ধ্বসে পড়তই, এবার পড়ে গেল

  • লেখক: চারু হক

তৈরিপোশাক খাত এবং প্রবাসী কর্মসংস্থান আগে থেকেই ধ্বসে পড়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। করোনা এসে ধাক্কা দিয়ে এদের পরিণতিকে চূড়ান্তে পৌঁছে দিল।

নিয়মিত ঋণখেলাপ ও অর্থপাচারের মতো দুর্নীতি, এবং সেই সাথে সরকারি দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপারঙ্গম, উদ্ভাবনী ক্ষমতায় অনিচ্ছুক রেন্টসিকিং মানসিকতার এই ভুঁইফোড় পুঁজিপতি চক্রটা এই অবস্থা বুঝতে পেরেই সাম্প্রতিক বছরগুলোকে অর্থ পাচারের গড় হার বছরে ১ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে- যার ৮০%ই করেছে আমদানি রপ্তানির মাধ্যমে। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রম, সবচেয়ে বেশি সরকারি আনুকুল্য পেয়েও তাই দেশের প্রধান এই অর্থনীতি গুটিয়ে যাচ্ছে। করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে একক জেলা হিসেবে কেবল গাজীপুরেই ১৭৮টি বৃহৎ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে গেছে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক। এবং এটাই এখন নিয়মিত ঘটনায় রূপ নিতে যাচ্ছে, যার অংশ হিসেবে এখন শ্রমিক ছাটাইয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্লাডলাইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, দেশের অর্থনীতির প্রধান খাতের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটতে চলেছে।

অর্থনীতির পরের পিলার প্রবাসী কর্মসংস্থান খাতও একই পরিনতিতে ধাবিত হচ্ছিল। প্রবাসী প্রধান রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সংস্কার, জনমনস্তত্বের পরিবর্তন এবং সেই সাথে সম্ভাব্য সমস্ত ক্ষেত্রে শুরু হওয়া অটোমেশন প্রযুক্তি বিশ্বজুড়েই অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমিয়ে এনেছে। সর্বগ্রাসী করোনাভাইরাস এসবের সাথে অর্থনৈতিক সংকোচন বা কৃচ্ছতা সাধনকে অনিবার্য করে তোলায় পরিস্থিতি দ্রুতই পরিণতির দিকে পৌঁছে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, কেবল সৌদি আরব থেকেই ১০ লাখ প্রবাসী শ্রমিককে ফিরতে হবে বাংলাদেশে। এবং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলোও একে একে এরকম পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই পরিসংখ্যানগত প্রতারণার বাইরে বাংলাদেশে যেশ্রমশক্তির অর্ধেক (প্রায় ৫ কোটি) মানুষই বেকার বসে আছে- এর সাথে আরও এক কোটি অতিরিক্ত বেকার, এবং সেই সাথে করোনার প্রভাবে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত সাড়ে ৫ কোটির মধ্যে বিরাট সংখ্যক যারা অলরেডি সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছে- তাদের সবাইকে সহ কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কততে দাঁড়াবে সে অনুমান আমাদের আতংকিত করে তুলছে। অতএব এ অবস্থায়, এতদিন যারা সরকারি সুবিধায় অর্থপাচার করে এসেছে গভীর ঘনত্বসহ চারিপাশে চেপে আসা অন্ধকার এখন তাদের নিজেদেরকেও পাচারে প্রলুব্ধ করছে। এই চক্রের সহায়তায় তাদের সরকার আগে থেকেই বিমান পরিচালনায় কোনরকম বাধা যাতে না আসে সেজন্যে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের আইন করেছে। এবং একই কারণে সম্প্রতি করোনা সংকটা কাজে লাগিয়ে আলাদা জোন করে তাদের পালিয়ে যাবার পথ আরও নিরাপদ করে দিয়েছে।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিবাজ কেরানী আবজাল- যাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সমস্ত প্রতিষ্ঠান সপরিবারে বিদেশে সংস্থান করেছে, এই খাতের বাকিসব কর্মচারিরাও যাতে দুর্নীতিতে সাম্যের অধিকার অর্জন করতে পারে সেজন্যে করোনাকালীন কেনাকাটাতেও তাদের জন্যে গলাকাটা দুর্নীতির সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে। ২-১ হাজার টাকার পিপিই তারা ৪৭ হাজার টাকা দেখিয়েছে। এবং জাফরুল্লাহর স্বদেশী স্বাস্থ্য সামগ্রীর অনুমতি না দিয়ে নানান দেশে থেকে মানহীন মালামাল আমদানির মাধ্যমে যাচ্ছেতাই লুটপাটের মচ্ছব অটুট রাখা হয়েছে।

মুক্তি ও মানবিক মর্যাদার জন্যে সর্বাত্মক যে যুদ্ধ হয়েছিল, যাকে এতকাল মুক্তিযুদ্ধ বলা হতো- সেটা স্রেফ এক গালগল্প যেন; এই বাংলাদেশ বলের ফলে গঠিত এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমেই পরিচালিত।

  • চারু হক: লেখক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *