মদিনার সঙ্কট : মদিনার রহমত

  • আবীর আহমেদ

মানুষ যদি কেবল রাজনৈতিক জীব হয় তাহলে আল্লাহর দুনিয়ার রাজনৈতিক অবতার ‘রাষ্ট্র’ এবং সেই রাষ্ট্রের মধ্যে মানব জীবনের রাজনৈতিক অবতার ‘নাগরিক’ নামক বর্গের বাইরে শুদ্ধ মানুষের জীবনকে কীভাবে বিচার করা হবে? রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিক পরিচয়ের বাইরে কেবল মানুষ হিসেবেই কোন জীবনকে আঁটানো যায় কি না? এ ধরনের প্রশ্নগুলো দীর্ঘকাল যাবৎ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলাপের অংশ হয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র থেকে নাগরিক পরিচয় হারানো শুদ্ধ মানুষের ঢল এবং তারই পরিণতিতে ঐ সময়টাতে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাগুলো নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় দেখা গেছে। এই ঘোষণাগুলোতে মূলত নাগরিক পরিচয়ের বাইরে শুদ্ধ মানুষ পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে- প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে কিছু অবিচ্ছেদ্য ও অহস্তান্তরযোগ্য অধিকার পাওয়ার অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই অধিকার নিশ্চিত করার জিম্মাদার করা হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্র নামক সেই প্রতিষ্ঠানকেই যার সার্বভৌম ক্ষমতার বলি হয়ে মানুষ নাগরিক পরিচয় হারিয়ে শুদ্ধ মানুষে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা কিনা নাগরিক পরিচয়ের বাইরে আর কোন জীবনের অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য নয় তার হাতেই নাগরিক অধিকার হারানো মানুষের জীবন তুলে দেয়ার মধ্যে যে সংকট হাজির আছে তার বিচার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তার সিলসিলা বহন করে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চুক্তিগুলোতে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো ঈমান আনলেও এসকল চুক্তি অনুযায়ী শুদ্ধ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রগুলো বাধ্য করতে পারে না। অর্থাৎ নাগরিক নয় এমন যে কোন জীবন এসমস্ত রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে নিপীড়নের স্বীকার হলে তার প্রতিকার করা সেই রাষ্ট্রের একান্ত ইচ্ছাধীন ব্যাপার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কিছু উপায়ে চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া এক্ষেত্রে কারো বিশেষ কিছু করার উপায় নাই। নাগরিক অধিকার হারানো এই সমস্ত মানুষ নিজেরা সংগঠিত হয়ে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে সেটুকু রাজনৈতিক অধিকারের আস্তরণ পর্যন্ত এমন নগ্ন শরীরে নাই। জার্মান দার্শনিক হান্না আরেন্ট, যিনি নিজেও নাজি জার্মানি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিলেন- উপলব্ধি করেছেন যে, রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত মানুষের ‘অধিকার চাওয়ার অধিকার’ই থাকে না। ‘অধিকার চাওয়ার অধিকারে’র জন্য তাদের প্রথমে কোন না কোন রাজনৈতিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে হয় (অরিজিনস, ২৯৬)। যেমন নাগরিকত্ব হারানো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার চাওয়ার অধিকার নাই। যেমন নুরেমবার্গ আইনের (১৯৩৫) আওতায় জার্মানির একটা বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব হারিয়ে শুদ্ধ জীবনে পরিণত হওয়ার পরে তাদের উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার চাওয়ার অধিকার তাদের ছিল না। এমন জীবনের কোন আইনি অধিকার না থাকায় এর উপর হওয়া সহিংসতার প্রতিকার চেয়ে কোন আইন কোন আদালতে বিচার চাওয়া যায় না। বলা যায়, উন্মুক্ত জীবনের উপর সংঘটিত অন্যায় আর আইনত অন্যায় থাকে না। রাজনৈতিক অধিকার হারানো মানুষ চুড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতে এমন এক পশু চরিত্রে পরিণত হয় যার জন্য ন্যায়-অন্যায়ের মত ধারণাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে অর্থহীনতার জগতে প্রবেশ করে। এমন মানুষের জীবন শুদ্ধ জীবের জীবন। সমস্ত ধরনের অধিকারের আবরণবিহীন নগ্ন জীবন। এমন জীবনের সাথে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। তাকে দাস বানানো যায়, কেনা-বেচা করা যায়, প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনে হত্যা করা যায়। এ সমস্ত অন্যায়ের কিছুই অন্যায় বলে বিবেচিত হয় না কারণ যে জীবনের উপর এই সহিংসতা চলমান সে নিজেই আইনের বাইরে- রাজনৈতিক অধিকারের বাইরে- এক পশুতুল্য চরিত্র।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক পরিচয় হারানো এই জীবের জীবন প্রবল রাজনৈতিক, কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্তাপ তার নগ্ন শরীরের চেয়ে বেশী আর কে আঁচ করতে পারে? নাগরিক জীবনের মতো এখানে চুড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা (সার্বভৌম ক্ষমতা) আর শুদ্ধ জীবনের মাঝে এমন কোন পর্দা নাই, এমন কোন তাবিজ নাই যা সার্বভৌমত্বের মত অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার উত্তাপ থেকে তার শরীরকে রক্ষা করতে পারে। শুদ্ধ জীবের জীবন সার্বভৌম ক্ষমতার সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত এক জীবন। রাজনৈতিক অধিকারহীন হওয়ার কারণেই চুড়ান্ত রাজনৈতিক এই জীবন। তাই এই নগ্ন জীবনকে জর্জো আগামবেন যখন ‘রাজনীতি নিরপেক্ষ’ জীবন বলে মত দেন, তখন মদিনার লেখক পারভেজ আলম এর বিরোধিতা করেন। আগামবেনের মতে, আগের কালে যে জীবের জীবন (মানুষ নামক জীব) বা উন্মুক্ত জীবন ছিল একান্তই আল্লাহর অধীন ও রাজনীতি নিরপেক্ষ জীবন- আধুনিক অধিকারের দলিলগুলো সেই জীবনকে জাতি রাষ্ট্রের আইনি-রাজনৈতিক অনুশাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করে (মদিনা ৭৫)। আগামবেনের এই বক্তব্য মদিনার লেখককে রীতিমতো বিভ্রান্ত করেছে। ঐ প্রবন্ধের পরের প্যারাতেই দেখা যায় তিনি আগামবেনের আরেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যেখানে আগামবেন উন্মুক্ত জীবের জীবনকে উদ্ধৃত চিহ্নের মধ্যে ‘রাজনৈতিক’ বলে মত দিচ্ছেন। পারভেজ আলম ধরে নিয়েছেন যে এমন জীবনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ জোর দিয়ে বোঝাবার প্রয়োজন থেকেই আগামবেন শব্দটাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বন্দী করেছেন। সেক্ষেত্রে আগামবেনের বক্তব্য কেবল যে সাংঘর্ষিক তাই নয়; পারভেজের মনে হয়েছে যে, এতে করে ‘মানুষের জীবের জীবন বা উন্মুক্ত জীবনের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এলাকা আগামবেনের ঐতিহাসিক চেতনার দিগন্তে অনুপস্থিত অথবা ঝাপসা থেকে গেছে’। মদিনার লেখকের এই উপলব্ধিগুলো মূল্যবান; এবং আমরা এই উপলব্ধিগুলো বিচার করে দেখতে আগ্রহী। কারণ, এই উপলব্ধিগুলোর বিচার জর্জো আগামবেন কিংবা পারভেজ আলমকে ছাপিয়ে জীবন ও রাজনীতির এক জটিল অথচ বাস্তব দুনিয়া আমাদের সামনে মেলে ধরে, যেখানে আমরা প্রত্যেক ‘আধুনিক মানুষ’ নিজেকে দেখতে পারব। বর্তমান প্রবন্ধ সেই দুনিয়ারই বিচার।

মদিনা, পারভেজ আলম, ২০২০

দার্শনিক লিও স্ট্রাউসের মত হলো, রাজনীতির দুইটা মেরু যার একদিকে নগর আরেকদিকে মানুষ। মদিনা শব্দটির অর্থ নগর। পলিটিক্স শব্দটি যে গ্রীক শব্দ পোলিস (polis) থেকে এসেছে তার অর্থও নগর। এই নগরের জীবনই নাগরিক তথা রাজনৈতিক তথা আইনের অধীন জীবন। সহজ বিপরীত অর্থ জুড়ে নিয়ে আমরা ধারণা করতে পারি যে নগর বা রাজনীতি বা আইনের বাইরে মানুষের যে জীবন আছে (যদি থেকে থাকে) তা ব্যক্তিগত জীবন, ঘরের জীবন, অরাজনৈতিক জীবন। দশজন মানুষ একসাথে থাকার প্রয়োজনে গঠিত রাষ্ট্রে সামষ্টিক পর্যায়ে কিছু বিধিবিধান যুক্ত করা হয় যা প্রত্যেকে মেনে চলবে। সাথে সাথে নগরভুক্ত এই জীবন নগর কর্তৃক কিছু অধিকার প্রাপ্ত হয়। মোট কথা, স্বাভাবিক অবস্থায় আইন এমন একটি ধারণা যা কেবল মাত্র নাগর ও নাগরিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বাভাবিক অবস্থায় জীবনের এক ব্যাপক কলেবর স্বভাবতই আইনের বাইরে থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো রাষ্ট্র কেবল আইন নয়, আধুনিক রাষ্ট্র হলো সার্বভৌম আইন। সার্বভৌমত্ব হলো চুড়ান্ত ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা। সার্বভৌম আইন আইনের সীমানা অতিক্রম করে স্বাভাবিক অবস্থায় যা নিয়মের ব্যতিক্রম তাকে নিয়মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেই সার্বভৌম হয়। তাই আগামবেন বলেন, সার্বভৌমত্ব হলো আইনের বাইরের আইন (হোমো স্যাকের, ৫৯)। আইনের স্বাভাবিক সীমানার মধ্যে যা করা সম্ভব নয়, আইনের চুড়ান্ত রূপ সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যে তা সম্ভব।

সার্বভৌম গুণ লাভ করে আইন তার সীমানা (নাগরিক/রাজনৈতিক জীবনের সীমানা) অতিক্রম করে মানুষের জীবনে (অরাজনৈতিক/শুদ্ধ জীবন) প্রবেশ করে। সার্বভৌম আইন স্বাভাবিক আইনের মত কেবল মানুষের নাগরিক জীবন নিয়ে কাজ করে না বরং সেই স্বাভাবিক আইনকে বাতিল করে। স্বাভাবিক আইনের পক্ষে যে সীমানা (নগর জীবনের সীমানা) অতিক্রম করা সম্ভব হয় না, সার্বভৌম ক্ষমতায় সেই সীমানা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অর্থাৎ, সার্বভৌম এলাকায় নিয়ম ও ব্যতিক্রম, আইন ও জীবন তাদের স্বাভাবিক সীমানা হারিয়ে একাকার হয়ে মিলিয়ে যায়। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয় জীবনকে নিজের মধ্যে ধারণ করে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের ধারণা হাজির করে যার বাইরে আর কোন জীবনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। এমন এলাকায় আইন এবং জীবন সমার্থক ধারণা। জার্মান দার্শনিক কার্ল স্মিটের ভাষায়, এরকম একটি অবস্থানে দাঁড়িয়েই সার্বভৌম আইন ঘোষণা করে- আমি, সার্বভৌম ক্ষমতা, যার অবস্থান আইনের বাইরে, ঘোষণা করছি যে, আইনের বাইরে কিছু নাই (স্মিট, পলিটিকাল থিওলজি, ১৩)।

এভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় আইনের বাইরের জীবন, সার্বভৌম ক্ষমতার এলাকায় আইনের সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অধিকারের আবরণহীন এই নগ্ন শরীরে এমন কিছু নাই যা তাকে আইনের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে পারে। সার্বভৌম আইন আইনি পথেই এমন জীবনের সাথে যে কোন কিছু করতে পারে যা বে-আইনি বলে সাব্যস্ত হবে না। এমন রাষ্ট্রে আইন তার চুড়ান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে দাবি করতে পারে যে, আইনের বাইরে কোন অধিকার নাই; আইনের বাইরে ন্যায়ের অন্য কোন ধারণা নাই, মানুষের কোন জীবন নাই। এজন্যই আগামবেন আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ক্যাম্প হিসেবে বিচার করতে চান। চুড়ান্ত রাজনৈতিক স্পেস হিসেবে ক্যাম্প আইনের বাইরে কোন জীবন থাকতে পারে বলে স্বীকার করে না। ক্যাম্পে আটকা পড়া জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন তাকে আইনত অন্যায় বলে বিচার করার সুযোগ থাকে না। ক্যাম্পের জীবন আইন বহির্ভূত জীবন শুধু নয় বরং আইনের চুড়ান্ত ক্ষমতার মধ্যে আটকা পড়া এক জীবন। সার্বভৌম এলাকায় রাজনৈতিক অধিকার বিহীন মানুষ যে আইন থেকে বহিস্কৃত হয়েছে সে-ই আবার আটকা পড়েছে সেই বহিষ্কারের মধ্যে।

নাজিবাদী আইন বিশেষজ্ঞ কার্ল স্মিট সার্বভৌমত্বের এই দ্বৈত স্বভাব নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। স্মিট তার সময়ের জার্মানিতে বার বার ঘোষিত হওয়া জরুরি অবস্থাকে একটা শক্ত আইনি ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। জরুরি অবস্থা হলো আইনের ব্যতিক্রম অবস্থা- যে অবস্থায় আইন বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় আইনত যা ঘটার কথা জরুরি অবস্থায় সেটি ঘটে না। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের মত প্রকাশ, চিন্তা, চলাফেরার অধিকারসহ আরো কিছু অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে আইনি সুরক্ষা দেয়া আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় কোন নাগরিক এসমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তাকে অন্যায় বলার সুযোগ আছে; এই অন্যায়ের বিচার চাওয়ার জন্য আইন-আদালত আছে। কিন্তু জরুরি অবস্থায়- যখন আইন বাতিল হয়ে যায়, তখন নাগরিকেরা স্বাভাবিক অবস্থার মত এই সমস্ত অধিকার পাওয়ার অধিকারী থাকে না। আমরা দেখেছি ‘অধিকার পাওয়ার অধিকার’ না থাকা, নগ্ন জীবনের বৈশিষ্ট্য, জরুরি অবস্থায় যা প্রত্যেক জীবনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। অর্থাৎ জরুরি অবস্থায় নাগরিক জীবন ও শুদ্ধ মানব জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। স্মিট যে ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিলেন তা হলো জরুরি অবস্থা আইনের ব্যতিক্রম অবস্থা হলেও আইনের বাইরের বিষয় নয়। তার মতে, জরুরি অবস্থায় আইন বাতিল হয়ে গেলেও তা আইনেরই বিষয় যেহেতু আইন তখন সার্বভৌম আইনের স্বভাব ধারণ করে। সার্বভৌম ক্ষমতা যেহেতু আইনি ভিত্তিতেই আইন বাতিল করতে পারে তাই এটি আইনের বাইরের বিষয় নয় বরং আইনের আদি ভিত্তি (আগামবেন, ‘মেসায়াহ’, ১৬২)। স্মিট জরুরি অবস্থাকে আইনি বিষয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জরুরি অবস্থাকে আইনের স্বাভাবিক আচরণ বলে রূপ দিয়েছিলেন। তার মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা কেবল নাগরিক জীবন আর খালি জীবনের সীমানাই নির্দেশ করে না, সেই সীমানা অতিক্রমও করতে পারে; বরং সীমানা অতিক্রম করে বাহিরকে নিজের মধ্যে দাখিল করেই এটি সার্বভৌম হয়। আইনের এভাবে আইনের বাইরে মানুষের জীবনে ভিত্তি গড়া স্বাভাবিক অবস্থার ব্যতিক্রম হলেও এটি আইনের বাইরের বিষয় নয় বরং তার চুড়ান্ত বিকাশ।

জরুরি অবস্থা ও সার্বভৌমত্বের এমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বিচার করেই স্মিটের সমসাময়িক দার্শনিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বুঝতে চেয়েছিলেন, আইনের সীমানা অতিক্রম করে ব্যতিক্রমকে স্বাভাবিক করাই যদি সার্বভৌমত্বের স্বভাব হয়ে থাকে তাহলে আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রে স্বাভাবিক অবস্থা ও জরুরি অবস্থার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? তার প্রশ্ন ছিল আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রে নিয়ম ও ব্যতিক্রমের মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য আছে কি না? এমন প্রশ্নের বিচার থেকেই বেনিয়ামিন তার বিখ্যাত ‘ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে’ নামক প্রবন্ধের আট নম্বর থিসিসে লিখেছেন, ‘মজলুমের ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছে, যে ‘জরুরি অবস্থার’ মধ্যে আমরা বাস করছি তা নিয়মের ব্যতিক্রম নয় নিয়ম মাত্র’। বেনিয়ামিন এই ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’ ধারণাটির বিপরীতে ‘আসল জরুরি অবস্থার’ ধারণা গড়ে তুলতে চেয়েছেন। অষ্টম থিসেসেই তিনি লিখেছেন- ‘ইতিহাসের এমন ধারণায় আমাদের পৌঁছাতে হবে যা মজলুম ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায়। আর তাহলেই আমরা দেখতে পাব যে আমাদের কাজ হচ্ছে একটা আসল জরুরি অবস্থা হাজির করা যার ফলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থার উন্নতি ঘটবে (‘ইতিহাসের’ ৩৯২)।

এখানে স্মিটের ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থার’ বিপরীতে বেনিয়ামিন যে ‘আসল জরুরি অবস্থার’ ধারণা হাজির করেছেন তা আসলে স্বাভাবিক জরুরি অবস্থার উন্মোচন মাত্র। জরুরি অবস্থা যে সার্বভৌম ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই নয় বা সার্বভৌম ক্ষমতা, যার মধ্যে আমরা বাস করি তা যে জরুরি অবস্থা ছাড়া কিছুই নয়- এই সত্য যেখানে উন্মোচিত হয় সেটিই আসল জরুরি অবস্থা; সার্বভৌম ক্ষমতার স্বরূপ উন্মোচন। সার্বভৌম ক্ষমতা, জরুরি অবস্থার মত ‘ব্যতিক্রম অবস্থা’তে শুধু নয় ‘স্বাভাবিক অবস্থা’তেই আইনের সীমানা অতিক্রম করতে পারে। যে সীমানা সমাজের মানুষেরা ঘর-নগর সীমারেখা দিয়ে চিহ্নিত করেছিল আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম এলাকায় সেই সীমানা ধূলিসাৎ হয়ে অরাজনৈতিক জীবন রাষ্ট্রের চুড়ান্ত ক্ষমতার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এই এলাকায় জীবন আর আইনের মধ্যেকার স্বাভাবিক ফারাক আর থাকে না- নগর ও ঘর, আইন ও জীবন- সার্বভৌমত্বের এলাকায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নাগরিক ও অ-নাগরিক এখানে এমন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাধা পড়ে যেখানে প্রত্যেকেই চুড়ান্ত ক্ষমতার সামনে উন্মোচিত একটি জীবন।

সার্বভৌম গুণ এমনই, কোন জিনিসকে আমূল পাল্টে দেয়। যেমন ভাষা ও সার্বভৌম ভাষার মধ্যে পার্থক্য বিশাল। ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। ভাষার বাইরের একজন মানুষ যেখানে অব্যক্ত, সার্বভৌম ভাষার মধ্যে সেই মানুষ পাগল, যার চিকিৎসা দরকার। স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যতিক্রম যেমন স্বাভাবিক, সার্বভৌমত্বের স্বাভাবিক জরুরি অবস্থায় সেই ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে অপরাধ। তাই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলোর আর আলাদা করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয় না। নিজেদের সার্বভৌম দাবি করার মাধ্যমে- জীবন ও রাজনীতির স্বাভাবিক সীমানা ধূলিসাৎ করে ফেলার মাধ্যমে, এটি নিজেই স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা হিসেবে টিকে থাকে। এই জরুরি অবস্থা আর নিয়মের ব্যতিক্রম নয় বরং ব্যতিক্রমীই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটিই মজলুমের ঐতিহ্য। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী মজলুম বলতে যেমন মাঠের কৃষক, কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর কিংবা রাষ্ট্র হারানো রোহিঙ্গা জীবন বোঝে এই মজলুম চরিত্রটি সেরকম ‘সীমানার’ ধারণা নয়। মজলুম ঐতিহ্যের অংশীদার এমন প্রত্যেকটি মানুষ যার ঘর এবং নগরের সীমানা হারিয়ে গেছে; যার ঘর নগরের হাতে লুন্ঠিত হয়েছে। এই জীবন আইনের এমন এক এলাকায় আটকা পড়েছে যেখানে আইন আর জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। মজলুমের বাস ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’য় যেখানে নগরের ভেতর ও বাহির, আইন ও বে-আইন, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক, নাগরিক ও শুদ্ধ জীবনের মত দ্বান্দ্বিক ধারণাগুলো একে অপরে মিলিয়ে গেছে। এই মজলুম চরিত্র আমরা প্রত্যেকে কারণ আমাদের প্রত্যেকের জীবনের উপর- জীবনকে বাতিল হিসেবে নিজের মধ্যে দাখিল করে রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাধারণত জরুরি অবস্থাকে কোন সাংবিধানিক বিধান বা কোন বিশেষ আইনের মধ্যে খুঁজতে যাওয়া হয় বলে বলে মজলুম চরিত্রটি দূরের কোন সীমানা চরিত্র বলে মনে হয়। আদতে, জরুরি অবস্থা কোন বিশেষ বিধান, কোন বিশেষ বাহিনীর কার্যক্রম কিংবা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর উপর চাপানো সহিংসতা নয়; বরং আইনের স্বাভাবিক ও চুড়ান্ত রূপ- যার মধ্যে আমরা সবাই বসবাস করছি।

আধুনিক সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রকে এরকম একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থান থেকে বিচার করেই আরেন্ট ও আগামবেনের মত চিন্তকেরা মানবাধিকারের ঘোষণাগুলোকে পাঠ করতে চেয়েছেন। নেশন শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে জন্ম তথা জীবের জীবন, তা আগামবেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য বাংলা ভাষায় জাতি বা জাত শব্দের অর্থও তাই- জন্ম (মদিনা, ৭০)। অর্থাৎ আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের চিন্তা ও কর্মসূচির কেন্দ্রেই রয়েছে জন্ম তথা জীবের জীবন। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের কাছে কেউ হয় জন্মগতভাবে সেই জাতিরাষ্ট্রের সদস্য (বিধায় তার জীবনের প্রতিটা ব্যাপারই রাষ্ট্রের ব্যাপার; তার জীবনে ঘর- অরাজনৈতিক- বলে কিছু নাই; জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তা রাজনৈতিক- নগরের আগ্রাসনভুক্ত) অথবা সে এক হত্যা যোগ্য পশু। জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্রকে ফরাসি বিপ্লবের সময়কার নাগরিক ও মানুষের অধিকারের দলিলে (Declaration of the rights of men and citizen, 1789) সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বলে স্বীকার করা হয়েছে (আগামবেন, ‘মানবাধিকার’ ২৫)। আর তাই মানুষ ও নাগরিক নামের বর্গগুলো স্বাভাবিক কোন অবস্থায় যদি আলাদা দুটি বস্তু হয়েও থাকে, জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌম এলাকায় তাদের মধ্যকার সেই স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় পার্থক্য আর থাকে না। মানুষ ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য জাতিরাষ্ট্র স্বীকার করতে পারে না- কথাটির অর্থ এমন নয় যে, জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে মানুষ মাত্রই নাগরিক; বরং তার উল্টো- নাগরিক না হলে সে মানুষ নয়- হত্যা যোগ্য পশু। এই শুদ্ধ জীবন নিঃসন্দেহে অরাজনৈতিক, যা চুড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা সার্বভৌমত্বের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ায় চূড়ান্ত ‘রাজনৈতিক’ চরিত্রে পরিণত হয়। সার্বভৌম কাঠামোর মধ্যে মানুষ ও নাগরিক তৎক্ষণাৎ একে অপরে লীন হয়ে যায়। যেখানে নাগরিক আর পশুর মধ্যে আর পার্থক্য থাকে না সেখানে কার্যত প্রত্যেকেই পশুর জীবন- কারো ক্ষেত্রে এই সত্য উন্মোচিত হয়েছে আর কারো ক্ষেত্রে তা উন্মোচনের অপেক্ষায়, বড়জোর এতটুকু তফাৎ।

তাই পারভেজ আলম যখন দাবি করেন যে, ‘জীবের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, এমন রাজনৈতিক জীবনের খোঁজ করা আগামবেনের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম লক্ষ্য’ তখন তার দাবি সঠিক। তবে সেটি এই অর্থে নয় যে, আগামবেন মানুষের জীবন ও রাজনীতির মধ্যকার পার্থক্য বাতিল করে জীবিনকে আপাদমস্তক রাজনীতি দিয়ে মুড়ে দিতে চান। বরং সেটি এই অর্থে যে, আগামবেন জীবন ও রাজনীতির মধ্যকার বাতিল হয়ে যাওয়া পার্থক্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে মজলুমের জীবন ঘনিষ্ঠ রাজনীতি বলে প্রচার করতে সচেষ্ট। অরাজনৈতিক জীবন প্রবলভাবে ‘রাজনৈতিক’ কেবল মাত্র এই কারণে যে এই অরাজনৈতিক জীবনের উপরেই, একে আত্মসাৎ করেই রাষ্ট্র নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মানুষের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক জীবনের এমন দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই রাজনীতি। যেখানে জালিম রাজনীতি হলো এই দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে উভয়কে এক অঙ্গে একীভূত করে স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা জারি রাখা, আর মজলুমের জীবন ঘনিষ্ঠ রাজনীতি হলো এই দ্বান্দ্বিক ধারণাগুলোর হারিয়ে যাওয়া সীমানা প্রতিষ্ঠা করা।  পুজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, কিংবা সেক্যুলারতন্ত্র- যে নামেই রাষ্ট্র নিজেকে গঠন করুক না কেন, যদি তাদের গঠিত রাষ্ট্রে সার্বভৌম ইচ্ছায় নির্মিত বিশেষ জীবনের বাইরে আর কোন অধিকারসম্বলিত জীবনের অস্তিত্ব না থাকে, যদি জীবন মানেই বিশেষ জীবন আর বাকি সব জীবন সার্বভৌম সহিংসতার সামনে উন্মোচিত পশুর জীবন হয় তাহলে এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের মতাদর্শের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। ততক্ষণ পর্যন্ত এরা প্রত্যেকে মজলুম উৎপাদনের ভিন্ন ভিন্ন দরজা মাত্র।

Walter Benjamin

যেমনটা আমরা দেখেছি, আগামবেন নগ্ন জীবনকে রাজনীতি নিরপেক্ষ ও ‘আল্লাহর অধীন’ জীবন বলেছেন। এই ‘আল্লাহর অধীন জীবন’ ধারণাটির একটা বিশেষ ইতিহাস আছে। বিশেষত পাশ্চাত্য দর্শনে এই ধারণাটি এত ব্যাপক যে, এর কোন সাধারণ নাম নাই। স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যাপক আলোচনা বর্তমান লেখায় তুলে আনা সম্ভব নয়। আপাতত আমরা যেটুকু বলতে চাই তা হলো- আল্লাহর অধীন জীবন মানে জীবের সাধারণ জীবন। আল্লাহ, যিনি কোন বিশেষ জীবনের জিম্মাদার নন বরং সমস্ত জীবনের প্রতিপালক; যেখানে প্রত্যেকের প্রথমত এবং যদি আর কিছু না-ও হয় তাহলে অন্তত- বেঁচে থাকার অধিকার আছে, নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার আছে। এমন একটা প্রেক্ষাপট থেকেই আমরা আগামবেনের দর্শনের সবচেয়ে আলোচিত ‘হোমো স্যাকের’ নামক চরিত্রের সাথে পরিচিত হতে চাই।

হোমো স্যাকের শব্দের আক্ষরিক অর্থ পবিত্র মানুষ। ইংরেজি স্যাক্রেড শব্দটি ল্যাটিন স্যাকার থেকে এসেছে। স্যাকার শব্দটির অস্পষ্টতা এবং পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক চিন্তায় এর তাৎপর্য নিয়ে আগামবেন এবং তার আগে-পরে অনেকে লিখেছেন। ‘আধুনিকতা’র আগে স্যাকের শব্দটি দিয়ে ধর্মতন্ত্রে ব্যবহৃত ‘পবিত্র’ শব্দটির মতো কোন ধারণা বুঝাত না। তালাল আসাদ আমাদের জানিয়েছেন যে, মধ্যযুগীয় ইংরেজিতে স্যাকের শব্দটি দিয়ে ব্যক্তিগত কোন কিছুকে বুঝানো হতো- যেমন ব্যক্তিগত অভ্যাস, ব্যাক্তিগত বিশ্বাস বা ধ্যান-ধারণা। এই ব্যক্তিগত জীবন মানুষের স্বভাবগত। উল্লেখ্য, গ্রীক শব্দ zoe, যেটি দিয়ে আইনের বাইরে ঘরের অরাজনৈতিক জীবন বুঝাতো, গ্রীক ভাষায় শব্দটির কোন বহুবচন নাই। অর্থাৎ এই শব্দটি দিয়েও একান্ত নিজি একটি জীবনের ধরণা প্রকাশ করা হতো। আবার, আগামবেন আমাদের জানিয়েছেন যে, নগ্ন জীবন বা বেয়ার লাইফ (bare life) শব্দটির ‘বেয়ার’ গ্রীক ‘haplos’ ধারণাটির সাথে সম্পর্কিত; অর্থাৎ এটিও ব্যক্তিগত জীবন নির্দেশক একটি ধারণা (হোমো, ১০২)। এখানে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো যে, এই শব্দগুলো সমষ্টির বাইরে, নিয়মের বাইরে- ব্যতিক্রম কোন কিছুর ধারণা দেয়। এই শব্দগুলো এমন এক জীবনের ধারণা প্রকাশ করে যেটি একক, নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং স্বভাবতই সমষ্টির ধারণাকে মোকাবিলা করার মাধ্যমে- সমষ্টির সাথে তফাৎ সৃষ্টি করেই এই ধারণা অস্তিমান হয়।

যেহেতু সমষ্টির প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে প্রশ্ন করে- তার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে নিজেকে অনুধাবন করেই এমন ব্যক্তি জীবনের ধারণা পাওয়া যায় তাই স্বাভাবিকভাবেই এই জীবন নগরের বাইরের জীবন; আর তাই আইন এই জীবনের কোন দায়ভার স্বীকার করে না। ব্যক্তির নিজস্ব এই জীবনের অধিকার নগর স্বীকৃত কোন বিশেষ জীবনে আরোপিত অধিকার নয়। এই জীবন আল্লাহ প্রদত্ত সাধারণ জীবনের অধিকার। এই জীবন মানুষের স্ব-ভাবগত, অর্থাৎ ‘যা নিজের মত’- নিজের ধর্ম। মানুষের এই ধর্ম, আজকে আমরা ইংরেজি ‘রিলিজিওন’ শব্দটি দিয়ে যেমন ধারণা বুঝি তার মতো নয়। রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছিলেন, ইউরোপে রিলিজিয়ন বলে যে শব্দ আছে ভারতবর্ষীয় ভাষায় তার অনুবাদ অসম্ভব। ইংরেজির সাথে যদি মিলিয়ে পড়তেই হয়, তাহলে ধর্ম শব্দটি রিলিজিয়ন নয় বরং ‘নেচার’ ধারণাটির কাছাকাছি। রিলিজিয়ন শব্দটি মানুষের ধর্ম নয় বরং ধর্মতন্ত্রের সাথে বেশি করে জড়িত। তালাল আসাদ রিলিজিয়ন শব্দটির ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ধর্ম (nature) শব্দটি কিভাবে মানুষের একান্ত জীবন বাচক একটি ধারণা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মতন্ত্র হয়ে উঠলো, তিনি এর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। আসাদের প্রস্তাব হলো, ইউরোপীয় শক্তিগুলো দেশে দেশে তাদের কলোনিতে পৌঁছে নানা রকম মানুষের নানা রকম ব্যক্তিগত জীবনকে একটি সাধারণ নামে ডাকার প্রয়োজন থেকে ‘রিলিজিওন’ বর্গটি গড়ে তুলেছিল। আর এভাবে বর্গীকরণ করতে গিয়ে কলোনিয়াল প্রভুরা এমন একটা জিনিসের সামষ্টিক নাম দিয়ে ফেলেছে যা স্বভাবতই সমষ্টির বাইরের অস্তিত্ব।

তবে ‘রিলিজিওন’ বর্গটি কলোনিয়াল প্রভুদের হাতে শুধু গড়েই ওঠে নি, ধারণাটি তাদের হাতে নির্যাতিত একটি বর্গও বটে। কলোনিয়াল প্রভুরা ‘রিলিজিওন’ নাম দিয়েই এক বিশাল সংখ্যক মানুষের ঐতিহ্যকে কুসংস্কার, অসত্য, অসভ্য কিংবা কেবলই মানসিক দশা বলে অপমান করতে পেরেছিল। রিলিজিয়নের বিপরীতে পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের একটি বিশেষ জীবনকে ‘উন্নত জীবন’- এবং কালক্রমে ‘মানবের একমাত্র জীবন’ হিসেবে মানুষের উপর চাপানোর প্রকল্প সাজাতে পেরেছিল; যে প্রক্রিয়া আজকের মত জৈবরাজনৈতিক সময়ে আরো প্রচন্ড হয়ে আমাদের ঘর ও নগরের সীমানা মিলিয়ে দিয়েছে। কলোনিয়াল মাস্টারদের হাতে গড়ে ওঠা ‘উন্নত জীবন’ নিজেকে ‘বৈজ্ঞানিক সত্যের’ মত স্বতঃসিদ্ধ ও সার্বজনীন দাবি করে আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে স্বাভাবিক জরুরি অবস্থার মধ্যে আটকে ফেলেছে যেখানে খাওয়া-পড়া-চিন্তা থেকে শুরু করে জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় রাষ্ট্রের বিষয়।

Giorgio Agamben

তবে আধুনিকতার মত ধর্মতন্ত্রও এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি বিশেষ জীবনের বাইরে আর কোন অধিকারসম্পন্ন মানব জীবনের ধারণা নাই, যেখানে খোদা একটা বিশেষ জীবনের খোদা, সকল প্রাণের প্রতিপালক নয়। ধর্মতন্ত্র মানুষের সাথে তার প্রতিপালকের রুহানি সম্পর্কের পথ রুদ্ধ করে তার পরিবর্তে একটি বিশেষ শ্রেণীর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদিক থেকে ধর্মতন্ত্র মানুষের ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধারণা। ধর্মতন্ত্র মানুষের স্বভাবগত-সাধারণ জীবনের প্রতিপালক আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের জীবন বিচ্ছিন্ন কৃত্রিম এক দেবতার শাসনের ধারণা দেয়। আল্লাহর অধীন জীবন, যেখানে মানুষের অন্তত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। জীবন ও ধর্মের এমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আইনের হাতে গড়ে ওঠা ধর্মের ধারণাতে থাকা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংবিধান কলোনিয়াল দাসত্বের ঐতিহ্য বহন করে বলেই কি না সেখানেও আমরা ধর্ম শব্দটির এমন জীবন বিচ্ছিন্ন অর্থ দেখতে পাই। আমাদের সংবিধানে ধর্ম পালনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে; এমনকি জরুরি বিধানও এই অধিকারকে অস্বীকার করতে পারবে না এমন সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এই ধর্ম পালনের অধিকার কি মানুষের স্বভাব ধর্ম? এটি কি যে কোন মানুষের বেঁচে থাকার, নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকারকে সুরক্ষিত করে? করে না, কারণ এখানে ধর্ম বলতে আল্লাহর অধীন জীবন বুঝানো হয় নাই; বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের ধারণাটি ঔপনিবেশিক দাসত্বের সাক্ষী হিসেবে আল্লাহর অধীন মানুষের স্বাভাবিক জীবিনের কৃত্রিম নাম হিসেবে হাজির আছে।

সার্বভৌম রাষ্ট্রে একটি বিশেষ জীবন (নাগরিক জীবন) প্রত্যেকের সাধারণ জীবনের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এই বিশেষ জীবনকে সমস্ত অধিকারের বাহক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে- আর সকল জীবনকে হত্যা যোগ্য পশুর জীবনে পরিণত করা হয়। সমস্ত অধিকার সম্বলিত এই বিশেষ জীবন তৈরী হয় একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতে- মালিকদের হাতে। যেমন পুজিবাদী রাষ্ট্রে পুজিবাদ নির্মিত বিশেষ জীবনের বাইরে খাওয়া-পড়া, শিক্ষা কিংবা তথ্য পাওয়ার মত মৌলিক অধিকারগুলো আর জনসাধারণের অধিকারে থাকে না। এই অধিকারগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে আইনে স্বীকৃত হলেও, জরুরি অবস্থার মতো তা স্থগিত হয়ে আছে। পুজিবাদী রাষ্ট্রে এ অধিকারগুলো তারই প্রাপ্য যে এগুলো কিনতে পারে- তারাই পারে যারা বাজার স্বীকৃত বিশেষ জীবনভুক্ত। আর সকল জীবন অধিকার পাওয়ার অযোগ্য হিসেবে বাজারের চুড়ান্ত ক্ষমতার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এই বিশেষ জীবন যেহেতু একমাত্র অধিকার সম্বলিত জীবন, আর সব নগ্ন জীবন, তাই এই অধিকার সম্বলিত জীবনের মূলা ঝুলিয়ে রাষ্ট্র মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি সমস্ত ঠিক করে দেয়ার ‘অধিকার’ অর্জন করে। মানুষের খাওয়া-পড়া, উঠা-বসা থেকে শুরু করে চিন্তা পর্যন্ত যা কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের ঘরের বিষয় ছিল, তাই সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তি রূপে নগরের বিষয় হয়ে উঠে। এমন রাষ্ট্রে বাজার, আইন আর জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না এবং বাজারের বাইরে কোন অধিকার, কোন জীবন থাকে না।

বর্তমান সময়ে দেশে দেশে ধর্মতন্ত্র কিংবা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে উত্থান দেখা যাচ্ছে, যেখানে এসব মতাদর্শের লোকেরা ‘পশ্চিমা আগ্রাসনের’ বিপরীতে নিজেদেরকে বিপ্লবী সমাধান হিসেবে হাজির করতে চায়- আদতে তারা সেই একই ‘আগ্রাসন’ নীতির চ্যালাচামুণ্ডা। এই আগ্রাসী নীতি পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তার একটা বিশেষ ধারণা যেখানে একটি বিশেষ জীবনের বাইরে মানুষের সাধারণ জীবনের অধিকারকে স্বীকার করা হয় না। ভিন্ন ভিন্ন নামে আর সকল রাজনৈতিক মতাদর্শও পশ্চিমের ‘আধুনিক’ প্রকল্পের মত সবার ঘর গুড়িয়ে দিয়ে, সবার খোদা কেড়ে নিয়ে সবাইকে ‘এক’ করতে চায়। এমন একটি ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ ধর্মহীন- এখানে প্রত্যেক স্বাভাবিক জীবনের প্রতিপালক খোদা নগরের হাতে তৈরি জড় খোদা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এমন মতাদর্শে গঠিত রাষ্ট্রে মানুষ ও নাগরিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। সার্বভৌম ক্ষমতায় আটকে পড়া সাধারণ মানুষ অনেক সময় সেচ্ছায় নিজের ধর্ম ত্যাগ করে নিজের ঘরে নগরের দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয় কারণ এমন রাষ্ট্রে সমস্ত অধিকার নগর দেবতার কুক্ষিগত। কেউ নিজের ধর্ম ত্যাগ করে এই বিশেষ ধর্মে ঈমান না আনে তাহলে তার জীবন অধিকারহীন পশুর জীবন হিসেবে বিবেচিত হবে।

এমন একটা প্রেক্ষাপট থেকে হোমো স্যাকের চরিত্রটির দিকে নজর দেয়া দরকার। প্রাচীন রোমান আইনের এই চরিত্রটি এমন এক জীবনের ধারণা দেয় যাকে উৎসর্গ করা যায় না তবে হত্যা করা যায় এবং যার হত্যাকাণ্ডে হত্যাকাণ্ডের অপরাধ হয় না। আগামবেন হোমো স্যাকের চরিত্রটি নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন যা স্বাভাবিকভাবেই এই লেখায় তুলে আনা সম্ভব না। আপাতত এর যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো তা হলো হোমো স্যাকের, দুনিয়ার এবং আল্লাহর- উভয় আইনের বাইরের জীবন। এই জীবনকে উৎসর্গ করা যায় না- কারণ, উৎসর্গ একটা বিধিবদ্ধ অনুষ্ঠান (ritual)। যেমন, বিধি মোতাবেক কেউ অপরাধ করলে তাকে বিধি মোতাবেক শাস্তি দেয়া। কিন্তু হোমো স্যাকেরের জীবন আইন অনুযায়ী অপরাধ নয় বরং আইনের বাইরের জীবন। তাই তাকে আইনের মধ্যে থেকে হত্যা (উতসর্গ) করা যায় না কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজের সার্বভৌম ইচ্ছায় আইন বহির্ভূতভাবে হত্যা করা যায় এবং এ কারণে এমন হত্যাকাণ্ডে অপরাধ হয় না। হোমো স্যাকের জীবিনের উৎসর্গ হতে না পারাকে আগামবেন এভাবেই দেখেছেন। তবে ব্যাপারটি বোঝার আরেকটি দিক থাকতে, যে দিকটির ইঙ্গিত পারভেজ আলমের মদিনা কিতাবটিতে আছে।

যেমনটি বলেছি একজন হোমো স্যাকের কেবল রাষ্ট্রের আইন নয়, আল্লাহর আইনেরও বাইরের জীবন। পারভেজ আলম মনে করেছেন, যেহেতু এমন জীবন আল্লাহর আইনের বাইরের জীবন তাই হোমো স্যাকেরকে হত্যা করলে তার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু হয় না অর্থাৎ তার মৃত্যুকে অন্যায় বলে সাক্ষ্য দেয়া যায় না(আরবি শাহাদাহ থেকে শহীদ শব্দটি এসেছে যার অর্থ সাক্ষ্য দেয়া)। এর অর্থ হতে পারে- হোমো স্যাকের যেহেতু আল্লাহর আইনের বাইরের জীবন হিসেবে সাব্যস্ত তাই তার উপর হওয়া জুলুমের সাক্ষ্য নেয়ার জন্য কোন মাবুদ নাই। আমরা দেখেছি ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা কীভাবে মানুষের ধর্মকে অবজ্ঞা করে তাকে প্রতিস্থাপন করতে চায়। তাই সেদিক থেকে ভেবে দেখলে, আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রে আমরা প্রত্যেকে এমন মাবুদহীন-ধর্মহীন জীবন, একেকজন হোমো স্যাকের। হোমো স্যাকের যে আল্লাহর আইন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে সেই আল্লাহ সাধারণ জীবনের প্রতিপালক নয়- বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে তৈরি বিশেষ জীবনের বিধাতা। যে বা যারা একজন হোমো স্যাকেরকে রাষ্ট্রের আইনের বাইরে বলে ঠিক করে দিচ্ছে সেই তারাই তাকে আল্লাহর আইনেরও বাইরে বলে ঘোষণা করতে পারছে। অর্থাৎ, এমন রাষ্ট্রে রাজার আইন আর আল্লাহর আইন এক- রাজা এবং আল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। হোমো স্যাকের যেহেতু সার্বভৌম এলাকায় আটকা পড়া জীবন যেখানে আইনের বাইরে ন্যায়ের/জীবীনের আর কোন ধারণা নাই তাই সে তার উপর হওয়া অন্যায়কে অন্যায় বলে সাক্ষ্য দিতে পারে না। হোমো স্যাকেরের উপর হওয়া জুলুমকে জুলুম বলে সাক্ষ্য দেয়ার কোন উপায় নাই; জুলুমের সাক্ষ্য নেয়ার জন্য তার কোন মাবুদ নাই।

সার্বভৌম আইনের মধ্যে, যেখানে আইনের বাইরে জীবনের কোন অস্তিত্ব নাই সেখানে আইনকে অন্যায় বলতে পারার কোন উপায় থাকে না। ‘অন্যায় আইন’ ধারণাটি সেখানেই সম্ভব যেখানে আইন ন্যায়ের ধারণাটিকে পুরোপুরি আত্মসাৎ করে নি। যেখানে আইনের বাইরে ন্যায় এবং অধিকার এবং জীবনের স্বাভাবিক অস্তিত্ব বজায় আছে। এই ধারণাগুলো মজলুম ঐতিহ্যে ভালভাবেই সংরক্ষিত আছে। যেমন, মুসা নবী ও ফেরাউনের কাহিনি। ফেরাউন নিজেকে আল্লাহ দাবি করত, আইন ও ন্যায়ের একমাত্র উৎস ও মানদণ্ড বলে ঘোষণা করত। ফেরাউনের শাসনে আল্লাহর আইন আর তার আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ আইনের বাইরে ন্যায্যতার অন্য কোন মানদণ্ড ছিল না। এ সময় মুসা ও তার সহযোদ্ধারা নগরের হাতে তৈরি আইনের বাইরে জীবনের স্বাভাবিক অস্তিত্বের কথা প্রচার করা শুরু করলেন। তারা ফেরাউনের আল্লাহ- যা বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে তৈরি বিশেষ জীবনের দেবতা, তার বিপরীতে মানব স্বভাবের প্রতিপালক, যে কোন জীবনের জিম্মাদার রবের ধারণা প্রচার করতে লাগলেন। ফেরাউনের আইনের মধ্যে নিঃশেষিত জীবনের বাইরে, সাধারণ জীবনের প্রতিপালক আল্লাহর উপর ভর করে তারা ফেরাউনের শাসনকে ‘অন্যায় শাসন’ বলতে পারতেন। আল্লাহর বাণী প্রচার করার মাধ্যমে তারা আইনের মধ্যে ন্যায় ধারণার (এবং জীবনের) নিঃশেষিত হতে না পারার সক্ষমতা প্রচার করতে পারতেন। তাই ‘অন্যায় আইন’ ধারণাটি মজলুম ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আইনের বাইরে ন্যায়ের একটি ধারণাতে বিশ্বাস করার মাধ্যমে মজলুম তার রবের প্রতি ঈমানের সাক্ষ্য দেয়। এভাবে অন্যায় শাসনের সাথে লড়তে গিয়ে যদি তার মৃত্যুও হয় তাহলে সেই মৃত্যুকে অন্যায় বলে সাক্ষ্য দেয়ার উপায় থাকে। এজন্যই দেখা যায় ‘অন্যায় আইন’ আর শহীদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বার বার মজলুমের ঐক্য গড়ে উঠেছে। নিজেদের ধর্ম রক্ষার্থে মজলুমের এই ঐক্যই তো আল্লাহর একত্ব। আর তাই ফেরাউন সৃষ্ট খোদা মানুষের স্বাভাবিক জীবনের প্রতিপালকের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। মুসা ও তার সাথীদের জীবন ফেরাউনের সার্বভৌম ক্ষমতার সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে; তারা হিজরত করতে বাধ্য হয়। মজলুম ঐতিহ্যের এই দশায় এসে নগরের আল্লাহর কাছে মুসার আল্লাহকে কিছুটা যেন অসহায় মনে হয়। সম্ভবত এই ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করতেই মজলুমের জীবনীসাহিত্যের এ পর্যায়ে আমরা আল্লাহর রহমত নাজিল হতে দেখি। আমরা দেখি, হিজরতরত মুসা নবীর আল্লাহর রহমতে নীল নদের পানি দুইভাগ হয়ে যেতে। আরো দেখি, নগর থেকে বহিষ্কৃত শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে বিরান মরুভূমির বুকচিরে পানির ফোয়ারা ছুটতে, মা হাজেরার আল্লাহর রহমতে। একইভাবে আমরা রহমত পৌঁছে যেতে দেখি সওর গুহায় আল্লাহর রহমতের অপেক্ষায় থাকা নবী মোহাম্মদ ও আবু বকরের উপর, যখন তারা মক্কা নগরীর কুরাইশদের আল্লাহর নিয়মে হত্যা যোগ্য খালি জীবনে পরিণত হয়ে হিজরতরত ছিল।

মজলুমের একতায়, খালি জীবনের প্রতিপালকের রহমতে, আরব মরুভূমিতে যে মদিনা গড়ে উঠেছিল, সেটি আইনের বাইরে শুদ্ধ মানুষের সম্ভাবনাকে স্বীকার করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার আরবে গোত্রগুলোই ছিল আইন; মানুষের সকল অধিকার তার গোত্র কর্তৃক প্রদত্ত অধিকার ছিল। গোত্রের বাইরে কোন আইন, কোন অধিকারের ধারণা ছিল না। তাই গোত্র বিচ্যুত কোন মানুষ অধিকারবিহীন খালি জীবনে পরিণত হত, যাকে হত্যা করা যায় এবং যার হত্যাকাণ্ডে কোন অপরাধ হয় না। এমন গোত্র বিচ্যুত খালি জীবনের হাতেই মদিনা সনদ লেখা হয়েছিল যেখানে গোত্রের বাইরে (আইনের বাইরে) জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মদিনা সনদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কারো ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে হয় নাই। গোত্রের বাইরে অধিকার বিহীন মানুষের জীবনে অধিকারের ধারণাতে ঈমান এনে (এবং আল্লাহর নবীকে এই সনদের জিম্মাদার মেনে) যে কারোর মদিনার উম্মাহ ভুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। এমনই ঘর হারানো মানুষের আল্লাহর রহমতেই একাত্তর সালে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে মানুষের জীবন ও তাদের অধিকার (মানবিক মর্যাদা) রক্ষার জন্য একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছিল।

আরবি রহমত শব্দটির একটি অর্থ ‘গর্ভ’ বা ‘শুদ্ধ সম্ভাবনা’ (pure potentiality)। শুদ্ধ সম্ভাবনা এমন একটা ধারণা যাকে কোনভাবেই নিয়মের মধ্যে পুরোপুরি বেঁধে ফেলা যায় না। রহমতের ধারণাও তো তাই- নিয়মের বাইরের সদা বর্তমান হাজিরা, যা বাস্তবতায় ফুরিয়ে যায় না। মানুষের ধর্ম এমনই রহমত (সম্ভাবনা) যা নিয়মের মধ্যে মানুষের সমস্ত অস্তিত্বকে পুরোপুরি নিঃশেষিত হতে না দিতে সক্ষম (potential not to be)। মানুষের স্বভাব ধর্ম এতটাই ব্যক্তিগত যে তা ভাষায় ব্যক্ত হয় না। এই ‘অব্যক্ত ভাষা’- শুদ্ধ স্বর, এক রহমত, সম্ভাবনাময় গর্ভ- যা মানব সত্ত্বার সমস্ত সম্ভাবনা ভাষার হাতে নিঃশেষিত হওয়া থেকে তাকে হেফাজত করে। আগামবেনের রচনায় দেখা যায় তিনি বারবার তার রাজনৈতিক আলোচনাকে ভাষা ও জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার সাথে যুক্ত করেছেন। তার মতে, চিহ্ন ও ভাব কখোনো একে অপরে পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না, একটা প্রয়োজনীয় ফারাক থাকে সেখানে, যে ফারাক জ্ঞান উৎপাদনের বীজতলা স্বরূপ (’সিগনেচার’,৫৯)। যেমন- মানুষ (অরাজনৈতিক মানুষ) ও নাগরিকের (রাজনৈতিক মানুষ) ধারণার মধ্যে প্রয়োজনীয় ফারাক এক লাওহে মাহফুজ যেখানে ‘মানুষ’ নামক ধারণাটির জ্ঞান সংরক্ষিত আছে। জরুরি অবস্থায় এই দ্বান্দ্বিক ধারণাগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক ফারাকটুকু মিলিয়ে যায়।

সুরা বাকারায় দেখা যায়, আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি’; সর্বদা আল্লাহর অনুগত ফেরেশতারা তখন প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরাই প্রতিনিয়ত আপনার পবিত্র মহিমা ঘোষণা করি’। তিনি বললেন, ‘আমি যা  জানি তোমারা তা জানো না’ (৩০)। এরপরের দুটি আয়াতে দেখা যায় আল্লাহ আদমকে নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর ফেরেশতাদের সামনে সেগুলো উপস্থাপন করে বললেন, ‘এইসবের নাম আমাকে বলে দাও যদি তোমারা সত্যবাদী হও’। ফেরেশতারা নাম বলতে পারলো না, কিন্তু আদম পারলো। যেহেতু আল্লাহ আদমকে নাম শিক্ষা দিয়েছেন আর ফেরেশতাদের দেন নাই। এরপরই আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলেন আদমকে সিজদা করার আর তখন সবাই সিজদা করল- ইবলিশ ছাড়া (৩৪)। ইবলিশ মানতে পারে নাই যে, ফেরেশতারা পুরোপুরি নিয়মের বাধ্যগত সৃষ্টি হওয়া শর্তেও মানুষ, যে নিয়ম মানতেও পারে আবার নাও মানতে পারে, কিভাবে আল্লাহর জ্ঞান ও মর্যাদার অধিকারী হলো। ইবলিশের চিন্তায়, আল্লাহর জ্ঞান এবং রহমত নিয়মের মধ্যে নিঃশেষিত ফেরেশতাদেরই প্রাপ্য। কিন্তু আল্লাহর রহমত এমন একটি ধারণা যা কখনোই নিয়মে নিঃশেষিত হতে পারে না। আর তাই, নিয়মের মধ্যে থেকেও নিয়মে ফুরিয়ে না যাওয়ার ক্ষমতা মানুষকে ফেরেশতার উপরে স্থান দিয়েছে।

যেখানে নিয়মের ও নিয়মের বাইরের জীবনের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য নাই হয়ে গেছে, সেখানে জ্ঞান ও রহমতের কোন ধারণা থাকতে পারে না। সোনার মদিনা তখনই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যখন নগরকে মানুষের ঘর থেকে আলাদা রাখা যাবে। নিজের অরাজনৈতিক জীবনকে প্রতিষ্ঠা করার রাজনীতি ছাড়া মজলুমের মুক্তির আর কোন পথ আছে কি? এর জন্য মানুষকে তার অরাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে হবে। আজকের সময়ে মানুষ তার অরাজনৈতিক অস্তিত্ব সম্পর্কে যত বেশি অজ্ঞ থাকবে, তার জীবন ততই বেশি রাজনৈতিক- অন্যের হাতে শোষিত হওয়ার জন্য ততই বেশি উন্মুক্ত। মানুষকে তার অরাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা বুর্জোয়া ব্যবস্থার অন্যতম প্রকল্প। কারণ এভাবে খুব সহজে মানুষের ঘরকে নগর, বাজার বা তাদের হাতে তৈরি অন্য কোন খোদা দিয়ে দখল করা যায়।  তাই, যে মজলুম আমরা প্রত্যেকে, তার মুক্তির জন্য অরাজনৈতিক জীবন প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে ইস্রাফিলের শিঙা যার ফুৎকারে  যে কেয়ামত সৃষ্টি হবে তাতে যে স্বাভাবিক জরুরি অবস্থায় আমরা বাস করি তা ধ্বংস হয়ে যাবে; আর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে হাজির হবে সোনার মদিনা যেখানে রাষ্ট্র মানুষের উপরে নয় মানুষের কাজে ব্যবহার হবে।

গ্রন্থপঞ্জি

[আগামবেন] Agamben, Giorgio. Homo sacer: Sovereign power and bare life. Stanford University Press, 1998

[আগামবেন] Agamben, Giorgio. ‘Beyond Human Rights’, Means without end: Notes on Politics. University of Minnesota, 2000

[আগামবেন] Agamben, Giorgio. Signature of All Things. Zone books, New York, 2009

[আরেন্ট] Arendt, Hannah. The Origins of Totalitarianism. New edition. San diego/New York/London: Harcourt, 1968

[আসাদ] Asad, Talal. Formations of the Secular: Christianity Islam Modernity. Stanford University Press, 2003

[বেনিয়ামিন] Benjamin, Walter. On the Concept of History. Selected writings, Volume 4, 1938-1940. Howard University press, 1996

[স্মিট] Schmitt, Carl. Political theology, Four Chapters on Sovereignty. University of Chicago Press, 2005

পারভেজ আলম, মদিনা, আদর্শ, ২০২০

  • আবীর আহমেদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *