রাখাল রাহা
একটা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরে যে আলাপ চলছে সেখানে শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে হাজির আছে। সেই আলাপকে প্রয়োজনীয় বুঝে এবং শিক্ষার এদেশীয় বৈশিষ্ট্য ও তার বিকাশ নিয়ে যেসব কথা রাষ্ট্র ও সমাজের নানা স্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তার ভিত্তিতেই এখানে কিছু প্রস্তাব সংক্ষিপ্ত আকারে উত্থাপন করা হলো।
এই প্রস্তাবগুলো খসড়া এবং এগুলো শিক্ষার রুটিন কর্মতৎপরতার সাথে খুব একটা সংশ্লিষ্ট নয়। কারণ যে-কোনো খাতের রুটিন কাজ ও তৎপরতার সংকট বা সীমাবদ্ধতাগুলো একটা যোগ্য, দক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনা কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব নয় সেই খাতের নিজস্ব সংগঠন ও ধারণাগত জায়গাগুলোতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজটা। এ বিবেচনা থেকে রুটিন সেই বিষয়গুলো এড়িয়ে এখানে শিক্ষা এবং বাংলাদেশের শিক্ষার নিজস্ব সংগঠন এবং ধারণাগত বিষয় নিয়ে কিছু আলাপের সূত্রপাত করা হলো।
১.
বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার আজ অতি মুমূর্ষু দশা। একটা স্বাভাবিক সুস্থ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য যে ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, মুমূর্ষুর জন্য তা নেওয়া যায় না। মুমূর্ষুকে বাঁচাতে প্রথমেই যেমন দ্রুত তার সমস্যা শনাক্ত করতে হয়, তেমনি দ্রুততার সাথে তাকে সঠিক দাওয়াইটাও দিতে পারতে হয়। সুতরাং এ দুটো কতটা সঠিক ও দক্ষতার সাথে করা সম্ভব হচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের শিক্ষার ঘুরে দাঁড়ানো অথবা মৃত্যুর দিকে আরো এগিয়ে যাওয়া। তাই শিক্ষা নিয়ে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দলের বা সংগঠনের যে ভাবনাই থাক, বা সামষ্টিকভাবে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমে এই দিকটি ভাবতে হবে।
২.
যে-কোনো খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের জন্য অন্তত ৪টা ধাপে ভাবতে হয় : জরুরী, স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। খাতের চরিত্র এবং পতনের দশা বুঝে কোন কাজটা কোন ধাপে করা হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, চিহ্নিত কাজ বা পদক্ষেপগুলোর আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয় করা এবং সে-অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতার সাথেই সেই খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। সুতরাং বাংলাদেশের শিক্ষাকে এই পতিত দশা থেকে উদ্ধার করতে হলে সবাইকে উদ্ধার তৎপরতার এসব ধাপ ও তাদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে হবে এবং তার ভিত্তিতে কথা বলতে হবে।
৩.
বাংলাদেশের শিক্ষায় অনেক ধারার কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এদেশের শিক্ষায় মোটাদাগে দুইটা ধারা আছে। একটা সাধারণ ধারা এবং আরেকটা মাদ্রাসা ধারা। মোটা দাগেই বলা যায়, সাধারণ ধারা রাষ্ট্র পরিচালিত এবং মাদ্রাসা ধারা সমাজ পরিচালিত। সাধারণ ধারার মধ্যে আবার ৪টি বড়ো উপ-ধারা আছে : বাংলা মাধ্যম, ইংরেজী মাধ্যম, ইংরেজী ভার্শন ও আলীয়া। অন্যদিকে সমাজ পরিচালিত মাদ্রাসা ধারার মধ্যেও বেশ কিছু উপ-ধারা আছে।
যেটা উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সকল ধারা ও উপধারা মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ দেশে তিন কোটি মানুষও নেই। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে যে-কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা শুধু নিজের গোত্র বা বিশ্বাস বা একটা স্কুল বা প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ অভিজ্ঞতার নিরিখে নয়, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের ধারা-উপধারার কথা মনে রেখে ভাবতে হবে।
৪.
যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের শিক্ষায় এইসব ধারার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে তাকে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে রেখে শিক্ষা উন্নয়নের কথা ভাবা যায়, আবার তাদের একত্রিত করেও ভাবা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষার সকল ধারা-উপধারার একত্রীকরণের সুবিধার একটা ইউটোপিয়া নানা সময়ে হাজির করা হয় এবং এর পক্ষে অনেক যুক্তি-তত্ত¡ও দেওয়া হয়। এসব যুক্তি-তত্ত্বের ভিত্তি হিসাবে বিজ্ঞানের কথা বলা হয়, প্রগতি ও আধুনিকতার কথা বলা হয়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে শিক্ষা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়। বস্তুত কোনো বিজ্ঞানই সমাজবিজ্ঞান নিরেপক্ষ নয়। সমাজবিজ্ঞানকে সাথে না নিয়ে বিজ্ঞান আগাতে পারে না। বাংলাদেশের শিক্ষাকে বাঁচাতে বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। যে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের জলধারা পদ্মা-ভাগিরথী-গড়াই হয়ে ছুটে চললো তাকে আবার উল্টো ঘুরিয়ে গঙ্গার অভিন্ন প্রবাহে মিশিয়ে দেওয়াই একমাত্র ভালো, এবং সেই ভালো না করা পর্যন্ত আর কিছু ভালো করা যাবে না – এই মত যে সমাজবিজ্ঞান সম্মত নয়, তা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
৫.
বাংলাদেশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার সংবিধানে “একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার” আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছিল। এর আক্ষরিক অর্থ বা প্রকৃত অর্থ নিয়ে বিতর্ক না করেও আমরা বলতে পারি, সংবিধান গ্রহণের পর রাষ্ট্র কখনো এটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সাংবিধানিক এই অঙ্গীকারের প্রতি বিগত ৫৩ বছরে ব্যাপক কোনো গণ-আন্দোলন হয়েছে তেমনও নয়। তবে সেই অঙ্গীকারের সাথে পরবর্তী সময়ে নানা সংগঠনকে “বিজ্ঞানভিত্তিক” শব্দটা জুড়ে দিতে দেখা গেছে, “কর্মমুখী” শব্দটাও নানা অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
সংবিধানের অঙ্গীকার এবং তার সাথে যুক্ত এসব পরিপূরকীয় শব্দে শিক্ষার গুণগত কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও এগুলোর আপাতঘাত ও চূড়ান্তঘাতের শিকার যেসব ধারা বা উপধারা হয়েছে, তারা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ধারার প্রতিপক্ষ হিসাবেই মূলত সমাজে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় তারা ক্রমাগতভাবে নিজেদের সংকট আড়ালে রেখে অস্তিত্ব রক্ষার প্রতি সচেতন হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষার ক্রম-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মাঝে নিজেদের বিকল্প হিসাবে ভাবতে শিখেছে। শিক্ষা নিয়ে যে-কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালিত এবং সমাজ পরিচালিত শিক্ষার নানা স্তরের মধ্যে বিরাজমান এই শিক্ষাপরিস্থিতিটা বোঝা জরুরী।
৬.
আমাদের মতো রাষ্ট্রের শিক্ষাপরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির বিচিত্র ইচ্ছা ও ইশারা থাকে। তাদের হয়ে এনজিও এবং আইএনজিও নামের নানা ধরণের উন্নয়ন-বাণিজ্যিক সংগঠন কাজ করে। এসব দেশের সরকার সেগুলো মেনে নিয়েই চলে, কারণ এতেই তাদের ক্ষমতাস্বার্থ রক্ষিত হয় তুলনামূলকভাবে অধিক। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বহুবিধ হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য তারা নিজেরাও শিক্ষাপরিস্থিতির মধ্যে পরিকল্পিতভাবে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের শিক্ষার সকল ধারা-উপধারা, কম বা বেশী, এই হস্তক্ষেপের শিকার।
সুতরাং সাদা চোখে আমরা শিক্ষার বিভিন্ন ধারাকে যা দেখি, এবং দেখে তার বিষয়ে যেভাবে ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নিই, তা সবসময় সত্য নয়। শিক্ষার এই রাজনীতি না বুঝে শিক্ষা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
৭.
বাংলাদেশের শিক্ষার সকল ধারা ও উপধারার মধ্যে সর্বাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে সাধারণ ধারার বাংলা মাধ্যমে। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাস হলো এই ধারার শিক্ষা ধ্বংসের ইতিহাস। এবং ধ্বংসটা পরিকল্পিত। বস্তুত এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এইসব ধ্বংস ও তার পরিকল্পনা যাতে আমরা বুঝতে না পারি, সেজন্য শত্রু হিসাবে শিক্ষার অন্যান্য ধারা, বিশেষ করে সমাজ পরিচালিত মাদ্রাসা ধারার দিকে নেতিবাচকভাবে তাকানোর সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে।
বস্তুত বাংলাদেশে শিক্ষার সংকট ধারাভেদে পৃথক এবং সেগুলোর মাঝে মাত্রাগত পার্থক্যও রয়েছে। কিন্তু এটাকে উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিশেষ ধারা বা উপ-ধারার উপর বিশেষ বিদ্বেষ সৃষ্টির যে সংস্কৃতি তা রাষ্ট্র-নির্মিত। বাংলাদেশের শিক্ষায় যে-কোনো ধরণের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করতে হলে এই সংস্কৃতিকে বুঝে ও মোকাবেলা করে আগাতে হবে।
৮.
সম্পদের যে দুটি প্রকার রয়েছে তাতে শিক্ষা অবস্তুগত সম্পদ। বস্তুগত সম্পদের সাথে এর পার্থক্য হলো এটার ভালো-মন্দ বা বড়ো-ছোট বিবেচনার মাপকাঠি সুনির্দিষ্ট নয়। তাই সমাজে বস্তুগত সম্পদের ভালো-মন্দ নিয়ে যতো সহজে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব অবস্তুগত সম্পদ নিয়ে তা নয়। বস্তুগত সম্পদের কর্তৃত্ব বা মালিকানা বা রক্ষার তাগিদ নিয়ে সমাজে যতো আগ্রহ থাকে, অবস্তুগত সম্পদ নিয়ে তা থাকে না।
বস্তুত একটা সমাজ কতখানি আগানো তা বোঝা যায় সেই সমাজে অবস্তুগত সম্পদের গুরুত্ব কতখানি, বা এ বিষয়ে মানুষের বোঝাপড়া কেমন তার ধরণ দেখে। সে বিচারে বাংলাদেশ একটা পশ্চাদপদ দেশ। এই পশ্চাদপদতার কারণ যেটাই হোক, সম্পদ হিসাবে শিক্ষার এই বৈশিষ্ট্য না বুঝে, সে বিষয়ে সমাজের মানুষের ভাবনার স্তর না ভেবে করণীয় করা ঝুঁকিপূর্ণ।
৯.
অবস্তুগত সম্পদ ‘শিক্ষা’ প্রাপ্তির উপায় হিসাবে অধিকাংশ মানুষ আবার বস্তুগত উপকরণ, অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তককেই বোঝে। সে-কারণে মানুষের এই বোঝার জায়গাকে ঘিরেই শিক্ষার দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা কষে অধিক। সমাজে চিন্তার বিভাজনকে ব্যবহার করে তারা পাঠ্যপুস্তকে এমনসব পাঠ বা ধারণার এমনভাবে সমাগম ঘটায়, যা সেই বিভাজনকেই আরো তীব্রভাবে উস্কে দেয়। সেই উস্কানিতে তখন শিক্ষার মানে হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা বিশেষ কোনো পাঠ থাকা বা না-থাকার মতো বিষয়।
বস্তুত কোন পাঠ কোন বিষয়ে কেন পাঠ্য হবে, সেই পাঠে কি কি শিখন-উদ্দেশ্য হাসিল হবে, কিভাবে হবে – এই বোধের জায়গায় তখন পৌঁছানো সম্ভব হয় না। শিক্ষার ভাবনায় পাঠ্যপুস্তকের এই রাজনীতি না বুঝে আগানো সম্ভব নয়।
১০.
শিক্ষা একটা ইতিবাচক প্রপঞ্চ। শুধু ইতিবাচক নয়, এটা হলো মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইতিবাচক প্রপঞ্চ। অতীতে মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রপঞ্চ থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার মাধ্যমে ধ্বংসসাধনের পরিকল্পনা করা হতো। বর্তমানে এটাকে সবার জন্য সুযোগ হিসাবে হাজির রাখার মাধ্যমে ধ্বংসের পরিকল্পনা সাজানো হয়। সবার জন্য যেনতেন কোনো এক ধরণের শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে যদি তার উপযোগী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না করা হয়, কিংবা যদি পরিকল্পিতভাবে উল্টোটা করে তোলা যায়, তবে পূর্বের অশিক্ষা থেকে সেই সমাজের যতখানি ক্ষতিসাধন করে স্বার্থ হাসিল করা যাচ্ছিল, পরের তথাকথিত শিক্ষা দিয়ে তার থেকে অনেক বেশী ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হয়, এবং একইসাথে বহুগুণ বেশী স্বার্থসিদ্ধিও লাভ করা যায়। আগামীর বাংলাদেশে শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে হলে এই ইতিবাচক প্রপঞ্চের রাজনীতিটা বুঝে করতে হবে।
১১.
বস্তুত এদেশের সকল স্কুল-কলেজ-কিণ্ডারগার্টেন-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় – সরকারী বা বেসরকারী, রাষ্ট্র পরিচালিত বা সমাজ পারিচালিত, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক – তার সকলই আমাদের, এবং এখানে যারা পড়ছে তারা এদেশেরই নাগরিক বা ভবিষ্যৎ নাগরিক। সুতরাং সকল ধারার শিক্ষাকে তার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেই মানসম্মত হতে হবে, সেখানে শিক্ষার্থীর জীবন নিরাপদ হতে হবে এবং শিক্ষার পরিবেশ অনক‚ল হতে হবে – এই দাবীতে এক না হয়ে এবং এই ধারাগুলোর প্রবাহ ও বিকাশের সুস্থ ধারাবাহিকতার প্রতি চরম অনাস্থা রেখে শুধু ইতিবাচকতার বোধ দিয়ে শিক্ষায় যা কিছু হস্তক্ষেপ করা হবে তাতে আরো কুফল ফলতে পারে।
পরিশেষে “সভ্যতার সংকট ও শিক্ষার দায়” শিরোনামে যে লেখাটা রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালে লিখেছিলাম তার শেষাংশ দিয়ে প্রস্তাবটা শেষ করছি :
“আধুনিক শিক্ষাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হবে যে, কোনো শিক্ষাদর্শন বা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়, একটা চরম কাক্সিক্ষত প্রতিপাদ্যকে প্রাণকেন্দ্রে রেখে এর সকল আয়োজন সাজানো হয়েছে। এটা হলো – মানুষ জানে এবং মানুষ পারে। আর এই জানা ও পারার বোধ জগৎ জুড়ে সকল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে চারিত করা হয়েছে, এবং যার ফলে এমন একটা বাতাবরণ শিক্ষাজগতে ছড়িয়ে আছে তা হলো, মানুষ সবই জানে বা সবই পারে। বস্তুত শিক্ষার স্নায়ুতে ছড়ানো এই প্রাণস্পন্দন সত্য নয়।
সত্য হচ্ছে মানুষ ইতিমধ্যে যতোটা জেনেছে বা পেরেছে তা দিয়েই বুঝেছে যে, জগতে যতো জানা বা পারা যায় ততোই না-জানা বা না-পারার পরিমাণটা বাড়তে থাকে। কারণ নতুন নতুন জানা বা পারার মাধ্যমে তার সামনে আরো বহুগুণ না-জানা বা না-পারার বিষয়টা উদ্ঘাটিত হতে থাকে। কিন্তু এই বিশাল সত্যের প্রকাশ জগতের কোনো আধুনিক শিক্ষা-আয়োজনের মধ্যে এতটুকু স্পষ্ট তো নয়ই, বরং ঠিক তার উল্টো প্রাণপ্রবাহ চরমভাবে চলমান। ফলে মানুষের সকল শিক্ষা, সকল মান, সকল কলা, সকল বিজ্ঞান, সকল উদ্ভাবনের সামষ্টিক সৃজনফল শেষাবধি দানবীয় এক ঔদ্ধত্য, যার মাধ্যমে পৃথিবী নামক তার একমাত্র বাসোপযোগী গ্রহটাকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ শিক্ষার প্রাণে এমন প্রতিপাদ্য নির্মাণ করলো কেমন করে? সভ্যতার বর্তমান এই ভয়াবহ সংকট, বস্তুত শিক্ষারই সংকট – সে বিবেচনা থেকে প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে মানুষ পারে – এই প্রতিপাদ্যের ঠিক বিপরীত প্রতিপাদ্য ছিল, মানুষ পারে না। বিপরীত এই প্রতিপাদ্যকে প্রাণকেন্দ্রে রেখে অতীতে (বলা যায় রেনেসাঁ-পূর্ব কাল পর্যন্ত) যে শিক্ষা-আয়োজন সাজানো ছিল তার উৎস ছিল মূলত ধর্ম, রীতি, বিশ্বাস ও সংস্কার। মানুষের সমাজকে এই শিক্ষা একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও শেষাবধি এর অবস্থান এমন হয়েছিল যে, মানুষের কোনো পারা বা কোনো জানাটাকেই সে সহজভাবে গ্রহণ করেনি, বরং দীর্ঘকাল ধরে তার প্রতি বর্বরতর আচরণ করেছে।
এভাবে না-পারার শিক্ষা একপর্যায়ে মানুষের জন্য এমন দানবীয় শিকলতুল্য হয়েছে যে, আর সেই শিকল মানুষকে এতো ভুগিয়েছে এতো পিছিয়েছে যে, বহু ত্যাগের বিনিময়ে সেই শিকল যখন সে ছিঁড়েছে তখন ঠিক তার বিপরীত প্রতিপাদ্যে গিয়ে হাজির হয়েছে যে – মানুষ সবই পারে, সবই জানে। মানুষের এ এক নিরন্তর ট্র্যাজেডী! এই উদ্ধত শিক্ষা-প্রতিপাদ্য এবং তার দ্বারা সৃষ্ট বোধ ও নির্মিতিই সভ্যতার সংকটের মূলে।
বস্তুত আমি কিছুই জানি না, কিছুই পারি না – এই বোধ ছিল মানবসত্তার জন্য ভয়াবহরকমভাবে অবমাননাকর। এই বোধ মানুষকে প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের জড়বস্তুতে পরিণত করে। অন্যদিকে আমি সব পারি, সব জানি – এই বোধের মনোস্তাত্তি¡ক পরিণতি শেষাবধি ঔদ্ধত্য এবং এটা অনিবার্য। এই বোধ সত্যও নয়, সার্থকও নয়। প্রকৃতপক্ষে আমি যতো পারি আমার না-পারার পরিমাণ ততো বাড়তে থাকে – এই সত্যবোধই আজ আমাকে সংযত করতে পারে। এটা মনোস্তত্ত্বের বিষয়, শিক্ষামনোস্তত্ত্বের বিষয় – রাজনীতি-অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ-সাম্যবাদের বিষয় নয়। শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রের প্রতিপাদ্য এই মনোস্তত্ত্বের ভিত্তিতে নির্মাণ আজ মানবসভ্যতা রক্ষায় জরুরী।”
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং জুলাই আন্দোলনের সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা।
- ৩১শে আগষ্ট ২০২৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে “জুলাই গণপরিসর” আয়োজিত শিক্ষা সেমিনারে উত্থাপিত ও পঠিত।