করোনা মহামারী: ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রের, ডিহিউম্যানাইজ করে মোকাবিলা সম্ভব না

  • লেখক: নিশাত জাহান নিশা

গত ২২ মার্চ রাতে আমার চাচাতো ভাই মারা গেছেন। ২৩ তারিখ জোহরের নামাজের পর তার জানাজা হয়েছে। আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের লোকজন সবাই এসেছেন। গাদাগাদি করে তারা দেখেছে, কথা বলেছে, ছোঁয়াছুঁয়ি তো আছেই, সর্দি, কাশি আছে এমন মানুষও কম আসে নাই। জানাজায় কম করে হলেও হাজার মানুষ তো হয়েছেই। এমন না যে, আমি বা আমাদের পরিবারের মানুষ করোনা নিয়ে সচেতন নয়। কিন্তু একদম কাছের মানুষের মৃত্যুতে এসব বিধিনিষেধ মানা সম্ভব হয় না। কাছের মানুষকে জড়িয়ে না ধরে দেওয়া যায় না, দিতে পারি নাই আমরা। জানি না ওখানে করোনা আক্রান্ত কেউ ছিলো কি না। জানি না, আমরাও কেউ আক্রান্ত কি না। এসব লিখছি কয়েকটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে।

১. বাংলাদেশে কত কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ, কত কোটি মানুষ ছিন্নমূল, বস্তিবাসী সে হিসাব আমি দিতে পারবো না। তবে এদেশের নিম্নআয়ের মানুষের জীবন আমি কাছ থেকে দেখেছি, দেখি, দেখতে হয়। একটা ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকে সবাই, ঘরগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। বাথরুম বলতে যা আছে কয়েকটা স্লাব বসিয়ে চাটাই বা বাঁশের বেড়া, অনেকের তাও নেই। পুরো বাড়ির মানুষজন ঐ একটা বাথরুম ব্যবহার করে, কোথায় গোসল করে, কি খায়, কেমনে খায় কোনো ঠিক নাই। আয়ের কোনো নির্দিষ্ট উৎস নাই, আজকে কি খাবে তার নিশ্চয়তা যাদের নেই, কালের চিন্তা তারা করবে কি করে? সাবান কেনা তাদের কাছে বিলাসিতা। এরকম মানুষের সংখ্যাটা কয়েক কোটির কম হবে না।

২. এদেশের কয়েক কোটি মানুষের শিক্ষার সাথে যোগ নাই। কয়েক কোটি মানুষ শিক্ষিত বলতে প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়েছে বা মাধ্যমিক। কিন্তু আপনি কি হলফ করে বলতে পারেন, আপনার শিক্ষাব্যবস্থা আপনার মাঝে স্বাস্থ্য-সচেতনতার বিষয়গুলো জাগাতে পেরেছে? খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েরাও তো বাসায় আসার আগে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন, ঘুরে বেরিয়েছেন, স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করেছেন। আপনাদেরও তো সচেতন হতে সময় কম লাগেনি। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠী যাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা, সচেতনতার ব্যবস্থা এই রাষ্ট্র করতে পারে নাই, তাদের সংখ্যাটা কত ভাবেন তো?

৩. আমাদের দেশের মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস আঁকড়ে বাঁচে। কিন্তু কেনো, সেটা জানেন তো? কারণ এছাড়া তাদের কাছে আর উপায় নাই। সে দেখে তার জীবনের হাজারটা সমস্যা, রোগ-শোক থেকে বাঁচার মত কোনো উপায় তার নাই। এক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করা ছাড়া আর কি উপায় আছে তার?

৪. এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানেন তো সবাই। খোদ জেলা শহরের চিকিৎসাব্যবস্থার যে বেহাল দশা, সেখানে গ্রাম-উপজেলার মানুষের কথা ভাবা যায়? এদেশের কয়েক কোটি মানুষ এখনো অসুস্থ হলে ডিসপেনসারিতে সিম্পটম বলে ঔষধ খায় কারণ ডাক্তারের যে ভিজিট (৫০০/৬০০এর কম নয়) তা দেওয়া তাদের কাছে বিলাসিতা। একেবারেই কোনো উপায়ান্তর না থাকলে মানুষ হাসপাতালমুখী হয়, এতটাই বেহাল দশা হাসপাতালগুলোর।

এরকম একটা দেশের মানুষকে এই ভয়াবহ মহামারি নিয়ে সচেতন করতে, মানুষকে এথেকে বাঁচাতে সরকারের ঠিক কতদিনের, কত ভালো পরিকল্পনার দরকার ছিলো ভাবেন তো? সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কি করা হয়েছে, কতটুকু হয়েছে, এখনও কি করা হচ্ছে? একটা ব্যাপার তিতা হলেও সত্য, সাধারণ মানুষ এক্টিভিস্টদের লেখা পড়ে না, শোনে না, বোঝে না। তারা শোনে মূলধারার মিডিয়ার খবর। অনেকের সে বালাইও নাই। তাই এক্টিভিস্টদের বার্তা তাদের কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছায় সরকারের দেওয়া অভয়বাণী, “দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। আমাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে।” আমি জানি, আমার এই লেখার দুপয়সা দাম নাই। কিন্তু একথাগুলো বলতে হলো, কারণ অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে মানুষকে গালাগাল করছেন ঠিক সেইভাবে যেভাবে ব্রিটিশরা আমাদের করতো, যেভাবে এখনো পশ্চিমরা, আমাদের করে। উদ্বিগ্ন হয়ে একটা ছোট্ট ব্যাপার যাতে না ভুলে যান, আপনি আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে যেভাবে মানুষকে ডিহিউম্যানাইজ করছেন, অন্যজনও তার দৃষ্টিকোণ থেকে আপনাকে ডিহিউম্যানাইজ করছে। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায় মানুষের ওপর চাপিয়ে মানুষকে ডিহিউম্যানাইজ করাটা অন্তত বন্ধ করি! এই দুর্যোগ আমাদের সবার, ডিহিউম্যানাইজ করে এটা মোকাবিলা সম্ভব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *