ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন লড়াই।। দীপেশ চক্রবর্তী

  • তর্জমা: মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুম

[সম্পাদকীয় মন্তব্য: শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি তেহরান টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের এপ্রিলে। ইংরেজি শিরোনাম A conscious fight against colonial rule. দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি তর্জমা করেছেন মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুম। মাসুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী]

প্রশ্ন: অনেক উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখকেরাই তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ঔপনিবেশিক কাঠামো এবং ক্ষমতা-সম্পর্কগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকার উপর জোর দেন বিষয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনি কি মনে করেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান পশ্চিমা শক্তিগুলোর সুপরিকল্পিত চাল ছিল, যাতে করে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বহাল তবিয়তে বজায় রাখা যায় নতুন উপায়ে?

দীপেশ চক্রবর্তী: এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, যখন এমনকি আনুষ্ঠানিক ঔপনিবেশিক সম্পর্কের অবসান ঘটেছে, তখনো জনগণ ও জাতিসমূহের মধ্যে আধিপত্যের সম্পর্ক বহাল তবিয়তেই ছিল। উপরন্তু, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের নির্দিষ্ট কিছু সিলসিলা এখনো চলমান আছে, যদিও খানিকটা পরিবর্তিত রূপে। উদাহরণস্বরূপ, যেমন ভারত রাষ্ট্র মূলগতভাবেই বৃটিশদের তৈরি সরকার-কাঠামোর উপরই প্রতিষ্ঠিত। নাগা জনগোষ্ঠীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যদিও এতদিনে তাদের আত্মীকরণ করে নেয়া হয়েছে। ব্রিটিশদের স্থাপন করা কাঠামোর পাশাপাশি কাশ্মিরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভারতের বিভিন্ন সরকারের আনাড়ি হাতে পরিচালনা করাই মূলত কাশ্মির প্রসঙ্গে জটিলতাগুলোর জন্য দায়ী। প্রত্যেকটি আধুনিকায়িত রাষ্ট্র যেকোনো ক্ষেত্রেই শেষতক কোনো না কোনো গোষ্ঠীর সাথে সাম্রাজ্যবাদী/ঔপনিবেশিক সম্পর্ক চর্চাতে গিয়েই ঠেকে।

আমি মনে করি না যে, বিউপনিবেশায়ন কারও তরফ থেকে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল। ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন যে, ১৯৫০’র দশকে এমনকি ডানপন্থী চিন্তক ও রাজনীতিবিদরাও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সাম্রাজ্যিক শক্তি বিশ্বের জন্য কোনো সামষ্টিক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয় না; যে বিশ্বকে একত্র করার জন্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্য, পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তি এতকিছু করল। প্রথাগত সম্রাজ্যসমূহ তার সমস্ত ন্যায্যতা হারিয়ে ফেলেছে। যাই হোক, তারপরও এটা আমলে নিতে হবে যে, জাতিসংঘ ব্যবস্থা দাঁড় করানো হয়েছিল উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তর-সাম্রাজ্যবাদী এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের আধিপত্য চালিয়ে যাবে। শুরুতে এই ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সবই ছিল পশ্চিমা। এমনকি এও বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদ-পরবর্তী বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বৈশ্বিক আধিপত্যশীল ক্ষমতার যুগ শুরু হলো। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং বর্তমানে চীন ও ভারত— এরা প্রত্যেকেই এই বৈশ্বিক-আধিপত্যশীলতার তকমাটা পেতে চেয়েছে।

দীপেশ চক্রবর্তী

প্রশ্ন: অনেক উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখকই যুক্তি দেখান যে, আদি ও অবিকৃত প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় আপনি কি তাদের সাথে একমত? উদাহরণস্বরূপ, ভারত কি ব্রিটিশ উপনিবেশ পূর্ববর্তী সময়ের আদি ভাষা ও সংস্কৃতিতে ফিরে যেতে পারবে?

দীপেশ চক্রবর্তী: হ্যাঁ, আমি তাদের সাথে একমত। আধুনিকতা বেশ দুরূহ ও জটিল একটি শব্দ, কিন্তু এই আলোচনার সুবিধার্থে আধুনিকতাকে আমরা কান্টের জনপরিসরে যুক্তি প্রয়োগের ধারণাতেই সীমাবদ্ধ রাখছি। এখন একবার যখন আপনি আধুনিকতার ছাঁচে গড়ে উঠলেন, তখন প্রাক-আধুনিক সম্পর্ক ও ধারণাসমূহের উপর ভিত্তি করে একটি জনজীবন বা নাগরিক জীবন নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। ভারতে জাতপাতের ভিত্তিতে যেই জুলুম তার উদাহরণ দেয়া যায়। জাতপ্রথার অনেক সমালোচনা ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতেও ছিল। কিন্ত সেসব সমালোচনার বেশিরভাগই ছিল ‘ঈশ্বরের চোখে সকল মানুষই সমান’ এই ধারণার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু আধুনিক ভারতে তথাকথিত জাত-প্রথার সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী সমালোচনাই দাঁড়িয়ে আছে ‘আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সম-মর্যাদা’র ধারণার উপর ভিত্তি করে। আমি মনে করি না যে, সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ দাবি করবে যে আগিলা আমলের অনুমান আজকের দিনের জন্যও যথেষ্ট।

আপনি যদি বর্তমান আমলাতান্ত্রিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত চর্চার দিকে তাকান, দেখবেন যে, ভারতবর্ষের মানুষেরা মূলত ব্রিটিশদের আইন-কানুন ও চর্চাকেই রপ্ত এবং এখনো অনুসরণ করে চলেন। কিন্তু তাই বলে এটাও বলা যায় না যে, আমাদের সমস্ত ধারণা ও চর্চাকে একই মাত্রায় বা একইভাবে পশ্চিমিকরণ বা ইউরোপীয়করণ করতে হবে। আপনি যদি আমলাতান্ত্রিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত অভ্যাসগুলোর দিকে তাকান তাহলে দেখবেন ভারতীয়রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় রীতি ও অভ্যাসগুলোকে (এমনকি ইউরোপীয় কেতায় পোশাক পরাও) আয়ত্ত করেছে। কিন্ত আপনি যদি সংগীতের ভুবনে নজরে দেন, আপনি দেখবেন যে ভারতীয়রা সেখানে অনেক বেশি সার্বভৌমত্বের চর্চা করে। অন্যান্য সৃজনশীল কর্মের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার খাটে। যেমন: সিনেমা, পারফরমেন্স ও ভিজুয়াল আর্ট, কথাসাহিত্য।

প্রশ্ন: পশ্চিমে বসবাসরত একজন প্রাচ্যদেশীয় গবেষক হিশেবে, আপনি কি মনে করেন যে, আপনার একটা সংকর (হাইব্রিড) পরিচয় আছে? আপনি কি এই সংকরায়ন (হাইব্রিডিটি) স্বীকার করেন? নাকি মনে করেন, আমাদের সকলের উচিত স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিচয়য়ের উপর ভর করা?

দীপেশ চক্রবর্তী: আমার ভালো একজন বন্ধু হোমি ভাভার দাবি হচ্ছে যে, আমাদের প্রত্যেকেরই সংকর (হাইব্রিড) পরিচয় আছে। তিনি ‘সংকর’ (হাইব্রিড) কথাটাকে “অন্তরস্থিত বৈচিত্র্য”র নীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। যেভাবে কেবলমাত্র অন্য ভাষার উপাদান ধার ও আত্মীকরণের মাধ্যমেই, ‘অভ্যন্তরীণভাবে বহুত্বে’র বিকাশ ঘটিয়ে কোনো ভাষা “একক” ভাষা হিশেবে নিজের পরিচয়কে বিকশিত ও শক্তিশালী করে, ঠিক সেভাবে মানুষও অভ্যন্তরীণভাবে বহুত্ব (internal plurality) অর্জনের মাধ্যমে তার সমৃদ্ধ ও একক পরিচয়কে বিকশিত করে। আমার নিজের ভাষা বাংলা। যে ভাষায় ভারতে পশ্চিম বাংলার মানুষ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষেরা কথা বলে। আমি একে একক একটি ভাষা হিসেবেই দেখি। মুসলমান বাঙালিরা পাকিস্তানের সাথে লড়াই করে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে, আক্ষরিক অর্থেই যে ভূমিতে বাংলা ভাষায় কথা বলা হয়। কিন্তু সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, ইংরেজিসহ অন্যন্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে বিপুল পরিমাণে ধার করেই একটি ভাষা হিশেবে বাংলা বিকশিত হয়েছে। শুধু যে শব্দ ধার করেছে তাই নয়; বাগধারা, বাক্যাংশ এবং ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্যাবলিও গ্রহণ করা হয়েছে। আমি এতগুলো কথা বললাম শুধুমাত্র এটা বুঝানোর স্বার্থে যে, আমরা সকলেই সংকর পরিচয়ের সাথে সমঝোতা করি। মূলত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণেই, কখনো কখনো আমরা পরিচয়ের সংকর চরিত্রকে অস্বীকার করি। ঘটনাচক্রে, একজন ব্যক্তি একইসাথে স্থানীয় ও সংকর হতে পারেন। ওপরে ভাষা সম্পর্কে যা বললাম তাতে এটাই বুঝাতে চেয়েছি আমি।

প্রশ্ন: আশিস নন্দী বলেন, ‘উপনিবেশ হলো সর্বাগ্রে চেতনাগত একটা ব্যাপার এবং শেষপর্যন্ত মানুষের মনেই এর পরাজয় ঘটাতে হবে’ আপনি কী মনে করেন? কীভাবে আমরা দক্ষিণ গোলার্ধে মানুষের মনে উত্তর-ঔপনিবেশিক ক্রিয়াপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি? আপনি কি ক্ষমতা-সম্পর্কের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের প্রতিরোধের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী?

দীপেশ চক্রবর্তী: মনোজগতেই প্রথম উপনিবেশায়ন ঘটুক বা না ঘটুক—একজন ইতিহাসবিদ হওয়ার কারণে এমনসব ঘটনাবলীর মধ্যে আমি অধিকাংশ সময়ই ঔপনিবেশিক শাসনের একাধিক বা অনিশ্চিত সব উৎস দেখতে পাই যেগুলোর সাথে বাধ্যতামূলকভাবে কোনো ঔপনিবেশিক নীলনকশার সম্পর্ক থাকতেই হবে তা কিন্তু নয়। একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর নিশ্চিতভাবেই জনগণের মনে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেই তা কার্যকর হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাই সচেতন কোনো সংগ্রামের শুরুই হয় এর ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর তাই হচ্ছে জনগণের মনোজগতের লড়াই। এই অর্থে নন্দী অবশ্যই ঠিক বলেছেন।

নিম্নবর্গের প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী, নিজের বাস্তবজ্ঞান বিসর্জন না দিয়েই। কিন্তু এটি সরল কোনো প্রশ্ন নয়। ধ্রুপদী শ্রমজীবী শ্রেণি, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থেকে শুরু করে কুইয়্যার, প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য নিম্নবর্গীয় গোষ্ঠীর দাবিদাওয়াকে গত শতাব্দীর তুলনায় বিশ্ব এখন অনেক বেশি স্বীকৃতি দেয়। এসব দিক বিবেচনা করলে নিম্নবর্গের প্রতিরোধ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কিন্তু গায়ত্রী স্পিভাক তার যুকান্তকারী রচনা Can the Subaltern speak-এ যে শিক্ষা তুলে এনেছেন তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এমনকি যখন ক্ষমতার মূল কাঠামো ও যোগসূত্রগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে তখনো নিম্নবর্গের প্রতিরোধকে সেই একই কাঠামো ও যোগসূত্রের মধ্য দিয়েই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে হয়, যার বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এটা ভাবা ঠিক হবে না যে নিম্নবর্গীয় প্রতিরোধ মানেই দুনিয়াকে চিরতরে উল্টেপাল্টে দেয়া। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বক্রমের প্রশ্ন ঠিকই বিরাজ করে। নিম্নবর্গের অধ্যয়নের গুরু রণজিৎ গুহ তার ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ধ্রপদী কিতাব Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India-তে এ প্রসঙ্গটিই তুলে এনেছেন। ‘নিম্নবর্গের অধ্যয়ন’ সিরিজ যেই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছিল এই বইটা তার একটি আকর গ্রন্থ। সুতরাং, অবশ্যই নিম্নবর্গীয় প্রতিরোধ সবসময়ই মঙ্গলজনক ও দরকারিও; কিন্ত আমাদের এটা ভেবে বিভ্রান্ত হলে চলবে না যে, একসময় মার্ক্সবাদী বিপ্লবের ধারণা যেই মুক্তির কথা বলত, এই প্রতিরোধের ফলে তেমন কোনো মুক্তির আগমণ ঘটবে। ফুকো ও দেরিদার আয়াসসাধ্য অন্তর্দৃষ্টির কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে, উত্তর-উপনিবেশবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করে নিয়েছে? নাকি আপনি এই বিষয়ে একে অপেক্ষাকৃত নতুন আমদানি হিসেবেই দেখেন, যা কিনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে একটি পাদটীকা হয়েই রয়েছে এই তত্ত্বের ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত কী হবে বলে আপনি মনে করেন?

দীপেশ চক্রবর্তী: আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ নই। কিন্তু উত্তর উপনিবেশবাদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অনুষ্ঠিত বেশকিছু আলোচনার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আমি বলব যে এ বিষয়ে আগ্রহের কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে একটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে কিন্তু তারা এখনো মূলধারা হয়ে উঠতে পারেনি। আর আমার কাছে মনে হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের “মূলধারা”-তে এখনো তথাকথিত বাস্তববাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য বজায় আছে। এর কারণ হচ্ছে, মূলধারার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমনকি একটা বিকল্প বিশ্বের কথা কল্পনা করারও চেষ্টা করে না। এটি সকল অর্পিত ক্ষমতাসম্পর্ককেই স্রেফ অবধারিত হিসেবে ধরে নেয়, এবং এর উপর ভিত্তি করেই দুনিয়ার ভবিষ্যতকে বিবেচনা করার চেষ্টা করে। সেকারণেই একটি বিকল্প বিশ্ব কল্পনা করার উপায় ও পদ্ধতি মূলধারার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের হাতে নেই। যেসমস্ত বাঁকবদল ও সংকট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি যতটুকু স্বীকার করে নেয় তার বাইরেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে, সে সমস্ত বিষয়গুলো এর আওতার বাইরেই থেকে যাবে।

সে কারণেই, যেমন ধরুন, যেসব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক গ্রহীয় (planetary) জলবায়ু সংকটের প্রশ্নটাকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নিবে, তারাও এই শাস্ত্রে মূলধারার বেশ বাইরে পড়ে রয়েছে। একইভাবে, বিশ্বের ক্ষমতাধর জাতিগুলোর যে আধিপত্য, যাকে কিনা “বিশ্বব্যবস্থা” বলা হচ্ছে, এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে একে যত শক্তিশালী ব্যবস্থাই মনে হোক না কেন, এর গুরুতর সমালোচনা দিয়েই উত্তর-উপনিবেশবাদী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তার আলোচনা শুরু করে। বর্তমান পরিস্থিতিকে কোনভাবেই বিশ্বের স্থায়ী অবস্থারূপে ভাবার সুযোগ নেই উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তার। তার নিজের চরিত্র ও এর বুদ্ধিবৃত্তিক অনুমানগুলোর কারণেই, উত্তর-উপনিবেশবাদী আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও ন্যায্য ও জাতিগত বিশ্বের বিকল্প একটি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। সেই কারণে আমার আশঙ্কা, বর্তমান চীন-মার্কিন আধিপত্যের অধীন বিশ্বব্যবস্থা যতদিন বিরাজ করছে, ততদিন উত্তর-ঔপনিবেশিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রান্তেই পড়ে থাকবে। কিন্ত সেটা হয়তো এতটা খারাপ কিছুও না। প্রান্তে অবস্থান করার কারণে আপনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সজাগ থাকবেন, এবং এর ফলে আপনার বিশ্লেষণী শক্তি পাবে প্রাণবন্ততা, যা কিনা সবসময়ই মূলধারার আত্মতুষ্টি থেকে আপনাকে দূরে রাখে।

প্রশ্ন: আপনি উত্তর-উপনিবেশবাদী চর্চায় প্রথম ‘ইউরোপের প্রাদেশিকীকরণ’ (provincializing Europe) কথাটি প্রস্তাব করেন আবার এই নামে আপনার একটি বইও আছে আপনি আসলে এই কথার দ্বারা কী বুঝাতে চান?

দীপেশ চক্রবর্তী: আপনি আমাকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে বলছেন যে, ‘ইউরোপের প্রাদেশিকীকরণ’ কথাটি আমি কোন অর্থে ব্যবহার করেছি এবং ‘প্রাদেশিকীকরণ’-এর কাজটির আসলে মানে কী। আমার কাছে ইউরোপকে ‘প্রাদেশিকীকরণ’ করার মানে ছিল বেশ ভেবেচিন্তেই একটা স্ববিরোধী পদক্ষেপ নেয়া। আমিই প্রথম ব্যক্তি নই যে এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। আমার আগে অন্যান্য উত্তর-উপনিবেশবাদী চিন্তকেরাও নিজের অবস্থান ব্যক্ত করার জন্য এমন স্ববিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন। দ্যু বইজ (Du Bois) ‘এক দ্বৈত চেতনা’ ধারণ করার কথা বলেছেন। মানবমুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদানই কীভাবে ইউরোপীয় চিন্তায় ছিল এবং উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে সেগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে, সে ব্যাপারে আলাপ করেছেন ফ্রাঞ্জ ফানো। আমাদের সময়ে সালমান রুশদির বিখ্যাত প্রস্তাবনা ছিল ‘দ্বিধাবিভক্ত জিভ’ (forked tongue) দিয়ে কথা বলার। হালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তক হোমি ভাভাও একইরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আমি যা করেছি তা হলো, আধুনিক বিশ্বে ইউরোপীয় চিন্তা যে অপরিহার্য সে দাবি তুলে ধরা। নাগরিক অধিকার ও মানবিক অধিকারগুলোর ধারণা ছাড়া আমরা এই বিশ্বের কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু একই সাথে এই ইউরোপীয় ভাবনা অপর্যাপ্তও। কেন এই অপরিহার্যতা এবং অপর্যাপ্ততা? খেয়াল করে দেখুন, আমি এখানে ‘কিন্তু’র বদলে ‘এবং’ কথাটি ব্যবহার করছি, কারণ ঠিক যাকে বলে ইউরোপীয় চিন্তার বিরোধী আমি সেটা ছিলাম না। কিন্তু এমন চিন্তা স্বতন্ত্রভাবে অ-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর জন্য অপর্যাপ্ত, কেননা তারা কখনোই রেনেসাঁ ও আলোকায়িত ইউরোপ হতে আগত চিন্তাভাবনাকে ‘প্রাথমিক’ অবস্থা থেকেই মোকাবিলা করে আসেনি। অন্যভাবে বললে, তারা ইউরোপকে মোকাবিলা করেছে তাদের নিজস্ব ইতিহাস, অতীত ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে, এবং সে অনুসারেই ইউরোপীয় চিন্তাকে তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে অনুবাদ করেছে (ঠিক যেভাবে কোনো দূরবর্তী উৎস হতে ভেসে আসা ধারণাগুলোকে ইউরোপীয় চিন্তকেরা অনুবাদ ও আত্মীকরণ করেছেন)।

এই অনুবাদ কার্য একাধিক অতীত ও ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করার মাধ্যমে চিন্তাকে হেটেরোটেলিক আকারে প্রকাশ করে, এমনিতে যেই চিন্তা কিনা অত্যাবশ্যক। একই কাঠামো খোদ ইউরোপের ক্ষেত্রেই খাটবে। ইউরোপীয়রা তাদের নিজেদের আধুনিকায়িত বিমূর্ত চিন্তাভাবনার মোকাবিলা করেছে তাদের নিজস্ব অতীতের মধ্য দিয়ে, এবং এর ফলে এই চিন্তাভাবনাগুলো সেখানেও কোনো না কোনো অনুবাদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গিয়েছে। আদতে, বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমার পূর্ব ইউরোপের অনেক বন্ধুই বলেছিলেন যে, আমার বইটির নামকরণ করা উচিত ছিল “পশ্চিম ইউরোপের প্রাদেশিকীকরণ” (“প্রোভিনশিয়ালাইজিং ওয়েস্টার্ন ইউরোপ”)! একই কথা ভিন্নভাবেও বলা যায়। যেমন ধরুন, তথাকথিত ইউরোপীয় উৎসের বিমূর্ত সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণিবিভাগ যেমন, আধুনিক ব্যক্তি অথবা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি ধারণার দুটি জরুরি দিক থাকে: ডিস্কার্সিভ (বিমূর্ত) দিক ও চিত্রায়িত দিক (অর্থাৎ যেভাবে এর ছবি করা হয়)। কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারে এভাবে যে: গণতন্ত্রের প্রত্যয় বলতে হয়তো বোঝায় স্বাভাবিকভাবে গৃহীত বিমূর্ত ও সর্বজনীন ধারণাসমূহকেই, কিন্তু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে একে ভিন্নভাবেই চিত্রায়িত করা হবে। যদিও প্রতিটি রূপকল্প নির্মাণকেই অপরাপর রূপকল্পসমূহের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়। ইউরোপের প্রাদেশিকীকরণ সর্বজনীন ও স্থানিক এ দুটি অবস্থানের মধ্যে একটি আঁটোসাটো দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে; এটি যেমন সর্বজনীনতাকে বিসর্জন দেয় না, তেমনি সর্বত্রই এটি এই সর্বজনীনতাকে স্থানিক ভূমির উপর স্থাপন করতে চায় এমনকি ইউরোপেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *