নাগরিক অবাধ্যতা

  • হেনরি ডেভিড থরো; ভাষান্তর: আব্দুল ওয়াহিদ দীপ্র

সম্পাদকীয় মন্তব্য: আমেরিকান ন্যাচারেলিস্ট, প্রাবন্ধিক, কবি ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো রচিত ‘Civil Disobedience’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। প্রবন্ধটি Resistance to Civil Government বা On the Duty of Civil Disobedience নামেও পরিচিত। রাজনৈতিক কর্মী ও এক্টিভিস্টদের কাছে, বিশেষ করে যারা অহিংস ধারা বা নন-ভায়োলেন্ট সিভিল রেসিস্ট্যান্স নীতিকে ধারণ করেন বা কার্যকর কৌশল হিসাবে মনে করেন তাদের কাছে এই প্রবন্ধের গুরুত্ব অপরিসীম; এর প্রভাবও পড়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের ওপর। সে তালিকায় মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ রয়েছেন। এই প্রবন্ধের ভাষান্তর করেছেন আব্দুল ওয়াহিদ দীপ্র। তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে ব্লগে প্রকাশিত এই অনুবাদটি সংক্ষেপিত; ‘রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালে’র পরবর্তী সংখ্যায় এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদটি প্রকাশিত হবে। উল্লেখ্য, হেনরি ডেভিড থরো সম্পর্কে আরো জানতে হোমেন বরগোহাঞি রচিত ‘হেনরি ডেভিড থরো‘ প্রবন্ধটি দেখা যেতে পারে।

‘সেই সরকারই সবচেয়ে ভাল যে সবচেয়ে কম শাসন করে’— আমি অন্তর থেকে এই নীতিটি সমর্থন করি এবং চাই যে আরও দ্রুত ও আরও নিখুঁতভাবে এটি কার্যকর করা হোক। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, সঠিকভাবে কার্যকর করা হলে নীতিটি শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়ায়­— “সেই সরকারই সবচেয়ে ভাল যে একেবারেই শাসন করে না”। যদি জনগণ উপযুক্ত হয় তবে এই ধরণের সরকার ব্যবস্থাই তারা পায়। সরকার আসলে জনগণের উদ্দেশ্য সাধনের একটি পন্থা; কিন্তু অধিকাংশ সরকারই সাধারণত এবং সকল সরকারই প্রায়শ এর ব্যতিক্রম বলে পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রে স্থায়ী সেনাবাহিনী রাখার বিরুদ্ধে যে ভারী ভারী অভিযোগ আনা হয় তা সরকারের বিরুদ্ধেও আনা যেতে পারে কারণ সেনাবাহিনী মূলত রাষ্ট্রেরই অঙ্গ। যদিও জনগণই নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সরকার নির্বাচিত করে, জনগণের কোনো কাজে আসার পূর্বেই সরকারের বিকৃত ও অপব্যবহৃত হবার সম্ভাবনাও সমানভাবে বিদ্যমান। চলমান মেক্সিকান যুদ্ধের উদাহরণ লক্ষ্য করা যেতে পারে; সেখানে মুষ্টিমেয় কয়েক জন ব্যক্তি সরকারকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এমন সব কাজ করছে যেগুলো তারা জনগণের সমর্থন নিয়ে করতে পারতো না।

এই যে আমেরিকান সরকার ব্যবস্থা, যদিও এর বয়স খুব অল্প এবং এখনও অপরিপক্ব, তবুও কি এটি আমাদের একটি ঐতিহ্য নয়? আমরা এই ঐতিহ্য অক্ষত অবস্থায় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চাই, তবুও কি প্রতি মুহূর্তে আমরা এই ঐতিহ্যের একাগ্রতা নষ্ট করছি না? সরকার ব্যাবস্থা কোনো একক ব্যক্তির মত একটি প্রাণ নয়, এটি ব্যক্তি ইচ্ছার উপর নির্ভর করে চলতে পারে না কারণ এতে সরকার ব্যক্তির যথেচ্ছ আচরণের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। বরং সরকার সর্বসাধারণের হাতে ধরা একটি অস্ত্র। জনগণ সর্বদাই এমন একটি সরকার ব্যবস্থা চায় যা তাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এভাবে, জনসাধারণ তাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্য সরকার তৈরি করে। তবু, এই সরকার জনগণের উন্নয়ন তো ঘটায়ই না, বরং জনগণের আত্মোন্নয়নের চেষ্টাগুলোকেও ব্যহত করে। এরা দেশের স্বাধীনতা নষ্ট করে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরি করে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে। এতদিনে আমেরিকা যা কিছু অর্জন করেছে তার পুরোটাই সাধারণ জনগণের মেধা আর প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। এই অর্জন আরও বৃদ্ধি পেত যদি সরকার এই অর্জনের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াত। সরকার জনগণের উদ্দেশ্য সাধনের একটি পন্থা যাকে ব্যবহার করে যেকোনো ব্যক্তি সফলতার পথে হাঁটতে পারে, কারও সাহায্য ছাড়াই; এবং যেকোনো ব্যক্তির অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই সফল হওয়াটাই স্বাভাবিক যদি সরকার উপযুক্তভাবে পরিচালিত হয়। আইনপ্রণেতাগণ ক্রমাগত যেসব নেতিবাচক নীতিমালা বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর চাপিয়ে দেয় তা থেকে দেশ কখনোই বেরিয়ে আসতে পারতো না যদি ভারতীয় রাবারের ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাগুলো না চলতো। আইনপ্রণেতাগণের এহেন যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচার করা যেত, তাহলে হয়তো দেখা যেত যেসব বিক্ষোভকারী রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে তাদের শাস্তির চেয়ে এই আইনজ্ঞদের শাস্তি কোনো অংশে কম হওয়া উচিত নয়।

হেনরি ডেভিড থরো

কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমি বলতে চাই, আমি সরকার বিরোধী নই, বরং আমি সরকারের এমন একটি সংস্করণ চাই যা অপেক্ষাকৃত উন্নততর এবং যা প্রকৃতপক্ষে ‘শাসন’ করে না। এভাবে শুধু আমি নই, বরং সকলের কাছেই জানতে চাওয়া হোক তারা কি ধরণের সরকার চান কারণ এই জানতে চাওয়ার মাধ্যমেই সেই উন্নততর সরকার তৈরির দিকে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবো।

স্বাভাবিকভাবেই যখন একবার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা চলে যায়, তখন তারা একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশ শাসন করার অধিকার লাভ করে। তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে তারা দেশ শাসন করে কারণ তারা শাসন করার জন্য উপযুক্ত, কিংবা তারা সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে; তাদের ক্ষমতার উৎস জনগণের প্রতি শুভবোধ নয়, বরং তারা বস্তুগতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার কখনোই ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, এমনকি সাধারণভাবে প্রচলিত অর্থে ন্যায়ের ধারণার উপরও নয়। ব্যাপারগুলো কি এমন নয় যে ভালো-মন্দ বিচারের দায়িত্ব ব্যক্তির বিবেকের উপর ছেড়ে না দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই নির্ধারণ করে দেয় কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ? বরং সরকারের কি উচিত না ব্যক্তিগত নৈতিকতার দায়িত্ব না নিয়ে শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিগুলো দেখা? নাগরিকগণ কি একটি মুহূর্তের জন্যও তাদের বিবেক সরকারের কাছে বন্ধক রেখেছে? নৈতিক ব্যাপারগুলোতে যদি সরকারই সিদ্ধান্ত নেয় তবে স্রষ্টা সকল ব্যক্তিকে বিবেক দিয়েছেন কেন? আমার মতে, আমরা আগে মানুষ, পরে নাগরিক, তারও পরে প্রজা। তাই আইনকে ব্যক্তিবিবেকের উপরে স্থান দেয়া মোটেই কাম্য নয়। যেকোন পরিস্থিতিতেই মানুষ হিসেবে আমার একমাত্র বাধ্যবাদকতা হচ্ছে আমার যা ঠিক বলে মনে হয় তা করা। যদিও কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো বিবেক নেই, তবু তা যখন ব্যক্তির বিবেকের উপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করে তখন তা প্রতিহত করা উচিত। আইন কখনোই কোনো ব্যক্তির ভেতর ন্যায়বোধ জাগাতে পারেনি, বরং, বিপরীতক্রমে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ও বিবেকবান ব্যক্তিটিও অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছে। আইনের প্রতি অন্ধভক্তি প্রায়শই ব্যক্তির উপর কি ধরণের প্রভাব ফেলে তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় অসংখ্য লাইনে সাজানো সৈন্য তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে যাচ্ছে। এই যাত্রা সত্যিই খুব যন্ত্রণাদায়ক এবং হৃদয়ে করুণার উদ্রেক করে কারণ এই যাত্রা নিজের বিবেক এবং মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যাত্রা। এখন, তারা আসলে কি? তারা কি মানুষ? নাকি তারা কেবল সরকারের লোকেদের দখলে থাকা দূর্গের নকশা যা প্রয়োজনে সরকার কর্তৃক অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়? যেকোনো সামরিক বাহিনীর কোনো ঘাঁটিতে গিয়ে এর যেকোনো সদস্যকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমারিকার সরকার কি ধরণের মানুষ বানাতে পারে, কিংবা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, সরকার কিভাবে জাদুমন্দ করে— মানুষ নয়, যেন মানুষের ছায়া, যে শরীরে বেঁচে আছে এবং সোজা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু যার মৃত্যু ও শেষকৃত্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। চার্লস উলফের লেখা “স্যার জন মুরের শেষকৃত্য” কবিতার কিছু লাইন মনে পড়ে—

“লাশ কাঁধে শ্রান্ত দেহে দূর্গে ফিরে দেখি,
না আছে কোনো বাদ্যের সুর, না আছে গানের কথা,
না আছে কোনো রাষ্ট্রীয় শোক, না আছে স্মরণ—সভা,
আছে শুধু এই বীরের কপালে অকাল মরণই লেখা।”

এইরূপে, জনসাধারণের এক বিশাল অংশ মানুষ হিসেবে নয়, বরং সরকারের হাতে থাকা যন্ত্রের মত করে বেঁচে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের কোন নিজস্ব চিন্তা, বিবেক বা ন্যায়বোধ থাকে না। এরা ইট, কাঠ, পাথর বা মাটির মতই জড় বস্তুতে পরিণত হয় এবং সরকারই নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই মানবরূপী জড়বস্তুগুলো তৈরি করে। এই মানুষগুলো কখনোই খড়কুটা বা ধূলিকণার চেয়ে অধিকতর মূল্যবান নয়। আসলে এরা ঘোড়া বা কুকুরের মত কারণ এরা মনিবের কথা মেনে চলে। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো, এরাই সরকার কর্তৃক সর্বোত্তম নাগরিকরূপে বিবেচিত হয়। এই হলো তাদের গল্প যারা তাদের শরীর দিয়ে সরকারের সেবা করে। আরও একদল লোক আছে যারা মাথা দিয়ে সরকারের সেবা করে। আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তাগণ এই কাতারে পড়ে। এদের বিবেক বা ন্যায়বোধ বলতে কিছুই নেই, এরা শয়তানের তপস্যাও করতে পারে, ঈশ্বরের উপাসনাও করতে পারে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ আছেন যারা শরীর কিংবা মাথা দিয়ে নয়, বরং বিবেক দিয়েও রাষ্ট্রের সেবা করে, এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজনে মূলধারার নাগরিকদের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করে। কিন্তু, এরাই সরকার কর্তৃক শত্রু বলে বিবেচিত হয়। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কখনোই মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবেন না; তিনি কখনোই “ঘরের দেয়ালে তৈরি হওয়া ছিদ্র আটকাতে মাটির দলায় পরিণত হবেন না” (হ্যামলেট, অঙ্ক ৫, দৃশ্য ১, ছত্র ২০৫-৬)—

“আমার শিরায় বহে ঔদ্ধত্যের রক্ত,
থাকি সকল শাসনের বহু ঊর্ধ্বে,
নই নতজানু নতদৃষ্টি ক্ষুদ্র কোনো দাস,
নই কোনো রাষ্ট্রের সীমায় বন্দী।” (কিং জন, অঙ্ক ৫, দৃশ্য ২, ছত্র ৭৮-৮১)

যেই ব্যক্তিটি তার আশেপাশের মানুষদের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে সে ব্যক্তিটি সরকারের চোখে অথর্ব এবং স্বার্থপর; কিন্তু যে ব্যক্তিটি নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে সরকারের দাসত্ব করছে সে সরকারের নিকট মানবপ্রেমী এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত।

এখন, আমেরিকান সরকারের সাথে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক কিরূপ? আমার মতে, সরকারের সাথে সহমত পোষণ করা মানে ব্যক্তির নিজের অসম্মান করা। আমি কখনোই ভাবতেও পারিনা যে আমাদের এই সরকার আসলে দাসদের সরদার। সকল সভ্যতাই বিপ্লবের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়; সরকার যখন অদক্ষ এবং অত্যাচারী হয়ে ওঠে তখন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা কিংবা বিদ্রোহ করা এই দুইয়ের স্বাধীনতাই ব্যক্তির রয়েছে। কিন্তু, আমাদের এইখানে অবস্থা যে এমন নয় তা সকলেই জানে। অথচ, সবাই এ-ও জানে যে ’৭৫ এর অভ্যুত্থানের সময় এই স্বাধীনতা ছিল। যদি কেউ আমাকে বলে যে সেই সরকার একটা খারাপ সরকার ছিল কারণ সেই সরকার কিছু বিদেশী পণ্য আমদানীর উপর অতিরিক্ত করারোপ করেছিল, আমি বলব আমার এই ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই কারণ আমার ঐসব বিদেশী পণ্য ছাড়াও চলে। যেকোনো যন্ত্রেরই নিজস্ব একটা বল থাকে যা ঘর্ষণ বলের মতন মূল বলের বিপরীতে ক্রিয়া করে। সরকার ব্যাবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই সবসময়ই সরকারের সমালোচনা করা উচিত নয়। কিন্তু ঘর্ষণ বলই যখন মূল বলের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, অর্থাৎ সরকার একটি নিপীড়নযন্ত্রে পরিণত হয়, আমি বলি, এমন যন্ত্র আর বাসায় রাখার দরকার নাই। যে ভূখন্ডের জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ দাস যারা স্বাধীনতার আশায় এই ভূখন্ডে আশ্রয় নিয়েছে, এবং যে ভূখন্ড অন্যায়ভাবে আমেরিকার সামরিক আইন দ্বারা পরিচালিত, আমি মনে করি, সেই ভূখণ্ডে সেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লব করার জন্য এই কারণগুলো মুখ্য হওয়া উচিৎ। যদিও আমেরিকার সরকার আমাদের নিজ দেশে নয়, বরং অন্য দেশের উপর এই আগ্রাসন চালাচ্ছে (আমেরিকা—মেক্সিকো যুদ্ধ ১৮৪৬—১৮৪৮), মূলত এই কারণেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরও জরুরী হয়ে পড়ে— যে দেশ নিপিড়ীত হচ্ছে সেই দেশ আমার নয়, কিন্তু যেই সরকার নিপিড়ন চালাচ্ছে সেই সরকার তো আমার!

ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২, বাংলাদেশ

প্যালে, যিনি নৈতিকতার প্রশ্নে একজন পণ্ডিত হিসেবে বিবেচিত, তাঁর “সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা” শীর্ষক প্রবন্ধে সকল নাগরিক বাধ্যবাদকতাকে সরকারের যোগ্যতার মাধ্যমে পরিমাপ করেন। উনি বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো সমাজের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক জনগণের মঙ্গল ব্যাহত হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্তই সরকারের প্রতি বাধ্য ও অনুগত থাকতে হবে, এর বেশি নয়… এই নীতি অনুসরণ করলে সকল বিপ্লব ও বিদ্রোহ একটি সরল সমীকরণে পরিণত হয় যার এক পাশে থাকে সরকার পরিবর্তনে যে অসুবিধা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তার হিসাব, অপর পাশে সরকার পরিবর্তনের ফলে যেসব শুভ সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে তার গণনা”। তাঁর মতে, এই সমীকরণের হিসাবনিকাশ ব্যক্তি নিজেই করবেন। কিন্তু প্যালে সম্ভবত সেইসব অবস্থার কথা ভাবেননি যখন এই সরল সমীকরণ কাজ করে না, যখন ব্যক্তিকে অবশ্যই ন্যায়ের পক্ষ নিতে হয় ব্যয়ের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন। যদি আমি কোনো ডুবন্ত ব্যক্তির কাছ থেকে এক টুকরো কাঠের তক্তা অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিই, তবে আমাকে অবশ্যই সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে যদিও বা আমি নিজে ডুবে মারা যাই। কিন্তু প্যালের দেখানো যুক্তিমতে ভাবতে গেলে এটি অগ্রহণযোগ্য। এই ক্ষেত্রে, যে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে জীবন বাঁচাবে, আসলে সে এই কাজের জন্যই মারা যাবে। একইভাবে, আমাদের মেক্সিকোতে সেনা নিপীড়ন বন্ধ করা উচিৎ যদিও বা তাতে আমাদের নিজেদের ক্ষতি হয়।

সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটসে যা ঘটছে তা আক্ষরিক অর্থেই প্যালের নীতির প্রতিফলন। সেখানে যারা রাজনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতা করছে তারা কোনো রাজনীতিবিদ নয়, বরং তারা কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা মানবতার চেয়ে কৃষি কিংবা বাণিজ্যে বেশি বিশ্বাসী; তাই তারা মেক্সিকোতে যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় না বা দাসদের মুক্তি চায় না কারণ এতে যদিও মানবতা মুক্তি পায় কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা এই ত্যাগটুকু করতে প্রস্তুত নয়। এখন, আমার বিবাদ তাদের সাথে নয় যারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদে বিশ্বাসী নয়, বরং আমার বিবাদ তাদের সাথেই যারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদে বিশ্বাসী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এইসব অন্যায় বন্ধের জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। তারা বলে জনগণ এখনও বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নয়, অথবা যারা মানুষ হিসেবে ভালো তাদের সংখ্যা সমাজে খুবই নগণ্য বলে বিপ্লব সম্ভব নয়, অথবা যারা বিপ্লব চায় না তারা বস্তুগতভাবে বেশি শক্তিশালী। আমাদের দেশে এমন হাজার হাজার মানুষ আছে যারা শুধুমাত্র বিশাস করে যে নিপীড়নের সমাপ্তি ঘটা দরকার, কিন্তু এই সমাপ্তি ঘটানোর জন্য বাস্তবে কোনো কাজ করে না। তারা নিজেদের ওয়াশিংটন এবং ফ্রাঙ্কলিনের বংশধর বলে দাবি করে, অথচ নিজেরা হাত গুটিয়ে অলস বসে থাকে আর বলে কি করা লাগবে সেটা তারা বুঝে না। এমনকি তারা নাগরিক স্বাধীনতার চেয়ে মুক্ত বাণিজ্যে বেশি বিশ্বাস করে এবং হয়তো আরাম করে রাতের খাবার সেরে বিভিন্ন পণ্যের বাজার দর যাচাই করে আর পত্রিকাতে মেক্সিকো যুদ্ধের খবর পড়ে, এবং খুব সম্ভবত বাজারের বই আর পত্রিকা দুটোই হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আচ্ছা, একজন সৎ এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকের বাজার দর এখন কত? তারা দ্বিধাবিভক্ত, তারা অনুশোচনাগ্রস্ত, আবার কখনও কখনও সরকারি অন্যায়গুলো বন্ধের জন্য স্মারকলিপিও লেখে, কিন্তু তারা আন্তরিকতার সাথে বাস্তবে কোনো প্রভাব ফেলবে এমন কাজ করে না। তারা অপেক্ষা করে কখন অন্য কেউ এসে তাদেরকে অন্যায়ের হাত থেকে উদ্ধার করবে। খুব বেশি হলে তারা যাদেরকে ন্যায়পরায়ণ এবং নীতিবান বলে মনে করে তাদের পক্ষে কেবলমাত্র একটা সস্তা ভোট দেয়।

ভোট পদ্ধতি আসলে দাবার মত একটা খেলা, শুধু এতে একটু নৈতিকতার স্বাদ জুড়ে দেয়া আছে— এটা ন্যায়-অন্যায়ের একটা খেলা, নৈতিকতার প্রশ্ন নিয়ে খেলা এবং স্বভাবতই এর মধ্যেও জুয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি ভোট দিচ্ছেন তাঁর নৈতিকতা ও ন্যায়বোধ সম্পর্কে আদৌ কোনো জ্ঞান আছে কিনা তা যাচাই করা হয় না। ফলে আমি তাকেই ভোট দিই যাকে আমি ঠিক বলে মনে করি; কিন্তু আমি আসলে এখানে ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, বরং এই দায়ত্বটি আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি— আমার সিদ্ধান্ত যদি ভুলও হয়, সবার সিদ্ধান্ত তো আর ভুল হবে না, এই হলো আমার যুক্তি! ভোটার হিসেবে আমি হচ্ছি একটি নামমাত্র মাধ্যম যার ভোটে নৈতিকতার জয় হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এমনকি নৈতিকতার পক্ষে ভোট দেয়াও প্রকৃতপক্ষে নীতি প্রতিষ্ঠা করা নয়; এটা শুধু আপনার ইচ্ছার জানান দেয়া যে আপনি একটি ন্যায়পরায়ণ সরকার চান, আসলেও আপনি তা পাবেন কিনা সেটা নির্ভর করবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর। তাই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই দেশের ভালো-মন্দ দৈবক্রমে নির্ধারিত হতে বা অন্যের হাতে ছেড়ে দেবেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তে খুব সামান্যই কল্যাণ থাকে। যারা দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার পক্ষে ভোট দেবে তাদের আসলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়া বা না হওয়া দিয়ে কিছু যায়-আসে না। তারা যখন এই যুক্তিতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার পক্ষে ভোট দেবে তখন তারাই দাসে পরিণত হবে। শুধুমাত্র সেই ব্যক্তির ভোটেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হতে পারে যে নিজের ভোটের মাধ্যমে তার দাসত্বের নয় বরং স্বাধীনতার প্রকাশ ঘটান।

চিলি, ২০১৯

শোনা যাচ্ছে, বাল্টিমোর বা অন্য কোথাও আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বেছে নেয়ার জন্য একটা সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে যেখানে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক অথবা রাজনীতিবিদ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো একজন স্বাধীন, বুদ্ধিমান এবং সম্মানীয় ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত কি তারা নিতে পারবে? আমাদের কি সেই সব সাধারণ নাগরিকের প্রজ্ঞা এবং সততার সঠিক ব্যবহার করা উচিৎ নয় যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্মেলনে যোগদান করেন? তাহলে শুধু রাজনীতিবিদদের মতামত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে কি আমরা নিজেরাও নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারি না? কিন্তু না, আমরা নিজেরা নিজেদের তথাকথিত সম্মানীয় ব্যক্তি বলে দাবি করবো, দেশের দুর্দশা নিয়ে হতাশাগ্রস্তও হবো; অথচ দেশেরই এ ধরণের নাগরিকদের উপর হতাশ হওয়ার কথা। এই রকম এক ব্যক্তির ভোট যেকোনো নীতিহীন বিদেশী বা ভাড়াটে ভোটারের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়। যদি আমাদের ভোটারগণ মানুষ হতো আর তাদের পিঠে একটা মেরুদণ্ড থাকতো! আমেরিকার জনগণ এক অদ্ভূত প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে যা শারিরীক গঠনে ঠিক থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং স্ব-নির্ভরতার ক্ষেত্রে অপরিপক্ক; জন্ম নেয়ার পর থেকেই যার প্রথম লক্ষ্য কিভাবে বিধবা বা এতিমদের মত সে-ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিক্ষা পাওয়ার উপযুক্ত হবে সেই ব্যবস্থা করা। মোদ্দা কথা হলো এরা কেবলমাত্র বীমা সহায়তায় বাঁচতে চায়, কারণ বীমা এদেরকে মৃত্যুর পর আর্থিক সম্মানের সহিত সমাহিত করার নিশ্চয়তা দেয়।

অবশ্যই কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সমাজ থেকে সকল সমস্যা দূরীকরণে নিজেকে নিবেদিত করা সম্ভব নয় কারণ তার সময় দেয়ার মত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্বেগ রয়েছে; তবে কমপক্ষে তার নিজের দায়িত্বটুকু পালন করা এবং বাস্তব জীবনে অন্যায়কে সমর্থন না করা তার কর্তব্য। আমি যদি অন্যান্য সাধনায় মনোনিবেশ করি তবে নিদেনপক্ষে আমার এতটুকু নিশ্চিত করা উচিৎ আমি যেন অন্যের কাঁধে জেঁকে না বসি। আমার অবশ্যই অন্যের কাঁধ থেকে নেমে পড়তে হবে যেন সে-ও নিজের কাজ করার সুযোগ পেতে পারে। আমি আমার শহরবাসীদের বলতে শুনি, “আমি চাই ক্ষমতাবান ব্যক্তিগণ আমার সাহায্য চাক, আমাকে বলুক দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা মেক্সিকো অভিমুখে যাত্রা করতে”। কিন্তু এরা নিজ উদ্যোগে কখনোই কিছু করে না। সেসকল সৈনিক প্রশংসিত হয় যারা অন্যায় যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে, কিন্তু যে নীতিবিবর্জিত সরকার এই যুদ্ধ তৈরি করে তাদের কুৎসা করা হতে এরা বিরত থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন— সরকার যেন নিজেই এমন কাউকে ভাড়া করেছে যে মাঝে মাঝে সরকারের দুই-একটা ভুল ধরিয়ে দেবে কিন্তু এমন কিছু করবে না যাতে সরকার সেই ভুলগুলো করা বন্ধ করে। এইভাবে আমরা শৃংখলা এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নামে নিজেদের নিকৃষ্টতাকে বৈধতা দিই।

সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক বিস্তৃত ত্রুটিগুলো আরও বিস্তৃত হয় কারণ আমাদের গুণগুলো এই ত্রুটিগুলো সমাধানের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। এই ত্রুটিগুলোর প্রতি সামান্য তিরষ্কার সাধারণত কোনো কাজে আসে না। যারা সরকারের সবচেয়ে বড় ত্রুটিগুলোর সমালোচনা করে কিন্তু সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগতও থাকে, অর্থাৎ যারা সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক, বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, এরাই সরকারের ত্রুটিগুলো সংস্কারের পথে মূল বাধা। কেউ কেউ সরকারের কাছে আবেদন করছে ইউনিয়ন (আমেরিকারে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলো নিয়ে তৈরি জোট) ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। কিন্তু রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক কি রাষ্ট্রের সাথে ইউনিয়নের সম্পর্কের মতোই নয়? নাগরিক রাষ্ট্রকে কর দেয় এবং সেই করের অর্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, আবার রাষ্ট্র ইউনিয়নকে অর্থ সহায়তা দিয়ে চালায়। অর্থাৎ নাগরিক রাষ্ট্রকে কর দেয়া বন্ধ করে দিলে রাষ্ট্রও বাধ্য হবে ইউনিয়নকে অর্থ সরাবরাহ করা বন্ধ করতে। তাহলে যে নিয়ামকগুলো ব্যক্তিকে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধা দেয় সেই একই নিয়ামকগুলোই কি সরকারকে ইউনিয়নের বিরোধিতা করতে বাধা দেয় না?

একজন মানুষ কিভাবে কেবলমাত্র প্রাত্যহিক বিনোদন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে? সে কিভাবে এটা জেনেও সন্তুষ্ট থাকতে পারে যে সে প্রতারিত হচ্ছে? আপনি যদি জানতে পারেন আপনার প্রতিবেশী আপনার মাত্র এক টাকার জিনিসও ছিনিয়ে নিয়েছে, তাহলে কি আপনি এটা জেনেই বসে থাকবেন? নাকি আপনি তাকে অনুরোধ করবেন যেন তিনি আপনার প্রাপ্য আপনাকে ফিরিয়ে দেন? এবং তিনি যদি তা না করেন তবে তাকে উচিৎ শিক্ষা দিবেন এবং পরবর্তীতে সে যেন আর কোনোদিন এই কাজ না করে তা নিশ্চিত করবেন? নীতি, ন্যায্যতার জ্ঞান এবং ন্যায্য কাজ আপনার জীবনকে বদলে দেবে কারণ তা প্রকৃতিগতভাবেই বিপ্লবী একটি কর্মকাণ্ড যা ব্যক্তির বিবেককে ব্যক্তির অসততা থেকে মুক্ত করে।

অন্যায় আইনের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে। আমরা কি সেগুলোই মেনে চলবো? নাকি সেগুলোকে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাবো? পরিবর্তন কিন্তু একবারেই আসে না। সাধারণত, এমন আমেরিকান সরকারের অধীনে যতদিন না পর্যন্ত সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিপ্লব চাচ্ছে ততদিন সকলেই বিপ্লব থেকে দূরে থাকে। তারা মনে করে, যদি তারা নিজেরা বিপ্লব শুরু করতে যায় তবে এর পরিণতি হবে নরকের চেয়েও ভয়াবহ। কিন্তু এটি আসলে সরকারেরই দোষ যে আসলেও এর ফলাফল নরকের চেয়েও ভয়াবহ হয়। সরকারই এইরকমের একটা পরিবেশ তৈরি করে। কেন এটি বিপ্লবের সুযোগ রাখে না? কেন এটি সংখ্যালঘু কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিদের দমিয়ে রাখে? কেন এটি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই সম্ভাব্য আঘাতকারীকে প্রতিহত করে? কেন এটি এর ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এর নাগরিকদের উৎসাহিত করে না? কেন এরা সবসময় যীশুদের মৃত্যুদণ্ড দেয় আর কোপার্নিকাস কিংবা মার্টিন লুথারদের বহিষ্কার করে? কেন এরা ওয়াশিংটন বা ফ্রাঙ্কলিনদের রাষ্ট্রদ্রোহী বানায়?

যদি অন্যায়ই সরকারযন্ত্রের ঘর্ষণবল হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই সেই যন্ত্র ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকবে। কিন্তু, অন্যায়ের বাহন যদি স্প্রিং হয়, কিংবা এর যদি একটি কপিকল থাকে, অর্থাৎ অন্যায় করা যদি খুবই সহজ হয় তাহলে এই অন্যায়ের প্রতিকার করার পথ অবশ্যই নরকের চেয়েও ভয়াবহ হবে। সেক্ষেত্রেও যদি সরকার চায় যে আপনাকে অন্যায়ের একটি বাহন হতে হবে, আমি বলবো, সেই আইন ভেঙ্গে দিন। আপনার জীবনকে সেই সহজ অন্যায়ের পথে দাঁড়ানো একটি বিশাল পাহাড় করে গড়ে তুলুন। সর্বাবস্থায় আপনি যেন অন্যায়ের বাহন হয়ে না যান তা আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজনে আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও।

এখন, এই অন্যায়ের প্রতিকার করার মত আইনসম্মত যেসব উপায় আছে বলে আমি জানি সেগুলোর কোনোটিই বাস্তবে প্রয়োগ করার মতন নয়— এগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ এবং একজন মানুষের পুরা জীবনকালও এর পেছনে ব্যয় হয়ে যেতে পারে! একজন ব্যক্তির তো আরও কাজ করার থাকে। কেউই পৃথিবীকে স্বর্গ বানানোর জন্য পৃথিবীতে আসে না, বরং পৃথিবীতেই বসবাস করতে আসে তা সে খারাপ হোক বা ভালো হোক। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় সবকিছু করতে পারে না; আর এইজন্যেই সে বেঁচে থাকা অবস্থায় যা যা করার সুযোগ পায় তা কোনো অন্যায় করে নষ্ট করা উচিৎ নয়। সরকার বা রাজনীতিবিদগণ কখন কি করছেন তা সবসময় দেখে রাখা বা তার বিরোধিতা করা আমার কাজ নয়, যেমনটা আমি কখন কি করে দিন পার করছি তা দেখে রাখা সরকারের কাজ নয়। তাছাড়া সরকার যদি আমার কথা না মানে তাহলে আমি কি করবো? আমি নিশ্চয় সরকারকে আমার সব কথা মানানোর জন্য সারাদিন ব্যয় করবো না! কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্র আমাকে আর অন্য কিছু করার সুযোগ দেয় না। রাষ্ট্রের সংবিধানটি পর্যন্ত শঠতায় ভরা! এটি শুনতে নিষ্ঠুর লাগতে পারে কিন্তু এটিই সত্য।

একজন ব্যক্তি হিসেবে এই সরকারের সাথে, কিংবা এর মুখপাত্রদের সাথে আমার দেখা হয় বছরে মাত্র একবার, শুধুমাত্র কর দেওয়ার সময়ে এবং এটাই আমার অবস্থান থেকে সরকারের সাথে কোনো মিথষ্ক্রিয়ায় জড়ানোর একমাত্র সুযোগ। এই সময় একজন ব্যক্তি সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে কার্যকর এবং সবচেয়ে অপরিহার্য যে কাজটি করতে পারে তা হলো কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো। আমার প্রতিবেশী, তিনি পেশায় একজন কর আদায়কারী এবং তিনি স্বেচ্ছায় এই সরকারী পেশা বেছে নিয়েছেন। যেহেতু আমার বিরোধ কাগজে-কলমে লেখা আইনের সাথে নয় বরং অন্যায় আইন পালনকারী মানুষগুলোর সাথে, আমার প্রতিবেশীর সাথে আমার বোঝাপোড়া আছে। আমি যদি সরকারী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ কর দিতে অস্বীকৃতি জানাই তবে কি তিনি আমার সাথে তাঁর প্রতিবেশীর মতই ব্যবহার করবেন? মানুষ হিসেবে আমার প্রাপ্য মর্যাদা এবং সম্মান দিবেন? নাকি তিনি আমাকে আইন অমান্যকারী এবং অশান্তি সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখবেন? যদি তিনি আমাকে অশান্তি সৃষ্টিকারী হিসেবেই দেখেন তবে তিনি কর্মফল হিসেবে আমার কাছে থেকে আরও অভদ্র ও দুর্বিনীত আচরণ পাবেন। আমি বিশ্বাস করি যদি একশো জনে এক জন, কিংবা এক হাজার জনে একজন, কিংবা এক লাখ বা এক কোটি জনেও একজন সৎ ব্যক্তি থেকে থাকেন যিনি দাসদের মালিক হওয়ার পরও দাসপ্রথার বিরোধিতা করেন এবং তার জন্য যদি জেলেও যান, সেই একজন ব্যক্তির জন্যই একদিন আমেরিকা থেকে দাসপ্রথা চিরতরে বিদায় নেবে। কারণ, সূচনা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন কোনো কাজ একবার ভালোভাবে করা হলে তা চিরকালের জন্য হয়ে যায়। কিন্তু আমরা আসলে কোনো কাজ করার চেয়ে গল্প দিতে বেশি ভালোবাসি। সেই জন্যেই শুধু সংবাদপত্রে বিপ্লব দেখা যায়, কিন্তু একজন মানুষের মধ্যেও বিপ্লব দেখা যায় না। একইভাবে যদি আমার বিজ্ঞ সরকারী চাকুরে প্রতিবেশি কাউন্সিল চেম্বারে বসে মানবাধিকার নিয়ে চেঁচামেচি না করে ম্যাসাচুসেটসে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করতেন, তবে সরকার এত সহজে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনটিকে দমিয়ে দিতে পারতো না।

আসলে যেখানে সরকার অন্যায়ভাবে নাগরিকদের গ্রেপ্তার করে সেখানে নীতিবান নাগরিকদের জন্য সত্যিকারের জায়গা হচ্ছে কারাগার। ম্যাসাচুসেটস এর সরকার এর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল এবং অপেক্ষাকৃত কম যান্ত্রিক নাগরিকদের জন্য শান্তিতে থাকার একমাত্র যে জায়গাটির ব্যবস্থা করেছে তা হচ্ছে জেল। সরকার তো তার নীতিহীন কর্ম দিয়ে এই প্রগতিশীল নাগরিকদের আগেই মানসিকভাবে একঘরে করে দিয়েছে, এখন যদি শরীরটাকেও নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে তাতে কিই বা আসে যায়! বরং কারাগারে থাকলে বিভিন্ন অপরাধী দাস, মেক্সিকো থেকে পালিয়ে আসা তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী, ইন্ডিয়ান আদিবাসী বা আরও বিচিত্র ধরণের সঙ্গী পাওয়া যায়। সরকার সেই সব ব্যক্তিদেরই কারাগারে পাঠায় যারা সরকারের আইন মেনে চলেনা, অর্থাৎ কারাগারে অপরাধীরা স্বাধীনচেতা এবং তারা বিভিন্ন অপরাধে কারাবাসী হলেও তাদের মধ্যে একটা সাদৃশ্য থাকে আর তা হলো এরা কেউই সরকারের লোক নয়— একটি দাস রাষ্ট্রে এর চেয়ে স্বাধীন জায়গা আর হতে পারেনা। তাঁরা যদি মনে করেন যে কারাগারে থাকলে তাদের কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা হেরে যাবেন, তবে তাঁরা জানেন না অন্যায় অপেক্ষা ন্যায় কতটা শক্তিশালী এবং সত্যের পক্ষে লড়াইটা আরও ভালোভাবে করা যায় যখন নিজের কাছেই অন্যায়ের শিকার হবার অভিজ্ঞতা থাকে। আপনার পুরো ভোট দিন, শুধু একটি নিছক কাগজের টুকরা নয়, বরং আপনার পুরো ব্যক্তিত্ব ব্যবহার করুন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কখনোই সংখ্যাগুরুর কথামত চলতে পারে না কারণ এতে সে তার সংখ্যালঘু হবার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। বরং সংখ্যালঘুরা যখন এর সর্বশক্তি দিয়ে মূলধারার গতি রোধ করে তখনই তারা সংখ্যালঘু হয়ে ওঠে। সরকারকে যদি দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা এবং সকল ন্যায়পরায়ণ নাগরিকদের কারাবন্দী করার দুটো পথের মধ্যে একটি বেছে নিতে হয় তবে সরকার অবশ্যই দ্বিতীয়টি করার জন্য এক মুহূর্ত সময়ও নিবে না। যদি এক হাজার নাগরিক সরকারকে কর দিতে অসম্মতি জানায় তবে সেটা সহিংসতা নয়, কিন্তু নাগরিকের করের টাকা যদি সরকার কর্তৃক নির্দোষ ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানোর জন্য ব্যয় হয় তবে তা অবশ্যই সহিংসতা হবে। আসলে কর না দেয়াটাই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হতে পারে। যদি কোনো কর গ্রহণকারী আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আমার কি করার আছে?”, তাহলে আমার উত্তর হবে, “যদি আপনি সত্যিই কিছু করতে চান, তবে প্রথমে আপনার চাকরী থেকে পদত্যাগ করুন”। যখন নাগরিক আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায় এবং আমলারা পদত্যাগ করে, কেবল তখনই বিপ্লব সম্ভব হয়। কিন্তু যখন নাগরিকের এই বিবেকবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হয়? আসলে তখনই প্রকৃত রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং একটি পুরো দেশ ধীরে ধীরে রক্তশূন্য হয়ে মারা যায়। আমি এই মুহূর্তে আমার দেশে এই ধরণের রক্তক্ষরণ দেখতে পাচ্ছি।

আমি এতক্ষণ প্রতিবাদকারী নাগরিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ নিয়ে কথা না বলে তাঁকে কারাবন্দী করার বিষয় নিয়ে কথা বলছি কারণ যাঁরা শুধুমাত্র অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেন তাঁরা সরকারের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর এবং সাধারণত তাঁরা সম্পদ লাভের পেছনে খুব একটা সময় ব্যয় করেন না। এই ধরণের লোকদের জন্য সরকার বা রাষ্ট্র কেউই খুব একটা কাজে আসে না কারণ তাঁরা সম্পূর্ণ নিজেদের প্রচেষ্টায় খুব কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই জন্যে তাদের কষ্টার্জিত টাকা তাঁরা এমন সরকারকে কেন দিবেন যে সরকার তাঁদের কোনো কাজে আসে না? অপরপক্ষে, ধনীদের কথা ভাবুন। সর্বদাই একজন ধনী যে প্রতিষ্ঠানটি তাকে ধনী বানিয়েছে তার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। একেবারে বলতে গেলে যত বেশি অর্থ, তত কম পূণ্য; কারণ অর্থ সবসময়ই মানুষ এবং তার চাহিদার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করে এবং পর্যাপ্ত অর্থ ব্যবহারের মাধ্যমে যখন চাহিদা পূর্ণ হয়, মানুষ তখন পূণ্য হারিয়ে ফেলে কারণ সকল চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে মানুষ প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেয় যেই প্রশ্নগুলো সে হয়তো দারিদ্র্যের মাঝে থাকলে করত। তার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়— টাকাগুলো কিভাবে খরচ করা যায়। এভাবে ধীরে ধীরে তার মন থেকে নৈতিকতার প্রশ্নগুলো মুছে যায়। তার বেঁচে থাকার অবলম্বন যত বাড়ে, তার বেঁচে থাকা তত কমে যায়। একজন ধনী ব্যক্তি তার দেশের জন্য সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হলো সে গরীব অবস্থায় যে পরিকল্পনাগুলো করত তা বাস্তবায়ন করা। কর প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে হেরোডদের প্রতি যীশুর পরামর্শ ছিল ওই মুহূর্তের জন্য উপযোগী— তারা যীশুকে জিজ্ঞেস করে সিজারকে রাষ্ট্রীয় কর দেয়া উচিৎ কিনা, যীশু তখন উত্তর দেন্‌ “যা সিজারের প্রাপ্য তা সিজারকে দাও, আর যা ঈশ্বরের প্রাপ্য তা ঈশ্বরকে” (ম্যাথ্যু ১৫ঃ২২)। উনি হেরোডদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানতেন এবং তাদের পরাস্ত করার জন্য ঐ মুহূর্তের অস্ত্র হিসেবে কথাগুলোকে ব্যবহার করেন।

আমি আমার প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে যা বুঝেছি তা হলো এরা বিপ্লবের সমস্যা এবং জনগণের শান্তির ব্যাপারগুলোতে যা-ই বলুক না কেন, তারা আসলে সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে এবং তাদের সম্পত্তি ও সন্তানদের উপর তার বিদ্রোহের কি কি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে তারা চিন্তিত। আমার মনে হয়, আমি কখনোই নিরাপত্তার জন্যে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল নই; কিন্তু, আমি যদি সরকারকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানাই তবে এরা আমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে যা আমাকে এবং আমার পরিবারকে অবর্ণনীয় সমস্যায় ফেলে দিবে। এটা খুব কঠিন। এই কারণে একজন ব্যক্তির পক্ষে একইসাথে সৎ এবং বাহ্যিকভাবে আরামদায়ক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। তাই, খুব বেশি সম্পদ বানানোর চেষ্টা না করাই ভালো। অবশ্যই মানুষের থাকার জন্য একটা জায়গা, শাক-সবজি চাষের জন্য এক টকুরো জমি দরকার। কিন্তু সেগুলো হতে হবে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। কনফুসিয়াস বলেছেন, “যে রাষ্ট্র যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় সেখানে দারিদ্র্য এবং দুর্দশা লজ্জাজনক, আর যে রাষ্ট্র যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না সেখানে সম্পদ ও সম্মান লজ্জাজনক”। না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার হারানোর কিছুই নেই ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সরকারের অন্যায় আইনের বিরোধিতা করতে পিছপা হবো না।

কয়েক বছর আগে, গীর্জার একটি বিষয়ে রাষ্ট্র আমার সাথে দেখা করেছিল এবং একজন পাদ্রীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের জন্য আমাকে আদেশ করেছিল। সেই পাদ্রীর প্রচারে আমার বাবা বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত থাকলেও আমি নিজে কখনও তার বক্তৃতা শুনিনি। আমাকে বলা হয়েছিল, “হয় অর্থ সাহায্য দিন, নয়তো জেলে বন্দী থাকুন”। আমি টাকা দিইনি। কিন্তু আমার প্রতিবেশি দিয়েছিল। আমি আজও বুঝিনা কিভাবে একজন পাদ্রীকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন স্কুলশিক্ষককে অর্থ প্রদানে জোর করা হয়! আমি তো সরকারী স্কুলের শিক্ষক নই, আমি স্বতন্ত্রভাবে অল্প কিছু অর্থ উপার্জন করি; বরং ওই পাদ্রী গীর্জার লোক আর সেই অর্থে সরকারেরও লোক। তাই হয়তো তারই উচিৎ ছিল আমার জন্যে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা। যাই হোক, এই বিষয়ে আমি একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলাম, “এখন থেকে সকলে জেনে রাখুন যে, আমি, ডেভিড থরো, এমন কোনো সমাজের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে চাই না যেই সমাজকে আমি নিজে বেছে নিইনি”। এবং আমি যে এই গীর্জার সদস্য হতে চাই না সেটি রাষ্ট্র জানার পর থেকে আমাকে আর কোনো সামাজিক প্রথায় অংশগ্রহণের জন্য বলেনি যদিও তাদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল আমাকে শাস্তি দেয়া। আমি কোন কোন সমাজে এরূপ না চাইতেও সদস্য বলে বিবেচিত হতাম তার তালিকা যদি ঐ মুহূর্তে আমার কাছে থাকতো তবে আমি ওই চিঠির একটি করে প্রতিলিপি ঐ সব জায়গাতেও পাঠাতাম।

আমি গত ছয় বছরে কোনো মাথট কর দেইনি। এইজন্যে আমাকে একবার জেলেও যেতে হয়েছে, এক রাতের জন্য। কঠিন পাথরের তৈরি দুই-তিন ফুট পুরু দেয়াল, লোহা ও কাঠের তৈরি এক ফুট পুরু দরজা তার উপরে লোহার প্রলেপ যেন ভেতরে আলো ঢুকতে না পারে— কারাগারের এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল এরা আমাকে রক্ত-মাংস-হাড্ডি দিয়ে তৈরি একটা শরীরই মনে করে শুধু, শরীর যেটাকে আটকে রাখা যায়। এরা কি বোকা! এরা ভেবেছে এখানে আমাকে বন্দী করে রাখাই আমাকে কাজে লাগানোর একমাত্র উপায়। আমাকে যতই বন্দী রাখা হোক না কেন আমি ঠিক ততটাই স্বাধীন আছি যতটা কারাবাসী হওয়ার আগে ছিলাম। আমার এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে বন্দী মনে হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার শহরের বাসিন্দাদের ভেতর শুধু আমিই কর দিয়েছি। তারা একেবারেই বুঝছিলো না আমার সাথে কিরূপ আচরণ করা উচিৎ। তাদের কথা-বার্তা, চলাফেরায় একটা শঙ্কা দেখা যাচ্ছিলো; তারা মনে করেছিল আমি বোধ হয় পালিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাবো। আর এদিকে তাদের দেখে আমার হাসি পাচ্ছিলো। তারা যেহেতু আমার মননের খোঁজ পায়নি, তারা আমার শরীরকে শাস্তি দেয়ার জন্য মনস্থির করেছিলো মানুষ যেমন তার রাগ তোলার মানুষ না খুঁজে পেলে রাস্তার কুকুর-বিড়ালদের মারে। আমি বুঝলাম রাষ্ট্র হচ্ছে অর্ধপাগল এক প্রতিষ্ঠান। এটি নিজের বন্ধু এবং শত্রুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আমি নিজের মধ্যে অবশিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতি শেষ কয়েক বিন্দু শ্রদ্ধাও হারালাম। বরং, আমার এখন করুণা হতে লাগলো।

রাষ্ট্র কখনোই চাইলেও ব্যক্তির মনন বা নৈতিকতায় আঘাত করতে পারে না, পারে শুধু তার শরীরকে, তার ইন্দ্রিয়গুলোকে শাস্তি দিতে। রাষ্ট্রের অস্ত্র উন্নততর বুদ্ধি বা মনন নয়, বরং রাষ্ট্রের শক্তি হচ্ছে শারিরীক এবং বস্তুগত। কিন্তু আমার জন্ম তো কারও শক্তির প্রদর্শনী দেখার জন্য হয়নি। আমার জন্ম হয়েছে নিজের মত করে চলার জন্য, নিজের মত করে শ্বাস নেয়ার জন্য। চলুন দেখি কার শক্তি বেশি। তারা আমাকে শুধু তাদের মত বানাতে জোর করতে পারে, কারণ তারা মনে করে তারা আমার চেয়ে উচ্চতর মানব। কিন্তু আমি কিভাবে জীবনযাপন করবো তা কেন তারা ঠিক করে দিবে? এটা কোনো বাঁচার মত বাঁচা হতে পারে না। তাই সরকার আমাকে “তোমার টাকা আমার, তোমার জীবন তোমার” এটা বলার সাথে সাথেই আমি তাকে আমার টাকা দিয়ে দিবো? রাষ্ট্র আর্থিক সংকটে থাকতে পারে, কিন্তু আমি কিভাবে কিংবা কেন তাকে সাহায্য করবো? রাষ্ট্রের নিজেরই নিজেকে সাহায্য করতে হবে। নাগরিকদের দরজায় দরজায় গিয়ে নাকিকান্না করে লাভ নেই। সমাজের সঠিকভাবে ক্রিয়া করা বা না করার জন্য তো আমি দায়ী নই। আমি এবং সরকার দুটো আলাদা স্বত্ত্বা। আপনি যদি একটি ভূট্টার চারা আর একটি কাজুবাদামের চারা পাশাপাশি রাখেন তবে তারা কি একে অন্যকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে? নাকি তারা নিজেদের মত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজে বেড়ে ওঠার জন্য? যদি একটি চারা এর প্রকৃতি অনুসারে পরিবেশ না পায় তবে এটি মারা যায়, মানুষের ক্ষেত্রেও এমনই হয়।

কারাগারে কাটানো রাতটি ছিল আমার জন্য একেবারে নতুন এবং কৌতূহলপূর্ণ। আমি যখন কারাগারে প্রবেশ করি অন্যান্য কারাবাসীরা তখন খোশ মেজাজে সন্ধ্যার বাতাস উপভোগ করছিল আর গল্প করছিল। আমি আমার কামরায় ঢোকা মাত্রই কারারক্ষী দরজায় তালা দিয়ে চলে গেল, আমি দূরে তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে শুনলাম। আমার কামরায় যে কয়েদী আগে থেকেই ছিলেন তিনি বেশ বন্ধুসুলভ এবং আমাকে আমার হ্যাট রাখার স্থান দেখিয়ে দিলেন। কামরাটিতে খুব অল্প কিছু আসবাব ছিল। কামরাগুলোকে মাসে একবার পরিষ্কার করা হত বলে জানলাম। আমার কয়েদী বন্ধুটি স্বাভাবিকভাবেই আমার বাসস্থান এবং গ্রেপ্তার হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। আমি তাকে জানালাম এবং তার কাছেও একই বিষয়ে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন তাকে একটা শস্যাগার পুড়ানোর অপরাধে এখানে আনা হয়েছে কিন্তু তিনি আসলে নির্দোষ— তিনি মাতাল অবস্থায় ওই শস্যাগারের কাছে গিয়ে তার পাইপে আগুন দিয়ে তামাক খেয়েছিলেন, সেখান থেকেই দুর্ঘটনাক্রমে শস্যাগারটি পুড়ে যায়। তিন মাস পর তার শুনানি আছে এবং তিনি এই জেলজীবনে অনেকটা সুখীই আছেন বলে মনে হলো। ঘরের দুটি জানালার মধ্যে তিনি একটায় বসলেন, আরেকটায় বসলাম আমি। যদি কেউ বেশি দিনের জন্য জেলে থাকে তবে তার একমাত্র কাজ হবে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা। আমি আমার বন্ধুর কাছে থেকে যতটা সম্ভব তার সম্পর্কে জেনে নিলাম কারণ এরপর তার সাথে আমার আর কখনো দেখা নাও হতে পারে।

এটি ছিল কোন সুদূর গ্রামে যাত্রার মতন, সেই গ্রাম যেখানে আমি রাত কাটানো তো পরের কথা, কোনোদিন বেড়াতে যাবো বলেও ভাবিনি। মনে হচ্ছিলো আমি এর আগে কখনও নগরীর কেন্দ্রীয় ঘড়ির শব্দ কিংবা গ্রামে নেমে আসা রাতের শব্দ শুনিনি। আমরা জানালা খুলে শুয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি হয়তো মধ্যযুগে আমার গ্রামে ফিরে এসেছি, আর আমাদের কনকর্ড নদী মধ্যযুগের রাইন নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে আর আমি জানালা দিয়ে রাতের পথচারীদের শব্দ পাচ্ছি। সকাল বেলা একটি টিনের চারকোণা প্লেটে দুই টুকরা পাউরুটি আর এক টুকরা চকোলেট এলো আমাদের সকালের খাবার হিসেবে। আমার বন্ধুটি পাশের একটি ক্ষেতে কাজ করতে যায়, আজ যাওয়ার আগে সে আমাকে বিদায় জানিয়ে গেলো কারণ তার মনে হয়েছিল সে ফিরে এসে আমাকে দেখতে পাবে না।

আমাকে যখন ছেড়ে দেওয়া হলো তখন জানতে পারলাম আমার পক্ষ থেকে কেউ একজন আমার মাথট করের অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে। বের হয়ে দেখি যারা যুবক বয়সে জেলে ঢুকে আর চুল পাকার পর বের হয় তাদের তুলনায় আমার কোনো পরিবর্তনই হয়নি। কিন্তু তারপরও আমার চোখে আমার চারপাশটা বদলে গেছে। আমি আমার প্রদেশ, আমার শহর, আমার গ্রাম, আমার আশেপাশের মানুষ সবকিছু আরও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমি যাদের সাথে বসবাস করি তারা প্রতিবেশী হিসেবে, কিংবা বন্ধু হিসেবে কতটা ভালো হতে পারে— তারা বসন্তের কোকিলের মত, তারা কেউই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে আগ্রহী নয়। তাদের অন্ধ বিশাস ও কুসংস্কারের কারণে তারা আমার থেকে একটি আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছে; চৈনিক এবং মালয় জাতির মত, দেখতে অনেকটা একই হলেও বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে আলাদা। আমার প্রতিবেশীরা সত্যের জন্য নিজেদের কোনোকিছুকে ঝুঁকিতে রাখতে চায় না।

কিছুদিন পূর্বে আমাদের গ্রামে একটা রেওয়াজ ছিল— যখন কোনো ব্যক্তি কারাগার থেকে ফেরত আসত তখন সবাই তার সাথে দেখা হলেই নিজেদের আঙ্গুলগুলো চোখের সামনে ক্রসাকারে ধরে কারাগারের শিকের মত একটা অবয়ব তৈরি করে সেই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে তাকে দেখত। আমাকে দেখে তারা তেমন কিছু করলো না, বরং তারা একবার আমার দিকে দেখে, একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, যেন আমি দীর্ঘকাল পরে গ্রামে ফিরে এসেছি। যখন আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমি আমার জুতা প্রস্তুতকারকের কাছে যাচ্ছিলাম আমার জুতাটা মেরামত করাতে। পরদিন সকাল বেলা যখন আমি ছাড়া পেলাম তখন সবার আগে ওই জুতার দোকানে গিয়ে আমার কাজ সারলাম এবং সেখান থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকা হ্যাকলবেরি গাছেদের সাথে দেখা করতে রওয়ানা হলাম। আধা ঘণ্টা ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে গেলাম শহর থেকে দুই মাইল দূরে বিশাল এক হ্যাকলবেরি ক্ষেতে। এই হচ্ছে আমার কারাগারের গল্প।

আমি কখনও হাইওয়ে কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানাইনি কারণ আমি যতটা একজন খারাপ নাগরিক হতে চাইতাম ঠিক ততটাই চাইতাম একজন ভালো প্রতিবেশী হতে। এবং এর অংশ হিসেবে আমি এখন আমার এলাকাবাসীকে শিক্ষিত করার জন্য একটা স্কুল চালাচ্ছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি কোনো একটা নির্দিষ্ট করকে ঘৃণা করি, বরং আমি কর না দেয়ার মাধ্যমে আমার অবাধ্যতা প্রকাশ করতে চাই, সরকারের কার্যক্রম থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে চাই। আমার সরকারকে দেয়া টাকা কোথায় যায় বা কোন পথে ব্যয় হয় তা আমার মাথা ব্যাথার বিষয় না, কিন্তু সরকারের অন্যায় কার্যক্রমের প্রতি আনুগত্যের কি প্রভাব হতে পারে সেটা আমার চিন্তার বিষয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার করের টাকা জনগণের শিক্ষায় ব্যয় হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নির্দোষ, কিন্তু আমার করের টাকায় যদি বিদেশে যুদ্ধ করার খরচ চালানো হয় তবে আমি অপরাধী। আসলে আমি এভাবে আমার নিজের মত করে রাষ্ট্রের সাথেই যুদ্ধ ঘোষণা করছি।

আমি যে কর দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি অন্য কেউ যদি সেই কর রাষ্ট্রের প্রতি সমবেদনা থেকে দেয় তবে রাষ্ট্র যে অন্যায় করছে তার থেকেও বড় অন্যায় করদাতা করছে। আর কেউ যদি নিজে কারাবন্দী হওয়া এবং নিজের সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ এড়াতে কর দিয়ে থাকে তবে সে অজ্ঞতার শিকার এবং বোঝেনা যে সে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে সমাজের অনেক বড় ক্ষতি করছে। এই হলো বর্তমানে আমার অবস্থান। তবে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই খুব সচেতন থাকতে হবে যেন তার কাজগুলো পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা অযৌক্তিক না হয়ে যায়। তিনি যেন শুধু নিজের বিষয়গুলোতেই বিদ্রোহ করেন, অন্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে এই মানুষগুলো এমন কেন; তারা মনে হয় আসলে অজ্ঞ, তারা যদি জানতো কিভাবে ভালো করতে হয় তবে তারা অবশ্যই করতো। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমিও আমার ব্যক্তিত্ব ভুলে তাদের মতো হয়ে যাবো। আবার, আমি ভাবি যখন সরকার কোনো রকম ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা অসদিচ্ছা ছাড়াই আমি সহ আরও হাজার হাজার মানুষের কাছে বছরে মাত্র ক’টা টাকা চাচ্ছে, শুধু শুধু সেটা দিতে অস্বীকার করে সরকারের হিংস্রতার কাছে নিজেকে সঁপে দিবো কেন? আমি তো ক্ষুধা বা শীত রোধ করতে পারি না, ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস রোধ করতে পারি না, এরকম আরও অনেক দুর্যোগের নিকট আমি নিজেকে ছেড়ে দিই। তাহলে সরকারের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো আমি সরকার এবং সহিংসতাকে কেবল একটি হিংস্র শক্তি হিসেবেই দেখি না, বরং একটি মনুষ্য শক্তি হিসেবেও দেখি আর মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের কাছে কিছু চাওয়ার অধিকার আমার আছে। আমি যদি আগুনের মধ্যে হাত দিই, আগুনের কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই, আগুন আমার কথা শুনবে না, কিন্তু যদি মানুষ হিসেবে সরকারের কাছে কিছু চাই, তবে সরকার তা অন্তত বিবেচনা করবে কারণ সরকারও মানুষ নিয়েই তৈরি। তাছাড়া আগুনে হাত দেয়ার জন্য আমি আগুনকে দোষ দিতে পারি না, দোষ তো আমার কারণ আমি নিজেই আগুনে হাত দিয়েছি। আমি যদি আস্বস্ত হতাম যে আমার প্রতিবেশীরা এই আগুনের মতোই আমার কথা শুনবে না তবে আমি তাদের কাছে কিছু চাওয়া ছেড়ে দিতাম আর একজন পাক্কা মুসলমানের মত বলতাম এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। আর রক্ত-মাংসের মানুষ এবং যেকোনো হিংস্র বা প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে পার্থক্যই হলো রক্ত-মাংসের মানুষের বিরোধিতা করলে কিছু না কিছু ফল পাওয়া যায়; আমি অর্ফিউসের মতন আশা করতে পারি না যে আমার জন্য আকাশ,বাতাস, জঙ্গল, জন্তু সবকিছু তাদের প্রকৃতি বদলে ফেলবে।

আমি কোনো মানুষ বা কোন জাতির সাথে বিবাদে জড়াতে চাই না; কিংবা চুলচেরা বিশ্লেষণের মহড়া দেখিয়ে নিজেকে অন্যদের চেয়ে ভালো প্রমাণ করতে চাই না। আমি আসলে দেশের আইন মেনে চলতেই চাই, আমি আইন মেনে চলতে অনেক বেশি আগ্রহী এবং প্রত্যেক বছর যখন সরকারের লোক আমার দরজায় কর নিতে আসে তখন আমি প্রত্যেকবারই ভাবি আমার অবস্থান পাল্টে নিবো।

“আমাদের প্রত্যেকেরই দেশকে ভালোবাসা উচিৎ,
যেমন আমরা আমাদের বাবা-মাকে ভালোবাসি,
দেশকে সম্মান দেয়া এবং দেশের জন্য কাজ করা উচিৎ;
চিত্তে নীতি ও বিবেক লালন করা উচিৎ,
দেশকে ভালোবাসা উচিৎ কোনো স্বার্থের চিন্তা না করেই।” (জর্জ পীলের আলকাযার যুদ্ধ  থেকে উদ্ধৃত)

আমার মনে হয় রাষ্ট্র খুব শীঘ্রই আমার হাত থেকে আমার এই ধরণের লেখাগুলো বাজেয়াপ্ত করবে, তখন আমিও হয়তো আমার প্রতিবেশীর মতই তথাকথিত একজন দেশপ্রেমিক হবো। আসলে, এক দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের সংবিধান অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও খুবই ভালো একটি সংবিধান; আমাদের আইন ও আদালত খুবই মর্যাদাবান; এমনকি এই আমেরিকা এবং এর সরকারও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসাযোগ্য আর অন্য সবার মতই এসবের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে আরও গভীরভাবে দেখতে গেলে এই সরকার কি আদৌ একজন নীতিবান ব্যক্তির সম্মান পাবার যোগ্য?

যা-ই হোক, আমি সরকার নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নই এবং আমার চিন্তাশক্তির খুব অল্পই আমি এর পেছনে ব্যয় করি। এই পার্থিব জগতেও আমি খুব বেশি সময়ের জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল হই না। যদি একজন মানুষ তাঁর চিন্তা, বুদ্ধি ও মননে স্বাধীন থাকেন, তবে নির্বোধ ও নীতিহীন সরকার তাঁর খুব একটা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে না।

আমি জানি অধিকাংশ মানুষই আমার থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করে; তবু যারা পেশাগতভাবে সরকার কিংবা আইন নিয়ে কাজ করতে বাধ্য তারা আমাকে খুবই হতাশ করে। রাষ্ট্রীয় আমলা অথবা আইনপ্রণেতাগণ, যারা সরকারের একেবারে প্রথম শ্রেণীর লোক, তারা কখনোই সরকারের সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। তারা সমাজ সংস্কারের কথা বলে, কিন্তু সমাজের কি সংস্কার করতে হবে সে ব্যাপারে তাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। তারা হয়তো অনেক অভিজ্ঞ ও সম্মানিত ব্যক্তি এবং অবশ্যই দেশ চালানোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারী কিছু পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করেছেন যার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ দিই, কিন্তু তাদের বুদ্ধি ও দক্ষতা খুবই সীমাবদ্ধ একটি পরিসরে কাজে আসে। তারা খুব হাসিমুখেই ভুলে যায় যে শুধুমাত্র কর্মপন্থা আর দক্ষতা দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। ড্যানিয়েল ওয়েবস্টার কখনোই সরকার পরিচালনায় ছিলেন না বলে তিনি সরকারের নীতিমালা সম্পর্কে অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন না। তাঁর কথাগুলো সেইসব আইনপ্রণেতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা প্রকৃতপক্ষে কোনো সংস্কার চায় না; কিন্তু যাঁরা চিন্তক এবং গুরুত্বপূর্ণ আইনজ্ঞ, তাঁরা ওয়েবস্টারের কথা গ্রাহ্যও করেন না। আমি এমন কিছু লোক সম্পর্কে জানি যাঁরা খুব সহজেই ওয়েবস্টারের নীতিদর্শনকে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। তবু অন্যান্য রাজনীতিবিদদের ভয়ানক অজ্ঞতা, সস্তা জ্ঞান, আর অস্বচ্ছ প্রকাশভঙ্গীর সাথে তুলনা করলে ওয়েবস্টারের দর্শন অনেক মূল্যবান এবং আমি এর জন্য ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ। তিনি সবসময় তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী, মৌলিক এবং সর্বোপরি, প্রাসঙ্গিক। তার সবচেয়ে বড় গুণ তার জ্ঞান নয়, বরং তার বুদ্ধিমত্তা। একজন আইনবিদের সত্য প্রকৃত সত্য নয়, বরং একজন আইনবিদের জন্য প্রকৃত সত্য হছে শব্দের ধারাবাহিকতা। সত্যের তার নিজের সাথেই একটি বোঝাপোড়া থাকে— সত্য ন্যায় বা অন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয় না, সত্য সত্যই। ওয়েবস্টার প্রকৃত অর্থেই সংবিধানের রক্ষাকারী। তাই তাকে আক্রমণ করা যায় না, শুধুই তার পক্ষ নেয়া যায়। সে কোনো নেতা নয়, বরং সে একজন অনুসারী, ’৮৭ এর নেতাদের অনুসারী। সে বলে, “আমি আমেরিকার উৎপত্তির সময়ের মূলনীতিগুলোকে নষ্ট করার কখনো চেষ্টা করিনি, কিংবা চেষ্টা করার প্রস্তাবও দেই নি; এবং সেই নীতিগুলোর উপর ভিত্তি করেই আজকের ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত”। তবু সংবিধানের যে অংশ দাসপ্রথাকে বৈধতা দেয় সে সম্পর্কে তার বক্তব্য, “যেহেতু এইটা মূল সংবিধানে আছে, একে সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই”। তার এই অবস্থান তার বুদ্ধিমত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এবং এক মুহূর্তের জন্যও সে কোনো ঘটনাকে এর রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো থেকে আলাদা করে তার নিজের বিবেক দিয়ে দেখতে পারেনি বা বর্তমান সময়ে দাসপ্রথার সাথে আমেরিকার কি ধরণের সম্পর্ক হওয়া উচিৎ তা নিয়ে ভাবেনি। তার কাছ থেকে তাহলে কি ধরণের সামাজিক সংস্কার আশা করা যাবে? সে বলেছে, “যেসব রাজ্যে দাসপ্রথা চালু আছে তারা কিভাবে দাসত্বের নীতিমালা নির্ধারণ করবে তা একান্তই সেই প্রদেশের সরকারের বিষয়, সেই রাজ্য ব্যতীত অন্য কোনো রাজ্য এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে না। তারা আমার কাছ থেকে কোনো ধরণের সহযোগিতা বা উৎসাহ পায়নি, পাবেও না”।

যারা সত্যের পবিত্রতর কোনো উৎস সম্পর্কে জানেনা, যারা সত্যকে একটা ছোট ঝিরি হিসেবে আবিষ্কার করে, তারা পবিত্র বাইবেল আর সংবিধানকেই সত্যের একমাত্র উৎস ভেবে সেখান থেকে পান করে নিজের তৃষ্ণা মেটায়; যারা বুঝতে পারে যে এটা একটা ঝিরি, এখানে অন্য কোথাও থেকে পানি এসে জমা হয় মাত্র, তারা তাদের সত্যের অন্বেষণ চালিয়ে যায় এবং এক সময় ঝিরির মুখ আর পানির প্রকৃত উৎস আবিষ্কার করে।

আমাদের আইন বিধায়কগণ এখনও একটি জাতির জন্য অবাধ বাণিজ্য, মুক্ত বাজার এবং সততার গুরুত্ব বুঝেনি। কর ধার্যকরণ, বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং কৃষির মত অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়গুলোতেও তাদের তেমন কোনো প্রতিভা নেই। আমরা যদি আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে শুধুমাত্র আইনজ্ঞদের উপদেশই অনুসরণ করি এবং নাগরিকদের সুপরামর্শ গ্রহণ না করি তবে অচিরেই আমরা বিশ্ব দরবারে আমাদের সম্মান হারাবো। যদিও হয়তো আমার এটি বলার অধিকার নেই তবু বলি— আজ থেকে প্রায় ১৮০০ বছর আগে পবিত্র বাইবেল লেখা হয়েছে, তবু আজ পর্যন্ত আইন তৈরি ও প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে উল্লেখযোগ্য এবং বাস্তব কোনো জ্ঞান উৎপাদিত হয়নি কেন?

একটি শাসকের শাসনের যথার্থতা শাসিতের সম্মতি ও অনুমোদনের উপর নির্ভর করে। আমি এমন এক সরকারের প্রতি সহাস্যে আনুগত্য প্রকাশ করবো যে সরকার আমার চেয়ে বিজ্ঞ ও দক্ষ, এবং সর্বোপরি আমার চেয়ে বেশি ন্যায়পরায়ণ। আমার স্বত্বা ও সম্পত্তির উপর সরকারের কোনো অধিকার থাকতে পারে না যদি আমি নিজে সেই অধিকার না দিই। চরম রাজতন্ত্র থেকে সীমিত রাজতন্ত্র, এবং সীমিত রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা ক্রমশ ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব অনুধাবন করার যাত্রা। চৈনিক চিন্তাবিদরাও সাম্রাজ্যের গাঠনিক একক এবং মূল উপাদান হিসেবে ব্যক্তিকেই চিহ্নিত করেছিল। গণতন্ত্রই কি সরকার ব্যবস্থার সর্বশেষ পরিণতি? এর চেয়ে উন্নততর কোনো পদ্ধতি কি আবিষ্কার হবে না? একজন ব্যক্তিমানুষের অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়ার পথে কি আমরা আরও একটি ধাপ এগিয়ে যেতে পারি না? একটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন এবং সফল রাষ্ট্র ততদিন হওয়া সম্ভব না যতদিন রাষ্ট্র ব্যক্তিকে একটি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ও উচ্চতর শক্তি এবং সর্বোপরি, রাষ্ট্রের ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকার না করে। শেষ পর্যন্ত আমি এক রাষ্ট্র কল্পনা করি যা সকল নাগরিকের প্রতি সমানভাবে আচরণ করবে, এবং সকল ব্যক্তিমানুষকে তার নিজের প্রতিবেশীর মতই সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে; এমনকি যারা রাষ্ট্র থেকে দূরে থাকবে তাদের প্রতিও রাষ্ট্র বৈরীতা প্রকাশ করবে না এবং তার কাজে বাধা দিবে না, বরং প্রতিবেশীর মতোই তাকে আলিঙ্গন করবে। যে রাষ্ট্র এই রকমের একটি বৃক্ষ তৈরি করতে পারবে এবং সেই বৃক্ষের ফল পরিপক্ক হওয়া মাত্রই তা নাগরিকদের হাতে তুলে দিতে পারবে, সেই রাষ্ট্রই একটি নিখুঁত ও মহিমান্বিত রাষ্ট্রে পরিণত হবে যা আমি প্রতিনিয়তই কল্পনা করি, কিন্তু আজও বাস্তবে কোথাও দেখিনি।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *