- খোইরোম রুধির
কোন আন্দোলন শুরু হবার পর সবারই কতগুলো প্রশ্ন মাথায় আসে। আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? কে বা কারা করছে? নেতা কে? তারা কি বামপন্থী নাকি ডানপন্থী, সরকারপন্থী নাকি সরকার বিরোধী? কোন আন্দোলন শুরু হবার পর পরই রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা চোখ-কান খুলে এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। আন্দোলন সংগ্রাম হলেই দল থাকবে, নেতা থাকবে, নাম সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন, পোস্টার-প্ল্যাকার্ড থাকবে, ‘মঞ্চ-মাইক-মুখপাত্র-মুরুব্বি-কমিটি’১ থাকবে এইসব চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়ে গেছে। হাস্যকর হচ্ছে, আমরা নিয়মের বেড়া জালে আবদ্ধ হতে হতে এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামকেও ছকে ফেলে চিন্তা করতে শুরু করেছি। আন্দোলন সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি আমাদের পরিচিত কাঠামোর বাইরে গেলেই ভ্রু কুঁচকে ফেলছি। এমনকি আমরা চাই ‘আন্দোলন-সংগ্রাম হোক নিয়মমাফিক’! যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি তার কাছে অনুমতি নিয়ে আন্দোলন করতেও দ্বিধা বোধ করি না। যেকোন প্রকার আন্দোলন-সংগ্রামকেই রাষ্ট্র নিজের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করে। অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের পথ যতই সংকুচিত হবে রাষ্ট্রের জন্য ততই মঙ্গল হবে। কারণ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই জনগণ রাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করে ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় করে নেয়। সুতরাং জনগণকে যতই ভয়-ভীতি দেখিয়ে, উন্নয়নের আফিম খাইয়ে এই পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে রাষ্ট্র ততই নিরাপদে শাসন-শোষণ কায়েম করতে পারবে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র চায় জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে সরে গিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, রাষ্ট্র নির্দেশিত নিয়মনীতি অনুযায়ী জীবনযাপন করুক, বিনা বাদ-প্রতিবাদে, ঘাত-প্রতিঘাতে, রোধ-প্রতিরোধে মেশিনের মত আদেশ পালন করুক।
আন্দোলন হলেই নেতার আবির্ভাব হয়। রাষ্ট্রীয় মোড়ল-মুরুব্বিরা আন্দোলনকারীদের পরামর্শ উপদেশ দিতে লাইন ধরেন। এমনকি কী কী কর্মসূচি হতে পারে, কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত সেইসব নিয়েও জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে শুরু করেন। তবে আদৌ ‘মঞ্চ-মাইক-মুখপাত্র-মুরুব্বি’র দরকার আছে কি? সম্প্রতি সংঘটিত ‘কিশোর বিদ্রোহ’র দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে ন্যায্য অধিকার ও ন্যায় বিচারের দাবিতে সংঘটিত সবচেয়ে যৌক্তিক, বৃহৎ ও শক্তিশালী আন্দোলন ছিল এটি। যা আমাদের সবাইকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার খুঁতগুলো চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের দাসত্ব ও শৃঙ্খলে আটকা পড়া মনোজগতকে মুক্ত করার চালিকাশক্তি দিয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে শিখিয়ে গেছে কীভাবে ন্যায্য অধিকার দাবি করতে হয়। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট কোন নেতা ছিল না, মুখপাত্র ছিল না, মঞ্চ ছিল না। তারা সারা ঢাকা এমনকি সারা বাংলাদেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল। সারা দেশের রাস্তা-ঘাট, সড়ক-মহাসড়কই তাদের অঘোষিত মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। স্কুল কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে কিন্তু কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা নেই, কোন ভাঙচুর নেই। উল্টো দেখা গেল চোখ জুড়ানো ‘শৃঙ্খলিত যান চলাচল’, ‘শৃঙ্খলিত ট্রাফিক’। কেউ লাইন ছেড়ে বেলাইনে যাচ্ছে না, কেউ কাউকে ওভারটেক করছে না, কেউ লাইসেন্স ছাড়া বের হচ্ছে না, কেউ লক্কর-ঝক্কর ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছে না, কেউ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের সাহস পাচ্ছে না। যানবাহনে যানবাহনে গতির প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হায়ার্কি, শ্রেণিগত বিভেদ্-বৈষম্য, লৈঙ্গিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে না, সবাই একত্রিত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আদতে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে ছাত্রসমাজের যে আদৌ কোন বিভেদ নেই, সব বিভেদ-বৈষম্য যে রাষ্ট্র নির্মিত সেইটাও স্পষ্ট প্রতীয়মান তাদের পারস্পরিক ‘সহাবস্থান-সাহচর্য-সহযোগিতায়’।
বাস চাপায় সহপাঠী হত্যার ন্যায় বিচারের দাবিতে ‘We Want Justice’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে তারা রাস্তায় নেমেছিল কিন্তু সেই আন্দোলন শুধু খুনী চালকের বিচারের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কারা দায়ি সেইটা তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল। শুধু যে বাস চালকের শাস্তি হলেই সব চুকে যাবে না, রাঘব-বোয়ালরা সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে তা তারা বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা ভাঙাচুরা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজেও হাত দিয়েছিল। পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে লেখা স্লোগানগুলোর কথাই ভাবুন- ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। এই কিশোর-কিশোরীরা রাষ্ট্র কাঠামোর খুঁতগুলো ধরতে পেরেছিল। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রকেও বুঝতে পেরেছিল। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র যে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করবে, দমন-নিপীড়ন চালাবে, এইটাই স্বাভাবিক। যেকোন প্রকার ন্যায্য দাবি-দাওয়া কেন্দ্রিক আন্দোলনকে দমন করতে ‘পুলিশ-প্রশাসন-পেটোয়া বাহিনী’ তৈরি থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র তার পেটোয়া বাহিনী ব্যবহার করে তাদেরকে তুলে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সকল প্রকার ভয়ডর তুচ্ছ করে তারা ক্রমেই সংখ্যায় বাড়ছিল। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের হুশিয়ারিকে তোয়াক্কা করেনি, পুলিশবাহিনী কে ভয় পায়নি। রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনীর সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়েছে, উচ্চারণ করেছে- ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ/যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’। বলতে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারালো নখরকেও তারা কয়েকদিনের জন্য ভোঁতা করে দিয়েছিল। সর্বাত্মক অহিংস অরাজপন্থায় নজরদারি-খবরদারি রাষ্ট্রযন্ত্রকে সাময়িকভাবে বিকলই করে দিয়েছিল। তাদের সামগ্রিক অহিংস প্রতিরোধ এতই শক্তিশালী ছিল যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাবতে হয়েছে নতুন দমন কৌশল। তাদের এই সামগ্রিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কৌশল রাষ্ট্রযন্ত্র তার চিরায়ত দমন কৌশলের ব্যকরণ দিয়ে ধরতে পারেনি সহজে। তারা নিপীড়ক ‘পুলিশ-প্রশাসন’কেও খারিজ করে দিয়েছে, ক্ষোভ নিয়ে স্লোগান দিয়েছে- ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল?’, ‘পুলিশ চোদার টাইম নাই বলে’। এই আক্রমণাত্মক স্লোগানগুলো দিয়ে তারা আদতে রাষ্ট্রের নিপীড়ক ও কর্তৃত্ববাদী চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা ‘পুলিশ-প্রশাসন’ নামক নিপীড়ক, জনস্বার্থবিরোধী প্রতিষ্ঠানকে বৃহৎ অর্থে নিপীড়ক রাষ্ট্রকে খবরদারি করেছে। জনগণের টাকা দিয়ে জনস্বার্থবিরোধী ‘পেটোয়া বাহিনী’ পোষার তো কোন মানে হয় না। তারা ‘পুলিশ-প্রশাসন’কে ফুল, যুক্তি, ভালোবাসা, আইন দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছে তাদের আসল চরিত্র আসলে কী হওয়া উচিত। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যে পারস্পরিক সহাবস্থান-সহযোগিতা-সহমর্মিতা চর্চার মধ্য দিয়ে কোন প্রকার ‘কড়া আইনের শাসন’, ‘কর্তার চোখ রাঙানি’, ‘শাসকের বিদ্বেষ-বাণী, শাসনপ্রণালী’ ছাড়াও যে ‘সুস্থ-স্বাভাবিক-সামাজিক’ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে ঐকতান বজায় রেখে চলতে পারে সেই চিরায়ত সত্য তারা আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে।
‘নেতা’ থাকলে প্রকৃতপক্ষে কার সুবিধা? আন্দোলনকারীদের নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রের? সুবিধা আদতে রাষ্ট্রযন্ত্রেরই। কারণ আন্দোলন দমন করতে সহজ হয়। নেতৃত্বদানকারী নেতাদের ধরে বেঁধে ‘দমন-নিপীড়ন-হয়রানি-জেল-জুলুম’ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করে দেয়া সহজ হয়ে যায়। কিন্তু নেতাবিহীন আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হয়। ‘কিশোর বিদ্রোহ’র কোন নির্দিষ্ট মঞ্চ ছিল না, মুখপাত্র ছিল না, নেতা ছিল না, মুরুব্বি ছিল না, মাতব্বরও ছিল না। তারা স্লোগানে স্লোগানে বলছে- ‘নেতা হতে আসি নাই, ভাই হত্যার বিচার চাই’। সুতরাং তাদেরকে কীভাবে দমন করা যায়? সেই দমন প্রক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে হাজির(আমদানি করা) হল ‘গুজবতত্ত্ব’। আর এই ‘গুজব’ই ‘গজব’ এ রূপ নিল। আন্দোকারীদের যখন ‘জামাত-শিবির-বিএনপি-রাজাকার’, ‘সরকার বিরোধী-রাষ্ট্র বিরোধী’ ট্যাগে ভূষিত করে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়ন করা যাচ্ছিল না তখন এই গুজবতত্ত্বের আগমন নিপীড়ক রাষ্ট্রের হালে পানি এনে দিল। অতঃপর রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রোপাগান্ডা মেশিন থেকে ক্রমাগত ছুঁড়ে মারা গুজব শেলে বিদ্ধ হয়ে, দলীয় পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ বর্বর আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে, লাঞ্চিত হয়ে আন্দোলনাকারীরা রাস্তা ছাড়লেন। কর্পোরেট মিডিয়ার এই যুগে রাষ্ট্রযন্ত্র চাইলেই মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক ‘সিটিজেন’ যখন ‘নেটিজেন’ হয়ে উঠছেন, তখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ মিডিয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। সহজলভ্য সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা এবং বিস্তৃতির দরুণ সত্য আর চাপা থাকছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র পড়েছে মহা ফ্যাসাদে, একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাচ্ছে না অকারণ অন্যদিকে অবাধ প্রচার রোধও করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় গুজবতত্ত্বের আগমন, প্রচার ও প্রসার রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ব্যক্তিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও মিডিয়া সেন্সরশিপকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বিরোধী মতকে দমন করছে।
কিশোর বিদ্রোহ আমাদেরকে আরেকটি বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে। ‘কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা’ই যে সকল সমস্যার মূল কারণ সেইটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। একমাত্র ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ’ ই পরিবহন মাফিয়াদের হাত থেকে বৃহৎ অর্থে ক্ষমতাবানদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। প্রখ্যাত কানাডিয়ান সাংবাদিক, লেখক ও এক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইনের থেকে ধার নিয়ে বলছি- ‘পুঁজিবাদের বিকল্প কম্যুনিজম নয়, সেই বিকল্প হচ্ছে বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতা’২। যতদিন কতিপয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত থাকবে ততদিন ক্ষমতার অপব্যবহার হবে। যার ক্ষমতা আছে সে ক্ষমতাহীনদের নির্যাতন করবে, নিপীড়ন করবে, শোষণ করবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দমন করবে। কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ৩; পুলিশ-প্রশাসন, সরকার কিংবা রাষ্ট্র নয়। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সাময়িক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছিল কিশোর বিদ্রোহে। রাষ্ট্রীয় মোড়লদের নজরদারি-খবরদারির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তারা যখন ক্রমাগত সর্বাত্মক সামাজিক নজরদারি-খবরদারির মাধ্যমে জবাবদিহিতা চেয়ে স্বাধীন-সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করল তখনই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটতে শুরু করল অন্তত সাময়িকভাবে। পরিবহন মাফিয়াদের মাফিয়াগিরি হ্রাস পেল, পুলিশ-প্রশাসনের অনর্থক-অনৈতিক চোখ রাঙানি-মাস্তানি কমে গেল। র্যাব-পুলিশ-বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনীও ক্ষমতার দৌরাত্ম্য প্রদর্শন করল না। আইন যে সবার জন্য সমান সেই হারিয়ে যাওয়া সাংবিধানিক সত্যকে তারা সড়ক-মহাসড়কে মঞ্চায়ন করে দেখিয়ে দিল। পুলিশ ভ্যান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি এমনকি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গাড়ি পর্যন্ত আটকে দিল লাইসেন্স না থাকার কারণে। রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণ যখন নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য বুঝে নিয়ে রাষ্ট্রের চালককে খবরদারি করা শুরু করবে ‘লাইসেন্স কই?’ বলে তখনই ‘কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বরফ পাহাড়’ গলতে শুরু করবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে কেউ আর লঙ্কাপতি রাবণ হয়ে উঠবে না। চাইলেই যথেচ্ছা দমন-নিপীড়ন, ধর-পাকড়াও, শোষণ-নির্যাতন করতে পারবে না।
কিশোররা কী চায়? তারা রাজা হতে চায় না, নেতা হতে চায় না, তারা শুধু তাদের সুপ্ত অস্তিত্বটাই প্রকাশ করতে চায়, তাদের সহজাত কর্তাসত্তার কথা জানান দিতে চায়। তারা ন্যায় বিচার চায়, তারা নিরাপদ সড়ক চায়, তারা নিরাপদে ঘরে ফিরতে চায়, তারা নিপীড়নমুক্ত দেশ চায়, তারা ভাঙাচুরা রাষ্ট্রের সংস্কার চায়। তারা চায় সর্বাত্মক সামাজিক সহাবস্থান-সহযোগিতা-সহমর্মিতা। তারা কোন ‘তৃতীয় পক্ষের’ কান পড়ায় বিভ্রান্ত নয়, বিচ্যুত নয়, পক্ষপাতদুষ্ট নয়। তারা ‘সেলফ ম্যানেজমেন্টে’ দীক্ষিত। তাদের এই অহিংস অভিনব প্রতিবাদ-প্রতিরোধেই আমাদের ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিহিত। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এই অভিনব পন্থা কে আমাদের নিজেদের করে নিতে হবে। নিপীড়ক এই রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর সর্বাত্মক সামাজিক নজরদারি-খবরদারি বাড়াতে হবে তাহলেই এই ‘বেপরোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র’ কে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
তথ্যপঞ্জি
১ ‘মঞ্চ-মাইক-মুখপাত্র-মুরুব্বি-কমিটি’ শব্দগুলো সেলিম রেজা নিউটনের ‘অচেনা দাগ’ বইয়ের ‘শাহবাগের স্বাধীনতাই শাহবাগের পথ’ (সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৫: ৪৫৩) অংশ থেকে নেয়া হয়েছে।
২ নাওমি ক্লেইন পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন বিরোধী লেখালেখির জন্য সর্বজন প্রশংসিত। পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম সংক্রান্ত লেখাপত্র ও বক্তৃতা সংকলন ‘Fences and Windows’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের ‘প্রাগ’ শিরোনামের প্রবন্ধের উপশিরোনাম ছিল উদ্ধৃতিটি। মূল উদ্ধৃতি- ‘The alternative to capitalism isn’t communism, it’s decentralized power’।
৩ রাষ্ট্রনৈতিক জার্নাল ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় সংকলিত হাসনাত কাইয়ূমের ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি খসড়া নোট’ শিরোনামের প্রবন্ধে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলতে আমরা কি বোঝাতে চাইছি?’ অংশ থেকে- “আমরা জানি রাজতন্ত্র মানে রাজার তন্ত্র, এ তন্ত্রে রাজাই সব। তিনি দেশের মালিক, আইনের মালিক, রাষ্ট্রের মালিক। তার মালিকানা সুসংহত করার জন্যই আইন-কানুন, বিচার-আচার ইত্যাদি। এসব আইন-কানুন বাস্তবায়নের জন্যই গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে গণতন্ত্র মানে ‘গণ’দের তন্ত্র। যেখানে দেশের মালিক, রাষ্ট্রের মালিক, ক্ষমতার মালিক সবই জনগণ। সেখানকার আইন, বিচার, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি সবই এমনভাবে প্রণয়ন করার কথা যাতে জনগণের মালিকানা, মর্যাদা, অধিকার ইত্যাদি কেউ খর্ব করতে না পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গড়ে তোলা হয় তেমনভাবে যাতে জনগণের ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, তা সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে।
ধর্মতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব ঈশ্বর বা স্রষ্টার, রাজতন্ত্রে রাজার, কিন্তু গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব ব্যক্তির, নাগরিকের।”
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। সেলিম রেজা নিউটন, অচেনা দাগঃ সম্পর্ক স্বাধীনতা সংগঠন, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৫।
২। Naomi Klein, Fences and Windows: Dispatches from the Front Lines of the Globalization Debate, Vintage Canada, 2002.
৩। রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ২, সংখ্যা ১, অক্টোবর ২০১৭।
রচনাকাল: ৫-৯ সেপ্টম্বর, ২০১৮
[প্রবন্ধটি পূর্বে ‘অরাজ’-এ প্রকাশিত হয়েছে]