রাষ্ট্রভাবনায় ‘জাতিসত্তা’ বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে

  • হেলাল মহিউদ্দীন

কৈফিয়ত

সম্প্রতি একটি বিতর্কের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগতভাবে ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটি অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। নৃবিজ্ঞান ছেড়ে সামাজিক ইতিহাস ও সামাজিক রাজনীতির দলিলপত্রাদি সাধ্যমত ঘেঁটেছি। উপমহাদেশের জনজীবনের বিচিত্রতার ধরন বুঝতে চেয়েছি। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতিধারা আলোচনারও চেষ্টা করেছি। শেষমেষ উপনিবেশমুক্ত ভারতবর্ষ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় এনেই ধারণাটিকে বুঝতে চেষটা করেছি। জানার প্রয়োজনে অতীতাশ্রয়ী থাকিনি। বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তায় ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটি কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটিও পর্যালোচনা করতে চেয়েছি। সবশেষে ধারণাটির প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তাও চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। এই লেখাটি আমার ব্যক্তিগত অনুধাবনের একটি সহজ সারসংক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করছি। লেখাটিকে যতোটা সম্ভব সহজ, বারোয়ারি, বোধগম্য ও আসরমূখী রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনে সহজপাঠ্য রাখা। সেজন্য লেখাটি হতে টীকা-টিপ্পনি, উদ্ধৃতি, গ্রন্থ-নির্দেশনা ইত্যাদি ইচ্ছাকৃতভাবেই তুলে নেওয়া হয়েছে। নিতান্তই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমিত আকারে কিছু উদ্ধৃতি ও টীকা থাকছে যদিও।  

জাতিসত্তা ও বেনেডিক্ট অ্যান্ডার্সনের ‘ইম্যাজিনড কম্যুনিটি’ 

‘জাতিসত্তা’ শব্দটি দিয়ে আসলে আমরা কী বুঝি বা বুঝাই? ‘জাতিসত্তা’ আসলে কী—এই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য সহজ উত্তরও নেই, সংজ্ঞাও নেই। বাংলাদেশে আমরা কী বুঝি কেন বুঝি তারও কোনো সরল-সোজা কোনো উত্তর নেই। বাংলাদেশে ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও কোনো গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা মেলেনি। কিন্তু এই সামগ্রিকতাবাদী বায়বীয় ধারণার বিপদ যে বাংলাদেশের ভবিষ্যত বিপন্ন করে তুলতে পারে, সেই ইঙ্গিতটি অহরহই মিলছে। ‘আমরা জাতিসত্তায় বাঙালি’—এরকম একটি ফাঁপা আবেগঘন উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনা আপ্তবাক্য আকারে বহু আলোচনায় ও লেখায় পেয়েছি। কিন্তু কীভাবে সেই উত্তর নিয়ে একটিও রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত, নিরাবেগ, গবেষণাধর্মী বা বিশ্লেষণধর্মী বয়ান কোথাও মেলেনি। মোটামুটি সকল বয়ানেই ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আলোচনার সারবেত্তাহীন বিতর্ক ও পারস্পরিক মুন্ডুপাতের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে। ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ ভাবনার আত্মপ্রসাদ হতেও এই বিভ্রান্তিটি তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

আমরা ‘জাতিসত্তা’ ভাবনা ভাবতে গিয়ে একটি বিমূর্ত সামাজিক সংগঠন কল্পনা করি। এই সংগঠনের সদস্যরা সকলে বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ। তবে দেশের রাজনৈতিক সীমানার বাইরের বাংলাভাষিদেরও এই দলে ফেলা হবে কী না আমরা নিশ্চিত নই। তবু আমরা মনে করি আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য-চিহ্ন, সাংস্কৃতিক জীবনপ্রণালীর ধারাবাহিকতার কারণে আমরা একটি অখণ্ড ও সঙ্ঘবদ্ধ বর্গ। আমরা এই সঙ্ঘটির সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ টের পাই। পরস্পরকে নিজেদের লোক মনে করি। ফলে নিজেদের ‘এক জাতীয়’ অর্থাৎ একই রকম বা কাছাকাছি ধরনের বৈশিষ্ট্য ভাগাভাগি করা মানুষ ভাবি। আমাদের এই বিমূর্ত বন্ধনই জাতি-রাষ্ট্রকে (Nation-state) সুসংহত করে রাখে।

জাতি-পরিচিতির এই বন্ধনটি বেশ নজরে পড়ে কোনো জাতীয় দূর্যোগের পর। সকলে যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসে। দেশ যুদ্ধের কবলে পড়লে সেনাসদস্য পেতে সমস্যা হয় না। দেশপ্রেম এই সম্পর্কের বাহ্যিক প্রকাশ। যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়ার পর নাগরিকগণ ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতির বিভেদ ভুলে এক আত্মা এক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ভূমিকম্পে হাইতিতে, ইরানে, আফগানিস্তানে বা লেবাননে মানুষজন।    

বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ গবেষণার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর আলোচনার গণ্ডিটি রাজনৈতিক। অনেকটা সামাজিক রাজনৈতিক। তিনি জানেন জাতীয়তাবাদ আত্মগর্বি হয়ে পড়লে উগ্র জাতীয়তাবাদের রূপ নিতে পারে। শ্লাঘা বা অতি-আত্মমর্যাদাবোধের উন্নাসিকতা সভ্যতার ইতিহাসে কম বিপর্যয় ডেকে আনেনি। যেমন জার্মান ন্যাশনাল আইডেন্টিটি (জার্মান জাতিসত্তা) স্বজাতশ্লাঘাকে ছাড়িয়ে উগ্র বর্ণবাদী ও পরজাতি-বিদ্বেষি রূপ ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছিল। জার্মান জাতি ‘আর্য এবং নীল রক্তের অধিকারী’—শ্লাঘাবোধটি সাধারণ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

আসা যাক চলতি সময়ে হঠাত পালে হাওয়া পাওয়া জাতীয়তাবাদী ‘ফরাসী ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ (ফরাসি জাতিসত্তা) ভাবনায়। অনেকেই মনে করেন যে ফরাসি জনগণের মাঝে জাতিত্বগর্ব, উন্নাসিকতা ও শ্লাঘা দ্রুত উগ্র রূপ নিচ্ছে (Abelson et al. 2020, Gareau 2020, Imbert 2020, Ferland and Sturgeon 2020)। ফরাসিরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও নন্দনতত্ত্বে বিশ্বসেরা। এটি পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃত সত্য। কিন্তু শুধু সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের উন্নাসিকতা ও শ্লাঘার কারণে কানাডার ফরাসিভাষী অধ্যুষিত ক্যুইবেক প্রদেশটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে চলছে কয়েক দশক জুড়েই।

‘ফরাসিদের নাক উঁচু’ এবং অন্যদের তারা ‘সাংস্কৃতিকভাবে হীনমান’ বিবেচনা করে—এটি বিশ্বজুড়েই একটি অতিশ্রুত এবং বহুল প্রচলিত বয়ান। সামাজিক ইতিহাসের গবেষক জ্যাক হেওয়ার্ড তাঁর Fragmented France: Two Centuries of Disputed Identity বইতে French Identity: The National Search for Retrospective Legitimacy and Unanimity অধ্যায়ে তথ্যপ্রমাণসহ দেখান যে ফরাসি জাতিসত্তা (ন্যাশনাল আইডেন্টিন্টি অর্থে) একটি সুচিন্তিত ও সুনির্মিত বিষয়। ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ ভাবালুতা দিয়ে জাতি-পরিচিতি নির্মাণ করা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সত্য-মিথ্যা-রূপকথা মিলিয়ে স্বজাত্যাভিমানমূখি ইতিহাস লিখতে হয়, লিখিয়ে নিতে হয়। আইনের ধারা-উপধারায় এবং গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্যে অসংখ্য উপকথা-লোককথা, অনুজ্ঞা-উপমা এবং রূপকাশ্রয়ি গর্ব-গৌরবগাথাকে চর্বিত-চর্বনের মাধ্যমে সজ্ঞানে বৈধতা দিতে হয়। ফরাসি জাতিবাদীরা সজ্ঞানেই সে কাজটি করেছে। ধর্ম ও শিল্পকলায় জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে গিয়ে ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় জ্ঞান-গরিমার উপাদানগুলোকে যথাসাধ্য স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উদ্দেশ্য ‘আমরা ফরাসিরা সংস্কৃতিতে বিশ্বসেরা’ কথাটি দিয়ে সকল নাগরিককে ফরাসিত্ববোধে আঁকড়ে রাখা।

বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন অস্বীকার করেন না যে জাতীয়তাবাদ অন্যের প্রতি ঘৃণা, অপরের বিপক্ষে যুদ্ধোম্মত্ততা, শক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, নিজদের মধ্যে বিভাজন ইত্যাদি ডেকে আনতে পারে। তবু তিনি মনে করেন ‘নেশন’ বা জাতি একটি ‘ইম্যাজিন্ড কম্যুনিটি’ বা অনুধাবননির্ভর কৌম বা সম্প্রদায়, এবং এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, দিনশেষে এই স্বগোত্র-ভাবটিই পস্পরের প্রতিও ভালবাসা ও দায়িত্বের মনোভাব জিইয়ে রাখে। তিনি তাই লিখেন—

“In an age when it is so common for progressive, cosmopolitan intellectuals to insist on the near-pathological character of nationalism, its roots in fear and hatred of the Other, and its affinities with racism, it is useful to remind ourselves that nations inspire love, and often profoundly self-sacrificing love” (Anderson 2006:141)।

এই ইম্যাজিন্ড কম্যুনিটির জন্য আত্মবিসর্জনের উদাহরণ দেখতে পাই মুক্তির যুদ্ধে, বহিশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দেবার মধ্যে। এটি স্পষ্ট যে, আমাদের ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটি বেনেডিক্ট-এর বলা ‘ইম্যাজিন্ড কম্যুনিটি’ মাত্র। সমস্যা হচ্ছে বেনেডিক্ট এর ‘নেশন’ বা ‘জাতি’ ধারণাটি স্পষ্ট হলেও ‘জাতিসত্তা’ হিসেবেও একই ব্যখ্যাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ কম।

রুথ বেনেডিক্ট ও ফ্রয়েডের সতর্কতাবাণী

জাতিসত্তা ভাবনাটি সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি স্মিথ-এর (Guibernau 2004) ভাবনার অনুরূপ। স্মিথ মনে করেন যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। ফলে রিলে রেইসের মত সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা দিয়ে একটি জাতি-পরিচিতির বন্ধন টিকিয়ে রাখতে পারা সম্ভব।   

‘সত্তা’ প্রশ্ন পরে আসুক। আগে প্রশ্ন করা যাক, ভৌগোলিকভাবে একই অঞ্চলের বাসিন্দা কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণের মিলগুলোকে বা সাংস্কৃতিক সমরূপিতাকে বিবেচনায় নিয়ে সেই জনগোষ্ঠীকে ‘জাতি’ বলা যাবে কি? অতীতের জীবনধারা ইতিহাসের পরম্পরায় বর্তমানেও টিকে থাকে কী না? ‘জাতিসত্তা’ ধারণা সম্পর্কে আমাদের মানসগঠন (মেন্টাল কন্সট্রাক্ট) কিন্তু সে রকমই। জাতিসত্তা ধারণা দিয়ে আমরা একই সাংস্কৃতিক জীবনধারার বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করতে চাইছি—সেটি স্পষ্ট।

এভাবে জাতিকে বা জাতিসত্তাকে দেখা কি ঠিক? নৃবিজ্ঞানী রুথ বেনেডিক্ট চল্লিশের দশকেই বলেছিলেন ‘না’, ‘ঠিক নয়’ (Benedict 1946)। এভাবে জাতি চিহ্নিত করার বিপদ অনেক। কারণ, সংস্কৃতি মহাগতিশীল। বেনেডিক্ট দেখালেন যে জীবনাচরণে অসংখ্য অলঙ্ঘ্য মিল থাকার পরও বৈপরীত্বের ছড়াছড়ি থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রেও। এমনকি পরিবারের মত ক্ষুদ্রতম গণ্ডিতেও। প্রতিদিনই আমরা নতুন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসি। প্রতিদিনই নিত্যনতুন উপাদান নিজেদের জীবনাচরণে যুক্ত করি। অতীতের অকার্যকর ও অ-সময়ানুগ উপাদানগুলো পরিত্যাগ করি। ফলে পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে আটকে থেকে কোনো সমাজ সামনে এগোতে পারে না।  তারও বহু আগে তিরিশের দশকেই সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Freud 1930 [1977]) জানিয়েছিলেন পাশাপাশি অনেকগুলো অঞ্চলের মানুষের ভাব-ভাবনা ও চালচলনে অশেষ মিল নিয়ে থাকার পরও তাদের মানসগঠন বা মনোজাগতিক গড়নকে একই ছকে ফেলা দারুণ ভুল হবে। তাদের মধ্যে বিভিন্নতা থাকবে। বিভিন্নতার পেছনে নানারকম ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ থাকবে। সহজ উদাহরণ—‘আমরা জাতিসত্তায় বাঙালি’ বলার বা বয়ানটি প্রতিষ্ঠাদানের নিরন্তর চেষ্টার পরও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ঘরাণায় আমাদের বিভক্তি তৈরি হয়েছে। একই ঘরে একই রক্তের উত্তরাধিকার সহোদর-সহোদরার মধ্যেও একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অন্যজন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এ বিশ্বাসী মেলাও কিন্তু অসম্ভব নয়।

উন্নত রাজনীতির জাতিরাষ্ট্রগুলো—বিশেষত কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো—রুথ এবং ফ্রয়েড-এর ভাবনার সূত্র ধরেই স্থুল জাতীয়তাবাদের রাহু হতে মুক্ত হবার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইম্যাজিনড কম্যুনিটির বাইরের সদস্যদেরও যাতে সমান সম্মান দেওয়া যায় সেজন্য ‘জাতিসত্তা’র মত স্বার্থপর আদর্শবাদকে পরিত্যাগ করে কতকগূলো শ্রেয়চিন্তাকে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিমালার অন্তর্ভূক্ত করে নিচ্ছে। শ্রেয়চিন্তাগুলো হচ্ছে মানবিকতা (হিউম্যানিটি), মানবাধিকার (হিউম্যান রাইটস), বহুবৈচিত্রতা (ডাইভার্সিটি), অন্তর্ভূক্তিকরণ (ইনক্লুশন), বহুসংস্কৃতিবাদ (মাল্টিকালচারালিজম), বহুবিশ্বাস-গোত্র (মাল্টিফেইথ কম্যুনিটি) প্রতিষ্ঠাদান।

জাতিসত্তা একটি পাশ্চাত্য ধারণা [বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়ও বটে]

‘জাতিসত্তা’ অনুভব-অনুভূতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’র মিল লক্ষ্যণীয়। ধারণাটি মূলত একটি মনোজাগতিক অনুভবের জন্ম দেয়। এ কারণে জন জস্ট এবং জিম সিদানিয়ু তাদের সম্পাদনায় ২০০৪ সালে ছাপা Key readings in social psychology. Political psychology: Key readings বইটিতে ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ ধারণাকেও সামাজিক মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত বিষয় গণ্য করেন। বইটিতে হেনরি তাজফেল এবং জন টার্নার The Social Identity Theory of Intergroup Behavior অধ্যায়ে ‘একই দেশভূক্ত একদল মানুষের স্ব-দল বিষয়ে গভীর ‘ইতিবাচক আবেগ’এর (পসিটিভ ইমোশন) ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন (Tajfel & Turner 2004)।   

সর্বোপরি, ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ও ‘ইম্যাজিনড কম্যুনিটি’র মত একটি সর্বৈব পশ্চিমা ধারণা।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ধারণাটিকে মদদ দান করেছে। জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতাকে উদাহরণ ধরলে ধারণাটির পশ্চিমা চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিমা বলেই প্রাচ্যে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলছি না। সেরকমটি হলে পশ্চিমা গণতন্ত্রও প্রাচ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। আলোচনার কেন্দ্রমুখ এই বাস্তবতার দিকে যে ফরাসি জাতি(সত্ত্বা), জার্মান জাতি(সত্তা) বা ইংরেজ জাতি(সত্তা) ধারণাগুলোর পেছনে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ক্রীড়নক রয়েছে। বাঙ্গালি জাতিসত্তার পেছনে সে রকম কোনো ক্রীড়নকের সন্ধান মেলে না। তাই দিনশেষে ‘বাঙালি জাতিসত্তা’ একটি বিমূর্ত ধারণাই রয়ে যায়।  

‘ন্যশনাল আইডেন্টিটি’ ভাবনার জন্মকালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ধরন-ধারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভিন্নতা সম্পর্কিত তুলনামূলক আলোচনাটি তোলার আগে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদ গবেষক কৃষাণ কুমারের English and French national identity: comparisons and contrasts শিরোনামের একটি গবেষণা প্রবন্ধের ভাষ্যে নজর রাখা জরুরি। কৃষাণ কুমার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ফরাসি ও ইংরেজ দুই জাতির ভাবনার গভীর মিল এবং অমিল দুটোই রয়েছে। মিল এই অর্থে যে উভয় জাতিরই বদ্ধমূল ধারণা তারা উপনিবেশ স্থাপন করে উপনিবেশিতদের দারুণ উপকার করে দিয়েছে। কৃষাণ কুমারের ভাষায় ‘মিশনারি’ দায়িত্ব পালন করেছে। ফরাসি ও ইংরেজরা শ্রেষ্ঠত্বের আলো না ফেললে উপনিবেশগুলো অনন্তকাল পশ্চাদপদ ও অন্ধকারে রয়ে যেত-এমনটিই তাদের দৃঢ়বিশ্বাস (Kumar 2006)। এ কারণে তাদের আত্মশ্লাঘাও আকাশ ছুঁইছুঁই। আত্মশ্লাঘা উগ্র জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য। ‘আমরা ফরাসী’, এবং ‘আমরা ইংরেজ’ ধরনের স্বাতন্ত্র্যবোধ-সচেতনতা—নিজেদের অন্যদের তুলনায় কীর্তিমান দেখানোর চেষ্টা—শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা তাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ইত্যাদি একসময়কার সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিও নিজেদের উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক অবতার এবং উপনিবেশিতদের জন্য আশীর্বাদ মনে করে। সে জন্য ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা-ভাস্কর্য ও নন্দনতত্ত্বে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর প্রতিযোগিতায় এক দেশ অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। উদ্দেশ্য যাতে সাধারণ্যে বা আমজনতার মাঝেও নিজেদের উৎকৃষ্টতার বিশ্বাস জন্ম নেয়।

হেওয়ার্ড মনে করেন, বাস্তবে কোনো সংস্কৃতিই অখণ্ড একক থাকে না। ফরাসি সংস্কৃতিও আর কোনোভাবেই অখণ্ড একক নেই। আঞ্চলিকভাবে এটি নানারকম বৈচিত্র্যমন্ডিত। প্রকারে ও প্রকরণে একেকটি অঞ্চল একেক রকম। তবু জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টায় কমতি নেই। হেওয়ার্ড তাই লিখলেন-

—”The French sense of national identity derives from legitimizing myths and symbols rather than from the divergent realities that operate within shifting territorial frameworks of reference. National heroes are commemorated in the Pantheon, statues, and state funerals while the people are personified in the secular figure of Marianne as against the Right’s Joan of Arc. Roman Catholicism’s link with the Monarchy historically linked claims to religious universality and national specificity. Conscription and literacy in French language reinforced national-building” (Hayward 2007: 41).

তাহলে অমিলটি কোথায়?  ফরাসি ও ইংরেজ স্ব স্ব জাতি-পরিচিতি নির্মাণের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে দুইভাবে। কৃষাণ কুমারের মতে ফরাসি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছিল রেভলিউশনারী বা বিপ্লবাত্মক। অন্যদিকে, বৃটিশ জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠেছিল ‘ইভল্যুশনারি’ বা বিবর্তনমূলক উপায়ে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব বিশ্বের সামাজিক রাজনীতির খোলনলচে পালটে দিয়েছিল। মুল কারণ ছিল জনগণের বিজয়। রাজতন্ত্রের অধীনে জনগণের মুখ খোলারই জো ছিল না। জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন শুধু দেখাই যায় না, বাস্তবায়নও করা যেতে পারে—এরকম বিশ্বাসও জনমনে আসন গেড়ে বসতে থাকে। ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের ভাঙ্গন তিনটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। এক, অর্থনীতিতে মূর্ত হয়ে ওঠছিল পুঁজিবাদের সমূহ বিকাশ এবং অপ্রতিরোধ্য প্রভাব সৃষ্টির শর্তগুলো। দুই, রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনা, অর্থাৎ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবার অমিত সম্ভাবনা। তিন, রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠেছিল ‘ফরাসি জাতীয়তাবাদ’। ফ্রান্স গর্ব করতে পারে ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী ‘রেঁনেসাঁ’কাল ও পরবর্তী আধুনিককালের দ্রুততম (বৈপ্লবিক) সমাজ পরিবর্তনের। উপনিবেশ বিষয়েও ফরাসিরা উদারপন্থার দিকে ঝুঁকছিল। ব্রিটেন একই সময়ে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ঘটা পরিবর্তনকে ধীরলয়ে আত্মস্থ করার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে আরো সুসংহত করে চলছিল।

পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝেও প্রাচ্য প্রায় অপরিবর্তনীয় গ্রামীণ কৌম সমাজ হিসেবে নিথর নিশ্চল ও ধীরস্থির কৃষি সমাজ রয়ে যায়। কার্ল মার্ক্স, ম্যাক্স ভেবার, হেনরি মেইন, শেল্ভাংকার, ডি ডি কোসাম্বি, কার্ল উইটফোগেল হতে শুরু করে হালের যদুনাথ সরকার, ইরফান হাবিব বা ভ্যান শ্যান্দ্যেলসহ সকলেই একটি বাস্তবতায় একমত। শিল্পভিত্তিক পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার উল্লম্ফনকালেও প্রাচ্যসমাজ কৃষিভিত্তিক সামন্ততন্ত্রেই আটকে ছিল। মার্ক্স বিষয়টিকে দেখলেন ‘এশিয় উৎপাদনব্যবস্থা’ হিসেবে। কার্ল উইটফোগেল দেখলেন ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে। হেনরি মেইন সমাজটিকে দেখলেন কৃষিনির্ভর ‘সেচ সমাজ’রূপে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চালু থাকলেও বৃটিশপূর্ব মোগল কৃষি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিই বহাল ছিল। ১৮৮৫ সালের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘জাতীয়তাবাদ’ ততোটা জন্ম নেয়নি। কৃষক আন্দোলন, বিদ্রোহ বা ক্ষুদ্রক্ষুদ্র প্রতিরোধগুলোর কোনোটিই জাতীয়তাবাদী ভাবনা উৎসারিত ছিল না। সেগুলোর বেশিরভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল ইনসাফ বা ন্যায়বিচার অর্জন, এবং শোষণ বন্ধ করা। অন্যদিকে উপমহাদেশে বহিরাগতদের আগমন ও শাসনের প্রভাবে আড়াই হাজার বছর জুড়েই সাংস্কৃতিক সংকরায়ন ঘটেছে। ফলে জাতিসত্তা হবার জন্য ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতার শর্তও বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই।    

জাতিসত্তার পরিভাষাগত অস্পষ্টতা

‘জাতি’ বলতে ‘নেশন’ বা ‘নেশন-স্টেইট’ নির্দেশ করা হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়। ‘সত্তা’ বলতে অস্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, পরিচিতি, স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি হয়ত বুঝিয়ে থাকতে পারে। ইংরেজিতে বুঝতে চাইলে বিষয়টিকে কি ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ দিয়ে বুঝতে হবে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। না কি ‘ন্যাশনালিস্টিক স্পিরিট’, ‘ন্যাশনাল প্রাইড’, ‘ন্যাশনাল কনশাসনেস’ ইত্যাদি ধারণার আলোকে বুঝতে হবে? ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটি ঠিক কী কারণে রাষ্ট্রের দরকার? জাতি গঠন বা পূণর্গঠনের জন্য? পশ্চিমে ‘নেশন-বিল্ডিং’ এর যে চলমান ধারণার জয়জয়কার, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে কী? ন্যাশনাল সেন্টিমেন্টও কি জাতিসত্তার ধারণাভূক্ত? এরকম অসংখ্য প্রশ্নই উত্তরহীন রয়ে যায় শেষ অব্দি।     

জাতিসত্তার সংবিধানগত বিভ্রান্তি

গত দুই দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাবনায় ‘জাতিসত্তা’ ধারণাটি নানা মোড়কে নানা আকারে লিখিত হয়ে চলেছে। ধারণাটির বিভ্রান্তিকর প্রয়োগের শুরু অন্য কোথাও নয়, সংবিধান দিয়েই। আশঙ্কার কারণ সেখানেই। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’র ২৩ক উপধারার শিরোনাম উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি। রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন”। স্পষ্টতই সংবিধান জাতিসত্তা শব্দের মাধ্যমে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’কে নির্দেশ করছে।

শুরুতেই একটি বিষয় পরিস্কার করে নেওয়া দরকার যে ইংরেজি ‘এথনিসিটি’ এবং ‘এথনিক আইডেন্টিটি’ এক নয়। ‘এথনিসিটির বাংলা করা যেতে পারে ‘জাতিত্ব’। তবে ‘নৃ-বর্গ’ লেখাই অধিক সমিচীন। ‘এথনিক আইডেন্টিটি’ জাতিগত পরিচয়। একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ‘দ্রাবিড়’ ‘জাতিত্ব’ বা নৃ-বর্গ। এটি সামগ্রিক অর্থবাচক। ইংরেজিতে যাকে ‘আম্ব্রেলা কন্সেপ্ট’ বলা যেতে পারে। কিন্তু ‘সিংহলি’ ও ‘তামিল’ নৃ-গোষ্ঠীগত পরিচয়। দ্রাবিড়দেরই দুটি শাখা। তাদের শাখা হবার কারণ ‘স্বাতন্ত্র্য’। প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় রাজনৈতিক  জাতি (নেশনহুড) গঠনের প্রক্রিয়ায় তারা কি ‘স্বাতন্ত্র্য’ বিসর্জন দিয়ে অন্য সকলের মত হয়ে যেতে চেয়েছিল? উত্তর ‘না’। বরং তারা ‘স্বতন্ত্র’ সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে রক্ষা করা তো বটেই, আরো উজ্জীবিতই রাখতে চেয়েছিল। তাদের “না” উত্তরটিকে আমলে না নেওয়া এবং স্বতন্ত্র জীবনধারার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব হতেই মূল সমস্যার শুরু। এই আমলে না নেওয়ার বিষয়টি চোখে দেখা যায় না। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র স্বীকার করা দূরে থাকুক, মনেও করে না অশ্রদ্ধা করা হয়েছে বা হবে।

জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র কেন ভাবে যে সংবিধান মোতাবেক কারো প্রতি বৈষম্যের কোনোই সুযোগ নেই? আগেই বলে নিই ‘আদিবাসী’ ও জাতীয়তাবাদ’ বিতর্কে এখনই যাব না। কারণ, এই পর্বে সেটি বিষয়ভাবনা ও আলোচনাকে সহজ করার বদলে জটিল করে তুলবে। যাই হোক জাতি-রাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র এমনটি ভেবে থাকে কারণ, সংবিধানে লিখিতই থাকে সকল নাগরিকের অধিকার, কর্তব্য, সম্মান-শ্রদ্ধা সমান।

জাতিসত্তার ধারণা নাগরিকত্বের ধারণাকেও বিভ্রান্তিকর করে তোলে

দেখা যাচ্ছে “নাগরিক” বা “সিটিজেন” ধারণাটিই আসল। তারপর লিখিত নীতিমালাই (সংবিধান) শেষ কথা। সকলকে এক পাল্লায় নাগরিক বানিয়ে ফেলার সুবিধা একটিই—‘পরিচিতি’ প্রদান। নাগরিকের পাসপোর্ট থাকবে, নাগরিক পরিচিতি থাকবে। ঠিকানা থাকবে। তার দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্র বাধ্য। বাংলাদেশের পাসপোর্ট যার হাতে সে বাংলাদেশের নাগরিক। এভাবে যে ব্যক্তি যে দেশের পাসপোর্টধারী, সেই ব্যক্তি সেই দেশের নাগরিক। পদ্ধতিটিকে জটিলতামুক্ত সহজ সমাধানই মনে হয়।

একটি নির্দিষ্ট সার্বভৌম রাজনৈতিক সীমান্তবেষ্টিত ভূ-খণ্ডের ভেতরে বসবাস করা সকলেই “নাগরিক”। “নাগরিক” একটি সর্বৈব রাজনৈতিক ধারণা। মূলত পশ্চিমা ধারণা। তদূপরি ‘শহুরে’ ধারণা। প্রাচীন গ্রীসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র বা ‘সিটি-স্টেইট’এর আওতায় বসবাসকারীরাই ছিল ‘নাগরিক’। নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম। বর্তমানের রাষ্ট্রও স্বাধীন এবং সার্বভৌম। মিল আছে। কিন্তু বড় অমিলও আছে। আধুনিক রাষ্ট্র ‘নেশন-স্টেইট’ বা ‘জাতি-রাষ্ট্র’। জাতি-রাষ্ট্র জটিল বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্থা। জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকলেই নগরের বাসিন্দা নয়। ভূবনায়নের সুবাদে তাদের এক বড় অংশ বৈশ্বিক পরিভ্রমণে মত্ত। তারা ‘গ্লোবাল ভিলেইজ’এর অধিবাসী। তাদের পরিভ্রমণ ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে। তারা নিত্যনতুন সংস্কৃতির সংস্পর্শ  লাভ এবং গ্রহন-বর্জন ও পরিবাহিতার মাধ্যমে গন্ডির ধারণা ভেঙ্গে বসেছে। বর্তমানের চলতি শ্লোগান ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’—সীমানা আকাশতক। এই অসীম বিশ্বনাগরিক ধারণার পাশে ‘জাতিসত্তা’ একটি হেঁয়ালি মাত্র। 

কিন্তু ‘জাতিসত্তা’র অন্তর্গত স্ব-জাতিবোধ বিষয়টিকে জটিল ও অ-মানবিক করে তোলে। ধরা যাক, একজন বাংলাদেশের নাগরিক—বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে, বাংলাদেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠে, বাংলাদেশকে গভীরভাবে ভালবেসে যাবার পরও শেষ বয়সে কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন। তাঁর পাসপোর্ট কানাডার। কিন্তু, বাংলাদেশে তাঁর আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু সমাজ সবই রয়েছে। মনে-প্রাণে-অস্তিত্বে-বিশ্বাসে-বোধে-সংস্কৃতিতে তিনি বাংলাদেশিই রয়ে গেছেন। তিনি তাঁর পরিচিতি দিচ্ছেন ‘বাংলাদেশি’। প্রবাসে দেশের সংস্কৃতি চর্চা করছেন। দেশের ফুটবল-ক্রিকেট দলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজয়ে উল্লাস করছেন। দেখা যাবে কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচে তিনি বাংলাদেশের পোশাক পরে বাংলাদেশের পতাকা হাতে বাংলাদেশ সমর্থকদের জন্য নির্ধারিত গ্যালারিতে বসেই উল্লাস করছেন। কানাডার পরাজয়ে উল্লাস করছেন। অথচ তিনি কানাডার নাগরিক। কানাডার পাসপোর্টধারী। তাঁর এই আচরণের কারণে কানাডা কি তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেবে? পাসপোর্ট বাতিল করবে। দেশদ্রোহী ঘোষণা করবে? কানাডা হতে বিতাড়িত করবে?

কানাডার স্টেডিয়ামে বসে জন্ম-কানাডিয় শ্বেতাঙ্গ বন্ধুর পাশে বসে কানাডার পরাজয়ে বাংলাদেশের পক্ষে উল্লাসের কারণে জন্ম-বাংলাদেশীদের এক কণা ক্ষতিও করবে না কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন বা কল্যাণ রাষ্ট্রের কোনোটিই। কানাডিয় শ্বেতাঙ্গ বন্ধুটি জন্ম-বাংলাদেশি বন্ধুটিকে উল্লাসের অপরাধে বন্ধুত্বছাড়াও করবে না। উল্টো জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানানোর সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, দেশটি ‘জাতিসত্তা’ নামক বায়বীয় স্ব-জাত্যবোধ ও উন্নাসবোধকে খারিজ করে দিয়েছে। যতোই দিন যাচ্ছে, ভূবনায়ন ঘটছে। মানুষ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রীয় গণ্ডিতে আটকে থাকতে পারছে না। ‘বিশ্বনাগরিকত্ব’ ধারণা শক্তিশালী হচ্ছে। জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্রত্বও প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। রাষ্ট্রের পাসপোর্ট বা পরিচিতি-কার্ডই ব্যক্তির সত্তা নির্দেশ করছে না।

জাতিসত্তা ভাবনার আগে এথনোসেন্ট্রিজম হতে মুক্তি বেশি দরকারি

‘এথনোসেন্ট্রিজম’ স্বজাত্যশ্লাঘাকে বুঝার জন্য আঞ্চলিকতার উদাহরণ টানছি। ‘আমরাই সেরা’ এথনোসেন্ট্রিজমের প্রথম খারাপ দিক। ‘আমার চোখ দিয়ে বা বোধ-বুদ্ধি দিয়ে যেটিকে অগ্রহণযোগ্য মনে হবে, সেটি আসলেই অগ্রহণযোগ্য’ ধরনের বদ্ধমূল অবস্থান এথনোসেন্ট্রিজমের দ্বিতীয় খারাপ দিক। এথনোসেন্ট্রিজম-এ অন্যের চোখ দিয়েও দুনিয়া দেখার বদলে নিজের দেখাই ঠিক ধরনের কূপমন্ডুকতা স্পষ্ট। আমরা প্রায়ই বলি ‘অন্যের জুতা পায়ে দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করো’। এই অবস্থানটি হচ্ছে মুক্তচিন্তার, স্বচ্ছতার, বিশ্লেষণের ও আলোকপাতের। এটি স্বজাত্যশ্লাঘার উল্টো অবস্থান। নৃবিজ্ঞানে এই ধারাকে বলা হয় ‘কালচারাল রিলেটিভিটি’ বা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা। এথনোসেন্ট্রিজমের স্থানীয় পর্যায়ের উদাহরণ ‘আঞ্চলিকতাবাদ’। বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড। তার ওপর ঘণবসতিপূর্ণ। একরকম গা ঘেঁষাঘঁষি থাকার পরেও সাধারণভাবে চট্টগ্রামের মানুষ নোয়াখালির মানুষ সম্পর্কে বিচিত্র পূর্বসংস্কার ও বিদ্বেষ পোষণ করে। বিদ্বেষ-পদ্ধতিটি একদেশদর্শী। উদ্দেশ্য নিজেকে বড় করে দেখানো। অন্যকে ছোট করা। অন্যদিকে দেখা যায় দেশজুড়েই ‘নোয়াখালি’ বিষয়ক নানারকম পুর্বসংস্কার ও অপবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়েই রয়েছে। এই সাংস্কৃতিক বিভাজনই যেখানে দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এখনো, সেখানে জাতিসত্তার ধারণাটি কষ্টকল্পনাই বটে!      

জাতিসত্তা জাতিত্ব (এথনিসিটি) নয়, নৃগোষ্ঠী-পরিচিতিও নয়

সমস্যাটি বাড়ে তখনই যখন ‘এথনিক আইডেন্টিটি’ মানুষকে এক ও একাত্ম করে তোলার বদলে বিভাজনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ধরা যাক বাংলাদেশের ‘সাঁওতাল’দের কথা। ওঁরাও এবং মুন্ডাদের কথা। সংবিধান ধরে এগোলে এদের এবং সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃ-গোষ্ঠী মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ খোলা চোখেই দেখা যায় যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ মূল ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠির চাইতে ভিন্নরকম। সংখ্যাও সমস্যার কারণ। তারা সংখ্যায় সংখ্যালঘূ। মূল ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠির ক্ষুদ্রতম অংশ। সে কারণেও সংবিধান নির্দেশিত আইনানুগ উপায়েই আমরা তাদের ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ বা ‘নৃ-গোষ্ঠী’ পরিচিতি দিচ্ছি। কিন্তু সামান্য মানবিক ভাবনার আলোকে বিচার করতে গেলে বুঝা যাবে সংবিধান মানতে গিয়ে আমরা হয়ত তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক, অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ উপেক্ষা করতে সক্ষম হবে না। কারণ তারা সংখ্যালঘূত্বের কারণে প্রতিরোধ দূরে থাক, অধিকারের কথাটিও সজোরে বলতে পারবে না। অথচ তারা ভূমিপুত্র। এ অঞ্চলের মূল আদি অধিবাসী। মূল ভূখণ্ডের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বহিরাগত ও অন্তর্গতদের নানা রকম শংকরায়ন ও মিশ্রণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। তারা সংখ্যায় বেড়েছে জনমিতিক পুণরুৎপাদন ও অর্থকরি উৎপাদন প্রণালী করায়ত্ত্ব করার মাধ্যমে। মূল ভূমিপুত্রদের যারাই এই পদ্ধতির মধ্যে বিলিয়মান হয়ে যেতে পারেনি, তারা সংখ্যায় কমেছে। সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও কৃষ্টিকে বদলে ফেলেনি। অর্থাৎ, তারা মৌলিকত্বকেও ধরে রেখেছে। অথচ আমরা তাদেরকেই পরিচিতি দিচ্ছি ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ ধারণার ক্ষুদ্রত্ব দিয়ে। বিশেষণটি হীনার্থক। আসলে অন্যায়।  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলাও এক ধরনের অবিচার। 

শেষ কথা

বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে। পাঁচ দশকে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের বিচিত্র বাস্তবতায় নানারকম রাজনৈতিক দর্শনেরও জন্ম হয়েছে। মোটা দাগে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দর্শনসমূহ নিতান্তই অগভীর ও বিপজ্জনক।  উদাহরণ ‘জাতীয়তাবাদ’ বিতর্ক। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নামক দুইটি বিচিত্র ধারণা দেশের জনগণকে দ্বিভাজিত করে রেখেছে। জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতজন এবং বুদ্ধিজীবীগণও ভাবনা দুটো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। শুধু প্রভাবিত হয়েছেন বললে ভুল বলা হয়। তাঁরা দুইটি বিবদমান শিবিরে বিভক্তই হয়ে গেছেন। অসংখ্য গবেষণা করেছেন, লিখেছেন, গ্রন্থ ছেপেছেন। অভিসন্দর্ভ লিখে অনেকে উচ্চতর ডিগ্রীও হাসিল করেছেন। কিন্তু, এই বিতর্কের ফলে দুইটি শিবিরে জাতীয়তাবাদী মৌলবাদের প্রকোপ বেড়েছে। দুইটি ধারাই বিপজ্জনক। বিপজ্জনক এ কারণে যে দুইটিরই জন্ম ক্ষুদ্র রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। পারস্পরিক রাজনৈতিক স্বতন্ত্র পরিচিতি রক্ষাই উভয় শিবিরের লক্ষ্য। এই বিতর্ক বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টি ছাড়া রাষ্ট্রভাবনায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। জাতিসত্তা ধারণাও যেহেতু মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, সামাজিক সমতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে সক্ষম নয়, বাহুল্য ভাবধারা বর্জনই শ্রেয়। 

তথ্যনির্দেশ

Abelson, Donald, et al. 2020. ‘Millennial and Gen Z francophones don’t value Quebec nationalismMaclean’s, August 26.

Anderson, Benedict 2006. Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. UK: Verso.

Benedict, Ruth. [1946] 1977. The Chrysanthemum and the Sword. London: Routledge and Kegan Paul.

Ferland, Benjamin, and Luc Turgeon 2020. ‘Understanding Majority Attitudes toward Minority Nations in Multinational Federations: The Case of Canada.’ Publius: The Journal of Federalism 50.2: 188-212.

Freud, Sigmund. [1930] 1963. Civilization and its Discontents, translated by Joan Riviere. London: The Hogarth Press.

Gareau, Paul L. 2020. ‘The Army of Mary: Quebec Nationalism and Catholic Heterodoxy.’ in The Mystical Geography of Quebec (Palgrave Macmillan, Cham) pp. 55–83.

Guibernau, Montserrat (2004). ‘Anothony D. Smith on Nations and National Identity: a critical assessment’. Nations and Nationalism. 10 (1–2): 125–141

Hayward, Jack 2007. Fragmented France: Two Centuries of Disputed Identity. US: Oxford University Press.

Imbert, Patrick 2020. ‘Francophones, Multiculturalism and Interculturalism in Canada, Quebec and Europe.’ In Citizenship and Belonging in France and North America (Palgrave Macmillan, Cham) pp. 33–53.  

Tajfel, Henri; Turner, John C. (2004). ‘The Social Identity Theory of Intergroup Behavior’. In Jost, John T.; Sidanius, Jim (eds.).  Key readings in social psychology. Political psychology: Key readings. Psychology Press. pp. 276–293).

Kumar, Krishan 2006. ‘English and French national identity: comparisons and contrasts’. Nations and Nationalism 12 (3), 2006, 413–432.

*প্রবন্ধটি দেশকাল পত্রিকা এর জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২ এ প্রকাশিত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *