করোনার শিক্ষা: প্রয়োজন নতুন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও ওষুধনীতির পুনর্গঠন।

  • লেখক: হাবিবুর রহমান

১. ভূমিকা:

কোভিড-১৯ বিশ্বমারী (pandemic) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বল ব্যবস্থা খুব নির্মমভাবে প্রকাশ করেছে। উদোম হয়েছে অনেক রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে মানুষকে হত্যার জন্য বিশ্ব যতটা প্রস্তুত মানুষকে রক্ষার জন্য ততটা নয়। রাষ্ট্রগুলো মানুষ মারতে অস্ত্র উদ্ভাবন, তৈরি ও ক্রয়ে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। অথচ এই রাষ্ট্রগুলো মানুষ রক্ষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের পিছনে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে কম থাকে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও যে খুব একটা কাজে আসে না সেটা প্রমাণ করেছে SARS-COV-2 ভাইরাস। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রসহ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ আজ পর্যদুস্ত এই একটি অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের কাছে। ২৩ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত ২১০টি রাষ্ট্র ও অঞ্চলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নিশ্চিত খবর পাওয়া গেছে। মোট সংক্রমণ ২৬,৫৬,৬২২ জন, সুস্থ হয়েছেন ৭,২৯,৮৭৩ জন এবং মৃত্যু ১,২৮,০৭১ জন। (source – Worldometer)

বর্তমানে বিশ্বের মানুষের কাছে একটি অতি ক্ষুদ্র অণুজীব থেকে আত্মরক্ষা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাইরাস আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলো মহামারী ঠেকাতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। ১. রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ আরোপের মাধ্যমে মানুষকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা, ঘরবন্দী করা। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সাধারণ চিত্র হল, যেকোনো ধরনের জন সমাগম বন্ধ করা, নাগরিকদের শারীরিক দুরুত্ব মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা, সন্দেহভাজনদের সঙ্গনিরোধ এবং শনাক্তদের সুস্থ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এর সর্বোচ্চ রূপ হল লকডাউন- উপদ্রুব অঞ্চল এবং গোটা দেশ।  ২. রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ নয়, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জনগণের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর আস্থা রাখা। স্বাভাবিক জীবনযাপন অক্ষুন্ন রাখা। মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা এ ধরনের পদক্ষেপের একটা লক্ষ্য। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় ধরন নিয়ে মতামত দেয়া সম্ভব নয়, উচিত হবে না। মাত্র ২/৩টি রাষ্ট্র এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। তাই এ পদ্ধতি নিয়ে এ নিবন্ধে আলোচনা করা হচ্ছে না।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেকগুলো রাষ্ট্র করোনা নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, সফল হয়েছে। তবে বেশিরভাগ রাষ্ট্রই করোনা নিয়ন্ত্রণে কমবেশি ব্যর্থ হয়েছে। এ নিবন্ধে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে এরকম সফল রাষ্ট্র ও ব্যর্থ রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করা হল। আলোচ্য সফল রাষ্ট্রগুলো হল ভিয়েতনাম, কিউবা ও তাইওয়ান। ভিয়েতনামকে বেছে নেয়ার প্রধান যুক্তি ২২ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় ওই দেশে একজনও মারা যায় নি, নতুন সংক্রমণ নেই। কিউবাকে বেছে নেয়া হয়েছে তার আলোচিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে। অন্যদিকে লকডাউন না করেও সফল তাইওয়ান। তাই তাইওয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চল থেকে আলোচনায় উঠে এসেছে ভারতের কেরল রাজ্য। তাই কেরালা নিয়েও এখানে আলোচনা করা হল। অন্যদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যায় প্রথম সারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি এবং সবচেয়ে বেশি আলোচিত। তাই সংক্রমণ রোধে ব্যর্থ হিসেবে স্বীকৃত এই দুইটি রাষ্ট্র বিবেচনায় এসেছে।   

এখানে উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। পৃথিবীব্যাপী সংক্রমণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সংক্রমণ রোধে সফল দেশগুলোও এখনই দাবী করতে পারে না, তারা চিরতরে মুক্ত। করোনা ফিরে আসতে পারে – জাপান, সিঙ্গাপুর তার উদাহরণ।

২. করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল ও ব্যর্থ রাষ্ট্র:

ক. করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল রাষ্ট্র:

ভিয়েতনাম:

২২ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ভিয়েতনামে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৬৮ জন, সুস্থ ২২৪ জন এবং একজনও মারা যায় নি। ১৬ এপ্রিল থেকে নতুন করে সংক্রমণ নেই।(source – Worldometer)  ভিয়েতনাম সম্পর্কে বলা হচ্ছে, সরকারিভাবে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ ও রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করার যে কর্মসূচী ভিয়েতনাম বহুদিন ধরে চর্চা করে আসছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সেটি বড় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯ একজন বিদেশী করোনা রোগী শনাক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় ভিয়েতনাম সরকার। সাথে সাথে ইমারজেন্সি এপিডেমিক প্রিভেনশন সেন্টার সক্রিয় করে সরকার। ১ ফেব্রুয়ারি একজন ভিয়েতনামি মেয়ের করোনা শনাক্ত হলে এটাই প্রথম অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ। সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী এটাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেন। বিমান চলাচল সীমিত, সীমান্তে করা নজরদারি ও ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।  ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ঠেকাতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। করোনা ভাইরাস নিয়ে ব্যাপক প্রচারে নামে সরকার। পাশাপাশি দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করা শুরু করে। আর কোভিড-১৯ দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আগেই পর্যায়ক্রমে তারা গোটা দেশটাই লকডাউন করে দেয়। নিচের উদাহরণগুলো থেকে ভিয়েতনামের তৎপরতা বোঝা সহজ হবে। ২ মার্চ ইউরোপের তিন দেশ ভ্রমণ করা একজন প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী পরীক্ষা এড়াতে হ্যানয় বিমান বন্দরে দায়ীত্বরত কর্মচারীদের ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢুকে পড়েন। অবশ্য পুলিশ তাকে ঠিকই আটক করে। এরপর পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। তখন ভিয়েতনাম সরকার একটি বড় পদক্ষেপ নেয়। তা হল, ওই নারী যে বিমানে এসেছিলেন তার সব যাত্রীকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তিনি যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন সেই রাস্তা জীবাণু মুক্ত করা হয়। সেই পথের ধারে বাস করা প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হয়। ৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ জানতে পারে করোনা পজিটিভ এক ব্রিটিশ ২টি কমিউন সফর করেছে। সাথে সাথে কমিউন দুটি লকডাউন করা হয়। এবং ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। ১৬ মার্চ এক ব্যক্তির করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয় যিনি মালয়েশিয়ার শ্রী পেটালিং মসজিদে তবলিগ জামাতের সমাবেশে অংশ নিয়েছিল। সাথে সাথে তিনি যে প্রদেশের বাশিন্দা সেই প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় তাদের পক্ষে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

কিউবা:

করোনা ইস্যুতে কিউবা আলোচনায় এসেছে প্রধানত দুটি কারণে। এক) করোনা নিয়ন্ত্রণে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভূমিকা। দুই) একটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রের করোনা মোকাবেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে মেডিকেল টীম প্রেরণ এবং ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা। এশিয়ার সফল দেশগুলোর মত দ্রুত লকডাউনের পথে হাঁটেনি তারা। পর্যটন তাদের আয় ও হার্ড কারেন্সির অন্যতম উৎস হওয়াতে তারা পর্যটক আগমন নিয়ন্ত্রণ করে বেশ দেরিতে। ততদিনে ভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু কিউবা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে তার জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কারণে। ১ মার্চ কিউবায় প্রথম SARS-COV-2 ভাইরাস পাওয়া যায় এক ইতালি পর্যটকের দেহে। ২০ মার্চ সংক্রমণের সংখ্যা ২১ এ দাঁড়ায়। ২৪ মার্চ থেকে পর্যটক তথা বিদেশিদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। দেশ ত্যাগ বন্ধ করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করে এবং দূরপাল্লার গণপরিবহণ বন্ধ করে। সবশেষে পর্যটক আগমন পুরোপুরি বন্ধ করে। Warldometer এর তথ্য অনুযায়ী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১,১৮৯ জন, মৃত ৪০ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৩৪১জন।

জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল দেশ কিউবা। তাদের স্বাস্থ্যসেবা ‘রোগ নিরাময়’-এর চেয়ে ‘রোগ প্রতিরোধে’ অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে বর্তমানে তারা বিশ্ব সেরা। তাই রোগ বালাই থেকে কিউবা আজ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৮২ জন বা প্রতি ১৭৫ জন নাগরিকের জন্য ১ জন চিকিৎসক রয়েছে যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। কিউবায় রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে না, ডাক্তার যায়  রোগীর কাছে। এ ধরনের জনগণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী ও মহাপরাক্রমশালি দেশ থেকে অনেক ভাল অবস্থানে কিউবা, যাকে যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশক ধরে অবরোধ করে রেখেছে।

কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারে নিচ থেকে একটি জালের মতো। দেশের যেকোনো স্থানে প্রতি ১০০-১২০টি  পরিবারের জন্য ৩ জন ডাক্তার যার মধ্যে ১ জন শিশু বিশেষজ্ঞ এবং ৩ জন নার্স নিয়ে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এর পরের ধাপে রয়েছে সমাজভিত্তিক ক্লিনিক (poly clinic) যেখানে থাকছে  primary care specialist. প্রতিটি poly clinic ২০-৪০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে সাপোর্ট দিয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে কিউবার সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার গ্যারান্টি দেয়া হয়। সেই থেকে প্রত্যেক কিউবান ডাক্তারি পরামর্শ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতাল খরচ, ওষুধপত্র এবং অস্ত্রোপচারের সমস্ত সেবা একদম বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। কমপক্ষে প্রতিবছর একবার প্রতিটি কেন্দ্র তার আওতাধীন পরিবারের সকল সদস্যের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকে। পরীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করে চিকিৎসকেরা নির্ধারণ করেন কোন নাগরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন, আর কোন নাগরিক ঝুঁকি মুক্ত। লক্ষ্য রোগ আসার আগেই ঠেকিয়ে দেবার চেষ্টা। বৈশ্বিক মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থার সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আর তা হল জনগণকে হাসপাতালমুখী না করে হাসপাতাল তথা চিকিৎসা সেবাকে জনগণের দুয়ারে নিয়ে গিয়েছে।       

করোনা মোকাবেলায়ও কিউবা অনেকটা নির্ভার। এশিয়ার সফল দেশগুলোর মত তারা আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নি। করোনা ভাইরাস দেখা দেয়ার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী শনাক্ত করছেন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। কেউ আক্রান্ত হলে বাড়িতে রেখেই তাকে সেবা দিচ্ছেন। শারীরিক দুরুত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না জানছেন। পুরো দেশবাসী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর নজরদারিতে চলে এসেছে। ফলে নিয়ন্ত্রণে আছে করোনা সংক্রমণ। সুরক্ষা সামগ্রী ও চিকিৎসা উপকরণের কোন সংকট নেই তাদের।

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থার জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিউবা বিশ্বমহামারী মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সংহতির প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। করোনা সংক্রমণের এই দুর্দিনে তারাই উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশে ডাক্তার, চিকিৎসা উপকরণ, দুর্লভ ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করছে। দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ১৯টি করোনা সংক্রমিত দেশে মেডিকেল টিম পাঠিয়ে একটি অসম্ভব রেকর্ড তৈরি করেছে। এ মুহূর্তে অন্তত ৫৯টি দেশে ২৯ হাজারের বেশি কিউবান ডাক্তার রয়েছে। আর ৬৭ দেশে ৬৭ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী কর্মরত আছেন।

খ. করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ রাষ্ট্র:

যুক্তরাষ্ট্র:

শুরুতে করোনা ভাইরাসকে মোটেও গুরুত্ব দেন নি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসন। চীনের বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দেয়ার পরও কিছু ভাইরাস বিশেষজ্ঞসহ নীতিনির্ধারকেরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তারা এই ভাইরাস সম্পর্কে অবগত ছিলেন, এবং এটাও জানতেন, আগামীতে এই ভাইরাস মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু তারা প্রস্তুতি নেন নি। এ ধরনের মহামারি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র অপ্রস্তুত, এই কথা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসব সতর্কবাণী গ্রাহ্য করেন নি। ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২২ জানুয়ারি ট্রাম্প বলেছিলেন, বিষয়টি বেশ ভালভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের টুইট, আমাদের দেশে মাত্র ১১জন আক্রান্ত এবং তারাও সেরে উঠেছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প বললেন, আপনারা হয়তো করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আমি বলছি যুক্তরাষ্ট্রে বিষয়টি বেশ ভালভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, একদিন এটি উধাও হয়ে যাবে, একেবারে জাদুর মতো। ৯ মার্চ তিনি বললেন, এটা সামান্য ফ্লু, দুদিনেই চলে যাবে। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এসব বলে চলেছেন, তখন করোনা ভাইরাস দু-চার জন করে বাড়ছে আর ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে।

ট্রাম্প একদিন বললেন, এটা কোনও সংকটই নয়, এটা সাধারণ ফ্লুর মতো। পরদিনই তিনি বললেন, এখন ভয়াবহ সংকটের সময়, এবং আমি সবই জানতাম। এ ধরনের বক্তব্য সংকটকে তীব্র করেছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অফ এলার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক এবং করোনার টাস্কফোর্স বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফাউসি ফেব্রুয়ারিতেই সামাজিক দুরুত্ব মেনে চলার বিষয়ে প্রশাসনকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু প্রশাসন তাতে পাত্তা দেয়নি। এমনকি, যখন নিউইয়র্ক-এ ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত, ৬৭২ জন মানুষ মারা গেছে, তখনও ট্রাম্প বলছেন দুই সপ্তাহের লকডাউনের প্রয়োজন নেই। এভাবে ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন প্রচুর সময় নষ্ট করে এবং ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সিএনএন কে ডাঃ ফাউসি বলেছেন, শারীরিক দুরুত্ব বজায় এবং বাড়িতে অবস্থানের নীতি মার্চের মাঝামাঝির পরিবর্তে ফেব্রুয়ারির ৩য় সপ্তাহ থেকে মানা হলে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত।

মার্কিন প্রশাসন একদিকে মুখে মুখে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে রোগ পরীক্ষা এবং লোকজনকে সঙ্গনিরোধ ও বিচ্ছিন্ন করণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। একারণে একটি ভুল বার্তা পেয়েছে দেশের মানুষ, জানতে পারেনি দেশে আসলে কত মানুষ আক্রান্ত। ফলে জনগণও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় নি। চলাফেরায় সতর্ক হয় নি। এই ফাঁকে ট্রাম্পের করা ১০ ফেব্রুয়ারির টুইটের মাত্র ১১ জন ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে লাখ ছাড়িয়ে যায়। করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণে মার্কিন প্রশাসনের অবহেলা ও ব্যর্থতা দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে তুলনা করলে বোঝা যাবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল একই দিনে, ২০ জানুয়ারি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৮০০ জনের পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখে পরীক্ষা হয় মাত্র আড়াই জন। কিন্তু ওই একই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৮০০০ জনের পরীক্ষা করা হয়। তাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ১০ লাখে ১৫৪ জন। ১৫ ফেব্রুয়ারির পরে সংক্রমণ স্থানীয়ভাবে ছড়ানো শুরু করে। কিন্তু তখনও সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবে পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয় নি। ২৪ ফেব্রুয়ারি সিডিসি’র ন্যান্সি ম্যাসেনির সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের এখানে হয়তো স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ শুরু হবে। আর এটা হলে অনেক মানুষ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হবে। কিন্তু পরের দিনও ট্রাম্প বলেন করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। আসলে ততদিনে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এরপর দিনে দিনে রোগী বেড়েছে, বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা, সতর্কতা থেকে এক পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা। একে একে সব কিছু বন্ধ, লকডাউন। কিন্তু প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর প্রায় ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বড়রকমের মূল্য দিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মোট সংক্রমণ ৮,৬৫,৯৭৯ জন, সুস্থ হয়েছেন ৮৪,৮১২ জন এবং মৃত্যু ৪৮,৮০৮ জন। (source: Worldometer) 

বস্তুত, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি প্রস্তুতি খুব খারাপ ছিল। তাই প্রথম দিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরীক্ষা করা হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন অনেক অঙ্গ রাষ্ট্রের গভর্নর। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম– মাস্ক–প্রটেক্টিভ গিয়ার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। বড় মহামারি মোকাবেলায় যথেষ্ট সক্ষম নয়।  

ইতালি:

ইতালির বেরগামো (বার্গমো) থেকে ডাঃ ড্যানিয়েল মাক্কিনির একটি মর্মস্পর্শী চিঠি বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। চিঠিতে তিনি আজকের অবস্থায় আসার জন্য প্রথম দিকে করোনার ক্ষমতা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, গুরুত্ব না দেয়াকে দায়ী করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কারো কোনও দোষ নেই। যারা আমাদের অভয় দিয়েছিল, এটা তেমন ভয়ংকর নয়, সব দোষ তাদের। তারা বলেছিল, এটা সাধারণ ফ্লু, ফলে ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। আর এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে’।

ইতালিতে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকা হল এর উত্তরের শিল্পাঞ্চল–মিলানের আশেপাশের এলাকা, লম্বারদি ও ভেনিসের নিকটস্থ ভেনেটা শহর। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মিলানের সানসিরো স্টেডিয়ামে আটলান্টার মুখোমুখি হয়েছিল স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া। গ্যালারিতে হাজির ছিল ৪০ হাজার দর্শক। করোনার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লম্বারদি অঞ্চলের বেরগামোতে (বার্গমো) আটলান্টা ক্লাব অবস্থিত। তাই সেদিন গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের অধিকাংশই ছিল বেরগামো (বার্গমো) থেকে আসা। এই ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকদের অনেকেরই কয়েকদিনের মধ্যে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়ে। অর্থাৎ ফুটবল ম্যাচে গোপন ঘাতকের মতো রয়ে গিয়েছিল কিছু দর্শক, যারা নিজেরাও জানতেন না যে তারা আক্রাত হয়েছে করোনায়। ধীরে ধীরে পুরো লম্বারদি অঞ্চলে ব্যাপক হারে সংক্রমিত হয়। অনেকে করোনার লক্ষণগুলো এড়িয়ে তাদের নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চালিয়ে গেছেন, ফলে করোনা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পর  অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের অন্যান্য এলাকার পর্বত ও সমুদ্র এলাকায় ছুটি কাটাতে নিয়ে গেছে। তারা ভেবেছিল তারা নিরাপদ রাখছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এধরনের ফলাফল ভাল হয়নি। অন্যদিকে ইতালি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে  খেলা বন্ধ করা হয় নি।

ইতালিতে ২৯ জানুয়ারি চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে আসা ২জন পর্যটকের প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তারা ২৩ জানুয়ারি ইতালির মিলান বিমান বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে এবং রোমে গিয়ে অসুস্থ হলে পরীক্ষায় তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ধরা পরে। শনাক্ত হওয়া তৃতীয় ব্যক্তি একজন ইতালীয় যিনি চীনের উহান থেকে ইতালি ফেরেন ৬ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি কডোনা শহরে একব্যক্তি সামান্য অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে তার পারিবারিক চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসা নিতে আসেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়ি পাঠান। দুই দিন পর শ্বাসযন্ত্রের তীব্র কষ্ট যখন পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হন তখন প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। অথচ সে একজন করোনা সংক্রমিত রোগী। ওই রোগীর কাছ থেকে ভাইরাস হাসপাতালের অন্য রোগী, হাসপাতালের কর্মী ও এলাকায় ছড়িয়ে পরে। তবে ওই ব্যক্তি কিভাবে সংক্রমিত হয়েছেন তা অজানা রয়ে গেছে। ধারণা করা হয় তার থেকেই পুরো ইতালিতে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরপরই ইতালি চীনের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, অনেক আগে থেকেই চীন বা করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে কেউ এলে হোম কোয়ারেন্টিন রাখা এবং চিকিৎসা কর্মীদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা করা হয় নি।  

এসব থেকে বোঝা যায়, শুরুর দিকে করোনা সংক্রমণ রুখতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া করোনা রুখতে ইতালি সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে নানা ত্রুটি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষতঃ সংক্রমণ রুখতে সর্বাধিক সংক্রমিত এলাকাতে যত কঠোরভাবে লকডাউন করা হয়ে থাকে ইতালির ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। এসব ঘাটতির বড় মূল্য দিতে হচ্ছে ইতালিকে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ইতালিতে মোট সংক্রমণ ২৬,৫৬,৬২২ জন, সুস্থ হয়েছেন ৭,২৯,৮৭৩ জন এবং মৃত্যু ১,২৮,০৭১ জন। (source – Worldometer)

ইতালির চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ইতালির হাসপাতালগুলো এ ধরনের মহামারি মোকাবেলার ক্ষমতা রাখে না। সুরক্ষা সামগ্রীসহ বিভিন্ন চিকিৎসা উপকরণ ও সরঞ্জামের তীব্র সংকট। যথেষ্ট ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর না থাকাতে ডাক্তারদের কঠিন স্বিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে, কাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। 

গ. লকডাউনের পথে না হেঁটেও সফল তাইওয়ান:

চীনের সাথে গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা তাইওয়ান দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হচ্ছিল। মাত্র ২৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটির প্রায় ০.৮৫ মিলিয়ন নাগরিক চীনের মূল ভূখণ্ডে বসবাস করে। এরা চীনা নববর্ষে চীন থেকে তাইওয়ানে বেড়াতে আসেন। ফলে এ আশংকা অমূলক ছিল না, এসময় করোনার প্রাদুর্ভাব বেশি হবে। কিন্তু Warldometer-এর তথ্য অনুযায়ী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৪৩৮ জন, সুস্থ হয়েছে ২৫৩ জন মারা গেছে মাত্র ৬ জন। লকডাউন না করেও সফল তাইওয়ান তাই আলোচনায় উঠে এসেছে।

তাইওয়ানের কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের মূলে রয়েছে সার্স সংকটের অভিজ্ঞতা।  ২০০২-০৩ সালের ওই মহামারিতে দেড় লাখের বেশি মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা এমন সংকটের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি জনস্বাস্থ্য রেসপন্স মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করে। অভিজ্ঞতা থেকে তারা আসন্ন সংকটকে দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং মহামারির প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাগুলো সক্রিয় করে তুলে।

চীনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরপরই বিদেশ ফেরত নাগরিকদের শনাক্তকরণ শুরু করে। স্বাস্থ্য তথ্য ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত একত্র করে তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সম্ভাব্য রোগীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। তাদের সবার জন্য কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। মোবাইল ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে প্রতি ২ ঘন্টা পরপর নিশ্চিত করা হয় যে তারা বাসাতে আছে। অন্যদিকে ৩১ ডিসেম্বর থেকে চীনের উহান থেকে আসা যাত্রিদের বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং করা শুরু করে। জ্বর, সর্দি-কাশি নিয়ে কেউ ফিরলে তাকে সোজা আইসোলেশনে পাঠানো হয়।

দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়। আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখা হয়। তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়।

স্কুল, অফিস, আদালত, দোকানপাট খোলা রাখা হয়। তবে ভিড় এড়াতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিমান চলাচল বন্ধ না করা হলেও বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কঠোরভাবে।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণের মজুত বৃদ্ধি এবং ভাইরাস বিরোধী মাস্ক তৈরিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে মাস্ক বা সুরক্ষাসামগ্রীর সংকট ছিলন তাইওয়ানে। ন্যায্য দামে মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। তা ছাড়া সরকার তার নাগরিকদের প্রত্যেককে প্রতিসপ্তাহে ২টি করে মাস্ক সরবরাহ করে।    

ঘ. কেরালা মডেল:

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কেরালার গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে, ‘কেরালা মডেল’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। গণহারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন রাখা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে দ্রুত খুঁজে বের করা, দীর্ঘ সময় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার পাশাপাশি হঠাৎ লকডাউনের কারণে আটকে পড়া হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিকের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও কয়েক লাখ শ্রমিকের কাছে নিয়মিত খাবার পৌঁছানো এবং দরিদ্রসীমার নিচে জীবনযাপন করা পরিবারদের জন্য খাবার বিতরণ ব্যবস্থার মতো মানবিক উদ্যোগের কারণেই প্রশংসিত হচ্ছে কেরালা। তাছাড়া  ছোট ছোট ‘কিওস্ক’ বা স্টলের মাধ্যমে স্বল্প খরচের করোনা টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সেখানে। এসব ব্যবস্থা নেয়ার কারণে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে তারা। ফলে সংকোচ, লোক লজ্জার ভয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মানুষও আরো বেশি করে এগিয়ে এসে নিজেদের পরীক্ষা করিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী শারীরিক দুরুত্ব মেনে চলেছেন। অবশ্য অধিক শিক্ষার হার এবং দীর্ঘদিনের কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের পরিবেশ মানুষকে সচেতন করতে সহায়ক হয়েছে। কেরালার মডেল মূলত অর্থনৈতিক-স্বাস্থ্য-সামাজিক এই তিন নীতির মিলিত ফল।

কেরালায় অভিবাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। তাই কেরালাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশংকা ছিল সবচেয়ে বেশি। আশংকার প্রতিফলন ঘটিয়ে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ভারতের প্রথম করোনা-আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায় এই কেরালা রাজ্যে। সংক্রমিত ব্যক্তি চীনের উহান থেকে আসা এক মেডিকেল শিক্ষার্থী। এ আশংকা থেকেই রাজ্য সরকার আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছিল, করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল। তাই করোনার আক্রমণ টের পাওয়ার পরপরই তাদের কাজে নেমে পড়া সহজ হয়েছিল। জানুয়ারি মাস থেকেই চারটি বিমানবন্দরে যাত্রীদের পরীক্ষা শুরু করা হয়। যাদের উপসর্গ ছিল, তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় নেওয়া হয়। ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে অবশ্য কেরালার আগে থেকেই লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৮ সালে নিপা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে কেরালাকে। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে কেরালার প্রস্তুতি ছিল অনেকটা নিখুঁত।

সংক্রমিত রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা, প্যারামেডিকস, স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে টীম গঠন করা হয়েছে। এসব টীম সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে খুঁজে বের করেছে। এর সাথে জিপিএস তথ্য, বিমানবন্দর, রাস্তা, দোকান প্রভৃতি জায়গা থেকে নেওয়া নজরদারির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংক্রমিত ব্যক্তির চলাফেরাসহ তাঁর সংস্পর্শে আসা সবার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। নিচের উদাহরণ টীমগুলোর তৎপরতা বোঝা যাবে। ৯ মার্চ নাগাদ কেরালায় একটি পরিবার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই এই টিমের কাছে তাদের যাতায়াতের সব জায়গার ম্যাপ চলে আসে। এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মানুষকে একটা হটলাইন নম্বর দেওয়া হয়। ওই পরিবারের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের যোগাযোগ করতে বলা হয়। দেখা গেল, ৩০০ মানুষের সঙ্গে ওই পরিবারে সাক্ষাৎ হয়েছে। এসব মানুষকে শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশন করা হয়। এরকম আইসোলেশনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রতিদিন কল করা হতো। তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া হতো। তাঁরা ঠিক বলছেন কি না, তাও পরীক্ষা করা হতো। ঠিক না বললে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। পুরো জেলাকে উচ্চ সতর্কব্যবস্থায় রাখা হয়।

সব মিলিয়ে সংক্রমণ রুখতে ভারতের মধ্যে এখনও কেরালা অনেকটা সফল। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত কেরালার মোট আক্রান্ত ৪৩৮ জন, সুস্থ হয়েছেন ৩২৪ জন এবং  প্রাণ হারিয়েছেন ২ জন। (সূত্র ২৩ এপ্রিলের আনন্দবাজার পত্রিকা)। 

৩. করোনা প্রতিরোধে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা

করোনা প্রতিরোধে উপরোক্ত সফল ও ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর তুলনামূলক আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি:  

  • করোনা কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেয়া হয় এমন রাষ্ট্রগুলো প্রণীত স্বাস্থ্যনীতি এবং এই নীতির আলোকে গড়ে তোলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। ব্যাপক করোনা সংক্রমণে এসব রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতার জন্য ঠিকমত চিকিৎসা দেয়া যায় নি। অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবাতেও সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু কোভিড-১৯ নয়, অন্য রোগের চিকিৎসাও অনেকেই নিতে পারেন নি বা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। চিকিৎসা উপকরণ, সুরক্ষা সামগ্রী ও ওষুধের প্রকট সংকট দেখা দিয়েছে। শুরুতেই পরীক্ষা কার্যক্রম চালাতে না পারার অন্যতম কারণ কীট সংকট। ভেন্টিলেটরের সংকটে কোথাও কোথাও ডাক্তারদের কঠিন স্বিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কাকে বাঁচিয়ে রাখবেন, আর কাকে রাখবেন না। এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্র তাদের স্বাস্থ্যনীতিতে রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে প্রধান করেছে তারা সংক্রমণ রোধে এগিয়ে আছে।
  • যে রাষ্ট্রগুলো চীনে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন করতে পেরেছে, গণহারে পরীক্ষা করে সংক্রমিতদের শনাক্ত করে বিচ্ছিন্ন রাখতে ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে পেরেছে, সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসা সকল মানুষকে দ্রুত খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিন করতে পেরেছে এবং জনসমাগম আটকে দিয়ে শারীরিক দুরুত্ব বজায় রাখতে পেরেছে সেসব রাষ্ট্র সংক্রমণ রুখতে পেরেছে। সময় ক্ষেপণ করে তথা সারাদেশে করোনা ছড়িয়ে দেয়ার পর লকডাউন করে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায় নি।
  • করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত এমন রোগীরাই মূলত মারা যাচ্ছে। ইতালির হেলথ ইন্সটিটিউট-এর দেয়া তথ্য বলছে, কোভিড-১৯-এর কারণে ১৭ মার্চ পর্যন্ত সেখানে যত লোক মারা গেছে তাদের ৯৯ ভাগের অন্য শারীরিক সমস্যা (ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি) ছিল। অন্যদিকে তরুণদের চেয়ে বয়স্কদের মৃত্যুর হার বেশি। এ তথ্য দুটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। এক. এ ধরনের মহামারি থেকে বাঁচতে হলে নিরোগ দেহ চাই। দুই. মানবদেহকে রোগ প্রতিরোধ সক্ষম রাখতে হবে। এমনকি হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার প্রশ্নটিও উঠে এসেছে। বস্তুত যারা অন্যরোগে ভুগছিলেন না এবং যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট আছে, তারা করোনায় আক্রান্ত হলেও দ্রুত সেরে উঠেছেন। করোনা এই শিক্ষাই দিচ্ছে, রাষ্ট্রগুলোর স্বাস্থ্যনীতির অন্যতম লক্ষ্য থাকবে তার নাগরিকদের রোগ প্রতিরোধক্ষম ও রোগমুক্ত রাখা।
  • ওষুধ ও ভ্যাকসিনের উন্নয়ন; গবেষণা-উৎপাদনের ব্যয়বহুল, অকার্যকর ও বাজারকেন্দ্রিক ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। গত ২০ বছরে করোনা ভাইরাস গোত্রের বেশ কয়েকটি ভাইরাস বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করেছে (সার্স, কোভ-২, ইবোলা, জিকা ইত্যাদি), SARS-COV-2  এর মধ্যে একটি। এই ধারণা  অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে সার্স-এর পরিবর্তিত রূপের করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা আছে। SARS-COV-2 কে  সার্স-এর আরেকটা রূপ মনে করা হচ্ছে। তাই সার্স-এর প্রতিষেদক আবিষ্কার হলে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেদক আবিষ্কার অনেক সহজ হতো। করোনা ভাইরাস গোত্রের কোনটির যে প্রতিষেদক এখনও আবিষ্কার হল না, এতে উন্নত দেশের সরকারগুলোর চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ সরকারগুলো চেয়েছে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি তা করবে। কিন্তু মুনাফার নিশ্চয়তা না পেলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সংকট মাথায় রেখে ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি করবে না কোন কোম্পানি এবং বাস্তবে তা করেওনি। একইভাবে উন্নত দেশগুলোতে সুরক্ষা সামগ্রী, চিকিৎসা উপকরণ ও ভেন্টিলেটরের ভয়াবহ সংকটও মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রকাশ করছে। তাই অনেকে ওষুধ উৎপাদনকে বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের খপ্পর থেকে মুক্ত করার কথা বলা শুরু করেছেন। করোনার শিক্ষা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে নয়, রাষ্ট্রের তদারকিতে ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
  • বায়ু দূষণের সঙ্গে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে দাবী কয়েকটি গবেষণার। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে  আমেরিকার Harvard ইউনিভার্সিটি, ইতালির ইউনিভার্সিটি অব দিয়েনা, ডেনমার্কের আরহুস ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। এসব গবেষণার ভিত্তিতে বিবিসি বলছে স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ও ফ্রান্সের ৫৬টি প্রশাসনিক এলাকায় মৃত্যুহার বেশি। এর মধ্যে পাঁচটি অঞ্চলে মৃত্যু হার ৭৮ শতাংশ যে অঞ্চলগুলো বেশি বায়ু দূষণের শিকার।
  • করোনা ধনী-গরিব বা সাদা-কালো মানছে না। অথবা ধনী দেশ–গরিব দেশ মানছে না। ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে  ধর্ম বা জাতির শ্রেষ্ঠতার দম্ভ। করোনার আরেকটা বার্তা হল, শুধু আমি সুস্থ থাকলে হবে না, তোমাকেও সুস্থ থাকতে হবে। নাহলে তোমার ভাইরাস দশজন ঘুরে আমার দুয়ারেও কোন না কোনভাবে চলে আসবে। করোনার শিক্ষা জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত না হলে ব্যক্তি বিশেষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও থাকে না। তেমনি দুনিয়ার সকল দেশের জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই মানব প্রজাতির নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
  • তথ্য গোপন বা বিকৃত বা উপেক্ষা করেছে যেসব রাষ্ট্র সেসব রাষ্ট্রে করোনা ব্যাপকহারে সংক্রমিত হয়েছে। চীন তথ্য গোপন করেছে এবং তা করোনার ব্যাপক সংক্রমণে ভূমিকা রেখেছে। ইরানের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত চিন্তার দেশ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্য বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন। সাধারণ ফ্লু বলে বিকৃত করেছেন। পরিণাম করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ। ইতালি ফুটবল খেলার বাণিজ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে করোনাকে উপেক্ষা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও কর্পোরেট স্বার্থের কারণেই কালক্ষেপণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ ছড়ানোতে বদ্ধ আর মুক্ত চিন্তার দেশ কেউ কম যায়নি। কেউ তথ্য গোপন করেছে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে, কেউ কালক্ষেপণ করেছে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায়। দু’ক্ষেত্রেই ফলাফল অসংখ্য মানুষের মৃত্যু।   
  • করোনার আরেকটি শিক্ষা হল জনগণকে আস্থায় না নিয়ে মহামারি মোকাবেলা করা সম্ভব হয়না। কেননা জনগণের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া সরকারের একক প্রচেষ্টায় করোনার মতো মহামারি মোকাবেলা সম্ভব নয়। আর সরকারের পদক্ষেপের ওপর আস্থা থাকলে তা বাস্তবায়নে জনগন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসে। করোনার ক্ষেত্রেও এটাই প্রমাণিত হয়েছে। যেসব রাষ্ট্র সফল হয়েছে সেসব রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সরকারগুলোর পদক্ষেপসমূহতে আস্থা স্থাপন করে তা বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকা সুচারুভাবে পালন করেছে।

৪. শেষের কথা:

এখনও পর্যন্ত করোনা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়। অনেকের আশংকা এরপর কম সংক্রমিত এলাকা যেমন আফ্রিকায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটবে। অনেকের আশংকা প্রথম ঢেউ শেষ হবে অল্প সময়েই। এরপর দ্বিতীয় ঢেউ আসবে যা হবে আরও মারাত্মক। তাই কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে মুল্যায়নে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটা মূল্যায়ন এখনি টানা যায়, তা হল করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী বৈশ্বিকভাবেই মোকাবেলার করতে হবে এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান মূলধারার স্বাস্থ্যব্যবস্থা করোনা সংক্রমণ রুখতে ব্যর্থ হয়েছে।

তারিখঃ ২৩.০৪. ২০২০   

লেখক: সম্পাদক, রাষ্ট্রচিন্তা জার্নাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *