করোনা, ‘উন্নয়ন’, এবং কিছু প্রশ্ন

  • লেখক: মাহা মির্জা

ঠিকা বুয়াকে বাড়িতে আসতে মানা করে দিয়েছে নানু। বলেছে, এই মাসে তোমার ছুটি। মাসের শেষে বেতন নিয়ে যেও পুরোটা। আমি বললাম, শিরিন, খুব সাবধানে থাকবেন। হাত না ধুয়ে খাবেননা। বাচ্চারা যেন বাইরে না যায়। বলেই বুঝলাম, এইসব বোকার মতো কথা। রায়ের বাজার বস্তির একজন খেটে খাওয়া মানুষকে সাবধানে থাকতে বলাটাও একটা অদ্ভুত রসিকতা। শিরিনও হাসলো। বললো, আমাদের আর সাবধানে থাকা আপু। রোগ হইলে মরবো। আল্লাহ ভরসা।

কুড়িল বস্তির কথা মনে পড়লো। খালের পাড়ে সারি সারি বাঁশের ঘর। ঐটুকু জায়গায় কত মানুষ রোজ ঢোকে, বের হয়। গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ বাঁচে। ডাম্প করা ময়লার স্তূপে বাচ্চারা খেলে।

আরবান এলিটদের নাক সিটকানি দেখি আর অবাক হই। তারা উপদেশ দেয়, এই জাতি নোংরা, খারাপ, থুথু ফেলার হ্যাবিট। মানলাম। কিন্তু থুথুর মধ্যে, কফের মধ্যে, আপনার ইউরেনাল লাইনের উপরে, খোলা পায়খানার কয়েক গজের মধ্যে একটা মধ্য আয়ের দেশের কত লক্ষ মানুষ জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় বলেনতো?

এলিয়েন তো নয়, আপনারই সার্ভিস প্রোভাইডার। আপনার ঠিকা বুয়া, সিঁড়ি মোছার বুয়া, সকাল বেলার হকার। প্রতিদিন আলু টমেটো সরবরাহ করা ভ্যানওয়ালা। আপনার প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ডিশের লাইন ঠিক করতে আসা অল্পবয়সী ছেলেটা? কই থাকে? গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস দেয়া এতগুলো মানুষ কেন এমন গায়ে গা লাগিয়ে ইতরের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, এই প্রশ্নটা করেননা কেন? কারণ এই প্রশ্নটা করলে সিস্টেমে ধাক্কা লাগবে। আপনার পোষাবেনা।

আচ্ছা, এই প্রশ্নটা করেননা কেন, সামিট গ্রুপকে বসিয়ে বসিয়ে ২ হাজার কোটি টাকার বিল দেয়া যায়, এস-আলম গ্রুপের তিন হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স মওকুফ করে দেয়া যায়, কিন্তু সারাবছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা গার্মেন্টসের মেয়েগুলোকে স্ব-বেতনে ছুটি দেয়া যায়না কেন?

প্রশ্ন করেনতো, ঢাকা-মাওয়া রুটের নির্মাণ কাজে ইউরোপের ৩ গুন বেশি খরচ হয়ে যায়, অথচ একটা আইসিউ বেডের জন্যে, একটা ভেন্টিলেটরের জন্যে প্রতিদিন শত শত মানুষ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাগলের মতো ছোটে কেন? বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের ফ্লাইওভারের দেশে প্রতি ১০০০ জন রোগীর জন্যে মাত্র ১টা হাসপাতাল বেড কেন?

আমরা মজুদ করেছিলাম কমব্যাট ফাইটার্স, এয়ার মিসাইল সিস্টেম, মিগ ২৯। এখন আমাদের ফ্রন্ট লাইনের চিকিৎসকরা হাহাকার করছে, মাস্ক নাই, কিট নাই, বেড নাই, আইসিইউ নাই। প্রায় দুই মাসের মতো অমূল্য সময় পাওয়ার পরেও আমাদের হাসপাতালগুলো আনপ্রোটেক্টেড কেন? প্রয়োজনীয় গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার, আর টেস্টিং কিট মজুদ করা গেলোনা কেন?

প্রশ্ন করেনতো, রাশিয়ার সঙ্গে আট হাজার কোটি টাকার আর্মস ডিল করা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের বেহুদা লোকসান সামলাতে পাবলিক ফান্ড থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকিও দেয়া যায়, অথচ এমন ভয়ানক বিপদের দিনেও এই শহরের খেটে খাওয়া মানুষদের জন্যে ফ্রি তে চাল ডাল সরবরাহ করা যায়না কেন?


ঢাকার কয়েক লাখ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে এক মাসের রেশনের ব্যবস্থা করা জরুরি। ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকাগুলোতে ভ্যানে বা ট্রাকে করে ভলান্টিয়ার পাঠিয়ে সাবসিডাইজড মূল্যে/ বিনামূল্যে চাল ডাল লবন সরবরাহ করা শুরু করা দরকার। বাচ্চাদের দুইবেলা ভাতের এটুকু নিশ্চয়তা পেলেই শুধু মানুষ ঘরে থাকবে। সরবরাহের সময় সবাই যেন ঘরে থাকে সেটা মাইকিং করে বা অন্য কোনো উপায়ে প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। দরকার হলে আনসার বা বর্ডার গার্ডের সাহায্য নিতে হবে।

রাষ্ট্র চাইলে সব কিছু পারে। যথাযথ প্রটেকশন সহ ভলান্টিয়ার পাঠিয়ে বস্তির ঘরে ঘরে চাল ডাল তেল নুন পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে। ওয়াসার ট্রাক পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানিও সরবরাহ করতে পারে। রাষ্ট্র চাইলে লুটপাটের মেগা প্রকল্পগুলো বাতিল করে দ্রুততম সময়ে জেলায় জেলায় টেম্পোরারি হাসপাতালও বানাতেও পারে। ইটস এ ম্যাটার অফ পলিটিকাল উইল।

কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকার এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্যে বিনামূল্যে চাল বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা গরিব দেশ, সামর্থ্য নাই, এইসব ফালতু কথা শুনলে চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবেন। সোয়া এক লাখ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় নিউক্লিয়ার ডিল করতে পারে, ৩৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মাফ করে দিতে পারে, শেয়ারবাজার থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া পিএমের উপদেষ্টাকে বারবার কোটি টাকার সুবিধা দিতে পারে, সারাবছর উন্নয়ন উন্নয়ন করে বাঁদরের মতো লাফাতে পারে, তাহলে দুর্যোগের দিনে শ্রমজীবী মানুষকে বিনামূল্যে চাল দিতে পারবেনা কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *