করোনা, সিস্টেমের গলদ এবং ব্যক্তির উদ্বেগ

  • লেখক: সহুল আহমদ

কবি মোস্তফা হামেদী তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘গ্রামের মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভাবতেছে। আর সেখানে ইন্টারনেট কাজ করে খুব সামান্যই। ফলে ফেসবুকীয় সতর্কতা লোকের কানে পৌঁছাইতেছে না। সবকিছু আগের মতোই আছে। যেহেতু ওষুধ নাই, প্রশাসনিক তৎপরতা তাদের পর্যন্ত যাইতেছে না, সে কারণে ধর্মীয় ও ভেষজ দাওয়াই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতেছে। শুধু গালি দিয়া, ট্রল কইরা আপনি তাদের ঘরে ঢুকাইতে পারবেন না। কাছে গিয়া বুঝাইতে হবে তাদের।…’

গত এক সপ্তাহ ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রাম আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আমার উপলদ্ধিও মোস্তফা হামেদী ভাইয়ের মতো। মধুখালীতে চা খাওয়ার সময় একজন চা’ওয়ালাকে বলেছিলাম, চাচামিয়া একটু সাবধান থাইকেন। মাস্ক-টাস্ক পইরেন। আপনি তো সহজে দোকান বন্ধ রাখতে পারবেন না, না খাইয়া মরতে হইবো। তাই আপনি একটু বেশি সাবধান থাইকেন। চা’ওয়ালা চাচা মিয়া মাঝবয়সী; করোনার হালচাল নিয়ে কথা হলো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর তিনি বললেন, ওয়ান-টাইম কাপে চা বেচলেই বোধহয় ভালো হয়, চা নিয়েই মানুষ চলে যেতে পারবে, আড্ডা জমবো না। আলাপকালে তিনি বারেবারে বলতেছিলেন, অবস্থা যদি খারাপ হয় তাহলে প্রশাসন কেন এখনো কিছু জানাচ্ছে না তাদের!


দেশের মানুষদের ‘গাধা-মূর্খ-অশিক্ষিত-ক্ষেত’ ও ‘গুজবপ্রিয়’ যাই বলেন না কেন, অনেকেই কিন্তু বলাবলি করতেন, ১৭ মার্চের আগে ‘ওরা’ কিছুই করবে না। চায়ের টঙ থেকে শুরু করে অটো-চালক অনেকের মুখেই শুনেছি। কখনো তাদের সাথে মাথাও নাড়িয়েছি। বাস্তবে কিন্তু তাই ঘটেছে। ১৭ মার্চের পর আমাদের মহোদয়রা কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। ‘গুজবপ্রিয়’ এই মানুষদের আরেকটা আন্দাজ আছে, ১৭ মার্চের বিদেশি মেহমান সমেত অনুষ্ঠানটা সরকার স্থগিত করে নাই, আসলে মেহমানরাই আসতে চায় নি। করোনার দেশে কে আসতে চাইবে? তাও আবার গণ-সমাগমে। তাদের এই আন্দাজও যথেষ্ট লজিক্যাল।


আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা সারাবছর ‘কেন উনাকে চেয়েছি’, ‘উনি-ই সব’ ইত্যাকার লেখা জন্ম দিয়েছেন তাদেরকে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানের উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে কোনো কথাবার্তা কইতে দেখলাম না। কেউ তাদের ‘প্রিয়’ নেতাকে এই উপদেশটাও দিলেন না যে, এমন সময়ে আতশবাজি ফুটিয়ে আসমান-জমিন লোকে-লোকারণ্য করে ফেললে দেশের মানুষের যে কতটা ক্ষতি করা হবে! এই অনুষ্ঠানের রেষ একেবারে গ্রামেও পৌঁছেছে। সেদিন এক গ্রামের ভেতর ছিলাম, কথা বলছিলাম কয়েকজনের সাথে। হঠাত করে বললেন, বাবা ৭ টা হয়ে যাচ্ছে, কেক কাটার প্রোগ্রাম আছে আজকে। স্থানীয় অফিসগুলোতে বিরাট বিরাট আড্ডা বসেছে। আজকে আমাদের জাফর স্যারের কলাম পড়লাম, তিনি বরাবরের মতো ‘আমি বিশেষজ্ঞ নই’ বলেই লেখা শুরু করেছেন, এবং বেশ সুন্দর সুন্দর উপদেশও দিয়েছেন। তিনিও বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অসংখ্য অনুষ্ঠান কোনও ভাবাবেগ ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি অনেক বড় দায়িত্বশীল একটি ঘটনা।’ স্যারের অনেক আগে একটা লেখায় পড়েছিলাম তিনি টিভি দেখেন না, ফেসবুক চালান না। ধরে নিলাম এই না-দেখা বা না-চালানোর জন্যই তিনি ‘আতশবাজি’ বা ‘জনসমাগম’ কিছুই দেখেন নি।


একটা ভিডিও দেখেছি, সাধারণ মানুষ বলছেন, করোনা আর কি করবে, আমিই তো করোনা!/ তেল মবিল সবই ডেইলি ভিতরে ঢুকে করোনা আর কি ক্ষতি করবে?/ আল্লা আছেন করোনা কিছুই করবে না। যারা কথাগুলো বলেছেন তারা হচ্ছেন আমাদের ‘আমজনতা’, রাষ্ট্র যাদের অধিকাংশের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু, তাদের এই বক্তব্যের সাথে আমাদের নেতামহোদয়দের বক্তব্য – শেখ হাসিনা নামাজ পড়েন, করোনা কিছুই করতে পারবে না, করোনা সর্দি-কাশির মতো সাধারণ জিনিস’- এর সাথে কতটা ফারাক? বলেন? নেতাদের অনেকেই তো মহাপণ্ডিত, ডিগ্রিধারী। দেশের নেতাদের যদি এই হাল হয়, সেই দেশের সাধারণ আমজনতাকে নিয়ে ট্রল করার ফায়দা কি? বরঞ্চ, সাধারণ মানুষ বলছে তাঁর সরলতা ও এতদিনকার বোঝাপড়ার জায়গা থেকে। সে দেখেছে বিপদে-আপদে কেউই তাঁর পাশে নাই, এমনকি রাষ্ট্রকেও পায় না। তার কাছে তো বিপদের উদ্ধারকারী কেবল আল্লাই। উলটো আমাদের নেতারা উচ্চশিক্ষিত, আপনি নিশ্চিত থাকেন তারা নিজেদের জন্য ঠিকই সুস্থ পরিবেশ তৈরি করছেন, তারা তাহলে কেন এমন জবানে কথা বলছেন? কারণ, এইটাই তাদের রাজনীতি। আমাদের নেতা ও হুজুর, যারা আপামর জনসাধারণের মাথার উপর বসে আছেন, স্কুল শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষা, যে শিক্ষাতেই তারা শিক্ষিত হোন না কেন, এমন ‘মিথ্যাচার’ আসলে তাদের রাজনীতিরই অংশ। অবশ্য, নেতারা তো এমনই বলবেন; তারা তো আর জনগণের রায়ে নির্বাচিত নন। জনগণের প্রতি তাদের দায় না থাকাটাই স্বাভাবিক।


বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ডাক্তার, ব্যাংকার, সাংবাদিক যে যেই প্রফেশনেই আছেন, সবার মুখেই আতঙ্কের কথা শোনা যাচ্ছে। সাংবাদিকরা বলছেন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন, তথ্য সাপ্লাই দেব। সেদিন বন্ধুতালিকার একজন ডাক্তারবন্ধু লিখেছেন, হাসপাতালে রাতের ডিউটি পড়ছে এখনো নিরাপত্তার সরঞ্জাম তাঁর কাছে সরবরাহ করা হয় নি। ব্যাংকার বন্ধুরা ফোন দিয়ে বলতেছে, তারা খুব অনিরাপদ অবস্থায় অফিস করছেন। এতদিন সময় পাওয়ার পরও কোনো সরঞ্জাম যোগাড় করা থেকে শুরু করে কোনো ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয় নি। এমনকি সচেতনতামূলক কোনো ক্যাম্পেইনও নেয়া হয় নি। এই কথাগুলো কট্টর লীগ পন্থী ভাই-ব্রাদাররাই বলছেন। আপনি জানেনই তো, আপনার দেশের বিরাট একটা অংশ মানুষ প্রবাসে আছেন। সেখানকার অবস্থা খারাপ হলে তারা দেশে ব্যাক করবেন বা করার চেষ্টা করবেন এতো জানা কথাই। কেন প্রস্তুতি সেই আকারে নেয়া হয় নি? এইসব কোনোকিছুর দায় কোনোভাবেই জনগণের নয়, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের।


আমরা যারা প্রগতিশীল তারা বরাবরের মতো ‘গুজব’ নিয়ে আতঙ্কে ভুগতেছি। কিন্তু কোন পরিবেশে গুজব হাওয়ার বেগে রটে, কোন পরিবেশ কখন গুজব-উর্বর হয়ে উঠে সে বিষয়ে তারা আলাপ আগে বাড়ান না। কিছুদিন আগে ইকোনমিস্ট বলছিল, করোনা মোকাবেলায় নেতার বিশ্বস্ততা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; জনগণ নেতাকে বিশ্বাস করে কি না! যদি নেতাদের প্রতি অবিশ্বাস থাকে এবং নেতারা যদি ক্রমাগত অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন তাহলে ‘গুজব’ মারাত্মক আকার ধারণ করে। যে দেশ গত কয়েকবছর যাবত চলছে ‘নির্বাচনহীন’ প্রতিনিধি দ্বারা, তাদের কথা মানুষ কেন বিশ্বাস করবে? কীভাবে বিশ্বাস করবে? বরঞ্চ, তারা কিছু বললে মানুষ উল্টোটাই করতে পারে! অবাক হবো না। এই দেশের মানুষ ‘গুজবপ্রিয়’ এটা বলার পূর্বে মানুষ কেন ‘গুজব’প্রিয় হয়ে উঠলো সেই প্রশ্ন করা দরকার। তাহলে দেখবেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়গুলোর গুরুত্ব টের পাওয়া যাবে। কেবল ‘করোনা’ নিয়েই নয়, যে কোনো ঘটনাতেই বাংলাদেশে গুজব হাওয়ার চেয়ে বেশি বেগে রটবে।


অলরেডি একটা বিষয় পরিষ্কার, বাংলাদেশে করোনার চেয়ে ‘করোনার আতঙ্ক’ বেশি ভয়ের। করোনা সন্দেহে রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না, রোগী মারা যাচ্ছেন। কি এক অদ্ভুত ভূতুড়ে অবস্থা! আমি ডাক্তারদের দোষ দিছি না। ডাক্তার-নার্সদের সেফটি দরকার সবার আগে। এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা গভীরভাবে একজায়গায় আটকানো: সিস্টেম। এইরকম একেকটা বিষয় আসে, সিস্টেমের গলদ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই সিস্টেমকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে হবে। এখানে লীগ-দল-হেনতেন কিছুই বিষয় না। সিস্টেম এবং মাথার উপরের ক্ষমতাকে ক্রমাগত ক্রিটিসাইজ করতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে। আমাদের বাঁচার তাগিদেই। না হলে, বারেবারে আমাদের উপর বিপদ আসবে, সেই বিপদকে উছিলা করে ‘উনারা’ ফায়দা লুটবেন: যেমন অর্থনৈতিক ফায়দা, তেমনি রাজনৈতিক ফায়দা।


সমাজ এখনো জেগে আছে। অনেকেই (যেমন, ছাত্র ইউনিয়ন) স্যানিটাইজার বানিয়ে বিতরণ করছেন। অন্যরাও অনেকভাবে সক্রিয় আছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু এই কয়দিন কয়েকটি গ্রামাঞ্চল ঘোরার ফজিলতে মনে হইলো, এই প্রচেষ্টাগুলো খুব অপ্রতুল।


আমার ঘরের একেকজন একেক দেশে। ছোট ভাই-কাজিন-স্বজনরা মিসর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি, মালোয়েশিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সবাই একেক দেশে বন্দী হয়ে আছেন। আমরা টেনশন করি তাদের জন্য, তারা টেনশন করেন আমাদের জন্য। মানসিকভাবে সবাই একটা প্রেসার বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে, অনেকেই এই অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন।

১০
আমাদের জেগে থাকতে হবে। সামনে আরো বিপদ আসবে। করোনা ভালো ধাক্কা দিয়ে যাবে। একসাথেই মোকাবেলা করতে হবে। এবং, অতি অবশ্য বর্ণবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এটা করোনার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *