- মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান
যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতির পর জনস্মৃতিতে আমরা প্রায়ই জড়িত নানা পক্ষের ভূমিকা সাদা-কালোর ব্যাখ্যায় নামিয়ে ফেলি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই প্রবণতা আরও প্রকটভাবে দেখা যায়। কেননা, বিজয়ের কৃতিত্বের দাবিদার বিভিন্ন পক্ষ যুদ্ধকালীন নানা অসন্তোষ, বিদ্রোহ, অভিযোগ, সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা হতাশার বিষয়গুলোকে পরে আর আলাপযোগ্যই মনে করেনি। এর স্পষ্ট কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় সুপরিচিত স্মৃতিকথাগুলোতেও। সেসবে স্ববিরোধী, বিব্রতকর, মানহানিকর কিংবা হয়তো লজ্জাজনক বিষয়গুলোকে বোধ করি সচেতনভাবেই অতীতের কম প্রয়োজনীয় ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, মূলধারার তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরাও বিভিন্ন পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে অনাগ্রহী থেকে গেছেন। অথচ যুদ্ধকে রাজনীতির অংশ হিসেবেই যদি ভাবা হয়, তাহলে যুদ্ধকালীন নানা পক্ষের অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর্যালোচনাকে ইতিহাস বিশ্লেষণের জরুরি উপায় হিসেবেই দেখার কথা। যেখানে যুদ্ধ মানেই লাখ-কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বিষয়, সেখানে এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর নানা উদ্যোগের দ্বান্দ্বিক জটিলতা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তা ছাড়া ব্যক্তিমানুষের দোদুল্যমানতা, স্বার্থ, সন্দেহ, অস্পষ্টতা কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না—এমন ভাবনা অনৈতিহাসিক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন কয়েক হাজার বইপত্রের খোঁজ সহজে পাওয়া গেলেও সেসবের অধিকাংশের মান ও গুরুত্ব নিয়ে চিন্তকসমাজের অসন্তোষ গোপন বিষয় নয়। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সাহিত্য যেন কানাগলিতে পৌঁছেছে, যেখানে বহুল পরিচিত তথ্যের চর্বিত-চর্বণ করেই প্রতিবছর প্রচুর বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেগুলোর সাফল্য অবশ্য যতটা না নতুন ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ বা তথ্যের উপস্থাপনের জন্য, তার চেয়েও বেশি বিশেষ বিবেচনায় সরকারি ক্রয়তালিকায় স্থান লাভের মধ্যেই যেন নিহিত। তার ওপর যুক্ত হয়েছে কথ্য এবং সামাজিক ইতিহাসের নামে অতিসাধারণ ও চিন্তাহীন প্রশ্নে জর্জরিত সাক্ষাৎকার–সংবলিত এবং কাঠামোবিহীন বইপত্রের বাহার। তা ছাড়া যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা আঙ্গিকের আলাপের বৈশ্বিক ধারা থেকেও বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে দেশীয় চর্চা। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় এই অচলাবস্থার পেছনে যেসব বাস্তব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত দলিলপত্র সংগ্রহে নিত্যনতুন উদ্যোগের অভাব। তাছাড়া, অভাবটা কেবল উদ্যোগের নয়, উৎসাহেরও। বাংলাদেশের জাতীয় মহাফেজখানায় মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহের সক্রিয় উদ্যোগ না থাকার বিষয়টি হয়তো এর বাস্তব প্রমাণ। পরিস্থিতি যখন এ রকম, তখন যেকোনো অজানা অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের খোঁজ পাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও গভীরভাবে ভাবা ও জানার সুযোগ আসা। তা ছাড়া নথিপত্রের গুরুত্ব কেবল নতুন তথ্য লাভের জন্য নয়, পুরোনো শোনা কথা কিংবা স্মৃতিকথায় প্রকাশিত তথ্যের সঠিকতা নির্ধারণের জন্যও সেগুলো প্রয়োজনীয় উৎস হতে পারে। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ও মতিউর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত ইংরেজি বই 1971: The Siliguri Conference. Government in Exile Meets the Elected Peoples Representatives: An Untold Story of the Liberation War তেমন একটি আকরগ্রন্থ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু ধূসর দিক উন্মোচনে গবেষক ও পাঠকদের সাহায্য করবে। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের ইতিহাস উন্মোচনে বইটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে কী ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল, তারও কিছু দালিলিক প্রমাণ বইটিতে পাওয়া যাবে।
১৯৭১–এর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রধানত আওয়ামী লীগ-দলীয় জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বইটির বিষয়বস্তু হলো যুদ্ধকালীন এই সম্মেলন বিষয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কিছু নথি। প্রধানত চারটি অংশে বিভক্ত এই বইটির প্রথমেই রয়েছে সম্পাদকের নোট, যেখানে তিনি সংক্ষেপে নথিপত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে পাঠককে ধারণা দিয়েছেন। দ্বিতীয় অংশে দেবাশীষ মিত্রের লেখা থেকে আমরা নথিপত্রগুলো উদ্ধারের কাহিনি জানতে পারি। তৃতীয় অংশে লে. কর্নেল (অব.) লুৎফুল হক উক্ত সম্মেলনের একটি বিস্তারিত প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেছেন এবং চতুর্থ অংশে নথিগুলো সংকলিত হয়েছে।
বিষয়টি এখন সুবিদিত যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে যে ‘প্রবাসী সরকার’ ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখে ভারত সরকারের পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল।১ বলা যায়, বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাদে সে সময়ে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতাই তাঁদের সহকর্মীদের কাছে সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি। প্রবাসী সরকারের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা কিংবা ব্যক্তিত্বের নানা সংঘাত খোদ মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়েই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালিদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার দুই মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক অনুযোগ-অভিযোগ, আঞ্চলিকতা আর দলাদলি সামরিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। সম্পাদক মতিউর রহমান জানাচ্ছেন, এ রকম একটি প্রেক্ষাপটেই ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের একটি সম্মেলন আয়োজনের পরামর্শ দেয়, যেখানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের বিভিন্ন পক্ষের বিপরীতমুখী চিন্তার ব্যবধান কমিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি মুক্তিফৌজের আস্থা নিশ্চিত করে স্বাধীনতা অর্জনের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে, বিশেষ করে ৩৩তম কর্পসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সম্মেলন আয়োজনের এবং তাদের সঙ্গে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সেস বা বিএসএফ–ও যুক্ত ছিল।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদস্যরাসহ ৫-৬ জুলাই অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ–দলীয় প্রতিনিধিরা। ব্রিগেডিয়ার অজিত কুমার মিত্র; যিনি ৩৩তম কর্পসের সদর দপ্তরের (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার ইন চার্জ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন; সম্মেলনটির আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁরই সন্তান, দেবাশীষ মিত্র, ২০০৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে এই নথিপত্রের সন্ধান পেয়ে যান এবং বলা যায়, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সম্পাদক ও প্রকাশকের কাছে এই নথিগুলো প্রকাশের জন্য হস্তান্তরের মাধ্যমে তিনি বেশ উদার মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য তাঁর কিংবা সম্পাদকের বিবরণে স্পষ্ট হয়নি, আবিষ্কৃত হওয়ার এত দীর্ঘদিন পর কীভাবে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল কিংবা নথিগুলোর মূল কপি এখন কোথায় সংরক্ষিত রয়েছে। যা–ই হোক, ৩৩তম কর্পসের সদর দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত লে. কর্নেল কে এ মজুমদারও এই সম্মেলন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন এ ডি সুর্ভের উপস্থিতিও নথিপত্র থেকে জানা যায়, যিনি গোয়েন্দা (৬৪৭ ফিল্ড সিকিউরিটি সেকশন) সংস্থার হয়ে সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সম্মেলন সম্পর্কে এই তিনজনের প্রতিবেদন নথিপত্রে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সম্মেলনে উপস্থাপিত মিজানুর রহমান চৌধুরীর একটি দীর্ঘ বিবৃতি এবং সর্বোপরি সম্মেলনের প্রথম গোপন অধিবেশনের কার্যবিবরণী; যেটি দিয়ে মূলত বইটির নথিপত্র অংশটি শুরু হয়েছে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বইটিতে সংকলিত নথিপত্রগুলো অসম্পূর্ণ। কারণ, সম্পাদকের তথ্যমতে, সবটা পাওয়া যায়নি। আসলে সম্মেলনের মূল প্রতিবেদনটিই উধাও। আরও পরিষ্কার করে বললে, দেবাশীষ মিত্র তাঁর বাবার ফাইলের মধ্যে যেটুকু পেয়েছিলেন, সেটুকুতে ইঙ্গিত রয়েছে যে মূল প্রতিবেদনটিতে আরও কিছু অংশ রয়েছে, যা পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সম্মেলনে যে চার শতাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়, তাঁদের নামের একটি প্রস্তুতকৃত তালিকাও একই কারণে এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার পরেও সংকলিত নথিপত্রগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে এই বইটি প্রকাশের আগপর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন নিয়ে কোনো দলিল বা নথির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়নি। এ ছাড়া সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ কেউ স্মৃতিকথা লিখে থাকলেও এই সম্মেলন সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো দালিলিক বিবরণ মেলে না। এসব দিক বিবেচনায় বইটির নথিপত্র মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের কাছে অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে হবে।
বইটির তৃতীয় অংশে লে. ক. (অব.) লুৎফুল হক একটি চমৎকার বিবরণ উপস্থাপন করেছেন যে কীভাবে ইতিমধ্যে প্রকাশিত নানা স্মৃতিকথায় উক্ত সম্মেলনের ইতিহাস উঠে এসেছে। যেমন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধী আওয়ামী লীগের কিছু গ্রুপের বেশ সক্রিয় থাকার বিষয়টি আগে মঈদুল হাসানের বই কিংবা ফারুক আজিজ খানের স্মৃতিকথায় তোলা হয়েছিল। জনাব হক একই সঙ্গে বইটিতে সংকলিত নথিপত্রে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোও এই অংশে তুলে ধরেছেন। অবশ্য সম্মেলনের সফলতা অর্জনের বিষয়ে তিনি যেভাবে উপসংহার টেনেছেন, তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হওয়া কঠিন। কারণ, সম্মেলনের পরেও যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ঘটনা থেমে থাকেনি। তবে জনাব লুৎফুল হকের লেখায় জুলাই সম্মেলনের আগের ও পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য যুক্ত হলে বইটি সম্পূর্ণতা পেত। যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন থাকা না-থাকা নিয়ে একাত্তর সালের এপ্রিল মাস থেকেই বিভিন্ন রকম সংবাদ পাকিস্তানে ও অধিকৃত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। আবার আগস্ট মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ের এই আলোচ্য সম্মেলনের পরেই আওয়ামী লীগ থেকে চলে আসা ৮৮ জন এমএনএর পদ ফিরিয়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের খবরও ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল ঢাকার পত্রপত্রিকায়। সন্দেহ, গুজব আর রটনার এসব ঘটনা দেখে মনে হবে, যুদ্ধের শুরুতেই নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের হৃদয় ও মন জয়ের লড়াইও চলমান ছিল পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে। পাকিস্তান সরকার, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল (বিশেষ করে পিডিপি) এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এসব নিয়ে অঘোষিত এক প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তরের গোপন পাক্ষিক প্রতিবেদনগুলোর দিকেও নজর দিতে পারি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তরের যে গোপন পাক্ষিক প্রতিবেদন২ তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে উল্লেখ করা হয়,
এক গোপন খবরে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ ১৮ এপ্রিল ’৭১ ঢাকায় পিডিপি প্রধান নুরুল আমিনের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আরও জানা গেছে, নুরুল আমিনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা ও রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে তাঁরা তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন।
এর পরের মাসেই একই দপ্তর থেকে প্রস্তুতকৃত গোপন প্রতিবেদনে৩ উল্লেখ করা হয়,
এক গোপন সূত্রে জানা গেছে, ২৬ মে ’৭১ দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে এক আলোচনায় নুরুল আমিন আশা প্রকাশ করেছেন যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তাঁকে নেতা মনোনীত করতে আওয়ামী লীগের ৭৫ জন এমএনএ ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছেন।
আবার জুন৪ মাসের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়,
এটা শোনা যাচ্ছে, পিডিপি প্রধান জনাব নুরুল আমিন বিশ্বাস করেন, দেশে পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমএলএদের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। তাঁর মতে, যেসব এমএলএ বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে সহায়তা করতে চান, তাঁদের অনুকূলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গতি আসবে। তাঁর উক্তি অনুযায়ী, তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএলএ এবং এমপিএদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে তাঁরা সেনাবাহিনীর প্রতি শত্রুতা পরিহার করেন।
আর, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় পাক্ষিকের গোপন৫ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়,
অন্য একটি তথ্যমতে, ময়মনসিংহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত এমপিএ (বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে) সৈয়দ বদরুজ্জামান এক বিবৃতিতে জানান, আওয়ামী লীগের কজন এমএনএ ও এমপিএ পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দিতে পারেন। তাঁর এই বিবৃতি পিডিপি মহলে বিস্ময় উপহার দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, নুরুল আমিন তাঁর দলীয় নেতা–কর্মীদের কাছে এটা বলে দিয়েছেন যে কফিলউদ্দিন চৌধুরী, জহিরউদ্দীন, আসাদুজ্জামান খানসহ (তাঁরা সবাই নির্বাচিত এমএনএ) অনেক নেতা তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যে দেখা করে আনুগত্য জানিয়ে গেছেন। নুরুল আমিনের মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে সৈয়দ বদরুজ্জামানকে কাজে লাগাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, জহিরউদ্দীন ও আসাদুজ্জামান খানকে নুরুল আমিন বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব এমএনএ ও এমপিএ থাকতে চাইছেন না, তাঁদেরকে বৈঠকে আহ্বান করে সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হবে, তাঁরা কি নতুন কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন নাকি স্বতন্ত্র থেকে যাবেন, নাকি নিজেদের জন্য নতুন কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ গড়বেন।
এসব তথ্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে আবির্ভূত পাকিস্তানের প্রধানতম দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কি না, তা নিয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকেই রাজনৈতিক মহলে নানা আলাপ চলছিল। আর তাই প্রবাসী সরকারের কাছে জুলাই মাসের ওই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল—এই বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য যে তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে।
বইটিতে সংকলিত নথিপত্রগুলোর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, তা হলো প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান এবং কমান্ডার ইন চিফ এম এ জি ওসমানীর মতো ব্যক্তিদের মনোভাব বোঝার জন্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সচেষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে নেতাদের মতামত জানা ছাড়াও তাঁদের ব্যক্তিত্বের একধরনের মূল্যায়নও নথিপত্রে দেখা যায়। এই সম্মেলনে উপস্থিত অন্য প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, সে ব্যাপারেও সংগৃহীত তথ্য প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। মুক্তিফৌজের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের সঙ্গে ছাত্রলীগের তরুণ নেতাদের দূরত্বের প্রমাণও সংকলিত নথিপত্রে স্পষ্ট।
যুদ্ধকালীন এই সম্মেলনটি যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচিত হচ্ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানে গৃহীত ও আলোচিত কিছু সিদ্ধান্তের মধ্যেই। যেমন এই সম্মেলনের মাধ্যমেই ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগে’র বিলুপ্তি ঘটে এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে’র নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। সামরিক প্রয়োজনে সমগ্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে সেগুলো বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তও এই সম্মেলনে আলোচিত হয়েছিল। ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন, তা বেশ স্পষ্ট করেই কর্নেল ওসমানী সম্মেলনে দাবি করেছিলেন। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের বাজেট পাস করা সম্ভব না হলেও প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য মাসিক ভাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এর পরিমাণ নিয়ে প্রবল অসন্তোষের বিষয়টি নথিতে উল্লেখ করা আছে।
বাংলাদেশ সরকারের মূল নেতাদের চমৎকার গুণাবলি আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের অবিচল অঙ্গীকারের কথা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ওই তিন কর্মকর্তার প্রত্যেকের প্রতিবেদনেই স্থান পেয়েছে। তবে নথিপত্রগুলোতে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশি নেতাদের প্রতি বিবিধ অভিযোগও লক্ষণীয়। এসব অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা এ পর্যায়ে তদন্ত করা কঠিন হলেও যেটা স্পষ্ট তা হলো, আওয়ামী লীগের নেতাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার প্রকাশ্য রূপ দেখা গিয়েছিল সম্মেলনের মধ্যেই। যেমন পেছনের দিকের বেশ কয়েকজন প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতা অভিযোগ করেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানি মুদ্রা ব্যাংক লুটের মাধ্যমে ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর সেগুলো জ্যেষ্ঠ জনপ্রতিনিধিরা আত্মসাৎ করছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিফৌজের কাছে দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কি না, তা নিয়েও একধরনের অস্বস্তিকর আশঙ্কার উপস্থিতি ছিল। তাই মুক্তিফৌজকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন করার বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার দাবিও তোলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ছাত্রলীগের প্রতি অভিযোগ করছিলেন যে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গণহত্যার দায় তাদের ওপরেও বর্তায়। কারণ, তারাই ২৫ মার্চের আগে সারা পূর্ব বাংলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ইয়াহিয়াকে উন্মত্ত আক্রমণের পথ তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, মুক্তিফৌজের অধিকাংশই ছাত্রলীগের সদস্য এবং তাদের কষ্টের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরাই সুবিধা নিচ্ছেন। এ ছাড়া জনাব কামারুজ্জামান এবং এম এ জি ওসমানীর নিয়োগের বিষয়টি নিয়েও অনেকের আপত্তি সম্মেলনে প্রকাশ পায়। বিশেষ করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এম এ জি ওসমানীর বিরুদ্ধে নকশালপন্থীদের মুক্তিফৌজের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত করার বিস্ময়কর অভিযোগও তোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে সম্মেলনের পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুর্ভের মন্তব্যের (পৃ. ১১৯-১২০) বাংলা রূপান্তর অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়,
উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে খুব কম দায়িত্বশীল ব্যক্তিই আছেন, যাঁরা সত্যিই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছিলেন। প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই বেশ ভাবলেশশূন্য ছিলেন এবং মনে করছিলেন যে পুরো আয়োজনটি একটি দুর্দান্ত প্রমোদভ্রমণের বিষয়। এমএনএ এবং এমপিএদের মাসিক ভাতা কত বরাদ্দ হচ্ছে, তা নিয়েই বরং বেশি মাথাব্যথা লক্ষ করা গেছে। শিলিগুড়ির পার্থিব আনন্দের বিষয়গুলোই যেন সমাবেশের মূল আগ্রহ।
বইটি সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বেশ প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে প্রায় এক যুগ আগে দৈনিক কালের কণ্ঠ–এ প্রকাশিত৬ এক সংবাদভাষ্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে,
পাকিস্তান গণপরিষদে নির্বাচিত এবং পরে দল থেকে বহিষ্কৃত ৪৩ জন আওয়ামী লীগ–দলীয় সদস্যের তালিকাটি সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি থেকে এক্সপাঞ্জ করেছেন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। গতকাল বুধবার সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের তারকা চিহ্নিত এক প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত ৪৩ জন গণপরিষদের সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি সংসদকে আরও জানান, এসব সদস্যের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার কিংবা তা বহাল রাখা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। এ তালিকা প্রকাশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম, রওশন জাহান সাথী ও শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তাঁরা বলেন, এই তালিকা প্রকাশ সঠিক হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যাঁদের নাম এ তালিকায় দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সুতরাং তা এক্সপাঞ্জ করা উচিত। আইনমন্ত্রীর উপস্থাপিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে বহিষ্কৃতদের তালিকা প্রকাশ নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্যের সুযোগ নিয়ে তিনি বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে আসেনি। বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা শুধু যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নন, বিভিন্ন কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁদের সবাই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন—এটা ঠিক নয়। যাঁদের নাম তালিকায় এসেছে, তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সুতরাং সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এই প্রশ্ন প্রত্যাহার (এক্সপাঞ্জ) করে নতুন করে উত্তর দেওয়ার দাবি জানান তিনি। উল্লেখ্য, ওই সময় বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন।
অতিসম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ১৯৭০ সালে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের তালিকা প্রণয়ন ও গ্যাজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতাও পেয়েছে।৭
সবশেষে বলা যায়, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বইয়ে নির্ঘণ্ট থাকা জরুরি ছিল। একটি দালিলিক ইতিহাসের বই হিসেবে নথিপত্রের বিভিন্ন তথ্যের (যেমন ব্যক্তির নাম কিংবা ঘটনা) জন্য টীকা-টিপ্পনী দেওয়া থাকলে আগ্রহী এবং নতুন পাঠকদের কৌতূহল মিটত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্নেল এম এ জি ওসমানীর কোন ভাতিজা নকশালপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যাঁকে মুক্তিফৌজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হচ্ছিল; তা নিয়ে টীকা বা ফুটনোট থাকা প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া মূল নথিপত্রের দু-একটি ছবি বইটিতে থাকলেও বেশ ভালো হতো। প্রতিবেদনগুলোর প্রাপক কে বা কারা এবং এসবের ভিত্তিতে কী ধরনের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল, তা এই আংশিক নথিপত্র থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে এ ধরনের বহু প্রতিবেদন যে সে সময়ের ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এই বইয়ে উপস্থাপিত নথিপত্র প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার উপাদান এখনো নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। শিলিগুড়ি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এই দালিলিক ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য হিসেবেই বিবেচিত হবে।
লেখক পিএইচডি গবেষক, স্ট্রসলার সেন্টার ফর হলোকাষ্ট অ্যান্ড জেনোসাইড স্টাডিজ, ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি। ইউএসএ।
তথ্যসূত্র:
১. দেখুন, এইচ টি ইমাম (২০০৪) বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৭৮
২. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ২৯
৩. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৪১
৪. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথমার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৪৫
৫. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় পাক্ষিকে পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে গোপন রিপোর্ট। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৭০
৬. কালের কণ্ঠ (২০১০) সাংসদদের আপত্তির মুখে বহিষ্কৃত ৪৩ আ.লীগ নেতার তালিকা এক্সপাঞ্জ। ২৩ সেপ্টেম্বর। বিস্তারিত জানতে দেখুন, https://www.kalerkantho.com/ print-edition/campus/2010/09/23/89944
৭. দেখুন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২। 2022-09-20-11-55 55a3a24bbf2fa27578169cd029f2f456.pdf (jamuka.gov.bd)
[লেখাটির ঈষৎ পরিবর্তিত সংস্করণ দুই পর্বে প্রকাশিত হয়েছে ১৯ ও ২০ অক্টোবর, ২০২২, দৈনিক প্রথম আলো’তে।]