বিজেপির সাম্প্রদায়িক মিশন এবং আমাদের করনীয়

  • হাসনাত কাইয়ূম

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি বাংলাদেশকেই প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। সিএএ কার্যকর করার অঙ্গীকারকেও তারা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তুলে ধরছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে নৃশংসভাবে ব্যবহারের ব্রিটিশ এবং ব্রিটিশোত্তর মডেলকে আরো অনেক নিকৃষ্ট পন্থায় খোলাখুলি ব্যবহারে গত প্রায় ২ দশক যাবত নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা।

গত শতাব্দীর ৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং দুনিয়াব্যাপী মার্কসীয় রাজনীতির সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে রাজনীতির অভিমুখ পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময় ছিলো যুদ্ধবাজ, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও নিজেদেরকে কল্যাণকামী, সোস্যাল ডেমোক্রাট, বা উদার গণতন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিতে বাধ্য হতো। সেদিন গত হয়েছে। এখন সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাবীদার একটি রাষ্ট্রে একটি রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় উপাসনালয় বা মসজিদ ভেঙে সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করবে, এরকম একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পেরেছে এবং সেখানকার জনগণ তাদেরকে সত্যি সত্যি ভোট দিয়ে জাতীয়ভাবে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছে, এটা আজ কোনো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তবেই ঘটেছে।

Farmers Protest, Democracy; Cartoonist: Mir Suhail

আমাদের দুর্ভাগ্য এরা আমাদের প্রতিবেশী। অবশ্য বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার পর ওখানকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও বুঝতে শুরু করেছে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির হওয়ার সাথে আরো অনেক কিছুই তাদের ভেঙেছে। কৃষকরা বুঝছে ফসলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ভেঙে দিচ্ছে তারা, মধ্যবিত্ত বুঝছে ব্যাংক বিক্রি হচ্ছে, বীমা বিক্রি হচ্ছে, রেল বিক্রি হবে হবে করছে, নতুন চাকরী সৃষ্টি হয়নি মোটে কিন্তু পুরনোরা চাকরি হারাচ্ছে, আদিবাসীদের বন-জঙ্গল-জমি, মাটির নীচের সম্পদ সবই বিক্রি হচ্ছে, আর তারা উদ্বাস্তু হচ্ছে। এই বোঝা যত বাড়ে, দেশের ভেতরে যত পুঁজিতে টান পড়ে, ততই তাদের বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।

জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা পাকিস্তানের জঙ্গলে তথাকথিত সার্জিক্যাল অপারেশন করে অভুক্ত দেশবাসীর সামনে মর্দামির জোশ দেখিয়ে ভোট বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন হয়েছে বাংলাদেশকে “পাকপন্থী” মুসলমানের দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা। হঠাৎ করে তাদের ধর্ষিতা পূর্ণিমার জন্য ভালোবাসা আর অইএসএস জঙ্গীদের জন্য ঘৃণা উপচে পড়ছে। যেন ভারতে এরা কোনদিন কাউকে ধর্ষণ করে না্ই, পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের দোসরদের মতো বিজেপির নেতাদেরও কেউ কেউ কেউ ধর্ষণের ফতোয়া দেয় নাই, যেন বিজেপি-আর এসএস কোনো জঙ্গী সংগঠন নয়, গোধরা হত্যাকাণ্ড যেন একটি “গণতান্ত্রিক” হত্যাকাণ্ড!

আমাদের আরেক দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের বর্তমান সরকার এবং তাদের লালিত-পালিত-পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তথাকথিত ইসলামী নেতৃবৃন্দের একটি অংশ। আমাদের সরকার আর এরা মিলে বিজেপির নষ্ট রাজনীতির বিকাশ ঘটানোর জন্য বাংলাদেশে যে ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা দরকার সেটা খুবই বিশ্বস্ততার সাথে করে চলেছে। তারা মানুষের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার, সভাসমাবেশ করার অধিকার, ভিন্নমত করার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। অপর দিকে এখানে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে এক ধরনের ছদ্ম উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে, দৃশ্যত নাস্তিক বিরোধীতার নামে কার্যত হিন্দু এবং অন্যান্য আদিবাসী বিরোধী, তারা সরকারী আনুকূল্যেই সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে।

আনন্দবাজার, ২৬ শে মার্চ ২০২১

সাম্প্রতিককালে মোদীর সফরকে সামনে রেখে শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘঠিত করার ক্ষেত্র তৈরী করে দেওয়া এবং নিজেদের দলীয় লোকদের দিয়ে সে হামলা সংঘঠিত করানো, বামপন্থী ছাত্র সংগঠন, মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি এবং নাগরিকদের মোদী বিরোধী রাজনীতিকে হঠাৎ করে ধর্মীয়গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রেও সরকার সংশ্লিষ্টদের ভূমিকাই প্রধান ছিলো। তারা অত্যন্ত নগ্নভাবে সাধারণ ধর্মপ্রাণ সরল মুসলিমদের মনোজগতের সুপ্ত হিন্দুবিরোধী মনোভাবকে মোদীবিরোধী রাজনীতির ছাতার নীচে জড়ো করে পাখির চেয়ে নির্মমভাবে খুন করেছেন। যার সবটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপির জন্য আশীর্বাদ হিসাবে আভির্ভূত হয়েছে।

আন্দাজ করা যায়, বাংলাদেশে এটাই শেষ নয় বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে তুলেমূলে শেষ করার শুরু। এভাবেই বাংলাদেশ আজ ইরাক, ইরান, সিরিয়া, আফগানিস্তান বা লিবিয়ার পথেই হাঁটতে শুরু করেছে কিনা সেই প্রশ্ন প্রায় সামনে এনে ফেলা হয়েছে।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির মালিকানা কর্মী বা সংগঠকদের হাতে নেই। এইসব দলে একদিকে মালিকপক্ষ বা সুবিধাভোগী পক্ষ এবং অপরদিকে শ্রমিকপক্ষ আছে। বলাই বাহুল্য যথারীতি শ্রমিক পক্ষটাই বড় এবং আওয়াজবিহীন। এইসব দলের যারা নিজেদেরকে যে উদ্দেশ্য বা আদর্শের অনুসারীই দাবী করুক না কেন, এরা সবাই আসলে বিভাজন এবং অপরপক্ষকে নির্মূলপন্থী। এখানকার রাষ্ট্র, সরকার, বুদ্ধিজীবীরা তাদের সাধ্যমত বিভাজন এবং নির্মূলের যুক্তি ও মনোস্তত্ব তৈরীর কাজ করে। রাজনৈতিক সমস্যার প্রকৃত সমাধান জনগণকে শোনানোর কিংবা বোঝানোর মতো পরিবেশ যাতে না পাওয়া যায়, সেটা নিয়ে কাজ করাও তাদের একটি মিশন।

বাংলাদেশ এমন একটি কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়ানো যে, আজ ভারতরাষ্ট্র এবং তার সরকারের সাম্প্রদায়িক, আগ্রাসী, প্রকৃতি বিরোধী রাজনীতির বিরোধীতা যেমন করতে হবে, একই সাথে এটা খুবই পরিষ্কার করে বুঝতে হবে যে, এ বিরোধীতা এমনভাবে করা চলবে না যা আখেরে তাদের সুবিধাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যি সত্যিই ভারত অত্যন্ত জঠিল একটি কার্ড হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এই জটিলতা বোঝা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারার মতো দক্ষতা এবং সততা আমাদের দেশে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন, তাদের বড় অংশের নাই বললেই চলে। অপরদিকে এখানে যারা প্রগতিশীল এবং সেক্যুলার হিসাবে পরিচিত তাদের মধ্যে মুসলিমদের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি এমন ঘৃণা আর উন্নাসিকতা বিদ্যমান, যা দেশ এবং মানুষের স্বার্থে বড় কোনো ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়ে আছে।

বাংলাদেশের এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনীতি এবং সংস্কৃতি গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জও তাদেরকেই নিতে হবে, যারা এই ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র আর পাচারকারীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *