোনো সমাজে যে, কাল প্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতার মতো উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না তার প্রমাণ পরবর্তীকালে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু হিসাবে কথিত ভারতীয় সমাজ। সিন্ধু সভ্যতায় যে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক কোনো সামাজিক ব্যবস্থা ছিল না তার সাক্ষ্য আমরা পাই ঋগে¦দ থেকেও। ঋগে¦দের এক ঋষি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, ‘দেখো, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জনকারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।’ (৯/১১/৩)

যাই হোক, পরবর্তীকালে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা গড়ে উঠল। বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠী এই ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে নিজেদের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করে বৃহত্তর সমাজের অঙ্গীভূত হলো। বেদের অভ্রান্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও উত্তরাধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং বেদ চর্চার বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেণীকে মেনে নিয়েই এই নতুন সমাজ গঠন হলো। এভাবে ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল এক ধরনের নতুন ধর্ম, যাতে বেদের প্রতি নৈতিক আনুগত্য দেওয়া হলেও বাস্তবে বেদেরও অনেক কিছুই রইল না। এটাই এখন আমাদের নিকট পরিচিত হিন্দু ধর্ম হিসাবে। এটাকে এক অর্থে ধর্ম সমষ্টিও বলা চলে। বেদ ও ব্রাহ্মণের নৈতিক বা আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়ে এই ধর্ম গঠিত হলেও বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজের ধারা-উপধারা এবং বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টি হওয়ায় এটা হলো বিস্ময়করভাবে স্ববিরোধেপূর্ণ। এ হলো একদিক।

অপর দিকে, সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তীকালে যুদ্ধ ও সহিংসতা ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও সেটা থাকল নগরকে কেন্দ্র করে সমাজের উপর তলায়। সমাজের নীচতলা বিশেষত গ্রাম-সমাজ শান্তি বা অহিংসাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত হতো পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা দ্বারা, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা তাদের জীবন-জীবিকা ও আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিত। বিশেষত হাজার হাজার বৎসর ধরে গ্রাম পঞ্চায়েত যে ভারতীয় সমাজের স্বশাসনের একটা বিশেষ রূপ হিসাবে বর্তমান ছিল বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে আমরা তেমনটা ধারণা করতে পারি।

৩. পঞ্চায়েত ও রাষ্ট্র

পঞ্চায়েতমূলক শাসন ব্যবস্থাকে বুঝলে সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ও সমাজের শাসন বা পরিচালনা ব্যবস্থার  চিত্র সম্পর্কে সামান্য কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে। পঞ্চায়েত সম্পর্কে আমরা যতটুকু ধারণা করতে পারি সেটা হচ্ছে এই যে, এতে নির্দিষ্ট গ্রাম ও এলাকার মানুষেরা সরাসরি হোক আর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে হোক যে সিদ্ধান্ত নিত তাতে সংখ্যাধিক্যের পরিবর্তে মতৈক্য বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। সুতরাং একটা ভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়তো অনেক সময় লাগত। তবু এটা যে ছিল গ্রাম সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান পদ্ধতি সেটা আমরা আজও গ্রাম সমাজে কিছু ক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত সালিশগুলি থেকে অনুমান করতে পারি।

অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু- সংখ্যালঘু কিংবা ভোটাভুটির পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছাবার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো––এমন একটা অনুমান করা যেতে পরে। অবশ্য আজকের মতো গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধের সময় কিছু প্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র চর্চায় এমন পদ্ধতির বিদ্যমানতার কথা আমরা জানতে পারি।

স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও প্রথার বিশেষ ভূমিকা থাকত। অনুমান করা চলে ঐতিহ্য ও প্রথা সংগঠনে অথবা সংরক্ষণে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত।

এখন যে প্রশ্ন আসে তা হলো, এত বিশাল ভূভাগে বিস্তৃত একটা রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হওয়া সম্ভব ছিল। সেটা ছিল খুব ধীর যোগাযোগের কাল। ঘোড়ার অস্তিত্বের প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেলেও বাহন হিসাবে তার ব্যবহারের পক্ষে কোনো প্রতœতাত্ত্বিক সাক্ষ্য আমরা পাই না। অনুমেয় যে ঘোড়ার ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বা ধ্বংসের সময় সীমিতভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল। ঋগে¦দ থেকে আমরা তেমন একটা অনুমান করতে পারি। সুতরাং পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়ীতে করে এবং কিছু ক্ষেত্রে নৌকায় যাতায়াতের যুগ সেটা। অর্থাৎ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ধীর গতিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

এমন একটা কালে নির্দিষ্ট গ্রাম বা নগর শাসনে সবাই অংশ নিলেও নিশ্চয় সুবিশাল সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র শাসনে সবাই অংশ  নিতে পারত না। এ ক্ষেত্রে কোনো না কোনো ধরনের জন-প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা নিশ্চয় গড়ে উঠেছিল। সেখানে জন-প্রতিনিধিরা কিভাবে নির্বাচিত হতো? এটাই আজ অনুমেয় যে পঞ্চায়েতমূলক কোনো প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা যদি থেকে থাকে তবে তা উপরে উঠে গিয়েছিল পিরামিডের মতো ধাপে ধাপে একেবারে বিশাল রাষ্ট্রের কেন্দ্র পর্যন্ত। যারা এই কেন্দ্রে অবস্থান করত, তাদের মেয়াদ যেমনই হোক, তারা যে এক অর্থে বিপুল ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী হতো তাতে কোনো সন্দেহ নাই। তারা যে নগরের ভিতর বিশেষভাবে গড়ে তোলা নগর-দুর্গ হিসাবে কথিত স্বতন্ত্র এলাকায় বাস করত তেমন অনুমানটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে এই যে তাদের এই বিপুল ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রকাশও আমরা তাদের বাসগৃহ বা সমাধি সৌধ বা এই ধরনের কোনো কিছুর মহানির্মাণের মাধ্যমে পাচ্ছি না।

প্রতœতত্ত্ব থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসকদের জীবনাচরণ ছিল কঠোরভাবে সংযত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ।  বলপ্রয়োগ ও স্বেচ্ছাচারিতানির্ভর সভ্যতা না হওয়ায় সেখানে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের একটা বড় শর্ত ছিল সম্ভবত সমাজ বা জনগণের নৈতিক আনুগত্য লাভ। এর জন্য শুদ্ধাচার, সংযম, মিতব্যয়ী জীবনযাত্রা ইত্যাদির চর্চা হয়তো শাসকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা  এমন হতে পারে যে, সমাজ থেকে উঠে এলেও সমাজ বা সাধারণ মানুষদের থেকে শাসক শ্রেণীর কিংবা শাসনের প্রতিষ্ঠানের একটা দূরত্বও থেকে গিয়েছিল। এ সম্পর্কে ধারণা করা দূরে থাক তথ্যের অভাবে এখন পর্যন্ত অনুমান করাও কঠিন। তবু সত্যটাকে ধরার জন্য আমরা চেষ্টা করে যেতে পারি।

এ কথা আমাদের বুঝতে হবে যে সিন্ধু সভ্যতা বহিরাক্রমণে বা কোনো দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নাই। বরং প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এই সভ্যতা অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে কয়েক শতাব্দী ধরে ধীরে গতিতে ধ্বংস এবং পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রতœতত্ত্বের সাক্ষ্য এবং ঋগে¦দের বর্ণনা থেকে আমাদের অনুমান যে, যে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক সময় তা ভেঙ্গে পড়লে সভ্যতায় যে সংকট দেখা দেয় তা তার পতন ঘটায়। তবে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা বা ভাঙ্গন এক দিনে হঠাৎ করে ঘটে নাই। কয়েক শতাব্দী যাবৎ ঘটেছে। সুতরাং ধীর গতিতে সভ্যতার ক্ষয় ও ধ্বংসকে আমাদের হিসাবে নিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

যাই হোক, সভ্যতার এমন এক ধীর গতির পতনের পরিস্থিতিতে এটা সহজবোধ্য যে, এই মহাসভ্যতা চূড়ান্ত বিলুপ্তির বহু পূর্ব থেকেই তার বহু বৈশিষ্ট্য ও উপাদানকে তার অধিবাসীদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সমাজের গভীরে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে দিয়ে গেছে নানান রূপে। সুতরাং নানান রূপে আমরা আমাদের জীবনে এই উত্তরাধিকারকে ধারণ করি। আমাদের ভাষায়, সংস্কৃতিতে, আচার-আচরণ-প্রথায়, মূল্যবোধে সিন্ধু সভ্যতা আজও তার গভীর প্রভাব রেখে চলেছে। যেমন ধরা যাক, বাংলা ভাষাসহ অধিকাংশ প্রধান ভাষাই বৈদিক বা সংস্কৃত জাত কিংবা তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। বাকী বিষয়গুলির ক্ষেত্রে মুসলমানরা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি উপমহাদেশীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষরা বহু বিষয়েই সিন্ধু সভ্যতাকে তাদের জীবনে বিভিন্নভাবে বহন করে নিয়ে চলেছে আজও।

আর এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই চিন্তা মনে উঁকি দেয় যে, এক অর্থে সভ্যতা তো মানুষের বস্তুগত শক্তির প্রকাশ। যখন মানুষের বস্তুগত শক্তি ধ্বংস অথবা বিলুপ্ত হয় তখন কি মানুষ তার সভ্যতার উত্তরাধিকারকে ভাবগত রূপে রেখে দিতে চাইবে না? এটা হচ্ছে বস্তুর ভাবে রূপান্তর। সিন্দু সভ্যতার মতো মহাসভ্যতার ক্ষেত্রে কি এই ঘটনা ঘটা আরও বেশি সম্ভব এবং স্বাভাবিক নয়? আর এই চিন্তার সঙ্গে যে চিন্তা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো দেখা দেয়, তা হলো সিন্ধু সভ্যতার পতনের অনেক পরবর্তী কালে বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য ইত্যাদি ধর্মীয় ও দার্শনিক আন্দোলনগুলিতে কি সিন্ধু সভ্যতার সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি স্থানান্তরিত বা রূপান্তরিত হয়ে ধর্মীয় ও দার্শনিক রূপ নিয়েছে আর এইভাবে রাষ্ট্র-শাসনের পরিবর্তে সমাজ-শাসনের ভার হাতে নিতে চেয়েছে?

বৈদিক ধর্ম তার ধর্মসংস্কার দ্বারা যুদ্ধ ও সহিংসতাকে প্রাধান্যে এনে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক প্রথা বা ঐতিহ্যের সঙ্গে বড় ধরনের ছেদ ঘটিয়েছে। ফলে সিন্ধু সভ্যতার মূল কিছু বৈশিষ্ট্য বা উপাদান তার কিংবা তার উত্তারাধিকারী ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু হিসাবে পরিচিত ধর্ম ও সমাজে অনুপস্থিত হতে অথবা কম থাকতে পারে। কিন্তু বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মতো অহিংসানির্ভর এবং সংঘের মতো প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংগঠিত ধর্মগুলিকে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা হিসাবে ধারণা করার কারণ আছে। হয়তো বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ও সংঘ বা প্রতষ্ঠানের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থারও অনেক উপাদান লুকিয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসকদের মধ্যে আমরা হয়তো অনেক পরবর্তী কালের শুদ্ধাচারী ও সংসারত্যাগী শ্রমণ ও ধর্মগুরুদের সবটা বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতার পরিবর্তে হয়তো জ্ঞান কিংবা অন্য আর কোনো গুণাবলীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীতে প্রবেশ করা যেত। হয়তো এখানে ছিল ধর্মেরও ভূমিকা।

এই রকম একটা কাছাকাছি ব্যবস্থায় ঐ রকম এক মহাসভ্যতার রাষ্ট্রশাসকদের পক্ষে অর্থের জোরে কিংবা অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার কোনো পথ না থাকায় সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাসীনরা অর্থ-বিত্তের আড়ম্বর কিংবা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পায় নিজেদের জন্য এমন কোনো গগনচুম্বী অট্টালিকা কিংবা সমাধি সৌধ কিংবা নিজেদের ভোগ-সম্ভোগের জমকালো আয়োজন নির্মাণে অক্ষম ছিল। বরং গোটা সভ্যতা যে মানুষের সর্বজনীন ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতো প্রতœতত্ত্ব সেই সাক্ষ্যই দেয়। শাসকদের দায়িত্ব ছিল সেই উদ্দেশ্য পূরণে নিজেদেরকে নিবেদিত রাখা। বিনিময়ে তাদের বস্তুগত অর্জন কী ছিল বা কতটুকু ছিল তা আজ বলা না গেলেও তারা যে সমাজ ও জনগণের বিপুল শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আনুগত্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও ভোগ করত সেই অনুমানটুকু করা যায়।

৪. সভ্যতার নম্র রূপ

আজকের যুদ্ধনির্ভর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সভ্যতার কেন্দ্র স্বরূপ পরাক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রেখে যখন আমি সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রধানত শান্তি ও অহিংসানির্ভর প্রাচীনতম মহাসভ্যতাকে দেখি তখন বিস্মিত না হয়ে পারি না। কীভাবে অত প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষরা মানব জাতিকে নম্র ও সৌম্য এমন এক মহাসভ্যতা উপহার দিতে পেরেছিল, যা আর কোথাও আজ পর্যন্ত মানব জাতি পারে নাই? সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীতে একটাই। যতই বিশালায়তনে ও যত দীর্ঘকাল স্থায়ী তা হোক তা এককই থেকে গেছে। তাকে অনুসরণ করতে আর কেউই পারে নাই।

এই আলোচনার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবে মনে করে সিন্ধু সভ্যতার সাম্প্রতিক আবিষ্কার নিয়ে এখানে আলোচনা করি নাই। তবু এটুকু উল্লেখ করি যে, ২০০১ সালে ভারত-রাষ্ট্রের গুজরাট উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার  দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের ৩০ থেকে ৪০ মিটার গভীরে সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই নগরে ভারতের সমুদ্র প্রতœতত্ত্ব বিভাগ থেকে শেষ অনুসন্ধান হয় ২০০৩-২০০৪ সালে। সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত নগরটি একটি প্রাচীন নদী খাতের দুই পাশে ৫ মাইল দীর্ঘ ও ২ মাইল প্রশস্ত এলাকা নিয়ে গঠিত। সুতরাং এটির আয়তন প্রায় ১০ কর্গমাইল। সেই তুলনায় মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা এবং  পরবর্তীকালে প্রাপ্ত রাখিগাড়ী ও গানেরিওয়ালা এই চার নগরের আয়তন অনেক কম। এগুলির আয়তন নিম্নলিখিত রূপ যথা, মহেঞ্জোদাড়ো ২০০ হেক্টর (৪৯০ একর) এর বেড় প্রায় ৩ মাইল বা ৫ কিলোমিটার, হরপ্পা ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর), রাখিগাড়ী অন্ততপক্ষে ৩ বর্গকিলোমিটার এবং গানেরিওয়ালা ৮০ হেক্টর।

ক্যাম্বে উপসাগরের তলদেশে প্রাপ্ত এই নগরের উপর সেখানে জলস্রোতের প্রচ-তার জন্য তেমন একটা কাজ করা যায় নাই। আবার ঘোলাজলের কারণে নগরের চিত্র চোখে দেখা যায় না। ফলে উপর থেকে শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে নগরের চিত্র (ংড়হধৎ রসধমব) নিতে হয়েছে। তা থেকে এবং সাগর গর্ভে নিমজ্জিত নগরের বেশ কিছু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এটিকে স্পষ্টভাবে সিন্ধু সভ্যতার নগর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নগর থেকে পাওয়া একটি কাঠের টুকরা থেকে সেটার যে সর্বপ্রাচীন বয়স পাওয়া গেছে তাতে তার বয়স সাড়ে নয় হাজার বছর হয় অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৭ হাজার ৫ শত বছর আগের কাষ্ঠখ- সেটি।

এখন এটাও বোঝা যায় যে নগরটি যখন স্থলভূমিতে ছিল তখন ছিল হিম বা বরফ যুগ। পৃথিবীর সর্বশেষ হিম যুগ আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে শুরু হয়ে প্রায় দশ থেকে বারো হাজার বছর আগে শেষ হয়। তবে হিম যুগ সর্বত্র পুরাপুরি শেষ হতে আরও কিছু সময় নেয়। হয়তো নয় হাজার বছর আগে এটা শেষ হয়। হিম যুগে বিপুল পরিমাণ জল বরফে পরিণত হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠা তখন এখন থেকে প্রায় ৩৩০ ফুট বা ১০০ মিটার পর্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু হিম যুগ শেষ হলে বরফ গলে বিপুল স্থলভূমি সমুদ্রতলে চলে যায়। ফলে হিম যুগে এমন সব অঞ্চলে অনেক বসতি এবং সভ্যতা গড়ে ওঠা সম্ভব যেগুলি হিম যুগের অবসানে সমুদ্র পৃষ্ঠর উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জলের নীচে তলিয়ে গেছে।

এমনই একটি নগর ভারতের গুজরাটের উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের জলের ৩০ থেকে ৪০ মিটার তলদেশে সন্ধান পাওয়া নগরটি। কাঠের রেডিও কার্বন পরীক্ষা এবং হিম যুগের সমাপ্তির হিসাব দুই দিক থেকেই তার বয়স অন্তত সাড়ে নয় হাজার বছর বা তারও বেশি নির্দেশ করে। এখন তার প্রতিষ্ঠার সময়কে যদি আরও এক হাজার বছর পিছিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বলতে হবে কমপক্ষে সাড়ে দশ হাজার কিংবা হয়তো এগারো হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে কথিত নগর সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। অথচ মেসোপটেমিয়া এবং মিসরের নগর সভ্যতার যাত্রা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর যাত্রা প্রায় ঐ সময় হলেও রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী চার হাজার ছয় শত বছর আগে। চীন আরও পরে নগর সভ্যতার নির্মাণ করে।

ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর ইতিহাস ব্যাখ্যার বহু সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রথমত, সিন্ধু সভ্যতার জš§ মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার তুলনায় আরও পাঁচ বা ছয় হাজার বছর আগে হয়েছে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োসহ বর্তমান সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেও নিমজ্জিত নগরের সম্পর্ক স্থাপনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে পরিচিত সভ্যতা এবং তার নগরগুলির বয়স চার হাজার ছয় শত থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে পর্যন্ত নেওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন আসবে, যদি ধরে নেওয়া হয় যে, প্রায় নয় হাজার বছর আগে এটি সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয় তাহলে নিমজ্জনের পরেও প্রায় চার হাজার বছর এই সভ্যতা কোথায় ছিল? হঠাৎ করে ঐ নগর সভ্যতা প্রায় চার হাজার বছর পর কী করে প্রায় অভিন্ন রূপ নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বর্তমান এলাকায় গড়ে উঠল? মাঝখানের এই চার হাজার বছরের ধাঁধার উত্তর এখনও অজানা। এই দুই কালের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে গেলে দিশাহারা হতে হয়।

দিশাহারা হবার প্রয়োজন নাই। সব প্রশ্নের উত্তর এখনই পেতে হবে তার কী মানে আছে? বরং প্রতœতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দিয়ে যেটুকু জানা হয়েছে সেটুকু দিয়েই আমরা আমাদের আলোচনাকে এগিয়ে নিতে পারি। সেখানে আমরা দেখতে পাই এক বিস্ময়কর মহাসভ্যতাকে। ক্যাম্বের নিমজ্জিত নগর থেকে শুরু করে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো-রাখিগাড়ী-গানেরওয়ালা এই চার সর্ববৃহৎ নগরসহ গড়ে ওঠা সভ্যতার সময়সীমাকে হিসাবে নিলে অন্তত এগারো হাজার বছর পূর্ব থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত আনুমানিক সাত থেকে আট হাজার বছর ধরে বিরাজমান একটা সভ্যতাকে  আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তবে ক্যাম্বে উপসাগরের নগরের কথা বাদ দিয়েও যদি ধরা যায় এবং সেটাই এখন যুক্তিযুক্ত হবে, তবু আমরা প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী বিদ্যমান একটা নগর সভ্যতাকে দেখতে পাই যা বিকশিত হয়েছিল এবং টিকেছিল যুদ্ধ ও সহিংসতাকে যতটা সম্ভব পরিহার করে।

আর কোন্ সভ্যতা প্রধানত নির্দয়তা, জবরদস্তি, যুদ্ধ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং টিকে থেকেছে? মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন? আরও পরবর্তী কালের গ্রীস অথবা রোম? কিংবা আমেরিকা মহাদেশের দিকে সৃষ্টি দেওয়া যাক। সেখানে নিয়মিত যুদ্ধের উপর প্রতিষ্ঠিত আজটেক, মায়া, ইনকা সভ্যতার দেবতাদের রক্ত পিপাসা মিটাবার জন্য ছিল মানুষ হত্যার নিয়মিত আয়োজন। প্রতি বছর শত শত মানুষকে বন্দী করে এনে দেবতাদের বেদীতে হত্যা করা হতো নিষ্ঠুর কায়দায়। কখনও কোনো উপলক্ষ্যে নরহত্যার সংখ্যা হাজার হাজার হতো। বোঝাই যায় অগণিত মানুষের রক্ত, অশ্রু আর ঘামে সিঞ্চিত হয়ে এই সব সভ্যতার যাত্রাপথ নির্মিত হয়েছে। এগুলি থেকে সিন্ধু সভ্যতা কত ভিন্ন!

এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নাই যে সিন্ধু সভ্যতায় যতই প্রাচুর্য ও সুষম বণ্টন থাক সবাই যে দেহশ্রমনির্ভর কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত তা হতে পারে না। অথচ সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘুর তুলনায় অনেক কষ্টসাধ্য কাজ করতে হয়েছে এবং সবখানেই থেকেছে বিভিন্ন ধরনের কাজ। কারণ শ্রমবিভাজন ছাড়া সভ্যতা অচল। আজকের দিনের মতো কঠিন কাজগুলি করার জন্য সেদিন যন্ত্র ছিল না। তাহলে যে ধরনের হোক অধিক শ্রম, ঝুঁকি ও কষ্টের কাজগুলি যারা করত তাদেরকে নিশ্চয় নানান কৌশলে হোক, চাপ দিয়ে হোক অথবা প্রণোদনা দিয়ে হোক সেগুলি করাতে হতো। হয়তো একাধিক পদ্ধতির সংমিশ্রণ ছিল। যেমনই হোক সিন্ধু সভ্যতার সেই পদ্ধতি আজ আমাদের অনেকটাই অজানা, কিছু হয়তো অনুমান সাপেক্ষ। তবে সেটা যে মেসোপটেমিয়া, মিসর, চীন বা পরবর্তীকালের গ্রীস-রোমের মতো চাবুক আর তলোয়ারনির্ভরতা থেকে বেশ খানিকটা দূরবর্তী কিছু সেটা আমরা পুরাতত্ত্ব থেকে বুঝতে পারি।

এ প্রসঙ্গে বারবার যে প্রশ্ন মনে জাগে তা হলো অর্থ নয়, ক্ষমতার বিরাট প্রদর্শন নয়, ধর্ম বিশ্বাসেরও বিরাট প্রদর্শন হিসাবে মহাকায় ও জাঁকালো মন্দির নির্মাণ নয়, তা হলে সেই আনুগত্যের প্রধান উৎসটি কী ছিল যার কারণে জনসাধারণ রাষ্ট্র ও শাসকের প্রতি অনুগত থেকেছে এবং সভ্যতার প্রয়োজনে সব ধরনের শ্রম দিয়েছে, ঝুঁকি নিয়েছে? একটু আগে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি শাসকদের শুদ্ধাচার, সংযম ও মিতব্যয়ী জীবন অনুশীলনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সম্ভাব্যতার মধ্যে। একদিকে জ্ঞান এবং নম্র ও সংযত জীবনাচরণ, অপর দিকে সমাজ বা সাধারণ মানুষদের কল্যাণে ভূমিকা পালন দ্বারা শাসকরা হয়তো সাধারণ মানুষের আস্থা ও আনুগত্য অর্জন করত। হয়তো সেটা তাদেরকে শক্তি যোগাত রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে। হয়তো গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবক শ্রেণী এবং দার্শনিক শাসকের কল্পনা এসেছিল সিন্ধু সভ্যতার এমন কোনো ব্যবস্থার স্মৃতি থেকে।

৫. সভ্যতার বিকল্প পথ

আজকের আধুনিক সভ্যতা মানুষকে গৌরব করবার মতো অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি-পুঁজিবাদ যেভাবে মানুষের মানবিকতার দিকগুলিকে পর্যুদস্ত করে চলেছে সেটাকে আমরা কীভাবে খাটো করে দেখব? বিশেষত এই পুঁজিবাদের যুদ্ধ, প্রতারণা, নিদারুণ বৈষম্য, মানুষকে বিশেষ করে নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে তার মনুষ্যত্বকে অবমানিত করা এবং সর্বোপরি তার ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্ব উš§ত্ত ভোগবাদ যা আমাদের এই গ্রহকে দ্রুত ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে সেগুলির প্রতি আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।

মানব জাতির অস্তিত্বের প্রয়োজনই সভ্যতার বিকল্প পথ সন্ধান করার সময় আজ আমাদের সামনে এসেছে। বিশেষত পরমাণু প্রযুক্তির ও ব্যাপক বিস্তারের এই কালে এই গ্রহ এবং মানব জাতির অস্তিত্ব ভয়ানকভাবে বিপন্ন। যুদ্ধ ও সহিংসতানির্ভর অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি পরমাণু যুদ্ধের মাধ্যমে যে কোনো সময় মানব জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে আধুনিক সভ্যতার উন্নততর ও বিকল্প রূপ সন্ধান করতে হবে। সহিংসতা ও যুদ্ধকে নিঃশর্ত ও অন্ধভাবে পরিত্যাগের কথা আমি বলি না। কিন্তু তার চর্চা হবে শুধু আত্মরক্ষার জন্য, মানবিক কল্যাণকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য। তার জন্য সন্ধান করতে হবে নতুন ধরনের সমাজ নীতি ও রাষ্ট্র নীতির। সেটা শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যও। আর সেদিক থেকে আমি সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু আবিষ্কার হয়েছে তার পুনর্মূল্যায়নের অপরিহার্যতা অনুভব করি। অবশ্যই সেটা সেখানে প্রত্যাবর্তনের জন্য নয়, বরং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আগামী সভ্যতার নতুন যাত্রাপথ নির্মাণের জন্য।

আমি অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার বিস্ময়কর শক্তির মূল উৎস নিহিত ছিল তার সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র এই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিন্যাসের মধ্যে। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ তার সঙ্গে সম্পর্কিত মাত্র। সমাজ গড়ে ওঠে মূলত মানুষের আচরিত নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা বোধ, বিশ্বাস এবং প্রথার ভিত্তিতে। এভাবে মানুষ বৃহত্তর পরিসরে ঐক্যবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ হয়। এখানে বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তির ভূমিকা থাকতে পারে, তবে সেটার ভূমিকা হয় সাধারণত গৌণ। রাষ্ট্র প্রধানত নির্ভর করে বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তির ক্ষমতার উপর। দুটোই মানুষকে এক অর্থে কিছু নিয়মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু সমাজ জোর দেয় স্বেচ্ছাসম্মতির উপর। বাধ্যতা কম বলে এ ক্ষেত্রে সমাজের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা যেমন বেশী থাকে তেমনি সমাজ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে বাধ্যও হয় তুলনায় অনেক বেশী। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। শুধুমাত্র বলপ্রয়োগেও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। বিশেষত অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ছিল সাধারণ নিয়ম।

সমাজে যেটা নিয়ম, রাষ্ট্রে সেটা আইন। সমাজে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে সাধারণভাবে তাকে সমাজচ্যুত বা বর্জন করা কিংবা তুলনায় কিছু লঘু দ- দেওয়া হতে পারে, যেটা হতে পারে জরিমানা, প্রহার কিংবা তিরস্কার ও ধিক্কার। যখন এই নিয়ম ভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তি বা গুরুদ- দানের বিষয় চলে আসে তখন সমাজ রাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সাধারণত বাধা দেয়। রাষ্ট্র তার এখতিয়ারের জায়গায় সমাজকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। কারণ তাতে সমাজ সরাসরি রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অবতীর্ণ হয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। রাষ্ট্র তাই এই জায়গায় সাধারণত খুব স্পর্শকাতর থাকে। এই জন্য কারাদ- বা মৃত্যুদ-ের মতো শাস্তি বিধানের ক্ষমতা রাষ্ট্রই নিজের হাতে একচেটিয়া করে রাখে। যদি কখনও সমাজ গুরুদ- দিবার জায়গায় যায় তবে বুঝতে হবে সেটা তা রাষ্ট্রের সম্মতি সাপেক্ষে এবং রাষ্ট্রের অঙ্গ ও সহায়ক হিসাবে করছে।

৬. শ্রেণীর প্রশ্ন

এখানে আর একটি প্রশ্নকে এড়িয়ে গেলে সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের মূল কিংবা অন্তর্নিহিত শক্তিটিকে আমরা ধরতে পারব না। সেটা হচ্ছে শ্রেণীর প্রশ্ন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হোক, যে প্রক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত হোক সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ যে শ্রেণী কিংবা শ্রেণীসমূহের হাতে ছিল তারাই যে মূলত সিন্ধু সভ্যতার শুধু সমাজ নয়, রাষ্ট্রকেও নিয়ন্ত্রণ করত এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। অর্থাৎ শাসন ক্ষমতায় কারা সামনে ছিল তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা মূলত কোনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণী বা গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করত এবং এই শ্রেণী বা গোষ্ঠীসমূহ কোন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল সেই বিষয়টি।

বিষয়টার গুরুত্ব বুঝবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আসে তারা ভোটারদের ভোটে ক্ষমতায় এলেও মূলত যে স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে সেটা হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজি। সেখানে আরও স্বার্থ আছে যাদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার উপায় নাই, যেমন সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু বৃহৎ কিংবা কর্পোরেট পুঁজির ভূমিকাই সেখানে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই পুঁজি সেখানে নানানভাবে যে শুধু রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ করে তাই নয়, সংবাদপত্র ও টিভিসহ প্রচার মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা জনমতকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এই পুঁজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেখানে রাজনীতিতে কার্যকর কোনো ভূমিকাই কারও পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রশাসনের প্রকৃত চরিত্র বোঝাবার জন্য সেখানে সমাজ ও সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের মূল বা প্রধান শক্তিটাকে খুঁজে বের করার গুরুত্ব অনেক বেশী। আর সেখানে আমরা দেখতে পাই কর্পোরেট পুঁজিকে। এই পুঁজি তথা পুঁজির মালিকদের মধ্যে স্বার্থের কিছু বিভাজন ও দ্বন্দ্ব থাকলেও মূল স্বার্থগত প্রশ্নে তাদর ভিতরে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব ঘটে না।

সিন্ধু সভ্যতা এমন কোনো সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। বোঝাই যায় যে সেটা ছিল ভারতবর্ষে মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে নব নির্মাণের কাল। সুতরাং যুদ্ধের পরিবর্তে এই নব নির্মাণে যারা ভূমিকা রেখেছিল সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যে মূলত তাদের হাতেই ছিল সেটা সহজবোধ্য। সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র-শাসক নির্বাচন কিংবা বাছাই কোন প্রক্রিয়ায় হতো সেটা খুঁজবার চেয়ে সম্ভবত এই নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে ছিল সেই শ্রেণীগুলি কারা এবং কোন প্রক্রিয়ায় তারা সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখত সেটা খুঁজে পাওয়াটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনুমান করা চলে এদের উদ্ভব ও বিকাশ মূলত অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও নম্র প্রক্রিয়ায় ঘটায় সমাজ ও সভ্যাতর বিকাশ যেমন নম্র ধারায় হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে সভ্যতা তার শক্তি ও সম্পদকে চোখ ধাঁধানো মহানির্মাণের পিছনে ব্যয় না ….  সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণ এবং কল্যাণের পিছনে ব্যয় করেছে, যার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই সিন্ধু সভ্যতার প্রতিটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে।

৭. ভাবাদর্শিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

কিন্তু প্রশ্ন একটা রয়েই যায়, সেটা হচ্ছে হিংসার শক্তি এবং বৈষয়িক ক্ষমতার কেন্দ্র স্বরূপ রাষ্ট্রের লাগাম টেনে ধরা কোন সামাজিক শক্তির পক্ষে সম্ভব? মানুষের বাস্তব জীবন তো অনেকাংশেই ভোগের প্রেরণা এবং বৈষয়িক কর্মনির্ভর। স্বাভাবিকভাবে ব্যবহারিক ও বৈষয়িক মানুষ দীর্ঘকাল ক্ষমতার চর্চা করলে ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত কিংবা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো সাধরণ নিয়ম না। তাহলে আর একটি সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হতে পারে সেটা হচ্ছে এই যে, সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রকে যারাই নিয়ন্ত্রণ করুক, যে প্রক্রিয়ায় তারা ক্ষমতায় আসীন হোক, সেটা নির্বাচন হোক অথবা মনোনয়নের কোনো পদ্ধতি হোক, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে অধিষ্ঠান করত আর একটি গোষ্ঠী, যারা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা না করলেও তার নীতি নির্ধারণে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখত।

আর এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম এবং তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যে উল্লেখ করেছিলাম সে প্রসঙ্গের জের ধরে বলতে হয় যে, এমনটা খুব সম্ভব যে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত ছিল মূলত একটি নৈতিক বা আদর্শিক শ্রেণী দ্বারা যেটা একটা ধর্ম গোষ্ঠী তথা ধর্মীয় শ্রেণীও হতে পারে। সেটা হতে পারে যথেষ্ট উদারভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের সমাহারও। এমনকি সেখানে বিভিন্ন লোকবাদী বা বস্তুবাদী আদর্শ বা ধ্যানধারণার মানুষদের অংশগ্রহণ থেকে থাকতে পারে। কথাটা আমি এই জন্য বলছি যে, ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মে অন্যান্য অনেক সমাজের তুলনায় যে পরমত সহিষ্ণুতা এবং বহুত্বের প্রতি অনুমোদন দেখা যায় সেটা যে সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতি বা চেতনার ধারাবাহিকতা তেমনটাই মনে হয়। অপর দিকে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন এবং ধর্মচিন্তায় নিরীশ্বরবাদ যে একটি শক্তিশালী ধারা ছিল সেই বাস্তবতাকেও আমাদের মেনে নিতে হবে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে ঈশ্বর ও ঈশ্বর চিন্তার কোনো স্থান নাই। নিরীশ্বরবাদের এ উৎস যে সিন্ধু সভ্যতায় ছিল সেটা মনে করার সঙ্গত কারণ আছে। এ ছাড়া চার্বাক ও লোকায়ত দর্শনের মতো যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী ও লোকবাদী দর্শনগুলির উৎসও আমরা সিন্ধু সভ্যতায় খুঁজে পেতে পারি।

সুতরাং এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ভিতর বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের এক ধরনের সমন্বয়ের  সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালন করত। তারা হয়তো শুদ্ধাচারী ও সংযত কিংবা সংসারত্যাগী জীবন যাপন করে সমাজের আনুগত্য অর্জন করত। প্রাচীনকালের সাংখ্য দর্শন প্রণেতা কপিল মুনির মতো বিভিন্ন দার্শনিকের যেসব প্রতিষ্ঠান বা স্কুল প্রজš§ পরম্পায় টিকে ছিল কোনো না কোনোভাবে সামজিক লালন ছাড়া সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? এই কালেও জ্ঞান সাধনা, ত্যাগ ও সংযত জীবনাচরণের প্রতি হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি ভারতীয় নিজস্ব ধারার জন-মানসে যে পরিমাণ আস্থা ও আনুগত্য দেখা যায় তাতে এমন কোনো দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে সাধারণ মানুষ যে সেকালে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অধিকতর অনুগত হবে সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়। সে ক্ষেত্রে বৌদ্ধ সঙ্ঘের মতো কানো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হয়তো রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালন করত।

‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় ঋগে¦দ ও আবেস্তার সূত্র ধরে আমরা বরুণ দেবতা কেন্দ্রিক একটি ধর্মকে সিন্ধু সভ্যতায় প্রধান ধর্ম হিসাবে দেখতে পেয়েছি। এই ধর্মে আরও দেবতা থাকলেও তারা ছিল বরুণের অধীনস্থ। অন্যদিকে এই ধর্মের দেবতাদের কোনো মূর্তি বা প্রতিমা না থাকায় সিন্ধু সভ্যতায় প্রতিমা পূজার নিদর্শন দেখা যায় নাই। এর ধারাবাহিকতা আমরা বৈদিক ও আবেস্তা উভয় ধর্মে দেখতে পাই।

যাই হোক, বৈশিষ্ট্যের বিচারে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মকে মূলত একেশ্বরবাদী এবং নিরাকারবাদী বলতে পারি। এটাই অনুমান করা যায় এই কারণে সিন্ধু সভ্যতায় বৃহৎ দেবতা মূর্তি পাওয়া যায় না।  অযতেœ নির্মিত পোড়ামাটির যে সব ক্ষুদ্র পুতুল পাওয়া গেছে, যেগুলিকে মাতৃদেবী মূর্তি বলা হয়, সেগুলি যে রাষ্ট্রীয় বা সভ্যতার দেবতা হতে পারে না তা অনুমান করা যায়। কারণ অমন শক্তিশালী ও বৃহৎ সভ্যতার দেব-দেবীদের মূর্তিও যে হবে আর সব সভ্যতার মতো বৃহদায়তন ও জমকালো সেটাই স্বাভাবিক। সমাজ ও সভ্যতা তার শক্তিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায় দেব-দেবীদের মূর্তি পূজা থাকলে প্রতীক হিসাবে তাদের মূর্তি নির্মাণ করে। এই ধরনের মূর্তি না থাকায় সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম মন্দির হিসাবে কোনো গৃহকে সেভাবে চিহ্নিত করা যায় না।

যাই হোক, যদি বরুণ কেন্দ্রিক ধর্ম সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের সরকারী ধর্ম হয়ে থাকে তবে এটা সম্ভব যে, বরুণ কেন্দ্রিক ধর্মের পুরোহিত শ্রেণী রাষ্ট্রের ক্ষমতায় সরাসরি অধিষ্ঠিত না থেকেও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালন করত। হয়তো এর জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠান হয়তো সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়কে কিছু দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ যেমন করত তেমনি উভয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্যও বজায় রেখে চলত।

এমন দৃষ্টান্ত আধুনিক কালেও পাওয়া যায়। যেমন আমরা ইরানে দেখি আয়াতুল্লাদের নেতৃত্বে সেখানকার শিয়া মোল্লা বা পুরোহিত শ্রেণীকে সরাসরি ক্ষমতা চর্চা না করেও রাষ্ট্রের উপর আনুষ্ঠানিক অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে। তবে সিন্ধু সভ্যতার সেই প্রাচীনকালে ঘটনাটা কী ছিল এখন আমাদের পক্ষে বুঝা দুঃসাধ্য হলেও সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক আবিষ্কার, ঋগে¦দসহ ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্য এবং ভারতবর্ষের বেশ কিছু সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিকে কিছু মনোযোগী দৃষ্টিপাত আমাদেরকে ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত অনেক সত্যকেই উদ্ঘাটনে সাহায্য করতে পারে বলে আমি মনে করি।

তবে সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ যথাযথভাবে অনুধাবনের জন্য আমি অহিংসা ও নম্রতানির্ভর জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিবার প্রয়োজন দেখি। আমার অনুমান সিন্ধু সভ্যতার নম্রতা, অহিংসা ও ন্যায়-নীতি বোধ এই দুইটি ধর্মের ভিতর দিয়ে আর এক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সময় বৃদ্ধের বাণী ভারতবর্ষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। সংসার ত্যাগী বুদ্ধের আকুল কামনা উচ্চারিত হয়েছিল এই বাণীতে, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। এই কামনা মানুষকে যতই তাড়িত করুক জীবন তো ভিন্ন। তাই সব প্রাণীর সুখ সাধনে সমাজ বা রাষ্ট্র যে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে তা নয়। তবে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণ ও ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের প্রতি একটা রাষ্ট্র যে কাল প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ পরিমাণে মনোযোগী হতে পারে এবং সুবিশাল ও পরাক্রান্ত হয়েও নম্রতার পথচারী হতে পারে তার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে সিন্ধু সভ্যতা। সুতরাং আজ আমাদের সেই দিকটাতে দৃষ্টিপাতের এত প্রয়োজন।

(ঋড়ড়ঃহড়ঃবং)

১ প্রকাশক : ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ’-এও দেওয়া আছে। এখানে এটি উল্লেখ করা যায় যে, এই প্রবন্ধের অনেকগুলি বিষয় কম-বেশী ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচিত হয়েছে।

২ Jim G. Shaffer and Diane A. Lichtenstein, ÒThe concepts of Ôcultural traditionÕ and ÔpaleoethinicityÕ in South Asian archaeology,Ó The Indo-Aryans in Ancient South Asia : Language, Material Culture and Ethinicity (1997), pp. 134-137.

৩ এ বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় ‘মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে একটি অধ্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা আছে।