নাওমি ক্লেইনের বয়ানে করোনা , দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক ডক্ট্রিন

  • ভূমিকা ও ভাষান্তর: সারোয়ার তুষার

অনুবাদকের ভূমিকা:

এক

কানাডিয়ান লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইন ২০০৭ সালে Shock Doctrine : The Rise of Disaster Capitalism নামে একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকে মূলত সংকট তৈরি করে এবং সংকটকে কাজে লাগিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭৩ সালের চিলি থেকে শুরু করে ইরাক পর্যন্ত কীভাবে মিল্টন ফ্রিডম্যানের ‘মুক্ত-বাজার অর্থনীতি’র প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব বাস্তবায়ন করা হয়েছে ‘শক থেরাপি’র মাধ্যমে। বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে (কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্যোগ সৃষ্টি করে) নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট মহল তাদের প্রতিক্রিয়াশীল, আরোপিত নীতি গ্রহণে বিশ্বের জনপদগুলোকে বাধ্য করে এবং একের পর এক অঞ্চলের নিজস্ব রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সহ গোটা জীবনযাপন মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্লেইন একে বলছেন ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ (Disaster Capitalism)। স্থানিক রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির স্বচ্ছন্দ বিকাশকে শক থেরাপির মাধ্যমে স্তব্ধ করাই যার মূল্য লক্ষ্য। এইভাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটদের আরোপিত প্রতিক্রিয়াশীল নীতি চাপিয়ে দেয়ার মতবাদই ‘শক ডক্ট্রিন’ (Shock Doctrine)।

গোটা পৃথিবী করোনা ভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। ইতোমধ্যেই অসংখ্য মানুষ নিহত ও আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। থমকে গেছে গোটা পৃথিবী। সমস্ত রকমের সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। ক্লেইন এই সাক্ষাতকারে দাবি করছেন, তাঁর দুই দশকের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আঁচ করতে পারছেন, এ রকম একটা নজিরবিহীন সংকট ও সংকট-পরবর্তী সময়কে কীভাবে বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এলিটরা তাদের ফায়দা লোটার কাজে লাগাতে পারে।

যে নীতিগুলো হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রহণ করলে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হতো রাষ্ট্রসমূহকে, সেই নীতিগুলোই এখন দুর্যোগের অজুহাতে অনায়াসে চাপিয়ে দেয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা খাতগুলোকে সংকুচিত করে কর্পোরেট শিল্পখাতগুলোকে বিশেষ আর্থিক ভর্তুকি দেয়ার পাঁয়তারা চলছে, যে কর্পোরেশনগুলো আসলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই রকম সংকটের জন্য দায়ী। অন্যদিকে সবেতন ছুটির অধিকার না থাকায় শ্রমজীবী মানুষকে অসুস্থতা নিয়েও কাজে যেতে হচ্ছে। আবার চীনা সরকার ঘোষণা দিয়েছে, সংকট ‘কাটিয়ে উঠতে’ তারা যেসব পরিবেশগত মান ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে মানতে হত, তা শিথিল করবে।

বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির পাঁয়তারা চলছে। অথচ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বলছেন, ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ আর ‘প্রক্লেমেশন অব ইমার্জেন্সি’ এক কথা নয়। আমাদের একদিকে ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা দরকার এবং অন্যদিকে মানুষ যাতে সরকারের উপর নজরদারি এবং সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ঘাটতি নিয়ে আরো বেশি কথা বলতে পারে তার জন্য স্বাধীনতাও দরকার । মেডিকেল ইমার্জেন্সির অজুহাতে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে মানুষের যতটুকু বাক স্বাধীনতা আছে তাও কেড়ে নিলে, এ বিপর্যয় থেকে এখানকার মানুষদের রক্ষা করা যাবে না। ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার অর্থ হচ্ছে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ রদ করা যাবে এবং এ নিয়ে আদালতে চাইলেই রিট করা যাবে না। করোনার মত দুর্যোগে আমাদের দরকার নিরাপদ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখা। সামাজিক সংহতিকে সুদৃঢ় করা। কোনভাবেই এমন কোন দাবি জানানো উচিত নয় যা আদতে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করে। করোনার কালে আমাদের দরকার শারীরিক দুরত্ব ও সামাজিক সংহতি। আমাদের দরকার আতঙ্ককগ্রস্ত না হয়ে সর্বোচ্চ সক্রিয়তা ও সতর্কতা। ভিন্নভাবে সমাজকে সংগঠিত করতে পারার মত একাগ্রতা ও রূপকল্প।

নিশ্চিতভাবেই করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবী ও করোনা-উত্তর পৃথিবী এক রকম থাকবে না। খুব ভালো কিংবা আরো খারাপ দুই সম্ভাবনাই আছে। মহামারির মত এরকম জরুরি পরিস্থিতি কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য বেশ ভালো ছুতা। ক্ষমতা আরো কেন্দ্রীভূত করা, ‘জনকল্যাণ’ এর নামে যেকোন ডিক্রি জারির করতে পারার পক্ষে একটা জনসম্মতি তৈরি হয়ে থাকে এই সময়ে। আবার যারা ভিন্নভাবে সমাজকে সংগঠিত করতে চায়, তাদের যদি পরিস্কার বোঝাপড়া থাকে, পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকে; তাহলে মহামারির সুযোগে রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক এলিট কর্তৃক সমাজকে আরো সংকুচিত করার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হতে পারবে।

এই প্রেক্ষিতেই নাওমি ক্লেইনের শক ডক্ট্রিন ও দুর্যোগ পুঁজিবাদের পাঠ করা দরকার আমাদের। চিন্তা ও তৎপরতার মাধ্যমে নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির ‘শক’ এর বিরুদ্ধে গণমানুষকে সংগঠিত করা দরকার। তাহলেই কেবল আমরা বর্তমান ‘দুর্যোগ’ এবং ভবিষ্যত ‘দুর্যোগ’ এর সম্ভাবনাকে নাকচ করতে পারব।

দুই

গত ১৭ই মার্চ, ২০২০ এ ‘The Intercept’ অনলাইন পোর্টালে কানাডিয়ান লেখক, সামাজিক ও জলবায়ু আন্দোলনের তাত্ত্বিক-অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইনের একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি করোনা মহামারির ফলে সৃষ্ট নজিরবিহীন সংকট ও সংকটকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটরা যেসব প্রতিক্রিয়াশীল, গণবিরোধী নয়া-উদারতাবাদী নীতি গ্রহণ করতে পারে কিংবা ইতোমধ্যেই করেছে, সে সম্পর্কে বিশ্বের আপামর মানুষ ও অ্যাক্টিভিস্টদের সতর্ক করেন। করোনা মহামারির দিশেহারা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট পুঁজির লাগামহীন পুঞ্জিভবনকে ক্লেইন বলছেন ‘করোনা পুঁজিবাদ’। দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি ‘করোনা পুঁজিবাদ’কে ব্যাখ্যা করেছেন।

The Intercept-এ প্রকাশিত ভিডিও বার্তাটি অত্যন্ত জরুরি মনে হওয়ায় বর্তমান অনুবাদক এটির শ্রুতিলিখন তৈরি করে অনুবাদ করেন। তবে এখানে প্রকাশিত পুরো অনুবাদটিই শ্রুতিলিখনের অনুবাদ নয়। The Intercept-এ প্রকাশিত ভিডিও বার্তার নিচেই নাওমি ক্লেইন বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা লিখেছেন। সেই ভূমিকাটির অনুবাদও এখানে হাজির করা হলো।

‘দুর্যোগ পুঁজিবাদের’ জন্য মোক্ষম সুযোগ করোনা ভাইরাস:
বৈশ্বিক মহামারির সংকট থেকে সরকার ও বৈশ্বিক এলিটদের ফায়দা লুট সংক্রান্ত নাওমি ক্লেইনের বিশ্লেষণ

করোনাভাইরাস আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত একটি বৈশ্বিক মহামারি যা এ পর্যন্ত সার্সের (Severe acute respiratory syndrome) চেয়ে ১০ গুণ বেশি লোককে সংক্রমিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর এবং থিয়েটারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবং সম্ভবত খুব শীঘ্রই, সবগুলো শহরও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে COVID-19 নামে পরিচিত ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশংকা করছেন এমন কিছু লোক তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় সিস্টেমেটিক ব্যর্থতার কারণে বেতনভুক্ত অবসরের সুবিধা নেই।

কী করতে হবে বা কার কথা আমলে নিতে হবে সে ব্যাপারে আমাদের বেশিরভাগই নিশ্চিত না। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রসমূহের সুপারিশগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের বার্তা সাংঘর্ষিক এবং এই মিশ্র বার্তাসমূহ অত্যন্ত সংক্রামক এই ভাইরাসের ক্ষয়-ক্ষতি প্রশমিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সময়কে আরও সংকুচিত করেছে।

এই হলো সেই মোক্ষম পরিস্থিতি যখন আমরা সকলে উদ্বিগ্ন থাকার ফলে সরকার ও বৈশ্বিক এলিটদের পক্ষে এমন সব রাজনৈতিক এজেন্ডা চরিতার্থ করা সম্ভব হয় যা অন্যক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারত। এহেন ঘটনাপ্রবাহ কেবল করোনভাইরাস দ্বারা উদ্ভূত সংকটের ক্ষেত্রেই অনন্য তা নয়; বরং রাজনীতিবিদ এবং সরকারসমূহ কয়েক দশক ধরে ‘শক ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত এই নীলনকশাই অনুসরণ করে আসছে। অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক নাওমি ক্লেইম ২০০৭ সালে লিখিত বইয়ে একেই ‘শক ডকট্রিন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের আঘাত ও আঘাত পরবর্তী পরিণতির প্রবহমানতা। ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ (Disaster Capitalism)-এ এই পরিণতিকেই রূপায়িত করা হয়। সংকটগুলোর পূর্বনির্ধারিত, মুক্তবাজার ‘সমাধান’ যা বিদ্যমান বৈষ্যমের সুযোগ নিয়ে তাকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলে।

ক্লেইন বলেন যে, আমরা ইতিমধ্যেই দুর্যোগ পুঁজিবাদকে জাতীয় পর্যায়ে প্রবল পরাক্রমে বিরাজ করতে দেখছি; করোনা ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ৭০০ বিলিয়ন ডলারের একটি উদ্দীপক প্যাকেজ প্রস্তাব করেছেন যা পে-রোল ট্যাক্সকে সংকুচিত করে সামাজিক নিরাপত্তাকে ধ্বংস করবে এবং মহামারির কারণে ব্যবসায় লোকসানের শিকার হওয়া শিল্পখাতগুলোকে সহায়তা প্রদানের মতো কর্মসূচিকে অন্তর্ভুক্ত করবে।

ক্লেইনের ভাস্যমতে, ‘তারা এটা এজন্য করছে না যে তারা মনে করে মহামারির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা; বরং তারা এটা এজন্য করছে যে আগে থেকেই পরিকল্পিত এসব কৌশল বাস্তবায়নের একটা মওকা তাদের সামনে হাজির হয়েছে’।

করোনাভাইরাসের ‘আঘাত’ কীভাবে এক দশকেরও বেশি সময় আগে তাঁর বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের পরিসর তৈরি করছে সেই ব্যাপারে ‘VICE’ ক্লেইনের সাথে আলাপ করেছে।

প্রশ্ন : একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা যাক। দুর্যোগ পুঁজিবাদ কী? ‘শক ডকট্রিন’-এর সাথে এর সম্পর্ক কী?

নাওমি ক্লেইন : দুর্যোগ পুঁজিবাদকে আমি যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছি তা সত্যিই সোজাসাপ্টা। এটা ব্যাখ্যা করে বড় আকারের সঙ্কটকে ব্যবহার করে বেসরকারি শিল্পখাতগুলো কীভাবে সরাসরি মুনাফা অর্জনের জন্য জেগে ওঠে। দুর্যোগ ও যুদ্ধ থেকে মুনাফা আদয়ের ধারণা নতুন কিছু নয়, তবে বুশ প্রশাসনের অধীনে ৯/১১’র পর এই প্রবণতা আরও গভীরতর হয়েছে, যখন এধরনের অন্তহীন নিরাপত্তা সংকটের কথা ঘোষণা করে প্রশাসন  ক্রমাগত এর বেসরকারিকরণ শুরু করল এবং বাইরের হাতে ছেড়ে দিতে থাকল— অভ্যন্তরীণ, বেসরকারি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি পাশাপাশি ইরাক ও আফগানিস্তান [বেসরকারি] আক্রমণ ও দখল যার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

‘শক ডকট্রিন’ হলো বড় আকারের সংকটকে পুঁজি করে, পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্যকে আরও গভীরতর করে তোলার একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা অন্য সকলকে তলায় ঠেলে দিয়ে অভিজাতদের করে তুলে বিত্তশালী। সংকটের মুহূর্তগুলোতে, মানুষ সাধারণত সেই সংকট উতরানোর নিত্যনৈমিত্তিক জরুরি পরিস্থিতির দিকেই মনোনিবেশ করে; সংকটের মুহূর্তগুলোতে মানুষ সংকট উত্তরণের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক জরুরি পরিস্থিতির দিকেই মনোনিবেশ করে, তা সেটা যাই হোক না কেন, এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের উপর খুব বেশি ভরসা রাখার প্রতি একটা ঝোঁক থাকে মানুষের। সঙ্কটের মুহূর্তগুলোতে আমরা সাধারণত মূল ঘটনা থেকে আমাদের নজর কিছুটা হলেও অন্যত্র সরিয়ে নেই।

প্রশ্ন : রাজনৈতিক কৌশলটি কোথা থেকে আসে? আমেরিকান রাজনীতিতে আপনি এর ইতিহাস কীভাবে চিহ্নিত করবেন?

নাওমি ক্লেইন : শক-ডকট্রিন কৌশলটি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট-এর অধীনে করা মূল ‘নতুন চুক্তির’(New Deal) একটি জবাব । অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বিশ্বাস করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দা ও ধূলোঝড়ের প্রতিক্রিয়ায় গৃহীত নতুন চুক্তির অধীনে সমস্ত কিছুই ভুল হয়েছে। দেশে অধিকতর সক্রিয় সরকার গড়ে উঠেছে, যা কিনা সরকারি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও সরাসরি ত্রাণ সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ সমাধানকে নিজের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল।

আপনি যদি মুক্তবাজার অর্থনীতির কট্টরপন্থী সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি জানেন যে, যখন বাজার ধ্বসে পড়ে তখন তা, বড় বড় করপোরেশানগুলোর স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে এমন নিয়ন্ত্রণবিহীন পলিসি গ্রহণের বদলে বরং আরও বেশি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রগতিশীল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ফলে প্রগতিশীল নীতিসমূহের আবির্ভাব ঘটে যেইসব মুহূর্তে, সেসব মুহূর্তকে পথ ছেড়ে দিলে যে ‘সংকট’ তৈরি হবে তাকে প্রতিহত করার জন্যই শক ডকট্রিনের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটরা বুঝতে পারে যে সংকটের মুহূর্তগুলোই তাদের অজনপ্রিয় নীতিগুলোর তালিকা চাপিয়ে দেয়ার মোক্ষম সময়, যা এই দেশে এবং সমগ্র বিশ্বজুড়েই সম্পদের আরও দূর মেরুকরণ ঘটায়।

প্রশ্ন : এই মুহূর্তে আমাদের একাধিক সংকট ঘটমান: একদিকে মহামারি, এটি সামলানোর জন্য অবকাঠামোগত দুর্বলতা আরেকদিকে পতনোন্মুখ স্টক মার্কেট। The Shock Doctrine এ আপনি যেই রূপরেখা প্রনয়ন করেছেন তার সাথে এই উপদানগুলো কীভাবে খাপ খায় তা কি একটু ব্যাখ্যা করতে পারবেন?

নাওমি ক্লেইন : প্রকৃতপক্ষে এখানে শক হচ্ছে ভাইরাসটি নিজেই । আর এটির ব্যবস্থাপনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে বিভ্রান্তি বাড়িয়ে সুরক্ষা হ্রাস পেয়েছে। আমি মনে করি না যে এটা কোনো ষড়যন্ত্র, বরং এভাবেই মার্কিন সরকার ও ট্রাম্প এই সংকট নিরসনে চূড়ান্তভাবে তালগোল পাকিয়েছে। ট্রাম্প এ পর্যন্ত এটিকে জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে না দেখে বরং দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সংকট হিসেবে দেখছেন, এবং নিজের পুর্নর্নিবার্চনের পথে সম্ভাব্য বাঁধা হিসেবে দেখছেন। পরিস্থিতির এই হচ্ছে সবচাইতে খারাপ দিক, বিশেষত আরও একটা ব্যাপার যদি যোগ করি, আমেরিকার নেই কোনো জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি, আর শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টিতো অত্যন্ত নাজুক। এই দুই সমস্যার সমন্বয়ই সর্বোচ্চ আঘাত প্রদান করেছে। একে কাজে লাগানো হবে সে সমস্ত শিল্পখাতগুলোকে আর্থিক ভর্তুকি প্রদান করার অজুহাত হিসেবে, যেই শিল্পখাতগুলো জলবায়ু সমস্যার মতো চূড়ান্ত দুর্যোগের মূল কারণ হিসেবে বিদ্যমান, যেমন- এয়ারলাইন, তেল ও গ্যাস, জাহাজ শিল্প— এ সবগুলোকেই তারা ঠিকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়।

প্রশ্ন : ইতোপূর্বে আমরা এই নাটকটি কীভাবে মঞ্চস্থ হতে দেখেছি?

নাওমি ক্লেইন : The Shock Doctrine বইয়ে আমি হারিকেন ক্যাটরিনার পরে এটি কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে কথা বলেছি। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের মতো ওয়াশিংটন থিংকট্যাঙ্কগুলো একসাথে হয়ে ক্যাটরিনার জন্য মুক্তবাজারের অনুকূল সমাধানের তালিকা হাজির করেছিল। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ঠিক একই ধরনের বৈঠক এখন আবারও হবে— এমনকি সেসময় ক্যাটরিনা গ্রুপের প্রধানের দায়িত্ব যেই ব্যক্তিটি পালন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন মাইক পেন্স। ২০০৮ সালে, আমরা সেই প্রথম [ব্যাংকখাতে] ভর্তুকির ঘটনাটি দেখেছি, যখন বিভিন্ন দেশ সেই ব্যাংকগুলোকে ব্ল্যাংক চেক লিখে দেয়, যার আর্থিক পরিমাণ হতে পারে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর প্রকৃত মূল্য টের পাওয়া গেছে অর্থনৈতিক সংকোচনের মাধ্যমে [পরবর্তীতে সামাজিক খাতে বাজেট সংকোচনে]। সুতরাং, এখন কী হচ্ছে শুধু সেটাই বিষয় নয়, বরং  ভবিষ্যতে যখন সময় আসবে তখন এসবের মূল্য কীভাবে পরিশোধ করা হবে সেটাই আসল বিষয়। 

প্রশ্ন : করোনাভাইরাসের প্রভাবে দুর্যোগ পুঁজিবাদের যে ক্ষতি আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি তা কমিয়ে আনার জন্য জনগণের করণীয় কিছু কি আছে? হারিকেন ক্যাটরিনা বা বিগত বৈশ্বিক মন্দার সময় থেকে আমরা কি ভালো না খারাপ অবস্থানে আছি এখন?

নাওমি ক্লেইন : যখন আমরা কোনো সঙ্কটে পতিত হই তখন আমরা আরও পিছিয়ে কিংবা ভেঙে পড়ি, অথবা আরও লায়েক হয়ে উঠি এবং শক্তি ও সমবেদনার ভাণ্ডার খুঁজে পাই এতদিন যেটা সম্ভব বলে মনে হতো না। এবারও একই রকমের পরীক্ষার মুখোমুখি আমরা। আমরা উন্নতির পথ অনুসরণ করতে পারি, এ ব্যাপারে আমি কিছুটা আশাবাদী কারণ, এখন আমাদের কাছে প্রকৃত একটা রাজনৈতিক বিকল্প আছে, যা এই দুর্যোগের মোকাবেলায় একটি ভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করছে, যেই প্রস্তাব আমাদের দুর্বলতাকে খুঁজে বের করেছে একেবারে গোড়া থেকে। এবং এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে এমন একটা বৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলনও রয়েছে বর্তমানে, যা ২০০৮ সালে ছিল না।

গ্রিন নিউ ডিলের সমস্ত পরিকল্পনার মূলে কাজ করছে এই ধারণাই: এরকম একটা মুহূর্তের জন্য তৈরি হওয়া। সাহস হারানো কোনো কাজের কথা না; সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সার্বজনীন শিশু সেবা, অসুস্থকালীন সবৈতনিক ছুটি প্রদানের জন্য আমাদের আগের তুলনায় আরও কঠোর লড়াই করতে হবে— কারণ এই সমস্ত কিছুই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

প্রশ্ন : আমাদের সরকারগুলো ও বৈশ্বিক এলিটরা যদি তাদের নিজেদের স্বার্থে দুর্যোগকে কাজে লাগায় তাহলে পরস্পরের খেয়াল রাখার জন্য জনগণের পক্ষে কী করার থাকে?

নাওমি ক্লেইন : ‘নিজের ভরণপোষণ আমি নিজেই করব এবং প্রচলিত সেরা বীমাটাই আমি পাব; আপনি যদি ভালো বীমা না পান সেটা আপনার  নিজের দোষে, আমার তা দেখার বিষয় না’। ‘যে জিতবে সেই সিকান্দার’ মার্কা অর্থনীতি এই ধারণাই আমাদের মস্তিষ্কে গ্রথিত করে। সংকটের এমন মুহূর্তগুলো পরস্পরের প্রতি আমাদের ছিদ্রান্বেষী মানসিকতাকেই উন্মোচন করে। কিন্ত এরকম কঠিন সময়ে আমরা উপলব্ধি করি বিচ্ছিন্নতা ও অপরের প্রতি নির্লিপ্তির যে বোধ চরম নির্মম এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে গেঁথে দিতে চায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা পরস্পরের সাথে যুক্ত। ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকলেই আমরা বেঁচে যাব এমনটা ভাবতেই পারি,  কিন্তু যে লোক আমাদের খাবার তৈরি করে বা খাবার সরবরাহ করে কিংবা আমাদের বাক্সপেটরা গোছায় তারাতো স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, রোগ পরীক্ষা করানোর সামর্থও তাদের নেই, ঘরে থাকার প্রশ্নতো ছেড়েই দিলাম যেহেতু অসুস্থতার জন্য বেতনভুক্ত ছুটির ব্যবস্থা তাদের নেই— এমন অবস্থায় আমরাও নিরাপদ নই। আমরা যদি পরস্পরের যত্ন না নেই, তাহলে আমাদের দেখার কেউ নেই। সেক্ষেত্রে আমরা চোরাবালিতে আটকা পড়ব।

সমাজ সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন উপায় আমাদের নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন দিককে প্রজ্বলিত করে। আপনি যদি জানেন আপনি এমন কোনো সিস্টেমে আছেন যা মানুষের যত্ন নেয় না এবং সম্পদের ন্যায্য বন্টন করে না; তার মানে আপনার নিষ্ক্রিয় সত্তাটি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। সুতরাং নিষ্ক্রিয় না থেকে, সচেতন হোন এবং ভাবুন। কেবলমাত্র আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের যত্ন নেয়ার কথা না ভেবে, আপনার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষটির দিকে নজর রাখুন।

করোনা পুঁজিবাদ ও প্রতিরোধের রাজনীতি

আমি দু’ দশক ধরে দুর্যোগের অন্তরালে সংঘটিত পরিবর্তনগুলো অধ্যয়ন করছি। আমি শিখেছি অন্তত যে একটা বিষয়ের উপর আমরা ভরসা করতে পারি তা হলো: বিপর্যয়কর পরিবর্তনের সময়গুলোতে, অকল্পনীয় বিষয়গুলো হঠাৎ করেই বাস্তবে পরিণত হতে থাকে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, মূলত নিকৃষ্ট পরিবর্তনগুলোই সাধিত হয়েছে। তবে বরাবরই এমনটা ঘটেছে তা নয়। এবং ভবিষ্যতেও একইভাবে চলতে হবে তাও নয়।

ক্রমবর্ধমান COVID-19 সংকট আমাদের সম্ভব-অসম্ভবের ধারণাকে যেভাবে পুনর্নির্মাণ করছে সে সম্পর্কে এই ভিডিওটি। ট্রাম্প প্রশাসন এবং পৃথিবীজুড়ে অন্যান্য সরকারগুলো ব্যস্ত এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিঃশর্ত আর্থিক ভর্তুকি প্রদান ও সরকারি তদারকি শিথিল করার কাজে। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন ম্যানুচিন (Steven Manuchin) ২০১০-এর ডড-ফ্র্যাঙ্ক (Dodd frank Act) আইনের অংশ হিসাবে সর্বশেষ বড় অর্থনৈতিক মন্দার পর যে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল তা বাতিল করতে চলেছেন। চীন তার দিক থেকে এরমধ্যেই ইঙ্গিত দেয়া শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য পরিবেশগত নীতিমালা শিথিল করবে তারা। যার ফলে এই দুর্যোগের মুখ্য যে ইতিবাচক দিক, অর্থাৎ দেশটির মারাত্মক বায়ুদূষণ যে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে সে অর্জনও পুরোপুরি বিনষ্ট হবে।

তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, আমরা শহর এবং রাজ্য স্তরের সংগঠনগুলোকে বৈশ্বিক মহামারি চলাকালীন সময়ে উচ্ছেদ রোধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সফলতা অর্জন করতে দেখেছি। সংকটের কারণে হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের, (এর মধ্যে মধ্যে স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত কর্মীরাও রয়েছে) ছয় সপ্তাহের বিনা কাজে বেতন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে আয়ারল্যাণ্ড। এবং এই বৈশ্বিক মহামারির সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবার কোনো যোগসূত্র নেই, সম্প্রতি এক বিতর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জো বাইডেন এমন দাবি সত্ত্বেও, বহু আমেরিকান হঠাৎ করেই উপলব্ধি করছেন যে কার্যকরী সুরক্ষা নীতি না থাকার ফলে নানা দিক থেকেই বরং ভাইরাসের ঝুঁকি বাড়ছে।

পূর্বের সংকটগুলোর মতোই এই সংকটও— সমাজের উঁচুতলার ধনীদের স্বার্থ রক্ষার উপলক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে, এমনকি এর সুফল ভোগ করবে আমাদের বর্তমান দুর্ভোগ ও নাজুক পরিস্থিতির জন্য যারা সবচাইতে বেশি দায়ী তারাও, অন্যদিকে সামান্য যা পারিবারিক সঞ্চয় সেগুলো নিঃশেষ করে দিয়ে আর ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো ধ্বংসের পর অধিকাংশ শ্রমজীবীদের ভাগে পড়বে না প্রায় কিছুই। কিন্তু এই ভিডিওতে যেমনটা দেখানো হয়েছে, অনেকেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন, সেই গল্পটা এখনো লেখা হয়নি।

এবারের স্ক্রিপ্ট আমাদের জানা… (নাওমি ক্লেইনের ভিডিও বার্তার শ্রুতিলিখনের অনুবাদ )

‘কেবল একটি প্রকৃত কিংবা উপলব্ধিজাত সংকটই আসল পরিবর্তন ঘটায়। যখন সেই সংকট ঘটে, তখন বিরাজমান ধারণাগুলোর উপর নির্ভর করেই পদক্ষেপ নেয়া হয়।’-মিল্টন ফ্রিডম্যান

বিরাজমান ধারণাগুলো….স্মরণকালের অন্যতম কট্টরপন্থী মুক্ত-বাজার অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান অনেক কিছুতেই ভুল করেছেন। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তিনি ঠিক।

সঙ্কটের সময়ে, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ধারণাগুলোই হঠাৎ করেই সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু কোন ধারণাগুলো? সংবেদনশীল, ন্যায্য ধারণাগুলো, যেগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে সম্ভব নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সুস্থ রাখতে? নাকি লুটপাটের ধারণাগুলো যা আদতে গৃহীত হয়েছে ইতোমধ্যেই অকল্পনীয় রকমের সম্পদশালীদের আরও ফুলেফেঁপে ওঠা নিশ্চিত করতে এবং সবচাইতে বিপদগ্রস্থকে আরও শোচনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে?

ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে বিশ্ব-অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ছে। এই সর্ববিস্তারি আতঙ্কের মধ্যে, নিঃসন্দেহে যত প্রকারের করপোরেট লবিইস্ট আছে সবাই যার যার মতো সবরকমের ধারণা হাজির করছেন। ট্রাম্প বেতন-শুল্ক স্থগিতের দিকে ঝুঁকছেন যা সামাজিক সুরক্ষাকে দেউলিয়া করে দিতে পারে। মূলত এই খাতকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা বা বেসরকারিকরণের মোক্ষম অজুহাত দাঁড় করানোর আইডিয়া অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, এছাড়াও, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বিত্তশালী ও সর্বাধিক দূষণমূলক খাতগুলোকে আর্থিক ভর্তুকি দেয়ার পাঁয়তারা তো আছেই। ফ্র্যাকিং কোম্পানি (তেল ও গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিগুলো), এবং বলাই বাহুল্য সমুদ্র জাহাজ, এয়ারলাইনস এবং হোটেলশিল্পের জন্য আর্থিক ভর্তুকিপ্রদান ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান করতে পারে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা কারণ ভাইরাসই আমাদের একমাত্র বিপদ নয় যা আমরা মোকাবেলা করছি, জলবায়ু বিপর্যয়ও আছে এবং আমাদের টাকায় ‘উদ্ধারকৃত’ এসব শিল্পই জলবায়ু বিপর্যয়ের মূল চালিকাশক্তি।

ট্রাম্প বৈঠক করেছেন বেসরকারি স্বাস্থ্য বীমাদাতাদের সাথেও, সেইসব কোম্পানি যারা অসংখ্য আমেরিকানের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সামর্থ অর্জন করতে না পারে তা নিশ্চিত করেছে। এবং তারা যে একটা ভাগ পেতে যাচ্ছে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? দেখে মনে হচ্ছে পুরো মহামারির দায়িত্বই বাইরে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রথম পদক্ষেপটিই ছিল অর্থনীতিতে আরও ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দেয়া, নিঃসন্দেহে যার পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে। তবে আপনি যদি একজন শ্রমজীবী মানুষ হয়ে থাকেন, বিশেষত যদি আপনি হয়ে থাকেন একজন ফ্রিল্যান্স শ্রমজীবী, সেক্ষেত্রে আপনার পোড়াকপালে হওয়া একটা বড় সম্ভাবনা আছে। আপনার যদি ডাক্তার দেখাতে হয়, তাহলে আপনার অবলম্বন না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই যা হতে পারে আপনার চিকিৎসার খরচ মেটাতে কেউ এগিয়ে আসবে না।

এছাড়া আপনি যদি জনস্বাস্থ্যজনিত সতর্কবার্তা আমলে নিয়ে কাজ বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন, সেক্ষেত্রে বেতন না পাওয়ারও একটা বড় সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও, সবকিছুর পরও বাড়িভাড়া সহ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রেডিট কার্ড, বন্ধকী ঋণগুলো আপনাকে পরিশোধ করতেই হবে।

ফলাফল খুব সহজেই অনুমান করা যায়: প্রচুর লোকের অসুস্থতা সত্ত্বেও কাজে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই, যার ফলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে ভাইরাস ছড়াবে। শ্রমজীবীদের ব্যাপক আর্থিক ভর্তুকি প্রদান না করা হলে, পথে পথে আরও বেশি সর্বস্বান্ত ও বাস্তুহারা মানুষ দেখতে পাব আমরা।

দেখুন, এই নাটক আমাদের পরিচিত। ২০০৮ সালে, সর্বশেষ বৈশ্বিক মহামন্দার সময়ে আমরা কর্পোরেশনগুলোকে কাছাছোলা নিঃশর্ত আর্থিক ভর্তুকি পেতে দেখেছি, যার কড়া মূল্য চুকাতে হয়েছিল সাধারণ মানুষকেই; যা এমনকি আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল।

তের বছর আগে আমি The Shock Doctrine: The Rise of Disaster Capitalism নামে একটি বই লিখেছিলাম। এতে [এমন পরিস্থিতিতে] ডানপন্থী সরকারগুলোর নৃশংস, গণবিরোধী কৌশলসমূহের পুনরাবৃত্তির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল।

যুদ্ধ, ক্যু, সন্ত্রাসী হামলা, বাজার ধ্বস কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কোনো প্রবল আঘাতের পর, জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নেয় তারা, গণতন্ত্রকে বাতিল করে দেয় এবং গোঁড়া ‘মুক্ত-বাজার’ নীতিমালাগুলো চাপিয়ে দেয়, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে শোষণ করে ১% কে বিত্তশালী করে তুলে।

তবে আমার গবেষণা আমাকে যা শিখিয়েছে তা হলো: এই আঘাত এবং সংকটগুলো সবসময়ই ‘শক ডক্ট্রিনের’ পথ অনুসরণ করে না। প্রকৃতপক্ষে, সংকটকে বিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে  চিহ্নিত করা যেতে পারে। ১৯৩০ এর দশকের কথাই ভাবুন, যখন আর্থিক মহামন্দা নতুন চুক্তির(New Deal) দিকে ধাবিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র, সরকারগুলো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করতে শুরু করেছিল যেন পরবর্তী ধ্বসের ক্ষেত্রে মানুষকে রক্ষা করার মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আগে থেকেই বিদ্যমান থাকে।

মূল কথা হচ্ছে ট্রাম্পের পরিকল্পনা কী তা আমরা জানি: যত প্রকার বিপজ্জনক ধারণা আছে তার সবগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি ‘মহামারী শক ডক্ট্রিন’ বাস্তবায়ন করা– সামাজিক সুরক্ষার বেসরকারিকরণ, সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া থেকে শুরু করে আরও ব্যাপক হারে অভিবাসীদের বন্দি করা। এমনকি নির্বাচন বাতিল করার পাঁয়তারাও তিনি করতে পারেন।

তবে এই কাহিনির শেষটি এখনো লেখা হয়নি। এটা নির্বাচনের বছর, সামাজিক আন্দোলন এবং ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদরা ইতোমোধ্যেই সংঘবদ্ধ এবং সক্রিয়। এবং 1930 এর মতো, আমাদের কাছে গুচ্ছ গুচ্ছ বিকল্প ধারণা মজুদ রয়েছে।

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও এই বিকল্প ধারণাগুলোকে খুব বেশি ‘র‍্যাডিকাল’ বলে বাতিল করে দেয়া সম্ভব ছিল। এখন এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকটকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলোকেই একমাত্র যৌক্তিক উপায় বলে মনে হচ্ছে।

এখন ওয়াশিংটন যখন হঠাৎই এই বিরাট তৎপরতায় মেতে উঠেছে, এটাই তাহলে সেই মোক্ষম সময় তৎপর হওয়ার, যেই তৎপরতার কথা আমরা অনেকেই বিগত কয়েক বছর যাবৎ বলে আসছি । যা ‘গ্রিন নিউ ডিল’ নামে পরিচিত। গত শতাব্দীর জীর্ন শিল্পগুলোকে উদ্ধারের পরিবর্তে আমাদের নতুন শিল্পকে উৎসাহিত করা উচিত যা আগামী শতাব্দীতে আমাদের সুরক্ষার দিকে নিয়ে যাবে।

ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা হলো– আঘাতের মুহূর্তগুলো গভীরভাবে পরিবর্তনশীল। হয় আমরা জমিনের পুরোটাই হারাব, এলিটদের প্রবল পরাক্রমে বিলীন হয়ে যাব এবং দশকের পর দশক ধরে ভুগতে থাকব অথবা কয়েক সপ্তাহ আগেও অসম্ভব মনে হচ্ছিল এমন প্রগতিশীল বিজয় অর্জন করব। এটা সাহস হারানোর সময় নয়। যারা বিকল্প রূপকল্পকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, তাদের সক্রিয়তা ও লড়াই করার একাগ্রতার উপরই ভবিষ্যত নির্ভর করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *