বাংলাদেশে প্রসারমান মিডিয়া-সংস্কৃতি

  • আ-আল মামুন

আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে, আমার ছোটবেলা কেটেছে কুষ্টিয়া শহরকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী এক গ্রামে। সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন বাড়ির কাছারিতে গ্রামের দু-দশজন মুরুব্বি, মাঝবয়সী প্রতিবেশী আর ছেলে-ছোকরা এসে জড়ো হতো। তারা গল্পগুজব করতো, গান গাইতো। আমরা ঘুমোতে যেতাম চাঁদ বা তারার আলোয় উঠোনে বসে তাদের গাওয়া কেচ্ছা, জারী আর কবিগান শুনে। নিয়মিতই সকালে-দুপুরে মাঠের ক্ষেতের কাজে মগ্ন কামলা ও কৃষকের সমবেত কণ্ঠের গান অবাধ বাতাসে ভেসে বেড়াতো, আর সন্ধ্যার পরে দূরগামী ক্লান্ত একলা পথিকের নিঃসঙ্গ গান বা বাঁশির সুর আমার পড়ার টেবিলে হানা দিত। মাসে-চাঁদে বাড়িতে বাউল-ফকিরদেরও ডাকা হতো গানের আসর করতে- নূরতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, দেহতত্ত্বের সেসব গান না-বুঝেও আমরা ছোটরা সূরের আবেশে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকতাম। রেডিও ছাড়া আর মিডিয়া-যন্ত্র তখন গ্রামে বিশেষ দেখা যেত না। কোনো বনেদি বাড়িতে যদি টেলিভিশন থাকতো তো চারপাশের গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুর ঢল নামতো সেখানে। বিকেল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তখন কেবল বিটিভি’র সম্প্রচার পাওয়া যেত সেই টেলিভিশনে। ব্যাটারিতে চালাতে হতো বলে সপ্তাহের নাটক বা ঈদের অনুষ্ঠানের বেশি কিছু দেখবার বিলাসিতা কেউ দেখাতো না। আর সেই অনুষ্ঠানগুলো দেখানোর বন্দোবস্ত হতো উঠোনে বা খোলা মাঠে। সাত কিলোমিটার দূরের কুমারখালী শহরে একটা সিনেমা হল ছিল। রূপবান বা এইরকম সাড়া-জাগানো কোনো সিনেমা থাকলে গ্রামের হাটে হাটে পোস্টার লাগতো, আর মাইকে চলতো প্রচারণা। এই সময়টায় গ্রামে ক্যাসেট-প্লেয়ার আমদানি হতে শুরু করে। কারো কাছে, বিশেষত যৌতুক হিসেবে পাওয়া, ক্যাসেট প্লেয়ার থাকলে সারা বছর এপাড়া-ওপাড়া, এ-গ্রাম-সে-গ্রামে তার বায়না লেগেই থাকতো। সন্ধ্যার আগেই সেই সৌভাগ্যবান দু’একজন সঙ্গীসহ ক্যাসেট-প্লেয়ার, বড় ব্যাটারি আর অনেক রেকর্ডেড ক্যাসেট সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে রওনা দিতো নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ক্যাসেট-মালিক ও তার সঙ্গী-সাথীদের ভালোমন্দ খাওয়ানো হতো, আর বিনিময়ে দশবাড়ির লোক একসাথে বসে মাঝরাত পর্যন্ত রেকর্ডের গান শুনতো, কাহিনী শুনতো, কখনো ওয়াজ-নসিহতও চলতো। এটা হলো সেই সময় যখন বাংলাদেশে ক্যাসেট প্লেয়ারের সুবাদে গানের জগতে মমতাজ, আর বিশ্বাসীদের জগতে সাঈদীর অধিষ্ঠান ঘটতে থাকে।

বছর কুড়ি বাদে, এখন আমি পাকা সড়ক ধরে সোজা বাড়িতে পৌঁছে যাই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। কুষ্টিয়া শহরটিকে আর দূরের মনে হয় না, গ্রাম ও শহরের ব্যবধান ঘুঁচে গেছে অনেকটাই। যাতায়াত ব্যবস্থার এই উন্নতির চেয়েও চোখে পড়ে গ্রামের মানুষের অভ্যাস, জীবন-জীবিকা আর সম্পর্কসূত্রের রূপান্তর – পাকা সড়কের ভূমিকা সেখানে সামান্যই। এখন ঘরে ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে, আর বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি অনেক চ্যানেলের টেলিভিশন চলে হরদম। গ্রামে ঢুকতেই দেখতে পাই অনেকগুলো দোকান বসেছে। তার সামনে সারি সারি আসন পাতা, কাজের ফাঁকে ফাঁকে তো বটেই, এবং বিকেল হলেই সব কাজকর্ম সেরে আজকের চাষীরা হাত-পা ধুয়ে ‘ভদ্দরলোক’ সেজে জড়ো হয় মাঝরাত অব্দি আড্ডা দিতে। চা-পানের দোকানগুলোতে চলতে থাকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো, কিংবা ঢাকার বা কলকাতার কোনো বাংলা ছবি। ভিন্নতর ও স্বপ্নময় দূরদেশী জীবন, জাতীয় জীবনের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা-সঙ্কট-রাজনীতি এবং লোভনীয় পণ্যের মদির আহ্বানে তারা মশগুল হয়। গিন্নী-বউরা সিনেমা আর সিরিয়াল-নাটক দেখে পরিবার ও সমাজে তাদের ভূমিকাটি রপ্ত করে নেয়; বিজ্ঞাপন দেখে ছেলে-মেয়ে, নিজের ও পরিবারের জন্য পণ্য কেনার ফরমায়েশ করে। সামর্থ্যবান সবার হাতেই আছে মোবাইল ফোন, এমনকি বাড়ির বউ-গিন্নীদের হাতেও। আর, সেই মোবাইল ফোনে নৈমিত্তিক প্রয়োজন ও সামজিক যোগাযোগের চাহিদা পূরণের বাইরেও, ভাব-ভালোবাসা-অভিমান-ঝগড়া-বিবাদ চলে; হরেক রকম ফটো তোলা, ভিডিও করা ও দেখা, গান শোনা সবই সম্ভব হয়ে ওঠে। যুগের হাওয়ায় পাল তুলে বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামের যে নির্বাচনী অঙ্গীকারে প্রলুব্ধ করেছিল তার প্রদর্শনী হিসেবে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র অত্যন্ত বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও ব্যর্থ সংযোজন হলেও গ্রামের মানুষের জীবনে আজ ইন্টরনেট খুব দূরের বস্তু নয়, তা এখন অনেক প্রয়োজনেরও নিদান। স্বচ্ছল পরিবারের উঠতি ছেলেমেয়েরা এখন হাতের মোবাইল ফোনটায় গান ডাউনলোড করে, ভিডিও ডাউনলোড করে, ফেসবুকে এ্যকাউন্ট খোলে, রাত-বিরাতে স্কুলের পড়া ফেলে প্রেমালাপ করে; আর উৎসবে-অনুষ্ঠানে নাচগানের আয়োজন করে – সাউন্ডবক্সে হালফ্যাশনের কোনো হিন্দি বা কোলকাতার বাংলা গানের সাথে দুরূহ শরীরি কসরতবহুল নাচটি তারা হুবহু নেচে দেয়।

কীভাবে পাঠ করবো এই পরিবর্তিত জনজীবনকে? গ্রামসমাজের আনাচে-কানাচে এই বহুবর্ণিল মিডিয়া আয়োজন কী বার্তা নিয়ে হাজির হয়? এ কি গ্রামের মানুষদেরকে ভোক্তা সমাজের বাসিন্দা বানিয়ে তোলার কারসাজি, তারা কেবলই খদ্দের হয়ে উঠবে বহুজাতিক পণ্যবিক্রেতাদের? এ কি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ কিংবা নয়া-উপনিবেশবাদ? আমাদের আবহমান সংস্কৃতি তাহলে কি মনভোলানো বাজার-সংস্কৃতির চাপে ও তাপে উচ্ছন্নে যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের চেষ্টায় লিপ্ত হবো পরবর্তী আলোচনায়। 

বাংলাদেশের সব গ্রামের চিত্র আজ কমবেশি এরকমই। শহর ও নগরের আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের চিত্র প্রবলভাবে বদলে গেছে এই সময়ের ব্যবধানে। অবশ্য, এই রূপান্তর আরও বড় পরিবর্তনের সাথে যুক্ত, যার সুবাদে আজ গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশ, এবং সেই বিদেশের প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা সবাই বৈচিত্রময় ও বহুমাত্রিক এক সূতোয় গাঁথা পড়ছে। মার্শাল ম্যাকলুহান গত শতকের সেই ষাটের দশকে টেলিভিশনের কারিশমা দেখে যে ‘গ্লোবাল ভিলেজের’ কথা বলেছিলেন, আজ তা এক অনিবার্য বাস্তব, আমরা সেই বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা। ঘটে চলেছে বিশ্বায়ন, একে কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, বা অর্থনীতির বিশ্বায়ন বললে ভুল হবে। উল্লেখ্য যে, সাংস্কৃতিক বা অন্য যেকোনো পণ্যের বিশ্ববাজার শত বছর আগেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে আজকের বিশ্বায়নের যে তীব্রতা ও গভীরতা তার সাথে তা কিছুতেই তুল্য নয়। এ-বিশ্বগ্রাম একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক ও বহুবর্ণিল; সমতাভিক্তিক নয়, বৈষম্যে ভরা। এ-গ্রামের মানুষদেরকে কেবলই ভোক্তা-ভোটার-অনুগত বানানোর পাঁয়তারা চলে; এ-গ্রামে সবার স্বর সমান জোরে শুনতে পাওয়া যায় না, কারো স্বর একেবারেই শোনা যায় না; সবার সমান ভূমিকাও থাকে না, সুবিধাও পায় না; প্রবলের স্বর প্রান্তিককে চাপা দেয়। অবশ্য এ-গ্রামে আধিপত্যের বিপরীতে প্রতিরোধের লড়াইও অবিরাম চলতে থাকে। জঙ্গী দমনের নামে দেশে দেশে মার্কিনি হামলা চলে, কর্পোরেট লুটপাট চলে, আবার ফেসবুক-টুইটারে ভর করে আরব বসন্তের হাওয়া বইতে থাকে এবং আন্দোলনের তোড়ে তিউনিসিয়া ও মিশরের স্বৈরশাসকদের পতন ঘটে যায়। নিশ্চিত করেই বলা যায় যে এই বিশ্বগ্রামের রীতিনীতি, আদাব-লেহাজ, আর রাজনৈতিক অর্থনীতি সবার জীবনকেই স্পর্শ করে যাচ্ছে। বস্তুত, আমরা একটা নতুন ধরনের সমাজকাঠামোর অবয়ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখছি, যা একইসাথে স্থানিক ও বৈশ্বিক, যা জাতি-বর্ণ-রাষ্ট্রর সীমানার পাঁচিল অনায়াসেই অতিক্রম করে ভিন্নতর সম্প্রদায় গড়ে তোলে। বলছিলাম, গত তিন দশক ধরে আমাদের সমাজ একটা কাঠামোগত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে। এই পরিবর্তন বহুমাত্রিক, আর এই পরিবর্তনের বাহন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আমরা যদিও একে জ্ঞান-সমাজ বা তথ্য-সমাজ বলেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছি, ম্যানুয়েল কাসট্রাল (২০০৫) বিকাশমান এই সমাজকে জ্ঞান-সমাজ বা তথ্য-সমাজ বলতে নারাজ। এর কারণ এই নয় যে জ্ঞান বা তথ্য বর্তমান সমাজের মূল চালিকাশক্তি নয়, বরং এ-কারণে যে সর্বকালে সব সমাজেই বস্তুত জ্ঞান ও তথ্য মূল চালিকাশক্তি ছিল; বর্তমান সমাজ-রূপান্তরের নতুন চালক হলো মাইক্রো-ইলেক্ট্রনিক নির্ভর নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি, যা পুরনো সমাজকাঠামোতে ফাটল ধরিয়ে নতুন সম্ভাবনার স্ফুরণ ঘটিয়েছে। তাই, তিনি একে বলছেন ‘নেটওয়ার্ক সোসাইটি’ বা আন্তর্জালিক সমাজ।

সোশ্যাল মিডিয়া, শেরিফ আরাফা, কার্টুন মুভমেন্ট

আন্তর্জালিক সমাজের মিডিয়া-সংস্কৃতি

এই আন্তর্জালিক সমাজে ডিজিটাল প্রযুক্তি আশ্রয় করে যে সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটছে তাকে আমরা বলতে পারি মিডিয়া-সংস্কৃতি। সমাজে পূর্ববর্তী এ্যানালগ প্রযুক্তিনির্ভির মিডিয়াগুলোর যে সাংস্কৃতিক ভূমিকা ছিল তার তুলনার বর্তমানের মিডিয়া-সংস্কৃতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তাই, শব্দবন্ধটি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখবার প্রয়োজন আছে। মিডিয়া বললেই এখনও আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায় সংবাদপত্র, রেডিও, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের নাম। এগুলোকে আমরা ‘গণমাধ্যম’ বলি, যদিও এগুলোকে গণমানুষের মাধ্যম বলা চলে না কিছুতেই। বস্তুত, ‘গণমাধ্যম’ বলার ভিতরে এমন একটা সূক্ষ্ম ভাঁজ আছে যার ফলে আমাদের মনে বিভ্রম জাগে যে এগুলো হলো জনগণের মাধ্যম, এতে সমাজের সকল সদস্যের সমান অংশিদারিত্ব ও অংশগ্রহণ থাকে। এই বিভ্রমের ফলে মিডিয়া একটা গণতান্ত্রিক চেহারা পায়, এবং এদের বিশেষ স্বার্থগত অবস্থান ও কর্মকা- আড়াল হয়ে যায়। যদিও, বস্তুত শ্রেণীবিভাজিত সমাজের উঁচু তলার কিছু মানুষের বিশেষ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বৃহত্তর জনগণের মাঝে বার্তা ছড়িয়ে দিতেই এধরনের মিডিয়ার বেশিরভাগ কর্মকা- পরিচালিত হয়। তাই এসব মিডিয়ার দর্পণে সবার চেহারা সমানভাবে ফুটে ওঠে না। কারো চেহারা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়, কারো চেহারা বাঁকাচোড়া দেখায়, আর বৃহদাংশ মানুষের চেহারা এক্কেবারেই দেখা যায় না। তথাপি, সেই অদৃশ্য জনমানুষের সামনে অনুসরণ ও অনুকরণের জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে সিনেমা, টিভি, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নতুন তারকাশ্রেণী তৈরি হতে থাকে এই মিডিয়াগুলোতেই। তাই, এসব মিডিয়ার আগে উপসর্গস্বরূপ লেপ্টে থাকা ‘গণ’ অংশটুকু ছেঁটে ফেলাই বাঞ্ছনীয় এবং মালিকানার দিক দিয়ে বিচার করলে এগুলোকে কর্পোরেট মিডিয়া বলাই শ্রেয়। গত দুই দশকে বাংলাদেশে গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত সংবাদপত্র-রেডিও-টেলিভিশনের সবগুলোরই জন্ম হয়েছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পেটের ভিতর থেকে, যাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য অধিকতর মুনাফা অর্জন করা, এবং মুনাফার পথ সুগম করতে একটা ভোগবাদী জনসমাজ নির্মাণ করা। এই মিডিয়াগুলোর আধেয়, মনোযোগ, বিজ্ঞাপনের বহর, আর উদ্দিষ্ট পাঠক-দর্শক-শ্রোতার দিকে তাকালেই সেটা বোঝা সম্ভব। 

যাহোক, আজকের মিডিয়া-সংস্কৃতিতে গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত মিডিয়াগুলোর ব্যাপক অংশিদারিত্ব ও কর্তৃত্ব আছে। তবে, সেটুকুই সব না। গণমাধ্যম হিসেবে কথিত সংবাদপত্র-রেডিও-টেলিভিশন এই বিকাশমান মিডিয়া-সংস্কৃতির নিয়ামক কারণ নয়, বরং বলা যায় বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের ওপর উচ্চকোটীর কিছু মানুষের ক্ষমতা ও স্বার্থ টিকিয়ে রাখবার এই মাধ্যমগুলো নিজেরাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে নতুন ডিজিটাল মিডিয়া-সংস্কৃতির কারণে – উৎপাদন, বিতরণ, ভোগ সকল ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন দৃশ্যমান। এই মিডিয়াগুলো এখন সমাজে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি তৈরি করতে পেরেছে, অনেক রকমের প্লাটফর্মে বিচরণ করছে এবং ভৌগোলিক সীমা ও দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে অনেক বেশি মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। তদুপরি, আধিপত্যশীল এই মূলধারা মিডিয়াগুলোর পাশাপাশি বর্তমান সময়ে আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতিক নির্মাণে ও তথ্য আদানপ্রদানে আরও অনেক প্রকৃতির, যেমন ইন্টারনেট-নির্ভর বিভিন্ন সাইট ও প্লাটফর্ম এবং সেলফোন মিডিয়ার অংশগ্রহণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং সব ধরনের মিডিয়া একই পাটাতনে এসে গলাগলি ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, যা (গণ)মাধ্যমের সনাতন সংজ্ঞায় ধরা যায় না। যেমন মুঠোফোনেই সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও ভিডিও স্ট্রিম, এফএম রেডিও, গানের রেকর্ড, ক্যামেরা সব পেয়ে যাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা, এ্যনালগ প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পণ্য ছিল সুনির্দিষ্টতা (ফিক্সিটি) কেন্দ্রিক, কপি করা গেলেও বদলানো যেত না, অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর সাংস্কৃতিক পণ্য – টেক্সট, ইমেজ, সাউন্ড – সঞ্চরণশীল, পরিবর্তনশীল, ফ্লুয়িড। চাইলেই বদল ঘটানো ও সংরক্ষণ, বিতরণ ইত্যাদি করা যায়। আর এসব সাংস্কৃতিক পণ্য নির্মাণে মুষ্টিমেয়র আধিপত্যেরও অবসান ঘটেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সবাইকেই সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদকে পরিণত করেছে, নিজেদের উপস্থিতি জাহির করবার সুযোগ করে দিয়েছে। অংশিদারিত্ব, বহুস্বর আর মিথষ্ক্রিয়া এই মিডিয়া-সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই, এখানে সংস্কৃতি বলতে কেবল কোনো নাটক, গান, কবিতা, চলচ্চিত্র, উপন্যাস বা অন্য কোনো অভিপ্রকাশ নয়, এবং মিডিয়া বলতেও  কেবল গণমাধ্যম হিসেবে কথিত মিডিয়াগুলোকে বোঝানো হচ্ছে না। বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন, অবসর, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিল্প, সামাজিকতা, চৈতন্য এবং আত্মপরিচয় নির্মাণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর নানাবিধ মিডিয়ার কেন্দ্রীয় ভূমিকার কারণে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে তাকেই বোঝানো হচ্ছে। আমাদের সকল অস্তিত্ব জুড়ে আজ এই মিডিয়া-সংস্কৃতি। আজকের যুগে তাই সমাজে মিডিয়া পণ্যের উৎপাদন, প্রভাব, বা ব্যবহার ও তার তৎপর্য, বিচার করতে হলে এই বহুমাত্রিকতা ও প্রযুক্তির মধ্যস্ততার স্বীকৃতি দিতে হবে।

স্মার্ট ফেটাস, অ্যালেক্স, কার্টুন মুভমেন্ট

‘মনোজগতে উপনিবেশ’?

মিডিয়া-ব্যবহারের ক্ষেত্রে আজকের গ্রামসমাজের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা আমাদের চোখে সচরাচর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ভোগবাদী সমাজ নির্মাণের প্রকল্প হিসেবেই গণ্য হয়। এরূপ ভাবনার চিহ্ন আমরা পেছনের ইতিহাসে খুঁজতে পারি। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন অধিকতর হারে এ্যানালগ মিডিয়া-সাংস্কৃতিক পণ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তখন ধুয়ো উঠলো যে বিশ্ব-সংস্কৃতি সমরূপতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে, সমাজে একই রকমের দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তবতার একইরকম ভাষ্যই কেবল টিকে থাকবে! এই বক্তব্য দেবার সময় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের লোকেরা বেশ কয়েকটি গুরুতর দিক উপেক্ষা করে যান: ভাষার বৈচিত্র এখনও টিকেই আছে, এমনকি নতুন বৈশ্বিক ভাষা (ইংরেজি) নির্মিত হচ্ছে;  বিদেশি সংস্কৃতি স্থানীক সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে বৈচিত্রপূর্ণ হাইব্রিড সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে; এবং নতুন ধরনের স্থানীক সংস্কৃতিরও জন্ম হচ্ছে। তাই, সমরূপতা নয় বরং বৈচিত্রই এ সময়ের বৈশিষ্ট্য। মার্ক পস্টার “ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ” ধারণা ব্যবহার করেছেন এই বৈচিত্র তুলে ধরতে।

সংস্কৃতির রূপান্তরকে আমরা বরং এভাবে দেখতে পারি, এ্যনালগ প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতি আধুনিক সমাজের বিকাশে সহায়তা করেছে। প্রথমে প্রকাশনা, তারপরে রেডিও ও চলচ্চিত্র, এবং তারও পরে টেলিভিশন ও টেলিফোন সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশগুলোকে সর্বোস্তরে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিক থিওডর এডোর্নো এবং ম্যাক্স হর্কহেইমারের (১৯৭২) দৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়া সমাজকে গণসমাজে (ম্যাস সোসাইটি) রূপান্তর করে, যেখানে শ্রেণীসংগ্রামের দ্বান্দিকতা ও শোষিতের সমালোচনাত্মক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটে। কিন্তু অন্যদিকে, যেমন ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের (১৯৬৯) মতে এ্যনালগ প্রযুক্তি বিশেষত চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষকে বরং সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করেছে এবং নতুন ধরনের বৈপ্লবিক রাজনীতির দ্বার খুলে দিয়েছে। একইসাথে, মাইকেল ওয়ার্নার (১৯৯২) গণতন্ত্রের চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক জমিন তৈরিতে সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন। অনেকের মতে, এ্যনালগ সাংস্কৃতিক প্রযুক্তির সবচেয়ে মূর্খতম মাধ্যম টেলিভিশন বৈচিত্রপূর্ণ ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীগুলোকে জাতির ধারণায় একতাবদ্ধ করতে সহায়তা করেছে। এই ধারায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ কাজ হলো, বেনেডিক্ট এ্যন্ডার্সনের ‘ইমাজিনড কমিউনিটিস’ (১৯৮৩), যেখানে তিনি দেখিয়েছেন মূদ্রণশিল্প কীভাবে পৃথিবীজুড়ে দেশে দেশে জাতি ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছে। আজ আমরা বাংলাদেশ সীমানায় যে রাষ্ট্রকাঠামো অর্জন করেছি ও জাতি ধারণায় সংঘবদ্ধ হয়েছি তার কল্পনা সুসংহত ও সর্বজনীনতা পেয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমেই। আর, বর্তমানে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত অনেকগুলো দৈনিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন, ডজনখানেক টেলিভিশন চ্যানেল, এবং অনলাইনের ব্লগ, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য প্লাটফর্ম, আর মোবাইল ফোন জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে একটা সংহত রূপের দিকে ধাবিত করছে এবং একইসাথে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত করছে। এর প্রমাণ হলো যে, স্পর্শকাতর কোনো ঘটনা ঘটলে মূহুর্তের মধ্যেই তার অনুরণন দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়ার জন্ম হচ্ছে।

তাই, বর্তমান সময়ে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের রমরমা দিনে, গ্রামে-গঞ্জে এর অপ্রতিরোধ্য বিস্তার দেখে আমাদের আবহমান সংস্কৃতি রসাতলে গেল বলে রব উঠাবার আগে ভিন্ন সম্ভাবনার দিকগুলোও একটু ভেবে নেয়া দরকার। ভোক্তা দর্শক-শ্রোতাদের অক্রিয় গ্রাহক ভাবার দিন চলে গেছে। তারা সক্রিয়ভাবেই অনুষ্ঠান বাছাই করে, নিজেদের মূল্যচেতনার সাথে মিলিয়ে নেয় এবং নতুন নির্মাণে সামিল হয়। লিসা পার্ক (২০০৫) লেখেন, স্যাটেলাইট টেলিভিশন কেবলই পশ্চিমা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট এবং নব্যঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে – এবোরিজিনদের মিডিয়া ব্যবহার এই বদ্ধমূল ধারণা চ্যালেঞ্জ করে। রমেশ শ্রীনিবাসও (২০০৬) দেখিয়েছেন, এ্যবোরিজিনদের মতোই ইনুইটরা স্যাটেলাইট প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে বৈশ্বিক জ্ঞানবিদ্যা ব্যবহার করে নিজেদের সংস্কৃতি বেগবান করা এবং নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্য। বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে মিডিয়া ব্যবহারের বৈচিত্রময় প্রক্রিয়া। স্থানিক পরিসরে বাস করেও আমরা বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছি। মানুষের পোশাক, পেশা, চিন্তা, অভ্যাস ও জীবিকা সব অদল-বদল ঘটে যাচ্ছে। পিয়ার-টু-পিয়ার মিডিয়া-প্রযুক্তি (ফাইল শেয়ারিং, ইউটিউব, মাই স্পেস, উইকিপিডিয়া, বিপুল অনলাইন গেম ইত্যাদি) আংশিকভাবে ব্যক্তির শরীরকে তার স্থানিক পরিসর থেকে বিযুক্ত করে, স্থানিক বন্ধন খানিকটা আলগা করে বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে যুক্ত করে। আর, এই ঘনিষ্ঠতায় যুক্ত করে দিচ্ছে তথ্য-মেশিন। বর্তমান সংস্কৃতি মূল্যায়নে মানব উপাদানের সাথে যন্ত্র-উপাদান তাই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ইয়াং অং অবশ্য সতর্ক করে দেন যে, এক জাতিগোষ্ঠী থেকে অন্য জাতিগোষ্ঠীতে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে মিডিয়া-সংস্কৃতির এই বিস্তৃতিকে ইমেজ ও সাউন্ডের অবাধ সম্প্রসারণ হিসেবে না দেখে বরং সংস্কৃতির ওপর কর্পোরেটীয় নিয়ন্ত্রণ হিসেবে দেখাই ভালো। আমরা বরং এখন এই ভাবনাটাকে বিচার করে দেখতে পারি।

মফিদুল হক, মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত, সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৫

একচেটিয়া কর্পোরেট দখলদারিত্ব বনাম বৈচিত্রময় বহু স্বর 

একথা সত্য যে নতুন প্রযুক্তির প্রচলন করা হয়েছে মূলত কর্পোরেট-চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে, যদিও তা ভিন্নতর সম্ভাবনার দিকও উন্মোচন করেছে। এগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিডিয়া-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীসংখ্যা হ্রাস করেও অধিকতর কাজ আদায়ের সুযোগ করে দিয়েছে, এবং তাদের জন্য বৈশ্বিক বিতরণ-ব্যবস্থা গড়ে-তোলাও সম্ভব করেছে। আন্তসক্রিয়তা (ইন্টারএ্যক্টিভ) সম্ভবকারী প্রযুক্তি প্রচলনের ফলে সৃষ্ট অডিয়েন্স ‘মিথষ্ক্রিয়ার’ (ইন্টারএ্যকশন) সুযোগ প্রধানত কেনাকাটা করতেই সহায়তা করে, কিন্তু একই সাথে তা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ অডিয়েন্স সম্পর্কে বিস্তারিত জানার, এবং তার ভিত্তিতে ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যের সাথে চমৎকারভাবে মিলিয়ে অনুষ্ঠানমালা ও বিজ্ঞাপন পরিবেশনের সুযোগ করে দেয়, সেইসাথে এসব অনুষ্ঠানের মাঝে মাউসের একটামাত্র ক্লিক করে পণ্য বিক্রিও সম্ভব করে তোলে। আর এসব কর্পোরেট মিডিয়ার লালিত সংস্কৃতি ও মতাদর্শ বহুলাংশেই জীবন ‘উদযাপন’ ভাবধারা, এবং ভোগ্যপণ্য ও পণ্যার্জনের ধারণাকেন্দ্রিক; এবং এগুলো জনজীবনের জন্য আবশ্যক যেকোনোরূপ কৌমবোধ (সেন্স অব কমিউনিটি) দুর্বল করে দেয়। এই মিডিয়া-ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যই (হলমার্ক) হলো অবিশ্রান্ত, সর্বব্যাপী বাণিজ্যিকতা। মিডিয়ায় কর্পোরেট আধিপত্য ব্যক্তিগত গোপনীয়তার গণ্ডি সীমিত করে ফেলছে তো বটেই, বাণিজ্যিকতা আরও বিস্তারিত হয়েছে। তবে, একথাও সত্য যে সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রি তার পণ্য-সীমানার গণ্ডিতে নতুন মিডিয়াকে ধরে রাখতে ইতোমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। যেমন ইউটিউবে প্রতিদিন ৬৫ হাজারের বেশি ফাইল আপলোড করা হয়। কেবল বিপুল পুঁজিপতি অভিজাতরাই সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন ও ভোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিকল্প মিডিয়া পরিসর সেটা করতে দেয় না।

এই রূপান্তরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্য বোঝা নিঃসন্দেহে খুবই জরুরি। প্রযুক্তি-নির্ভর প্রকাশের ক্ষেত্রে আসা পরিবর্তনগুলোর নতুনত্বের ওপর গুরুত্বারোপের সাথে সাথেই জরুরি হলো, রাজনৈতিক চৈতন্যের ক্ষেত্রে আসা পরিবর্তনগুলোও নিবিড়ভাবে পাঠ করা। আজকাল সমাজ কতো সফলভাবে প্রযুক্তির বিন্যাস ঘটাতে পারছে তার ওপরে সম্পদ, ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রবৃদ্ধি অনেকখানিই নির্ভরশীল। এখনও জারি-থাকা কেন্দ্রীয় সত্য হলো: গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য আবশ্যক হলো তথ্যসূত্রগুলোর গণতন্ত্রায়ন এবং একটা অধিকতর গণতান্ত্রিক মিডিয়াব্যবস্থা। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে হলে অমুনাফামুখী গোষ্ঠীভিত্তিক সম্প্রচারকেন্দ্র ও নেটওয়ার্ক এবং জন-অভিগম্য চ্যানেলগুলো আরও লাগসইভাবে ব্যবহার করতে শেখা, ইন্টারনেট এবং স্বাধীন মিডিয়া গড়ে তোলা আবশ্যক হবে। কর্পোরেট আধিপত্যের বিপরীতে পাল্টা সংস্কৃতি নির্মাণের অবিরাম প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের দুনিয়ায় শোষিতের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের চেতনায়, আমাদের সময়ের গায়ে লেপ্টে থাকা পণ্যায়িত-বাণিজ্যায়িত মিডিয়ার মদির-সম্মোহন থেকে মুক্ত হয়ে দুনিয়াকে দেখতে শেখা, ‘বিটুইন দ্য লাইন’ পড়তে শেখা এবং বিকল্প মিডিয়া-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি বলেও আমি মনে করি- যদিও এই কাজগুলো মোটেই সোজা নয়। কারণ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-অফিস-আদালত মায় আপন পরিবারের আঙ্গিনাতেও পায়ে পায়ে ছড়ানো রয়েছে দীক্ষায়ণের নিপুণ জাল।

টীকানির্দেশ :

১) Marshall McLuhan, Understanding Media : The Extensions of Man, McGraw-Hill, 1964

২) Manuel Castells and Gustavo Cardoso, The Network Society: From Knowledge to Policy, Center for Transatlantic Relations, Johns Hopkins, 2006

 ৩) আশির দশকে মফিদুল হকের লেখা অত্যন্ত মূল্যবান একটি গ্রন্থের শিরোনাম এটি। মফিদুল হক, মনোজগতে উপনিবেশ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত, সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *