জাতীয় সংসদ নির্বাচন : রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের রাজনীতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন : রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের রাজনীতি

[রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে উত্থাপিত।]


বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি হলো এতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বা সরকার বদলের পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া আছে। এ বৈশিষ্ট্যটি এমন কার্যকরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিল যে, ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতাসীনরা কখনো পরাজিত বা ক্ষমতাচ্যুত হয়নি। এই সংবিধানের অপর একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অধীনে যারা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায় তারা যে-ধরণের ক্ষমতা ভোগ করে তার নজীর সভ্য দুনিয়ায় আর একটাও নাই বললেই চলে। এখানে যিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসাবে মনোনীত হন, তিনি হন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক; রাষ্ট্র ও সংবিধান হয় তার অধীন; তিনি কারো কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকেন না, বরং রাষ্ট্রের সকলেই তার কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য থাকে। ফলে প্রধান নির্বাহী ছাড়াও সরকারের সাথে যারা যুক্ত থাকেন, তারাও তার অনুগ্রহে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে বসবাস করেন। আর তাদের ধন-সম্পদের পরিমাণ এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াতেই অর্জন করা সম্ভব হয় না।
এ দুইয়ের সম্মিলিত ফল হয়েছে ভয়াবহ। একদিকে নজীরবিহীন ক্ষমতার জোরে বিরোধী দলসহ যাকে-খুশী-তাকে দমন-পীড়ন, আর অন্যদিকে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার পরিস্থিতিকে এমন মাত্রায় অস্বাভাবিক করে তোলে, যার অনিবার্য পরিণতি হিসাবে এখানে বারবারই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে অস্বাভাবিক এবং হিংসাত্মক পথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেনা-অভ্যুত্থান, কোনো কোনো সময় গণ-অভ্যুত্থান বা কোনো সময় দুই এর উদ্ভট মিশেলে। ফলে রাজনীতি থেকে সুস্থ আদর্শিক প্রতিযোগিতা, সহনশীলতা ও সৃজনশীলতা নির্বাসনে গেছে; আর বিপরীতদিকে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, হামলা, মামলা, হত্যা-খুন-মাস্তানী ইত্যদির কদর দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন সে নিজেই রাজনীতিকে গিলে ফেলেছে।


বাংলাদেশের জনগণের সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এখানকার শাসক দলগুলি ভোটের অধিকারের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল, এবং তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে এই সমস্যাটির একটি আধা-খেচড়া বা আংশিক সমাধান বের করেছিল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করে। পুরো সংবিধানটির ক্ষমতা-কাঠামোর যে সংশোধন প্রয়োজন ছিল, তা না করে তারা কেবল নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত যে বিধানসমূহ ৭২-এর সংবিধানে ছিল, সেইসব বিধানকে নির্বাচনের সময়কালের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও এদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এগুলিই ছিল তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু এ ব্যবস্থার যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি এ সময়কালে দৃশ্যমান হচ্ছিল এখানকার রাজনৈতিক দলগুলি তার প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোনো উদ্যোগ তো গ্রহণ করেইনি, উল্টো এসব ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে কিভাবে দলীয় স্বার্থ হাসিল করা যায় তার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতাকে এমন মাত্রায় কলুষিত করেছিল যাতে খোদ ব্যবস্থাটির যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন তোলার পরিবেশ তৈরী হয়।


শুধু সেনাবাহিনী নয়, উচ্চ-আদালতও জন-রাজনীতির প্রতিবন্ধক হতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের জীবনদান এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাটি সংবিধানের মূল চেতনা (রাষ্ট্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হবে, অনির্বাচিতদের দ্বারা এক মুহূর্তও নয়)-এর পরিপন্থী দাবী করে হাইকোর্টের কতিপয় আইনজীবী একটি রীট পিটিশন দায়ের করলে প্রাথমিক শুনানী শেষে হাইকোর্ট পিটিশনটি তাৎক্ষণিকভাবে খারিজ করে দেন।

পরবর্তী সময়ে বিষয়টি আবার অন্য একটি বেঞ্চে উত্থাপন করা হলে সেই ২ জন বিচারকও তা খারিজ করেন ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে। তাদের ভিন্ন ধরণের মত বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চে ৩ জন বিচারক কর্তৃক একত্রে শুনানী শেষে ৩ জনই তা খারিজ করে দেন। তবে উত্থাপিত প্রশ্নটির সাংবিধানিক গুরুত্ব বিবেচনা করে তা আপীলেট ডিভিশনে শুনানীর জন্য উত্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটির শুনানী হয়। এ পর্যায়ে এসে ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ব্যবস্থাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষের ৪ জনের একজন ছিলেন বিচারপতি এস. কে. সিনহা, যার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার অনৈতিকতার অভিযোগ এনেছেন। আর মূল ‘জাজ’ খায়রুল হক ঘোষিত রায় থেকে নজীরবিহীনভাবে লিখিত রায়ে সরে গেছেন বলে রায়েই অভিযোগ করেছিলেন অপর বিচারক এম. এ. ওয়াহাব মিয়া। কিন্তু এমিকাস কিউরিদের ৮ জনের ৭ জনই ছিল ব্যবস্থাটি বাতিল না করার পক্ষে।

আশ্চর্যজনক হচ্ছে, জনগণের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত একটি সাংবিধানিক সংশোধন আদালতের রায়ে বাতিল করার কর্তৃত্ব বিচার বিভাগের আছে কিনা, বা থাকা উচিত কিনা, তা নিয়ে কোনো আলোচনা কোনো রাজনৈতিক দলই আজ পর্যন্ত উত্থাপন করেনি। এতে স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্রকাঠামোর সামগ্রিক সংস্কার না করে শুধুমাত্র সংবিধানের নির্বাচন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি জীবন দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সংস্কার করে যে-বিজয় ছিনিয়ে আনা যায়, তা ধরে রাখা যায় না।


বাংলাদেশের সংবিধানে যেমন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একজনের হাতে তুলে দিয়ে তাকে রাষ্ট্রের এবং সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে, একইভাবে এখানকার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সকল ক্ষমতাও এমনভাবে এক হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, যেন তা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকারসূত্রে বণ্টন করা যায়। আর প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে আদর্শভিত্তিক যে সব দল-গ্রুপ বা গোষ্ঠী রয়েছে তারাও বড় দলগুলির সাথে দৃশ্যমান কোনো পার্থক্য নির্মাণ করতে পারেনি। এইসব দলের প্রধান প্রধান পদ উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তরযোগ্য না হলেও, নেতাদের জীবদ্দশায় তাদের হাত থেকে দলের নেতৃত্ব স্থানান্তরের কোনো নজীর প্রায় নেই বললেই চলে। আর ধর্ম ব্যবহারকারী যে সব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তাদের মধ্যে পীরপন্থীরা আদর্শিকভাবেই উত্তরাধিকারপন্থী। আর যারা পীরপন্থী নয়, তারা ধর্মকে ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত ও দুনিয়াবী বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করার জন্যই।

ফলে এইসব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে যতো-যাই বলুক-না-কেন, রাষ্ট্র-রাজনীতি-দলের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় রাখার প্রশ্নে তারা একে অপরের পরিপূরক হিসাবেই কাজ করে। এইসব ব্যক্তি-মালিকানাধীন রাজনৈতিক দল তাই কখনোই গণক্ষমতাতান্ত্রিক মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।


বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটিই যদি একমাত্র সাংবিধানিক সমস্যা হতো তাহলে এর সমাধান অনেক সহজ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো বাংলাদেশের প্রায় সকল সমস্যাই রাজনৈতিক সমস্যা এবং সকল রাজনৈতিক সমস্যাই সাংবিধানিক সমস্যা। এসব সমস্যার যন্ত্রণা বাংলাদেশ তার সৃষ্টির পর সেই ১৯৭২ সাল থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছে।
যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনেরই একটি সংবিধান থাকে এবং প্রায় সব সংবিধানেরই দুইটি ভাগ থাকে। এক ভাগে থাকে সংগঠনটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, আর অন্যভাগে থাকে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গঠনতন্ত্র Ñ অর্থাৎ কোন পদের কি দায়িত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করা হবে, তারা কি পথে তা প্রয়োগ করবে, কি পথে দায়িত্ব অর্পিত হবে এসবের বিবরণ। বাংলাদেশ তার সংবিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অংশে (প্রস্তাবনা থেকে তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত) যেসব নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে তার প্রায় ৯০ ভাগই মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার যে বিন্যাস এবং সে-ক্ষমতা অর্জনের ও প্রয়োগের যে পথ-পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে (চতুর্থ অধ্যায় থেকে শেষ অংশ পর্যন্ত) তা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী শুধু নয়, একেবারেই বিপরীত। এই বৈপরীত্যে ঠাসা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে মানুষের আয়-উপার্জন দিনে দিনে কিছুটা বেড়েছে, রাষ্ট্রের তহবিলও স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ স্ফীত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যতো বেড়েছে, বাজেটের আকার যতো বড়ো হয়েছে, রাষ্ট্রের নিপীড়নের প্রয়োজন ও সক্ষমতাও তার সাথে সাথে বেড়েছে। তাই এক সরকারকে বদলিয়ে আরেক সরকারকে ক্ষমতায় বসালেই এসব সাংবিধানিক সংকটের সমাধান হবে না।

তবে এটা সত্য যে, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি দলকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে তার বিরোধী কোনো পক্ষকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে এবং এটুকু সতর্কতা যদি ক্ষমতাসীনদের মাথায় রাখতে হয় যে, যে-ধরণের হামলা-মামলা তারা সরকারে থেকে করছে, বিরুদ্ধপক্ষ ক্ষমতায় এলে তাদেরও এরকম হামলা-মামলা মোকাবেলা করা লাগতে পারে, তাহলে জনগণের উপর নিপীড়নের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন-পদ্ধতি প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্টতাকে নিশ্চিত না করে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে কার্যত সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসনকে নিশ্চিত করে। সবচাইতে ভয়াবহ বিষয় হলো এ ব্যবস্থা পরাজিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোটারদের ভোটকে সরাসরি বাতিল করে দেয়। এই পদ্ধতি ভোট নষ্টের পদ্ধতি। আমরা রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে এ সমস্যার সমাধানের জন্য ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা’, মানে সারাদেশে একটি দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে তাদের পূর্বঘোষিত তালিকা থেকে ক্রমানুসারে নির্বাচিত ঘোষণার পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বলে আসছি। একই সাথে আমরা এটাও সতর্ক করে আসছি যে, রাষ্ট্রকে সামগ্রিকভাবে গণক্ষমতাতান্ত্রিক না করে শুধু নির্বাচন-পদ্ধতিকে সংখ্যানুপাতিক করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতার উপর জনগণের মালিকানা নিশ্চিত না করা গেলে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল স্তরের কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার মতো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে এইসব খাতওয়ারী সংস্কার এখানে আর তেমন কোনো কাজে আসবে না। শাসনের এইসব চক্র থেকে বের হয়ে আসার পথ হলো রাষ্ট্র-সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন।


বাংলাদেশ বর্তমানে যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সামগ্রিক সংস্কারের ব্যবস্থা না করতে পারলে এ দেশকে আর মানুষের বসবাসযোগ্য করা যাবে না। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো, এই রাষ্ট্রের আইন-কানুন Ñ বিশেষত রাষ্ট্র-পরিচালনার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক আইন, পুলিশের আইন, বিচারের আইন, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসহ ৭ দফা যে প্রস্তাবনাটি আমরা রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে উত্থাপন করেছি এ রাষ্ট্রকে ন্যূনতম মানবিক, গণক্ষমতাতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক করতে হলে এ নিয়ে ভাবা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।

এর ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি আজ স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে আছে তারা, যারা এ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অক্ষুণœ রেখে শুধু ক্ষমতাদখল বা বদল করতে চায়। তারা প্রচার করে, যারা ক্ষমতায় আছে তাদের সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতা দখল/বদল করতে পারলেই দেশ মুক্তি পেয়ে যাবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এ পক্ষে আছে, এবং তারা শুধু বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ততোটুকুই পরিবর্তন চায়, যতোটুকু পরিবর্তন করলে তারা নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে বা ফলাফল ঠিক আছে বলে মনে করতে পারবে। সেজন্যে তারা দেশের রাজনৈতিক সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান কিংবা এ ব্যবস্থার সংস্কারের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামে না ।

অপর ভাগে রয়েছে তারা, যারা এই জালিমী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সংস্কার দাবী করে। তারা এখনো অসংগঠিত, অধিকাংশই ব্যক্তি, গ্রুপ, গোষ্ঠী, পাঠচক্র বা সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন বা আন্দোলনমাত্র। তারা নিজেদের মধ্যে এখনও এমন মাত্রার সম্পর্ক বা যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেনি, যতোটা যোগাযোগ বা বোঝাপড়া থাকলে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তারা ঐক্যবদ্ধ ও দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ এইসব রাজনৈতিক শক্তিসমূহ রাষ্ট্রসংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকদূর পর্যন্ত সামনে নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবী কিংবা নিরাপদ সড়কের দাবীতে গড়ে ওঠা কিশোরদের আন্দোলন থেকেও রাষ্ট্র-মেরামতের প্রয়োজনীয়তার কথা অত্যন্ত জোরের সাথে উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশে এ প্রয়োজনের কথা যতো জোরের সাথে উচ্চারিত হবে, ততোই রাষ্ট্রসংস্কারের কর্মসূচী বা প্রস্তাবনাটিও অনেকবেশী সামনে আসবে।

এদিক থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে বিদ্যমান এই সব রাজনৈতিক দলের প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামো বজায় রাখার রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিপরীতে জনগণের পক্ষ থেকে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী তাদের বিবেচনার জন্য সামনে উত্থাপন করা জরুরী। সাথে সাথে এইসব রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেরাও যে গণতান্ত্রিকভাবে গঠিত নয় এবং গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হওয়ার কোনো শর্ত যে এইসব দলে অনুপস্থিত তা সামনে আনার জন্য জনগণের নিজেদের দল/সংগঠন কোন পথে গড়ে তোলা যায় বা বিকল্প পথ কি হতে পারে, তার নিরীক্ষা করার জন্যও মাঠে নামা উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রচিন্তার রাষ্ট্রসংস্কার প্রস্তাবনাটি কেউ মানতে পারেন, কেউ না-মানতে পারেন, কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিংবা কেউ নতুন প্রস্তাবনা তৈরী করতে পারেন Ñ কিন্তু রাষ্ট্রসংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরী, তাকে জনপ্রিয় করা, নিজেদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ দেশ-সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার আলাপে ও প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া ছাড়া এদেশের মানুষের উদ্ধারের আর কোনো পথ খোলা নেই।


বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন বিষয়ে যে-ব্যবস্থাটা ৭২ সালের সংবিধান এবং আরপিও অনুযায়ী ছিল, ২০০৮ সালের সামরিক জান্তার মদতপুষ্ট সরকার এসে তার অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামক সামরিক সরকারের আরপিও সংশোধন ৭২-এর সংবিধান অনুমোদন করে না। তারা ৭২-এর আরপিও সংশোধন করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার প্রাক-যোগ্যতা হিসাবে মোট ভোটের এক শতাংশের আগাম সমর্থন প্রকাশ্য ঘোষণার শর্ত যুক্ত করে। একইভাবে অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলির নিবন্ধনের জন্য এমনসব শর্ত আরোপ করে, যা মূলতই নতুন রাজনৈতিক দল হিসাবে যাতে টাকাওয়ালাদের বাইরে সাধারণ মানুষ সফল না হতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। আশ্চর্যের বিষয়, সামরিক জান্তার মদদপুষ্ট সরকারের যারা তীব্র সমালোচক, ক্ষমতায় আসার পর সেই জান্তার জারীকৃত গণবিরোধী এসব আইনকে তারাই অনুমোদন দিয়ে নতুন আইন হিসাবে পুনর্বহাল করেছে।

এ অবস্থায় যে সমস্ত দল, গ্রুপ বা ব্যক্তি বিদ্যমান রাষ্ট্র ও রাজনীতির বাইরে এসে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতি সংস্কারের কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নতুনভাবে সংগঠিত হতে চায়, এসব গণবিরোধী আইন সে-ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিবন্ধক। তাই রাষ্ট্রচিন্তা মনে করে এইসব সংশোধনী বাতিল করতে হবে।


বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রচিন্তার দাবী :

১) ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক সামরিক সরকারের আরপিও সংশোধন করে একে পূর্বের অবস্থায় ফেরত আনতে হবে, যাতে যে কোনো দল বা গ্রুপ চাইলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে পারে এবং যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে;

২) সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদকে সংশোধন করতে হবে। অভিজ্ঞতার আলোকে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে এই সরকার নির্বাচিত সরকার হতে পারে, এবং তার গঠন এমন হয়, যাতে তা বিচার বিভাগের সুনাম ক্ষুণ্নের কারণ না হয়;

৩) সংসদ সদস্যরা আইন-প্রণয়ন ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমে যাতে অংশ নিতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব উন্মুক্ত রাখতে হবে, বৈধ উৎসের বাইরে সম্পদ পাওয়া গেলে সদস্যপদ বাতিল ও বিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে; সর্বোপরি সরকারে অংশগ্রহণ বা দায়িত্বপালনকে অ-লাভজনক করার পথ নিশ্চিত করতে হবে;

৪) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করতে হবে;

৫) বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার বদলে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে; এবং

৬) বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে, রাষ্ট্রচিন্তার প্রস্তাবিত সংস্কার-প্রস্তাবের আলোকে সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন দিতে হবে।


বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কোন দল, গ্রুপ, ব্যক্তি বা জোট, বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনো জোটও যদি রাষ্ট্র-সংস্কারের প্রস্তাবনা বা কর্মসূচী নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে, অথবা বাংলাদেশের কোনো দল, গ্রুপ, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রচিন্তার অনুরূপ দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে, তাহলে ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ তার সাংগঠনিক শক্তির সর্বোচ্চটুকু নিয়ে সেইসব প্রার্থী বা আন্দোলনকারীদের পক্ষে ভূমিকা নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
সবাইকে অভিবাদন ।
-----------------------
রাষ্ট্রচিন্তা, ইব্রাহীম ম্যানশন, কক্ষ নং ২০৪, ১১ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০; ফোন : ০১৮১৬ ০১১ ২১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *