জায়নবাদ, অথবা পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক-কালামতত্ত্ব

  • পারভেজ আলম

মানুষের প্রথম অবাধ্যতা,
নিষিদ্ধ গন্ধমের স্বাদ
মরণ আনলো দুনিয়ায়, আনলো দুঃখ,
বেহেশত হইতে বিতাড়িত, যতদিন না
আসলেন সেই মহাত্মা মানব,
আবার ফিরাইয়া দিতে আমাদের সেই
হারানো মোকাম,
সুতরাং গাও, বেহেশতি বন্ধুয়া আমার,
ওরেব অথবা সিনাই পাহাড়ের গোপন চুড়ায়,
করেছিল উদ্বেল,
সেই রাখালকে, প্রথম বীজেদের যিনি
দীক্ষা দিয়েছেন, একেবারে আদিতে,
শূন্য হইতে বেহেশত ও দুনিয়া, হইল উদয়
কেমনেঃ অথবা ,যেনবা সিয়োন পাহারের চূড়াই
তোমার জন্যে, সবচাইতে পরমানন্দের, আর
শীলোহের স্রোত, যা বহে খোদার দৈব বানীতে,
করো দয়া অধমেরে, এই রোমাঞ্চের গানে,
যেন সে পারে উড়িতে সেই আসমানে, এক লাফে,
ছাড়িয়ে কৈলাসের চূড়া, পাইতে তাহা,
যাহা আজো কেউ পারে নাই ধরিতে,
গদ্য কিংবা পদ্যে।

জন মিল্টন, পারাডাইস লস্ট (১৬৬৭)

মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট কবিতাটির সামান্য অংশও কখনো অনুবাদ করবার সাহস করি নাই। আর্কাইক ইংরেজিতে লেখা এবং ধর্মীয় ও মিথিকাল নানান স্থানের নাম ও রূপকে ভরপুর এই কবিতাটির প্রতিটা লাইন বোঝার জন্যেই সংগ্রাম করতে হয়। অনুবাদতো আরো পরের কথা। এবং ভাবানুবাদ ছাড়া এই কবিতার রস উপস্থাপন করাও অসম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি কবিতাটির প্রথম কিছু পঙক্তিকে ঠিকঠাক অনুধাবন করতে গিয়েই এই কয়টা লাইন অনুবাদ করতে হলো। কারো সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যে যে এই বাংলা অনুবাদটুকু করেছি, তা নয়। বরং এই বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের একেবারে শুরুতেই সিয়ন (যায়ন) পাহাড়ের রূপকটিকে ঠিক কী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অনুধাবন করবার উদ্দেশ্যেই বাংলা অনুবাদের আশ্রয় নেয়া। অন্যভাবে বললে, অনুবাদ আর অনুধাবন এইক্ষেত্রে একাকার হয়ে গেছে।

এই অনুবাদ ও অনুধাবনের পেছনে মূল কারণ অবশ্য ফিলিস্তিনের পক্ষে চলতে থাকা সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাথে জড়িত শিক্ষার্থীরা নিওলিবারাল পাশ্চাত্যে গেড়ে বসা অনেক ট্যাবু ইতোমধ্যেই ভেঙে ফেলেছে। তাদের র‍্যাডিকাল রাজনৈতিক অবস্থানও জন্ম দিয়েছে নানান রকম বিতর্ক। যেমন, ইউনিভারসিটি অফ আমস্টার্ডামের ক্যাম্পাসে লেয়লা খালেদের পোস্টার বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শাদিয়া আবু ঘাজালেও পরিণত হয়েছেন আন্দোলনকারীদের একাংশের পছন্দের প্রতীকে। ফিলিস্তিনের মানুষের কাছে লেয়লা বা শাদিয়া হলেন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ইসরায়েল ও তার মিত্রদের চোখে তারা সন্ত্রাসী। কৌশলগত কারণে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকা অনেক একটিভিস্টও এধরণের র‍্যাডিকালিজমের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু জেনোসাইডের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে এসব কৌশলগত সংকট বোঝানো কঠিন। তারা বর্তমানে একটা বিদ্রোহী-বিপ্লবী ভাবের মধ্যে বিরাজ করছেন। সমালোচনা বা সাবধানবাণী দিয়ে তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না। উলটো এনার্কিস্ট শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আমস্টার্ডাম শহরের একেবারে কেন্দ্রীয় একটি এলাকার একটি স্কোয়াট ভবনকে (দখলকৃত ভবন) পিপলস ফ্রি ইউনিভার্সিটি নামের একটি কল্পিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘোষণা করেছে। আর ভবনটির নামকরণ করেছে – শাদিয়া আবু ঘাজালে ক্যাম্পাস।

সম্প্রতি আমাদের ডিপার্টমেন্টের আরো কয়েকজন শিক্ষক এই ক্যাম্পাসে কিছু ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমিও সেখানে গিয়েছি। শিক্ষার্থীদেরকেই জিজ্ঞাস করেছি তারা কোন বিষয়ে ক্লাস চান। এক চটপটে তরুণি বললেন যে, যেকোন বিষয়েই ক্লাস নিতে পারেন – জায়নিজম ছাড়া। কিন্তু আমি তাকে বললাম যে, জায়নিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে জায়নিজম বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা জরুরি। সুতরাং, আমি জায়োনিজম বিষয়েই ক্লাস নেবো। উপস্থিত অন্যরাও একমত হলেন। এই ক্লাসটি অবশ্য এখনো নেয়া হয় নাই। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরমধ্যেই গত সপ্তাহে ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে (রুটার্সআইল্যান্ড) বিশ্ববিদ্যলায়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা একটি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করলেন। নাম দিলেন “আল আকসা আমস্টারডাম ক্যাম্পাস”। ইজরাইল শুধু ফিলিস্তিনিদের হত্যাই করছে না। একইসাথে ধ্বংস করছে তাদের সকল শিক্ষালয়। গাজায় অবস্থিত আল আকসা বিশ্ববিদ্যালয়টিও (প্রতিষ্টা ১৯৫৫ সাল) সম্প্রতি ইজরাইলি বোমা হামলায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আল আকসা ক্যাম্পাস নামটি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতীকীভাবে বাঁচিয়ে রাখার একটি চেষ্টা। তো, এই নতুন ইনক্যাম্পমেন্টের কর্মসূচী হিসাবেই কিছু টিচ ইন সেশনের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং, এই অস্থায়ী আল আকসা ক্যাম্পাসেই প্রথম জায়নিজম বিষয়ক ক্লাসটি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। খানিকটা তাড়াহুড়া করে, মাত্র একদিনের প্রস্তুতিতে। “জায়নিজম এজ এ পলিটিকাল থিওলজি অফ ন্যাশনালিজম” নামক টিচ ইন সেশনটিতে দেয়া বক্তব্যের সারমর্মই অল্প কথায় এই লেখাটিতে তুলে ধরবো।

সাধারণত ফরাসী বিপ্লব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে (সেকুলার) জাতীয়াবাদের সুচনাবিন্দু হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু পশ্চিমা ইউরোপের প্রটেস্টান্ট রাষ্ট্রগুলার আবির্ভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেড়ে ওঠার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে জাতীয়তাবাদের উত্থান আসলে ঘটেছে ষোল-সতের দশকে। এবং জন্মের সময় জাতীয়তাবাদ মোটেই ঠিক সেকুলার জাতীয়তাবাদ ছিল না। বরং ইংল্যান্ড, ন্যাদারল্যান্ডস, সুইডেন ইত্যাদি দেশে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে প্রটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের গর্ভে। সাধারণত এই জাতীয়তাবাদকে বাইবেলীয় জাতীয়তাবাদ (বিবলিকাল ন্যাশনালিজম) ও ইবরানি জাতীয়াতাবাদ (হিব্রু ন্যাশনালিজম/ হিব্রু রিপাবলিকানিজম) বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, এই জাতীয়তাবাদ প্রথম জন্ম নিয়েছিল একধরণের রিপাবলিকানিজম হিসাবে। ইংল্যান্ডে এই ইতিহাস বেশ পরিষ্কার। থমাস হবস যখন লিবিয়াথনের প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন, তখন তিনি নবী স্যামুয়েলের কিতাবের একটি নতুন পাঠ উপস্থাপন করেন। স্যামুয়েলের কিতাব মোতাবেক, প্রাচীন ইজরাইলিরা নবী স্যামুয়েলের কাছে একজন রাজা নিযুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল, যেন তারা আর দশটা জাতির মতো হতে পারে। হবসের দাবি, এর আগে বনি ইজরাইলিদের রাজা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। এই পাঠ নতুন হলেও কষ্টসাধ্য কিছু না। কিন্তু রাজতন্ত্রের বৈধতা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে গিয়েই হাজার বছর ধরে ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা এহেন পাঠ করবার সাহস করেন নাই। হবস যদিও সাহস করেছেন, কিন্তু লিবিয়াথনের পরবর্তি এক সংস্করণে নিজেই এই অংশটুকু বাদ দিয়েছেন। লিবিয়াথন কিতাবের এই অংশটুকু নানান বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, বাদ দেয়ার পেছনে তা একটি কারন। কিন্তু আরো বড় কারন হলো যে তৎকালীন ইংল্যান্ডে এমন কিছু জনপ্রিয় প্যাম্ফলেট এই সময় প্রকাশিত হয়েছে, যাতে হবসের পাঠের বেশ কাছাকাছি ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে। পার্থক্য হলো যে হবস নিজে ছিলেন একজন মনার্কিস্ট। কিন্তু এইসব প্যাম্ফলেটের লেখকরা ছিলেন রিপাবলিকান। নিজের পাঠ প্রতিপক্ষের পাঠের সাথে মিলে যাওয়াতেই হবস বাধ্য হয়ে লিবিয়াথনের পরবর্তি সংস্করণ থেকে স্যামুয়েলের কিতাবের এই পাঠটুকু বাদ দিয়েছেন, সেই সম্ভাবনাই বেশী।

স্যামুয়েলের কিতাবের সবচাইতে পরিষ্কার রিপাবলিকান পাঠ প্রথম যিনি করেছেন, তিনি হলেন কবি মিল্টন। কাব্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক লেখালখিতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তিনি স্যামুয়েলের কিতাবের রিপাবলিকান ব্যাখ্যা হাজির করেছেন মূলত তার সময়কার গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাজা চার্লসের মৃত্যদন্ডকে ধর্মসঙ্গত করতে গিয়ে। প্রথমত তার দাবি, আল্লাহ হলেন একমাত্র রাজা। এবং দুনিয়ায় মসিহ ছাড়া আর কারো রাজত্ব ধর্মসঙ্গত নয়। সুতরাং, আল্লাহকে বাদ দিয়ে রাজার আনুগত্য করা হলো শিরক (iconoclasm), যা মহাপাপ। আদি বনি ইজরাইলীরা আর দশটা জাতির মতো ছিল না। তাদের কোন রাজা ছিল না। একমাত্র সার্বভৌম যেই আল্লাহ, তার কণ্ঠ হিসাবে নবী রাসুলরা তাদের বিচার আচার করতেন। সুতরাং, রাজার শাসনে থেকে আর দশটা জাতির মতো যখন হতে চেয়েছে বনি ইজরাইলিরা, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু অসন্তুষ্ট হলেও তিনি জনতার দাবী মেনে নিয়েছেন। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ইজরাইলিদের রাজার অবস্থান থেকে। এখন, মিল্টনের দাবী, যদি স্বয়ং আল্লাহ জনতার ইচ্ছায় দুনিয়াবি কুরসি ত্যাগ করতে পারেন, তবে চার্লসকে কুরসি থেকে উৎখ্যাত করাটা জনগণের জন্যে পাপ বা অপরাধ হতে পারে না।

উল্লেখ্য যে, মিল্টন কেবল স্যামুয়েলের কিতাবের উদ্ধৃতিই দেন নাই। সেই সাথে উল্লেখ করেছেন মিদ্রাসে হাজির থাকা বেশ কয়েকজন ইহুদি রাবির ব্যাখ্যা। মিল্টন হিব্রু ভাষা জানতেন বলে মনে হয় না। তবে তার সময়ে প্রটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে হিব্রু বাইবেল এবং আরো নানান হিব্রু কিতাব অনুবাদ করা হয়েছিল ল্যাটিন ভাষায়। মিল্টন এসব অনুবাদের সাথে পরিচিত ছিলেন। যার কারণে তার গদ্য এবং পদ্যে দেখা যায় বহু হিব্রু শব্দের ব্যবহার। সিওন বা জায়ন নামের স্থানটিও একটি রূপক হিসাবে এই সময়ই জনপ্রিয় হয়েছে। প্যারাডাইস লস্ট কাব্যের একেবারে প্রথম দিকেই যেমন আমরা পাই সিয়ন পাহাড় বা জায়নের বর্ণনা, যেই পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছিল প্রাচীন জেরুজালেম শহর। মিল্টন একাই যে সিয়ন রূপকের ব্যবহার করেছেন, তা না। ইংল্যান্ড ও নেদ্যারল্যান্ডসের মতো প্রথম আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলার রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় সাহিত্য এবং রাজনৈতিক বয়ানে সিয়ন/জায়ন প্রতীকটি একটু একটু করে জনপ্রিয় হয়েছে। এধরণের সাহিত্য ও রাজনৈতিক বয়ানে রিপাবলিকানিজমকে কেবল রাজতন্ত্রের চাইতে বেশী শ্রেষ্টই দাবি করা হয় নাই, বরং ধর্মীয় দিক থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশী পছন্দনীয় হিসাবে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এধরণের রিপাবলিকানিজমের মধ্যে প্রথম থেকেই ঢুকে গিয়েছিল নির্বাচিত জাতির ধারণা। আল্লার নির্বাচিত জাতির শ্রেষ্টত্বের ধারণা। এবং উপনিবেশের পক্ষের ধর্মীয় মতাদর্শ।

স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নেদারল্যান্ডসে যেই জাতীয় চেতনা বিকাশ লাভ করেছিল, তার পাটাতনে হাজির ছিল প্রাচীন বনি ইজরাইলের ধারণা। এর আগে ডাচ জাতি নামক আলাদা কোন জাতির ধারণা ছিল না। এমনকি নেদারল্যান্ডসের জাতীয় সঙ্গীতেও এই অঞ্চলের মানুষকে একটি জার্মান জাতি বলে ডাকা হয়েছে। পরাক্রমশালী স্পেনীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ডাচদের মতো একটি ক্ষুদ্র জাতি যে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডাচরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করেছে নতুন ইজরাইলি হিসাবে। স্পেনের হাত থেকে বাঁচতে উত্তর দিকে পলায়নকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মুসার নেতৃত্বে মিশর থেকে হিজরতের আলোকে। স্পেনকে কল্পনা করা হয়েছে মিশর হিসাবে, আর স্পেনের রাজা পরিণত হয়েছেন ফেরাউনে। উইলিয়ামকে তুলনা করা হয়েছে দাউদের সাথে। আর আমস্টার্ডামকে তখন আদর করে ডাকা হয়েছে “নতুন জেরুজালেম”। সিয়ন/জায়ন শব্দটিও এই সময় জনপ্রিয় হয়েছে জাতীয়তাবাদী রূপক হিসাবে। যেমন, সুইডিশরা নিজেদের রূপক নাম দিয়েছিল সিয়নের সন্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক জায়নবাদের জন্ম হয়েছে ইউরোপে ইহুদিদের মধ্যে জায়নবাদ জন্ম নেয়ার কয়েক দশক আগেই। কিন্তু মার্কিনি জায়নবাদের ইতিহাস আসলে আরো কয়েকশ বছর পুরাতন। যুক্তরাষ্ট্রে হিজরত করা আদি প্রটেস্টান্ট পায়নিয়াররা অনেকেই মূলত আমেরিকান মহাদেশে নতুন ইজরাইল বা নতুন জায়ন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে ঈসা মসিহ ফেরত আসবেন।

আমেরিকার অন্যতম রূপক নাম তাই সিটি আপন দা হিল, যাহলো সিয়ন পাহাড়ের উপর অবস্থিত জেরুজালেমের রূপক নাম। বহু মার্কিন রাষ্ট্রপ্রতিই এই রূপক নামটি ব্যবহার করেছেন তাদের বক্তৃতা ও লেখালেখিতে। এমনকি লিবারালদের মাহদি হিসাবে যাকে হাজির করা হয়েছিল, সেই বারাক ওবামাও পিছিয়ে ছিলেন না। যা বলতে চাচ্ছি, জায়নবাদ নাম ধারণ করবার বহু আগে থেকেই হিব্রু জাতীয়তাবাদ, হিব্রু রিপাবলিকানিজম, ইত্যাদি নামে পশ্চিম ইউরোপে ও আমেরিকায় খ্রিষ্টীয় জায়নবাদ বিকাশ লাভ করেছে। উল্লেখ্য যে, খোদ ইহুদিরা তার আগে সাধারণত সিয়ন/জায়ন নামটিকে একটি রুহানি মোকাম হিসাবেই বেশী বিবেচনা করতেন। মানে, জাতীয়তাবাদী রূপক হিসাবে ইউরোপীয়রা জায়নের ধারনাটিকে আবিষ্কার করেন নাই, বরং খ্রিষ্টানদের থেকে ধার করেছেন। থিওডর হার্জল যখন জায়নিজমের মতাদর্শ হাজির করেছেন, ততদিনে বিবলিকাল জাতীয়তাবাদের জায়গায় উপস্থিত হয়েছে সেকুলার জাতীয়তাবাদ (যদিও তার বাতেনে রাজনৈতিক কালামতত্ত্ব হিসাবে জায়নবাদ নাই হয়ে যায় নাই)। এবং একটি সেকুলার জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ হিসাবেই হার্জল জায়নবাদের প্রস্তাব করেছেন। জাতিরাষ্ট্রময় ইউরোপে ইহুদি প্রশ্নকে জাতি প্রশ্নে পরিনত করতে চেয়েছিলেন তিনি। জায়নবাদ বলে আমরা এখন যা চিনি, এভাবেই তার সূত্রপাত।
অবশ্য মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টে যেই সিয়নের উল্লেখ আমরা দেখি, তাও ঠিক ভৌগলিক কোন স্থান নয়, বরং একটি রুহানি মোকাম বলে মনে হয়। কিন্তু সেই সাথে এও সত্য যে মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট নেহায়েত কোন ধর্মীয় কাব্য নয়, বরং একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কাব্যও বটে। ধর্মীয় নানান নাম ও চরিত্র এই কাব্যে উপস্থিত আছে খোদ মিল্টনের সময়কার বিভিন্ন ঘটনার রূপক হিসাবে। প্যারাডাইস লস্টের মূল ভিলেইন আর কেউ নন, স্বয়ং ইবলিশ শয়তান। কিন্তু, সেইসাথে একজন দুনিয়াবি ভিলেইনের কথাও মিল্টন বলেছেন। এই ভিলেইন হলেন তাওরাতে উল্লেখিত প্রথম রাজা – নমরুদ। মিল্টনের ভাষায়ঃ

অতঃপর…একজন দাঁড়াবে উঠিয়া,
এক গর্বিত, উচ্চাকঙ্খী মন,
যার মাঝে নাই কোন ইনসাফ ও ভাতৃত্ব,
উদ্ধত অহংকারে অন্যায্য রাজত্ব
চাপাইবে সে ভাইয়েদের উপরে, নিবে কাড়িয়া
দুনিয়া হইতে ঐকতান ও ফিতরতি হক,
করিবে শিকার (পশুরে নয়, মানুষেরে),
যুদ্ধ আর হিংসার ফাঁদে ফেলে সেজদা আদায়
করিবে সে তার স্বৈরাচার সাম্রাজ্যের তরেঃ
এক মহা শিকারী – নামে ডাকা হবে তারে,
আল্লাহ আর বেহেশতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
দ্বিতীয় সার্বভৌমত্বের দাবিদার,
ফ্যাসাদ হইতে লভিবে আপন নাম,
কিন্তু জমিনের অন্যদের বলিবে

ফ্যাসাদকারী, সন্ত্রাসী

মিল্টন এখানে নমরুদের নাম না নিলেও তাওরাতে উল্লেখ করা তার উপাধিটি ব্যবহার করেছেন (আল্লাহ আর বেহেশ্তের মুখোমুখি এক মহা শিকারী)। কিন্তু এইক্ষেত্রে নমরুদ তার জন্যে একটি মেছাল বা উদাহরণ। সাধারণভাবে এই নমরুদ হলো রাজার আর্কেটাইপ। কিন্তু বিশেষভাবে খোদ রাজা চার্লসেরও রূপক। তবে, আমাদের সময়ে আমরা এই নমরুদকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র বলেও কল্পনা করতে পারি। যেই জনগণের ইচ্ছাকে উর্ধে তুলে ধরতে গিয়ে হিব্রু রিপাবলিকানিজমের প্রচার করেছিলেন মিল্টন, দেখা গেল যে আধুনিক গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রেও সেই জনগণ থেকে গেল মজলুম।

স্যামুয়েলের কিতাবের যেই কাহিনীর ব্যাখ্যার উপর ভর করে আধুনিক রিপাবলিকান মতাদর্শ বেড়ে উঠেছে, সেই কাহিনীটি কোরানেও আছে। তবে খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে। তবে সংক্ষিপ্ত হলেও কোরানের কাহিনীটির সাথে তাওরাতের কাহিনীর বড় ধরণের কিছু ফারাক রয়েছে। কোরানের কাহিনীটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। অল্প কথায় কিছু বলতে গেলেও কেবল মাত্র একটি আংশিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। কিন্তু আংশিক ব্যাখ্যা হিসাবেও দুই চার কথা বলা দরকার। কোরানে আমরা দেখি যে বনি ইজরাইলিরা অভিযোগ করছে যে, তালুততো ধন সম্পদের অধিকারী না। তবে তাকে কেন রাজা বানানো হলো? স্যামুয়েল (কোরানে তাকে একজন অনামা নবী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে) তখন বললেন যে, আল্লাহ তালুতকে দিয়েছেন জ্ঞান ও দৈহিক সামর্থের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ, গরীব হওয়াটা রাজা হওয়ার পথে বাধা নয়। জ্ঞান এবং দৈহিক সামর্থই রাজা হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অবশ্য, তালুত হলেন দাউদের আগমনের পথ প্রস্তুত করা একজন ব্যক্তি মাত্র। কেননা এরপরেই কোরানে বলা হচ্ছে দাউদের কথা, যার বীরত্বে গোলিয়াথ পরাজিত হয়েছে। এবং আল্লাহ তাকে একই সাথে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা (হিকমা) দিয়েছেন। তবে, কোরানের এই কাহিনির অন্যতম বক্তব্য হলো যে – আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা নেতৃত্ব দেন।
কোরানে তালুতের কাহিনীটি এসেছে মূলত তৎকালীন মুসলমানদের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। তারা তখন সদ্য মক্কা থেকে হিজরত করেছেন মদিনায়। এবং কোরানে বারবার নবী মুহাম্মদের উম্মতকে উপস্থাপন করা হয়েছে বনী ইজরাইলিদের রূপকে। মুসা নবী ও তার জাতির কাহিনী কোরানে হাজির আছে এই নতুন উম্মতের জন্যে শিক্ষার প্রয়োজনেই। এবং নবী মুসা পরিণত হয়েছেন নবী মুহাম্মদের আর্কেটাইপে। আলোচ্য আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা পাচ্ছি স্যামুয়েল এবং তালুতের কথা। স্যামুয়েল ছিলেন নবী, আর তালুত ছিলেন রাজা। অন্যদিকে মহানবী একদিকে যেমন রাসুলের দায়িত্ব পালন করেছেন, আরেকদিকে তাকে দিতে হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। পালন করতে হয়েছে সেনাপতির দায়িত্ব। দ্বীন আর রাজনীতির এই জটিলতা সূরা বাকারার এই অংশের কেন্দ্রীয় বিষয়। কেননা এই অংশটিতে প্রাচীন ইজরাইলিদের সাথে নবীর উম্মতের তুলনা করা হয়েছে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার ও হিজরতের আলোকে। প্রাচীন ইজরাইলিরা যুদ্ধ করেছিল, কারন তারা নিজ বাসভূম থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। নবী এবং তার উম্মতদেরও একই অবস্থা। যুদ্ধ না করে তাদের উপায় নাই। কিন্তু সূরা বাকারার এই অংশেই আবার আমরা পাই সেই বিখ্যাত আয়াতঃ লা ইকরাহা ফিদ্বীন। মানে, দ্বীনের প্রশ্নে কোন জবরদস্তি নাই। আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে ঈসা নবীর আগমনের পরেই কালামতত্বীয় সব বিবাদ মিটে যেতো। কিন্তু এই বিবাদ মিটিয়ে ফেলাটা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নে জবরদস্তি করে লাভ নাই। কিন্তু হক তথা সত্যের জন্যে, অধিকারের জন্যে, ভিটামাটির জন্যে – লড়াই করতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই।

তাই বলে কোরানের এই অংশে ধর্ম আর রাজনীতিকে পুরাপুরি সম্পর্কহীন করা হয়েছে, তাও বলা যাবে না। বরং, এমন দাবি করা হয়েছে যে – আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন। আল্লাহ তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। আর কাফেরদেরকে (যারা সত্যকে লুকায়) নিয়ে যান আলো থেকে অন্ধকারে। ফলে, কাফেরদের সাথে যুদ্ধে মুমিনরা এমনিতেই জিতবে। কাফেররা মুমিনদের – লেভেলে নাই। কারন তারা জালেম। প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুর সামনে সংখ্যায় অতি ক্ষুদ্র তালুতের বাহিনীকে বলতে শোনা যায়, আজতক বহু ছোট বাহিনীই নিজের চাইতে বহু বড় শত্রুকে পরাজিত করেছে। এর কিছুকাল পরেই কিন্তু খোদ মদিনার মুমিনরা এই বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন – বদরের যুদ্ধে। তবে, তাওরাতের কাহিনির সাথে কাঠামো ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও কোরানের কাহিনীটিতে রাজার শাসন নিয়ে একেবারে কিছু বলা নাই, তা না। বরং, তালুতের কাহিনী শেষ করবার পরেই প্রচার করা হয়েছে আল্লাহর রাজত্বের কথা। সেই বিখ্যাত বাক্যের মাধ্যমে এই ঘোষণার সূত্রপাতঃ “আল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লা হুয়া আল হাইয়ুল কাইয়ুম”। মানে, আল্লাহঃ তিনিই সদা প্রাণবান, সবকিছুর ধারক। সেই সাথে বলা হয়েছেঃ তাঁর কুরসি বিস্তৃত বেহেস্ত হইতে জমিন পর্যন্ত। এমন কেউ নাই, যে কিনা আল্লাহর হয়ে কোন কথা বলতে বা কিছু করতে পারেন, যদি না আল্লাহ নিজে তাকে সেই অনুমতি দেন।

কোরানে তালুতের কাহিনির একটি ইতিহাসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যাবে তালুতের কাহিনীটির একেবারে শেষ আয়াতে। এই আয়াতে আমরা দেখি জালুতের বিরুদ্ধে দাউদের যুদ্ধ। অতঃপর দাউদের রাজত্ব এবং হেকমত/প্রজ্ঞা লাভের কথা। সবশেষে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহ যদি এভাবে একদল মানুষকে দিয়ে আরেক দল মানুষকে না ঠেকাতেন, তবে দুনিয়া ফ্যাসাদে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। এধরণের ইতিহাসবাদীতা বা ইতিহাসের মধ্যে আল্লাহর বিচারের এই ধারণাটি কোরানে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *