নিওলিবারেল জমানার অবসান হচ্ছে। কী আসছে এরপর?

  • রুটগার ব্রেগম্যান; ভাষান্তর: মনিরা শরমিন প্রীতু

অনুবাদকের উৎসর্গ:
আমার শিক্ষক আ-আল মামুনকে…
যিনি শিখিয়েছেন শিরদাঁড়া সোজা না থাকলে জ্ঞান চর্চার কোন মূল্য নাই।

অনেকেই বলছেন মহামারীকে রাজনীতিকরণ করাটা ঠিক নয়। যদিও এভাবে বলাটা আদতে মিথ্যে ন্যায়পরায়নতার জালে নিজেকে আবদ্ধ রাখারই সামিল। ঠিক যেমন ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা চলমান মহামারীকে উপরওয়ালার ক্রোধ বলেই আখ্যা দিচ্ছেন, আর ওদিকে ‘চীনা ভাইরাস’ সংক্রান্ত জনপ্রিয় ভীতি তো রয়েছেই। অনেক পর্যবেক্ষক আবার ভাবছেন এই মহামারীর হাত ধরে শেষ পর্যন্ত আমরা নতুন এক ভালোবাসা ও আনন্দময় এবং সবার জন্য মুক্ত-অর্থের যুগে প্রবেশ করতে চলেছি।

আরেকদল বলছেন, শেষ পর্যন্ত সময়ই বলে দেবে সবকিছু। তাঁরা ধারণা করছেন, এই মুহুর্তে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর ফলাফল পাওয়া যাবে সুদূর ভবিষ্যতে। অথবা ২০০৮ এ লেম্যান ব্রাদার্স এর পতনের সময়, ওবামার চিফ অব স্টাফ ঠিক যেভাবে বলেছিলেন, “এমন ভয়াবহ সংকটময় মুহুর্ত বৃথাই যেতে দিতে পারি না।”

প্রথম কয়েক সপ্তাহে, আমি সমালোচকদের সাথেই গলা মিলিয়েছি। এর আগে, এই সংকটকাল আমাদের সামনে কী ধরণের সুযোগ হাজির করে তা নিয়ে লিখেছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ভাবনার আসলে কোন মানে হয় না, এমনকি বিষয়টি খানিকটা বিরক্তিকরও। একের পর এক দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, দিন যতই গড়াচ্ছে, বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে এ সংকট মাস, বছর পেরিয়ে আরও অনেকটা সময়জুড়ে টিকে থাকবে। এবং সংকট উত্তরণের অস্থায়ী ব্যবস্থাপনাগুলো হয়ত স্থায়ী হয়ে থেকে যাবে।

আমরা তো আসলে কেউই জানি না, এই সময়ে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে? আদতে ভবিষ্যত এতই অনিশ্চিত যে, আমাদের এখনই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

রুটগার ব্রেগম্যান; ছবি: ইন্টারনেট

জোয়ারের দিক পাল্টাচ্ছে: (The tide is turning)

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ফাইনানশিয়াল টাইমস চলতি বছরের (২০২০) এর ৪ এপ্রিল, একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। আমার ধারণা ইতিহাসবিদগণ ভবিষ্যতের সময়গুলোতে এখান থেকে উদ্ধৃত করবেন।

ফাইনানশিয়াল টাইমস এই সময়ে বিশ্বব্যপী নেতৃত্ত্বদানকারী বাণিজ্য বিষয়ক (bussiness) দৈনিক পত্রিকা। সত্যি কথা বলতে, এটি আদতে কোন প্রগতিশীল প্রকাশনাও নয়। মূলত এই পত্রিকাটির পাঠক হলো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুনিয়ার তাবৎ বাঘা বাঘা খেলোয়াড় এবং ধনীক শ্রেণিটিই। এর সাথে মূলত ইয়ট, বাগানবাড়ী, ঘড়ি এবং গাড়ী সংক্রান্ত বিষয়াদি ক্রোড়পত্র আকারে প্রতিমাসেই প্রকাশিত হয়, লাজ-শরমের বালাই ছাড়াই (unabashedly) যেটির নামকরণ করা হয়েছে ‘কীভাবে খরচ করবেন’ (how to spend it)।

অথচ এপ্রিলের শনিবারের সেই স্মরণীয় সকালে, পত্রিকাটি যা প্রকাশ করলো, তা হলো:

‘বিগত চার দশক ধরে বিরাজমান নীতিমালাগুলোর বিপরীতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে। সরকারকে অর্থনীতিক খাতে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। পাবলিক সার্ভিসকে দায় [লায়াবিলিটিস] হিসেবে ভাবার চেয়ে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে, শ্রম বাজারকে নিরাপত্তা দেবার পথগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সম্পদ ও সুবিধার পুনর্বন্টনকে আবার আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে; বয়স্ক এবং ধনীদের বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তিকে প্রশ্ন করতে হবে। যেসব নীতিকে এতোকাল উদ্ভট ভাবা হয়েছে, যেমন ন্যূনতম আয় [বেসিক ইনকাম] এবং সম্পদের উপরে ট্যাক্স [ওয়েলথ ট্যাক্স], সেগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।’

বাব্বাহ, কী হচ্ছে এখানে? কীভাবে পুঁজিপতিদের পুরোধা, আরও বন্টন, বৃহৎ সরকারের, এমনকি ন্যূনতম আয় নিয়েও কথা বলছে?

দশক ধরে এই প্রতিষ্ঠান বলিষ্ঠভাবে ছোট সরকারের ধারণা, কম কর এবং সীমিত সামাজিক সুরক্ষা সর্বোপরি সকল তীক্ষ্নতাকে ভোতা করে দেবার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী মডেলের পক্ষে সমর্থন দিয়ে গেছে। ১৯৮৬ সাল থেকে সেখানে কর্মরত এক সাংবাদিক এভাবেই বলেন, ‘‘এতগুলো বছর আমি এখানে কাজ করি, দ্যা ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেস মানবিক মুখ নিয়ে আদতে মুক্ত বাজার পুঁজিবাদকেই সমর্থন যুগিয়ে গেছে বছরের পর বছর। অথচ আজ সম্পাদকীয় পর্ষদ নতুন সাহসী দিকনির্দেশনা নিয়ে হাজির হয়েছে’’

সম্পাদকীয়টিতে প্রকাশিত চিন্তাধারাগুলো (Idea) অকস্মাৎ হাজির হয় নি:  বরং প্রান্ত থেকে মূলধারা, নৈরাজ্যবাদী টেন্ট সিটি থেকে প্রাইমটাইম টক শো, অখ্যাত ব্লগ থেকে দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমস পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এমন সম্পাদকীয় আমাদের সামনে হাজির করা হয়েছে।

এবং এখন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড় সংকটকালের মধ্যবর্তী সময়ে, এইসকল চিন্তাভাবনা আমূল পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীকে।

আমরা এখানে কীভাবে পৌছলাম বুঝতে আমাদের চলে যেতে হবে ৭০ বছর পেছনে। যদিও এখন আমাদের ভাবতে কষ্ট হয় যে, ৭০ বছর আগেও কোন একটা সময় ছিলো-যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন, যাদের তখন রেডিক্যাল (radical) বলা হতো।

১৯৪৭ সালে সুইস গ্রাম মন্ট পেলেরিন (Mont Pèlerin) এ একটি ছোট্ট থিংক ট্যাঙ্ক এর গোড়াপত্তন ঘটে। দার্শনিক ফ্রেডরিক হায়েক এবং অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান এর মত স্ব-ঘোষিত ‘নয়া-উদারবাদী’রা মন্ট পেলেরিন পরিষদের (Mont Pèlerin Society) এর সভ্য ছিলেন।

ঠিক যুদ্ধপরবর্তী সময়টাতে, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ, কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্রের ধারণা, উচ্চহারের কর এবং সবল সামাজিক সুরক্ষা জালের সমর্থক জন মেয়নার্ড কেনিস (John Maynard Keynes) এর ধারণা দ্বারা বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদই প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেখানে নয়া-উদারবাদীরা ভয় পাচ্ছিলেন এই ধারণা মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করবে। সুতরাং তারা বিদ্রোহ করে বসলেন।

মন্ট পেলেরিন পরিষদের সভ্যগণ জানতেন তাদের অনেকটা পথ পেরুতে হবে। তাদের এই নয়া ধারণা জনগণের মধ্যে প্রচললিত হতে ‘এক প্রজন্ম বা তারও বেশি সময়’ লেগে যেতে পারে বলে মনে করতেন হায়েক। তিনি আরও বলেন ‘আর এজন্যই সমসাময়িক ঘটনাবলিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা-ধারাকে অক্ষম মনে হচ্ছে’।

ফ্রিডম্যানও একই কথা বলছিলেন “বর্তমানে যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা মূলত দুই দশক আগে কলেজ জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যান ধারণাকেই বহন করে চলেছেন” – তাঁর মতে বেশিরভাগেরই এই চিন্তা-চেতনার ভিত্তি তৈরী হয়েছে তাদের কৈশোরকালে। ‘কেনো এখনও সেই মান্ধাতার আমলের তত্ত্বগুলো রাজনৈতিক বিশ্বে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে’’ এটা ছিল তারও বড় কারণ।

ফ্রিডম্যান মুক্ত-বাজার নীতির প্রচারক ছিলেন। তিনি নিজ-সুবিধা (self-interest) এর গুরুত্বে বিশ্বাস করতেন। যে কোন সমস্যার জন্য তাঁর একটাই সমাধান ছিলো তা হলো সরকার থেকে মুক্ত করে বাণিজ্যকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া [out with government; long live business.] অথবা সরকারের উচিৎ স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা প্রতিটি খাতকে এক একটি বাজারে পরিণত করা। যদি দরকার পড়ে, তবে বল প্রয়োগ করে হলেও। এমনকি প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়ও রিলিফ সংগঠনের দ্বায়িত্ব পাবে সেসব কোম্পানি যারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

ফ্রিডম্যান জানতেন তিনি একজন র‌্যাডিকাল। তিনি জানতেন, মূলধারা থেকে তিনি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই বিষয়টা দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হতেন তিনি। ১৯৬৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন এই আমেরিকান অর্থনীতিবিদকে বিশেষায়িত করেন ‘প্যারিসের সেই ডিজাইনার যার উচ্চদরের ফ্যাশনেবল পোশাক (haute couture) হয়ত খুব কম মানুষই কিনেছেন, কিন্তু এর প্রভাব ছুঁয়ে গেছে প্রায় সকল জনপ্রিয় ফ্যাশনকেই’।   

ফ্রিডম্যানের চিন্তায়, সংকট একটি গুরুত্বর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। তাঁর ক্যাপিটালিজম এ্যান্ড ফ্রিডম (১৯৮২) এ তিনি সেই বিখ্যাত কথাগুলো লিখেন,

‘শুধুমাত্র একটি সংকট- বাস্তব অথবা অনুভূত – সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসে। যখন কোন সংকট উপস্থিত হয়, তখন প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে (The ideas that are lying around) কেন্দ্র করেই কর্মপদ্ধতি নির্ধারিত হয়।’

বিরাজমান প্রচলিত চিন্তাভাবনা । ফ্রিডম্যানের কথানুযায়ী, একটি সংকটকালে যা যা ঘটে তা আসলে ইতোমধ্যে বিদ্যমান ভিত্তির উপর নির্ভর করেই ঘটে। তারপর একদা যে ভাবনাগুলোকে অবাস্তব বা অসম্ভব বলে খারিজ করা হয়েছিল সেগুলো অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

মিল্টন ফ্রিডম্যান

এবং এমনটাই কিন্তু ঘটেছিলো। নয়া-উদারবাদীরা ১৯৭০ এর সংকটকালের (অর্থনৈতিক সংকোচন, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওপেক কর্তৃক তেলের উপর বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা) জন্য প্রস্তুত এবং ওত পেতে বসে ছিলেন। ঐতিহাসিক আঙ্গুস বার্জিন বিষয়টি নিয়ে এক কথায় এভাবেই বলেন, ‘সকলে মিলে তড়িৎগতিতে বৈশ্বিক-নীতিতে একটি রূপান্তর নিয়ে আসেন।’ রক্ষণশীল দলগুলোর নেতা যেমন, ইউ এস প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার, হায়েক ও ফ্রায়েডম্যানের একসময়ের সেই র‌্যাডিকাল চিন্তাধারাকেই নিজেদের জন্য গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, একই ভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও যেমন বিল ক্লিনটন এবং টনি ব্লেয়ার সময়ে সময়ে এই নীতিকে গ্রহন করেছেন।

বিশ্বজুড়ে একের পর এক সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারীকরণ করা শুরু হয়। ইউনিয়নগুলোতে সঙ্কোচন শুরু হয়, সাথে সামাজিক কল্যাণ তহবিল কেটে ফেলা হয়। রিগান বলেন ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে ভয়াবহ ৯টি শব্দ হলো “আমি সরকারী মানুষ এবং এখানে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি”। এমনকি ১৯৮৯ সালে কমিউনিজম পতনের পর, স্যোশাল ডেমোক্রেটরাও সরকারের উপর আস্থা হারাতে শুরু করেন। মজার বিষয় হলো ১৯৯৬ সালের স্টেট অব দ্যা ইউনিয়ন (State of the Union) বক্তব্যেও, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ঘোষনা করেন “বৃহৎ সরকারের যুগ শেষ”।

নয়া-উদারবাদী ধারণা প্রথমে সাংবাদিক, সেখান থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে জনগণের মাঝে ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়ছিলো। ২০০২ এর এক রাতের খাবারের দাওয়াতে, থেচারকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কী প্রশ্ন করা হলে, তার উত্তর ছিলো ‘টনি ব্লেয়ার ও নিউ লেবার। আমরা আমাদের বিরোধীদলকে তাদের মন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছি।’

ফ্রেডরিখ হায়েক

এরপর এলো সেই ২০০৮ সাল।

১৫ সেপ্টেম্বর, সেই অর্থনৈতিক মহা-মন্দার পর এই প্রথম ইউএস ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স এর হাত ধরে উন্মোচিত হলো চরম অর্থনৈতিক সংকট, যখন এই তথাকথিত ‘মুক্ত’ বাজারকে বাঁচাতে প্রয়োজন হলো সরকারী সহায়তার। মনে হচ্ছিলো এটা নয়া-উদারবাদের পতনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কিন্তু, ২০০৮ ও এই ঐতিহাসিক পটপরির্তন ঘটাতে পারে নাই। একের পর এক দেশে নির্বাচনে বাম রাজনীতিবিদদের পতন হতে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গভীর ক্ষত তৈরী হয় আর বিভাজন বাড়তে থাকে ক্রমশ। আর ওয়াল স্ট্রিটের অতিরিক্ত আয় ফুলে ফেঁপে রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলে। এবং এর ঠিক পরের বছরই দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমস বিলাসবহুল জীবনধারার জন্য একটি অনলাইন ম্যাগাজিন ‘কীভাবে খরচ করবেন’ (How to Spend It) চালু করে।

যেখানে নব্য-উদারবাদীরা ১৯৭০ এর সংকট মোকাবিলায় বছরের পর বছর নিজেদের তৈরী করেছে, অথচ তাদের সেই আহ্বান আজ শূণ্য হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। মূলত তাঁরা জানতো তারা কার বিপক্ষে। তারা জানতো তারা সংকোচন বিরোধী, তারা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কিন্তু আসলে তারা কার পক্ষে এটা কখনই পরিস্কার ছিলো না।

এখন ১২ বছর পর, সংকট আবার সম্মুখে দন্ডায়মান। এই সংকট আরও বিধ্বংসী, আরও জঘন্য এবং আরও ভয়াবহ। ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতানুযায়ী, ১৭০৯ এর  শীতের  পর ব্রিটেন আজ আবার সেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকার ১৭ মিলিয়ন মানুষ অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে অর্থ প্রাপ্তির জন্য আবেদন করেছে। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার সময়, পুরো দুবছর সময় লেগেছিলো এর অর্ধেক সংখ্যার আবেদন জমা পড়তে।

২০০৮ এর ধসের কোনো নির্দিষ্ট কারণ আমাদের জানা ছিলো না, যেখানে করোনা ভাইরাস সংকটের নির্দিষ্ট কারণ আমাদের জানা। সেসময় আমাদের বেশিরভাগের কাছেই ‘collateralised debt obligations’ অথবা ‘credit default swaps’ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না, সেখানে অন্তত এবার জানি যে ভাইরাস বিষয়টি আসলে কী? উপরন্তু ২০০৮ পরবর্তী সময়ে বেপরোয়া ব্যাঙ্কাররা, সংকটের দায় চাপিয়ে দিয়েছিলো ঋণগ্রহীতাদের উপর (debtors), কিন্তু সেই কৌশল এবার আর চোখে ধুলো দিতে পারছে না।    

কিন্তু ২০০৮ এবং আজকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য কী? বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি। বিরাজমান প্রচলিত চিন্তা ধারণা যদিফ্রিডম্যান সঠিক হয়ে থাকেন এবং একটি সংকট অচিন্তনীয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, তাহলে এই সময়ে এসে ইতিহাসকে একটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে হয় বইকি।

১৯৮০ সালের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। সাথে রয়েছেন তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টাবৃন্দ: ওয়াল্টার রিস্টন, মিল্টন ফ্রিডম্যান, ড্যারিল ট্রেন্ট, জর্জ শালজ, এলান গ্রিনস্প্যান। ছবি: বেটম্যান/গ্রেটি

তিন বিপদজ্জনক ফরাসী অর্থনীতিবিদ:

‘যুবসমাজ অর্থনীতি ও পুঁজিবাদকে কীভাবে দেখে এর পেছনে তিন অতি-বাম অর্থনীতিবিদের প্রভাব রয়েছে’ এমনই শিরোনাম ২০১৯ এর অক্টোবরে হাজির করেছিলো একটি অতি-ডান ওয়েবসাইট। এটি  হলো সেই ধরণের লো-বাজেটের ব্লগ, যেগুলো ভুয়া সংবাদ ছড়াতে অত্যন্ত পটিয়সী। কিন্তু ফরাসী ত্রয়ী অর্থনীতিবিদের প্রভাব সম্পর্কিত এই শিরোনাম একদম খাপে খাপ মিলে গিয়েছিলো।   

আমার মনে আছে, যখন প্রথমবার এই ত্রয়ীর একজনের নাম আমি জানতে পেরেছিলাম, থমাস পিকেটি। ২০১৩’র শরতে আমি ব্রানকো মিলানোভিচ (Branko Milanović) এর ব্যক্তিগত ব্লগটি ব্রাউজ করছিলাম। মাঝে মাঝেই আমি তাঁর ব্লগে ঢু মারতাম, কারণ মজার বিষয় ছিলো, ব্লগে তিনি তাঁর সহকর্মীদের সমালোচনা হাজির করতেন। কিন্তু এই বিশেষ পোস্টটিতে মিলানোভিচ হঠাৎই এক অন্য সুরে কথা বললেন। এইমাত্রই তিনি ৯৭০ পৃষ্ঠার একটি ফরাসী বই পড়ে শেষ করেছেন, এবং সেই বইটিরই সুনাম করছিলেন। বলছিলেন এটা ছিলো ‘অর্থনৈতিক চিন্তার এক সন্ধিক্ষণ’।

মিলানোভিচ একজন অন্যতম অর্থনীতিবিদ যিনি অনেক দিন ধরেই ‘বৈষম্য’ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তাঁর তাবৎ আগ্রহকে ‘বৈষম্য’ গবেষণার দিকে ধাবিত করেছিলেন। অথচ তার সমসাময়িকদের বেশিরভাগই এইদিকে পা মাড়াননি। ২০০৩ সালে, নোবেল লরিয়েট রবার্ট লুকাসও বলেছিলেন, বণ্টন বিষয়ক গবেষণা ছিল ‘সাউন্ড ইকোনমিক্স’ এর জন্য ‘সবচাইতে বিষাক্ত’ বিষয়।  

অবশ্য ইতিমধ্যে পিকেটি তাঁর যুগান্তকারী কাজটি শুরু করে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে তাঁর রহস্যময় বইটি প্রকাশিত হলো যেখানে আমেরিকার সর্বোচ্চ ধনীদের, যারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ, তাদের সম্পদের পরিমান গ্রাফ আকারে প্রকাশ করলেন। কাজটিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসী ত্রয়ীর দ্বিতীয়জন ইমানুয়েল সায়েজ (Emmanuel Saez)। সায়েজ তাঁর গবেষণায় দেখান আমেরিকার বর্তমান বৈষম্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, ঠিক যেমনটা ছিলো বিশের প্রবৃদ্ধির (roaring twenties) সময়ে। এবং এই একাডেমিক কাজটিই ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট – ‘‘আমরা ৯৯ শতাংশ’’ আন্দোলনটিকে অনুপ্রাণিত করেছিলো।

২০১৪ সালে এসে পিকেটি পৃথিবীতে ঝড় তুলে দেন। এই প্রফেসর একেবারে ‘‘রকস্টার অর্থনীতিবিদ’’ হয়ে ওঠেন। এর পাশাপাশি কারও কারও হতাশার কারণও হয়ে ওঠেন (ফাইনানশিয়াল টাইমস আক্রমনাত্বক ভাবে সমালোচনা করে)। সাংবাদিক এবং রাজেনীতিবিদদের সাথে নিজের রেসিপি ভাগ করে নিতে তিনি বিশ্ব পরিভ্রমন করেন। রেসিপির মূল  উপাদান কি? কর (taxes)।

এবং এটাই আমাদের পৌছে দিলো ফরাসী ত্রয়ীর তৃতীয়জনের কাছে, তরুণ অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জুকম্যান (Gabriel Zucman)। ২০০৮ এর যেদিন লেহম্যন ব্রাদার্স এর পতন ঘটে সেদিনই ২১ বছর বয়সী অর্থনীতির এই ছাত্র একটি ফরাসী ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। বিশ্ব অর্থনীতির এই ভয়াবহ পতন একদম কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখছিলেন ধনকুবেরদের বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা লুকিয়ে রাখা আছে লুক্সেমবার্গ বা বারমুদার মত ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোতে। কারণ করের জন্য এই দেশগুলো বেহেস্ত হিসেবে গণ্য হয়।

মাত্র দু’বছরের মধ্যে জুকম্যান পৃথিবীর এক নাম্বার কর বিশেষজ্ঞে পরিণত হলেন। তাঁর বই দ্যা হিডেন ওয়েলথ অব ন্যাশন (২০১৫)। তিনিই প্রথম বললেন যে পৃথিবীর তাবদ সম্পদের ৭.৬ ট্রিলিয়ন ডলার লুকানো আছে এই করের স্বর্গরাজ্যে। এবং ইমানুয়েল সায়েজ এর সাথে লেখা আরেকটি বইয়ে তিনি দেখান, আমেরিকার ৪০০ জন ধরকুবেরের থেকে, দেশের অন্যান্য আয়ের মানুষ; মিস্ত্রি থেকে ক্লিনার, নার্স বা অবসরপ্রাপ্তদের কর দেয়ার হার অনেক বেশি।  

তরুণ এই অর্থনীতিবিদকে তাঁর যুক্তিতে পৌঁছাতে খুব অল্প শব্দই ব্যবহার করেছেন। তাঁর পরামর্শদাতা পিকেটি ২০২০ সালে সম্ভাবনার আরেকটি দরজা খুলে দেন (১০৮৮ পৃষ্ঠার বই)। কিন্তু জুকম্যান ও সায়েজের বই একদিনেই পড়ে ফেলা যায়। বইয়ের উপশিরোনামই যথার্থ: ‘‘ধনীরা কীভাবে কর ফঁকি দেয়, এবং কীভাবে তাদের কর দিতে বাধ্য করা যায়’’; যেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টের টু-ডু লিস্টের মতো।

থমাস পিকেটি

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তাহলে কী? মাল্টিমিলিয়নিয়ারদের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন সম্পদ কর পাস করানো। দেখা গিয়েছে, উচ্চকর অর্থনীতির জন্য মন্দ নয়। বিপরীতে, বেশি কর প্রদান পুঁজিবাদকে সফলভাবে চালনা করে। (১৯৫২ সালে আমেরিকায় আয়কর বন্ধনীর মাত্রা ছিলো প্রায় ৯২ শতাংশ, সেবছর অর্থনীতি অন্য যে কোন বারের চেয়ে অনেক বেশি সচল ছিলো)

পাঁচ বছর আগেও এই ধারণাগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত র‌্যাডিকাল মনে করা হতো। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবাবামার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তাঁকে নিশ্চিত করেছিলেন, সম্পত্তি কর কখনও কাজ করবে না এবং ধনীরা (তাঁদের আইনজীবি ও হিসাবরক্ষকদের বহরসহ) সারাজীবনই কোন না কোনভাবে তাদের সম্পদ লুকানোর জায়গা খুঁজে বের করবে। এমনকি বার্নি স্যান্ডার্স ২০১৬ তে নির্বাচনী লড়াইয়ের সময় ফরাসী ত্রয়ীর সম্পদ কর তৈরীতে সাহায্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ২০১৬ তে ধারণাগত অবস্থান আজকের থেকে অনেক আলাদা ছিলো। ২০২০ সালে স্যান্ডার্স এর ‘‘মধ্যপন্থী’’ বিরোধী জো বাইডেন, হিলারী ক্লিনটনের চার বছর আগের পরিকল্পনার মতই করের পরিমান দ্বিগুন করার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এই মুহুর্তে, বেশিরভাগ আমেরিকান ভোটারই (রিপাবলিকানরা সহ) উল্লেখযোগ্যভাবে ধনকুবেরদের ওপর উচ্চ কর আরোপের পক্ষপাতী। এমনকি এই মতাদর্শে সর্বশেষ সংযোজন সম্পূর্ণ অন্য ধারার দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমসের মন্তব্য যে, সম্পদ করের ধারণা আদতে মন্দ কিছু নয়।

বিলাসী সমাজতন্ত্রকে [champagne socialism] ছাড়িয়ে:

থ্যাচার উপহাস করে বলেছিলেন যে, ‘সমাজতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে যে আপনি অন্যের টাকায় চলার ধান্ধা করেন’।

থ্যাচার একেবারে ক্ষতের জায়গাটাতে হাত দিয়ে বসেন। বামপন্থী রাজনীতিবিদরা কর ও বৈষম্য নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা থেকে। দুই রাজনৈতিক দলেরই ধারণা যে, বেশিরভাগ সম্পদ জেফ বেজোস এবং এলন মাস্কের মতো শীর্ষস্থানীয় দূরদর্শী উদ্যোক্তাদের দ্বারা ‘উপার্জিত’ হবে। এবং এখানে এসে তারা নৈতিক প্রশ্ন তোলে যে এই ধনকুবেরদের কী উচিৎ নয় তাদের বিশাল সম্পদ থেকে কিছুটা বিতরণ করা?

যদি আপনার বোঝাপড়াও এমনটাই হয়, আমি আপনাকে এই সময়ের একদন দূরদূর্শী অর্থনীতিবিদ মারিয়ানা মাজুকাটোর (Mariana Mazzucato) সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। মাজুকাটো সেই প্রজন্মের অর্থনীতিবিদ, যারা বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র কর নিয়ে আলাপ আলোচনাই যথেষ্ট নয়। মাজুকাটো আর বলেন, প্রগতিশীলরা অনেক ক্ষেত্রেই তর্কে হেরে যায়, ‘‘কারণ তারা সম্পদ তৈরী বা উৎপাদনের চেয়ে সম্পদ পুনঃবণ্টনের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে ফেলে।’’ 

বিগত কয়েক সপ্তাহজুড়ে সারা বিশ্বেই ‘প্রয়োজনীয় কর্মজীবি’দের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এবং মজার বিষয়, প্রতিবন্ধক তহবিল ম্যানেজার (hedge fund manager) এবং বহুজাতিক কর পরামর্শক (multinational tax consultant) এর নাম, এই তালিকার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই এটা সবার সামনে পরিস্কার হয়ে যায় যে কারা আদতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গণপরিবহন এবং মুদির দোকানে বসে সত্যিকারের কাজগুলো করে।

২০১৮ সালে দুই ডাচ অর্থনীতিবিদেদর করা এক গবেষণায় দেখা যায় কর্মরত মানুষের এক চতুর্থাংশই মনে করে তাদের কাজগুলো আদতে সামাজিকভাবে অর্থহীন। এবং অবাক করা বিষয়, বিজনেস জগতে এমন মনে করা চাকুরীজীবির সংখ্যা পাবলিক খাতের থেকে আরও চারগুন বেশি। এই বিশাল সংখ্যার মানুষজন যারা নিজের চাকুরীকে ‘‘আজাইরা কাজ’’ (bullshit jobs) বলে আখ্যা দিয়েছেন, তাদের বিশাল অংশই ফাইনান্স ও মার্কেটিং এর মত সেক্টরে কাজের সাথে যুক্ত।

এই পরিস্থিতি আমাদেরকে যে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা হলো, সম্পত্তি মূলত উৎপন্ন হয় কোথা থেকে? দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমস এর মত পত্রিকাগুলো অবশ্য তাদের নয়া উদারবাদী গুরু ফ্রিডম্যান এবং হায়েক এর মত প্রায় দাবি করে যে, সম্পদ উৎপাদিত হয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে নয়। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে বড়জোর সাহায্যকারীর ভূমিকা নিতে পারে। তাদের কাজ শুধু সুন্দর অবকাঠামো আর আকর্ষণীয় কর বসানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ- এবং এরপর রাষ্ট্রের কাজ হলো দূরে গিয়ে বসে থাকা।  

কিন্তু, ২০১১তে এসে যখন অজস্র রাজনীতিবিদ এক সুরে সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তারাদেরকে ‘ব্যবসার শত্রু’ বলে আখ্যা দিতে থাকলেন, তখনই মাজুকাটোর মাথায় একটা বিষয় আঘাত করলো, এবং তিনি তৎক্ষণাত গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই বছর পরে তিনি যে বই প্রকাশ করলেন তা নীতি নির্ধারকদের দুনিয়া কাঁপিয়ে দিলো। বইয়ের নাম ‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ (The Entrepreneurial State)।

বইটিতে, মাজুকাটো দেখালেন সরকারের কাজ শুধু স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ময়লা সংগ্রহ এবং চিঠি পৌঁছে দেয়ার মধ্যে সীমিত নয়, বরং লাভজনক এবং সত্যিকারের উদ্ভাবনগুলোও মূলত সরকারের হাত ধরেই ঘটেছে। ধরেন আইফোন। এই আইফোনের একটি বোকাফোন থেকে স্মার্টফোন (ইন্টারনেট, জিপিএস, টাচস্ক্রিন, ব্যাটারি, হার্ড ড্রাইভ, ভয়েজ রিকগনিশন) হয়ে ওঠার যাত্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ই সরকারী অর্থায়নে গবেষণায় তৈরী হয়েছে।

এবং অ্যাপলে মত অপর প্রযুক্তি দানবদের (tech giants) ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গুগল? সার্চ ইঞ্জিন এর জন্য মোটা টাকা অনুদান নিয়েছে তারা। টেসলা? বিনিয়োগকারীর জন্য হাহাকার করেছে যতক্ষণ না ইউএস এর জ্বালানী অধিদপ্তর তাদের ৪৬৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান দিয়েছে। (এলন মাস্ক বরাবরই অনুদানের জন্য লালায়িত, তিনি তাঁর তিনটি প্রতিষ্ঠান- টেসলা, স্পেস এক্স এবং স্কলারসিটির জন্য সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ৫ বিলিয়ন সরকারী করের টাকা গ্রহণ করেছেন।)  

মাজুকাটো, টেক পত্রিকা ওয়্যারডকে (Wired) দেয়া এক সাক্ষ্যাৎকারে বলেছেন ‘আমি যতই দেখছিলাম, ততই বুঝতে পারছিলাম সর্বক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ রয়েছে’।

২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে অর্থনীতিবিদ মারিয়ানা মাজুকাটো; ছবি: ইপিএ

এটা সত্যি যে, সরকার অনেক সময় এমন খাতেও বিনিয়োগ করে যেখান থেকে অর্থপ্রাপ্তির কোন রকম সম্ভাবনা থাকে না। ধাক্কা খাবার মত, তাই না? কিন্তু বিনিয়োগ এমনই হওয়া উচিৎ। ঝুঁকি নিয়েই উদ্যোগ (Enterprise) নিতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তি ‘‘উদ্যোগ’’ বিনিয়োগে কোন ধরণের ঝুঁকি নিতে চায় না। ২০০৩ এ সার্স প্রাদুর্ভাবের পর, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা করোনা গবেষণা থেকে খুব দ্রুত নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র এখান থেকে লাভের কোন উপায় নেই বলে। ইতোমধ্যে, সরকারী অনুদানে গবেষণা চলছে, যে গবেষণার জন্য মার্কিন সরকার প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। (যদি এবং কখনও ভ্যাকসিন আবিস্কার হয়, আপনাকে সরকারের কাছেই কৃতজ্ঞ থাকতে হবে)।

কিন্তু ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির কেসের উদাহরণই মাজুকাটোর কাজকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। বেশিরভাগ মেডিকেলই তাদের প্রাথমিক বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করে সরকারী অর্থায়নে ল্যাবরেটরির নাম ভাঙ্গিয়েই। রোচে (Roche) ও ফিজার (Pfizer) এর মত বিশাল বিশাল ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো খুব বেশি হলে প্যাটেন্টটা কিনে নেবে এবং পরবর্তীতে পুরোনো ঔষধগুলোই নতুন ব্রান্ডের নাম লাগিয়ে বিক্রি করবে পরিশেষে লাভের অংশ ব্যায় করবে সুদের টাকা পরিশোধ করতে (স্টক মার্কেটে দাম বাড়াতে যা খুব কার্যকর।) আর এভাবেই ২০০০ সালে থেকে এখনও পর্যন্ত ২৭ টি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যালস তাদের শেয়ার হোল্ডারের টাকা পরিশোধ করে আসছে।

মাজুকাটোকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এটা পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, যখন সরকার বড় বড় আবিষ্কারগুলোকে অর্থায়ন করে, ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে অবশ্যই এখানে স্বাগতম। আর কী, এখানেই পূর্নাঙ্গ আইডিয়া! এরপরই সরকারকে তার প্রাথমিক ব্যয়টুকু, সুদ সহ ফেরত দিতে হবে। এটা অদ্ভুত যে এখন যে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো এখন বিশাল বিশাল হ্যান্ডআউট পাচ্ছে, তারাই সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপী। আর অ্যাপল, গুগল, ফিজারের মত কর্পোরেশনগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুকিয়ে রেখেছে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা করের স্বর্গরাজ্যগুলোতে।

এ বিষয়ে কোন প্রশ্নই নেই যে, কোম্পানিগুলো তাদের ট্যাক্সের মাধ্যমে একটি বড় অংশ সরকারকে প্রদান করবে। কিন্তু মাজুকাটো বলছেন, এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ যে সরকার তার নিজের অর্জনের কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। মাজুকাটোর প্রিয় উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা হলো ১৯৬০ এর মহাশূণ্য যাত্রা। ১৯৬২ সালে বক্তব্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কেনেডি বলেছিলেন, ‘এমন নয় যে কাজগুলো সহজ বরং কঠিন বলেই এই দশকে আমরা চাঁদে অভিযানসহ আরও কিছু কাজ করেছি’।

এই সময়ে বা এই যুগে আমাদের জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হলো, আমরা উদ্যোক্তা রাষ্ট্রের কাছে অতুলনীয় উদ্ভাবনী সক্ষমতা দাবী করতে থাকি।  শুরুতেই, মানবজাতিকে যেকোন সময়ের থেকে এখন প্রথমবারের মত যে জরুরী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা হলো : জলবায়ু পরিবর্তন। কেনেডির বক্তব্যের মতই এখন আমাদের মানসিকতাকে মহিমান্বিত করার সময় এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা যেন প্রয়োজনীয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে পারি। এটা কোন দূর্ঘটনা নয় যে, মাজুকাটোর পাশাপাশি ব্রিটিশ-ভেনিজুয়েলান অর্থনীতিবিদ কার্লোটা পেরেজকে (Carlota Perez), জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নতুন সবুজ চুক্তির জননী বলা হচ্ছে।

মাজুকাটোর আরেক বন্ধু, ইউএস অর্থনীতিবিদ স্টেফানি কেলটন (Stephanie Kelton) আরও যুক্ত করেন যে, সরকার তার উচ্চাকাঙ্খা এবং ঘাটতি পূরণের জন্য, জাতীয় ঋণ এর কথা মাথায় না রেখে অতিরিক্ত টাকা প্রিন্টও করতে পারে। (মাজুকাটো ও কেল্টনদের পুরোনো ধারার রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের শোনার ধৈর্য্য ছিল না, যারা কিনা সরকারকে গেরস্থালির সাথে তুলনা করতেন। হাজার হোক, গেরস্থালি আপনাকে নিজ মুদ্রায় ঋণ দেয়া বা ক্রেডিট ইস্যু করার মত কাজগুলো করতে পারে না।)

আমরা এখানে যা আলোচনা করছি তা আদতে অর্থনীতিতে বিপ্লবের চিন্তাভাবনার থেকে কম কিছু নয়। ২০০৮ এর সংকট এসেছিলো ভয়ানক দৃঢ়তার (austerity) হাত ধরে, আর এখন আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন আর অন্য কেউ নয়, বরং খোদ দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমস কেলটন (সেই লেখক, যিনি কথাচ্ছলে বলে ফেলার মতো তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন, দ্যা ডেফিসিট মিথ) এর মত অর্থনীতিবিদকে প্রশংসা করছে নতুন দিনের মিল্টন-ফ্রিডম্যান বলে। এবং যখন এই এপ্রিলের শুরুতে এসে লেখা হলো যে সরকারের উচিৎ পাবলিক সার্ভিসকে দায় হিসেবে ভাবার চেয়ে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে, যা কিনা বিগত বছরগুলো ধরে মাজুকাটো ও কেলটন ক্রমাগতই বলে আসছিলেন।

কিন্তু এই নারীদের সবচেয়ে মজার জায়গা হলো, কথায় চিড়ে ভেজানো কৌশলে তাঁরা ভরসা করেন না। বরং তারা ফলাফলে বিশ্বাসী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কেলটন একজন রাজনৈতিক উপদেষ্টা, পেরেজ অসংখ্য কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন, এবং মাজুকাটো যোগাযোগে অত্যন্ত পটু একজন ব্যক্তি, যিনি বিশ্বজুড়ে তাঁর অবস্থানটা জানেন।

সে যে শুধু দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (যেখানে পৃথিবীর তাবৎ ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা একত্রিত হয়) নিয়মিত অতিথি তাই নয়, বরং এই ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ ইউএস সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন (Elizabeth Warren) এবং কংগ্রেসের অপর নারী আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কারটেজ (Alexandria Ocasio-Cortez) এবং স্কটিশ ফাস্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন এর মত রথী মহারথীদের নিয়মিত পরামর্শও দিয়ে থাকেন। এবং গত বছর ইউরোপিয়ান সংসদ একটি উচ্চাভিলাষী উদ্ভাবনী প্রোগ্রাম পাশ করার জন্য যে ভোট করছিলো, সেই ড্রাফটিও মাজুকাটোরই করা।

‘প্রভাব রেখে যায় এমন কাজই আমি করতে চাই’, খুব আনন্দের সাথেই বললেন এই অর্থনীতিবিদ। ‘নাহলে তো এটা বিলাসী [শ্যাম্পেনের] সমাজতন্ত্রের মত হয়ে যাবে। আপনি যাবেন, যখন তখন কথা বলবেন, কিন্তু কোনো কিছুই ঘটবে না’

কীভাবে আইডিয়া পৃথিবীকে জয় করবে?

একদল প্রগতিশীলকে এই প্রশ্ন করুন, কিছুদিন আগে পর্যন্তও সকলে জোসেফ ওভারটন (Joseph Overton) এর কথা বলতো। তিনি নিও-লিবারাল থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করতেন, এবং বছরের পর বছর ছোট সরকার স্বল্প-করের স্বপক্ষে প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। তার আগ্রহের জায়গা ছিলো যেসব বিষয় আমাদের ভাবনায়ও আসে না, সেসবই  কীভাবে একসময় বাস্তবে এড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়।  

‘মনে করেন একটা জানালা’ ওভারটন বলতেন, সেই জানালার মধ্য দিয়ে যেসব আইডিয়া ভেতরে এসে পড়ত সেগুলোকেই আমরা ‘গ্রহণযোগ্য’ বা কখনও কখনও ‘জনপ্রিয়’ হিসেবে ভাবতাম। আপনি যদি একজন রাজনীতিবিদ হন, যিনি পুনরায় নির্বাচিত হতে চান, আপনার জন্য ভালো হলো এই জানালার মধ্যেই থাকা। কিন্তু আপনি যদি পৃথিবীকে বদলে দিতে চান, আপনার জানালাটাকে পরিবর্তন করতে হবে। কীভাবে? দেয়ালগুলো সরিয়ে পরিসর বড় করার মধ্য দিয়ে। এবং অকারণ, অসহনীয় এবং অবাস্তব হবার মধ্য দিয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে ওভারটনের জানালা অনস্বীকার্যভাবে পাল্টে গেছে। তখন যা প্রান্তিক ছিলো, এখন তা মূলধারা হয়ে উঠেছে। একজন ফরাসী অর্থনীতিবিদের রহস্যময় গ্রাফ এখন ওয়াল স্ট্রিট অকুপাই এর শ্লোগান হয়ে উঠেছে (‘আমরাই ৯৯ শতাংশ’)। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেয়ার পথ সুগম করেছে, এবং বার্নি সেন্ডার্স, বাইডেন এর মত অন্যান্য রাজনীতিকদেরও নিজের পথে টানতে পেরেছেন।

এখনকার সময়টাতে তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে পুঁজিবাদের চেয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে- যেটা ৩০ বছর আগে কল্পনাতীত ছিলো। (১৯৮০ এর প্রথম দিকে রিগানের ভোটারদের বড় অংশই ছিলো নয়া-উদারবাদী এই তরুণ সমর্থকরা)।

কিন্তু স্যান্ডার্স কী প্রাথমিকে (primaries) হেরে যায়নি? এমনকি গত বছর যুক্তরাজ্যে সমাজতান্ত্রিক প্রার্থী জেরেমি করবিন (Jeremy Corbyn) কী নাটকীয়ভাবে হেরে যাননি?

অবশ্যই, কিন্তু শুধু নির্বাচনী ফলাফলই সময়কে চিহ্নিত করে না। করবিন ২০১৭ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন, কিন্তু রক্ষণশীল নীতি নিজেদের মেনিফেস্টোর থেকে লেবার পার্টির আর্থিক পরিকল্পনার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো।

ঠিক তেমনি, সেন্ডার্স ২০২০ এ জলবায়ু সংক্রান্ত আরও বেশি র‌্যাডিকাল পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, বাইডেনের জলবায়ু পরিকল্পনা ২০১৬ সালে স্যান্ডার্স এর পরিকল্পনার চেয়ে বেশি র‌্যাডিক্যাল ছিলো।

থেচার যখন তার সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে ‘নিউ লেবার এবং টনি ব্লেয়ারের’ কথা বলেছিলেন তখন তিনি মোটেও মজা করছিলেন না। ১৯৯৭ সালে যখন তাঁর দল হেরে গিয়েছিলো, তখন তাঁর প্রতিপক্ষীয় এক নারীর আইডিয়াই জয়ের কারণ হয়েছিলো। পৃথিবীকে পাল্টে দেয়া আদতে একটি ধন্যবাদহীন কাজ। বিজয়ের কোন মুহুর্তেই আপনার প্রতিপক্ষ স্বীকার করবে না যে আপনিই সঠিক ছিলেন। রাজনীতিতে আপনি সেরা যে জিনিসটা আশা করতে পারেন তা হলো নকল করা। ফ্রিডম্যান এটা ১৯৭০ সালেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যখন তিনি একজন সাংবাদিককে ব্যাখ্যা করছিলেন, কীভাবে তার আইডিয়া পৃথিবীকে জয় করবে। চারটি পদ্ধতিতে এটা কাজ করবে:

‘অ্যাক্ট-১ আমার মত ছিটগ্রস্থ মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত এড়িয়ে চলা হয়।

অ্যাক্ট-২ গোড়া বিশ্বাসী এবং এদের ঘরানার লোকজন এই ধারণাগুলোর কারণে অস্বস্তিতে পড়ে কারণ এগুলো শুধু নিছক ধারণা নয়, এর মধ্যে সত্যও রয়েছে।

অ্যাক্ট-৩ লোকে বলে ‘আমরা সবাই জানি, এটা আসলে একটা অবাস্তব এবং চরম তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে অবশ্যই আরও সহনীয় পন্থা খুঁজে বের করতে হবে।’

অ্যাক্ট-৪ বিরোধীদল আমার আইডিয়াকে নিয়ে গতানুগতিক ব্যাঙ্গচিত্র বানাবে, যেন তারা বিরোধীতা করার জন্য মাঠে নামতে পারে, ঠিক যে জায়গায় আমি আগে দাঁড়িয়ে ছিলাম।‘

যদিও সব বিশাল আইডিয়াগুলোই ছিটগ্রস্থদের কাছ থেকেই আসে, তার মানে এই নয় ছিটগ্রস্থ মানেই বড় বড় আইডিয়ার ভান্ডার। যদিও র‍্যাডিকাল চিন্তা-ভাবনা খুব কম সময়ই জনপ্রিয় হয়, একবারের জন্যও নির্বাচনে জেতা আদতে মন্দ কিছু নয়। প্রায়ই ওভারটনের জানালাকে বামেদের হেরে যাওয়ার ছুতো হিসেবে বলা হয়ে থাকে। বিষয়টা এরকম যে, ‘অন্ততপক্ষে আমরা আইডিয়া যুদ্ধে তো জিতে গেছি’

অনেক স্বঘোষিত ‘র‌্যাডিকাল’দের ক্ষমতায় যাবার জন্য একটি আধা-খাচরা পরিকল্পনা থাকে, যদি সত্যিকার অর্থেই তাদের কোন পরিকল্পনা থেকে থাকে। কিন্তু এটাকে সমালোচনা করলেন তো আপনি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবেন। সত্যি বলতে কি বামেদের অন্যের উপর, প্রেসের, প্রতিষ্ঠানের উপর দোষ চাপানো, আর নিজেদের মর্যাদাক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলার এই চরিত্র বহু পুরোনো- কিন্তু খুব কম সময়ই এরা দায়- দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।

পৃথিবীকে বদলে দেয়া যে কত কঠিন, সেটা আবার টের পাচ্ছি বাসায় বসেই, অবশ্যই সেটা বই এর মাধ্যমেই। ব্রিটিশ সাংবাদিক হেলেন লুইস (Helen Lewis) এর ডিফিকাল্ট ওমেন (Difficult Women) বইটা আমি লকডাউনের মধ্যে বাসায় বসেই পড়ছি। ব্রিটেনে নারীবাদের ইতিহাস নিয়ে লেখা এই বইটি, তাদের সকলেরই পড়া উচিৎ, যারা একটি উন্নত পৃথিবীর জন্য লড়াই করছে।

‘কঠিন’ বলতে লুইস তিনটি বিষয়ের কথা বুঝিয়েছেন:

১. পৃথিবীকে পরিবর্তন করা কঠিন। ফলে আপনাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

২. অনেক বিপ্লবীই অনেক কড়া/বেয়াড়া। প্রগতি শুরুই হয় আসলে জেদী, যাচ্ছেতাই আর স্থিতিবস্থায় অস্থিরতা তৈরী করে এমন মানুষের হাত ধরে।

৩.  ভালো করছেন মানেই আপনি নিঁখুত বিষয়টা এমন না। ইতিহাসের খুব কম বীরই আসলে একদম দাগহীন, যেমন তাদেরকে ইতিহাসে আমরা বানিয়ে তুলি।

লুইস সমালোচনা করছেন যে প্রচুরে এক্টিভিস্ট এই জটিলতাকে এড়িয়ে আলাপ পাড়তে চান ফলে আলোচনাগুলো তার গুরুত্ব হারায়। টুইটারে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে সাধারণত মূল বক্তব্যের থেকে অপরের টুইট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কতেই বেশি দেখা যায়। ফলে, দেখবেন গতকালের হিরো পরেরদিনই কোন বিতর্কের ফেরে পড়ে তার অবস্থান হারিয়ে ফেলেছেন।

লুইস বলছেন যেকোন আন্দোলন করার জন্য আলাদা আলাদা ভূমিকা থাকে। প্রয়োজনে কখনও অস্বস্তিকর-জোটও গঠন করতে হতে পারে। যেমন ব্রিটেনে ভোটাধিকারের আন্দোলনে (British suffrage movement), ‘নানা শ্রেনীর নারীরা, জেলেনি থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী, মিলের মেয়ে থেকে ভারতীয় রাজকন্যা’ এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন জটিল সমন্বয়ই ১৯১৮ সালে সম্পদে মালিকানা আছে এমন ত্রিশোর্ধ নারীর ভোটের অধিকার ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলো।

(এটা সত্য যে প্রাথমিকভাবে, শুধু সুবিধাপ্রাপ্ত নারীরাই ভোটাধিকার অর্জন করেছিলো। কিন্তু এটা প্রমানিত যে এই বিচক্ষণ আপোস, এবং প্রাথমিক পদক্ষেপ নেবার কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবে পরবর্তী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো ১৯২৮ সালে। যখন পৃথিবীর সকল নারী ভোটাধিকার লাভ করেছিলো)

কিন্তু না, তাদের এই সফলতা কিন্তু সকল নারীবাদীদের বন্ধু বানাতে পারেনি। কিন্তু তাও, লুইসের মতে ‘তারপরও সেই আন্দোলনকারী নারীরা তাদের তাবত ব্যক্তিত্বের সংঘাতসহ সেই বিজয়কে উৎযাপন করেছিলো।’

প্রগতি আসলে জটিলতার মধ্য দিয়েই লব্ধ হয়।

ছবি: সেসিল জিরাডিন/আইআইইডি

কিন্তু যেভাবে আমরা আন্দোলনের পাঠ সারতে চাই, সেখানে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকার জায়গাটা ভুলে যাবার প্রবণতা আছে। আমাদের বোঝাপড়াগুলো আটকে থাকে টক-শো আর খাবার টেবিলের চারপাশে। আমরা গ্রেটা থানবার্গকে স্তুতি করি, একই সাথে বিলুপ্তি বিদ্রোহ (Extinction Rebellion) এর মত জলবায়ু আন্দোলনকে গালমন্দ করি। আমরা ওয়াল স্টিট অকুপাইয়ের আন্দোলনকারীদের সমর্থন দেই কিন্তু দাভোসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা লবিস্টদের অবজ্ঞা করতে থাকি।

আসলে এভাবে পরিবর্তন আসেনা। সব মানুষের আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। শিক্ষক এবং নৈরাজ্যবাদী, যোগাযোগকারী বা আন্দোলনকারী, উষ্কানী দাতা এবং শান্তির অগ্রদূত, যিনি খটোমটো একাডেমিক লেখা লিখছেন, আর যে অনুবাদক সেটা সহজ করে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, যে মানুষগুলো ঘটনার বাইরে থেকে তদবির করছে, আর যাদের দাঙ্গা পুলিশ টেনে হিঁচড়ে হাজতে পুরছে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

একটা বিষয় নিশ্চিত, এমন একটা সময় আসে যখন ওভারটনের জানালার দেয়াল ঠেলে পরিসর বড় করাটাই যথেষ্ট হয় না। এমন একটা সময় আসে যখন প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সটান হেঁটে যেতে হয়, এবং সেই আইডিয়াগুলোকে আবার সামনে হাজির করতে হয় যা ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছে একসময় অনেক র‌্যাডিকাল মনে হতো।

আমার মনে হয় সময়টা এসে গেছে।

যে মতাদর্শ গেলো ৪০ বছরে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলো, তার মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু সেই জায়গাকে দখল করবে, সেটা কেউ আসলে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে, এই সংকট হয়ত আমাদের আরও অন্ধকার পথের দিকে ঠেলে দেবে। শাসকগোষ্ঠী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করবে, জনগনের স্বাধীনতাকে আরও সীমাবদ্ধ করে ফেলবে এবং বর্ণবাদ ও ঘৃণায় আর আগুন ঢেলে দেবে।

কিন্তু বিষয়টা তো আলাদাও হতে পারে; অগণিত সক্রিয় কর্মী (activists), একাডেমিশিয়ান, আন্দোলন, যোগাযোগকারীদের জন্যই আমরা বিকল্পভাবেও চিন্তা করতে পারছি। এই অতিমারী হয়তো আমাদের নতুন কোন মূল্যবোধের জায়গায় এনে হাজির করবে।

যদি নয়া-উদারবাদকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য একটিই মতবাদ থাকতো, তাহলে সেটা হতো যে, বেশিরভাগ মানুষই স্বার্থপর। এবং মানব প্রকৃতি সম্পর্কে এই ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাকিগুলো উৎসারিত, এবং তা হলো  বেসরকারিকরণ (privatisation), ক্রমবর্ধমাণ বৈষম্য আর পাবলিক পরিসরের ক্রমশ ক্ষয়।

এখন মানব চরিত্রের আরও বেশি মানবিক ও বাস্তবিক দিকগুলো নিয়ে বিবিধ মতাদর্শিক অবস্থান নেয়ার পথগুলো খুলে গেলো। এটি নির্মিত হবে সেই দৃঢ় বিশ্বাসের উপর, যা অন্যরা অনুসরণ করতে পারবে। এমন একটি সরকার যার ভিত্তি হলো আস্থা [ট্রাস্ট], সকলের সংহতিতে নির্মিত কর ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই বিনিয়োগই আমাদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে পারে। এবং এখন যেটা করণীয় সেটা হলো এই শতকের আরও বড় পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, সেই ধীর গতির মহামারীর জন্য, মানে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। [পড়ুন রব উইনবার্গ এর নিবন্ধ: Read Rob Wijnberg’s article ‘Why climate change is a pandemic in slow motion (and what that can teach us)’.]

আমরা জানিনা এই সংকট আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলবে। কিন্তু শেষবারের তুলনায় পরের বার আমাদের অন্তপক্ষে আরও বেশি প্রস্তুত!

মূল লেখার লিংক: Rutger Bregman, The neoliberal era is ending. What comes next?, The Correspondent, 14 May 2020

  • রুটগার ব্রেগম্যান: হল্যান্ড-ভিত্তিক ইতিহাসবিদ ও লেখক
  • মনিরা শরমিন প্রীতু: শিক্ষক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *