পাশ্চাত্যের ‘সোনালী জীবন’ বনাম প্রবাসীদের আত্মত্যাগ ও দীর্ঘশ্বাসের গল্প

ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া হয়েছে।
  • লেখক: সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া

আমাদের লক্ষ-কোটি প্রবাসী শ্রমিক পরিবার-পরিজন ছেড়ে প্রবাসে এক অন্তহীন জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, অসংখ্য প্রবাসীর আয় যৎসামান্য। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া বেশিরভাগ আবার ঋণগ্রস্ত। আমি দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য শ্রমিক ভাইদের আয় দেশি মুদ্রায় ২০ হাজার টাকার কম-বেশি। ইউরোপ-আমেরিকা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু আমরা কি জানি প্যারিসের রেল স্টেশনে ফুটপাতে যে যুবককে সিডি ক্যাসেট বিক্রি করতে দেখেছি কিংবা রোমের রাস্তায় ফেরি করে সংবাদপত্র বিক্রি করা মধ্যবয়সী ব্যক্তি, অথবা নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এ ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করার মানুষগুলোর আয় কেমন? তাদের জীবনের কষ্ট, গল্পগুলো জেনেছি কখনো?

ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে ফরিদপুরের যে যুবকের সাথে একদা একসাথে থেকেছি, সে রেস্তোরাঁ ও হোটেলে দুটি চাকুরী করে। ডিভি লটারি জিতে বড় ভাই আমেরিকা এসেছিলো। বড় ভাই কাগজপত্র পেয়ে প্রায় এক যুগ পর ছোট দুই ভাইকেও নিয়ে যায়। কী সহজ, সরল যুবক! জীবনে খুব বেশি চাওয়া-পাওয়া নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ঘণ্টায় ৮-৯ ডলার করে উপার্জন। দুটি চাকুরী মিলিয়ে দৈনিক ১৪ ঘণ্টার বেশি কাজ। সাপ্তাহিক ছুটি কোনো সপ্তাহে নেয়, কখনো নেয় না। মাসে ৩৫০ ঘণ্টার বেশি কাজ করে প্রায় ৩ হাজার ডলারের আয়। সেটি যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের দেশে তার নিজের খরচ কত? বাসা ভাড়া, খাওয়া, পরিবহন – এসবের পিছনে ১০০০ বা ১৫০০ ডলার ব্যয় করে বাকী অর্থ কিছু সঞ্চয় করে আর কিছু দেশে স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজনের জন্য পাঠায়। পরিবারের ভরণ-পোষণ হয়। সন্তান স্কুলে যায়। বাবা-মায়ের ঔষধ কেনা হয়। আত্মীয়-পরিজনের জন্য ঈদের জামা-কাপড়ও হয়। কিন্তু যে মানুষটা নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে এই হাজার খানেক ডলারের সঞ্চয় দেশে পাঠায় দিন শেষে তার নিজের জন্য থাকে কেবলই স্বজনদের হাসি-আনন্দ। আর নির্মম একাকীত্ব! তার কোনো সামাজিক জীবন নেই। প্রবাসী শ্রমিকের জীবনে কোনো টিজিআইএফ নেই (TGIF – Thanks God It’s Friday – শনিবার ছুটি শুরু হওয়ার আগের রাতে পাশ্চাত্যের লোকজন বন্ধুদের নিয়ে মজা করে, আনন্দ করে। সেজন্য শুক্রবার আসায় স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানায়), বারে যাওয়া যায় না, কোনো সামাজিকতা নেই। ওসব করলে সঞ্চয় থাকে না, পরিবারকে পাঠানো টাকায় টান পড়ে!

সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আমি বিমানে এমনও মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যারা তাদের জীবনের সোনালী সময়ের পুরোটা ইতালি, ফ্রান্সে বিদেশ-বিভূঁইয়ে একা কাটিয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম: কেন? সাধারণ উত্তর ছিলো পরিবারকে সচ্ছল রাখা, সন্তানদেরকে “মানুষ” করা। আফসোস করেন? একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তার দীর্ঘশ্বাসটি বুকে বিধে রয়েছে। তিনি বলেছেন আবারও জীবনে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পেলে তিনি এমনটি করতেন না! দেশে পরিবারের সাথে যা আছে তাই নিয়ে থাকতেন! বস্টন শহরের ক্যামব্রিজে যে ভদ্রমহিলার বাসায় থাকতাম, তিনি এক বাঙালি নারী। ষাটোর্ধ বয়স। স্বামীর সাথে প্রায় ৪০ বছর আগে এদেশে এসেছিলেন। স্বামী তার উচ্চশিক্ষা শেষে আরেকটি বিয়ে করে। ওই নারী আর বিয়ে থা করেননি। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তার একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন শুরু হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ল্যাবে কাজ করেন। ২০ বছর ধরে গৃহ ঋণের কিস্তি গুনছেন। শেষ হয়ে এলো বলে। চল্লিশ বছরের প্রবাস জীবন – পরিবার-পরিজন ছাড়া! সঙ্গীটিও নেই! কেমন? জানতে চেয়েছিলাম। তিনি কবিতা ভালোবাসেন, সাহিত্য নিয়ে আলাপ করতে চান। তার না বলা, জমানো হাজারো কথা বেরিয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, এ জীবন জানলে হয়তো সবকিছু ছেড়ে আসতাম না! প্রবাস জীবন বেশিরভাগ মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়, নিঃস্ব করে দেয়! প্রবাস জীবন বড় নিষ্ঠুর, বেদনাদায়ক এক উপাখ্যান হয়ে ওঠে! প্রতিটি জীবন হয়ে উঠে আত্মত্যাগের খেরোখাতা! আমার এক আমেরিকান বন্ধু শুনে আকাশ থেকে পড়ে যে আমাদের বহু তরুণ-যুবক নিজের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনকে দেশে রেখে বিদেশে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়! তার কাছে এটি অবিশ্বাস্য! এ কোন মায়া! সে দ্বিধায় পড়ে যায়।

আমাদের লক্ষ-লক্ষ তরুণ-যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গহীন, বিপৎসংকুল জঙ্গল পায়ে হেঁটে কিংবা উত্তাল সমুদ্র নৌকায় পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যায়, আমেরিকা যায়। তারা জানে এই দুর্গম যাত্রায় তাদের মৃত্যু হতে পারে। তারা জানে যে স্বপ্নের দেশে পৌঁছুলেও তারা কাগজপত্র-বিহীন বহু বছর কাটিয়ে দিতে হবে, স্বজনদের প্রিয় মুখটি দেখবে না। আমি প্যারিস-জেনেভা-লন্ডনের রাস্তায় এমন বহু যুবকের সন্ধান পেয়েছি যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। যেকোনো উপায়ে সেখানে গিয়েছে। কেউ শিক্ষার্থী ভিসায়, কেউ সাংবাদিক, শিল্পী হিসেবে, কেউ কন্টেইনারে পাচার হয়ে। যারা বুদ্ধিমান (হয়তো সৌভাগ্যবান) তারা খুব দ্রুতই বৈধ কাগজপত্র ব্যবস্থা করে নেন। কিন্তু বহু যুবক “বৈধ” হওয়ার অপেক্ষায় জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। অনেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বছরের পর বছর ঝুলে আছে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় তারা তিনটি নির্মম সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়: (১) সব কিছু ছেড়ে দেশে চলে যাওয়া (বৈধ কাগজপত্র না থাকায় আর ফেরা যাবে না); (২) দেশ-স্বজন ভুলে গিয়ে সেদেশে বিয়ে থা করে জীবন-সংসার গুছিয়ে নেওয়া; অথবা (৩) বৈধতার অপেক্ষায় থাকা, ধরা না পড়া, এবং কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে গোপনে যতটুকু কাজ করে দু’ পয়সা উপার্জন করে নিজে চলা যায় ও দেশে পরিবারকে পাঠানো যায় তা করা।

ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায়-রাস্তায় আপনি শেষোক্ত শ্রেণির অসংখ্য যুবকের দেখা পাবেন। বহু যুবককে হতাশায় মুষড়ে পড়তে দেখেছি। এক যুগেও “কাগজ” না হওয়ার হতাশায় প্যারিসে এক টগবগে যুবকের আত্মহত্যা করতে শুনেছি। প্যারিসের এক বাঙালি রেস্তোরায় এক প্রৌঢ় ব্যক্তির দেখা মিলেছিলো। তিনি সারা জীবন একা কাটিয়ে দিয়েছেন। সরকারি যে যৎসামান্য ভাতা পান তা দিয়ে নিজের কোনো মতে চলে যায়। বিয়ে করেন নি, সংসার নেই। পঞ্চাশ বছরের এই ফেরার জীবন শেষে অনিশ্চয়তার শঙ্কায় দেশেও ফিরতে চান না। তার জীবনে আর কোন স্বপ্ন অবশিষ্ট নেই, কোনো আশা নেই। নিয়ম করে বাঙালি রেস্তোরায় আসেন। দেশের মানুষ দেখেন। এক অদ্ভুত নেশায় ফেরার হয়ে সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিলেন! তার চাহনির শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো। কিছু কি পেলেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম। “মাসে বয়স্ক ভাতা পাই – তা দিয়ে চলে যায়” – তাঁর সরল উত্তর। “জীবনের” কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম – হয়তো ওই ভাতাটুকুই তাঁর জীবন এখন! কথা বাড়াইনি।

ডেইলি স্টার থেকে নেয়া হয়েছে।

আমাদের এই তরুণদের অনেকেই বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান ফেলে, যৌবনের সোনালী সময় প্রবাসে কাটিয়ে দেন। ঘণ্টায় কয়েক ডলারে আয় করে দেশে স্ত্রী-সন্তান-বাবা-মা-ভাই-বোনের খাওয়া-পরা-শিক্ষার টাকা পাঠান। ২০ বছর, ৩০ বছর নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেশে পরিবারের ভরণ-পোষণ পাঠায়, সন্তানদের শিক্ষিত করতে চান। সন্তানদের বড় করতে গিয়ে জীবনের ঘানি টেনে নিজের উচ্চতাই কখন যে খাটো হয়ে যায় সে খেয়ালও অনেক সময় থাকে না!

পৃথিবীর অন্য আরো সংস্কৃতিতেও নিশ্চয়ই এরকম আত্মত্যাগের ঘটনা আছে। কিন্তু আমি ইউরোপ, আমেরিকার বহু দেশ ঘুরেও পরিবারের ঘানি টানতে এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া অন্য জাতির অনেক যুবকের দেখা পাইনি। কিসের নেশায়, কোন মোহে তারা এটি করে? কেন করে?

আমরা কেবল দেশের জিডিপি-তে প্রবাসীদের অবদানের অংক গুনি। দেশের অর্থনীতির স্তম্ভ হিসেবে প্রবাসী শ্রমিকদের কথা বলি। কিন্তু বাংলাদেশের লক্ষ পরিবারে, পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে জীবন থেকে নেওয়া প্রবাসীদের শৌর্য-বীর্যের অসংখ্য গল্পের কথা কি জানি?! তাদের আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস কি জানি? কোনো সাহিত্যিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক কি তাদের কলমের তুলিতে এই বীরত্বকে, আত্মত্যাগকে ধারণ করেছে? সাহিত্য তো সময়কে ধারণ করার কথা। আমাদের সোনালী এই মানুষগুলোর জীবন-যৌবন-স্বপ্ন চুরি হয়ে যাওয়ার ইতিহাস কি তাদের কথামালায় উঠে এসেছে?

  • সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া: লেখক ও গবেষক, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

এ সংক্রান্ত আরো দেখা যেতে পারে:
Why Bangladeshi migrants board boats from Libya to reach Europe


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *