আইন যখন ন্যায্যতার বিপরীতে অবস্থান নেয়, তখন মানুষের দায়িত্ব সেই আইনকে উপড়ে ফেলা

  • লেখক: হাসনাত কাইয়ূম

.
আইন সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমি সাধারণত প্রথমেই বলে নিই যে আইন ২ প্রকার : এক প্রকার হলো ‘সাধারণ আইন’, যা এক নাগরিকের সাথে আর এক নাগরিকের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যে কাজ করে। আর অন্য প্রকার আইন হলো ‘রাষ্ট্র পরিচালনার আইন’, যা সাধারণত নাগরিক বা মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ করে। উপনিবেশ ছিলো এমন রাষ্ট্র, বিশেষত ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলো এমন রাষ্ট্রগুলিতে সাধারণ আইন কিভাবে কাজ করবে বা কতটুকু কাজ করবে এসব নির্ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার আইন। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনার আইন এবং সাধারণ আইনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে সাধারণ আইন সমূহের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব অসঙ্গতি যখন মানুষের সামনে আসে, মানুষ যখন দেখতে পায় তার চেনা আইন কাজ করছে না, তখন তারা সহজ স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়, এখানে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নাই। আমাদের দেশে যাদেরকে আইনের বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়, তারাও যখন একই কথা বলে এবং উনাদের কথাবার্তা যখন পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন-মিডিয়ায় প্রচার-প্রকাশিত হয় এবং মানুষ তার অভিজ্ঞতার সাথে মিলায়ে দেখতে পায় যে কথা সত্য তখন তারা এইসব পণ্ডিতদের অনেককে অনেকটা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আসনে স্থান দিয়ে রাখে!

এইসব অর্ধসত্য প্রচারের ফলে যে ক্ষতিটা হয় তাহলো, মানুষ আইনের প্রয়োগ না হওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছোটখাটো আমলা-অফিসারদের ব্যক্তিগত অসততাকে দায়ী করে, কিন্তু তার আসল কারণ সম্পর্কে সে তিমিরেই থাকে, যে তিমিরে সে ছিল উপনিবেশিক আমলে। এর সবচাইতে বড় ক্ষতির দিকটা হলো ন্যূনতম বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলেও যে রাষ্ট্র পরিচালনার আইনের এইসব অন্যায় কর্তৃত্বের অবসান ঘটাতে হবে, সে সম্পর্কে মানুষের কোনো বোধ তৈরি হয় না। দুই-দুইবার দেশ স্বাধীন করার পরও কেন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র এখনো গড়ে তোলা গেল না, সে বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক চেতনাকে এখনো যে প্রায় বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী পর্যায়ে আটকে রাখা গেছে, তার মূল চাবিকাঠিটা এইখানে।

২.
অতি সম্প্রতি আমাদের ২ জন ‘শিল্পপতি’, যারা অপর এক ‘শিল্পপতি’র ব্যাংক থেকে অপর এক মালিকের জমিজমাকে নিজের দেখাবার জন্য জাল কাগজপত্র বানায়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ম্যানেজমেন্টকে অপহরণ, আটক, ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং অপমান-নির্যাতন করার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে অনেক বিলম্বে হলেও একটা ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর প্রচলিত আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়নি। রাষ্ট্র-সরকার নিজ ব্যবস্থাপনায় করোনাকালে তাদেরকে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ব্যবহার করে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ ঘটনায় আবারও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ‘সীমিত আকারে’ আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে।
এখন এই ঘটনাকে যদি কেউ ব্যাখ্যা করতে চায় তাহলে অন্তত ৪টি মন্ত্রণালয়কে এর সাথে যুক্ত হিসাবে দেখতে পাবে। প্রথমত তারা গেল করোনাকালে, যখন দেশের অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল। দ্বিতীয়ত এ সময়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ ছিল এবং এর জন্য বিমান মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হয়েছে। তৃতীয়ত এদের ভিসা ছিল না এবং স্বাভাবিক ভিসা কার্যক্রম বন্ধ ছিল, সেজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। চতুর্থত চূড়ান্ত অনুমোদন প্রয়োজন ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, কারণ তারা ছিল ফৌজদারি মামলার পলাতক আসামী। সে মামলায় তাদেরকে যেন গ্রেফতার না করা হয়, বরং তারা যাতে নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে তার জন্য পুলিশকে একদিকে নিষ্ক্রিয় এবং অপরদিকে সক্রিয় করতে হয়েছিল।

ইন্টারনেট থেকে নেয়া।

.
সংবিধানের ৫৫-৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কে কতক্ষণ মন্ত্রী থাকতে পারবে বা পারবেনা এটা নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টির উপর। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো মন্ত্রীই নেয়ার সাহস করেন না। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো উপায় নাই এবং প্রধানমন্ত্রী যে অসন্তুষ্ট হন নাই এটা আমরা তাদের মন্ত্রিত্ব বহাল থাকা দিয়েই বুঝতে পারি। আর প্রধানমন্ত্রী যদি অসন্তুষ্ট না হন, তাহলে দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের অসন্তোষে মন্ত্রীদের কিচ্ছু যায়-আসে না। আর প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সাংবিধানিক বা রাষ্ট্র পরিচালনার আইন অনুযায়ীই কারো কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য নন, ফলে সেটাই বৈধ, যা তিনি করেছেন।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে ধারণাটা তৈরি হয় তাহলো, পুলিশ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে নাই, তাই তারা সবার নাকের ডগা দিয়ে দেশ ছেড়ে যেতে পেরেছে। সবচাইতে অগ্রসর পণ্ডিতরা অবশ্য খুব সাহস করে এইটুকু দাবী অনেক সময় উচ্চারণ করে বসেন যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, বা অনেক সময় এমন আলাপও হয় যে মন্ত্রীরা খুবই খারাপ, কারণ তারা এর পরেও পদত্যাগ করছেন না।

কিন্তু এই ঘটনাটি হলো উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার আইনের কাছে সাধারণ আইন একই সাথে দুইভাবেই ধরাশায়ী হয়েছে।

৪.
কয়েকদিন আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। তিনি একটি রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু রেস্টুরেন্টের ওয়েটার উনাকে বসতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন, কারণ করোনাকালে রেস্টুরেন্টটি যত লোককে বসানোর অনুমোদন পেয়েছে, তত লোক ইতিমধ্যেই বসানো হয়ে গেছে। এইটুকুই। প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দ্রাকে কেন বসতে দেয়া হলোনা তার জন্য ওয়েটারকে কোনো প্রকার জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ ওয়েটার কোনো অন্যায় করেননি, আইন অমান্য করেননি।
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্দ্রা এবং ওয়েটারের মধ্যে মানুষ হিসাবে মর্যাদার কোনো পার্থক্য ওখানকার আইনে নাই। ওখানে রাষ্ট্রপরিচালনার আইন জেসিন্দ্রাকে সাধারণ নাগরিকের উপর আলাদা কোনো মর্যাদা দেয়নি। ফলে ওয়েটার তার কর্ম-এলাকায় আইনানুযায়ী যা করণীয় তাই করতে পেরেছে। এখানে যেটা লক্ষ্য করার বিষয় এবং যে প্রশ্নটা আলোচনায় আনা দরকার তা হলো, ওখানে জেসিন্দ্রার বদলে যদি আমাদের বর্তমান অথবা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কেউ একজনও প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে কি খুব বেশী পার্থক্য হতো? আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কি তাদের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার কারণে ওয়েটারকে শাস্তি দিতে পারতেন?

পারতেন না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কেন জেসিন্দ্রা বা ট্রুডোর মতো নয়, এটা নিয়ে আমাদের তথাকথিত পণ্ডিত আর সংস্কৃতিমনা জ্ঞানী ব্যক্তিরা প্রচুর হা-হুতাশ করবেন, কিন্তু কখনোই তারা কেন জেসিন্দ্রা-ট্রুডো হয়ে উঠতে পারেন না, আর আমাদের ওয়েটাররা কেন মানুষের মর্যাদা পায়না, সে বিষয়ে আসল কথাটা তুলে ধরতে পারেন না। তারা আইনের প্রযোগের সমস্যার কথা বলেন, কিন্তু আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই যে বৈষম্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়, আইনের সাপোর্টটা তুলে নিলে যে খোদ প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী পর্যন্ত যে একজন সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অনেকবেশী মামলাবাজির শিকার হয়, এ কথাটা কারণসহ তারা কোনোদিনই বলেন না। এমনকি নিপীড়নের শিকার হওয়ার সময়েও না।

কার্টুনিস্ট কিশোরের আঁকা। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক রয়েছেন বর্তমানে।

৫.
বাংলাদেশের মতো ব্রিটিশ উপনিবেশের জঠর থেকে বের হওয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনীতি আর উপনিবেশ ছিলনা এমন দেশের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যের সবচেয়ে বড় নির্ধারক মানদণ্ডটি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার আইন আর সাধারণ আইনের পার্থক্য এবং অধীনস্ততা মাপার মানদণ্ড। আমাদের রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের কাছেই এই মানদণ্ডটি নাই। তারা সবসময় ইউরোপ বা আমেরিকার মানদণ্ড দিয়ে এখানকার রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজতে যেয়ে একটার পর একটা ভুল নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এদেশের মানুষের যা-কিছু অর্জন তার সবটুকই বলা যায় এইসব পণ্ডিতদের না মেনে কাণ্ডজ্ঞানের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার ফলাফল। এই যে আমাদের পণ্ডিতরা সাধারণ জনগণের কাণ্ডজ্ঞানের তুলনায়ও পিছিয়ে থাকে বা ভুল করে, এটা সবসময় তাদের দোষ না, ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাও না; সীমাবদ্ধতা হলো তাদের শিক্ষার এবং সেই শিক্ষায় আয়ত্ত করা মানদণ্ডের, যেটি ইনবিল্ট গলদযুক্ত, বা জনগণের ভাষায় সেটি ‘ফের দেওয়া নিক্তি’, যেটা দিয়ে যা মাপা হয় তারই ত্রুটিযুক্ত ফল আসে।

৬.
বাংলাদেশ ১৯৪৭ বা ১৯৭১-এর মতো আর একটা বড় বাঁক-বদলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনো যদি আমরা কলোনি থেকে, বিশেষত ব্রিটিশ কলোনির জঠর থেকে বের হওয়া রাষ্ট্রের বিশেষত্বকে নিজেদের চোখ আর অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি দিয়ে দেখতে-বুঝতে না পারি, আর তাদের পুরনো বিশ্লেষণ পদ্ধতির ফাঁদেই আটকা রাখি নিজেদের, তাহলে আমরা আবারো একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারি। যারা আমাদের নিয়ে বারবার খেলেছে, তারা এখন আরো অধিক সক্রিয়। সকলের সম্মিলিত বোধোদয়ই আমাদের রক্ষা করতে পারে। আর কে না জানে, আইন যখন ন্যায্যতার বিপরীতে অবস্থান নেয়, তখন মানুষের দায়িত্ব সেই আইনকে উপড়ে ফেলা আর নতুন ন্যায্য আইন প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *