শ্রদ্ধেয়জন, অন্তত ‘টুঁ’ শব্দটি তো করুন!

  • হেলাল মহিউদ্দীন

কবি –সাহিত্যিকগণ, আপনারা কি নিজেদের ঘৃণা করেন যখন পরম ভক্তিতে পাঠ করেন, অনুবাদ করেন, আলোচনা করেন এজরা পাউন্ড, টি. এস . এলিয়ট, ন্যুট হ্যামসুন, ডব্লিও বি ইয়েটস? উনারাসহ আপনাদের পাঠ্যতালিকাভূক্ত অনেকেই ছিলেন হিটলারের নাজিবাদের সমর্থক, প্রচারক এবং নাজিপন্থী চিন্তা ও দর্শনে তাল দেওয়া মানুষ।

পন্ডিতগন, আপনারা নিজেদের নিশ্চয়ই ভীষণ ঘৃণা করেন যখন পড়তে-পড়াতে হয়, উদ্ধৃত করতে হয় চিন্তক-দার্শনিক নীটশে, হাইডেগার, টমাস মান, স্পেংলার, রোজেনবার্গ, কার্ল স্মিট , এর্ন্সট ক্রীক, ফিলিপ লেনার্ড, কার্ল গুন্থার, জ্যোহ্যান্স স্টার্ক, ইউজেন ফিশার, হাইনরিখ গ্রস, চেম্বারলিন, সাবিত্রি দেবী, আর্থার গ্যব্যিন্যুসহ আরো আরো বহু নাজিবাদ সমর্থককে?

সাবিত্রী দেবী হতে পাঠ ও উদ্ধৃতি দিতে অধিকারকর্মীগণ কি মরমে মরে যান? তিনি তো নাজিবাদের হয়ে ভারতে গুপ্তচরবৃত্তি এবং অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মত ধ্বংসাত্মক কাজেও জড়িয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদের গভীরতম মৌলবাদী চর্চা, এমনকি বর্ণাশ্রম প্রথাও যে প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ-বান্ধব, সেইরকমই তো ছিল তাঁর দর্শন! তিনি আরএসএস-বিজেপিরও নমস্য,আপনাদেরও? খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই!

তাঁদের জন্য যদি ঘৃণা না আসে, রাজনৈতিক ভিন্নমতের দু’চারজন দেশি কবি-সাহিত্যিক যেমন আল মাহমুদ, ফররুখ বা যিনিই হন, তাঁদের প্রতি আপনাদের ঘৃণা শুধুই স্ববিরোধিতা বা বালখিল্য আচরণ থাকে না—বরং সংকীর্ণ দলীয় ভেদবুদ্ধিজনিত ঘৃণা-বিদ্বেষবাদী আচরণ, এবং নাজিবাদের চেয়েও বেশি উগ্রতর জাতীয়তাবাদ-প্রবণতা হয়ে ওঠে।

নাজি রাজনৈতিক ভাবনার সমর্থক যাঁদের কথা বললাম তাঁরা যেমন অসমর্থনযোগ্য রাজনৈতিক দর্শনের পরও সৃষ্টিশীল থেকেছেন, এবং ভাবনা উস্কে দেবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছেন বলে শ্রদ্ধেয়–ঠিক একই কারণে ভিন্নচিন্তার মানুষগুলোও সমান শ্রদ্ধেয়। তাঁরা আপনাদের সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিচারে ভিন্নমতাবলম্বী বটে, কিন্তু সৃষ্টিশীলও তো অন্যদের মতই।

মোটা দাগে আপনারাই কিন্তু দারুণ অশ্রদ্ধেয় ও ঘৃণার্হ। সামান্য মত প্রকাশের কারণে, এক দুইটি অপছন্দনীয় শব্দ বা বাক্য লেখার কারণে, মামলা-হামলা ধর-পাকড়-নিবর্তনের যে ভয়াবহ ইতিহাস-বহির্ভূত মচ্ছব চলছে, তার বিরুদ্ধে আপনাদের ঘটে হতে একটি টুঁ শব্দ বের করার ন্যুনতম নৈতিক সাহসটুকুই নাই, কিন্তু তাল ও হাওয়া দেবার নাজিবাদী অনৈতিক চর্চাটি নিজেরাই করে চলছেন বাধাবন্ধনহীন।

একটু ভাবুন,মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা দেশপ্রেম দেখানো-শেখানো বড় বড় কথা আপনাদের মুখে আদৌ মানায় কি? আপনারা লিখেন-পড়েন বটে, কিন্তু জানেনও না যে ঘৃণাবাদীদের জন্য দেশের আমজনতার বিন্দুমাত্রও শ্রদ্ধা নাই, অশেষ করুণা ও অভিশাপ-অভিসম্পাত আছে!

নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও আপনাদের আছে জানান দিতে চাইলে ঘৃণা না ছড়িয়ে বরং জননিবর্তনমূলক যে কোনো আইনের বিরুদ্ধে কথা বলুন। যাঁরা বলছেন,তাঁরা কিছুটা হলেও মানবিকতার দায় শোধ করার কষ্টকর চেষ্টাটি আপ্রাণ করে চলেছেন। আপনারা কিছুই করছেন না। এমনই অটো-শাট-আপ হয়ে আছেন যে আপনাদের বলাও যাচ্ছে না—‘যদি টুঁও করতে না পারেন, জাস্ট শাট আপ!’

  • হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *