বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি খসড়া নোট

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি খসড়া নোট

হাসনাত কাইয়ূম

ভূমিকার বদলে
বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত এটা মূল সমস্যা না, মূল সমস্যা হলো এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ বা পদ্ধতি কি, এটা না জানা। সমস্যার আরও বড় দিকটি হলো এ পথ অনুসন্ধানের সূচনাবিন্দু নির্ধারণ না করতে পারা। কোত্থেকে শুরু করব আমরা? ঘুষ, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, গুম, নেশা, রিজার্ভ চুরি, সড়ক দুর্ঘটনা, শিক্ষা, নৈতিকতা, জনসম্পদ আত্মসাৎ, লুণ্ঠন, অর্থপাচার, পরিবেশ ধ্বংস, ভুল উন্নয়ন ইত্যাকার যেসব ইস্যু প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় সেসব ইস্যু, নাকি অন্য কোনো কিছু নিয়ে?

বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট অবশ্য সম্প্রতি বাংলাদেশের এসব সমস্যার একটা অন্যরকম একটা সারমর্ম তুলে ধরেছে। তারা বলেছে, আমরা এমন একটি পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি যেখানে ভালোমানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখতে পারছে না, রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে, মেধার পরিবর্তে ক্ষমতার মাধ্যমেই সরকারী অফিস নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দেখা দিয়েছে, নির্বাচন কমিশনও প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি, সামরিক শাসকরা ২ বার আমাদের রিপাবলিককে ব্যানানা রিপাবলিকে পরিণত করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোনো ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, আমাদের পূর্বপসূরীরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্য নয়।

কিন্তু বাংলাদেশ এ অবস্থায় কেন পড়ল স্বাভাবিক কারণেই তারা তা বলেননি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সংবিধানই এ রকম একটি একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামো তৈরী করেছে যার অধীনে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে না। এ ব্যবস্থায় ‘আমি’র বিপরীতে ‘আমরা’র চিন্তা করাই অপরাধ। আর ‘আমরা’র স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু আমরা যদি এ অবস্থা থেকে উদ্ধার চাই তা হলে বাংলাদেশকে আমার বদলে আমাদের বাংলাদেশে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের বাংলাদেশ বানানোর কাজটা আমরা কিভাবে, কোত্থেকে শুরু করব? অনেকে মনে করেন এটা হতে পারে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের চিন্তা এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবীতে তৎপরতা শুরু করার মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন হলো গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলতে আমরা তা হলে কি ধরনের নির্বাচনের কথা বলছি? বলা বাহুল্য, নির্বাচন হলো বৈধ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার প্রশ্নে সর্বোচ্চ লড়াই এবং বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন করেছে সবচেয়ে বেশি কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে সবচেয়ে কম।

আমরা কেমন নির্বাচন চাই, কেন চাই এবং আমাদের আকাক্সিক্ষত নির্বাচন ব্যবস্থা এদেশে প্রতিষ্ঠা করা আদৌ সম্ভব কি না, সম্ভব হলে তা কোন পথে সম্ভব, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আমরা সংক্ষেপে আমাদের নির্বাচনী রাজনীতি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনৈতিক কর্মকাÐ, আইন-কানুন, বিচার-আচার, আদালত, সংসদ, সরকার ইত্যাদি প্রায় সবকিছুই ব্রিটিশদের দ্বারা প্রণীত হয়েছে।

ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্য করতে এসে ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০০ বছর ভারত শাসন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই একটি ভিনদেশী কোম্পানীর দর্শন ছিল মুনাফা অর্জন এবং নিরাপদে তা নিজ দেশে প্রেরণ। কোম্পানীর শাসন-শোষণ-নির্যাতনে অতিষ্ঠ ভারতবাসী বিশেষত সেনাবাহিনীর এদেশীয় সৈন্যরা ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহের পর এদেশে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ মুনাফা অর্জন বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৫৮ সালে প্রথম ‘ইÐিয়ান গভর্ণমেণ্ট অ্যাক্ট, ১৮৫৭’ পাস করে এবং ভারতের শাসনভার কোম্পানীর হাত থেকে সরকারের নিজের হাতে তুলে নেয়। এটাই ছিল ভারতের প্রথম শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাদের এই শাসনতন্ত্রটি বেশ কয়েকবার সংশোধন করেছেন। এ শাসনতন্ত্রের অধীনে অনেক আইন তারা প্রণয়ন করেছেন, যার মধ্যে ‘ইÐিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১’ নির্বাচন ও আইনসভার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

এদেশে ব্রিটিশরা প্রথম নির্বাচনের আইন করে ১৮৮২ সালে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য। আর ভারতের সরকার পরিচালনায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার দাবী প্রথমবারের মতো উত্থাপিত হয় ১৮৮৫ সালে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলনে। ভারতীয় আইনসভায় ভারতীয়দের মধ্য থেকে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রথম সুযোগ সৃষ্টি হয় ‘ইÐিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১’-এর মাধ্যমে। এ আইনের সংশোধনী আনা হয় ১৮৯২ সালে এবং এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আইনসভায় ভারতীয়দের নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অবশ্য তখন নির্বাচন বলতে পরোক্ষ পদ্ধতিকেই বোঝানো হতো।

এদেশের মুসলিমরা মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা, আইনসভায় কোটা সংরক্ষণ এরকম বিভিন্ন দাবী করে আসছিল বঙ্গভঙ্গের আগে থেকেই। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের পর এ দাবী আরও জোরালো হয় আর ‘ইÐিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’ আর একবার সংশোধন করা হয় ১৯০৯ সালে।

১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে লক্ষেèৗ চুক্তিতে হিন্দুরা মুসলামানদের দাবীকৃত স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথাকে মেনে নেওয়ায় ভারতের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি নতুন দিগন্ত উšে§াচিত হয়। ১৯১৯ সালের আইনে কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা চালু হয়। উচ্চকক্ষের নামকরণ করা হয় ‘কাউন্সিল অব ষ্টেট’ আর নিম্নকক্ষের নাম করা হয় ‘সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলী’। ১৯২০ সালের হিসাব অনুযায়ী সমগ্র ভারতে ‘কাউন্সিল অব ষ্টেটের’ ভোটার ছিল মাত্র ১৭,৩৬৪ জন আর ‘সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলীর’ ভোটার সংখ্যা ছিল মাত্র ৯,০৯,৮৭৪ জন, কারণ সকল নাগরিকের ভোটাধিকার ছিল না। তখনো পর্যন্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্পদশালী, শিক্ষিত, সরকারী খেতাবপ্রাপ্ত বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মধ্যেই ভোটাধিকার সীমিত ছিল। ১৯১৯ সালের আইনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের উভয় কক্ষে নির্বাচিত সদস্যদের জন্য প্রত্যক্ষ বা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার বিধান চালু করা।

কিন্তু শুধুমাত্র এইটুকু সংশোধন .... ভারতের নাগরিকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। পরবর্তী সময় ভারতীয়দের আন্দোলন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমঝোতার ভিত্তিতে ১৯৩৫ সালে পুনরায় ইÐিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধন করা হয়। এ আইনে বলা হয়, আইনসভার সদস্য নির্বাচনে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা (সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা) অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ মুসলমান, হিন্দু, শিখ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের জন্য আইনসভায় আসন নির্দিষ্ট এবং এসব আসনে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।

প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য সংখ্যা প্রদেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যেমন নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা: মাদ্রাজ ২১৫, বোম্বে ১৭৫, বাংলা ২৫০, উত্তর প্রদেশ ২২৮, বিহার ১৫২, মধ্যপ্রদেশ ১১২, আসাম ১০৮, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ৫০, উড়িষ্যা ৫০ এবং সিন্ধু ৬০।

বাংলার ২৫০ আসনের মধ্যে সাধারণ ও তফসিলী হিন্দু মিলিয়ে ৭৮ আসন, মুসলমানদের জন্য ১১৭ আসন, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৯ আসন, ভ‚-মধ্যকারীদের ৫ আসন, শ্রমিকদের জন্য ৮ আসন এবং দুই সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য ২টি করে ৪টি আসন এবং অ্যাংলো ইÐিয়ানদের জন্য ১টি আসন সংরক্ষিত ছিল।

এই আইনের অধীনে প্রাদেশিক পরিষদের নিম্নকক্ষের জন্য ১৯৩৭ সালে একবার এবং ১৯৪৬ সালে আর একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষের কোনো নির্বাচন হয়নি। কেবল শিক্ষিত লোক, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ (যেমন রায়বাহাদুর, খানবাহাদুর) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান, কো-অপারেটিভ ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট প্রমুখ ক্যাটাগরীর ব্যক্তিদের ভোটাধিকার ছিল।

নির্বাচিত আইনসভার মেয়াদ ছিল ৫ বছর। অবশ্য গভর্নর জেনারেল ইচ্ছা করলে মেয়াদের আগেই আইনসভা বিলুপ্ত করতে পারতেন এবং মেয়াদোত্তরকাল পর্যন্ত তা বহালও রাখতে পারতেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ভোটার ছিল মোট জনসংখ্যার ১৪%। ১৯৪৬-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৫ ভাগে।

পাকিস্তান পর্ব
১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যে সব সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল তাদের মধ্য যাদের নির্বাচনী এলাকা নব-সৃষ্ট পাকিস্তানের ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে পড়েছিল তাদের নিয়েই সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। প্রতি দশ লক্ষ জনগণের জন্য একজন প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানে মোট ৬৯ জনকে নিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ গঠিত হয়। এর মধ্যে ৪৪ জন ছিল পূর্ববাংলার।

পরবর্তীকালে পশ্চিমাঞ্চলের দেশীয় রাজ্যসমূহ পাকিস্তানে একীভ‚ত হওয়ায় এবং ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মোজাহের পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে আশ্রয় নেওয়ায় এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৭৯ করা হয়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৪৬-এর পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ৫ বছর পরে ১৯৫১ সালে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে ১০-২১শে মার্চে পাঞ্জাবে, ৮ই ডিসেম্বর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে, আর সিন্ধুতে। পূর্ববাংলায় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে যদিও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনসমূহ অনুষ্ঠিত হয়, তবে বাংলাদেশ ছাড়া এসবের বেশীরভাগই ছিল ভোট-কারচুপি আর জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ।

অপরদিকে গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের কাজে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও গড়িমসি চলছিল। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদে একটি বিল ২৯-১১ ভোটে পাস হয়। কিন্তু উক্ত বিল বাস্তবায়নের পূর্বেই ২৪শে অক্টোবরে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল (প্রেসিডেন্ট) মালিক গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দেন। পরবর্তীকালে ফেডারেল কোর্টের আদেশ মোতাবেক দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদে ৭২ জন সদস্য ছিল নির্বাচিত এবং ৮ জন ছিল দেশীয় রাজ্য ও উপজাতি এলাকা থেকে মনোনীত।

দ্বিতীয় গণপরিষদ ১৯৫৬ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে সংবিধান গ্রহণ করে এবং ২৩শে মার্চকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। উক্ত সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থার বিধান রাখা হয় এ সংবিধানে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশ হতে সমান সংখ্যক সদস্যকে নিয়ে ৩০০ সদস্যের একটি জাতীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। ১০টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়।

প্রাদেশিক পরিষদ এবং জাতীয় সংসদে একই সাথে কেউ সদস্য থাকতে পারবে না এমন বিধান করা হয়। ২১ বছর বয়সের সকল নাগরিকের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। সংবিধানের ২২২ থেকে ২২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্যথায় অর্থাৎ বিলুপ্ত না হলে বিলুপ্ত হওয়ার নির্ধারিত তারিখের ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচনের ১৪তম দিনের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করতে হবে।

নির্বাচন পরিচালনা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকাÐ পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যবস্থাও করা হয়। প্রধান বিচারপতির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট একজনকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ হিসেবে নিয়োগ করার বিধান করা হয়। কমিশনের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। কিন্তু এই সংবিধান কার্যকর করার ২ বছরের মাথায় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন।

তার মাত্র ২০ দিনের মাথায় ২৭শে অক্টোবর আইয়ুব খান ইস্কান্দার মীর্জাকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেন এবং নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৯ সালের ফেব্রæয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন।

আইয়ুব খান ক্ষমতাগ্রহণের পর একটি কমিশন গঠন করেন এবং উক্ত কমিশন তার রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রপতি কিংবা জাতীয় পরিষদ এবং স্থানীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনের যোগ্যতা সম্পন্ন নয়। তাই ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ব্যবস্থায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের ৮০ হাজার সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং এই নির্বাচিত সদস্যরা দেশের রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচনের অধিকারী ছিলেন।

১৯৬২ সালের এ সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পাঁচ বছরের জন্য পেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা হয়। জাতীয় পরিষদে মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১৫৬ জন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭৫ জন করে ১৫০ জন, আর ৬টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন ফাতিমা জিন্নাহ সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) পক্ষ থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে আইয়ুব খানকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।

অগণতান্ত্রিক সংবিধান, কারচুপির নির্বাচন, সামরিক শাসন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রাখা, ভাষার লড়াই, শিক্ষার লড়াই, শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরির লড়াই, আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ইত্যাদি মিলে শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্টের পথ ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণ-অভ্যুত্থান গড়ে ওঠে তার মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ২৮শে নভেম্বর তিনি ঘোষণা করেন যতশীঘ্র সম্ভব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে যত দ্রæত সম্ভব দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র (সংবিধান) প্রণয়ন করা।

নির্বাচনের জন্য তিনি ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) জারী করেন। উক্ত ‘এলএফও’র অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহের বিরূপ সমালোচনা সত্তে¡ও বেশীরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে ছিল। ন্যাপ ভাসানী ঐ নির্বাচন বর্জন করে মূলত ২টি দাবীতে, (এক) নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদে শ্রমিক-কৃষকের জন্য আসন নির্দিষ্ট করতে হবে, (দুই) নির্বাচনের আগেই ১৯৪০ সালের লাহের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন মীমাংসা করতে হবে।

নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ ৬ দফা তথা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে রেফারেন্ডাম হিসেবে ঘোষণা করে এবং অংশ নেয়। জাতীয় পরিষদে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

বাংলাদেশ পর্ব
১৯৭১ সালে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র জনযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবিভর্‚ত হয়। ব্রিটিশদের অধীনে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে যেমন স্বাধীন পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়, হুবহু একই কায়দায় পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে ছয়দফা ভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হয় তাদের উপরেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে ১ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনের দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসটা সবার জানা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যত ধরনের অনিয়ম ও অপরাধ কল্পনা করা সম্ভব অর্থাৎ বর্তমানে আমরা যত ধরনের নির্বাচনী সমস্যা মোকাবিলা করি তার প্রত্যেকটির অবাধ প্রয়োগ করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে। মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা প্রদান, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বিরোধীদের উপর চাপপ্রয়োগ, সম্ভাব্য প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের গুম-খুন, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়া, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়া অর্থাৎ নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সরকারী/রাষ্ট্রীয়/দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকার-বিরোধীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথচলা শুরু। পরবর্তীকালে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারীতে জারী করা ৪র্থ সংশোধনী অপরাপর অনেক বিষয়ের সাথে নির্বাচনী ইতিহাসে যে বিষয়টি সৃষ্টি করে এক কথায় তাও নজীরবিহীন। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ইতিপূর্বে অর্থাৎ ৭৩ সালে যারা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল তাদেরকে পুনরায় আরো ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হিসেবে ঘোষণা করা হয। সংবিধান সংশোধনই নির্বাচনের স্থান দখল করে বসে।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট একটি মর্মান্তিক সামরিক অভ্যুত্থানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশ কয়েকজন সামরিক কর্তাব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং বেশ কয়েকজন সামরিক শাসকের হাত বদল শেষে ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসনের অধীনেই দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংসদেই শাহ আজিজুর রহমাকে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়। বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান খান।

১৯৮১ সালের ৩০শে মে আর এক মর্মান্তিক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কিছু দিন পর ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারী করে লে. জে. হু. মু. এরশাদ। পূর্ববর্তী সামরিক রাজনীতিক জিয়াউর রহমানের পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনিও একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে ১৯৮৬ সালের মে মাসে ৩য় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামীলীগ সহ মোট ১১টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৮৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর এ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সালে পুনরায় ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এই নির্বাচনে আ. স. ম. রবের নেতৃত্বে কয়েকটি কাগুজে দল ছাড়া দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থীরা এ নির্বাচন বর্জন করে।

১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগের আগে এরশাদ এই সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

আমার ভোট আমি দেব...
সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের অভিমুখ ছিল স্বৈরাচারের অবসান ও আকাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্রের অনেক উপাদান নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে ওঠার পরিস্থিতিও তৈরী হচ্ছিল তখন, তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের প্রশ্ন। কারণ এর পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে বা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে এমন কোনো নজীর ছিল না। সেজন্যে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বরাবরই সরকার পরিবর্তন হয়েছে অবৈধ পন্থায় এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অথবা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়কালে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির একটি সেøাগান : ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশী তাকে দেব’ জাতীয় দাবী হিসেবে আবিভর্‚ত হয়। আর এ দাবীটা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে উত্থাপিত হয়, ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকারের রূপরেখা’। আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সংস্থা, তিন রাজনৈতিক জোট ছাড়াও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (্স্কপ), ১৭টি কৃষক ও ক্ষেত মজুর সংগঠন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার শক্তিকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের শর্ত হিসেবে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের রূপরেখাকে সমর্থন করে এবং এর দাবীতে আন্দোলন করে।

এরশাদ পতনের পর সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মদকে প্রধান করে শুধুমাত্র নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ গঠন করা হয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রধানের থেকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে অঙ্গীকার অনুযায়ী ফেরত দিতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়। সংবিধানে যা একাদশ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এটাই একমাত্র সংশোধনী যেখানে জনগণের পক্ষে আন্দোলনকারী প্রায় সকল সংগঠনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই একটি সংশোধনীতে পূর্বের ক্ষমতাসীনদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। (আগ্রহীরা সংশোধনীর ভ‚মিকাটি দেখে নিতে পারেন)।

নির্বাচন কমিশন নয়, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী নির্ধারণ করে নির্বাচনের পরিবেশ
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পরাজিতদের পক্ষ থেকে মৃদু সমালোচনা সত্তে¡ও বাংলাদেশের ইতিহাসে সে নির্বাচনটিই আজ পর্যন্ত সবচাইতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

এ নির্বাচন পরিচালিত হয়েছিল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আঃ রউফের নেতৃত্বে। উক্ত নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতাসীন হয় এবং বিএনপি আমলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার আঃ রউফ স্বপদে বহাল ছিলেন। কিন্তু বিএনপি সরকারের অধীনে প্রথম উপ-নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়েই তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। পরবর্তীকালে মাগুরার উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় তিনি সরকারের পক্ষে এতটাই পক্ষপাতিত্ব করেন, যার কারণে তখন নির্বাচন ‘মাগুরা ষ্টাইল’ হিসাবে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন যে দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে পারে না সেই বক্তব্যটি নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত তা আদায় করতে সক্ষম হয়। সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাংবিধানিক ইতিহাসে এটি ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী’ হিসেবে খ্যাত। ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় গঠিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সমালোচনা সত্তে¡ও নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের নজীর স্থাপন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে উচ্চ আদালতের বিতর্কিত এক রায় এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থাকে বাতিল করায় বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা যতটুকু ইমেজ দীর্ঘ আন্দোলনের পর উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল তা সমূলে ধসে পড়ে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী দাবী করে ১৯৯৬ সালে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন জনৈক সৈয়দ মশিউর রহমান। বিচারপতি এমডি মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি এম.এ. মতিন প্রাথমিক শুনানি শেষে কোনো রুল জারী না করেই মামলাটি খারিজ করে দেন। পরবর্তীকালে (মরহুম) অ্যাডভোকেট সলিমউল্লাহ আর একটি রিট পিটিশন দায়ের করলে এর শুনানিকালে বিচারপতি শাহ আবু নঈম এবং বিচারপতি এমডি আব্দুল আওয়াল, আগের মামলার খারিজ আদেশের সাথে একমত হতে না পারায় মামলাটি শুনানির জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ করেন। প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এমডি জয়নুল আবেদীন, বিচারপতি এমডি আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মীর্জা হোসেন হায়দারের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। বৃহত্তর বেঞ্চ মামলাটি শুনানি শেষে ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী’ অবৈধ নয় মর্মে ঘোষণা দিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেন। তবে তারা তিনজনই পৃথক পৃথক রায় দেন এবং রিটকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করেন যে মামলাটিতে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।

আপীল বিভাগের চেম্বারজজ মামলাটি আপীল বিভাগের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পর আপীল বিভাগ জনাব টি. এইচ. খান, ড. কামাল হোসেন, রফিক উল হক, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এম. আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দীন মাহমুদ এবং আজমালুল হোসেন প্রমুখের Amicus Curiae (আদালতের সহায়তাকারী বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ করে। শুনানিতে ৮ জনের মধ্যে আজমালুল হোসেন ছাড়া বাকী ৭ জন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সমর্থন করে শুনানি করেন। আওয়ামী লীগ তাদের লিখিত জবাবে এবং বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষ অবলম্বন করেন।

শুনানি শেষে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এমডি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস. কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের পরিপন্থী এবং বাতিল ঘোষণা করেন। তবে পরবর্তী ২টি নির্বাচন জনস্বার্থে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মতপ্রকাশ করেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের তত্ত¡াবধায়ক প্রধান হওয়ার বিধানটি পরিবর্তনের নির্দেশ দেন।

অপরদিকে বিচারপতি এম. এ ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং বিচারপতি ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী নয় বলে রায় প্রদান করেন। বিচারপতি এম. এ. ওয়াহাব তাঁর রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক ঘোষিত রায় এবং লিখিত রায়ের মধ্যে পার্থক্যের জন্য সমালোচনাও করেন। বিধি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থা সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়।

এই রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা এ পরিসরে না করেও এটুকু দেখা যায় যে, হাইকোর্ট পর্যায়ে অন্তত ৭ জন বিচারপতি এবং আপীল বিভাগের অন্তত ৩ জন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ মনে করেননি। এ ছাড়া হাইকোর্ট এরং আপীল বিভাগ মিলিয়ে দশজন Amecus Curiae-এর মধ্যে ৯ জনই ছিলেন ত্রয়োদশ সংশোধনী বহাল রাখার পক্ষে। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের ইতিহাসে যে ১৬টি সংশোধনী আজ পর্যন্ত আনা হয়েছে তার মধ্যে একমাত্র এটিই ছিল দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ নাগরিকদের আন্দোলন দ্বারা সমর্থিত।

জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নিরবচ্ছিন্ন শাসনের কথা বলে এ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু এ রায়ে জনগণকে স্থায়ীভাবে অনির্বাচিত বা কুনির্বাচিতদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পরিবেশই তৈরী করে, যার আশংকা ১ জন ছাড়া প্রত্যেক এমিকাস কিউরিই করেছিলেন।

ক্ষমতার জন্য সেবাবাহিনী থেকে সরে উচ্চ আদালতের ব্যবহার
গণ-আন্দোলনের মুখে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং উচ্চ আদালতের রায়ের বরাতে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিদায় বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থাকে অক্ষুণœ রেখে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রণালী এখানকার শাসক রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের মিত্ররা সম্পন্ন করেছিল ৯০ সালে, জাতীয় সংসদের তিনটি নির্বাচনের পর ২০১১ সালে তা থেকে সরে আসে তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর এ সরে আসার ‘বৈধ ’ ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় উচ্চ আদালতের একটি রায়। উচ্চ আদালতের এ রায় নিয়ে এখানে শুধু সংক্ষেপে এটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই রায়ে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ পুনরুজ্জীবিত হয়। অনুচ্ছেদ ১২৩ অনুযায়ী ক্ষমতাসীনরা শুধু ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন পরিচালনা ও অংশগ্রহণ নয়, বরং নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর পরবর্তী সংসদ ক্ষমতা গ্রহণেরও পূর্ব পর্যন্ত প্রাক্তন সাংসদদের সদস্যপদ বহাল থাকে।

ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় খোদ ৭৩ সালের নির্বাচনের সংস্কৃতিসহ পুরনো সাংবিধানিক অবস্থা ফেরত আসে। দেশ এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যা সেনাবাহিনী কিংবা একদলীয় শাসন ব্যবস্থারই অনুরূপ, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে আরো নিয়ন্ত্রণমূলক। নির্বাচন না দেওয়া কিংবা সামরিক শাসকদের অধীনে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ পাকিস্তান আমল থেকে আন্দোলন করে আসছিল তার সকল অর্জনকেই উচ্চ আদালতের একটি বিতর্কিত রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণ যে নৈতিক মনোবল নিয়ে লড়তে সক্ষম ছিল স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে তার ঘাটতি দেখা দেয়। আন্দোলনকারী জনগন উচ্চ আদালত প্রশ্নে অনেক বেশী নাজুক এবং দোদুল্যমানতায় নিপতিত হয় এবং সেই ক্ষেত্রে এটি এক বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দেয়।

প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি সস্পর্কে
আগেই বলা হয়েছে বাংলাদেশে বর্তমানে যে নির্বাচন পদ্ধতিটি জারী আছে, তার সূত্রপাত ব্রিটিশদের হাতে, ভারতের পরাধীনতার কালে। ভারতে শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বশংবদ শ্রেণী ও নেতৃত্ব গড়ে তোলা, তাদের পেছনে জনসমর্থনকে তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিকতায় আটকে রাখা, ভারতের স্বাধীনতার দাবীতে যারা সশন্ত্র লড়াই গড়ে তোলার পক্ষে তাদের মোকাবিলা করাÑ এ রকম বিবিধ কারণে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এদেশে প্রথমে স্থানীয় শাসকদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ক্রমান¦য়ে নিজেদের লোকদের নেতৃত্বে এবং পরিচালনায় ভারতীয়দের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়।

সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাকে মোকাবিলা করা এবং ব্রিটিশদের অনুগতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার কৌশল হিসেবে ব্রিটিশরা নির্বাচন পদ্ধতিকে ব্যবহার করায় এদেশের আপোষহীন সংগ্রামীদের কাছে খোদ নির্বাচনী ব্যবস্থাটিই একটি নেতিবাচক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠে এবং এই নেতিবাচক ধারণার সাথে মার্কসবাদীদের ‘বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লবের তত্ত¡’ যোগ হওয়ায় এ প্রবণতা এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পায়, যাতে খোদ নির্বাচনই এদেশে বিপ্লবী ঘরানার অনেকের কাছে বিরোধিতার বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে এরা নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রæটি-বিচ্যুতি, অগণতান্ত্রিকতা ইত্যাদি পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই এর ফল হয়েছে মারাত্মক। ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচন পদ্ধতির যতটুকু সুফল তার সবটুকুই একচ্ছত্রভাবে ভোগ করেছে এখানকার শাসকগোষ্ঠী, কখনো নির্বাচন করে, কখনো না করে।

বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার প্রসঙ্গে যে মিথগুলো সাধারণভাবে ব্যাপক মাত্রায় প্রচলিত আছে, তার মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি :

ক. এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করার অধিকার ভোগ করেন।

খ. সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়।

গ. সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে কারণ ৫ বছর পর তাদের পুনরায় জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হয়।

ঘ. এতে পূর্ণ বয়স্ক সকল নাগরিকের সরকার পরিচালনায় মতামত প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ঙ. রাষ্ট্রের মালিকানা যে জনগণের তা প্রমাণ হয়।

প্রকৃতপক্ষে উপরে প্রচারিত ধারণাগুলোর প্রায় সবই হয় অসত্য অথবা অর্ধসত্য বা মিথ্যা। কারণ :

ক.       এ নির্বাচন ব্যবস্থায় বাংলাদেশেকে ৩০০টি আসনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বীসহ অপরাপর প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রদানকারী জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কোনো সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। বাংলাদেশের এ যাবৎকালের নির্বাচনের ভোটের হিসাব থেকে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তরা সরকার গঠন করেছে আর বাকী ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটার রয়েছে প্রতিনিধিত্বহীন। এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের বদলে সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠদেরকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়। প্রথম থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয় বলে সবকারগুলো সাধারণভাবে বলপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং কর্মীদের মস্তানিকেও প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। সমাজে অস্থিরতা স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। যেহেতু অধিক আসনে জয়ী হলে সরকার গঠন করা যায়, ফলে আসন ভিত্তিক কালো টাকার মালিক, মস্তানদের পরিচালনায় দক্ষ মাফিয়া, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বা আমলা কর্মকর্তার সাথে দহরম-মহরম আছে এমন লোকদের কাছে দলের নিষ্ঠাবান, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত জনস্বার্থে নিবেদিত সৎ মেধাবী নেতৃত্ব বলি হয়ে যায়। সমাজে যেনতেন উপায়ে টাকা কামানোই রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে ওঠে।

খ.       বর্তমান আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো সংসদ সদস্যই আর জনগণের প্রতিনিধি থাকতে পারেন না। আইনানুযায়ী তিনি দলীয় প্রতিনিধিতে পরিণত হন। দলের সিদ্ধান্তের বা স্বার্থের বাইরে জনগণের কিংবা তার নির্বাচকমÐলীর প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ীই তার সদস্যপদ বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে।

গ.       বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সরকারপ্রধান কারো কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। দলের সদস্যরা সরকারপ্রধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। প্রতি ৫ বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার যে বিধান এখন পর্যন্ত আইন ও সংবিধানে রয়েছে সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্য সরকারে আসীনরা জনগণের মাঝে কৃত্রিম বিরোধ, বিভ্রান্তি ও বিভক্তি তৈরীর কাজেই পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। একদিকে এরা পরবর্তী নির্বাচনে ব্যাপক বিনিয়োগ ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বিপুল মাত্রায় লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের অর্থ ও সম্পদ কুক্ষিগত করে, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার উচ্চ পদস্থদের অজস্র অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগদানের বিনিময়ে সেই সব সংস্থাকে জনগণ ও জনগণের পক্ষের সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তিকে দমন ও নিশ্চিহ্ন করার অন্যায় কাজে ব্যবহার করে। ফলে জনগণের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ক্রমে জনবিরোধী হয়ে উঠতে থাকে।

বস্তুত মিথ্যাচারের উপর দাঁড়ানো যে নির্বাচন ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থাকেই গণতন্ত্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে প্রতিনিয়ত মহিমান্বিত করার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সরকারের দেশী-বিদেশী বন্ধু, বিশেষজ্ঞ আর বুদ্ধিজীবীরা। তারা এই ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েও কথা বলেন এবং প্রায়ই বিভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করেন যার মধ্যে নীচের দুটি প্রস্তাব প্রায়শই আমরা শুনতে পাই :

১.        নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে,

২.       কালোটাকা, পেশীশক্তি ও সরকারের প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল রাজনীতিবিদদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিদেশী দাওয়াই হলো এই প্রথম প্রস্তাব, অর্থাৎ একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান মিডিয়া, সরকার এবং বিরোধী দল সকলে মিলে এ বিষয়ে এত বেশি ঐকমত্যের মধ্যে অবস্থান করে যে তারা একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য ‘সার্চ কমিটি গঠন’ এবং সার্চ কমিটির কাছে তাদের সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিনিধিদের নামের তালিকা প্রদান করার সুযোগ পেতেও সদাসর্বদা উদগ্রীব থাকেন।

এ ক্ষেত্রে প্রতারণাটা বোঝার জন্য রউফ কমিশনের উদাহরণই যথেষ্ট হতে পারে। বিদ্যমান শাসনকাঠামোতে নির্বাচন কেমন হবে এটা কখনোই নির্বাচন কমিশন ঠিক করতে পারে না। নির্বাচন কেমন হবে এটা নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। কারণ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তার জন্য এমনভাবে বিন্যস্ত করা আছে, যা সামরিক শাসক কিংবা সম্রাটের চেয়েও বেশী। তত্ত¡াবধায়ক সরকাব ব্যবস্থার যে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সাফল্য, সেটা এজন্যে যে, ওই ৯০ দিন সময় এমন কেউ ক্ষমতাসীন থাকে না যিনি সরাসরি দলীয়। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছে তত্ত¡াবধায়ক আমল ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কোনো নজীর নেই।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলতে আমরা কি বোঝাতে চাইছি?

আমাদের সকলের জানা অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের কিছু বিষয়ে আমরা আবারও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চাই।

আমরা জানি রাজতন্ত্র মানে রাজার তন্ত্র, এ তন্ত্রে রাজাই সব। তিনি দেশের মালিক, আইনের মালিক, রাষ্ট্রের মালিক। তার মালিকানা সুসংহত করার জন্যই আইন-কানুন, বিচার-আচার ইত্যাদি। এসব আইন-কানুন বাস্তবায়নের জন্যই গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে গণতন্ত্র মানে ‘গণ’দের তন্ত্র। যেখানে দেশের মালিক, রাষ্ট্রের মালিক, ক্ষমতার মালিক সবই জনগণ। সেখানকার আইন, বিচার, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি সবই এমনভাবে প্রণয়ন করার কথা যাতে জনগণের মালিকানা, মর্যাদা, অধিকার ইত্যাদি কেউ খর্ব করতে না পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গড়ে তোলা হয় তেমনভাবে যাতে জনগণের ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, তা সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে।

ধর্মতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব ঈশ্বর বা স্রষ্টার, রাজতন্ত্রে রাজার, কিন্তু গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব ব্যক্তির, নাগরিকের।

এসব অতি প্রাথমিক কথাবার্তা মাথায় রেখেই আমরা বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা জনগণের, সে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি তদারকির ক্ষমতা জনগণের। জনগণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যদি অন্যথা হয় তবে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের শাস্তি বিধানের ক্ষমতাও জনগণের। এই তিনটি অধিকার যে রাষ্ট্রের জনগণ যদ্দুর মাত্রায় ভোগ করে, সে রাষ্ট্র তদ্দুর মাত্রায় গণতান্ত্রিক। একটি রাষ্ট্রে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা নাকি প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা, সংসদ কি এক কক্ষবিশিষ্ট নাকি দুই কক্ষবিশিষ্ট, রাষ্ট্রটি ফেডারেল নাকি এককেন্দ্রিক (এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিগত দিক)Ñ এসবের সাথে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্পর্ক অতি সামান্য, নেই বললেও চলে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে একটি সামাজিক চুক্তির ভেতর দিয়ে বর্তমানে যার স্থান নিয়েছে লিখিত সংবিধান। রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, কারা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় যোগ্য হবে, কি পথে তারা নিযুক্ত হবে, কি পথে বিদায় হবে, তারা কি কি করার অধিকারী হবে, কি করতে পারবে নাÑ এসব বিষয়ে একটি প্রাথমিক মতৈক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সামাজিক চুক্তির সেই দলিল তথা সংবিধানে উপরে উল্লিখিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা যদি না থাকে তবে কোনো পদ্ধতিগত সংস্কার করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

সাধারণভাবে নীতি হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত সংখ্যালগিষ্ঠরা মেনে নেবে, এটা গণতন্ত্রে একটি স্বীকৃত নীতি। কিন্তু তার চাইতেও বড় নীতি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠরা কোনো কারণেই ব্যক্তির মৌলিক আধিকার খর্ব করতে পারবে না।

আমরা কেমন নির্বাচন ও সংসদকে গণতান্ত্রিক বলে মনে করি

১.        আমরা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী পদ্ধতি চাই। আমরা প্রত্যেক নাগরিকের প্রদত্ত ভোটের মূল্যায়ন হবে এমন ব্যবস্থা করতে চাই। একটি নির্দিষ্ট আসনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে আর বাকী প্রার্থীদের সমর্থনে যে-সমস্ত ভোটার ভোট প্রদান করেছেন, কার্যত তাদের ভোট বাতিল হয়ে যাবেÑ এ ব্যবস্থার অবসান চাই। প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠিত হবে এমন ব্যবস্থা চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার শুভঙ্করের ফাঁকির আড়ালে অধিক মানুষের পছন্দের প্রার্থীরা বাদ পড়বে, কিন্তু কম ভোটপ্রাপ্তরা নির্বাচিত হয়ে আসবে, এ অবস্থার বিলোপ চাই।

ক)       ধরা যাক, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের জন্য নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে যেসব দল প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবে তাদের মধ্যে ১% ভোট যারা পাবেন, সেই দলও সংসদে ৩টি আসনে জয়ী বলে বিবেচিত হবে। এ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক দল, তাদের দলীয় নির্বাচকমÐলী তথা সদস্যদের মনোনয়ন অনুযায়ী নির্বাচনের পূর্বে তাদের প্রার্থীতালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করবে। তালিকার প্রথম দিক থেকে ক্রমানুসারে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সদস্যরা নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবেন।

খ)       এভাবে প্রাপ্ত ভোটের ৫১ শতাংশ যারা পাবেন সেই দল সরকার গঠন করবে। কোনো একক দলের পক্ষে ৫১% ভোটারের সমর্থন পাওয়া সম্ভব না হলে সর্Ÿোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দল নিকটতম সমমনাদের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে।

গ)       সংসদীয় কমিটিসমূহের প্রধানগণ বিরোধী দলসমূহ থেকে নির্বাচিত হবেন। সংসদীয় কমিটির ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে হবে। জনগণের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংসদে বিল উত্থাপনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

ঘ)       সংসদ সদস্যগণ আইন প্রণয়নের বাইরে অপরাপর কোনো কর্মকাÐ, বিশেষত কোনো উন্নয়ন কর্মকাÐে অংশ নিতে পারবে না।

ঙ)       প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির সম্পদের বিবরণ, আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের জন্য উš§ুক্ত থাকতে হবে এবং প্রতি ছয় মাস পরপর তাদের হিসাবের সর্বশেষ অবস্থা জানাতে হবে। অনৈতিক আয়ের সাথে সংশ্লিষ্টদের সদস্যপদ বাতিল হবে।

চ)       প্রতি ৪ বছর পর পর জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ছ)       দুই বারের বেশী কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নিতে পারবেন না। নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের বিপরীতে অবস্থান নিলে সদস্যপদ বাতিলের আইন থাকতে হবে।

জ)       নির্বাচনের সাধারণ ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে, তবে নিবন্ধনের শর্ত পূরণে সক্ষম নয় এমন দলসমূহ নিজ উদ্যোগে এবং নিজ খরচে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন

১.        স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বাইরে থাকবে। দেশের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাÐ স্বাধীন স্থায়ীয় সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।

২.       স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। তবে জনগণের কাছে তাদের প্রত্যাহার করার (রিকল) ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

আমরা এমন নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যাতে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকে।

এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা কি আমরা চাইলেই কার্যকর হবে? অথবা এসব দাবী-দাওয়া আদায়ের পথই বা কি? এ বিষয়ে আমাদের মতামত তুলে ধরার আগে আমাদের নিকট অতীতের ২টি ভিন্ন ধরনের নির্বাচনের ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করে নিতে চাই।

২টি ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন অভিজ্ঞতা

(১) ১৯৪৬ সালের নির্বাচন, পাকিস্তানের পক্ষে রেফারেন্ডাম

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন হয় ১৯৩৭ সালে।

ভারতের মোট ১১টি প্রদেশেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে কংগ্রেস ৬টি প্রদেশে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। মুসলিম লীগের ফলাফল ছিল বেশ হতাশাব্যঞ্জক। ১১টি প্রদেশে মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত মোট ৪৮২টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫১টি আসন পায় মুসলিম লীগ। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতারা কংগ্রেস থেকে মনোনয়ন নিয়ে ৫৮টি আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে ২৬টি আসনে বিজয়ী হয়। বাংলায় এ. কে. ফজলুল হকের ‘কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি)’ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৬টি আসনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন পদক্ষেপ মুসলিম লীগকে ভারতের মুসলমানদের একক পার্টিতে পরিণত করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তান ইস্যুর ভিত্তিতে অংশ নেয়। বাংলায় হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াার্দী এবং আবুল হাশিমের নেতৃত্বে এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুসলমানদের জন্য বরাদ্দকৃত ১১৭টি আসনের মধ্যে ১১০টি আসনই মুসলিম লীগ দখল করে নেয়, অথচ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ মাত্র ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে যেখানে কৃষক প্রজা পর্টি ৩১.৫১% ভোট পেয়ে ৩৬টি আসন জয় করেছিল সেখানে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪টি আসনে জয়ী হয় তারা, ভোট নেমে দাঁড়ায় ৫.৩০%। অপরদিকে মুসলিম লীগ গ্রামাঞ্চলের ৯৩.৬৯% ভোট লাভ করে, যেটা ১৯৩৭ সালে ছিল মাত্র ২৬.১৩%।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অনেক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় লাভ করেছিল, কিন্তু ১৯৪৬ সালে তা নেমে আসে মাত্র ২ জনে।

ভারতের মোট ৪৮২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৩টিতে জয়লাভ করে মুসলিম লীগ। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ মুসলমান ভোটারদের ৪.৮% ভোট পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪.২%। ১৯৩৭ সালে ভারতের ১১টি প্রদেশের ৫টি প্রদেশে মুসলিম লীগ কোনো মনোনয়ন দিতে পারেনি। কিন্তু ১৯৪৬ সালে সব প্রদেশে শুধু মনোনয়ন নয়, দলটি নিরঙ্কুশ বিজয়ী হিসেবে আবির্ভ‚ত হয়। বোম্বে, মাদ্রাজ ও উড়িষ্যায়ও ১০০% আসনে বিজয়ী হয় তারা।

মুসলিম লীগের এ নজীরবিহীন বিজয়ই এক বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মতো একটি অবাস্তব-অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্রপ্রকল্পকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তোলে।

(২) ১৯৭০-এর নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা

১৯৪৬-এর নির্বাচনের মতো প্রায় একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে।

১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, ১৯৭০ সালের ৫ ই অক্টোবর দেশে জাতীয় পরিষদের এবং ২২শে অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি Legal framework order (আইন কাঠামো আদেশ)-এর মূল বিষয়গুলো ঘোষণা করেন।

এ ঘোষণায় তিনি উল্লেখ করেন ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর ভিত্তিতে প্রদেশসমূহের জন্য গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হবে। এর ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ১৬২, পাঞ্জাব ৮২, সিন্ধু ২৭, বেলুচিস্তান ৪, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ১৮ এবং উপজাতি এলাকার জন্য ৭টি আসন বণ্টন করা হয়। এ ছাড়া সংরক্ষিত মহিলা আসনের ১৩টির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৬টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়। পাকিস্তানের ২ ইউনিট পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ করে আসন বরাদ্দ রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসন আবার পশ্চিমের চার প্রদেশের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

২১ বছরের প্রত্যেক নারী-পুরুষকে ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা যা ১৯৫৬-এর সংবিধান বাতিল করেছিল তা বহাল রাখা হয় অর্থাৎ সর্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়।

২৫ বছর বয়স্ক যে কোনো ভোটারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখা হয়। অবশ্য ১৯৬৯ সালের ১ লা আগষ্টের পর পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন এমন লোকদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ, সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার ২ বছর অতিবাহিত হয়নি, কিংবা সরকারী চাকুরীজীবীর স্বামী বা স্ত্রী, দেউলিয়া ব্যক্তি ইত্যাদিকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এই Legal frame work order-এর ১৪ ধারায় বলা হয় যে, জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র (সংবিধান) প্রণয়ন করার জন্য প্রেসিডেন্ট তার বিবেচনামতো উপযুক্ত স্থান, তারিখ ও সময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহŸান করবেন। অধিবেশনের সময় থেকে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হলে পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে।

জাতীয় পরিষদে পাস করা বিল প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ আইনসভা হিসেবে কাজ শুরু করতে পারবে না। ঐ বিল প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ঐ বিলে অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে না।

এ আদেশে এও বলা হয় যে উক্ত আদেশের কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে প্রেসিডেন্টের ব্যাখ্যাই চ‚ড়ান্ত হবে এবং এ বিষয়ে কোনো আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।

উক্ত এলএফওর অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহের বিরূপ সমালোচনা সত্তে¡ও ন্যাপ ভাসানী ছাড়া বেশীরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে ছিল।

নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ ৬ দফা তথা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে রেফারেন্ডাম হিসেবে ঘোষণা করে জাতীয় পরিষদে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের ২৯৮ আসনে জয়লাভ করে।

নির্বাচন কয় প্রকার
সাদা চোখেই আমরা দেখতে পারি নির্বাচন অন্ততপক্ষে ২ প্রকার। এক প্রকার হলো সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ সরকার পরিবর্তন বা নির্ধারণের নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজের নিজের দলীয় নির্বাচনী মেনিফেষ্টো নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের বিজয়ীরা সরকার গঠন করে। মূলত পরবর্তী ৫ বা ৪ বছর কারা দেশ শাসন করবে, তাই নির্ধারিত হয় এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে।

আর এক ধরনের নির্বাচনে নির্বাচিতরা সাধারণত দেশের সংবিধান পরিবর্তন কিংবা প্রবর্তনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। এ ধরনের নির্বাচনকে সাধারণত ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ বলা হয়। ১৯৪৬ এবং ১৯৭০ সালে দুইবার ২টি গণপরিষদ নির্বাচন হয়েছে এ দেশে। এই ২টি নির্বাচন ইতিহাসের বড়রকম ২টি রাজনৈতিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এমন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখে যখন দেশ এসে দাঁড়ায়, যখন মানুষ নির্বাচনকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের যে আন্দোলন তারই একটি রূপ হিসেবে গ্রহণ করে তখন অবৈধ অর্থ, পেশীশক্তি, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ থাকা বা না থাকা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারÑ কোনো কিছুই জনগণকে প্রতিহত করতে পারে না বরং জনগণ সকল বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে তাদের কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক পরিবর্তনকে নিশ্চিত করার জন্য ‘নির্বাচনী অভ‚্যাত্থান’ এর পক্ষ বেছে নেয়।

অবশ্য তেমন একটি নির্বাচনী অভ‚্যত্থানের জন্য প্রয়োজন এমন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী যে কর্মসূচীর মাঝে জনগণ তাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের পথরেখা দেখতে পায়।

বর্তমান বাংলাদেশ এমন একটি কর্মসূচীর অধীনে তেমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন আর ইতিহাসের তৃতীয় গণপরিষদ নির্বাচনে একটি ‘নির্বাচনী অভ‚্যত্থান’ করার জন্য আন্দোলন শুরুর অপেক্ষায়।

শেষ কথা
উপরে যে ২ প্রকারের নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এ ২টিই ব্রিটিশ পদ্ধতি। ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এ রকম দেশসমূহে এ ধারার নির্বাচন পদ্ধতিই চালু আছে। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশ নয় এ রকম দেশসমূহের অধিকাংশই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি অনুসরণ করে। ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এমন কোনো কোনো দেশও যেমন শ্রীলঙ্কা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু করেছে। এ ছাড়া আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপালও তাদের সংবিধানে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত করেছে। আমরা চাই নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক ধারাবাহিক আলোচনা। ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ আপনাদের সাথে নিয়ে এ আলোচনাকে এমন মাত্রায় বিস্তৃত করতে চায় যাতে আগামী নির্বাচনে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’ নিজেই একটা নির্বাচনী দাবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং জনগণ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু গতানুগতিক সাধারণ নির্বাচনে এ দাবী পূরণ হওয়ার নয়। এ দাবী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পড়বে ৪৬ কিংবা ৭০-এর মতো গণপরিষদ নির্বাচন। সে নির্বাচন অনুষ্টনের পথ কি হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *