বাংলাদেশের সংবিধান: উপনিবেশের উত্তরাধিকার

  • লেখক: ফিরোজ আহমেদ

বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান যে পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যুকৃষ্ট, সম্ভাব্য প্রায় সকল ভাল ভাল বাক্য এবং প্রতিশ্রুতি এখানে অকাতরে উপহার দেয়া আছে, এবং এর গুরুত্ব নিয়েও প্রচুর লেখা হয়েছে। সংবিধান বিষয়ক অধিকাংশ রচনা পাঠ করলে ধারণা হবে ‘৭২ সালের আদি সংবিধান থেকে বিচ্যুত হবার কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান নিয়তি। কিন্তু সংবিধান বিষয়ক মূলধারার অধিকাংশ গ্রন্থে বাংলাদেশের সংবিধান কোন প্রক্রিয়ায় কাদের দ্বারা রচিত হয়েছিল, জনগণের কত অংশের কোন প্রতিনিধিত্ব এই সংবিধান রচনার সময় ছিল কিংবা ছিল না, রাষ্ট্রের সাথে জনগণের ক্ষমতা-সম্পর্কে কোন কোন অধিকারের নিশ্চয়তা এই সংবিধান দিয়েছে বা দেয়নি এই সব বিষয়ে আলোচনা পাওয়া যায় বেশ কমই। জনপ্রিয় অধিকাংশ রচনায় বর্তমান সংবিধানকে ৭২ এর সংবিধান থেকে পৃথক করে দেখার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু ৭২ এর সংবিধানের রচনাপ্রক্রিয়ার মাঝেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মাঝে একদিকে পাওয়া যাবে বৃটিশ ও পাকিস্তানী উপনিবেশের ধারাবাহিকতা, অন্যদিকে পাওয়া যাবে পরবর্তীকালের বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহেরও মূলবীজ। সেই কারণেই ৭২ এর সংবিধান,এটা প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান প্রয়োজন।

স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়নে প্রথম সরকারী পদক্ষেপ হলো ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ জারি করা বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ। গণপরিষদ আদেশ অনুযায়ী গঠিত সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত সংবিধানসভার (বাংলাদেশে যেটির নামকরণ হয়েছিল গণপরিষদ) গঠন ও কার্যপ্রণালী শুরু থেকেই দুটি বিতর্ক উঠেছিল। প্রথমটি হলো গণপরিষদের নৈতিক বৈধতার ভিত্তি, অপরটি হলো সংবিধান রচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের এই সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারহীনতা এবং রাষ্ট্রপরিচালনার অধিকারহীনতা। প্রথম প্রশ্নটি উত্থাপন করছিলেন আওয়ামী লীগ বাদে বাকি প্রায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। দ্বিতীয় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল আওয়ামী লীগেরই অভ্যন্তরে।

গণপরিষদের নৈতিক বৈধতা

দেশ স্বাধীন হবার মাত্র অল্প কয়েকদিন পরই ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সমাজসেবা সম্পাদক কে.এম ওবায়দুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে জনগণের পূর্ববর্তী ম্যানেডেট অনুসরণের ওপর গুরুত্ব দেন:

‘জনগণের ইতিপূর্বে প্রদত্ত ম্যানডেট অনুযায়ী কাজ করা উচিত। নির্বাচিত প্রতিনিধি নহেন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত কোন সরকার দেশে গুরুতর আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণ হইতে পারে।’

[সূত্র: সাংবাদিক সম্মেলনে ওবায়দুর রহমানের বিবৃতি, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১)]  

আওয়ামী লীগের তরফ থেকে এই বিবৃতির প্রয়োজন পড়েছিল, কারণ সংবিধান প্রণয়ন সভাটি কিভাবে গঠিত হবে, সেটা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানান প্রশ্ন ও প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়া শুরু হয়েছিল। কে এম ওবায়দুর রহমানের এই সংবাদ সম্মেলনের ঠিক দু’দিন আগেই ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত আরেকটি সংবাদ সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান গ্রহণের জন্য আহবান জানায়, এবং এরই সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়ায় কে এম ওবায়দুর রহমান পূর্বোক্ত মত প্রকাশ করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদ গুরুতর সেই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন, তার মতে আর একটি সাধারণ নির্বাচন না করে দেশের জন্য কোন স্থায়ী সংবিধান গ্রহণ করা যেতে পারে না। তাৎপর্যপূর্ণ এবং অসাধারণ একটা উপলদ্ধিই থেকেই তিনি এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন: স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দেশে একটা গুনগত পরিবর্তন সাধন হয়েছে এবং এই পরিস্থিতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে জনগণের মতামত যাচাই ও বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে অপর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অপরিহার্য। [সূত্র: ২২ ডিসেম্বর অবজারভার পত্রিকায় ‘সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও অন্তবর্তীকালীন সংবিধান গ্রহণের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফর) আহবান]  

পরবর্তীতে এই বিতর্কটি ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেও উঠেছিল। সংবিধান প্রণয়নের জন্য নতুন নির্বাচন দেয়া উচিত, মোজফফর সাহেবের এই মতামতের প্রতি ইঙ্গিত করে এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন:

‘মাত্র এক বৎসর পূর্বে আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। কেহ কেহ এখনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে চাহিলে, আমরা তাহাদের ইচ্ছামত যে কোন নির্বাচনী এলাকাতেই তাহাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে প্রস্তুত আছি। শীঘ্রই কতকগুলি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে এবং তাহারা উক্ত সকল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া দেখিতে পারেন। আমি নিশ্চিত, তাহাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হইবে।’

(ইত্তেফাকবাংলাদেশ অবজারভার, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭২)।

উল্লেখ্য যে, এই প্রতিশ্রুত উপনির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

এভাবে ‘মাত্র এক বৎসর পূর্বে নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মধ্য দিয়ে গোটা জাতির রাজনৈতিক চেতনার যে বিকাশটি ঘটেছিল, তাকে পাশ কাটানো হয়। কারণ নতুন নির্বাচনের যুক্তি উত্থাপিত হয়েছিল মাত্র এই এক বছর সময়ের মাঝে জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর রাজনৈতিক চেতনার যে বিকাশ ঘটেছিল, তার প্রতিফলন ঘটাবার জন্য। আগের নির্বাচনটি কত আগে হয়েছে, সেটা এখানে বিবেচ্য হতে পারে না। বরং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে জন্ম নেয়া সেই উচ্চতর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের জন্যই প্রয়োজন নতুন নির্বাচন, এটিই ছিল বিরোধীদের দাবি।

অল্প কিছুদিন পরই ১৯৭২ এর ৬ অক্টোবর প্রদত্ত এক বিবৃতিতে দুই প্রাক্তন প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম. আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ বলেন,

“পরিষদ-সদস্যের শতকরা নব্বই জনই যেখানে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সাথে যুক্ত না থেকে আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দিয়ে এবং নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সম্পূর্ণ সময়টুকু ভারতে নির্লিপ্ত জীবন যাপন করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সেই সব গণপরিষদ-সদস্যের আদৌ আছে বলে দেশবাসী মনে করেন না।”

[সূত্র: ৭ অক্টোবর দৈনিক গণকণ্ঠ।]

তারা আরও একটা প্রশ্ন তোলেন, সেটা হলো “প্রায় ৫০ জনের অধিক গণপরিষদের সদস্যের (যাহারা দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত, অনুপস্থিত এবং পদত্যাগী) অবর্তমানে, অর্থাৎ বাংলাদেশের এক কোটির বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।” উল্লেখ্য যে, পূর্বোল্লিখিত সংবাদ সম্মেলনেই সদ্যদায়িত্ব গ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ‘শীঘ্রই কতকগুলি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং সেখানে বিরোধীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও এই উপনির্বাচনগুলো যে আদৌ আর আয়োজন করা হয়নি, সেই দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সংবিধান বিষয়ে তখনকার আরেকটি প্রভাবশালী দল মওলানা ভাসানীর ন্যাপও প্রশ্ন উত্থাপন শুরু করেছিল। এই দলটি ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ শ্লোগান দিয়ে ১৯৭০ সালের সেই নির্বাচন বর্জন করে। মওলানা ভাসানী এবং তার গোত্রভুক্ত অনেকেরই রাজনৈতিক তৎপরতা বেশ আগে থেকেই স্বাধীন পূর্ববাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছিল। সে কারণেই তারা ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। শুরুর দিকে গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন না করলেও এবং নতুন সরকার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত ন্যাপের মুখপত্র সাপ্তাহিক হক কথায় ‘সংবিধান প্রণয়ন করিবে কাহারা’ র্শীষক নিবন্ধটিতে ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট নিয়ে বিজয়ী হওয়া ব্যক্তিদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার বিষয়ে প্রথম ইঙ্গিতপূর্ণ কথা তোলা হয়। [সূত্র: হককথার সবগুলো উদ্ধৃতি সাপ্তাহিক হক কথা সমগ্র থেকে গৃহীত। বিপুল জনপ্রিয় এই সাপ্তাহিকটি ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ হয়।]

পরবর্তীতে হক কথার ১৪ জুলাই সংখ্যাটিতে আরও স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে ‘গণপরিষদের আইনী ভিত্তি কোথায়’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে বলা হয়:

‘জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পাঁচ দফা শর্ত মেনে এই সদস্যরা নির্বাচনে গিয়েছিল। সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদ তথা গণপরিষদ নির্বাচিত হয়েছিল, তৎসহ নির্বাচিত হয়েছিল প্রাদেশিক পরিষদ।…. পাকিস্তান কায়েম থাকাকালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই দুই সময়ের ব্যবধান মাত্র ৯ মাস হলেও রাজনৈতিক সচেতনতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যদানের দিক দিয়ে জনগণ অনেক এগিয়ে গেছে।’

এরপর গণপরিষদ খসড়া সংবিধান উত্থাপন করলে মওলানা ভাসানী ও তার রাজনৈতিক দল ন্যাপ (ভাসানী) এর বিভিন্ন ধারার তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি গণপরিষদের বৈধতা নিয়ে আবারও সরাসরি প্রশ্ন তুললেন। ২০ অক্টোবর প্রবীণ মওলানা ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় আবারো বলেন:

‘বর্তমান গণপরিষদে ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারের আইনগত কাঠামোর অধীনে নির্বাচিত সদস্যগণ ৬-দফা দাবী আদায়ের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পাইয়াছিলেন। সুতরাং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির সম্মিলিত সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় তাহাদের কোন অধিকার নাই।’

[সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ অক্টোবর, ১৯৭২]

ভাসানীর রাজনৈতিক বলয় থেকে শুরুতে আওয়ামী লীগের সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার নিয়ে মৃদুস্বরে সমালোচনা করলেও, কোন কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক মতামত প্রকাশ করলেও গণপরিষদ সদস্যদের দেশব্যাপী নিপীড়ন, ত্রাণসামগ্রী চুরি, সম্পত্তি দখল, দুর্নীতিসহ নানান অপরাধমূলক তৎপরতার অজস্র সংবাদ প্রচারিত হওয়া শুরু হলে অচিরেই গণপরিষদের এই সদস্যদের সংবিধান প্রণয়নের নৈতিক অধিকারটি জনমনেও গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

সম্ভবত এই বৈধতার প্রশ্নটিকে মওলানা  ভাসানীই প্রথম এই দিক দিয়েও উত্থাপন করেন যে, এই গণপরিষদের সদস্যদের জনগণ নির্বাচিত করেছিল পাকিস্তানের কাঠামোর মাঝেই সীমিত সায়ত্ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত ৬ দফার বাস্তবায়নের জন্য। ফলে বৈধতার প্রশ্নটিকে দুটি দিক থেকে ন্যাপের দুই অংশ থেকে উত্থাপন করা হয়। মোজাফফর সাহেব স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনার যে বিকাশ ঘটেছে, তার প্রতিফলন ঘটাবার জন্য নতুন করে গণপরিষদের নির্বাচনের অনুরোধ করেন। অন্যদিকে ভাসানী এই গণপরিষদ পাকিস্তানের কাঠামোর মাঝেই নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, সেই দিকটি তুলে ধরেন। উভয় বক্তব্যেরই মূল সুর একই: স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদটি স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের চেতনার বহিঃপ্রকাশ নয়। মোজাফফর সাহেব, পূর্বেই বলা হয়েছে, অচিরেই রাজনৈতিক মিত্র আওয়ামী লীগের চাপে আত্মসমর্পণ করেন।

মস্কোপন্থী মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ অবশ্য এই বৈধতার প্রশ্ন একেবারে শুরুতেই উত্থাপন করলেও পরবর্তীতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাদের প্রতিনিধি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অংশগ্রহণ করেন। তিনিও শেষ পর্যন্ত সংবিধানে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে গণপরিষদের একমাত্র সদস্য হিসেবে তাতে স্বাক্ষর প্রদান থেকে বিরতও থাকেন। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চীনপন্থী ধারা বলে পরিচিত প্রায় সকলে সম্মিলিতভাবে এই বৈধতার প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন। এদের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কাঠামোর আওতায় জনগণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগকে দিয়েছিল। মওলানা ভাসানী সমেত অনেকেই সেই নির্বাচনকে বয়কটও করেছিল, তাদের রাজনৈতিক দাবি ছিল পূর্ববাংলাকে মুক্ত করা। এরপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা, জনগণের মুক্তির সংগ্রাম প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষার যে বিকাশ ঘটলো, সেটিকে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তানের সংবিধান পরিষদ ধারণ করতে পারে না। ন্যাপ ভাসানীর মত প্রভাবশালী বহু রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে আদৌ অংশও নেয়নি। ফলে নতুন সংবিধান পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেয়াটা তাদের বিবেচনায় ছিল ন্যায়সঙ্গত একটি দাবি। অচিরেই অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাওয়া জাসদ গঠনকারী নেতৃবৃন্দও গণপরিষদ অধিকাংশ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎপরতা নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করেন।

ফলে গণপরিষদের বৈধতার এই গুরুতর প্রশ্নটা উল্লেখযোগ্য বেশ কটি মহল থেকেই উঠেছিল। ভারত ও পাকিস্তানের বেলায় সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে বৃটিশ আমলে অনুষ্ঠিত হওয়া শেষ নির্বাচনে বিজয়ীরাই দায়িত্ব পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী সংবিধান প্রণয়নের জন্যই জনগণ সেই নির্বাচনে তাদের ভোট দিয়েছিল। এ দেশ দু’টিতে শাসকের পরিবর্তন কোন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয়নি, বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা আইনী ধারাবাহিকতাই রক্ষিত হয়েছিল। ফলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ‘আইনী অর্থে’ বৈধতার অভাব তাদের ছিল না, সেই প্রশ্ন ওঠেওনি। কিন্তু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন চেতনাগত উত্তরণের সুবাদে সেই ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা সঙ্গতকারণেই ছিন্ন হবার কথা ছিল।

কিন্তু সাংগঠনিকভাবে বহুধা বিভক্ত পিকিংপন্থী বা চীনাপন্থী বা মাওবাদী বলে পরিচিত দল-উপদলসমূহ এবং আওয়ামী লীগ ভেঙে বেড়িয়ে আসা সদ্যোজাত জাসদ ঠিক এই প্রশ্নে কোন মাঠের আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। এমনকি, ঘটনাপ্রবাহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিকাশ হিসেবে আবির্ভূত জাসদ এর সাথে সরকার বিরোধী অন্যান্য বামদলগুলোর তেমন কোন কর্মসূচিগত ঐক্য সংবিধান বা অপর কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গড়ে ওঠেনি। অপরদিকে ন্যাপ মোজাফফর গণপরিষদের বৈধতা নিয়ে শুরুতে প্রশ্ন তুললেও দ্রুতই তারা তাদের নির্ধারক রাজনৈতিক মিত্র আওয়ামী লীগের অস্বস্তি উপলব্ধি করে প্রশ্নটিকে পাশ কাটায়। শুরুতে এই বৈধতার প্রশ্নটিকে যথাযথ গূরুত্ব দিয়ে উত্থাপন করলেও পরবর্তীতে এই বিষয়টি তারা আর উত্থাপনই করেনি। ফলে বৈধতার প্রশ্নটির আইনী-রাজনৈতিক গুরুরুত্ব যতই বিপুল হোক না কেন, আওয়ামী লীগ এই প্রশ্নটিকে আমলে না এনেই রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে প্রায় অনায়াসে একে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। বরং যে গণপরিষদকে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়, স্বয়ং সেই গণপরিষদের নিজস্ব এখতিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কত সামান্য ছিল, সেই প্রশ্নটিই অতিসামান্য পরিমানে হলেও অস্বস্তির জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল। কেননা মুক্তিযুদ্ধের অবসানে প্রবল প্রতাপশালীরূপে আবির্ভূত আওয়ামী লীগের মাঝেই বহুমুখী অন্তর্দ্বন্দ্বের আভাস ছিল সেই বিতর্কে।

মওলানা ভাসানী

গণপরিষদের এখতিয়ার

সংবিধান প্রণয়নপর্বে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কটি ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের ক্ষমতা ও কার্যবিধির সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটি। আগের পর্বে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের নৈতিক বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মাঝে তরুণতর একটা অংশের মাঝে জন্ম নেয়া ‘বিপ্লবাত্মক’ চিন্তাও আওয়ামী রাজনীতির সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আকারেই প্রশ্নটি উত্থাপন করে। কিন্তু গণপরিষদকে সংবিধান প্রণয়নী সভা হিসেবে যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাদের রাজনৈতিক স্বার্থ আওয়ামী লীগ ও গণপরিষদের সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের অনেকের জন্যও অস্বস্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল গণপরিষদের এখ্তিয়ারের সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটি। অকার্যকর একটি গণপরিষদ যাদের ভেতর অস্বস্তি, অসন্তুষ্টি কিংবা ভিন্ন চিন্তার জন্ম দিয়েছিল, তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিরই অভ্যন্তরস্থ পক্ষসমূহ।

ঘটনাপ্রবাহ যতই অগ্রসর হতে থাকে, আওয়ামী লীগের বাইরের শক্তিগুলো যেমন অল্পসময়ের মাঝেই বেশ দ্রুতগতিতে শক্তিসঞ্চার করতে থাকে, ভেতরের স্বার্থগুলোও বেশ কটি ধারায় দানা বাধে। বায়াত্তর সালের পত্রপত্রিকার দিকে চোখ বোলালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বড় অংশের বেপরোয়া লুণ্ঠনজনিত রাষ্ট্র ও সমাজের নৈরাজ্যের আংশিক চিত্রটি যেমন পাওয়া যাবে, রাজনৈতিক কর্মসূচির উত্তরোত্তর তীব্রতা বৃদ্ধি থেকে অন্যান্য দলগুলোর দ্রুত শক্তিসঞ্চয়ও উপলদ্ধ হবে। সংবিধান প্রণয়নের স্বল্পায়ু কালপর্বটিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার জোর এবং সেই সাথে বাস্তব রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি দিয়ে দলের বাইরের বিরোধিতা অতিক্রম করতে পেরেছিল। আওয়ামী লীগের ভেতরের প্রশ্নগুলো কিন্তু দলটির কিংবদন্তি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি ও ব্যক্তিত্বের সামনে ঠিকমতো পরিস্ফূটই হতে সক্ষম হয়নি, সেগুলো আভাসমাত্র দিয়েই তাৎক্ষণিক মিলিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন ভিন্ন চিন্তা ও মতগুলো শেখ মুজিবকে কোন কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি করতেই সক্ষম হয়নি।

৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান এবং ১০ তারিখ বাংলাদেশে আসেন। ওই দিনই ইতিপূর্বে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপতি ধরনের শাসনের বদলে ওয়েস্টমিনিস্টার ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। এরপরই সংবিধানসভা হিসেবে মনোনীত গণপরিষদকে তিনি দুই ভাবে ক্ষমতাহীন করেন: প্রথমত, আর সব গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান প্রণয়নী সভার হাতে রাষ্ট্রের প্রায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকলেও গণপরিষদকে এ থেকে বঞ্চিত করা হয়; দ্বিতীয়ত, গণপরিষদের সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার আইন করে রুদ্ধ করা হয়।

ব্যরিস্টার আবদুল হালিম এই প্রেক্ষিতে একটা ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির যে বৈঠকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ‘রাষ্ট্রপতির ধরনের সরকার’ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর ধরনের সরকার’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন, ওই একই বৈঠকে তিনি জানান যে, সংবিধান পরিষদকে আইনপ্রণয়নী কিংবা মন্ত্রীসভার কাজকর্ম তদারকির কোন ক্ষমতাই দেয়া হবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের দেবতুল্য জনপ্রিয়তার মুখে কেউ এর প্রতিবাদ করতে সাহস করেননি, কেবলমাত্র আমির-উল-ইসলাম ‘অনভিজ্ঞতাহেতু’ আপত্তি প্রকাশ করেন এবং তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, অস্থায়ী সংবিধান আদেশ এর খসড়া প্রণয়নের আগেই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা অবশ্যই আহবান করা উচিত, আর গণপরিষদকে আইনপ্রণয়নের ক্ষমতা না দেয়াটাও চরম অগণতান্ত্রিক হবে। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে তিরস্কার করে থামিয়ে দেন। [ভাষ্যটা আবদুল হালিমের মেকিং দা কন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থে এ রকম: অ্যাট দিস সাজেশন শেখ মুজিব স্টপড হিম (আমীর-উল-ইসলাম) বাই সেয়িং : য়ু আর অ্যান ইনএক্সপিরিয়েন্সড ইয়াং ম্যান। হোয়াট নলেজ ডু য়ু কিপ য়্যাবাউট স্টেট য়্যাডমিনিস্ট্রেশন? ] হালিম সাহেবের বিবরণ অনুযায়ী আমির সাহেব ঐ বৈঠকে নিজেকে ‘স্টুপিড’ হিসেবে আবিষ্কার করলেন, ‘এক্সপিরিয়েন্সড’ ব্যক্তিরা কেউ তার সমর্থনে কিছু বলার সাহস পেলেন না।

সংবিধান পরিষদ যে অস্থায়ী সংসদ হিসেবে বিবেচিত হবে না এবং সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রটি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনসমূহ প্রণয়নের দায়িত্বটি পাবে না, সেটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের একটা ইঙ্গিতও এখানে পাওয়া যাবে। সংবিধান প্রণীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হবার সাথেও এর ভবিষ্যত নিয়তির একটা গুরুতর সম্পর্ক রয়েছে। আদতে, এই কয়েক মাসের ক্ষমতার চর্চার ধরণই পরবর্তীকালের বাংলাদেশে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হবার ভিত্তি রচনা করেছে, এবং সেদিক থেকে বলা যায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চার ধারাবাহিকতা প্রথম দিন থেকেই অব্যাহত আছে আজও।

স্বাধীনতা পাবার পর ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেই ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টের অধীনে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ীরা দু’টি পৃথক সংবিধান পরিষদ গঠন করেন। তাদের বৈধতার উৎস ছিল এই যে, ওই নির্বাচনে নির্বাচিতগণ অবিভক্ত বৃটিশ-ভারতের জনগণের কাছ থেকে সংবিধান প্রণয়নের জনরায় (ম্যান্ডেট) গ্রহণ করেছিলেন। নতুন সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রদ্বয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবেও এই দুই সংস্থাই কার্যকর ছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রে সংবিধান পরিষদ সংবিধানসভা ও আইনসভার দ্বিবিধ ভূমিকাই পালন করে। মন্ত্রীসভার ওপর এর কর্তৃত্ব ছিল, মন্ত্রীসভা সংবিধান পরিষদের নিকট দায়বদ্ধ ছিল। পরিষদের অনুমতি ছাড়া সরকার কোন অর্থ ব্যয় করতে পারতো না, কোন নতুন করও আরোপ করতে পারতো না।

বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এই গণপরিষদের কোন আইনপ্রণয়নী ক্ষমতা ছিল না, মন্ত্রীসভার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, ছিল না সরকারের ব্যয়ের ওপরও কোন তদারকির ক্ষমতা। ফলে যে বিপুল বিস্তারী রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির লুণ্ঠন, অপব্যয় এবং তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির কাজে বেপরোয়া ব্যবহার রুদ্ধ করার কোন আইনী ব্যবস্থা কিংবা জবাবদিহিতা আদায়ের উপায় প্রথম থেকেই ছিল না। ’৭২ সালের ওই সময়েই সাপ্তাহিক হক কথায় তুলনামূলক কম দামে ইউরোপীয় নতুন জাহাজ না কিনে কিভাবে পুরানো ভারতীয় জাহাজ কিনে রাষ্ট্রীয় অর্থের লোপাট করা হচ্ছিল তার বর্ণনা পাওয়া যাবে, এবং এ জাতীয় অজস্র ঘটনা ঘটছিল। কলকারখানার যন্ত্রাংশ ক্রয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রির পারমিট থেকে শুরু করে লাইসেন্স, ঠিকাদারি সকল কাজেই রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক লুণ্ঠন তদারক করার মত কোন ব্যবস্থা প্রথম থেকেই করা হয়নি। প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে এই কাজটি সংসদই করে থাকে, এখন পর্যন্ত আামাদের দেশে রাষ্ট্রীয় নিরীক্ষণ সম্পূর্ণতই আমলাদের হাতে।

এছাড়া সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল এককভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর, যিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোন কিছু করতে পারতেন না। এভাবে গণপরিষদ কার্যত রাষ্ট্রপতির (এবং রাষ্ট্রপতি আইনত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই সকল কাজ পরিচালনা করতেন বলে প্রধানমন্ত্রীর) অধীনস্ত হল এবং সরকারের জবাবদিহিতা চাইবার মত কোন প্রতিষ্ঠান আর অবশিষ্ট থাকলো না।

গণপরিষদকে কোন রকম ক্ষমতা না দেয়ার পেছনে জনপ্রিয় যে যুক্তিগুলো দেয়া হয়, সেটা হলো সংবিধান প্রণয়নে পাকিস্তানের নয় বছর লেগে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের সংবিধান পরিষদকে আর সব দায় থেকে মুক্ত করা হয়েছিল, যাতে বিলম্ব ছাড়াই দায়িত্বটি পালন করা যেতে পারে। বহুবিধ কারণে এই অজুহাত ধোপে টেকে না, যেমন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংবিধান প্রণয়নে একটি বড় আপদ ছিল রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ। সংবিধান প্রণেতাদের জন্য এমন একটা ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন করাটা জটিলতম সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল যেটা আবার পরস্পর বিরোধী বৈচিত্রপূর্ণ কতগুলো জাতি, পক্ষ ও গোষ্ঠীর স্বার্থের সমন্বয়ও ঘটাবে। আরও বেশি সময় লেগেছিল কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পূব আর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য কিভাবে রক্ষিত হবে, সেটি নির্ধারণ করতে। এরপর ছিল ভাষা বিতর্ক, স্থানীয় পরিষদ আর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার বন্টন কিভাবে ঘটবে- এইসব ঝামেলা। এবং শেষত সংবিধান প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতায় এটাকে বিলুপ্ত করে দেয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন রীতিমত বিপদগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ সকল দিক দিয়েই এই দ্বন্দ্ব ও জটিলতাগুলো থেকে মুক্ত ছিল।

ফলে এই যুক্তি এখানে অবান্তর যে অতি দ্রুত একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদকে আর কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি, এটা আসলে দায়িত্ব না প্রদান করা বা গণপরিষদের কাজের বোঝা কমিয়ে দেয়া নয়। এটা কার্যত ছিল গণপরিষদকে ক্ষমতাচ্যুত করা, তার এখতিয়ারকে সমূলে বিনষ্ট করা। নিজ দলের ভেতরে যে অবিশ্বাস এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতির কারণে পরিস্থিতির বিকাশের ওপর তার আস্থার ঘাটতি থেকেই এটা করা হয়েছিল (এ বিষয়ে ৪ নং পাদটীকা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য)।

ছবিসূত্র: বাংলাট্রিবিউন

গণপরিষদের ভেতরে থাকা সদস্যরা কেউ কেউ গণপরিষদের হাতে এই ক্ষমতা প্রদানের দাবি উত্থাপন করেছিলেন বটে, তারাও ব্যরিস্টার আমীরের মতই নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। নিয়তির বড় পরিহাস, নতুন গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে উড়িয়ে দেয়া কেএম ওবায়দুর রহমানই গণপরিষদকে কেন নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হবে না, এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন পরিষদের দ্বিতীয় সভায়। গণপরিষদের পরিষদ বিতর্ক, বাংলাদেশ গণপরিষদ, মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ১৯৭২ থেকে উদ্ধৃত:

জনাব স্পীকার: আমাদের সভার কাজ আরম্ভ হবে।
জনাব কে, এম, ওবায়দুর রহমান: মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই পরিষদের সদস্যগণ জনসাধারণের নিকট দায়িত্বশীল। কিন্তু মন্ত্রিসভা এই পরিষদের নিকট দায়িত্বশীল নন। ইহা গণতন্ত্র পরিপন্থী। মাননীয় স্পীকার সাহেব, বঙ্গবন্ধু সব সময়েই পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। আমরা পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য জনগণের নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই প্রসঙ্গে মাননীয় স্পীকার সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। ১৯৪৭ সালে ভারতে নেহেরু সরকার ভারতীয় গণপরিষদের নিকট দায়িত্বশীল ছিলেন। পাকিস্তানের লিয়াকত আলি সরকারও তৎকালীন পরিষদের নিকট দায়িত্বশীল ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তান উভয় সরকারের গণপরিষদ জাতীয় পরিষদেরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই পরিষদ যদি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী না হন, তবে মন্ত্রিসভার ক্ষমতার উৎস কোথায়!
মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমি দাবী জানাচ্ছি যে, অবিলম্বে এই গণপরিষদকে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম পার্লামেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

আগে উল্লেখ করা আমীর উল ইসলামের গল্পের সাথে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায়, গণপরিষদকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ তদারকি ক্ষমতা তুলে দেয়ার এই প্রস্তাব শেখ মুজিবুর রহমানের ক্রোধের উদ্রেক করবে। ঘটলোই ঠিক তাই। গণপরিষদের বিবরণীর ঠিক পরবর্তী অংশে আমরা পাই:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: মেম্বারদের আর একটা বিষয়ে হুঁশিয়ার করতে চাই। স্পীকার যখন কথা বলেন, তখন আর কোন মেম্বরের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবানি করে তাকে পরিষদ থেকে বের করে দিতে পারেন।

ওই শেষ। এই হুঁশিয়ারির পর আওয়ামী লীগের আর কোন সদস্য গণপরিষদের হাতে সার্বভৌম সংসদের ক্ষমতা তুলে দেয়ার প্রস্তাব কখনো আর তোলেননি।

গণপরিষদকে অকার্যকর করার এই কায়দাটিকে বাস্তবায়ন করার জন্য আওয়ামী লীগ কিন্তু শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের মন্ত্রগুণের ওপরই শুধু নির্ভর করেনি, তার জন্য প্রয়োজনীয় দাওয়াই এর বন্দোবস্তও আগে আগেই তৈরি ছিল। সেটি ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ, [কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি (সিসেশন অব মেম্বারশিপ) অর্ডার(পিও ন. ২৩ অব ১৯৭২)]। বাংলাদেশের ইতিহাসেব এটি সবচে বড় গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী আইন। রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশ বলে প্রণীত বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ আইনটির অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:

৩। (১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক  দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে এবং উক্ত দলের সদস্যপদ লাভ করে কোন ব্যক্তি পরিষদ-সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি (ক) উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন; অথবা (খ) উক্ত দল হতে বহিষ্কৃত হন;

তবে তার মেয়াদকালের অসমাপ্ত সময়ের জন্য তিনি আর পরিষদ-সদস্যপদে থাকবেন না। আইনটির ৫ সংখ্যক ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীনে প্রণীত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

৫। এই আদেশের অধীনে প্রণীত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন আদালত কোন প্রশ্ন উত্থাপন করিবেন না।

গণপরিষদকে সংসদের ক্ষমতা না দিয়ে বরং এমনি আরও অনেক নির্বাহী আদেশেই তখন দেশ পরিচালিত হচ্ছিল, এবং নির্বাহী আদেশ প্রদানের এই ধরনের মাঝেই সেই সঙ্কটের বীজ নিহিত ছিল, যা পরবর্তীতে মহীরূহ আকারে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করবে। এই ক্ষমতা যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকেই উৎসরিত [‘রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী-বিভাগীয় ও আইনপ্রণয়নগত ক্ষমতা চর্চা করিবেন’, ‘কর ধার্য ও অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে’], তারপরও এর অবারিত চর্চা স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে যে ক’টি গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটির উদগাতা।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসের শুরুতেই আমরা একদিকে দেখব একদিকে বৃটিশ কায়দায় সংসদীয় সরকার গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা, আরেকদিকে ছিল চরমতম ব্যক্তিকেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকাশ্য তোড়জোড়। গণপরিষদের সদস্যদের স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দান, এবং সেই মতপ্রকাশ মনমতো না হলে তা দলন। উপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা প্রাপ্ত হওয়া ভারত-পকিস্তানের তুলনায় যে বিপ্লবাত্মক চরিত্র রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের থাকার কথা ছিল, তা তো হয়ইনি, আওয়ামী লীগের নিজেরই আয়ত্তে থাকা গণপরিষদের কাছ থেকেও তার স্বাভাবিক কর্তৃত্বটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধারা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার কাজে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ও প্রভাবকে ঠিকই ব্যবহার করা হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী কালে দল ও নেতার বিপুল জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার মোটেই করা হয়নি। দলের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাস এর পরিণতিতে তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে সংসদীয় উত্থানের আশঙ্কা থেকে হোক, আর জাসদের মত অন্য নতুন কোন ভাঙনের ভীতি থেকে হোক কিংবা আরও ডানপন্থী সাংসদদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ক্রমশ শক্তিশালী হওয়ার কথিত বিপদ থেকে বাঁচার জন্য হোক, সংসদীয় গণতন্ত্রকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে করার তত্ত্বগত সূচনা ও বাস্তব অনুশীলনে শুরু একদম প্রথম দিনটিতেই।

বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশটিকে আওয়ামী মতাবলম্বী আইনবিদগণ পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ন্যায়সঙ্গত কাজ হিসেবেই দেখাতে চান। পাকিস্তানে ১৯৪৭-৫৬ এই নয় বছর লেগেছিল সংবিধান প্রণয়নে, কেননা সেখানে সদস্যদের পক্ষ ত্যাগের কোন আইনী প্রতিবন্ধকতা ছিল না। কিন্তু সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অপর একটি অংশ এই অজুহাতটিকে খারিজ করে দেন, কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই ধারার কোন প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। পাকিস্তান বা ভারতের কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির মত বাংলাদেশের সংবিধানসভাটি যেহেতু একই সাথে সংসদ হিসেবেও ক্রিয়াশীল ছিল না, ফলে এখানে সংবিধান পরিষদে ভোট কেনাবেচার ও সরকার পরিবর্তনের কোনই সুযোগ ছিল না। এর অর্থ দাঁড়ায় একটিই, সেটি হলো পার্টির ইচ্ছা (কিংবা পার্টিপ্রধানের ইচ্ছা) যেন সর্বোচ্চমাত্রায় প্রতিফলিত হয়, তা নিশ্চিত করা। এবং এই আদেশ বলেই আওয়ামী লীগের বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদ সদস্য, যারা স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় সংবিধান প্রণয়নের সাথে একমত হতে পারেননি, দল থেকে এবং গণপরিষদ থেকে এই অভিযোগে রীতিমত বহিষ্কৃত হন। এভাবে “শেখ মুজিব এর উপরোক্ত বক্তব্যে শেখ মুজিব আর নেতৃবৃন্দের এই দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত হয় যে গণপরিষদের দলীয় সদস্যগণ নেতৃবৃন্দের হাতের মুঠোয় থাকা নামমাত্র প্রতিনিধি মাত্র। এর পর থেকে কোন কার্যকর বিষয়েই গণপরিষদ আর আর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের মাঝে কোন পার্থক্য আর রইল না। মুজিব আমলের প্রথম রাজনৈতিক আদেশটি এভাবে সত্যিকারের সংসদীয় প্রকৃতির শাসনের বদলে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্রে পর্যবসিত হয়।”

ফলে এর পর থেকে গণপরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের দলীয় গোপন সভার সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার প্রকাশ্য আলঙ্কারিক অনুমোদন ছাড়া করার মত কার্যত আর কিছুই বাকি ছিল না। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও সংবিধান সভায় কংগ্রেসের একক আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও খোলামেলা বিতর্ককে উৎসাহিত করা হয়েছিল সংবিধান প্রণয়নের সময়কার বৈঠকগুলোতে।

ছবি সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১০ এপ্রিল, ১৯৭২। দুই দিনের এই অধিবেশনের প্রথম দিনটিতে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন ও এর কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় দিনে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে ১০ জুনের মাঝে একটি রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাপ (মোজাফফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ১৭ এপ্রিল তার প্রথম বৈঠকে বসে। এতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মতামত আহবান করে একটি প্রস্তাব নেয়া হয়, এটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিতও হয়। কিন্তু সঙ্গতকারণেই মানুষ এই বিজ্ঞপ্তিতে খুব বেশি সাড়া দেয়নি। প্রথমত, তিন জন বাদে গণপরিষদের সকল সদস্যই আওয়ামী লীগের ছিলেন বলে, উপরন্তু আওয়ামী লীগের সদস্যদের স্বাধীন মতামতের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করায় ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, এই আহবান লোক দেখানো। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে তেমন কোন গণবিতর্ক, মতামত আহবান বা অন্যকোন রকম জনমত যাচাইয়ের আয়োজন করা হয়নি। জনগণকে উদ্দীপ্ত ও অংশগ্রহণ করাবার নামমাত্র কর্মসূচির পরও ৯৮ টি স্মারকলিপি আসে। ঠিক কি ঘটেছিল এই ৯৮ টি স্মারকলিপির ভাগ্যে? ব্যারিস্টার আবদুল হালিম জনগণের কাছ থেকে আসা এই প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে খসড়া প্রণয়নী কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎ নিতে গেলে তিনি জানান যে ২৫ বছর পর স্মরণ করাটা কঠিন জনগণের পক্ষ থেকে আসা এই মতামতগুলো কতদূর বিবেচনা করা হয়েছিল; ব্যক্তিগত উদ্যোগে হালিম সাহেব সংসদ ভবনের এর মহাফেজখানার তালিকায় এদের উল্লেখ পেলেও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন, কেননা আরও বহু দলিলাদির সাথে এগুলোও যথাযথভাবে গ্রন্থনা করা হয়নি। ফলে যে ন্যূনতম সাড়া জনগণের কাছ থেকে এসেছিল, সেগুলোতে কি বলা ছিল, কোনদিন তা আমরা আর জানতে পারবো না।

গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবরে। সেদিন খসড়া সংবিধান প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করা হয়। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খসড়া সংবিধান বিষয়ে জনমত যাচাই এর জন্য ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সভা স্থগিত করার আহবান জানান। তাকে সমর্থন করেন স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাদের মতে জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য এক সপ্তাহ মোটেই যথেষ্ট সময় নয়। ‘মূল্যবান সময়ের অপচয়’ এড়াতে একই সঙ্গে জনগণের মতামত গ্রহণ ও সংসদে আলোচনা চালিয়ে যাবার মত দেন আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন। বিলটি নিয়ে গণপরিষদে সাধারণ আলোচনা চলে অক্টোবর তিরিশ পর্যন্ত। এতে দশটি অধিবেশনে আটটি কর্মদিবস জুড়ে প্রায় ৩২ ঘন্টা ব্যাপী আলোচনা হয়। ইতোমধ্যেই ২০ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় গণপরিষদের সদস্যসংখ্যা চারশ চার জনে নেমে এসেছিল, তাদের মাঝ থেকে ৪৮ জন আলোচনা করেন। এর মাঝে ৪৫ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য।

আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় পাঁচ দিন জুড়ে প্রায় ১৫ ঘন্টা আলোচনা হয়। সেখানে তারা কিছুটা স্বাধীন ভাবে মত দিতে পারলেও গণপরিষদের অধিবেশনে তাদের স্বাধীন মতামত প্রদান নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী পার্লামেন্টারি দলের বৈঠকে দলীয় সদস্যদের ৭৭৫টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, এর মাঝে ৮০টির মত প্রস্তাব আওয়ামী সংসদীয় দল গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবগুলো গণপরিষদে পাঠান হয়। এদের অধিকাংশই ছিল ভাষারীতি সংক্রান্ত প্রস্তাব। গণপরিষদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবি করার কারণে আওয়ামী লীগেরই কেন্দ্রীয় নেতা কেএম ওবায়দুর রহমানের গঞ্জনার শিকার হওয়ায় এবং গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল আইনের কঠোর প্রয়োগ সঙ্গত কারণেই গণপরিষদের সদস্যদের স্বাধীনভাবে আলোচনা উত্থাপনকে বিপুলহারে নিরুৎসাহিত করে।

অক্টোবর একত্রিশ তারিখে সংবিধান বিল এর তৃতীয় পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। এটা নভেম্বরের তিন তারিখ পর্যন্ত চলে। এই চার দিনে আরও ২১ ঘন্টা আলোচনা হয় সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে। মোট ১৬৩ টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর মাঝে ৭০ টি প্রস্তাব উত্তাপন করেন ন্যাপ দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আজকেও কেউ যদি বাংলাদেশের সংবিধানের অগণতান্ত্রিক, জাতিদ্বেষী ও স্বৈরতন্ত্রী ধারাগুলোর তালিকা প্রণয়ন করতে চান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর মানবেন্দ্র লারমা কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর দিকে নজর বোলানোই তার জন্য অনেকটাই যথেষ্ট হবে। (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আজ বেঁচে নেই, আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আজ অকাতরে পঞ্চদশ সংশোধনীকে ‘প্রাগমেটিক’ বলে ফতোয়া দিচ্ছেন। সেই পুরনো প্রবাদটিই স্মরণ করা যায়: মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনীতিবিদকে সততার পরীক্ষা দিতে হয়।)

উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর মাঝে ৮৪টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, এর মাঝে একটি বাদে বাকি সবগুলোই আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের উত্থাপিত। এদের অধিকাংশই ভাষাগত পরিমার্জন সংক্রান্ত হলেও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী প্রস্তাবও ছিল। এদের মাঝে একটি হলো সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত। খসড়া সংবিধানে কেবলমাত্র সংসদ সদস্যদের মাঝ থেকেই মন্ত্রী নিয়োগ করার বিধান ছিল। সংশোধনীর পর সদস্য নন এমন কাউকে মন্ত্রীপদে নিয়োগ করা সম্ভব হয়, যদিও তাকে ছয় মাসের মাঝে সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবার বিধান রাখা হয়, অন্যথায় তার মন্ত্রীত্ব বহাল থাকবে না।

দ্বিতীয় সংশোধনীটি খুবই বিতর্কিত, এবং তাৎপর্যপূর্ণও। খসড়া প্রস্তাবেই ৭০ অনুচ্ছেদ যথেষ্ট অগণতান্ত্রিক ছিল, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দল বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নিলে তার সংসদ সদস্যপদও চলে যাবার প্রস্তাব ছিল এটি:

রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা বহিষ্কারজনিত কারণে আসন শূন্য হওয়া

৭০(১) কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার পর তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন বা বহিষ্কৃত হন, তাহা হইলে এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলী অনুযায়ী তাহার আসন শূন্য হইবে।

(২) এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন রাজনৈতিক দলের সম্পাদকের নিকট হইতে স্পীকার উক্ত দল হইতে কোন সংসদ-সদস্যের পগত্যাগ বা বহিষ্কারের ( শেষোক্ত ক্ষেত্রে বহিষ্কারের কারণসহ) সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হইলে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব না করিয়া স্পীকার তাহা সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করিবেন এবং অনুরূপ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হইলে উপরি-উক্ত ব্যবস্থা সাপেক্ষে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।

(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফা-অনুসারে সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে স্পীকার উক্ত সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি প্রদান করিবেন এবং যদি উক্ত সদস্য অনুরূপ সার্টিফিকেট-প্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে স্পীকারকে এই মর্মে নোটিশ প্রদান করেন যে, তিনি এই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (৪) দফার অধীন উক্ত বিষয় নির্ধারণের জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট আবেদন করিতে ইচ্ছুক এবং যদি তিনি অনুরূপ নোটিশ প্রদানের সাত দিনের মধ্যে উক্ত আবেদনপত্র দাখিল করেন, তাহা হইলে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করিয়াছেন বা বৈধভাবে দল হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছেন বলিয়া নির্বাচন কমিশন স্থির না করেন, ততক্ষন পর্যন্ত তিনি সংসদ-সদস্যপদে বহাল থাকিবেন এবং স্পীকার তদনুযায়ী সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ স্থগিত রাখিবেন।

কিন্তু গণপরিষদে খসড়া সংবিধান বিষয়ক আলোচনায় এই প্রস্তাবিত ৭০ ধারায় ‘বহিষ্কারে ক্ষেত্রে কারণসহ’ এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বিষয়টি স্থির করা পর্যন্ত কালক্ষেপনের সুযোগ ছিল, সেই চক্ষুলজ্জাটুকু বাতিল করা হয়, তারই সাথে যুক্ত করা হয় দলের বিপক্ষে ভোট দিলেও তার সদস্যপদ বাতিল হবে। সংশোধনী প্রস্তাবের পর চূড়ান্ত চেহারায় ৭০ অনুচ্ছেদ দাঁড়ায় এমন:

৭০। কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি

(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা

(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযৈাগ্য হইবেন না।

অর্থাৎ, খসড়া প্রস্তাবে ‘কারণ দর্শানো’ ‘বৈধভাবে দল হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছেন বলিয়া নির্বাচন কমিশন স্থির না করেন’ ইত্যাদি যে সামান্য দ্বিধা ছিল, চূড়ান্ত সংবিধানে তা ঝেড়ে ফেলে সাথে এও যুক্ত করা হয় যে, এমনকি দলের বিপক্ষে ভোট দিলেও সদস্যপদ চলে যাবে। বলা যায়, গণপরিষদ সদস্যদের মুখে কুলুপ আঁটার জন্য যে সদস্যপদ বাতিল আদেশটি ছিল, তার হুবহু প্রতিলিপি আমরা পেলাম। এভাবে সংবিধান প্রণয়নকালীন রাষ্ট্রপতির অগণতান্ত্রিক যে আদেশটি গণপরিষদ সদস্যদের দলের দাসে পরিনত করেছিল, সেটাই এবার সংবিধানসম্মত হয়ে ভবিষ্যত সংসদ সদস্যদেরও মুখবন্ধ করার ও দলীয় স্বৈরতন্ত্রের অধীনে নিয়ে আসার কাজটিও সম্পন্ন করল। গণপরিষদের সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশে যেভাবে গণপরিষদের সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের এখতিয়ারকে বিনষ্ট করা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতা সংসদেও অব্যাহত থাকল।

তৃতীয় সংশোধনীটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাঙালী ব্যতীত আর সকল জাতির মর্যাদা-নির্ধারণসূচক। খসড়া সংবিধানে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা ছিল:

নাগরিকত্ব ৫। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।

কিন্তু গণপরিষদে আঃ রাজ্জাক ভূঁইয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী এটি সংশোধন করা হয়। নাগরিকত্ব সম্পর্কিত এই গূরুত্বপূর্ণ অংশটি গণপরিদের আলোচনা থেকে উদ্ধৃত করা যাক:

জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়াা আপনার প্রস্তাব পেশ করুন।

জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া: মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমি প্রস্তাব করছি যে,

‘সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;

“৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।”

জনাব স্পীকার: পরিষদের সন্মুখে জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া প্রস্তাব এনেছেন যে,

” সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক;

“৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।”

ড: কামাল হোসেন (আইন ও সংসদীয় বিষযাবলী এবং সংবিধান-প্রণয়ন মন্ত্রী): মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই সংশোধনী গ্রহনযোগ্য বলে আমি মনে করি এবং এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।

জনাব স্পীকার: শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।

শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি. ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয় স্পীকার সাহেব, জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া সংশোধনী – প্রস্তাব এনেছেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হবেন।

মাননীয় স্পীকার সাহেব, এব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, সংবিধান বিলে আছে, “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে”; এর সংগে সুস্পষ্ট করে বাংলাদেশের নাগরিকগণকে ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত করবার জন্য জনাব অ: রাজ্জাক ভূইয়াার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের যে সংজ্ঞা, তাতে করে ভালভাবে বিবেচনা করে তা যথোপযুক্তভাবে গ্রহন করা উচিৎ বলে মনে করি।

আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্রগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সংগে আমরা লেখাপড়াা শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।

আমার সদস্য-সদস্যা ভাই বোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়…

জনাব স্পীকার: আপনি কি বাঙালি হতে চান না?

শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোন দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।

জনাব স্পীকার: আপনি বসুন।

শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত: মাননীয় স্পীকার সাহেব, এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, জনাব অ: রাজ্জাক ভুইয়া সাহেব যে সংশোধনী এনেছেন, তাতে মনে এ প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশে বাঙালি ছড়া ভারতের কেউ বাস করেছে। আমি শুধু বলতে চাই যে, বাঙালি বলতে এইটুকু বোঝায় যে, যারা বাংলা ভাষা বলে তাদেরকে আমরা বাঙালি বলি।

জনাব স্পীকার: আপনি বসুন, আপনি বসুন। এখন পরিষদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে..

                             (কণ্ঠধ্বনিতে সংশোধনিটি পাশ হয়ে যায়)

শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি. ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয় স্পীকার আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে এই ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধিত আকারে গৃহীত হল। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।

                             (অতঃপর মাননীয় সদস্য পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।)

(সূত্র: বাংলাশে গণপরিষদ বিতর্ক, খ- ২ সংখ্যা ১৩, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭২)

এমনিভাবেই সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ আরও কিছু বিষয়ে সংবিধানকে কিছুটা গণতান্ত্রিক করার সংশোধনী প্রস্তাব তোলেন; সেগুলো সবই প্রত্যাখ্যাত হয়। অন্য কোন সদস্যই এমন কোন প্রস্তাব হাজির করেননি। খসড়া সংবিধানের ৩২, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪৭, ৬৬, ৭০, ১৩৫ ধারার অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে তার সংশোধনী প্রস্তাব হাজির করেন। সবগুলো প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। সেটাই স্বাভাবিকও ছিল, কারণ এই সংশোধনী প্রস্তাবগুলো সমর্থন করলে সেই নির্দিষ্ট সংসদসদস্যের সদস্যের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যেতো। স্থানাভাবে এখানে আমরা ৩২ অনুচ্ছেদের ওপর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আলোচনার কিছু অংশ তুলে ধরছি:

খসড়া সংবিধারে ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ

৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।

শ্রী লারমা: জনাব স্পীকার সাহেব, এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য হলো, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’ শব্দাবলী যদি এই অনুচ্ছেদে রাখা হয় এবং সেটা যদি এই পরিষদে গৃহীত হয়ে যায়, তাহলে আগামীতে যারা আইন পরিষদে আসবেন, তারা যদি ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’ শব্দাবলীর মাধ্যমে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান, তাহলে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার জন্য এই যে ৩২ অনুচ্ছেদটি করা হয়েছে, সেই অনুচ্ছেদের কোন অর্থ থাকবে না। তার কারণ, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার জন্য ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’এই শব্দাবলীর মাধ্যমে ক্ষমতার দ্বারা এমন এমন আইন গৃহীত হতে পারে, যার দ্বারা জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হয়ে যাবে।

এখন আমাদের এখানে পাবলিক সেফটি আইন নাই, কিন্তু ইে অনুচ্ছেদ দ্বারাতা প্রণয়ন করা যাবে যে কোন সময়ে এবং এই অনুচ্ছেদ যদি এইভাবে গৃহীত হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে যদি এই ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’ শব্দাবলীর দ্বারা জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করার আইন বলবৎ হয়, তাহলে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কোন সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ মানুষের নাগরিক জীবনের যে স্বাধীনতা, স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে অভিব্যক্তি, তা সম্পূর্ণরূপে খর্ব হয়ে যাবে।

তাই আমি এই অনুচ্ছেদে ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’ শব্দগুলির পরিবর্তে ‘আদালতের অনুমোদন’ শব্দাবলী সন্নিবেশিত করার প্রস্তাব করছি।

আদালতের কাছে যদি আমাদের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার এই রক্ষাকবচ দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের যে স্বাধীনতা, তা নিশ্চয়ই সংরক্ষিত হবে।

(প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়)

মানবেন্দ্র লারমা

মানবেন্দ্র লারমার এই আশঙ্কা সত্যমূলক ছিল, অচিরেই ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় সংশোধনীতে ‘জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ , গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ’ অংশেরই ৩৩ অনুচ্ছেদে আদালতের অনুমোদন ছাড়াই নিবর্তনমূলক অন্তরীণ রাখার ব্যবস্থা সম্বলিত দফা যুক্ত করা হল, তারই সাথে জরুরি অবস্থা জারির বিধান ও জরুরি অবস্থার সময়ে সকল মৌলিক অধিকার স্থগিতের বিধান সম্বলিত অংশও গৃহীত হলো।

একইভাবে এই দুই সদস্য বাক স্বাধীনতা নিয়েও আলোচনা করেন, যদিও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি মোটেই, এমনকি তারা সংবিধানের এই ধারাগুলোর সাথে পাকিস্তানেরই মিলগুলোও দেখিয়ে দেন, যেমন মানবেন্দ্র নারায়ণ ৩৯ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আলোচনায় বলছেন:

সংবিধান বিলের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ম দফায় রয়েছে:

(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

তারপর ২য় দফায় রয়েছে:

(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে-

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের; এবং

(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হল।

এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, সেটা হল, বাকস্বাধীনতা, ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতা শর্তহীন হতে হবে। সংবাদপত্র-জগতের স্বাধীনতা বা চিন্তা জগতের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এই অধিকার আবার এক দিক দিয়ে খর্ব করা হয়েছে। যেমন- রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে আমার বাক স্বাধীনতা থাকবে না। বিদেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কে বন্ধুত্বপূর্ণ কোন রকম উক্তি করার ব্যাপারে আমার বাক-স্বাধীনতা থাকবে না।

চূড়ান্ত পাঠ অনুষ্ঠিত হয় চার নভেম্বর। সেদিনের পাঠে দুই ঘন্টা সময় নেয়া হয়। এরপর সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান প্রণয়নী সভায় খসড়া উত্থাপনের মাত্র ২৪ কার্য দিবসের মাঝে সংবিধান চূড়ান্তরূপে গ্রহণের উদাহরণ বিরল। প্রতিবেশী ভারতে খসড়া সংবিধান প্রকাশ করা হয়েছিল জানুয়ারী ১৯৪৮ সালে ও গ্রহণ করা হয়েছিল ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে, সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল ১১৪ কর্মদিবস। আগেই বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে কোন প্রক্রিয়ায় এবং কিভাবে সংবিধান প্রণয়নের কার্যক্রমে বাংলাদেশে গণপরিষদের সদস্যদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত ও রুদ্ধ করা হয়েছিল। বিপরীতে ভারতে কংগ্রেস দলের একাধিপত্য থাকলেও দলীয় সদস্যদের স্বাধীন আলোচনাকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নী বিতর্ক কতটা অগুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার বেশ কিছু নিদর্শন সমকালীন অনেক রচনায় পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে হাস্যরসই সেখানে অধিক সময় পেয়েছিল। ভারত বা পাকিস্তানের সাথে তুলনায় বিষয়টা আরও মর্মান্তিক এই কারণে যে, ওই দু’টি রাষ্ট্রের থেকে ব্যতিক্রমীভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল রক্তক্ষয়ী একটি মুক্তির যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা জনগণের মাঝে যে উচ্চতর রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা আর প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছিল, তার কোন বিপ্লবাত্মক প্রতিফলন সংবিধান প্রণয়নে পাওয়া যায় না। খসড়া সংবিধান প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনার পর ১৬৩টি সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়, এর মাঝে ৮৪ টি গৃহিত হয়, যার মাঝে ৮৩ টি আওয়ামী সদস্যদের এবং একটি সুরঞ্জিত সেন গুপ্তর। কিন্তু অধিকাংশ সংশোধনীই শাসনতান্ত্রিক বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্কিত ছিল না, এগুলো ছিল ভাষাগত সংশোধনী।

গণপরিষদে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

সংবিধান প্রণয়নকারী সভাকে নির্বাহী বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব ও আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়া হয়নি বলে পুরো সময়টি রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশ বলে আইন প্রণয়ন করেছেন। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি তার আদেশবলে ১৬৬টি আইন প্রণয়ন করেন, এর মাঝে পিও ফাইভ অব নাইনটিন সেভেনটি টু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই আদেশে বাংলাদেশের হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চূড়ান্ত আদালত হিসেবে অনুমোদন পায়। কিন্তু এই আদেশের মাঝে আইনের শাসনের চেতনা সম্পূর্ণভাবেই অনুপস্থিত ছিল, উচ্চআদালতকে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি; রিট জারি করা, হেবিয়াস কর্পাস, ম্যান্ডামাস, প্রহিবিশন, কো-ওয়ারানটো, সারটিওরারি আকারে আদেশ বা নির্দেশনা প্রদান বন্ধ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর হয় বটে, তবে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল নতুন সংসদ এর সভা অনুষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত ২১০টি নির্বাহী আইন প্রণয়ন করা হয় কোন রকম আলোচনা বা জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থার সাথে পরামর্শ ও বৈঠক ছাড়া।

এভাবে নতুন সংসদের আধিবেশন বসার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র কার্যত রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশ বলে পরিচালিত হয়, যদিও আওয়ামী লীগ দাবি করে যে তারা একদম শুরু থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাবান ছিল।

গণপরিষদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এই ভাবে সংবিধান প্রণয়নকারী পরিষদটিকে

ক. কেবলমাত্র সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করা,
খ. তাদের আইন প্রণয়ন করার অধিকার না দেয়া,
গ. নির্বাহী পরিষদের ওপর তাদের কোন তদারকির অধিকার না দেয়া,
ঘ. সংবিধান পরিষদের সদস্যদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রস্তাব উত্থাপন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার প্রদান না করা (এবং কার্যত এর মাধ্যমে সংবিধান পরিষদকে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটিতে পর্যবসিত করা)

বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসকে শুরু থেকেই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং একটি মাত্র দলের স্বার্থরক্ষায় পরিচালিত করেছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থকে আওয়ামী লীগের স্বার্থের সাথে অঙ্গাঙ্গী করা হয়, এবং আওয়ামী লীগের মাঝে আবার একক নেতার মুখ্য ভূমিকার কারণে আর কোন ভিন্নমত প্রকাশের পরিসর খুব বেশি ছিল না।

বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান উত্থাপন হবার পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এই প্রতিক্রিয়াকে তিনভাগে ভাগ করা যায়, মস্কোপন্থী বাম রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিক্রিয়া, যারা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত ছিল, চীনাপন্থী বলে পরিচিতি রাজনৈতিক ধারাসমূহ এবং অন্যান্য।

মস্কোপন্থীদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ দল সিপিবি সাধারণভাবে এই সংবিধানকে স্বাগত জানায়। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়:

‘বিশেষত, খসড়া সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়ন ও সাম্প্রদায়িকতা বিলোপের জন্য যে সব নীতি ঘোষিত হইয়াছে এবং সাম্প্রদায়িক দল ও সংস্থা গঠন নিষিদ্ধ করিয়া যাহা বলা হইয়াছে, সেইসব নীতি ও ধারা-উপধারাগুলিকে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাগত জানাইতেছে। কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করার যেসব বিধান খসড়ায় রহিয়াছে, সেগুলিকেও পার্টি স্বাগত জানাইতেছে। ঐসব নীতি ও ধারা-উপধারাগুলি খসড়া সংবিধানে পরিবেশিত হওয়াতে পার্টি সরকারকে অভিনন্দিত করিতেছে। পার্টি খসড়া সংবিধানকে সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক বলিয়া মনে করে।’

এরপর সংবিধানে কিছু ধারার অগণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করে আশা প্রকাশ করা হয়েছে:

‘ঐসব ধারা-উপধারা যথাযোগ্য সংশোধনের অপেক্ষা রাখে, তবে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে উহা সরকার কর্তৃক কিভাবে কার্যকর হয়, তাহার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে যে, বর্তমান খসড়া দেশের সংবিধানরূপে গৃহীত হইয়া উহা সঠিকভাবে কার্যকর করা হইলে কতকগুলি ত্রুটি সত্ত্বেও ইহার মাধ্যমে ও সহায়তায় দেশ ও সমাজ প্রগতির পথে অগ্রসর হইতে পারিবে।’

ন্যাপ (মোজাফফর) সংবিধানের বেশ কিছু ধারার অগণতান্ত্রিক চরিত্রের সমালোচনা করে বলে, ‘শাসনতন্ত্রের মূল রাষ্ট্রীয় আদর্শ অনুচ্ছেদে কেবলমাত্র কতকগুলি সদিচ্ছার ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে, যাহা পূরনে রাষ্ট্র আইনানুগতভাবে বাধ্য নহে।’ এরপর ন্যাপ “প্রতিটি নাগরিকের কর্ম ও জীবিকার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রভৃতি জীবনধারনের উপকরণসমূহের গ্যারান্টি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রদান” করার দাবি জানায়। এছাড়া শাসনতন্ত্রে পুঁজিবাদী সম্পত্তির বিকাশ ঘটতে দেয়া যাবে না, এই মর্মে সুস্পষ্ট ঘোষণারও তারা দাবি জানান। অবৈতনিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিকাশের জন্য বিশেষ বিধান রাখার দাবিও জানান হয়।

সাধারণভাবে বলা যায়, সংবিধানের মৌলিক অগণতান্ত্রিক চরিত্রটি তাদের সমালোচনায় অনেকটাই উঠে আসলেও আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের বশবর্তী থাকার কারণেই বায়াত্তুরে সংবিধানের প্রতি তারা পুরোপুরি আনুগত্য প্রদর্শন করে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি মত প্রকাশ করে যে,

এই বিষয়ে অন্তত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহ এবং গণপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ গ্রহণ একান্ত জরুরি ছিল। সংবিধানের পক্ষে সমগ্র জনতার পরিপূর্ণ সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে উহা সহায়ক হইত। মনে হয়, শাসক দলের সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ফলে তাহা সম্ভব হয় নাই।

মূলগতভাবে তারা সংবিধানকে ইতিবাচক বলে গ্রহণ করেন এবং সংবিধানকে আরও গণতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে পার্টি নেতা আবদুস সালাম ও মনি সিংহ ১১ টি প্রস্তাব পেশ করেন। সংবিধানের “কালাকানুনগুলো যেন শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়, সেটার দিকে সজাগ প্রহরা রাখার কথা”ও তারা উল্লেখ করেন। যদিও এই ‘সজাগ প্রহরা রাখা’র কাজটি তারা তেমন একটা করতে পারেননি; সরকার অচিরেই ধর্মঘটকে বেআইনী করে, শ্রমিক অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ ও সম্পাদকদের গ্রেফতার, পত্রিকা নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে পত্রপত্রিকাকে দমন করার চেষ্টা করে।

আওয়ামী লীগের সাথে অধীনতামূলক মিত্রতার সম্পর্ক থাকায় মস্কোপন্থী সিপিবি ও ন্যাপ কখনো কখনো মৃদু সমালোচনা করলেও এসবের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেয়া জাসদ ও ন্যাপ (ভাসানী) বরং সিপিবির রোষের শিকার হয়, এই সময়ে প্রকাশিত বহু বিবৃতি ও ভাষ্যে সিপিবি সরকারের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন এবং ব্যর্থতা স্বীকার করেও সরকারকে কঠোর অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করার জন্য ওই বিরোধী দলগুলোর গৃহীত আন্দোলন কর্মসূচির নিন্দা করে।

চীনাপন্থী নামে পরিচিত নানান ধারাসমেত অন্যান্য বামপন্থীরা সংবিধান সভা বা গণপরিষদের বৈধতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলেছিলেন, খসড়া সংবিধানের অমোচনীয় ও মৌলিক অগণতান্ত্রিক চরিত্র বিষয়েও তারা আপত্তি উত্থাপন করেন। লেলিনবাদী কমুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অমল সেন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক তো নয়ই, এমনকি অন্যান্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যে ধরনের সাংবিধানিক অধিকার থাকে তাও নেই।’

শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের প্রতিক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে বলা হয়:

‘বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বলা চলে।… এই শাসনতন্ত্র চালু হলে দেশে শ্রেণী-শাসন অব্যাহত থাকবে। দেশ স্বাধীন হবার পর কুখ্যাত পাকিস্তানী নাগরিকদের যে সম্পত্তির মালিক সরকার হয়েছে খসড়া সংবিধানে সেই সম্পত্তিকে একটা সমাজতান্ত্রিক লেবেল লাগিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে।… এমনকি কতিপয় আইন কার্যকর থাকবে বলে ঘোষণা করে বিদেশী মূলধন জাতীয়করণ না করার সরকারী সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকাপোক্ত করা হয়েছে।’

জাতীয় রাজনীতিতে ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা আসম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ তাদের বিবৃতিতে খসড়া সংবিধানের অসংখ্য সমালোচনা করে বলেন, ‘এক কথায় বলা যায়, এটা একটা অকেজো সংবিধান। তবে বর্তমান পরিবেশে এ বাজে সংবিধানও সংবিধানহীন দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল।’ মওলানা ভাসানী খসড়া সংবিধানকে শুধু আক্রমণই করেননি, তিনি ঐ সংবিধান সভার বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন এই বলে যে, সেটি ইয়াহিয়া খানের আদেশ বলে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের এখ্তিয়ার নিয়ে গঠিত হয়েছিল। জনগণ আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল ৬ দফার ভিত্তিতে, যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের কাঠমোর মাঝেই স্বায়ত্বশাসন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের এখ্তিয়ার জনগণ এই গণপরিষদ সদস্যদের প্রদান করেনি। এছাড়া আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী প্রস্তাবিত নতুন সংবিধানের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ধারার উপস্থিতি, বিদেশী মালিকানাধীন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করা, গ্রামাঞ্চলে সামন্তবাদ উচ্ছেদে কার্যকর ভূমিকা না রাখা ইত্যাদি প্রশ্নে প্রস্তাবিত সংবিধানের সমালোচনা করেন। তাদের অধিকাংশই গঠনগত দিক দিয়ে এই সংবিধানের ত্রুটিগুলোকে অমোচনীয় বলে মনে করতেন।

সংবিধানের নানান ধারার মাঝে স্বৈরতান্ত্রিক উপাদান বিষয়ে বিরোধীদলগুলো নানানভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও বদরুদ্দীন উমরের একটি পর্যবেক্ষণে যে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী এই সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেছিল, তাদের শ্রেণীগত দুর্বলতা আর অস্থিরতা দিয়েই সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুটি চিহ্নিত করেছেন। যে ধারার উপস্থিতির কারণে গণপরিষদের কোন সদস্য স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে আইনানুগ ভাবে অক্ষম ছিলেন, এবং যে ধারাটি গণপরিষদকে কার্যত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সাথে একাকার করে ফেলেছিল, সেই বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশটিও খসড়া সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ হিসেবে (অনুচ্ছেদ ৭০) সংযোজিত হয়। এই ধারাটিকে উপলক্ষ্য করে বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর সঙ্কটটিকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, খসড়া সংবিধান প্রকাশ হবার পর ১৯৭২ সালের ২৯ অক্টোবর অ পড়হংঃরঃঁঃরড়হ ভড়ৎ ঢ়বৎঢ়বঃঁধষ বসবৎমবহপু নামের একটি নিবন্ধে তা প্রকাশিত হয়, বাংলা অনুবাদে দাঁড়ায় চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থার একটি সংবিধান। এখান থেকে একটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি আমাদের বর্তমান আলোচনায় খুবই প্রাসঙ্গিক:

‘শাসক-শ্রেণী যে রাষ্ট্রের মৌলিক সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই বিপুল পরিমানে অবিশ্বাস করে এই সংবিধান তারই ইঙ্গিতবহ এবং সংবিধানটি সংসদীয় সংখ্যাধিক্যের সাহায্যে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দেয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ইঙ্গিত দেয় যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকেও নির্ভরযোগ্য শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ফলে এটাকে স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব একটা হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়েছে, যাকে শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অসীম ক্ষমতা চর্চা করার অধিকার দেয় হয়েছে। এই খসড়া সংবিধান পরিস্কার ভাবেই ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী কেবল অসংখ্য অভ্যন্তরীন সঙ্কটে জর্জরিতই নয়, মোটাদাগে তারা অসংহতও। … এই রকম একটি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যমান রয়েছেন সম্পূর্ণ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার সবচে বড় শর্ত হিসেবে। এবং এই কারণেই অন্যদের নানা রকম আপত্তি সত্ত্বেও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারা তাদের আস্থা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর অর্পণ না করে তার ওপর স্থাপন করতেই বাধ্য। এবং এ কারণেই শাসকশ্রেণীর একনায়কত্ব একজন প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের রূপে পর্যবসিত হবার দিকে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে তা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বৈরতন্ত্র। সুনির্দিষ্টভাবে শেখ একজন বেসামরিক ব্যক্তি বলেই প্রাথমিক পর্বে এই স্বৈরতন্ত্র একটা সংসদীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। আগামীকাল যদি পরিস্থিতি বেসামরিক কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায় এবং শাসক শ্রেণীর জন্য আরও খারাপ হয়ে ওঠে, সংসদীয় ধরনটি রাষ্ট্রপতির ধরনের শাসন দিয়ে কিংবা আরও খারাপ কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে পারে। এইসব জরুরি কারণবশতই এখানে একটি ‘চিরস্থায়ী’ জরুরি অবস্থার পূর্বানুমান করা হয়েছে এবং সেই অনুমানের ভিত্তিতে শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি সংবিধানের কাঠামোর ভেতরে সকল ধরনের জরুরি ক্ষমতা অনুশীলনের বন্দোবস্ত করারই একটা প্রয়াস নেয়া হয়েছে।’

১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি বাতিল করে রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম করেছিল। আদি সংবিধানে জরুরি অবস্থার কোন বিধান না থাকলেও যে জরুরি অবস্থা এবং শাসকশ্রেণীর অসংহত দশা বদরুদ্দীন উমর আশঙ্কা করেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল, সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসন, এবং কার্যত দলীয় প্রধানের ব্যক্তিগত শাসন শুরু হল। অধিকাংশ পত্রিকা নিষিদ্ধ হলো, এবং যে অল্পকিছু গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সংবিধানের ছিল, তাও রদ করা হলো, ‘১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসনও যে বায়াত্তুরে সংবিধানকে উচ্ছেদ করেনি, তার কারণ গুনগতভাবেই এই সংবিধানটিই এমন ছিল যে এই কাঠামোর ভেতর ছোটখাট কিছু সংশোধনীর মাধ্যমেই সামরিক শাসকরাও নিজেদের কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পেরেছিল।’

চূড়ান্ত সংবিধান গৃহীত হবার আগে ন্যাপ মোজফফর এর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা সংসদে তাদের আলোচনায় খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের সকল গুরুত্বপূর্ণ নেতাও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানের ওপর জনরায় নেয়ার জন্য গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, যে সব ধারার নিন্দা আওয়ামী লীগ ’৫৬ সালে করেছিল, হুবহু সেগুলোই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবিষ্ট করিয়েছে। তিনি আরও বলেন,

‘৬২ সালের শাসনতন্ত্র করা হয়েছিল আইয়ুব খানকে সামনে রেখে। বর্তমান শাসনতন্ত্রে বিলে প্রধানমন্ত্রীকেও বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।… শাসতন্ত্রে যখন সমাজতন্ত্র করার কথা বলা হয়েছে তখন শাসনতন্ত্রের উপর বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে আইনমন্ত্রী গিয়েছেন ব্রিটিশের কাছে।’

মানবেন্দ্র লারমা বলেন,

‘শাসনতন্ত্র বিলের প্রতিটা ধারাই প্রমাণ দেয় যে, একহাতে জনগণকে অধিকার দেয়া হয়েছে, আবার অন্য হাতে সে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।” জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করে তিনি বলেন, “আমি সেই নির্যাতিত ও নিপীড়িত জাতিসত্তার একজন। … আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু আমাদের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের। খসড়া সংবিধানে আমাদের জাতিসত্তার কথা নেই। এ কথা আমি শুধু আজ বলছি না, ইয়াহিয়া আর আইয়ুব আমলেও বলেছি। … ’৫৬ ও ’৬২ সালের শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। তাই জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি করার সময় আমাদের তা মনে রাখতে হবে। সংবিধান এমন হতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তাকে গ্রহণ করে।’

দৈনিক বাংলা; কৃতজ্ঞতা: সচলায়তন ব্লগ

চার মূলনীতি ও রাষ্ট্রের গতিমুখ

বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে যে কোন সাধারণ পর্যালোচনায় দেখানো সম্ভব যে-

১. এটা গণতান্ত্রিক ছিল না। বায়াত্তুরের সংবিধান কোন গণতান্ত্রিক উপায়ে রচিত হয়নি। যে গণপরিষদ সংবিধান রচনার দায়িত্ব পেয়েছিল, তাদের স্বাাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার আইন করে শেখ মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোন ভিন্ন মত উপস্থাপন, সমর্থন বা বিরোধিতা করলে তার গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল হত। দুনিয়ার কোন দেশে এমনটা শুধু হয়নি তাই নয়, সকল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশেই সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন সংসদ প্রণয়ন পর্যন্ত গণপরিষদ বা সংবিধান সভা বা কনটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিই দেশ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে। বিরোধী দলগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ তো বটেই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র লারমার মত সংসদ সদস্যরাও সেটার অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট চরিত্র তখনই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। অনুচ্ছেদ ৭০ এর মত দলীয় একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়া ধারার উপস্থিতির পরও এটাকে গণতান্ত্রিক বলাটা গণতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কে চরম উদাসীনতার পরিচায়ক, কিংবা এমন ধরনের আনুগত্যের নিদর্শন যা জাতির সর্বনাশ করেও মিত্রকে টিকিয়ে রাখে। এই সংবিধানে কোন মৌলিক অধিকারকেই আদালতে বলবত যোগ্য করা হয়নি। প্রদত্ত সবগুলো গণতান্ত্রিক অধিকারই প্রকারন্তরে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ৯৩ অনুচ্ছেদের অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা একে বৃটিশ ভারতীয় ও পরবর্তী পাকিস্তান আমলের মতই সরকারের সংসদকে পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারমূলক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছে, এবং বিশেষ সঙ্কটের কালগুলোতে এটি নিদারুণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

২. এটা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। বড়জোড় বলা হয়েছে যে ভিন্ন ধর্মের অনুষ্ঠানে থাকতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। পাকিস্তান আমলের বর্বর অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয়নি। আবুল বারকাতের গবেষণাতেও পরিস্কার, সর্বাধিক পরিমান অর্পিত সম্পত্তি আওয়ামী লীগেরই দখলে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার হাঁকডাক যেটুকু দেয়া হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনার যে বিকাশটি ঘটেছিল, তার সাথে একটা ছেলেভুলানো আপোষ, মাদ্রাসা শিক্ষাসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কারের কোন উদ্যোগ এই সময়টুকুতে নেয়া হয়নি। বরং তাকে জিইয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার সকল বন্দোবস্তই ধীরে ধীরে করা হতে থাকে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত রমনা কালীবাড়ির সম্পত্তি ’৭২ সালে গণপূর্ত অধিদফতরের হাতে ন্যস্ত করা হয়, তারা বুলডোজার দিয়ে সেটি সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়। মন্দিরের ভক্তরা সুবিচারে আশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেও কোন ফল পাননি, বরং তাদেরকে বালুর মাঠে তাবুতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের আমলে সেখান থেকেও তাদেরকে সবলে উচ্ছেদ করা হয়। মুজিবুর রহমান আর জিয়াউর রহমানের এই দুই শাসনামলের এই দুই ধাপ আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়তির দিকে যাত্রারই মাত্রাগত ইঙ্গিতসূচক, একজন মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের ওপর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার সাথে মৌখিক রফা করলেও রাষ্ট্রকে ক্রমাগত ভিন্ন পথে চালিত করার বন্দোবস্ত করেছেন, অপরজন সেই ভিন্ন পথে গমনের কাজটিই সুস্পষ্টভাবে সম্পন্ন করছেন। সেই অর্থে আরও বহু দিক দিয়ে পরবর্তীকালের বাংলাদেশ প্রথম পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতাতেই পরিচালিত হয়েছে।

৩. সমাজতান্ত্রিক! শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল এটাকে বলেছিল ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র’। পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া যে সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ হয়, সেটাকেই তারা সমাজতন্ত্র নামে চালায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি, তিনি তার বাকি সব দাবি ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন অন্তত বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হোক। সেটুকুও করা হয়নি এই ‘সমাজতান্ত্রিক সংবিধানে’। ভূমিসংস্কার বা গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতাসম্পর্কের ন্যূনতম কোন বদল করা হয়নি। কারখানায় পাকিস্তান আমলের চেয়ে শ্রমিকদের বেতনে মোট অংশ দশমিক অঙ্কে অতিসামান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। বরং অব্যাহত পরিকল্পিত দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্তকৃত কারখানাগুলো অচিরেই অলাভজনক হয়ে পড়ে, সেগুলো জনগণের অর্থের ভর্তুকিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গুটিকতক মানুষের সম্পদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটা সমাজতান্ত্রিক বলা অর্থহীন, গণতান্ত্রিকও এটি ছিল না।

৪. বাঙালী জাতীয়তাবাদ, এটা নিয়ে কি বলার আছে! এর মর্ম আদিবাসীরা আজও টের পান। তবে বাঙালীদের পক্ষে এটুকু বলা যেতে পারে যে, খুব দ্রুতই বাঙালী জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ দেশটাকে ভারতীয় অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিনত করে, তার উত্তরসূরী জিয়া আর এরশাদ মার্কিন, চীন আর অন্যান্যদের জন্যও এই চারণভূমিটি উন্মুক্ত করে দেয়।

সমাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক হবার বিষয় বাদ যাক, এই শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় অর্থের দুর্নীতি, অপচয় আর তসরুফের বিষয়েও কতখানি শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল সেটা বোঝা যাবে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে জারি করা মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক আদেশ আইনটির দিকে চোখ বোলালে। পৃথিবীর প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয় খরচাপাতির হিসাব নিরীক্ষণ করা হয় বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির মাধ্যমে, এবং সেটি নিয়মিত ভাবে সংসদে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। বাংলাদেশে প্রথম থেকে এই কমিটিকে সংসদের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে আমলাতন্ত্র ও নির্বাহী বিভাগের হাতে স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির হাতে এই কমিটির প্রধানের নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা ন্যাস্ত করে এই গুরুত্বপূর্ণ পদটির দলীয়করণ ও নিরাপদকরণ সম্পন্ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি কমিটি হিসেবেও এটি প্রথম থেকে আজও অকার্যকর। ৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী:

অষ্টম ভাগ

মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক

১২৭(১) সরকারী হিসাব নিরীক্ষা ও সেই সম্পর্কে রিপোর্ট দানের জন্য বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন; মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবেন, ইত্যাদি

(২)  মহা হিসাবনিরীক্ষকের কাজের শর্ত হবে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা যেরুপ নির্ধারণ করিবেন, সেই রূপ হইবে।

(এরপর ১২৮-১৩১ অনুচ্ছেদ কার্যাবলির বর্ণনা ইত্যাদি)

১২৮ (৩) এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় নির্ধারিত দায়িত্বসমূহ ব্যাতীত সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন মহাহিসাব রক্ষককে সেইরূপ দায়িত্বভার অর্পণ করিতে পারিবেন এবং এই দফার অধীন বিধানাবলি না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা অনুরূপ বিধানাবলি প্রণয়ন করিতে পারিবেন।

১৩২। প্রজাতন্ত্রের হিসাব সম্পর্কিত মহাহিসাব নিরীক্ষকের রিপোর্টসমূহ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।

এখানে প্রথমত মহাহিসাব রক্ষক পদটিকে প্রত্যক্ষভাবে সংসদের অধীনে না এনে রাষ্ট্রপতির অধীনস্ত করা হয়েছে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছেই প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। রাষ্ট্রপতি এই প্রতিবেদন সংসদে অবশ্যই উপস্থাপন করতে বাধ্য থাকবেন, এমন কথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে ব্যবস্থা নেবেন। মহাহিসাব নিরীক্ষককের কার্যাবলীকেও সংসদ আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭০ এর কথা স্মরণে রাখলে আমরা বুঝব, সংসদ সদস্যরা এমন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম নন, কিংবা রাষ্ট্রপতিকে এটা করাতে বাধ্য করার ক্ষমতার অধিকারী নন, যদি দলের মত না থাকে। এর সাথে যদি আমরা সংবিধানের আরেকটি ধারা মিলিয়ে দেখি:

সরকারী অর্থের নিয়ন্ত্রণ ৮৫

সরকারী অর্থেরর রক্ষণাবেক্ষণ, ক্ষেত্রমত সংযুক্ত তহবিলে অর্থ প্রদান বা তাহা হইতে অর্থ প্রত্যাহার কিংবা প্রজাতন্ত্রের সরকারী হিসাবে অর্থ প্রদান বা তাহা হইতে অর্থ প্রত্যাহার এবং উপরিউক্ত বিষয়সমূহের সংশ্লিষ্ট বাআনুষঙ্গিক সকল বিষয় সংসদের আইন দ্বারা এবং অনুরূপ আ নের বিধান না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইবে।

এটা করাই হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থের যে বিপুল তসরুফের ওপর এই শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে দাঁড়িয়েছিল, তাকে আড়াল করার জন্য। এই সংবিধানের বলেই বিদেশের সাথে সম্পাদিত অধিকাংশ চুক্তি গোপন থেকে যায়, জনগণের সামনে প্রকাশ করা দূরে থাকুক, জনপ্রতিনিধিদের সামনেও আলোচনার দরকার পড়ে না।

এই পুরো বিষয়টির অনুশীলনগত দিকটিও বোঝা যাবে অজস্র ঘটনার মাঝে একটি মাত্র দৃষ্টান্তে, সংবিধান প্রণীত হবার অল্পকিছুকাল পর প্রথম জাতীয় নির্বাচন যখন সামনে, তখনকার একটি ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের পুর্বাপর নামের গ্রন্থে মাইদুল হাসান তার স্মৃতিচারণায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত সরকারের কাছে রয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ১৭ কোটি টাকা কীভাবে ফেরত পাঠানো হবে, ব্যাংক ড্রাফট আকারে না পণ্য ক্রয়ের আকারে শোধ করা হবে, সেটা ভারতীয় প্রতিনিধি পিএন হাকসার জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান টাকাগুলো ট্রাকে চাপিয়ে পাঠাতে বলেন, জবাবে বিস্মিত হাকসার যখন বলেন যে ‘ট্রাকে করে টাকা কীভাবে দেব? আমাদের তো সরকারি হিসাব-পদ্ধতি আছে, ব্যাংকিং পদ্ধতি আছে।’ বিস্মিত-ব্যথিত ‘নিয়মনিষ্ঠ’ হাকসার অবাক হয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরটি শুনলেন “সামনে আমার নির্বাচন, এই টাকা সেজন্য আমার দরকার হবে।” নিজ দলের মাঝেই অবিশ্বাস, অনির্ভরশীলতার যে প্রতিচ্ছবি সংবিধান প্রণয়নের কালে আমরা দেখেছি, তারই পাশাপাশি দেখা যায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থকে একদম শুরু থেকেই ব্যক্তিগত ও দলীয় জ্ঞান করার মনোজগতটিও।

Constitution Drafting Committee members.

বাহাত্তুরের সংবিধানের শ্রেণীগত ভিত্তি

রাজনৈতিক বিবেচনায় আর একটি বিষয় খুব জরুরি, সেটা ভারত প্রশ্ন। ১৯৭২ সাল থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ সদ্যজাত বাংলাদেশকে কিভাবে ভারতের প্রায় অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিনত করা হচ্ছে, তার নিয়মিত বর্ণনা ও প্রতিবাদ জারি রাখলেও ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও তারা সঙ্গতকারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। বলা যায়, বাংলাদেশের শৈশবাবস্থাতেই যে নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সাথে স্থাপিত হয়েছিল, তারই সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাও দেশে জারি হয়েছিল। এই অধীনতামূলক অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্যই প্রয়োজন ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, গোপনপ্রবণ এবং জনগণের অংশগ্রহণহীন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রেহমান সোবহানের মত আওয়ামীপন্থী অর্থনীতিবিদের রচনাতেও নতুন শাসক হয়ে ওঠা বাঙালী পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর লুণ্ঠনের চিত্র পাওয়া যাবে (যদিও বায়াত্তুরের সংবিধানের জাতীয় আন্তর্জাতিক দেশীয় শিল্পকারখানা ও উৎপাদন ক্ষেত্রে শাসক শ্রেনীর বেপরোয়া লুণ্ঠনের সাথে ভারতের সাথে এই পরনির্ভরশীল অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্পর্কটি তার রচনায় কখনোই আসেনি)। রেহমান সোবহান এবং আরও অনেকের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ মূলত ছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন ক্ষুদে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল, স্বাধীনতার পর এরা রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান ব্যবহার করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৃদ্ধিতে, এর বাইরে ধনী হবার প্রধান উপায় ছিল রিলিফ সামগ্রী লুণ্ঠন (দেশের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া যুবলীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা ছিলেন রেডক্রসের চেয়ারম্যান), লাইসেন্স পারমিটের একচেটিয়াকরণ এবং গ্রাম ও মফস্বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ অপরের সম্পত্তি দখল। কারখানাগুলোতে সরাসরি কলকব্জা পাচার থেকে শুরু করে বাড়তি মূল্যে যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল সরবরাহ, অস্বাভাবিক কম দরে উৎপাদিত দ্রব্যাদির একচেটিয়া সরবরাহের অধিকার লাভ এবং সেই পণ্যাদি অস্বাভাবিক উচ্চদরে জনগণের কাছে বিক্রি- এই ছিল সম্পত্তি মালিক হবার সবচে’ লাভজনক উপায়।

রেহমান সোবহান তার ‘রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতের উদ্বৃত্ত আয়ের বন্টন ব্যবস্থা: বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে’ নিবন্ধে দেখিয়েছেন ৬৯-৭০ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎপাদন মূল্যের বন্টনে শ্রমিক কর্মচারিদের বেতন ছিল ১০.৫০ ভাগ, বস্তুগত উপাদান বাবদ খরচ ছিল ৫৬.২০ ভাগ। স্বাধীনতার পর ৭৫-৭৬ সালের মাঝে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন বাবদ অংশ বৃদ্ধি পায় মাত্র দশমিক ৪০ ভাগ, কিন্তু উৎপাদন সামগ্রী বাবদ খরচ ১২.২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৮.৪০ ভাগে। উল্লেখ্য করা দরকার যে, পাকিস্তান আমলেও এই কারখানাগুলোতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি বেশি পাবার উদ্দেশ্যে এই বস্তুগত উপাদান খাতে খরচ এমনিতেই বহু বেশি ধরা হতো, সেটিই বাংলাদেশ আমলে আরও বৃদ্ধি পাওয়া লুণ্ঠনের মাত্রা বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত করে। রেহমান সোবহারের ওই নিবন্ধে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির বেলায় মুনাফার হারের যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, তা আরও ভীতিকর: ‘এ থেকে দেখা যায় যে এ ধরণের পণ্যের ফ্যাক্টরি মূল্য থেকে উচ্চতর খুচরা মূল্যের ব্যবধানের সীমা ৮০ শতাংশ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করে থাকে।’ ওই একই নিবন্ধের সাত সংখ্যক সারণীতে পাওয়া যাবে ৭৩-৭৪ সালে সার, সাবান, ওষুধ, চিনি, সিমেন্ট, পাট, ময়দা সমেত ২৫টি রাষ্ট্রীয় খাতে উৎপাদিত পণ্যের তালিকা, যেগুলোর অধিকাংশতেই উৎপাদন খরচের (কাঁচামাল ক্রয়ে দুর্নীতির ফলে যা ইতিমধ্যেই কৃত্রিম ভাবে বৃদ্ধি পাপ্ত) চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে অতি কম, সামান্য কম বা সমান দরে কারখানার বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন যে চিনির উৎপাদন খরচ ৪০৪ টাকা, কারখানাগেটে বিক্রয়মূল্য ২৪৫.২ টাকা! রেহমান সোবহানের হিসেবে চিনির বাজারজাত করণে ’৭৪-’৭৫ সালে মুনাফা হত ১০০-১৫০ ভাগ। সাবান উৎপাদনের বেলায়ও উৎপাদন খরচ ৭১.৫, কারখানা গেটে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭০.৭, বাজারজাতকরণে মুনাফার হার ছিল ১২১ ভাগ। দু’টি পণ্যেরই দাম নির্ধারণ করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এভাবে কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করাটা চক্রান্তমূলক ছিল নাকি পারমিটধারীদের মুনাফা যথাসম্ভব উচ্চ করার ‘নিরীহ ধান্ধা’, তা বলা মুশকিল। কিন্তু এর ফলাফল যা হবার তাই হল। এভাবে কৃষক পর্যায়ে চাষীরা কতটা বঞ্চিত হতো, এবং পরিশেষে দেশবাসী কত টাকায় পণ্যটি ক্রয় করতো এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে মধ্যস্বত্তভোগীরা ধাপে ধাপে জনগণের কতটা অর্থ পকেটস্থ করতো, তার একটা ধ্রুপদী উদাহরণ পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের লবণ কেলেঙ্কারির সময়ে। ৯ অক্টোবর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত শ্রমিক লীগের এমপি আবদুল মান্নান এর বক্তব্য অনুযায়ী,

“লবণের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল প্রকার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, মজুতদার উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ২ টাকা মন দরে লবণ কেনে। মজুতদারদের জন্য অশোধিত লবণের সরকারী দাম ১৫ টাকা, আর শোধিত লবণের দাম ৫৫ টাকা।…অশোধিত লবণের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবণ পাওয়া যাবে মজুতদারের মত প্রকাশ করছেন।”

লবণের দাম এই সময়ে খুচরা পর্যায়ে কত ছিল, সেটা কল্পনাতীত নিশ্চয়ই, এই বক্তব্যের কয়েক মাস আগেই পত্রিকার খবর অনুযায়ী চার আনা সেরের লবণের দাম ৩২ টাকা হয়ে গিয়েছিল। চাষী যেটি মন প্রতি দুই টাকা দরে বিক্রি করছেন, অতি সামান্য মূল্য সংযোজন শেষে সের প্রতি তা ৩২ টাকায় খুচরো বিক্রি হওয়া থেকেই কতটা অকল্পনীয় হারে লুণ্ঠন সম্পন্ন হয়েছে তা বোঝা যায়। পরিকল্পনা কমিশনের হিসেব থেকে জানা যায় মাত্র দুই বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম প্রায় চারশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্ধিত এই গোটা অর্থ অল্প কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগসম্পন্ন পারটিমটধারী ব্যক্তির পকেটস্থ হত। এর পুরোটাই ‘সমাজতান্ত্রিক’ বাংলাদেশের নব্য ধনীক শ্রেণীর পকেটস্থ হয়ে কেবল তাদের সম্পদই বৃদ্ধি করেনি, দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রেরও মহাসর্বনাশ করেছিল।

দেশে পরিচালিত এই আদিম কায়দার সম্পদ আহরণের একটা সঙ্গত পরিনতি ছিল দেশীয় শিল্প-কৃষি কাঠামোর সম্পূর্ণ বিনষ্টি, তার বিকাশ রহিত হওয়া এবং পরনির্ভরশীলতার অর্থনীতির জন্ম। লুণ্ঠনের অপর পিঠটি তাই ছিল প্রথমত এবং প্রধানত ভারত, এবং এর সাথে বাকি পুঁজিবাদী দুনিয়ার একটি অধীনস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির বিকাশ। এদিক দিয়ে বাংলাদেশে একটা ঐতিহাসিক পরম্পরা বজায় থেকেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল বাঙালী হিন্দু পুঁজিপতি-বণিকদের অর্থবিত্ত শিল্পোদ্যোগ এবং ব্যবসার প্রসারে না বিনিয়োজিত হয়ে তা ভূ-সম্পত্তিতে নিয়োজিত হলো। এতে একটা স্থায়ী ভূস্বামী মিত্র পাওয়ার রাজনৈতিক লাভের পাশাপাশি বৃটিশরা সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত থেকেও রক্ষা পেল। তবে বাংলায় পুঁজিপতি শ্রেণী গড়ে না উঠলেও ভিন্ন ধরনের ভূমিবন্দোবস্তের কল্যাণে মাদ্রাজ আর বোম্বেতে ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণী ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করলো। বাংলার অতুল সম্পদ ব্রিটিশদের নতুন গড়ে ওঠা শিল্পে কাঁচামালের যোগান দিয়েছে, আর নিজে ব্রিটিশের বাজার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বাংলার দেশীয় উৎপাদনশীল খাত (বস্ত্র, সুতা, কুটিরশিল্প, লবণ, তৈজসপত্র প্রভৃতি) প্রায় সমূলে ধ্বংস করেছে কিংবা তার ওপর নানান বিধি নিষেধ জারি করেছে, কৃষিকে তার স্বার্থ অনুযায়ী রূপান্তরিত করেছে, তার বাণিজ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবহণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছে। এই সব কিছু করতে গিয়ে গোটা অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতির ওপর তারা নির্বিচার তাণ্ডব চালিয়ে ঐতিহ্যবাহী সকল পেশাকে ধ্বংস করেছে। ব্রিটিশ শাসনের আইনী ধারাবাহিকতা ও উত্তরাধিকার বজায় রাখা পাকিস্তান আমলেও প্রায় একই ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে প্রধানত পাঞ্জাব কেন্দ্রিক শিল্পোদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এবং আবারও বাংলার কাঁচামাল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের মালিকানাধীন কারখানায় জোগানদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারেও পরিনত হলো। সকল বিবেচনায় পূর্বপাকিস্তান হলো পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উপনিবেশ। ব্রিটিশ আমলের প্রায় সকল উপনিবেশিক আইনের ধারাবাহিকতাই তাই পাকিস্তানেও বহাল ছিল।

একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবার পর শাসকদের অনুৎপাদক এবং লুটেরা চরিত্র বাংলাদেশকে আবারো নতুন করে ভারতের অর্থনৈতিক মুক্ত চারণভূমিতেই পরিনত করলো। সেই সাথে বাংলাদেশে ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্বও সর্বময় হয়ে উঠলো। দেশীয় পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী একদিকে যেমন তাদের লুণ্ঠনের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদিকা শক্তির সমূহ বিনাশ ও শিল্প ও কৃষির সর্বনাশ করছিল, তারই পরিপূরক হিসেবে এখানে ভারতীয় পুঁজির আগ্রাসন ঘটতে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য সম্পর্কে বিশাল ঘাটতিই শুধু লক্ষণীয় নয়, অনানুষ্ঠানিক চোরাকারবারও দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ছিল। এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বরাবরই বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ঘটত, এবং এখনও ঘটে। কেননা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া চামড়া, পাট, ডিজেল, ধাতব বস্তুর বিপরীতে ভারত থেকে আসে প্রক্রিয়াজত পণ্য। এতে মূল্যসংযোজনের প্রায় পুরোটাই ঘটে ভারতে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বর্তমানে এই অনানুষ্ঠানিক চোরাকারবারীর পরিমান আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের অন্তত তিন/চার গুন। ওই সময়ে এই অনুপাত যে বহুগুন বেশি ছিল তা তখনকার সংবাদপত্র ঘাটলেই পরিস্কার হবে। এমনকি চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বহুগুন বৃদ্ধিতেও এই চোরাকারবারী অর্থনীতির বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

একদিকে স্থানীয় শাসকগোষ্ঠীর লুণ্ঠন এবং অপরদিকে দেশীয় উৎপাদিকা শক্তির শূন্যস্থান দখল করা ভারতীয় পুঁজি উভয়েরই যৌথস্বার্থ ছিল বাংলাদেশে একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংবিধান ও শাসকগোষ্ঠী কায়েম করা। এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দেশীয় লুটেরাদের দরকার, কারণ লুণ্ঠনকে অবারিত করার জন্য প্রয়োজন প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিনাশ, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। উৎপাদনশীল জাতীয় বুর্জোয়া তুলনামূলকভাবে উদারতরই হয় সাধারণত। অপরদিকে যারা এদেশটিকে তাদের বাজারে পরিণত করতে আগ্রহী তাদেরও প্রয়োজন ভঙ্গুর, নতজানু, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গণভিত্তিহীন একটি শাসকগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা করায় বাংলাদেশে একদিকে তার প্রভাব সাময়িকভাবে অনেকটাই হ্রাস পায়, বাংলাদেশের নতুন শাসক শ্রেণীর সাথে মার্কিনের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই ভাল থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ এতে সাময়িক কালের জন্য হলেও একটা প্রবল ছেদ আনে। এই শূন্যতাও ভারতই পূর্ণ করে।

অন্যদিকে ষাট ও সত্তুরের দশকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ছিল বিপ্লবাত্মক। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতার লড়াই সংগঠিত হচ্ছিল প্রবলরূপে। একের পর এক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী বলয় থেকে বের হয়ে আসছিল কিংবা তার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের শুধু নয়, গোটা সাম্রাজ্যবাদী মহলের জন্য আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয় ছিল পূববাঙলায় একটি বিপ্লবাত্মক উত্থান। এই উত্থান রোধ করার জন্য ভারত কতটা মরিয়া ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিপ্লবী চেতনার বিকাশ দমন করতে তারা কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তারা কিভাবে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভাজিত এবং বিশেষকরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোকে খতমের জন্য মুজিব বাহিনী নামে একটি পৃথক খুনে বাহিনীর জন্ম দিয়েছিল, তার বিবরণ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মইদুল হাসান এর মূলধারা একাত্তর গ্রন্থটিতে পাওয়া যাবে।

এই বিবেচনায় এটা অনুমান করা অসম্ভব নয় যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের যে উচ্চতর আকাক্সক্ষার জন্ম হয়েছিল, সেই বিপ্লবী চেতনার পথে একমাত্র কার্যকর প্রতিবন্ধক হবার ক্ষমতা ছিল আওয়ামী লীগের। জনপ্রিয় সকল শ্লোগানকে আত্মসাৎ করেও পুরনো ক্ষমতা সম্পর্ক ও সাম্রাজ্যবাদী যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণ অটুট রাখতে পেরেছিল দলটি। এই সংবিধানে তাই আওয়ামী লীগকে একক কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়, কারণ ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন তাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মত একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আওয়ামী লীগের একটা বেশ উল্লেখযোগ্য অংশের মাঝেও যে গণতান্ত্রিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে শক্তিশালী করেছিল, সেটাকেও যথেষ্টই ভয় পেত ভারতসহ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব। তাদের বাণিজ্য বিস্তারে কামনার সাথে এটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ফলে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন দ্রুত আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগ পুনস্থাপনের মরিয়া চেষ্টা চালায়, শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় ইন্ধন দিয়ে তুলনামূলকভাবে আরও ডানপন্থীদের ক্ষমতাসীন করে সেটা স্থাপনও করে, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় কিন্তু তার হাতেই সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখাটাকেই তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য নিরাপদ ও স্বস্তিকর জ্ঞান করে।

ভারত তার এই বাজার বিস্তারে শুধু যে বাংলাদেশের ভঙ্গুর এবং লুণ্ঠনজীবী শাসকগোষ্ঠীর আনুগত্য পেয়েছিল তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিন্যাসও তাকে মস্কোপন্থী বলে পরিচিত বাংলাদেশের বামপন্থীদের একটা বড় অংশের সহায়তা এনে দিয়েছিল। এটা কৌতুহলোদ্দীপক যে, ভারতের শাসকগোষ্ঠী, যারা মূলত বোম্বে এবং মাদ্রাজ কেন্দ্রীক পুঁজিপতিদের প্রতিভূ, যে সময়টিতে ‘সমাজতান্ত্রিক সংবিধান’ এর বন্দোবস্ত করে এবং নানান সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদেশী পুঁজির হাত দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে রক্ষা এবং নিজেদের শিল্পভিত্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই একই সময়ে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী ‘সমাজতান্ত্রিক সংবিধান’ এর আড়ালে ভারতীয় শিল্প এবং বণিক পুঁজির শিকারে পরিণত করছে দেশটিকে। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ কোন বিরাট অর্থনৈতিক স্বার্থ না থাকলেও, এবং সীমিত আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু দান-খয়রাত সদ্যস্বাধীন দেশটিকে করলেও তারা তাদের অনুগত রাজনৈতিক দলসমূহকে মুজিবুর রহমান ও ভারতের সাথে মিত্রতা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের বন্ধুত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল, আর সে বন্ধুত্বের দায় মেটানোর জন্য সোভিয়েতপন্থী দলসমূহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক ভূমিকাটি যথাসম্ভব পালন করে। আরও একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। সেটি হলো, ভারত সাধারণভাবে রুশ বলয়ের বলে পরিচিত হলেও সত্তরের দশকের সেই সময়টিতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক যথেষ্টই দৃঢ় ছিল। আজকের মতই তখনও ভারতকেই এই অঞ্চলের ‘মাতব্বর’ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করত। ভারত বিশ্বভূরাজনৈতিক বিভাজনে একদিকে রাশিয়ার পক্ষালম্বন করে সামরিক-অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভূতভাবে লাভবান হয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও উল্লেখযোগ্য পরিমানে সম্পর্ক রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের বেলায় এই উভয় সম্পর্কই তার জন্য লাভজনক হয়েছে।

১৯৭২-৭৫ সালের বহু দলিলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মস্কোপন্থীরা যে কোন রাজনৈতিক ঘটনার মূল্যায়ন করছে ‘রুশ-ভারত মৈত্রী’র সাপেক্ষে তার ইতিবাচকতার আলোকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংবিধান প্রণয়নের অনতিকাল পরেই ’৭৩ নির্বাচনে সিপিবির নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, “কমিউনিস্ট পার্টি… বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী দৃঢ় করার জন্য একটি বাস্তব ও নিম্নতম কর্মসূচি উপস্থিত করিয়াছে”; সেই ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ফলাফলকে সিপিবি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল জনগণ “ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সহিত বন্ধুত্ব প্রভৃতি নীতির প্রতি সমর্থন জানাইয়াছে এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও ভারত আর সোভিয়েত বিরোধীদের পরাজিত করেছে” (উল্লেখ্য যে, এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সবগুলো প্রধান দলই বামপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক ছিল, সাম্প্রদায়িকদের পরাজিত করেছে কথাটি আদতে এখন যেভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা অর্থে দাঁড় করিয়ে ফায়দা লোটা হয়, সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে); ’৭৩ সালেই আওয়ামী লীগ-ন্যাপ (মোজাফফর)-সিপিবি এই তিন দলের ঐক্যজোটের (গণঐক্যজোট) ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে “এটা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কুৎসা বন্ধ করবে” ইত্যাদি। ফলে, সিপিবির তৎকালীন সংবিধান বিষয়ক সমালোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এই সংবিধানটি ছিল অগণতান্ত্রিক; সমমনা এবং বৃহত্তর দল ন্যাপ (মোজাফফর) এর ভূমিকা ছিল কখনো কখনো আরও সাহসী, কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি হয়ে ‘রুশ মৈত্রী’র দাম এই দু’টি দলকে নগদে শুধতে হয় একদিকে দেশীয় ক্ষেত্রে লুণ্ঠনজীবী শাসকগোষ্ঠীর সাথে রাজনৈতিক পরজীবিতার সম্পর্কে যুক্ত হয়ে এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ভারতীয় পুঁজির আগ্রাসন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে, এবং এই উভয় গোষ্ঠীর জারি করা শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে। এরই পরিনামে, সব মিলে আওয়ামী লীগের বাইরের তিনটি ধারা, চীনপন্থী বিপ্লবী অংশ, মস্কোপন্থী ধারা এবং জাসদ এই তিন অংশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সংবিধান কায়েমে কোন কার্যকর কোন ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলত, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দিক দিয়ে কোন কার্যকর বাধা ছাড়াই বাংলাদেশে এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো, যার দায় ঐতিহাসিকভাবেই আজও দেশের জনগণ বহণ করে আসছেন। এদিক দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার সাথে তার সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়, এবং সেই আকাক্সক্ষার বিপরীতভাবে একটি অগণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদনির্ভর, ফ্যাসিস্ট ও জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্ররূপেই বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সর্বতঃ অর্থেই সেই বিয়োগান্তক পরিণতির স্মারক।

সংবিধানকে উপনিবেশিক ধারা থেকে মুক্ত করার উপায়

শেষ পর্যন্ত একথা বলতেই হবে, খুব ভাল কোন সংবিধানও আদৌ কার্যকর থাকবে কি না, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রে বিভিন্ন শক্তিগুলোর ভারসাম্য এবং কাদের নিয়ন্ত্রণ ও দাপট প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তার ওপর। এই ভারসাম্যে সমস্যা থাকলে খুব ভাল কোন সংবিধানও নৈরাজ্যকর শাসনের জন্ম দিতে পারে। অন্যদিকে, জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সমাজে কার্যকর থাকলে অগণতন্ত্রের গর্ভেও ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো দানা বাঁধতে পারে।সেই বিবেচনায় বলা যায়, আলাদা করে সংবিধান সংশোধন করে এখন আর তেমন কোন গণতান্ত্রিক অগ্রগতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব না। কেননা, যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজে, সেখানে এগুলো কাগুজে অধিকার হিসেবেই থাকবে।কিন্তু অন্যদিকে, যদি এই অধিকারগুলো জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ভিত্তিতে অর্জিত হয় এবং সংবিধানে প্রতিফলিত হয়, তাহলে তার কার্যকর প্রয়োগ আশা করা যায়। তবে সমাজে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে গুরুতর পরিবর্তন না করে পারবে না, এবং তাদের সেক্ষত্রে দৃষ্টি রাখতে হবে:

ক. সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক একটি নির্বাচন পদ্ধতি সুনিশ্চিত করা।

খ. এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর অবসান

গ. রাষ্ট্রের সকল কাজে সংসদের কাছে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। সকল চুক্তি সংসদে প্রকাশ করা।

ঘ. সংসদ সদস্যদের যে কোন লাভজনক কাজে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।

ঙ. জনগণের প্রতি দেয়া যে কোন প্রতিশ্রুতিকে বাধ্যতামূলক হিসেবে গ্রহণ করা।

চ. রাষ্ট্রের সকল আয়-ব্যায়কে সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে উন্মুক্ত করা।

টীকা:

১. এই আইন (এবং এর আগে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারী প্রণীত বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ) অনুযায়ী গঠিত গণপরিষদই বাংলাদেশের সংবিধান সভা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই সংবিধান সভার সদস্যরা হলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ (ন্যাশলাল অ্যাসেম্বলি) ও প্রাদেশিক পরিষদের (প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বনকারী জীবিত সদস্যগণ। ওই নির্বাচনদ্বয়ে নির্বাচিত মোট সদস্য সংখ্যা ৪৬৯ (১৬৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) হলেও গণপরিষদের জন্য মনোনীত সর্বমোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৩০ জন। বাকি ৩৯ জনের মাঝে দশ জন ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন (৫জন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে শহীদ হন), ২জন পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখানোর দায়ে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন এবং চার জন বাংলাদেশ যোগসাজশকারী বা দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশে গ্রেফতার হন। এবং বাকি আরও ২৩ জন সদস্য দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ, [কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি (সিসেশন অব মেম্বারশিপ) অর্ডার(পিও ন. ২৩ অব ১৯৭২)] এর অধীনে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গণপরিষদে অংশগ্রহণেরই অধিকার হারান, যদিও তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিই ছিলেন।

এই ৪৩০ জন গণপরিষদ সদস্যের মাঝে অচিরেই আরও ১৯ জন তাদের সদস্যপদ হারান আওয়ামী লীগ কর্তৃক বহিস্কৃত হয়ে, গণপরিষদচলাকালীন। অন্যদিকে সরকারের দুর্নীতি আর অসদাচরণের প্রতিবাদে গণপরিষদের ৩ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে তাদের সদস্যপদ হারান, তিন জন মৃত্যুবরণ করেন, সংবিধান পরিষদ থেকে একজন পদত্যাগ করে বৈদেশিক দফতরে যোগ দেন। অবশিষ্ট ৪০৩ জন সদস্য সংবিধান পরিষদের শেষ পর্যন্ত ছিলেন, এদের মাঝে তিনজন ছিলেন বিরোধী দলীয় সদস্য: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির( মোজাফফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর বাকি দু’জন স্বতন্ত্র সদস্য।

২. এই সময়ের হক কথার সংখ্যাগুলো এই জাতীয় অজস্র তথ্য আর সংবাদে ভরপুর ছিল। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সরকারী দলের বেপরোয়া দুর্নীতি, লুণ্ঠন, ডাকাতি, অপহরণ আর রাজনৈতিক নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা সাপ্তাহিক হক কথা অচিরেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে, সংবাদপত্রের আকালের সেই যুগে এই সাপ্তাহিকীটির প্রচার সংখ্যা ৬০ হাজার পর্যন্ত পৌঁছে। সাপ্তাহিক হককথার সংকলন ঘাঁটলেই যে কেউ এটা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না যে, পত্রিকাটিতে কি বিপুল পরিমাণে গণপরিষদ সদস্যদের (এমসিএম- মেম্বার অব দি কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি নামেই তারা পরিচিত ছিলেন) অপরাধমূলক তৎপরতার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

৩. গণচীনের নামে নামকরণ হলেও চীন দেশটির সাথে এদের কার্যত কোন সম্পর্ক ছিল না, এটা ছিল বিপ্লবের পন্থা প্রশ্নে রুশ ও চীন পার্টির মহাবিতর্কের জেরে সারা দুনিয়াব্যাপী কমুনিস্ট আন্দোলনে দ্বিধাবিভক্তিজনিত দুটো মতধারা, মস্কোপন্থীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন যতকাল টিকে ছিল, তার সাথে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও নানান সুযোগ-সুবিধার নির্ভরশীলতার সম্পর্ক বজায় রাখলেও চীনাপন্থী দলগুলো মূলত দেশে দেশে স্বাধীনভাবেই ক্রিয়াশীল ছিল।

৪. ব্যারিস্টার আমীর অচিরেই আবিষ্কার করেন উক্ত বৈঠকে এই মতামত ব্যক্ত করার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এই সন্দেহ করা শুরু করেন যে ব্যারিস্টার আমীর নিজে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি সংসদীয় ক্যু এর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত, এবং এরই অংশ হিসেবে এই প্রস্তাব তোলা হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতার পর আমীর সাহেব প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন বলে ব্যারিস্টার হালিম সাহেবকে ঐ একই সাক্ষাৎকারে জানান।

৫. সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখানে বৃটিশদের পরার্ম গ্রহণের নিন্দা করেছেন, এটা নতুন প্রজন্মের বহু পাঠকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকতে পারে। স্মর্তব্য, মওলানা ভাসানীর পত্রিকা হক কথাতেও খসড়া সংবিধান প্রণয়নের পর কামাল হোসেনের ভারত ও যুক্তরাজ্য সফরের নিন্দা করা হয়। সমসময়ে হককথার একটি শিরোনাম ছিল ‘সংবিধানের ভারত যাত্রা’। এই সফরের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ভারত ও ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক চর্চা সম্যকভাবে পর্যবেক্ষণ। সুরঞ্জিত ও ভাসানীর আশঙ্কাটা মূলত একই, সেটা হল বাংলাদেশে নয়া উপনিবেশিক শাসন পুনস্থাপনের উপযোগী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ছিল ওই শক্তিগুলোর (সুরঞ্জিত অবশ্য শুধু যুক্তরাজ্যের কথাই বলছেন) লক্ষ্য। তবে কামাল হোসেন এর ভারত ও যুক্তরাজ্য সফর বাংলাদেশের সংবিধানের কোন নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য দূর করতে কিংবা ইতিবাচক কোন উপাদান অন্তর্ভুক্ত করতে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তাদের বৃটিশ ও ভারতীয় পরামর্শকগণ যদি এই সংবিধানকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলে অনুমোদন করে থাকেন, তাহলে সেটা থেকেই এই পরামর্শকগণের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষা পরিস্কার বোঝা যায়, এবং সেটা যে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আকাক্ষার ঠিক বিপরীত, তাও স্পষ্ট।

  • ফিরোজ আহমেদ: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *