সবুজের অভিযান

  • পার্থ প্রতীম দাস

এসো নিজে করি: রাস্তার পাঠশালায় ক্লাশ     
বড়রা অংশ নেবে কি? 

স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যবইয়ে এসো নিজে করি টাইপের অংশ থাকে। প্র্যাকটিক্যাল। সেটা তারা করে থাকে। না কি করে না, জানি না। এখন রাস্তায় নেমে সেই টাইপের একটা এসো নিজে করি জিনিসই স্কুলেজের শিক্ষার্থীরা করছে বলে মনে হচ্ছে।

দেশ নামের একটা ক্লাস তারা নিজেরাই খুলে নিয়েছে। হাতেকলমে সব কিছু করার এই ব্যবহারিক ক্লাসের সময়সূচি নির্ধারণ করছে তারা। কোন দিন হবে, কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত- সেটা তারাই ঠিক করছে। এই জিনিস অভূতপূর্ব। কোথাও দেখা যায়নি এখনো দুনিয়াতে।

কেন হঠাৎ বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ছেড়ে এই রাস্তার ক্লাস চালু করতে হলো শিক্ষার্থীদের? কারণ যাদের হাতে রাস্তা চালানোর, দেশ চালানোর, সমাজ চালানোর দায়িত্ব তারা দিয়ে রেখেছিল, ভেবেছিল যে, এরাই তো আমাদের গুরুজন- সম্মানিয়—সেই বড়-বুড়ো মানুষরা তাদেরকে বারবার শুধু যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছে। শৈশব কেড়ে নিয়েছে, কৈশরের অ্যাডভেঞ্চার ভুলিয়ে দিয়েছে। খেলার মাঠ নাই, জিরোনোর সময় নাই, মনে শান্তি নাই। তারা ত্যক্ত-বিরক্ত।

ছোটবেলা থেকে তাদের ওপর যে জুলুম চাপায়ে দেওয়া হয়, চারদিকে তারা যে অন্যায়-অনিয়মগুলো দেখে, একের পর এক ইস্যু আসছে-যাচ্ছে আর সেগুলো নিয়েরাজনীতিবিদদের উদ্ভট সব মন্তব্য, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বানোয়াট কথাবার্তা – ইত্যাদি রাবিশ শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে।

সেই সাথে তাদের নিজেদের বঞ্চনাগুলো তো আছেই। তাদের খেলার মাঠ নাই। সব সময় একটা প্রতিযোগিতা- পাল্লাপাল্লির মধ্যে তাদের থাকতে হয়। তাদের শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। তাদের বিকাশ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এই সব জীবনযুদ্ধের মধ্যে শেষপর্যন্ত নিজের জান বাঁচানোটাও কঠিন হয়ে পড়ছে এই কিশোর-কিশোরীদের।

চোখের সামনে তারা দেখছে সহপাঠীরা পিষে-থেঁতলে যাচ্ছে ঘাতক বাসের পাল্লাপাল্লির রেষারেষিতে। এই দৃশ্য তারা মেনে নিতে পারেনি। তাদের মনে শঙ্কা জেগেছে, ‘আগামীকাল আমি-ই সুস্থভাবে ঘরেফিরতে পারব তো?’ আমাকেই লাশ হয়ে যেতে হবে না তো? একেবারে প্রাণের তাগিদে এই স্কুলেজ (স্কুল+কলেজ) পড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলো ঘটিয়ে দিয়েছে অভূতপূর্ব এই ক্লাস কর্মসূচির ঘটনা।

তারা বলছে, থামো। অনেক হয়েছে। অনেক দেশ চালিয়েছ তোমরা। এমন দেশ চালাইছ যে, আমাদের বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে গেছে। আমাদের প্রাণের মূল্য শুধু কয়েক লাখ টাকা বানিয়ে দিয়েছ তোমরা। বন্ধ করো এগুলো। আমরাই এখন ক্লাস করে তোমাদের দেখায়ে দিচ্ছি দেশ কিভাবে চালাইতে হয়।

হোক প্রতিবাদ, শিল্পী: তন্ময়, সূত্র: তন্ময়’জ কার্টুন

তারা শুরু করেছে রাস্তায় লাইসেন্স চেকিং। ‘বাদ যাবে না একটি শিশু’ নীতিতে বিশ্বাসী মনে হয় তারা। কাউকেই বাদ দিচ্ছে না। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-আমলা-পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী-আমলা-উকিল-মোক্তার-সাংবাদিক-চিকিৎসক-শিক্ষক, এমনকি বাপমা পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। সবার চলছে লাইসেন্স চেকিং। “আছে? লাইসেন্স আছে?” বলে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছে কিশোর বিদ্রোহীরা। এই ক্লাসে তারা শিক্ষক হিসেবেও গ্রহণ করছে অনেককে। একটা ভিডিওতে দেখা গেল, এক পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে লাইসেন্স চেক করতে হয় শিখিয়ে দিচ্ছেন। এক জায়গায় এক পুলিশ সদস্য বলছেন কিভাবে দেশ গড়তে হবে। কথা পছন্দ হওয়াতে হ্যা, স্যার, ঠিক স্যার বলে হাততালি দিয়ে মেনে নিচ্ছে এই শিক্ষার্থীরা। এমন কত কত মানুষকে যে তারা শিক্ষক হিসেবে মেনে নিচ্ছে— হিসেব নেই।

আবার যে শিক্ষক পছন্দ হচ্ছে না, তাকে বলে দিচ্ছে রাস্তা মাপো। বিদেয় হয়ে যাও। অনেক ফেসবুক সেলিব্রেটি, তারকারা পড়েছেন এই তালিকায়— দেখা গেল।

আর নিজেরা এই ‘এসো নিজে করি’ ক্লাসটা করার মধ্য দিয়ে যে অন্যদের, বড়দের কত কিছু শেখাচ্ছে- তা ভাবনার বাইরে। অকল্পনীয় সব কাজ করছে তারা। কমবেশি দেখেছি আমরা সবাই। নতুন করে বলতে গিয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন দেখছি না। ক্লাসটা নির্বিঘ্নে চলতে পারলে মনে হয় মন্দ হতো না— এমন কথা বলার মুখ মনে হয় কম নাই।

কিন্তু আফসোসের বিষয় নজির সৃষ্টিকারী এই রাস্তার পাঠশালা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। হীরক রাজারা কেঁপে কেঁপে উঠছেন। ধামাধারীদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে— কিভাবে বাগে আনা যায় বিচ্ছুগুলাকে? চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। নানাবিধ ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ফাঁদছেন। বিভ্রান্তির জাল বিছাচ্ছেন। কিন্তু বাগে আনা যাচ্ছে না যে এখনো।

তাহলে? সর্বশেষ উপায় হিসেবে তারা সবসময়ই যেটা করেন— সেটাই করছেন। সিপাহী-প্রহরী পাঠাচ্ছেন। সরকারী-বেসরকারী সব ধরণেরই। রাষ্ট্রীয় গুণ্ডাবাহিনীর যৌথ ফোর্স পাঠাচ্ছেন তারা ক্লাস ভেঙে দেওয়ার জন্য। পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। ধামাধামীরা বলে বেড়াচ্ছেন, ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’।

সবাই ছেলেমেয়েগুলোদের পারফরম্যান্সও কিন্তু দেখছে। ব্যবহার-শান্তি-শৃঙ্খলায়? হু, মোটামুটি। ভাষায়? ওরে বাবা! ফাটাফাটি! – ইত্যাদি প্রভৃতি জিনিস এভাবে কিন্তু টুকছে বড়রা-অভিভাবকরা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিছুটা শিক্ষা নিয়ে এই এসো নিজে করি ক্লাসে যোগদান করছে কী? ছোটরা যেভাবে রাস্তায় লাইসেন্স চেক করছে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, সবাইকে লাইনে আনার জন্য; সেভাবে বড়টাও কী পারে না এভাবে নিজেদের, বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বটা নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে?

রাস্তার এই পাঠশালায় শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি যা শিখিয়েছে, তা হলো ভালোবাসা। বন্ধুর রক্ত দেখে টগবগে মাথায় শ্লোগান দিয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। পরম যত্নে তারা অসুস্থ-দুর্বলদের সেবা দিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়া রিকশাচালককে নিজেরা রিকশা চালিয়ে নিয়ে গেছে। রাস্তায় কাগজ টুকিয়ে বেড়ানো পাগলটাকে ধরে এনে জামা-কাপড় পড়িয়েছে। তারপর তাকে একটা গাড়ির উপর তুলে দিয়ে বলছে, ‘এটা তোমার, তোমার’। সত্যি, কান্না চলে আসে এদের ভালোবাসা বিলানোর তরিকা দেখলে।

তো, বড়দের হৃদয় কী একটুও গলছে না এগুলো দেখে? জানি যে, ‘বড়দের বুড়ো দুনিয়া’টা বড়ই নির্দয়-নিষ্ঠুর। কিন্তু তাই বলে কী এতই পাষাণ হয়ে গেছি আমরা? নিজেদের শিশুদের স্বার্থে বাসযোগ্য একটা পৃথিবী বানানোর জন্য আমরা কিছুই করতে পারি না? তারা এতো কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে— তারপরও না?না চাইলে আর আলাপ নাই। আর যদি চাই, তাহলে আসেন পথ খুঁজি। কী করা যায় ভাবি। আমার ভাবনা হলো: শিক্ষার্থীরা যেভাবে সব কিছু নিজেরা করা শুরু করেছে, তেমনি বড়রাও কিছু কিছু জিনিস নিজেরা করতে শুরু করি। ট্রাফিক পুলিশের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি বলে ছোটরা নিজেরাই লাইসেন্স চেক করতে শুরু করেছে। আমরা বড়রাও তো আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভরসা রাখতে পারছি না। আমরা কেন তাহলে পুলিশ-র্যাবের দায়িত্বটা নেব না? প্যারালাল একটা নিরাপত্তা সিস্টেম গড়ে তুলব না? এটা করার উপায়ও খুব সহজ। পাড়ায় পাড়ায়, ওয়ার্ড ধরে ধরে অভিভাবক-নাগরিকদের কমিটি গঠন করা যায়। নিরাপত্তা কমিটি। সবার কথাবার্তা-মতামতের ভিত্তিতে যেগুলো পরিচালিত হবে। পুলিশের যেরকম মোড়ে মোড়ে বক্স থাকে, সেরকম অভিভাবকরাও নিরাপত্তা চৌকি গড়ে তুলতে পারে। এলাকার নানাবিধ সমস্যা-সংকটগুলো কিভাবে দ্রুত সমাধান করা যায়, মিমাংসা করা যায়— সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারে।

মানুষের আসলে বাঁচার পথ এটাই। এতে করে একটা সামাজিক বন্ধনও গড়ে উঠবে। রাষ্ট্রের নির্মম নিষ্পেষণে যে বন্ধন ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দুই তলার মানুষ, তিন তলারে চেনে না। রাস্তার একটা মানুষের কথা তো বাদই দিলাম। এমনটা হলে ষড়যন্ত্রের যাতনাও অনেকখানি কমে আসবে।মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন থাকে— তখনই সেই ঘোলাজলে মাছ শিকার করতে পারে ষড়যন্ত্রকারীরা। চক্রান্তকারীরা। সেই সুযোগ আমরা দিনের পর দিন দিয়ে এসেছি রাজনীতিবিদদের। ফলে এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, যে কোনো কিছুতেই তারা একটা না একটা ষড়যন্ত্র খুঁজে পান। এবং জল ঘোলা করে দিয়ে মাছ শিকার করতে থাকেন আরামসে। দেখা হয়নি এখনো এই জিনিস? নাকি আরও বাকি আছে? বাকি থাকলে আরও ভোগান্তিও আছে।

আর যদি বাকি না থাকে, স্কুলেজের পোলাপাইনগুলার মতো আপনিও বুঝে থাকেন যে, মাথার ওপর ডাণ্ডা হাতে দাঁড়ানো কর্তৃপক্ষের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিলে এমনটাই হতে থাকবে; সোনা-কয়লা গায়েব, কোটি কোটি টাকা পাচার-লুট-খুন-ধর্ষণ-লুটপাট-স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার চলতেই থাকবে; তাহলে আসেন, আমরাও যোগ দেই এই এসো নিজে করি ক্লাসে।

আমরা এবার একটু খতিয়ে দেখি থানা-পুলিশ-অফিস-আদালতগুলোর কী অবস্থা। কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা বারবার মাইর খাচ্ছে রাস্তায়। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় এতো অব্যবস্থাপনা কেন? খোদ ঢাকা শহরটাকেই আরও বাসযোগ্য করা যায় কিভাবে? আমরা তো টাকা দিচ্ছি দেশ চালানোর জন্য। তাহলে এরকম হজবরল অবস্থা কেন? কিভাবে? এগুলো সব কিছু একদম নিজেদের দেখতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেভাবে রাস্তায় গাড়ির লাইসেন্স দেখছে, সেভাবে।

এগুলো একবার করতে শুরু করলে প্রশাসন এমনিতেই হালকা হয়ে যাবে। সরকার গদিতে আছে না নাই— সেটার দিকে তাকানোরই দরকার পড়বে না। এক বিচ্ছু দেখলাম পুলিশের গাড়ির সঙ্গে কাগজে লিখে রেখেছে, ‘প্রশাসন তুই দূরে সর, হালকা মুতে শুয়ে পড়’! দেশের মানুষ পাবলিকই যদি এগুলো দেখতে শুরু করে, তাহলে প্রশাসনের সত্যিই এটা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।

বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনের দেশ। ৫২ সালের সেই গৌরবজ্জল ঘটনা এখন পুরো বিশ্বের গর্ব। পুরো দুনিয়ার মানুষ পালন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই ২০১৮ সালের কিশোর বিদ্রোহের জন্যও বাংলাদেশের নাম একদিন গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হতে পারে বিশ্বজুড়ে।বাংলাদেশের এই কিশোররা তাই এই এসো নিজে করি ক্লাসটা চালু করে দুর্দান্ত একটা কাজ করে দিয়েছে। এটাই হতে পারে না? মুক্তির পথ। ভেবে দেখা দরকার কিন্তু খুব ভালোমতো। এভাবে আমরা সত্যিই প্রকৃত অর্থে দেশের মালিক হয়ে উঠতে পারব। বিশ্ববাসীও হয়তো এমন একটা মডেলের দিকেই চেয়ে আছে? হয়তো!

এগুলো সব কিছু ভাবতে আমরাও অংশ নেই না কেন রাজপথের পাঠশালায়? ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই হয়তো এখান থেকে শিখছেন। তবে মাঝেমধ্যে পড়া ভালোমতো করার জন্য গ্রুপ স্টাডি খুবই জরুরি। শিক্ষার্থীদের, ছোট ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েদের বলি যে, তোমরা আমাদের একটু জায়গা করে দাও না! আমরা একটু গ্রুপ স্টাডি করি?

গভার্নমেন্ট ভায়োলেন্স, শিল্পী: দানিয়েল মেদিনা, সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা শিশুদের কল্পনার হাতে 

আপনার বাচ্চাটার মুখে যখন আধো আধো বোল ফোটে, তখন কী আপনি বুঝতে চেষ্টা করেন না যে, সে কী বলতে চাচ্ছে? কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? We Want Justice বলে তারা গলা ফাটাচ্ছে। মার খাচ্ছে। মাথা ফাটাচ্ছে। কী তাদের জাস্টিস? বুঝতে চান না কেন আপনারা?রাজপথে-রাজনীতির ময়দানে তারা তো সেই আধো আধো বোল ফোটা শিশুর মতোই। আপনারা তো অনেক বয়স্ক। অনেক পরিপক্ক। আপনাদের কত কত বছরের সব গৌরব আছে। রাজপথ-রাজনীতির দাবায় চাল কী আপনারা কম দিন ধরে দিচ্ছেন! কত কত সব মহান অর্জন-অভিজ্ঞতা আপনাদের! সেই তুলনায় এরা তো একেবারেই ছোট্ট শিশু। তো, তাদের ভাষাটা বোঝার চেষ্টা করছেন না কেন? কী বলতে চাইছে তারা প্ল্যাকার্ডগুলো দিয়ে? কী চাইছে? কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?বোঝার চেষ্টা আমরা করছি না। কারণ আমরা পরিবারে একটা শিশুর সঙ্গে যা করি, এই রাস্তাতেও ঠিক তা-ই করছি। শাসাচ্ছি। ভয় দেখাচ্ছি। জোর করছি। নানাবিধ জুজুর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিচ্ছি তাদের মনে। মাঝেমধ্যে আদরও করছি। চকলেট দিচ্ছি। এটা-ওটা কিনে দেওয়ার, করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ভুলাচ্ছি। ছেলেভোলানো! ব্যক্তিগত জীবনেও এই জিনিসই করি না আমরা? নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী চালাই না বাচ্চাদের? চাই না আমরা, আমাদের ছেলে-মেয়েরা এটা করুক, ওটা করুক! এটা হোক-সেটা হোক! সেটা কতটুকু তার জন্য? আর কতটুকু আমাদের নিজেদের জন্য? আমরা চাই ওরা এটা-ওটা হোক, অনেক সাফল্য পাক যেন আমাদের নিজেদের মুখ উজ্জল হয়। সোসাইটিতে গর্ব করতে পারি। এজন্যই তো, নাকি? পাশের বাসার ছেলেটা বা মেয়েটা আমারটার চেয়ে ভালো কিছু করে ফেললে মুখ দেখাবো কী করে? ভাবি না, আমরা? আমরা কখনো ভাবি যে, আমাদের সন্তানেরা কী চায়? ওর সেটা ভালো লাগছে কিনা? ও আনন্দে আছে কিনা? ভাবি? ভাবি না। তো, সেই এক জিনিসই তো ঘটে চলেছে রাস্তায় এখন। রাজনীতির মাঠের জাঁদরেল-পাকা-ঝুনাদের কাছে নাজেহাল হচ্ছে বাচ্চারা। নোংরা-ঘিনঘিনে সব প্যাঁক কাদার মধ্যে পড়ছে তারা। মার খাচ্ছে, হেনস্তা হচ্ছে, কটু বিতর্কে জড়াচ্ছে। কেউ তাদের কথাটা কিন্তু বুঝতে চাইছে না। শুনতে চাইছে না। বাড়িতেও যা করা হয়, এখানেও তা-ই করা হচ্ছে। বাপমা বলে, আমি চাই তুমি এটা হবে। আমি চাই তুমি এটা করবে।

রাস্তাতেও একই ব্যাপার। ছেলেমেয়েদের নসিহতে ব্যস্ত সব্বাই। এটা করো, ওটা করো। পড়তে বসো, হাগতে যাও। ওটা করেছ কেন? সেটা করোনি কেন? অস্থির! এখন কেউ কী বলবেন যে, বাড়ির সঙ্গে এই রাজনীতি-রাস্তা মেলানো ঠিক হচ্ছে না? বইলেন না প্লিজ। দুইটা একই ব্যাপার। বাচ্চাদের আমরা এতদিন ঘরে যেভাবে ট্রিট করেছি এখন রাস্তাতেও সেভাবে করছি।

একটা ছোট্ট সিম্পল উদাহরণ দেই। অনেকেই ছোট-‘গুলগুলে’, ‘কিউট’ বাচ্চা দেখলেই গাল টিপতে লেগে যান। কখনো ভাবেন যে, এটা বাচ্চারা পছন্দ করছে কিনা? রাস্তায় আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, হঠাৎ বন্ধুর সঙ্গে আসা অপরিচিত কেউ আপনাকে ‘ওল্লে কিউট’ বলে গাল টিপতে লেগে গেল। কেমন লাগবে আপনার ভাবেন তো? আপনি বড়- সেজন্য আপনাকে করা যাবে না? ওরা ছোট- তাই করা যাবে? ওদের ভালো লাগে না এটা। খুব ব্যক্তিগত শিক্ষার মধ্য দিয়ে জানি। সুযোগ পেলে তারা বলেও দেয়, “গালে হাত দিও না! ও মাই গড!” দুই-আড়াই বছরের শিশু বলে এটা। নিজের চোখে দেখা-কানে শোনা।বাচ্চাদের আসলে আমরা মানুষ ভাবি না। বাচ্চা ভাবি। আমরা সব কিছুই ক্ষমতা-কর্তৃপক্ষের চোখে দেখি তো, ফলে তাদের পড়ানো শিক্ষায় আমরা বাচ্চাদের দুর্বল ভাবি। ছোট ভাবি। যাদের মাইর দিয়ে সাইজ করতে হয়। চকলেট দিয়ে ভোলাতে হয়। রাস্তাতেও তা-ই হচ্ছে। চকলেট দিয়ে ভোলানো হচ্ছে। এটা-ওটা দেখিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মাইর দিয়ে সাইজ করা হচ্ছে। নানা রকম ষড়যন্ত্র-গুজব-গজবের ফাঁদ বিছানো হচ্ছে তাদের সামনে।

মানুষ তা-ই দেখে, যা সে দেখতে চায়। আগে ঠিক করেন যে, কী দেখবেন। ষড়যন্ত্র-গুজবতন্ত্রের ছবি-ভিডিও দেখবেন? নাকি বাচ্চাদের প্রেম-ভালোবাসা, তাদের সৃজনশীলতা, তাদের কল্পনাশক্তি, তাদের ক্ষোভ-বিদ্রোহ, তাদের ফেটে পড়া, তাদের রক্তাক্ত হওয়া দেখবেন? এই স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা কী চায়, কী বলতে চায়—সেটা শুনবেন না? তাদের ভাষাটা বোঝার চেষ্টা করবেন না?

সিন্ধু নদীর তীরে এই উপমহাদেশের আদিতম বসতি হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর খোঁজ যখন পাওয়া গিয়েছিল- তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রত্নতাত্তিকরা। রাস্তাঘাটে, ঘরে-বাজারে; সব জায়গাতেই তারা পেয়েছিলেন মাটির বানানো বাঁশি। ছোট ছোট সব খেলনা। তারা বলেছিলেন, মনে হচ্ছে এটা যেন একটা শিশুদের নগরী। সব জায়গায় তারা খেলে বেড়ায়।

হাজার হাজার বছর আগেকার সেই সিন্ধু সভ্যতারই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি কিন্তু আমরা। যতই ইতিহাস ভুলে যাই না কেন- সেগুলোর বীজ মনে হয় থেকে যায়। মানুষ যেভাবে বাপ-মায়ের জীন বহন করে ঠিক তেমনই হয়তো। বংশগতিবিদ্যায় বলা হয় যে, কয়েক প্রজন্ম আগের কারো কোনো বৈশিষ্ট্যও অনেক সময় ঢুকে যায় বংশ পরাম্পরায়। সেগুলো প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। আর হুট করে সেটা প্রকটিত হতে পারে।

ইতিহাসের তেমনই কোনো সুপ্ত জীন কী এখন দেখা যাচ্ছে এই কিশোর বিদ্রোহে? এরা কী আবার সেই শিশুদের নগরী বানানোর ডাক দিচ্ছে? সেই হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো? তাদের কথামতো, চাওয়া মতো সব কিছু চললে তো খারাপ কিছু হয় না। দুর্দান্ত দুর্দান্ত সব ব্যাপারই ঘটে। দেখলাম আমরা এই কয় দিনে। বুঝতে পারছি কী তাদের চাওয়াগুলো? ইশারা-ইঙ্গিতগুলো?

একেবারে ছোট বয়সের স্মৃতি আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু সেই সময়েও তো মাথায় নানান চিন্তা খেলা করে। নানান কল্পনায় আচ্ছন্ন থাকে তারা। কী চিন্তা করে এক-দেড় বছরের আধো আধো বোল ফোটা শিশুরা? সেই সময়টায় তারা কত কিছু কল্পনা করে- আমরা জানি? জানার ইচ্ছা হয় না আমাদের? বুঝতে চান না কেউ? না। কিছুই জানতে-বুঝতে চাই না আমরা। শুধু বুঝি নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ। নিজেদের আরাম। নিজেদের ভালো-মন্দ। নিজেদের চাওয়া-পাওয়া। আর সেগুলোই চাপাতে থাকি বাচ্চাদের ওপর।

৫০ বছর আগে, ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্তের একটা কাব্যিক শ্লোগান ছিল, “সকল ক্ষমতা চাই কল্পনার হাতে”। ২০১৮ সালের কিশোর বিদ্রোহ সেই কথাটা বলে নি শুধু। কাজে-কর্মে বুঝিয়ে দিয়েছে। এদের অসাধারণ সৃজনশীল সব প্ল্যাকার্ড দেখে চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে। এরা কল্পনার শক্তি দিয়ে চলছে। সৃজনশীলতার শক্তি দিয়ে চলছে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, স্থান: রামপূরা ব্রিজ

আর এদের প্রতিপক্ষ কারা? যারা জীবনে মিথ্যাচার, দুর্নীতি-লুটপাট, লাঠিসোটা, গুলি-বন্দুক, ইভটিজিং-ধর্ষণ ছাড়া কিছুই বোঝেনি। একটা মোড়ে দাঁড়ায়ে জমা হয়ে, ‘উত্তর যুবলীগ, উত্তর যুবলীগ’ শ্লোগান দেয় ১৫-২০ মিনিট ধরে। নিজের চোখে দেখা। একজন বলছে উত্তর, ভেড়ার পাল চিল্লাচ্ছে, যুবলীগ। ১৫-২০ মিনিট ধরে চলছে এই একই জিনিস। আর কোনো কথা নাই। তো, এরা কী বুঝবে ওদের শ্লোগানের ভাষা-প্ল্যাকার্ডের ভাষা?

বুঝবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যরা কী বুঝবে না? বুঝতে চেষ্টা করবে না? এই স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলোর ভাষা? অনেক তো দেখলাম শাসক-শোষক। স্বৈরাচার, তত্ত্বাবধায়ক, সেনাবাহিনী, ভোটে নির্বাচিত সরকার, জোর করে নির্বাচিত হওয়া সরকার। সবই তো দেখলাম। কিছু তো বদলাইতে দেখলাম না। মানুষ যেরকম দুরাবস্থায় থাকে, তেমনই থেকে গেল। বরং অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপই হয়েছে।

সেই জায়গায় এই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। পথ দেখিয়েছে। কিভাবে সব কিছু লাইনে আনতে হয় দেখিয়েছে। আর এজন্য তাদের মার খেতে হয়েছে। তারা আর মারটা না খাক। এটা চাই প্রথমে। এই গত কয়েকদিনে রাস্তার পাঠশালায় তারা যে, শিক্ষাটা নিয়েছে- এটা তো থাকবে তাদের মগজে। স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতার এই পাঠ তো সঞ্চয় করেছে তারা অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।

এর ধাক্কা শুধু সরকার কেন, বাপ-মা-রাও সামলাইতে পারে কিনা, দেখার বিষয়। ঘরেও তারা যদি বিদ্রোহের ঘোষণা দেয়- অভিভাবকদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে, তাহলে কিন্তু মুশকিল আছে। বাপ-মারা কুল পাবেন না। সত্যিকার অর্থে, একদম আক্ষরিক অর্থে “গৃহযুদ্ধ” শুরু হয়ে যেতে পারে।

রচনাকাল: ৩–৫ আগস্ট, ২০১৮

  • [প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল অরাজ-এ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *