রাষ্ট্রচিন্তার আয়োজনে ‘করোনাকালের কৃষি ও ত্রাণ : সংকট ও পরিত্রাণ’ শীর্ষক ভিডিও কনফারেন্স

গত ২০/০৪/২০২০ তারিখে রাষ্ট্রচিন্তার আয়োজনে ‘করোনাকালের কৃষি ও ত্রাণ : সংকট ও পরিত্রাণ’ শীর্ষক ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ত্রাণ ও দুর্গত মানুষ রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম পরিচালনা করা ব্যক্তিবর্গ, দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী ও সাংবাদিক।

আলোচকবৃন্দ করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতিতে উপদ্রুত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা, সরকারের ব্যবস্থাপনাগত সংকট ও আসন্ন বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে কৃষিখাতে জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জোর তাগিদ জানান।

আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও করোনাদুর্গত সহযোগিতা কেন্দ্রের আহবায়ক অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও কাজী জাহেদ ইকবাল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা এবং হাওরাঞ্চলের সাংবাদিক নাসরুল আনোয়ার। রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন হাসনাত কাইয়ূম।

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং মোশাহিদা সুলতানা ঋতু কথা বলেছেন ত্রাণ সহায়তা বিষয়ে।

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

১. আমরা কেনো ত্রাণ-কাজ শুরু করলাম এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই শুরু করি। আমরা অতীতেও কাজ করেছি, সিডর, বন্যার সময়। তখন আমি লেকচারার ছিলাম, ছাত্রদের নিয়ে কাজ করেছি, সেই ছাত্ররাই এখনো যুক্ত আছেন। যদিও তারা আর এখন ছাত্র নেই, তারা এখন বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে আছেন। তাতে একটা সুবিধা হয়েছে। বিভিন্ন পেশার লোকজন আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন, আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, এমনকি শ্রমজীবী মানুষও আমাদের সাথে যুক্ত আছেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও এই পরিস্থিতি কিন্তু সাইক্লোন বা বন্যার মতো নয়।

২. আমি মোটা দাগে এই দুর্যোগের চারটা ঝুঁকি চিহ্নিত করি: ১) রোগ সংক্রমণ, মৃত্যু ২) অনাহার ও দূর্ভিক্ষ ৩) অর্থনৈতিক মন্দা ৪) সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতা।

৩. যদিও দায়িত্বটা সরকারের, কিন্তু আমরা আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি আমাদের সরকারেরগুলো জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। দলগুলো যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তখন দলীয় সম্পৃক্ততার বাইরে, নিজের সমর্থকদের সম্পৃক্ততার বাইরে আর কোনো সম্পৃক্ততা তৈরি হয় না। দলগুলো তার নিজের দলের সমর্থকদেরই মনে করে পুরো বাংলাদেশ। এই জনবিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের নিজেদের এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। এই ভাবনা থেকেই করোনাদুর্গত সহায়তা কেন্দ্র কাজ শুরু করে।

৪. বন্যা বা পূর্বের অন্যান্য দুর্যোগের সাথে এবারের সবচেয়ে বড়ো অমিল হচ্ছে এবার ফিজিক্যালি মুভ করার সুযোগ কম। আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যারা তৃণমূল পর্যায়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করছেন তাদের সহায়ক শক্তি হওয়া। আরেকটি দিক হচ্ছে এখানে যেহেতু অনেক ধরণের পেশাজীবী জড়িত আছেন, ফলে চিন্তার একটা বৈচিত্র্য রয়েছে। এই যে সংকটের ধরণ সেটার যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে একে মোকাবিলা করার জন্য চিন্তার বৈচিত্র্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো জরুরি।

৫. এটা করতে গিয়ে প্রথমে আমাদের দরকার হয় অর্থ সংগ্রহ করা। করতে গিয়ে চারপাশের মানুষদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, অনলাইনে, ওয়েবসাইটে, সোশিয়াল মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রচারণার মাধ্যমে চাঁদা সংগ্রহ করেছি। কেবল অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণ নয়, আমরা একটা নতুন ভাবনাও যুক্ত করার চেষ্টা করেছি: একটা মেডিকেল টিম যুক্তি করেছি। যারা করোনায় আক্রান্ত হন নি, কিন্তু বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তাদেরকে অনলাইনে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমাদের গণ্ডির মানুষজনের বাইরে প্রবাসীরাও ব্যাপক সাহায্য করছেন; প্রবাসীরা আমরা দেখেছি রানা প্লাজার ঘটনার সময়ও সাহায্য করেছেন। প্রবাসে আমাদের যে সকল বন্ধুরা রয়েছেন তারাই আসলে আমাদের বড়ো শক্তি।

৬. অর্থ সংগ্রহের দিকে এখন একটা বিপদ শুরু হয়েছে, যেহেতু এটা দীর্ঘমেয়াদি সংকট। শুরুর দিকে মধ্যবিত্ত এগিয়ে এসেছিল, এখন মধ্যবিত্তই চাপের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ফলে এখন আর আগের মতো অর্থ সহযোগীতা আসছে না।

৭. অন্যদিকে প্রচারণার কারণে মানুষ যেহেতু আমাদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে, সেহেতু তাদের মনে আমাদের মধ্যে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে, প্রচুর ফোন-কল পাচ্ছি। সকাল থেকে আমিই প্রায় ৩০-৪০টা কল পেয়েছি। একে তো তাদের খাবারের সংকট, অন্যদিকে তাদের হাতে নগদ অর্থ নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো মানুষের পক্ষে না, ফলে এখানে মানুষ অনেকবেশি ওষুধের উপর নির্ভরশীল, ফলে তার নগদ অর্থ দরকার। তারা যখন যোগাযোগ করছে, তখন নগদ অর্থ চাচ্ছে মূলত।

৮. আমাদের সাথে যখন যোগাযোগ করা হচ্ছে, তখন আমরা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সরকারী সাহায্য পাওয়াটা আপনার অধিকার। এটা আপনার করের টাকাই। তাদেরকে উৎসাহিত করছি সরকারী উৎস থেকে সাহায্য নেয়ার জন্যে, সরকারী উৎসগুলোর সাথে আগে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তারা খুব একটা পজিটিভ রেসপন্স পাচ্ছেন না। একজন বলছেন যে, ভাই কেন আমাদের দিয়ে ৩৩৩-এ ফোন দেওয়ান, ফোন দিয়ে সাহায্য চেয়েছি বলে চেয়ারম্যানের মাস্তানরা এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছে।

আমরা চেষ্টা করছি মানুষের মধ্যে ঐ বোধ তৈরি করার, ত্রাণ আসলে আমাদের সবার অধিকার, যারাই দুর্গত। সেদিক থেকে প্রথমেই তাদেরকে ৩৩৩ ফোন দিতে বলি। কিন্তু যখন ঐদিক থেকে কোনো সাহায্য না পান, তখন আমাদের সাথে আবার যোগাযোগ করেন, তখন চেষ্টা করি আমরা আমাদের তরফ থেকে।

৯. আমরা বিভিন্নজনের আলাপ-আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে পেয়েছি তা হচ্ছে, ত্রাণ বিতরণ পুরোপুরি দলীয় দখলদারিত্বের মধ্যে আটকে আছে। দলীয় ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, যারা দলের সমর্থক না, বা দলের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তারা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একটা ফোন পেলাম যশোরের এক উপজেলা থেকে, সেখানকার চেয়ারম্যান বিএনপি সমর্থক হওয়ার ফলে ত্রাণ পৌছাচ্ছে না ঠিক মতো। ত্রান আসলেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলটা নন-পার্টিজান হওয়া উচিৎ। এটা খুব বড়ো ধরনের সংকট। ত্রান চুরিতো আছেই।

১০. আমাদের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব করছি, যদি রাষ্ট্র শুনতে চায়। আমরা যা করছি, সেটা আসলে সমুদ্রের ন্যায় এক ফোটা জলও না। আমরা একটা মানসিক স্বস্থি হয়তোবা পাচ্ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব হচ্ছে মূলত সরকারের, রাষ্ট্রের। আমাদের যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তা দিয়ে সরকারকে সাপোর্টটা দেয়াও আমাদের দরকার। সেই ক্ষেত্রে মনে করি যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের নিয়ে একটা রিলিফ ওয়াচ গ্রুপ করা। ত্রান চুরি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংবাদ করলে দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এটা সংকটকে আরো বাড়িয়ে দেয়। যদি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রিলিফ ওয়াচ গ্রুপ তৈরি করা যায় তাহলে এই ব্যবস্থাপনাকে একটু সহজ করে তোলা যাবে বলে মনে করি।

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু

১. সচরাচর দুর্যোগগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় এককালীন ত্রান, বাড়ি নির্মাণ, কর্মসংস্থান তৈরি ইত্যাদির মাধ্যমে সংকটকে কাটিয়ে উঠা যায়। এখন কিন্তু এরকম না, এখন মানুষ কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে। আগে আমরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আইডিন্টাইফাই করতে পারতাম, কিন্তু এখন নতুন করে দরিদ্র যোগ হচ্ছে, নিম্নবিত্ত, এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত এই সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে পড়ছে। সাহায্য না দিলে তারা বেঁচে থাকতে পারছে না, বেঁচে থাকা মানে কিন্তু কেবল খাদ্য নিরাপত্তা না।

২. ত্রান সহায়তা দেয়ার জন্য কোন ইউনিভার্সাল রুল নেই। একেক সময় একেক পরিস্থিতিতে ত্রান কতটুকু দেয়া হবে তা নির্ণয় করা হয়। এখানে সমস্যা অনেক, ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে শনাক্তকরণ বা টেস্ট বেশি করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার লকডাউনে যেতে হবে, লকডাউনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সংক্রমণ কমাতে হবে বা রোধ করতে হবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষকে যদি খাবারের নিরাপত্তা না দিতে পারি তাহলে লকডাউন কার্যকর হবে না। লকডাউন কার্যক্রর করতে হলে আসলে আমাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে ত্রান সহায়তা দিতে হবে। এই যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইন্ডিভিজুয়াল ফান্ড এগুলো দিয়ে আসলে হবে, আমাদেরকে সরকারকে চাপ দিতেই হবে।

৩. এখন নানান ধরনের কথা উঠছে। ত্রান দেয়া নিয়ে প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়েছে: কতদিন দেব, কতজনকে দেব, কতটুকু দেব। অনেক কথাই হচ্ছে গ্লোবালি কত পার্সেন্ট ক্ষতি হবে, কেউ বলছেন ৭%, কেউ বলছেন ১০% ক্ষতি হবে। কিন্তু কেউ আসলেই কনফিডেন্টলি বলতে পারছেন না কি পরিমাণ ক্ষতি হবে। ধরে নেই আমাদের এখানে ১০% ক্ষতি হয়, তাহলে আমাদের প্রতিদিন লস হয় ৭শত কোটি টাকা। আমি বলতে চাচ্ছি, আমি যদি এই ৭শত কোটি টাকার নিচে ত্রান দিয়ে মানুষকে বাচিয়ে রাখতে পারি এবং লকডাউনকে কার্যকরী করতে পারি তাহলে সেটা এফেক্টিভ হবে। যত দ্রুত ইফেক্টিভ হবে, তত দ্রুত আসলে আমরা লকডাউন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারব। উদ্দেশ্য থাকবে, লকডাউন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিথিল করা।

৪. অনেকেই বলাবলি করছেন হার্ড-ইমিউনিটির কথা, কিন্তু আমরা এখন আর পিছনে ফিরে যেতে পারবো না। আমরা দেখেছি অনেকগুলো দেশ লকডাউন শিথিল করার পর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। আর আমাদের যেখানে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে সেখানে আমরা আসলে বেশি দূর যেতে পারব না। ফলে আমাদের লকডাউনেই রাখতে হবে, এবং ত্রানের মাধ্যমেই লকডাউনকে কার্যকর করতে হবে। আর, টেস্টতো অবশ্যই বাড়াতে হবে।

৫. আমরা একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম, দশ হাজার টাকা করে প্রতি পরিবারকে যদি আমরা দেই, এককোটি বা দেড় কোটি পরিবারকে দিয়ে দেখা যায় যে, আমরা প্রতিদিন সাত শ কোটির নিচে দিয়ে লকডাউনের দিনের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারব। এবং দ্রুত অর্থনৈতিক কাজ শুরু করতে পারব।

৬. এখন প্রশ্ন হচ্ছে কত খাদ্য বা কত ত্রান সহায়তা আমরা দিতে পারব? সিপিডির সুপারিশ মতে, ৮ হাজার টাকা মিনিমাম মজুরি ধরে, তারা বলছে যে এই হিসাব করে টাকা দিলে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারবে। আমরা যদি দুই মাস ধরে ১ কোটি ৭০ লক্ষ বা ১ কোটি ৯০ লক্ষ পরিবারকে দেই মোট ২৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা লাগবে। এটাতে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আওয়তাভুক্ত করা যাবে। এটা আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই রিজনেবল।

৭. ব্র্যাকের আরেকটা স্টাডিতে তারা অন্যভাবে করেছে। প্রথমে তারা দেখছে মানুষের যে খাদ্য কনজামশন তা কতখানি কমে গেছে। তারা দেখাচ্ছে যে রুরাল এলাকায় ৪০-৩০% কমে আসছে ইতোমধ্যে। তাদেরকে ইমিডিয়েটলি সহায়তা দিতে হবে। এখান থেকে তারা বলছে যে, ৪ কোটি মানুষকে সহায়তা দিতে। প্রতিটা মানুষের জন্য মাসে ১৭০০ টাকা (শহর এলাকায়), এবং ১৩৬৮ টাকা (গ্রামীন এলাকায়) দিতে হবে। তারা বলছে যে ৪ কোটি মানুষকে দিতে হবে। এখন যদি একটা পরিবারে আমরা চারজন করে সদস্য ধরি তাহলে এক কোটি পরিবার হয়।

৮. এখন আমরা নাগরিক হিসেবে প্রস্তাব করেছি পরিবার প্রতি দশ হাজার টাকা দেয়ার জন্য। আমরা বলেছি যে, খাদ্য সামগ্রীর জন্য থাকবে পাঁচ হাজার টাকা এবং, বাকী পাঁচ হাজার টাকা অন্যান্য জিনিসের জন্য যেমন ঔষধপত্র। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, কেবল খাদ্য নিরাপত্তায় হবে না, মানুষকে যদি লকডাউনে ঘরে রাখতে চান তাহলে তাকে আরো কিছু দিতে হবে।

৯. আপনি কেরালা মডেলের দিকে তাকান, সেখানে খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে প্রায় ১৭ ধরণের আইটেম দিচ্ছে, ফলে মানুষের আর বের হওয়া লাগছে। এসব করার মাধ্যমে সে আসলে মানুষকে সিগনাল দিচ্ছে যে, দেখো আমি সিরিয়াস। সরকারের তরফ থেকে সিরিয়াসনেসের সিগনাল না পেলে জনগণ সিরিয়াস হবে না।

১০. আমাদের এখানে যে ত্রান বা সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে সেটা অপ্রতুল। সাথে রয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ, সিস্টেম লস, চুরি। আমরা দেখছি মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। এখন আপনি যখন অল্প পরিমাণ ত্রান দিবেন, কেউ পাবে কেউ পাবে না, তখনই এমন অবস্থা তৈরি হবে; সে রাস্তায় বের হবে, ক্ষোভ প্রকাশ করবে। যতদিন পর্যন্ত যথেষ্ট বা ন্যুনতম বাঁচার খরচ সরকার তাকে দিতে পারবে না ততদিন তাকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না, লকডাউন সফল হবে না।

১১. এখন, অভিযোগগুলো কীভাবে এড্রেস করব? একটা হচ্ছে মাইকিং, মেসেজ করে তাদেরকে জানানো। এবং, ওয়েবসাইটে তালিকা দিয়ে দিতে হবে, ফলে একধরণের স্বচ্ছতা আসবে।

. কাজী জাহেদ ইকবাল জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কথা বলেছেন সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ নির্মূল) আইন, ২০১৮ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ আইন বিষয়ে

কাজী জাহে ইকবাল

১. সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ নির্মূল) আইন, ২০১৮ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২, এই দুটো আইনই বর্তমান পরিস্থিতির সাথে অধিকতর সম্পৃক্ত। আরো অনেকগুলো ঘটনার কারণে অন্যান্য আইনও যুক্ত হচ্ছে।

২. প্রথম কথা হচ্ছে, আমার বেঁচে থাকার জায়গা হচ্ছে সাংবিধানিক অধিকার। আমরা যে রাষ্ট্র বানিয়েছি, তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা রাষ্ট্রের মধ্য কিছু নিরাপত্তা চাই, তা মহামারি হোক, আর অন্য কোনো দুর্যোগই হোক। নিরাপত্তাটাই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার জায়গাটিতে বর্তমানে যে বিষয়টি চলে এসেছে তা হচ্ছে খাদ্য ও চিকিৎসার প্রশ্ন। এগুলো আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। বলা হয়েছিল যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য বা গোল হবে এইসব লক্ষ্যে পৌঁছানো। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর দেখা যাচ্ছে, আমরা এই লক্ষ্যসমূহে পৌঁছাতে পারিনি, মহামারির সময় আমাদের খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা লাগছে। পার্ট টু ব্যবহারকে ঘিরে যে মিথটা তা খানিক ভেঙ্গেছে আমরা জানি।

৩. ১৮৬০ সালের পেনাল কোডেই সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি এটা কেউ ছড়ান বা এমন কিছু করেন তাহলে তার ছয় মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে। মানে ধারণাটা এই সমাজে ছিল উনিশ শতক থেকেই।

৪. এরপর ২০১৮ সালে একটা আইন করলাম, আমি বলতে চাই আইনটি ভালোই। ভালো এই জন্য যে, যদি স্বদিচ্ছা সহযোগে সমাজের কল্যানের দিকে তাকিয়ে প্রয়োগ করা হয় তাহলে এতে খুব একটা অসুবিধার কিছু নেই। আমাদের অসুবিধার জায়গাটা মূলত আইনে নয়, আইনের প্রয়োগে। যেমন এই আইন অনুসারে, লকডাউন আরোপ করার ক্ষমতা সেকশন ১১ অনুযায়ী রাষ্ট্র বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আছে। কিন্তু প্রয়োগের বেলায় দেখছি মোবাইল কোর্ট কান ধরে উঠবস করাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রয়োগকারীর অসততার ফলেই এটা ঘটছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া দরকার। আবার সাধারণ মানুষের মধ্যেও আইনভঙ্গের একটা প্রবণতা দেখা দেয়। এটা নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের।

৫. অন্য আইনটি হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, এই পরিস্থিতিতে এটি আসলেই মূল আইন। এই আইনে কিন্তু স্পষ্টভাবে জাতীয় কমিটির কথা বলা আছে। তানজীম উদ্দিন যে ওয়াচ কমিটির কথা বলছেন তার বিধান এই আইনেই আছে। এখন মাঠ পর্যায়ে যে অসুবিধাগুলোর কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে এই
এই আইন যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিৎ।

৬. মাঠ পর্যায়ে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, যেমন, ত্রানচুরির অভিযোগ আসছে, বিতরনের দুর্বলতার কথা আসছে, এগুলো কিন্তু অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, দুর্নীতির পর্যায়ে। তখন অন্যান্য আইনও সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। কিছুটা শাস্তির খবর আমরা শুনেছি, কিন্তু সেটা তো প্রশাসনিক সাজা। কিন্তু সে তো করেছে ক্রিমিনাল অফেন্স। ক্রিমিনাল আইন অনুযায়ী এর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

৭. আরেকটা সাবধানতার বিষয় আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির লক্ষণ দেখা দিতে পারে, চুরি-ডাকাতি বাড়তে পারে। এই বিষয়ে কমিউনিটি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক থাকা উচিৎ।

সঞ্চালক: যে আইনটা সর্বশেষ আলোচনা করলেন তার ৫৭ ধারায় বলা আছে যে, এই আইনটা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে, ২০১২ থেকে কার্যকর। দুর্যোগ কাকে বলবে, ত্রান কাকে বলবে, কে দায়িত্ব পালন করবে, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে কি শাস্তি হবে তা সব বলা আছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি যে বললেন আইনের প্রয়োগ হয় না, আমাদের কি এখন ভাবতে হবে যে, সরকার বলতে আমি যদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝি, সরকার বলতে যদি আমি দুর্যোগ ও ত্রান অধিদপ্তর বুঝি , তাদের যদি কোনো ধরণের অবহেলা দেখা দেয় তার বিরুদ্ধে কি ধরণের ব্যবস্থা হবে সেটা যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আমাদের দেশের আইনগুলোর উপর যুক্ত করতে না পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এটাকে কি কোনো ড্রাইভিং জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন কি না? আপনি তো প্রয়োগের সমস্যার কথা বললেন, এখন প্রয়োগ তো হয় যারা প্রয়োগ করবেন তাদের ইচ্ছায়, এখন তারা যদি প্রয়োগ করার ইচ্ছা না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের কোনো উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ আছে কি?

৮. আমি খুবই স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ২০১৮ সালের আইনে বলা আছে এখানে ফৌজদারী কার্যবিধি প্রয়োগের সুযোগ আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনেও আছে। যাদের চোখে অনিয়ম ধরা পড়ছে, বা কোনো ভুক্তভোগী নিশ্চিতভাবেই বাদী হতে পারবেন, বিশেষ করে ক্রিমিনাল অফেন্স হলে অন্যান্য আইনের মাধ্যমেও করতে পারবেন।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

১. আমরা বারেবার যে দুটো আইন বিষয়ে কথা বলছি তাকে নাঈম ভাই যেভাবে বলেছেন জনবিরোধী তাতে আমি একমত। এখানে আমাদের এক এপিডেমিক ডিজিজের এক্ট ছিল ১৮৯৭ সনের, সেটাকে বাতিল করে ২০১৮ সালে এই নতুন আইনটি করা। আগেরটা বাতিল করে নতুন এক্টে যে অর্জন তা হচ্ছে মূলত নতুন নতুন রোগকে অন্তর্ভুক্ত করার পথ খোলা রাখা। যদিও বাংলাদেশে ৮ই মার্চ প্রথম এই ধরণের রোগীর কথা আমরা জানতে পারি, কিন্তু এর আরো অনেকদিন পরও আমরা এর স্বীকৃতি দিতে পারি নি। একজন আইনজীবীর পক্ষ থেকে মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় এটি গেজেট নথিভুক্ত করা হয়। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন এগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের এখতিয়ারের মধ্যে রাখা হয়েছে। সরকারের জাতীয় কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি এগুলো দেখে অনেক হাই পাওয়ার্ড মনে হলেও এর কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

২. সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে WHO যে নির্দেশনা দিবে সেটা ফলো করতে হবে, এটি একটা ইতিবাচক দিক। এই আইনের তিনটা কাজ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল। এই তিনটা কাজের জন্য নিশ্চয়ই সরকারি, মানে জনগণের অনেক অর্থ ব্যয় হবে। তো, সেখানে ২৩ নং ধারাতে একটা মজার কথা বলা আছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো যানবাহন, স্থান বা স্থাপনা জীবাণুমুক্তকরণের জন্য ব্যয়িত সরকারি অর্থ, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, ফেরত গ্রহণ করিতে পারিবে।’
তার মানে হচ্ছে, জনগণের জন্য জনগণের টাকা খরচ করে এটা আবার জনগণের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে আদায় করতে পারবে।

৩. লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এই তিন জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস মিসিং। সেটা ২০১২ সালের আইন দিয়ে কিছুটা হলেও হয়তোবা পূরণ করা যেতে পারে। আপনি যখন লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন করছেন তখন মানুষের আচরণ কেমন হবে, তারা কোন ধরণের সাহায্য পাবে এই সংক্রান্ত কিছুই এই আইনে নেই। তাহলে যে জটিলতাগুলো তৈরি হচ্ছে, অনেকেই দৈনন্দিন জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রের সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তারা জানেন না, সাহায্যের জন্য কই যেতে হবে। আমরা সেটা জানি।

৪. আমরা গার্মেন্টেসের প্রণোদনার কথা শুনছি। মার্চের ২৩/২৪ তারিখ পর্যন্ত গার্মেন্টস খোলা ছিল, শ্রমিকরা কাজ করেছেন, তাহলে মার্চ মাসের বেতন সরকারকে কেন দিতে হবে? কর্মী ছাটাই চলছে, তাহলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা গেলো কোথায়? এইসব প্রশ্ন তোলায় একজন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

৫. এখানে শ্রমিকের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু এর বাইরে যে কেউই, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত যাই হোক না কেন, করোনা মোকাবিলার জন্য লকডাউনের সময় কি কি সহযোগিতা পাবে তা ২০১৮ আইনে কিছুই বলা নেই। ৬. ন্যাশনাল এ্যাকশন টিম বলে যা দেখছি সেখানেও কোনো কো-অর্ডিনেশন আছে বলে মনে হয় না। আমরা পত্রিকায় দেখেছি, কিছু কমিটি করা হয়েছে, যোগাযোগের জন্য ফোন নাম্বারও দেয়া হয়েছে।

৭. এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের দিকে যদি তাকাই, সেখানে ২ নং ধারার ১১ (ই) তে বলা হয়েছে, যদি কোনো মহামারি রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা হওয়া দরকার। ফলে এই ব্যাখ্যা পাচ্ছি যে, এরকম মহামারিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের অধীন। এখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল আছে যার প্রধান হিসেবে থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরেও অনেকগুলো হাই-পাওয়ার্ড মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু দুর্যোগ ঘোষণার আজ ২০-২৫ দিন হয়ে গেলেও এই কমিটি কি করলেন তার কোনো খবরাখবর কোথাও পেলাম না।

৮. এছাড়াও, ত্রান বিতরণে কীভাবে বিভিন্ন বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করবে সে বিষয়েও আইনে উল্লেখ আছে। লকডাউনের সময় ব্যবস্থাপনাগুলো কি হবে তা ২০১৮ সালের আইনে না থাকলেও ২০১২ সালের আইনের ধারা ২৭ -এ পরিষ্কারভাবে বলা আছে। ধারাটা একটু পড়ে শোনাচ্ছি:

২৭। (১) সরকার, বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে, দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য বা ঝুকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবে :

তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে অতিদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষতঃ বয়োবৃদ্ধ, মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা ও ঝুঁকিহ্রাসকে অগ্রাধিকার প্রদান করিতে হইবে।


(২) দুর্যোগ মোকাবেলায় জরুরি সাড়া প্রদান বা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা, কর্মচারী বা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন হইলে, তাহাদের উপযুক্ত পুনর্বাসন বা ঝুকিঁ হ্রাসের জন্য সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবে।


[ব্যাখ্যাঃ এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী অর্থে আর্থ-সামাজিক ও নানাবিধ সুবিধা হইতে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, উপ-জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হইবে]

[বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায়  জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আলাপ শেষ করতে পারেন নি।]

গওহার নঈম ওয়ারা এবং নাসরুল আনোয়ার কথা বলেছেন মূলত কৃষি, ধান, হাওর ও কৃষি-শ্রমিক বিষয়ে।  

গওহার নঈম ওয়ারা

১. আমরা যে আইনের কথা বলছিলাম এটা আসলে খুব জনবিরোধী একটা আইন। উপরের মহলকে দায়মুক্তি ও সাধারণ মানুষকে ক্রিমিনালাইজ করার সকল উপায় এতে রয়েছে। এও বলা হয়েছে, যদি কোনো মানুষ সরকারী কর্মকর্তাকে অপমান করে অথবা অপমান করার চেষ্টা করে তাহলে তার দুই লক্ষ টাকা জরিমানা ও দুই বৎসর জেল হতে পারে। এখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের কথাই বলা হচ্ছে। এই আইন নিয়ে কথা বলার সময় আসছে।

২. আমরা কিছু ভুল এসাম্পশনে কাজ করছি। বাংলাদেশ বহুদিন লম্বা লম্বা হরতাল-বন্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু এইবার প্রথমবারের মতো প্রথম দিন থেকে আমাদের মনে হয়েছিল মানুষকে রিলিফ দিতে হবে। ফলে আমরা চাল-ডাল দেয়া শুরু করলাম, এখন আমরা বলছি মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। আমরা যে আইনের কথা বলছি সেখানে জাতীয় কমিটির কথা বলা হয়েছে। এর কি খবর আমরা জানি না। পৃথিবীর ইতিহাসের নজিরবিহীন এই মহামারির সময়ে আমরা মনে করছি, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের সরকার মনে করছে, এখন জাতীয় কমিটির ঘটনের দাবি করা যাবে না। এইটা একটা ভুল এসাম্পশন।

৩. দ্বিতীয় এসাম্পশন হচ্ছে, শুরু থেকেই বলে দিলাম কিস্তি নেয়া যাবে না, মানুষের উপর অত্যাচার করা যাবে না। কিস্তি নেয়া বন্ধ করা মানে ঋণের ‍কিস্তি দেয়াও বন্ধ করা হয়ে গেছে। ধান কাটার জন্য তার অনেক টাকা লাগে; আমাদের পুরো রোরাল ইকনোমি আছে ঋণের উপর নির্ভর করে। কৃষক এখন আরো উচ্চ হারে ঋণ নিচ্ছে। এই বাস্তবতাগুলো আমরা আলোচনায় আনছি না।

৪. আমাদের লকডাউন মানতে হবে, ঠিক। কিন্তু সুনামগঞ্জের ডিসি লকডাউন উইথ্রড্রো করেছেন, কারণ কামারের দোকান খোলা রাখতে, না হলে কাস্তে-বটি বানাতে পারবে না। শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করতে হবে। আরো দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি হাওরের ধান তুলতে না পারা যায়, তাহলে টোটাল খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। কেউ সাহায্য করবে না। প্রতিটি দানা এখন আমাদের দরকার। সামনে আমাদের বড়ো কাজ হচ্ছে হাওরের ধানটাকে সম্পূর্ণভাবে হার্ভেস্ট করা। গত তিনদিনে সাতজন মানুষ মারা গিয়েছেন বজ্রপাতে। গার্মেণ্টে যে পরিমাণ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে তার মাত্র ১% দিয়েই পুরো হাওর এলাকাকে বজ্রপাত নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। তা কেনো করা হচ্ছে না?

৫. এখন কিভাবে এদের কাছে পৌঁছাতে পারি? মওলানা ভাসানী যেমন করে বলতেন, খোরাকি ঋণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আগে যে ওল্ড রেশন ব্যবস্থা ছিল সেটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি, নতুন কোন ব্যবস্থা গড়ে তুলি নাই। কিন্তু যদি আমরা খোরাকি ঋণের ব্যবস্থা করি, দুই/তিন বছরের মধ্যে মানুষ শোধ দিবে, পাকিস্তান যেটা করেছে, ১২ হাজার টাকা করে ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারবে। আমাদের সকলের আইডি কার্ড আছে, ইলেক্ট্রোনিকালি সহজেই ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব, কিন্তু আমরা কেনো সেখানে যাচ্ছি না? অবশ্য সকলের আইডি কার্ড আছে এটাও একটা ভুল ধারণা। পাহাড়েও অনেকের কার্ড নেই, সমতলেও অনেকের নেই। এদের দিকে আমাদের ফোকাস করতে হবে।

৬. আমাদের দেশে তো অনেকেই তো ক্ষুদ্র ঋণ দেয়, বন্যা বা এমন কিছুর পরে সুদমুক্ত ঋণ চালু করে, এবার কেনো এরা দিচ্ছে না। তাদের কাছে তো অনেক টাকা রয়েছে।

৭. আমাদের মনে রাখতে হবে, লকডাউনের পর যখন স্কুলগুলো খুলবে তখন আমাদের অনেক আচার-আচরণে চেঞ্জ আসবে। আমরা কি এইসব নিয়ে কাজ করা শুরু করছি? ভাবছি? যেসব উপজেলায় এখনো করোনা নেই সেগুলো কেনো গ্রিনজোন ঘোষণা করে কাজ করা শুরু করা হচ্ছে না? আমরা যদি অর্থনীতি চাঙ্গা না করতে পারি, তাহলে টাকা পাম্পিং করে কোনো লাভ হবে না। কিছু কিছু প্রয়োজনীয় দোকানপাট সপ্তাহে একদিন দুইদিন খোলা রাখতে হবে।

৮. পশ্চিম বাংলা থেকে আতঙ্কের সংবাদ আসছে। প্রচুর লোকের লক্ষণ নেই, কিন্তু করোনায় আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের ধরে নিতে আমরা সকলেই ভাইরাস নিয়ে ঘুরছি।

নাসরুল আনোয়ার

১. হাওরের প্রায় বত্রিশ ভাগ ধান হাইব্রিড বা আগাম বি ২৮, কৃষকদের উদ্যোগে এগুলো কাটা হয়ে যাচ্ছে একরকম। সংকট হচ্ছে বি ২৯ নিয়ে, এটা প্রায় ৭০ ভাগ। এটা অর্ধেকের মতো ইতোমধ্যেই পেকে গেছে। যদি শ্রমিক পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে এখনি এটা কাটা উচিৎ।

২. আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেরী হলে নেতিবাচক ঘটনাই ঘটবে, ভয়ঙ্কর অবস্থা দাঁড়াবে।

৩. এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে শ্রমিক পাঠাতে হবে; শ্রমিক পাঠানো শুরুও হয়েছে।জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কিছু তালিকাও দেয়া হয়েছে। আজকে পর্যন্ত পাঁচ হাজার কিশোরগঞ্জে শ্রমিক আসছেন। এছাড়া, আরো এক হাজার শ্রমিকের ব্যবস্থার কথা হচ্ছে, যারা চট্টগ্রাম থেকে হাওরে আসবেন। গতকালও এসেছেন, আজকেও চারশ/পাচশ শ্রমিক নিয়ে কয়েকটা বাস এসেছে। বাদ বাকীরা আগামীকাল আসবে। তারা হাওরের দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই যে চার/পাঁচ/ ছয় হাজার শ্রমিক দিয়ে ৯ লক্ষ ৩৬ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে, এটা অপ্রতুল। এর জন্য সেন্ট্রালি আরো ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া দরকার।

৪. আজকে প্রধানমন্ত্রীর কনফারেন্সের মাধ্যমে এগুলো আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মূল জায়গায় ফোকাস করা হয় নি। কৃষক যেন ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়, সে বিষয়ে এখনো কোনো কর্মসূচি শোনা যায় নি। হাওর থেকে কিছু ফসল বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে, কিন্তু পরিবহন সংকট বা অন্যান্য কারণে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।

৫. সুনামগঞ্জের থেকে খবর পেয়েছি যে, কিছু হার্ভেস্টার সেখানে গিয়েছে। কিন্তু এই রিপার বা হার্ভেস্টারগুলো এতো হেভি যে হাওরের খুব একটা নিচে নামার সুযোগ নেই। আবার খুব একটা চালকও পাওয়া যাচ্ছে না। যেভাবে বলা হচ্ছিল সেটা কাজ করতে পারবে আসলে তা হচ্ছে না।

৬. শ্রমিকদের আনার ক্ষেত্রে আরো ব্যপক উদ্যোগ নিতে হবে, এছাড়া আসলে আর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি হাওরের বন্ধ যে স্কুলগুলো আছে সেগুলোতে শ্রমিকদের জন্য আশ্রম তৈরি করা হোক। এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টাও মাথায় রাখা দরকার। এটা সবেমাত্র আজকের আলোচনা এখনো দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।

৭. বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন নেতা বা চেয়ারম্যানের কথাও শোনা যাচ্ছে যারা মাঠে যাচ্ছেন, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে যারা ঢাকা থেকে ফিরে এসেছেন বা কর্মহীনভাবে আছেন তাদেরকে যেভাবে ইনভলভ করা দরকার ছিল, সেরকম কোনো আয়োজন বা উদ্যোগ এখনো নেয়া হচ্ছে না।

৮. আরেকটা প্রস্তাব হচ্ছে, শ্রমিক যারা যাবেন, স্থানীয়দের সাথে তাদের মেলামেশাকে কিভাবে রোধ করা যায় তা নিয়ে ভাবা দরকার। হতে পারে মাথায় কোনো কাপড় বেঁধে দেয়া, গাউন পরিয়ে দেয়া এমন অনেক কিছুই করে আলাদা করে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

সবশেষে রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয় যে, এই কনফারেন্সে আলোচকবৃন্দ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছেন ও প্রস্তাব রেখেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো সেগুলো বিচার-বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *