- লেখক: রাখাল রাহা
আন্দোলন করে এখন আমরা আসলে কি চাই? এবং কেমন করে তা পেতে পারি?
এই দুইটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে স্পষ্ট না হলে, আর মানুষের কাছে স্পষ্ট করে না তুলতে পারলে আমাদের ছাত্র-জনতার সকল আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে, কিংবা দেশ আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে।
খেয়াল করি, পাকিস্তান আমলে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য ৬ দফা দাবী দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। এর জন্য বলেছিলাম, নির্বাচন দাও, আমরা স্বায়ত্তশাসনের সংবিধান ও আইনকানুন বানাবো। না দেওয়ায় আমরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭০ সালে নির্বাচন আদায় করেছিলাম এবং বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সংবিধানসভাকে যেহেতু আর বসতে দেওয়া হলো না, তাই যুদ্ধ করে আমরা দেশটা স্বাধীন করেছিলাম।
ব্রিটিশ আমলে আমরা জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে মুক্তির জন্য লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। সেই রাষ্ট্র কেমনভাবে চলবে তা নির্ধারণের জন্য ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচিতদের সংবিধান বানানোর ক্ষমতাও আমরা দিয়েছিলাম। সেখানেও আমরা বিপুলভাবে ভোট দিয়ে পাকিস্তানের মতো এমন অকল্পনীয় রাষ্ট্র-প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের পর আর সেই সংবিধানের অগ্রগতি হলো না, ফলে ২৩ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার ফয়সালা হলো।
১৯৯০ সালেও আমরা ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সামরিক স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা চেয়েছিলাম এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করেছিলাম, যা ২০১৩ সালে একপদকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো আদালতের উপর হস্তক্ষেপ করে তা বাতিল করে দিয়েছে।
এখন আমাদের চাওয়াটা কি এবং তা পাওয়ার পথই-বা কি?
আমাদের চাওয়া খুব স্পষ্ট। আমরা একপদকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন, সাংবিধানিক পদগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন, জনগণের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহারকারীদের জবাবদিহি এবং দুর্নীতি ও জুলুম-অবিচারের উৎস নির্মূল করতে সংবিধান ও আইন-কানুন সংশোধন করতে চাই এবং এর জন্য সংবিধান সংশোধন-সভার নির্বাচন চাই।
কিন্তু যেখানে বলা হয় সংবিধান অনেক ভালো, আইন অনেক ভালো, মানুষ খারাপ, সেখানে আমরা এগুলো কেন সংস্কার করতে চাই?
খেয়াল করি, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সভার নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীরাই স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান সভায় বসে ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানটি পাশ করেছিলেন। সেই সংবিধানটি পড়লে আমরা এর দুইটি অংশ পাবো। একটিকে বলা যায় রাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-ঘোষণা অংশ (শুরু থেকে ৩য় ভাগ) এবং আরেকটাকে বলা যায় সেগুলো বাস্তবায়নের অংশ বা ক্ষমতাকাঠামো অংশ (৪র্থ থেকে শেষ ভাগ)। আমরা দেখবো এই সংবিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-ঘোষণা অংশে যা যা ভালো ভালো কথা লেখা আছে, ক্ষমতাকাঠামো অংশ দ্বারা তা পাওয়ার পথ সুকৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অথবা এমনভাবে সেগুলো সাজানো হয়েছে যাতে যিনি ক্ষমতার প্রধান হবেন, তা তিনি প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী যে নামেই হোন, তিনি চাইলে সেটা বন্ধ করে দিতে পারেন। এই সংবিধান অনুযায়ী, দেশ চলবে সংবিধান দিয়ে, কিন্তু সংবিধান চলবে সরকার-প্রধানের কথায়; সবাই সরকার-প্রধানের কাছে জবাবদিহি করবে, কিন্তু তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করবেন না। এমনকি মানুষ রক্ত দিয়ে সেই সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনলেও তা তিনি বাতিল করে দিতে পারেন, যেটা আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেখেছি।
এই যে একব্যক্তিকেন্দ্রিক, জবাবদিহিতাহীন সংবিধান, এর মাধ্যমে ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইনসহ প্রজাশাসনের সকল আইন, পাকিস্তান আমলের কালাকানুন সবই স্বাধীন দেশের নাগরিকের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিগত ৪৮ বছরে এই ক্ষমতাকাঠামো আর আইনকানুন অংশে কেউ তেমন কোনো পরিবর্তন করেনি, বরং আরো নতুন নতুন নির্যাতনমূলক আইন বানানো হয়েছে। এই ক্ষমতা-কাঠামোর পরিবর্তন নিয়ে, এমনকি জোরালো কোনো আলাপও করা হয়নি, বরং মাঝ থেকে সংবিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অংশ, যা জনগণের পক্ষে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেই অংশে কেউ কেউ নানা সময়ে বিসমিল্লাহ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে মুখরোচক আলাপের বিষয় হিসেবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের এ সংক্রান্ত তর্কবিতর্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার উপনিবেশিক কাঠামো ও আইনকানুন-বিচারব্যবস্থা যতক্ষণ বহাল থাকবে ততক্ষণ নিরপেক্ষ ভোট দিয়ে যাকেই আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতায় পাঠানো হবে সে-ই নাগরিকের সাথে রাজার মতো, বড়োজোর দলীয় প্রধানের মতো আচরণ করবে; সে-ই জুলুম-অবিচার আর লুটপাট করবে। এটা আমরা ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে দেখেছি।
তাহলে আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ধাপগুলো কি কি?
১. প্রথমে আইনকানুন-সংবিধানের কোথায় কোথায় সংশোধন এনে এই ক্ষমতা-কাঠামোর ন্যূনতম কি কি পরিবর্তন করতে চাই সে-বিষয়ে আমাদের মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২. এরপর এই অবৈধ সরকারকে পদত্যাগ করে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার নিকট গ্রহণযোগ্য মানুষের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করতে হবে।
৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সংবিধান-সংশোধন-সভার নির্বাচন দেবে।
৪. সংবিধান-সংশোধন সভায় নির্বাচিতদের প্রধান কাজ হবে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সংবিধান ও আইনকানুনের সংস্কার প্রস্তাব করে সেগুলো গণভোটে দেওয়া।
৫. গণভোটে বিজয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে গণক্ষমতাতন্ত্রী বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করবে।
অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বা দল পরিবর্তনের আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন ক্ষমতার উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে একটা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।