ফৌজদারি মানহানি থেকে সাইবার মানহানি: স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চর্চার আদ্যপান্ত

  • ইয়ামিন রহমান ও রিয়াসাত আজমি

১. সূচনা

উপনিবেশ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ তার চরম দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হলেও, এই একুশ শতকেও এদেশে ফৌজদারি মানহানির চর্চা অব্যাহত রয়েছে, যখন কিনা আন্তর্জাতিকভাবে আইনকানুন ধীরে ধীরে নিবারণমূলক দণ্ডবিধি থেকে সরে আসছে। এই রচনায় দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে ফৌজদারি মানহানি এবং সাইবার মানহানির যে আইনকানুন রয়েছে, সেসব ঔপনিবেশিক চেতনাকে লালন করে এবং আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে সেগুলো শোচনীয়ভাবে অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে।

পূর্বতন উপনিবেশগুলোতে টিকে থাকা ঔপনিবেশিক আইনকানুন এখন বাক-স্বাধীনতার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকাংশেই। এই ধরনের ঔপনিবেশিক আইনকানুন, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে দুই ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করেছে: ক. ভারতের মানুষের বৈচিত্র নিয়ে যে জৈব-রাজনীতি তারা চালু করে দিয়েছিল তা মানুষে মানুষে বিভক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, খ. ইংরেজ আইনের ভারতীয়করণ, বিশেষ করে নিবারণমূলক দণ্ডবিধি এই বিভক্তি এবং ধর্ম ও বর্ণপ্রথা থেকে উদ্ভুত সমস্যাগুলোকে সমর্থন করেছে। ভারতের গণপরিষদের সভাতেই এইসব আইনের এ ধরনের চরিত্র নিয়ে শংকা প্রকাশ করা হয়েছিল এবং সন্দেহ করা হয়েছিল যে, লাইবেল, স্ল্যান্ডার, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং এই ধরনের আইনকানুনগুলোর উপরে বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না।

অথচ, ফৌজদারি মানহানির বৈধতা নিয়ে সাম্প্রতিককালে ভারতে ওঠা চ্যালেঞ্জটির শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। সুব্রামানিয়াম স্বামী বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (২০১৬) মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৯ এবং ৫০০ ধারাকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। এই রায় সন্দেহাতীতভাবে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে বাক-স্বাধীনতার চর্চার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

অপরদিকে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার করে ফৌজদারি মানহানিকে বিলুপ্ত করতে আহবান করছে, যার মধ্যে জাতিসংঘেরর মানবাধিকার কমিটিও রয়েছে। রাষ্ট্রগুলোকে এই কমিটি মানহানির বিফৌজদারিকরণ করতে আহবান জানিয়েছে।

বাংলাদেশও পুরোনো ঔপনিবেশিক মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের আইন থেকে বেরোতে পারেনি। ফৌজদারি মানহানি এখনো এইদেশে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর একুশ অধ্যায়ে বলবৎ আছে। এছাড়াও দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এর মতো আরও গুরুতর ধরনের ফৌজদারি মানহানিমূলক অপরাধও বলবৎ রয়েছে। উপরন্তু, ফৌজদারি মানহানি এদেশের সাইবার আইনগুলোতেও দুই দফায় ঢুকানো হয়েছে – প্রথমবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারায় এবং দ্বিতীয়বার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮ এর ২৫, ২৯ সহ বিবিধ ধারায়। যদিও পরে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩২ ধারায় ৫৭ ধারারই গুঁড়ো গুঁড়ো অংশ বিভিন্ন নামে বলবৎ হয়েছে।

এই রচনা ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে চার ধরনের মানহানিকে বিশ্লেষণ করেছে, সেগুলো হল সাধারণ মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং সাইবার মানহানি (অধ্যায় ২)। এরপর এটি আন্তর্জাতিক আইনের মানদন্ডের সঙ্গে দেশীয় বর্তমান আইনগুলোর মান তুলনা করেছে (অধ্যায় ৩)। সবশেষে, এটি ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সামনে রেখে এইসব আইনকানুনগুলোর আগ্রাসী চরিত্রকে চিহ্নিত করেছে (অধ্যায় ৪) এবং মানহানিকে বিফৌজদারিকরণের পরামর্শ দিয়েছে (অধ্যায় ৫)।

সাইবার এটাক; ওসামা হাজ্জাজ; কার্টুন মুভমেন্ট

২. বাংলাদেশী আইনে ফৌজদারি মানহানির ধারণা

২.১. দণ্ডবিধির অধীনস্থ সাধারণ মানহানি

ইংরেজি আইনের নিয়ম অনুযায়ী, শুধু লিখিত আকারে কেউ কোনোকিছু প্রকাশ করলে তবেই তা ফৌজদারি মানহানি হতে পারে। মুখে বলা কথা শুধু দেওয়ানি প্রতিকারের উপযোগী হতে পারে। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর প্রবক্তা, লর্ড মেকলে এই নীতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন, “লিখিত মানহানি হয়তো একটা চিঠিতে লেখা হতে পারে যা হয়তো একজনের নজরেই আসতে পারে। কিন্তু ভরা মজলিসে, হাজার লোকের সামনে মুখে বলা কথায় মানহানি হতে পারে।”

দণ্ডবিধি প্রণয়ণের সময়, প্রবক্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মানহানিকে “অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন হবে, এক্ষেত্রে এর অবৈধ সহিংসতা সংঘটনের প্রবণতা কোনো পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে না।” কমিশন ঠিক করে যে, ইংরেজি আইনে যে ধরনের পার্থক্য করা হয়েছে “সে ধরনের পার্থক্য এখানে না করাই সমীচীন হবে।”

বাংলাদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঐ একই দণ্ডবিধি পাকিস্তানের সূত্রে পাওয়ার পরে১০ একই চেতনাকে আজও বয়ে নিয়ে চলেছে। মজার কথা হল, মানহানির বেলায় কিন্তু ফৌজদারি এবং দেওয়ানি, দুই ধরনের প্রতিকারই রয়েছে, এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে একইসাথে দুই ধরনের মামলাই করতে পারেন। দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা এরকম:

কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা তার খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হবে বলে জানা সত্ত্বেও বা তার বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও কথিত বা পঠিত হওয়ার জন্য অভিপ্রেত কথা বা চিহ্ন কর্তৃক বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে সে ব্যক্তি সম্পর্কিত কোন নিন্দাবাদ প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তবে নিম্নে নির্দেশিত ব্যতিক্রমসমূহ ছাড়াই অন্যান্য ক্ষেত্রে, সে ব্যক্তি উক্ত অন্য ব্যক্তির মানহানি করে বলে পরিগণিত হয়।১১

একই আইনের ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তির কথা বলা হয়েছে:

কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির মানহানি করে, তবে উক্ত ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।১২

এছাড়াও দণ্ডবিধি এরপর মানহানির কোনো মানহানিকর বক্তব্য মুদ্রণকারী, প্রকাশক, খোদাইকারী১৩ এবং এমনকি বিক্রেতার উপর দায় এবং শাস্তি আরোপ করেছে।১৪

তবে, এ.কে.এম এনামুল হক বনাম মোঃ মিজানুর রহমান এবং অন্যান্য (১৯৯২)১৫ মামলায় আদালত বলেন যে, উচ্চারিত শব্দের বাচনভঙ্গী পরিষ্কারভাবে দাম্ভিক, নিষ্ঠুর অথবা অসম্মানজনক হলেও, কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে না। এসব সাধারণভাবে বিষোদগার বলে প্রতীয়মান হয়, এবং তা কেবলমাত্র ঘটনা পরম্পরায় বিষোদগার হিসেবেই প্রতীয়মান হয়, কোনো জুগুপ্সার পর্যায়ে পড়ে না। মানহানি হতে হলে, আদালতের মতে “মানহানিকর শব্দগুলোতে অবশ্যই যে ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, ওইসব কথা বলা হলে ওই ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এমন উদ্দেশ্যে বিষোদগারের অস্তিত্ব থাকতে হবে।”১৬

উপরোক্ত বিধানগুলোর অধীনে প্রতিকার ছাড়াও, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে দেওয়ানি আদালতেও ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। বাংলাদেশে মানহানির দেওয়ানি প্রতিকারের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নীতি রয়েছে এবং সেই নীতিটি হল সঠিক ক্ষেত্রে মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করা যাবে। তবে, ইংরেজি কমন ল-এর নিয়মকানুন মেনে, দেওয়ানি দায় নির্ধারণ করতে হবে, অথবা ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার এবং সুবোধের নীতি অনুসরণ করতে হবে।১৭ দেওয়ানি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৯ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করা যাবে।১৮

সিভিল রং (wrong) হিসেবে ক্ষতিপূরণের মামলা করা হলেও এতে ফৌজদারি মামলা করার অধিকার বাতিল হয়ে যায় না, কারণ দণ্ডবিধিতে মানহানির যে বিধানগুলো রয়েছে সেগুলো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে একইসঙ্গে দুই ধরনের প্রতিকার চাওয়া থেকে বারণ করে না। এক্ষেত্রে একটি প্রতিকার অপর প্রতিকারের বিকল্প নয়।১৯

তবে, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৯৮ ধারা অনুযায়ী: “সংশ্লিষ্ট অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নালিশ ব্যতীত কোন আদালত দণ্ডবিধির ২১ অধ্যায়ের অধীন কোন অপরাধ আমলে নিবেন না।”২০

দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় চারটি ব্যাখ্যা এবং দশটি ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে। আইনটি এই ব্যতিক্রমগুলোকে মোটাদাগে দুটি শিরোনামে ভাগ করেছে – জনস্বার্থে ‘সত্য কথা বলা’ এবং ‘সরল বিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ’।

বিভিন্ন মামলা থেকে দেখা যায় যে, মানহানির মামলার বেশীরভাগই করা হয়েছে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এবং মামলাগুলো সাধারণত করেছেন রাজনৈতিক নেতারা, সরকারি আমলারা। এই মামলাগুলোতে খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তি হতে দেখা যায়। তবে, ফৌজদারি মানহানির যে চরিত্র এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার যে চর্চা তাতেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ এই দীর্ঘসূত্রিতাই যেন এক ধরনের শাস্তির মতো কাজ করে থাকে।২১ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরাজউদ্দিন এবং অন্যান্য বনাম ফকরুজ্জামান এবং অন্যান্য (১৯৯৫)২২ মামলায়, লাকসামের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৫০১ ধারায় অভিযোগ দায়ের করেন। সময়টা ছিল হুসেন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক আইনের সময়। অভিযোগাকরীর বক্তব্য অনুযায়ী, ৫-১০-১৯৮৯, ১২-১০-১৯৮৯ এবং ১৯-১০-১৯৮৯ তারিখে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “কে বেশী শক্তিশালী – রাষ্ট্রপতি নাকি মন্ত্রী?” শিরোনামে খবর প্রকাশ হয়। রাষ্ট্রপক্ষ দাবী করেন যে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের ফলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ, বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন বোর্ড, সেইসঙ্গে অভিযোগকারীর মানহানি হয়েছে এবং এ ধরনের বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে জনগণের সামনে তাঁদের হেয় করা হয়েছে। তবে, সরল বিশ্বাসে মতামত দেওয়া হয়েছে মর্মে হাইকোর্ট অভিযোগটি বাতিল করে দেন।

শাহাদাত চৌধুরী বনাম আতাউর রহমান (১৯৯৬)২৩ মামলায়, সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক অভিযুক্ত আবেদনকারী শাহাদাত চৌধুরী জনৈক আমলার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেন। আবেদনকারী দেখান যে দুর্নীত-দমন ব্যুরো ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়েছিল। তারা একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। আদালত এই বলে অভিযোগটি বাতিল করে দেন যে, বাদী উক্ত প্রতিবেদনটিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

একই ধরনের আরও অসংখ্য মামলার নাম উল্লেখ করা যায়, যেমন: কমর উদ্দিন চৌধুরী বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য (২০১৮)২৪, শফিকুর রহমান এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র (২০১২)২৫, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য (২০০১)২৬, আফজাল হোসেন বনাম এস.এম. সেলিম ইদ্রিস (১৯৯৫)২৭

উপরোক্ত বিধানসমূহ ছাড়াও, কোনো ক্ষতিকর বা অশ্লীল বিষয় সংবলিত কোনো প্রতিবেদন বা ম্যাগাজিন লিখলে, ছাপালে, প্রকাশ করলে, বিতরণ করলে, বা বিক্রয় করলে তা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ১৬ ও ১৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হত। তবে, সাংবাদিকদের আন্দোলনে, এই দুটি ধারা বিশেষ ক্ষমতা (সংশোধনী) আইন ১৯৯১২৮-এর মাধ্যমে বাতিল করা হয়।২৯ তখন থেকেই, দণ্ডবিধির ধারাগুলোই মানহানির ফৌজদারি বিধান হিসেবে রয়ে গেছে।

২.২. রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত

রাষ্ট্রদ্রোহ লাইবেলের একটা গুরুতর প্রকার যা ঘৃণা, অবমাননা বা সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের জন্য প্রকাশিত বা প্রকাশের অভিধার কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে।৩০ রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো প্রকাশনা কোনো বিদ্রোহ বা কোনো ধরনের উপদ্রব সৃষ্টি করেছে কিনা সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনো বিদ্রোহ উস্কে দিয়ে থাকে বা উপদ্রব সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে সেই কাজটি সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় পড়ে।৩১ রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যেকোন কম মেয়াদের কারাদণ্ড, যার সঙ্গে জরিমানাও প্রযোজ্য হতে পারে, বা জরিমানা সহ বা জরিমানা ব্যতিরেকে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড।৩২

রাষ্ট্রদ্রোহের ইতিহাসও যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক। ১৮৩৭ সালে ভারতীয় আইন কমিশন যে খসড়া তৈরি করেছিল সেখানে এই বিষয়ে বিধান ছিল, এবং তারা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে একে সংযোজন করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ১৮৬০ সালে যে দণ্ডবিধি তৈরি করা হয় সেখানে অজ্ঞাত কারণে এটি বাদ রাখা হয়। ১৮৭০ সালে, ভারতীয় দণ্ডবিধি (সংশোধনী) আইন এর মাধ্যমে ১২৪ক ধারা সংযোজিত হয়।৩৩

এছাড়া, দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় আরও এক ধরনের ফৌজদারি লাইবেল আছে যার হল শিরোনাম ‘কোন শ্রেণি বিশেষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে উক্ত শ্রেনীর ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বা হিংসাত্মক কার্য’। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দের কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অণুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ও হিংসাত্মকভাবে লিখিত বা উচ্চারিত কথা কর্তৃক বা দৃশ্যমান কোন বস্তু কর্তৃক সে শ্রেণির ধর্মকে বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অপমানিত করার চেষ্টা করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অধবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।৩৪

এই ধারাটিও দণ্ডবিধিতে পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে যুক্ত করা হয়। এই ধারাকে ঘিরে বিচিত্রসব মামলা রয়েছে যেগুলো সমাজে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মামলার দুষ্টচক্রে জর্জরিত করেছে।

এ ধরনের একটা মামলা হল শামসুদ্দিন আহমেদ বনাম রাষ্ট্র (২০০০), যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ দাবী করে যে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটা গল্প মুসলিম হিসেবে তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করেছে। হাইকোর্ট প্রকাশনাটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে:

এখানে আসলে সারাদেশে প্রচলিত, বিশেষ করে কম শিক্ষিত এবং অর্ধ-শিক্ষিত উদ্মাদ মোল্লা এবং ফতোয়াবাজদের সংকীর্ণ ব্যাখা বা বিকৃত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে। পুরো শিরোনাম এবং প্রকাশনাটি পড়ালে বোঝা যায় যে, এর অন্তর্নিহিত এবং সত্যিকার অর্থ কোনোভাবেই কোনো মুসলিমের অনুভূতিকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে বা পবিত্র কোরআনের দাবীকৃত সূরার অর্থকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি।৩৫

একই ধরনের আরও একাধিক মামলার নজির পাওয়া যায় যেখানে আদালত অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে পাননি, তাই বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু, এসব মামলার একটা উল্লেখযোগ্য প্রভাব সমাজের উপর পড়েছিল। এরকম আরও কয়েকটি মামলা হল: মোঃ শাহাবুদ্দিন চিশতী এবং অন্যান্য বনাম মওলানা মোঃ নুরুল হুদা মন্ডল এবং অন্যান্য (২০০৫)৩৬, ডা. তসলিমা নাসরিন বনাম মোঃ নুরুল আলম এবং অন্যান্য (১৯৯৫)৩৭, ড. আহমদ শরীফ বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য (১৯৯৪)৩৮

তবে, ইন্টারন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড বনাম রাষ্ট্র (২০০১) মামলায় দেখা যায় যে, ধর্মীয় অনুভূতিকে রক্ষা করতে গিয়ে আদালত সরকার কর্তৃক একটি ম্যাগাজিন বাজেয়াপ্তের নির্দেশ বহাল রেখেছেন। আদালতের ব্যাখ্যা হল:

কোন বিশেষ শ্রেণির নাগরিকগণ কোনো আপত্তিকর বস্তুর লেখা পড়তে বা বুঝতে পারেন কিনা সেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; যদি এটা বোঝা যায় যে, ওই প্রকাশনাটি দেখতে মুসলিমদের হৃদয়ের ধন আরবি ভাষার সদৃশ, যা যেকোন পাঠক নির্বিশেষে দেখামাত্রই রেগে যাবেন, সেখানে দণ্ডবিধির ১৯৫ক ধারা অনুযায়ী সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে।৩৯

২.৩. সাইবার মানহানি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬ সাইবার জগতে মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিধানকে আমদানি করেছে। আইসিটি আইনের তুমুল বিতর্কিত ৫৭ ধারা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন ধরনের প্রকাশনাকে অপরাধের আওতাভুক্ত করে।৪০

৫৭ ধারার শাস্তিও ছিল অতিরিক্ত কড়া। এর শাস্তি ছিল ন্যূনতম ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড সঙ্গে সর্বোচ্চ দশ কোটি টাকার অর্থদণ্ড।৪১ এই বিধান বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী এবং গবেষকদের তরফ থেকে বিতর্কের সূচনা করেছিল এবং পীড়নমূলক আইন হিসেবে আখ্যা পেয়েছিল।

সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইবুনালের আইনজীবির ভাষ্যমতে, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত আইসিটি আইনের অধীনে সারাদেশে অন্তত ৭৪০টি মামলা হয়েছিল, এবং এগুলোর ৬০% মামলাই হয়েছিল ৫৭ ধারায়।৪২ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা পরবর্তীতে বাতিল করা হয়, কিন্তু তাতেও সাইবার দুনিয়ায় ফৌজদারি মানহানির ক্ষেত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসে না। এই আইনটি আরও বেশী পীড়নমূলক আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এই আইনটি নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রের লাগামকেই আরও মজবুত করেছে। ডিএসএ অন্তত ১৪টি অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন-অযোগ্য শাস্তির বিধান এনেছে। শুরুতেই বলা যেতে পারে সবচেয়ে বিতর্কিত ৩২ ধারার কথা যা কিনা অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট ১৯২৩৪৩-কে ডিজিটাল মাধ্যমেও প্রয়োগ করেছে।

এই আইনে প্রতিটি অপরাধই দ্বিতীয়বার বা বারংবার সংঘটনের জন্য গুরুতর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। উপরে উল্লিখিত ধারায় দ্বিতীয়বার বা বারবার অপরাধটি করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।৪৪ ডিএসএ-এর অধীনস্থ মানহানিমূলক অপরাধগুলোর নাম এবং ও শাস্তির তালিকা নিচে দেওয়া হল:

শিরোনাম ও ধারাপ্রথমবার সংঘটনের শাস্তিদ্বিতীয়বার সংঘটনের শাস্তি
Offence and punishment for deteriorating law and order, etc. (Section 31)Maximum imprisonment of 7 years or max. fine of BDT 5 lacs or bothMax. 10 years or max. fine of BDT 10 lacs or both
Punishment for making any kind of propaganda or campaign against liberation war, spirit of liberation war, father of the nation, national anthem or national flag (Section 21)Max. 10 years or max. fine of BDT 1 crore or bothImprisonment for Life or max. fine of BDT 3 crore or both
Publication, broadcast, etc. of information in website or in any electronic format that hurts the religious values or sentiment (Section 28)Max. 5 years or max. fine of BDT 10 lacs or bothMax. 10 years or max. fine of BDT 20 lacs or both
Publication, transmission, etc. of defamatory information (Section 29)Max. 3 years or max. fine of BDT 5 lacs or bothMax. 5 years or max. fine of BDT 10 lacs or both

সাধারণত বিখ্যাত ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ, ব্যবসায়ী এবং তাদের ঘিরে থাকা মানুষজনকে এই আইনগুলোর আশ্রয় নিতে দেখা যায়। পুরো প্রক্রিয়াটাই যারা ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের জন্য কাছে এক মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করে এবং বাক-স্বাধীনতার বিপক্ষে এক ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

কাজেই, উপরোক্ত বিধানসমূহ থেকে দেখা যায় যে, যদিও পুরো পৃথিবী যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমের দিকে অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের আইন প্রণেতাগণ সেইসব মাধ্যমগুলোর উপর যেন ঔপনিবেশিক আইনগুলোর মতোই নিবারণমূলক আইন চাপিয়ে দিয়েছেন। এইসব আইনকানুন আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা পরবর্তী অধ্যায়ে যাচাই করে দেখা হবে।

৩. ফৌজদারি মানহানি এবং অনলাইনের জিনিসপত্র সংক্রান্ত বাংলাদেশী আইনের আন্তর্জাতিক মান

বেশকিছু আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী হওয়ায় বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণের জন্য বাংলাদেশের একটা দায় রয়েছে। কিন্তু, দণ্ডবিধি এবং ডিএসএতে যেভাবে ফৌজদারি মানহানির বিধানসমূহ রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই সেই মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

বাক-স্বাধীনতার বেলায় প্রথম এবং প্রধান আন্তর্জাতিক দলিলটি হল ইউনিভার্সাল ডিকলারেশন অফ হিউম্যান রাইটস (ইউডিএইচআর)৪৫ রাষ্ট্র যেহেতু এই দলিলের অন্তর্গত বাক-স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই ইউডিএইচআরের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাকে অবশ্যই বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এই অধিকারে ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিকাল রাইটস (আইসিসিপিআর)৪৬ এর ১৯ অনুচ্ছেদ আরও বড় আইনি ভিত্তি রচনা করেছে। বাংলাদেশ একে ২০০০ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং সেই কারণে এর মানও অনুসরণ করতে আইনত বাধ্য।

তবে, ইউডিএইচআরের বেলায় হয়তো দাবী করা যেতে পারে যে, এগুলো পালন করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে বাধ্য করা যাবে না। তারপরেও, এর বেশকিছু বিধানকে প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।৪৭ এছাড়াও, একটু ভিন্নভাবে হলেও, অনুচ্ছেদ ১৯ মতামত প্রকাশের অধিকারও নিশ্চিত করে। অধিকার হিসেবে বাক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা গেলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা যায় না। রাষ্ট্রপক্ষ কখনোই ব্যক্তি অধিকারকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে না।৪৮

আইসিসিপিআর ১৯(১) অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। আইসিসিপিআরের ১৯ অনুচ্ছেদ বাক স্বাধীনতার ব্যাপ্তিকে আরও বড় করে দেখেছে। একটি রাষ্ট্রে যত ধরনের মত প্রকাশের মাধ্যম রয়েছে সবগুলো ব্যবহার করেই তথ্য ও চিন্তা আদানপ্রদানের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করেছে। এই অধিকারটির কলেবর এতোই বড় যে, অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অগ্রহণযোগ্য তথ্য, চিন্তা, মতামত করার বিষয়টিকেও ধারণ করেছে।৪৯

তবে, এতো বৃহৎ কলেবরের অধিকার পুরোপুরি শৃঙ্খলাহীন হয়ে প্রযুক্ত হতে পারে না। সুতরাং, এটি অবাধ অধিকার নয়; এতে কিছু সীমাবদ্ধতাও আরোপ করা হয়েছে। আইসিসিপিআরের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে কিছু সীমাবদ্ধতা এবং বারণের কথা বলা হয়েছে। তবে এইসব সীমাবদ্ধতাগুলো অবশ্যই (ক) এমন ধরনের আইনকানুন দিয়ে পরিচালিত হতে হবে যেগুলো মানুষের ব্যবহারকে খুবই সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, (খ) একটা বৈধ লক্ষ্যকে অর্জন করতে চাইবে, যেমন অন্যের মর্যাদাকে রক্ষার লক্ষ্য, জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা এবং জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতা রক্ষা, এবং সবশেষে (গ) আরও কঠোর হওয়া চলবে না; বরং, গণতান্ত্রিক সমাজে যতোটুকু দরকারি এবং যথাযথ, যতোটা কম হস্তক্ষেপমূলক বা বাধাহীন করা সম্ভব, ততোটুকু।৫০

আইসিসিপিআরের ১৯ অনুচ্ছেদের বেলায়, মানবাধিকার কমিটির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি বোঝাপড়া একটি বিষয়ের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে বলছে। সেটি হল এই অনুচ্ছেদটি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একেবারে অপরিহার্য একটি অধিকার। ফৌজদারি মানহানিসহ বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য এই কমিটি একে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রথা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।৫১ এর থেকে এই অনুসিদ্ধান্তে আসা যায় যে, মানুষের এই ধরনের সংবাদের তথ্য পাওয়ার অধিকারও রয়েছে।৫২

গথিয়ার৫৩ মামলায় মানবাধিকার কমিটি বলেছে যে রাষ্ট্র অবশ্যই সীমাবদ্ধতা জারি করে করে কোন ধরনের হুমকিকে প্রশমনের চেষ্টা করছে সেটি স্পষ্ট করে বলতে হবে। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের জারিকৃত যেকোন সীমাবদ্ধতা, তা আইনস্বীকৃত হলেও অবশ্যই দরকারি এবং যথাযথ হতে হবে।৫৪ একই মত বডরোজিক বনাম সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো৫৫ মামলাতেও দেখা যায়, যেখানে জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমালোচনা করার জন্য একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মানহানির মামলা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কমিটি আরও বলে যে, “গণতান্ত্রিক সমাজে, বিশেষ করে গণমাধ্যমে, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্য বিতর্কের ক্ষেত্রে, এই কোভেন্যান্ট যে মূল্যবোধ হাজির করে তা বন্ধনহীন প্রকাশের দিকেই সবচেয়ে বেশী ঝুঁকে আছে।”

অধিকন্তু, ডি মোরাইস বনাম এঙ্গোলা৫৬ মামলায়, এঙ্গোলার রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করার জন্য একজন সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কমিটির ভাষ্য ছিল, “লেখকের উপরে যে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে তাকে কোনোভাবেই জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে যথাযথ বলা যায় না বা বিখ্যাত লোক হিসেবে রাষ্ট্রপতির সম্মান ও মর্যাদার স্বার্থেও নয়, কারণ তিনিও সমালোচনা ও বিরোধীতার উর্ধ্বে নন।”

এগুলো সবই হল সাংবাদিকতার ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিটির দেওয়া দৃঢ় সিদ্ধান্তসমূহের উদাহরণ। এই সিদ্ধান্তগুলো ছাড়াও, কমিটি ফৌজদারি মানহানির ফলে বাক-স্বাধীনতার উপর যে ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয় সেসবেরও সমালোচনা করেছে।৫৭

তবে, বাংলাদেশে, সাংবাদিকতার উপর রাষ্ট্র যে হস্তক্ষেপ করেছে বেশকিছু ঘটনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। জুন, ২০২০ এর পূর্বে, প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে৫৮ এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিটির আর্দশিক ও আইনি ভিত্তির বিপরীতে প্রবল সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখা গেছে।

ইউনাইটেড নেশনস স্পেশাল র‍্যাপোর্টার অন ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন এন্ড ওপিনিয়ন (এফওই)৫৯ বাক-স্বাধীনতার উপর যেকোনো ধরনের সীমাবদ্ধতাকে যাচাই করার জন্য এক তিন-স্তরী পরীক্ষার কথা বলেছে এবং ব্যাখ্যা করেছে। যেকোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই এই তিন-স্তরী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। নিম্নলিখিত তিন ধরনের প্রকাশকে আইনের আওতায় আনা যাবে:

ক. এমন প্রকাশ যা আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় সেটিকে ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

খ. এমন প্রকাশ যা ঠিক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না তবে দেওয়ানি মামলার মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে।

গ. এমন প্রকাশ যা দেওয়ানি বা ফৌজদারি কোনো ধরনের দায়ই সৃষ্টি করে না কিন্তু সহনশীলতা, সভ্যতা এবং পারস্পরিক সম্মানকে বিঘ্নিত করে।৬০

এছাড়া এফওই বেশকিছু অস্পষ্ট শব্দকেও চিহ্নিত করেছে এবং সেগুলো বাক-স্বাধীনতার বেলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেও জানিয়েছে। কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে “ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা,” “ধর্মীয় অবমাননা,” “সহিংসতায় উস্কানিদান,” “শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং অসম্মান প্রদর্শন,” “রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিনষ্ট করতে উস্কানীদান,” এবং “জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করে এমন অপরাধ”।৬১

৪. সাইবার আইন এবং দণ্ডবিধির ফৌজদারি মানহানির সেকেলে চরিত্র

ক. অপরাধীকরণের ঔপনিবেশিক স্টেরিওটাইপের উপর প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন: দণ্ডবিধির যে মানহানি তা ইংরেজি কমন ল থেকে আলাদা। ভিডার দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ আইনের মানহানি ছিল কিছু সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার সমষ্টি। তাই, যে ঘটনাগুলোর পরম্পরায় সেটির জন্ম দিয়েছে সেগুলোকে যাচাই করে না দেখলে তা বোঝা যাবে না।৬২ ইংরেজি আইনে উপযোগিতাবাদের উদ্ভবকে এইরকম একটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এর উত্তরণের ধারাবাহিকতায় উপযোগবাদী দার্শনিক জেরেমি বেনথাম ১৯ শতকে ইংল্যান্ডে কোডিফিকেশনের একজন বড় প্রস্তাবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। লর্ড মেকলে ছিলেন বেনথামের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। ফৌজদারি মানহানির মত নিবারণমূলক দণ্ড এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাতের মতো অপরাধগুলো দণ্ডবিধিতে অন্তর্ভূক্তির বিষয়গুলো ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোডিফিকেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

বেনথামকে দিয়ে দারুণভাবে প্রভাবিত মেকলে ভারতীয়দেরকে ধর্ম, রুচি, আচার-ব্যবহারের দিক দিয়ে একে অপরের থেকে ভীষণভাবে আলাদা বলেই বিশ্বাস করতেন। তিনি দেখেছিলেন পার্থক্যগুলো মূলত ধর্ম এবং বর্ণের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্বাস করতেন যে সমাজের একটা বড় অংশের নিতান্তই কোনো সাদামাটা প্রথাও অপর একটি বড় অংশের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াত। তাই, তিনি এই বলে ফৌজদারি মানহানিকে জায়েজ করেছিলেন যে, “একজন হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্টান এখানে একে অপরের দুঃখ দেখেও উদাসীন থাকতে পারে এমনকি খুশি হতেও পারে।”৬৩

মেকলের ভাষ্য থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতি পরিষ্কার বোঝা যায়: “আমাদের নীতি সহজ – একীভবনের সুযোগ থাকলে তা করা; বিভক্তি অবশ্যম্ভাবী হলে তা করা; কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই দৃঢ়তা বজায় রাখা।”৬৪ এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে আইন কমিশনকে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন রক্ষণশীল নীতিগুলোকেই প্রয়োগ করতে হয়েছিল।৬৫ এসব করা হয়েছিল কারণ কাউন্সিল যাতে “অজস্র ধারায় বিভক্ত মানুষের নিজস্ব অভ্যাস, চরিত্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সুশাসনের অত্যাবশ্যক নীতি প্রয়োগ করে সেগুলোকে করায়ত্ব করতে পারে।”৬৬ ফলাফল হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসন নিবারণমূলক শাস্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মেকলের ভাষ্যমতে, “দণ্ডবিধির উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অপরাধ থেকে নিবারণ করা।”৬৭

অনেক গবেষকই দেখিয়েছেন যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে কোডিফিকেশন প্রক্রিয়া সবচেয়ে দ্রুত সম্পন্ন হয়।৬৮ ব্রিটিশ ভারতে কোডিফিকেশন প্রক্রিয়া অত্যন্ত সাবলীলভাবে এবং দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ঔপনিবেশিক আইনপ্রণেতাগণ “এমন কোনো রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হননি যেগুলো তারা তাদের নিজেদের দেশে হয়েছিলেন, যেমন ক্রমবর্ধমান সুশীল সমাজ এবং জনমতের জামানা।”৬৯ কাজেই সাম্রাজ্য “দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে গিয়েছিল এবং যেকোন ধরনের কাজকেই অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে ফেলে ইচ্ছামত শাস্তি নির্ধারণ করার কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল।”৭০ সাংবিধানিক সুরক্ষার অনুপস্থিতি নীতিহীন ফৌজদারিকরণের পথ সুগম করেছিল।৭১ একদিকে, মেকলে এবং আইন কমিশনের সদস্যগণ “ব্রিটিশ শাসকদের অবস্থান সবার উর্ধ্বে রেখে প্রচলিত ফৌজদারি আইনকেই নতুন করে ব্যাখ্যা করেছিল।”৭২ অপরদিকে, “দণ্ডবিধিতে বর্ণিত অনেক অপরাধই আসলে ইংরেজি ফৌজদারি আইনেরই অনুকরণ কিন্তু এমনভাবে সেগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছিল যা এক ধরনের স্থানীয় আইনের মতোই দেখতে হয়েছিল।”৭৩

ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার আইনব্যবস্থার আধুনিকায়নের প্রকল্প ছিল কোডিফিকেশনে।৭৪ তবে, বাস্তবে, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠিত পুরো ব্যবস্থাটাই, শাসকের মতাদর্শিক ব্যবধান এবং মহানুভবতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ছিল যার কোনোটাই জনসমর্থন বা মতামতের কোনো তোয়াক্কা করেনি। ঔপনিবেশিক ব্যবধানের যে যুক্তিগুলো ছিল সেগুলো শুধুমাত্র শাসক ও শোষিতকেই আলাদা করেনি, বরং, ইউরোপীয় কর্মকর্তা, ইউরোপীয় বাসিন্দা এবং স্থানীয়দের মাঝে এক জটিল এবং ভঙ্গুর সম্পর্ক তৈরি করেছিল যা পরস্পরের মধ্যে আরও অস্বস্তিকর ও থমথমে একটা ক্ষমতা সম্পর্ক তৈরি করেছিল।৭৫ স্থানীয়দের ধর্ম এবং বর্ণের ভিত্তিতে পার্থক্য করে মর্যাদা রক্ষায় প্রচলিত আইনকানুনের অসংখ্য পদ্ধতিকে এড়িয়ে ফৌজদারি মানহানিকে জায়েজ করা হয়েছিল। পুরো কোডিফিকেশন প্রক্রিয়াই মূলত ইংরেজি কমন ল’কে ভারতে প্রতিস্থাপন করেছিল।৭৬ এইসব ঔপনিবেশিক ব্যবধান এবং বৈষম্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করেছিল।

দণ্ডবিধির প্রণেতারা একে ফৌজদারি আইনের স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান বলে দাবী করেছিলেন। তবে, এতেও ৩৯বার সংশোধনী করতে হয়েছিল।৭৭ বিশেষ করে, ১৮৭০ সালের সংশোধনীতে রাষ্ট্রদ্রোহ সংযুক্ত করা হয়েছিল যা আবার ১৮৯৮ এবং ১৯২৭ সালে সংশোধন করা হয়। প্রতিবারই শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়েছিল। ১৯২৭ সালে এতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপরাধটি যুক্ত হয়।৭৮ মজার কথা হল, প্রথমদিকে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রধান লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যম।৭৯ ধাওয়ান দেখান যে, “বিদ্রোহ দমন, বিরোধীকে চুপ করিয়ে দেওয়া, সেন্সর আরোপ এবং বৈরী প্যাম্পলেট এবং লেখা, বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্যই” এই সংশোধনগুলো করা হয়েছিল।৮০

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহসহ আরও অনেক গণআন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে আরও আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।৮১ এইরকম একটি আইন ছিল প্রেস এক্ট অফ ইন্ডিয়া ১৯১০, যেখানে “মহারাণীর বিরুদ্ধে…বা মহারাণীর অধীনস্ত ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো বিষোদগার বা অবমাননার উদ্দেশ্যে” কোনো প্রকাশনাকে নিষিদ্ধ করার বিধান ছিল।৮২

এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে ঔপনিবেশিক হেজিমনি। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র, কিন্তু মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এখনো এদেশের দণ্ডবিধি ১৮৬০ আইনে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে সব ফৌজদারি মানহানিকে সাইবার আইনেও অন্তর্ভূক্ত করেছে।

কার্টুন : মেহেদি

খ. বাক স্বাধীনতা এবং মানহানি: জনস্বার্থে ফৌজদারি মানহানির মামলায় রাষ্ট্রের বাদী হওয়া একটা ঔপনিবেশিক হেজিমনির অংশ। এতে সংক্ষুব্ধের যে একচ্ছত্র স্বার্থ তা প্রশমিত হয়।৮৩ দণ্ডবিধির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল একটা রাষ্ট্র-কেন্দ্রীক বিচার ব্যবস্থা কায়েম করা যা কিনা আইনী চর্চায় আরও বেশী দৃঢ়তা আনতে পারবে। দণ্ডবিধির ফৌজদারি অপরাধের সংজ্ঞায় মানহানির শ্রেণিকরণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানাকে আরও কঠিন মানহানিকর অপরাধ হিসেবে পরবর্তী সংশোধনের মাধ্যমে সংযুক্ত করার কাজটি আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল।

মানহানির মামলা রাষ্ট্রের বাদী হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নাই। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হল ‘সমাজকে রক্ষা করা’। তবে, ‘মর্যাদা’ মানেই সমাজের মর্যাদাকে বুঝায় না; মর্যাদাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবেই দেখা যেতে পারে। এর সঙ্গে এমন কোনো গুণ জুড়ে দেওয়ার প্রয়োজন নাই যেখানে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মর্যাদাকে জনস্বার্থের ধারণায় রূপান্তর করতে পারে এবং এর সুযোগ নিয়ে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে।

মানহানির মোকাবেলায়, কেবলমাত্র সত্য বলাটাই যথেষ্ট নয়।৮৪ বক্তব্যটি ‘জনগণের ভালোর জন্যও’ বলতে হবে। তবে, মর্যাদাকে যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়, কাজেই মানহানি কোনোভাবেই সমাজের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ হতে পারে না। একে বাক স্বাধীনতার উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কোনো অর্থ নাই।

মানহানিকে অন্যান্য অপরাধের সাথেও তুলনা করা চলে না। মানহানি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অপরাধ। এটি এমন এক ধরনের অপরাধ যেখানে অন্যতম প্রধান একটি মৌলিক অধিকারকে খর্ব করতে হয়; আর সেটি হল বাক স্বাধীনতা। এর চরিত্রই এমন যে, এটি বাক স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেয়। এই বাধা শুধুমাত্র ব্যক্তিমর্যাদার পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না; ধীরে ধীরে তা সরকার, রাষ্ট্র, ধর্মের বিরুদ্ধে সমালোচনার ক্ষেত্রেও ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় এবং রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি নাম ধারণ করে।

মানহানিকে এমন কোনো শ্রেণিতে ফেলা যায় না যা আসলে সত্যিকার অর্থে কোনো জনস্বার্থকে খর্ব করে। অথচ, মানহানির বিধান বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করে, যা কিনা জনগণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ। ধর্মীয় কটূক্তি ফৌজদারি এবং সাইবার, উভয় ক্ষেত্রেই মানহানির অপরাধ। অধ্যায় ২-এ উল্লিখিত বেশীরভাগ মামলা থেকেই দেখা গেছে যে, এসবের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল ব্যক্তিগত প্রতিশোধ অথবা রাজনৈতিক আগ্রাসন, যা কিনা পরিষ্কারভাবে বাক স্বাধীনতার পক্ষে অন্তরায়।

এমনকি আজও, আমাদের সংবিধানের ব্যাখ্যাগুলো ঔপনিবেশিক স্টিরিওটাইপের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। যেহেতু আমরা ঔপনিবেশিক স্টিরিওটাইপ থেকেই আজও সংবিধানের ব্যাখ্যা করি তাই আমরা অবচেতনেই ধরে বসি যে মানুষ হয়তো একে অপরের দুঃখে উদাসীন থাকতেই চায়। এর ফলস্বরূপ, আমরা কেবলমাত্র বাক স্বাধীনতার উপর আরোপিত সীমাগুলোর উপরেই বেশী জোর দেই এবং নিবারণমূলক আইন প্রণয়ন করতে চাই। আমরা যেহেতু এখনো পুরাতন ঔপনিবেশিক নিবারণমূলক আইনের চোখেই দেখি, এই কারণেই হয়তো, মানুষকে সীমাব্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার বদলে আমাদের সংবিধানের যৌক্তিক সীমাবদ্ধতাগুলোই আমাদের আমাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সংবিধানে বাক স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা রয়েছে সেখানেও কিন্তু ধর্ম কিংবা রাষ্ট্রের সমালোচনাকে সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি।৮৫

সারা পৃথিবীর মানুষ সহনশীলতা এবং যৌক্তিক সমালোচনাকে স্বাগত জানায়। সেই সমালোচনা রাষ্ট্র, ধর্ম, সরকার, ব্যক্তিসহ যেকারও হতে পারে। তাছাড়া, মানহানির আইনে কোনো প্রণালী দিয়েই আসলে ধর্মীয় উস্কানীমূলক বক্তব্যকে যাচাই করা সম্ভব নয়। এর সংজ্ঞাটাই এমন যে আক্ষরিক যেকোন বক্তব্যের উপরেই ধর্মীয় অবমাননার বা রাষ্ট্রের জন্য অপমানকর বলে আখ্যা দেওয়া যাবে।

বাংলাদেশের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অনুরূপ একটা ধারা ভারতের আইসিটি আইনেও ছিল তবে, সেই ধারাটি বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতে অনেকদিন হল বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশও আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করেছে, ৫৭ ধারার পুরাতন বিধানগুলো নতুন ডিজিটাল নিরাপত্ত আইনের ২৮, ২৯, ৩১ এবং ৩২ ধারায় সংযুক্ত করা হয়েছে।

এই ধারাগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিশোধের বেলায় ব্যবহারের জন্য ইতিমধ্যেই কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এসবের অনেক ঘটনাই আবার মিথ্যা প্রতীয়মান হয়েছে৮৬, এবং অনেকগুলো হঠকারী হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।৮৭ এইসব মানহানির ঘটনাবলীর পেছনে যে রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ বা ধর্মীয় উস্কানীর প্রভাব রয়েছে এটি আর আশ্চর্যজনক কিছু নয়।

গ. মানহানির সম্প্রসারণশীল চরিত্র: মানহানির আইনের একটা সম্প্রসারণশীল চরিত্র রয়েছে, এবং এই সম্প্রসারণটি আরও নিবারণমূলক দণ্ডের দিকেই ধাবিত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মানহানিকে জনস্বার্থের বিষয় বানিয়েছিল এবং পরবর্তীতে সেটাকে ধর্মীয় অনুভূতি এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রীক অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। উপনিবেশ-পরবর্তী আমলগুলো এটাকে জিইয়ে রেখেছে এবং সাইবার দুনিয়ায় এর সম্প্রসারণ করেছে। এর ফলস্বরূপ, সাইবার মানহানি আইন বিবর্তিত হয়ে এমন এক প্রণালী তৈরি করেছে যেখানে সাধারণ মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আরও বড় পরিসরে সংযুক্ত হয়েছে।

ঘ. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার মানেই ফৌজদারি মামলা করা বুঝায় না: যদিও, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার অধিকার রয়েছে। তবে, এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, মর্যাদা কেবলমাত্র ফৌজদারি মামলা করেই রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তিগত মর্যাদা দেওয়ানি আদালতেও বেশ ভালোভাবেই রক্ষা করা যায়।

দেওয়ানী ক্ষতিপূরণের মামলায়, আর্জিতে দাবীকৃত সুনির্দিষ্ট অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করতে হয় এবং তার বিপরীতে এড ভোলারেম কোর্ট ফি দিতে হয়। বাংলাদেশের আইন কমিশন ফৌজদারি মানহানির সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন যে যদি কেউ কোনো দেওয়ানী মামলায় হেরে যায়, তাহলে তাকে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ কোর্ট ফি হিসেবে দিতে হয়। এই কারণে, বিত্তবান মানুষ ব্যতীত কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিই মানহানির জন্য দেওয়ানী মামলা করতে আগ্রহ দেখান না।৮৮

আইন কমিশন কেন একে নেতিবাচকভাবে দেখেছেন সেটা পরিষ্কার নয়। উপরন্তু, একই অপরাধে ফৌজদারি ও দেওয়ানী উভয় প্রকার প্রতিকার বিদ্যমান থাকার কারণে এবং ফৌজদারি মামলায় কোনো অর্থ খোয়া যাবার ভয় না থাকার কারণে, বিশেষ করে প্রভাবশালী ও বিত্তবান লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই ফৌজদারি মামলার দিকেই ঝোঁকেন।

কোনো মামলায় জেতা বা হারার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কোনো আইনকে ভালো বা মন্দ ঘোষণা করা সঠিক নয়। তার বদলে, সাধারণ নিয়ম হওয়া উচিত যদি কেউ কোনো মিথ্যা মামলায় হেরে যায় অথবা অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে সেই ক্ষতিও বহন করতে হবে। তবে, এক্ষেত্রে কোর্ট ফি একটা যৌক্তিক মাত্রায় কমানো যেতে পারে, তাতেই বরং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সুবিধা হবে।

ঙ. নির্দোষ অনুমানের নীতির বিপরীত: জনস্বার্থ বাংলাদেশের মানহানির আইনের সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে গেছে যে এটি প্রমাণের দায়ভার গিয়ে পড়েছে আসামীপক্ষের উপর। মর্যাদা একটা আধিবিদ্যক সম্পত্তি, এবং মানহানি ফৌজদারি মামলার সূচনা করে কারণ এটি দোষের অনুমানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আইনবিদগণ এই নীতিটিকে ফৌজদারী আইন বিজ্ঞানের বাইরে রাখার পক্ষপাতী কারণ এটি প্রমাণের দায়ভারের ব্যাপারে স্পষ্ট সমাধান দেয় না।৮৯ ফৌজদারি বিচারের প্রতিষ্ঠিত নীতিটি হচ্ছে দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে অনুমান করা। কিন্তু, মানহানির মামলায় এই প্রতিষ্ঠিত নীতির লঙ্ঘন দেখা যায়।

চ. শাস্তি এবং গুরুত্বে অসামঞ্জ্যস্যতা: যৌক্তিকতা সামঞ্জ্যস্যতার নীতির উপরে ভিত্তি করে তৈরি করা উচিত। অথচ, দণ্ডবিধিতে মানহানিকে ওয়ারেন্ট কেস হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। দন্ডবিধি সাধারণত তিন বছরের বা তার বেশী মেয়াদের শাস্তি আছে এমন অপরাধকে ওয়ারেন্ট কেস হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে। ৫০০, ৫০১ এবং ৫০২ ধারার অপরাধগুলোর শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড হলেও, ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলের চতুর্থ কলামে একে ওয়ারেন্ট কেস হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।৯০

আইন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, তৎকালীন আইন প্রণেতাগণ এই আপরাধের প্রতি প্রবল গুরুত্ব দিয়েছিলেন।৯১ বাংলাদেশের আইন কমিশন কেন এই বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আইন কমিশনের এই স্বীকারোক্তি আমাদের সপক্ষেই যায় যে, তৎকালীন আইনপ্রণেতাগণ দমনমূলক এইসব চিন্তার উপর অনৈতিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যা সামঞ্জ্যস্যতার নীতির সঙ্গে প্রবল বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছিল।

ছ. লোকাস স্টান্ডিতে অস্পষ্টতা: মানহানির মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা বাদীকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। একদিকে, যিনি সরাসরি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তিনি মামলা করতে পারেন; অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় কৌসুলীও বাদী হয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। এভাবে মামলায় নিজে রাষ্ট্র সংযুক্ত হয়ে বাক স্বাধীনতার পথকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে।

যখন আইসিটি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারা বলবৎ ছিল, তখন এর লোকাস স্টান্ডি নিয়ে বেশ অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়েছিল। ৫৭ ধারা একটি বিশেষ আইনের অংশ হওয়ায় এটিই অগ্রাধিকার পেত। তবে, আইসিটি আইনে ফৌজদারি কার্যবিধিকে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।৯২ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারার বাধ্যবাধকতা তাই আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বেলায়ও প্রযোজ্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে, সংশ্লিষ্ট অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নালিশ ব্যতিত কোন আদালত দণ্ডবিধির ১৯ অধ্যায়ের অধীন কোন অপরাধ আমলে নিবেন না।৯৩ কিন্তু, বাস্তবে, এই নিয়ম মানতে দেখা যায়নি। বেশীরভাগ মামলায়ই দেখা গেছে যে এমন ব্যক্তি বাদী হয়ে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন যার সঙ্গে মামলার কোনো সরাসরি সম্পর্ক নাই।

আবার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়নের পর, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হয়। ডিএসএর ৫০ ধারা অনুযায়ী, এই আইনেও সিআরপিসির ১৯৮ ধারা অনুসরণ করতে হবে। সাইবার আইনের মামলাগুলোতেও ১৯৮ ধারার বিচ্যূতি লক্ষ্য করা গেছে। লক্ষ্য করা গেছে যে বেশীরভাগ মামলাই মানুষের প্রকাশিত মতামতের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম যেমন: ফেসবুক বা টুইটাইর ইত্যাদি মাধ্যমে এবং, এখানেও সরাসরি সংক্ষুব্ধ নন এমন ব্যক্তিকেও মামলার বাদী হতে দেখা গেছে। এটা সিআরপিসির ১৯৮ ধারার একটা স্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে আদালতগুলো এই লোকাস স্টান্ডির বিষয়টি কদাচিৎ আমলে নিয়েছে।

কার্টুন: ফারহা তাহসিন

এবার আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ব্যবচ্ছেদ করব:

ক. মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড: ২১ ধারা৯৪, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার শাস্তি বিধান করা হয়েছে, তা আশ্চর্যজনকভাবে প্রোপাগান্ডা এবং প্রচারণার কোনো সংজ্ঞা প্রদান করেনা নাই। এছাড়াও, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটির ব্যাপ্তিও বিশাল। এর সংজ্ঞাটি যেভাবে দেওয়া হয়েছে, “যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহিদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ।”৯৫ এমন বিশাল ব্যপ্তির সংজ্ঞা সরকারের যেকোন নেতিবাচক কর্মের সমালোচনার জন্য কোনো রাস্তা খোলা রাখে না।

খ. আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি: ২৫(১)(ক)৯৬ ধারা হল বিদ্যমান ফৌজদারি মানহানিরই একটা বিবর্ধিত আইন। এখানে “ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন” তাহলে তার শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এই ধারাটির ব্যাপ্তিও বিশাল এবং বাক স্বাধীনতার উপর সীমাব্ধতা আরোপ করেছে। এখানে কোন ধরনের কাজ আসলে “মিথ্যা তথ্য” বা “অপমানকর” হয় তার কোনো সংজ্ঞা নাই। এই পরিভাষাগুলো অসংজ্ঞায়িত হওয়ায় যেকোন সাংবাদিক প্রকাশ বা মতামতকে এই দুই শ্রেণির কোনো একটিতে ফেলা সম্ভব।৯৭ এতে “বিরক্তিকর” এবং “অপদস্থের” মত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো অস্পষ্ট এবং অপরাধ সংঘটনের বেলায় সামান্য সীমা নির্ধারণ করে।৯৮

২৫(২) ধারায় “বিভ্রান্তি ছড়ানো” এবং “রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার” মত শব্দগুলোর ব্যাপ্তিও বিশাল এবং অস্পষ্ট হওয়ায়  সরকারের যেকোন ধরনের সমালোচনাকেই এর অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব।

গ. ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি: ২৮ ধারা৯৯ ধর্মীয় অনুভূতি এবং মূল্যবোধকে আঘাত করে এমন কিছু কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই বিধানটি বাক স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদন্ডের বিরুদ্ধে যায় কারণ এটি বস্তুত কোনো ধর্মীয় অধিকারকে শক্তিশালী করে না বরং কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুভূতি এবং মূল্যবোধকেই রক্ষা করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি বলেছে যে কোন আইন যদি ব্লাসফেমিসহ কোনো ধর্মের প্রতি কম শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টিকে নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করে তাহলে সেটি আইসিসিপিআরের মানদন্ড নিশ্চিত করবে না।১০০

ঘ. মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি: ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে মানহানির যে ধারণা রয়েছে সেটিই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৯ ধারায় সংযোজিত হয়েছে। এককথায় এটা বাক স্বাধীনতার বেলায় মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানকে পাশ কাটিয়ে দণ্ডবিধির সেই ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণাকেই গ্রহণ করেছে।

ঙ. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড: ৩১১০১ ধারায় ‘বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটাবার উপক্রম হয়’ এমন এমন কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ বা সম্প্রচার করার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারাটির মধ্যেও বেশকিছু অসংজ্ঞায়িত শব্দ রয়েছে যেগুলোর ব্যাপ্তি এবং অর্থের পরিসর হতে পারে অত্যন্ত বিশাল, যেমন: ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’, ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতি’। এই ঘাটতিটি ব্যবহার করে সাংবাদিকতা এবং বিদ্যায়তনিক চর্চাকে রুদ্ধ করা যেতে পারে। তাছাড়া, সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও অযৌক্তিক শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে। তাছাড়া, ৩২ ধারায়১০২ অফিসিয়াল সিক্রেটস এক্ট ১৯২৩ এর সমস্ত ধারাকে বলবৎ করা হয়েছে যা সরকারি গোপনীয়তাকে রক্ষা করে। এটিও সাংবাদিকতা, বিদ্যায়তনিক চর্চা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই অপরাধের সংজ্ঞাটির ব্যাপ্তিও এতো বিশাল যে যেকোন বৈধ কর্মকেও এর অধীনে এনে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে।

কার্টুন: মেহেদি

৫. উপসংহার

একজন ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তির মানহানি একটি দেওয়ানি ভুল বা টর্ট; কমন লয়ের ক্ষেত্রে যার সহজ সমাধান হল ক্ষতিপূরণের দাবী করা। ইংল্যান্ডেও একসময় মানহানি ফৌজদারি অপরাধ ছিল তবে, খোদ ইংল্যান্ডেও এই মামলার প্রকৃতি বদলে গেছে। কমন ল-এর উত্তরসূরী হিসেবে বাংলাদেশও মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং ঔপনিবেশিক চেতনাকে বয়ে নিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক আইন মানহানির আইনকে বিফৌজদারিকরণ করতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু, আমাদের উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা শুধু একটা বাস্তবতাই নয়, বরং, এক ধরনের শোষণযন্ত্র যা সাইবার আইনেও ছড়িয়ে গেছে।

অবশ্যই মানহানির কবল থেকে মানুষের মর্যাদাকে রক্ষা করার বিধান থাকতে হবে। মানহানির বিফৌজদারিকরণের মানে এই নয় যে মানহানিকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে হবে। এর অর্থ হল মানহানির মামলায় কেবল দেওয়ানি দায় থাকবে।

এই ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা এখন এইটুকু পরিষ্কার হয়েছি কেমন করে বাংলাদেশে মানহানি টিকে রয়েছে। সাইবার আইনের ক্ষেত্রে মানহানির উৎস খুঁজতে হলে আমাদের তাই খোদ মানহানির ইতিহাসেরই সন্ধান করতে হবে। ফৌজদারি মানহানির বিলুপ্তি ব্যতীত বাক স্বাধীনতার মুক্তি নাই।

তথ্যসূত্র

১.‘Criminal Defamation in the Commonwealth – A Case for Abolition’ (Commonwealth iLibrary) <https://read.thecommonwealth-ilibrary.org/commonwealth/governance/2005-meeting-of-commonwealth-law-ministers-and-senior-officials/criminal-defamation-in-the-commonwealth-a-case-for-abolition_9781848598843-11-en> accessed 26 June 2020.

২. ‘Constituent Assembly of India Debates (Proceedings)’ (1948) VII <https://www.constitutionofindia.net/constitution_assembly_debates/volume/7/1948-12-01>.

৩. Subramanian Swamy V The Union of India [2016] AIR 2718 (Supreme Court).

৪. UN Human Rights Committee (HRC), ‘General Comment No.34, Article 19, Freedoms of Opinion and Expression’ <https://www.refworld.org/docid/4ed34b562.html>.

৫. The Penal Code 1860, s 124A.

৬. ibid, s 295A.

৭. Thomas Babington Macaulay, The Complete Works of Thomas Babington Macaulay (Ebook Edn, Delphi Classics 2016), Note R: On the Chapter of Defamation, para 6.

৮. ibid, Note R: On the Chapter of Defamation, para 4.

৯. ibid.

১০. Bangladesh (Adaptation of Existing Laws) Order 1972.

১১. The Penal Code, s 499.

১২. ibid, s 500.

১৩. ibid, s 501.

১৪. ibid, s 502.

১৫. 1994 BLD 201 (High Court Division).

১৬. ibid.

১৭. ‘Final Report on Whether Specific Provisions of Civil Remedy Can Be Formulated Regarding Defamation’ (Law Commission – Bangladesh) 81, para 22 <http://www.lawcommissionbangladesh.org/reports/81.doc>.

১৮. The Code of Civil Procedure 1908, s 19.

১৯. ‘Final Report on Whether Specific Provisions of Civil Remedy Can Be Formulated Regarding Defamation’ (n 17), para 19.

২০. The Code of Criminal Procedure 1898.

২১. ‘Defamation’ The Daily Star (13 November 2018) <https://www.thedailystar.net/law-our-rights/news/defamation-1659532> accessed 24 September 2020.

২২. LEX/BDHC/0307/1995 Bdlex (High Court Division).

২৩. LEX/BDHC/0135/1996 Bdlex (High Court Division).

২৪. LEX/BDHC/0042/2018 Bdlex (High Court Division).

২৫. LEX/BDHC/0304/2012 Bdlex (High Cour Division).

২৬. LEX/BDHC/0290/2001 Bdlex (High Court Division).

২৭. 1995 BLD 362 (High Court Division).

২৮. No.18 of 1991

২৯. ‘Final Report on Whether Specific Provisions of Civil Remedy Can Be Formulated Regarding Defamation’ (n 19), para 13.

৩০. The Penal Code, s 124A.

৩১. Ratanlal Ranchhoddas and Dhirajlal Keshavlal Thakore, The Indian Penal Code (19th edn, The Bombay Law Reporter Office 1948).

৩২. The Penal Code, s 124A.

৩৩. KN Chandrasekharan Pillai and Aquil Shabistan, Essays on the Indian Penal Code (Indian Law Institute 2005) 281.

৩৪. The Penal Code, s 295A.

৩৫. Shamsuddin Ahmed and Others vs The State and another LEX/BDHC/0150/2000 Bdlex (HCD).

৩৬. LEX/BDHC/0210/2005 BdLex (HCD).

৩৭. LEX/BDHC/0070/1995 Bdlex (HCD).

৩৮. LEX/BDHC/0005/1994 Bdlex (HCD).

৩৯. International Book Agency Ltd vs The State (2001) LEX/BDHC/0259/2001 Bdlex (HCD).

৪০. The Information and Communication Technology Act 2006.

৪১. ibid, s 57(2).

৪২.  Tribune Desk, ‘Section 57 Cases Will Continue’ Dhaka Tribune (29 January 2018) <https://www.dhakatribune.com/bangladesh/law-rights/2018/01/29/section-57-cases-will-continue> accessed 3 December 2020.

৪৩. Act No XIX of 1923

৪৪. The Information and Communication Technology Act, s 32(2).

৪৫. UN General Assembly, ‘Universal Declaration of Human Rights’ [1948] 217 A (III) <https://www.refworld.org/docid/3ae6b3712c.html>.

৪৬. UN General Assembly, ‘International Covenant on Civil and Political Rights’ [1966] United Nations, Treaty Series, Vol. 999, p. 171, <https://www.refworld.org/docid/3ae6b3aa0.html>.

৪৭.  United States Court of Appeals and Second Circuit, ‘630 F2d 876 Filartiga v. Pena-Irala’ (1979) F2d 876; Toby Mendel, Public Service Broadcasting: A Comparative Legal Survey (2011); Eurpean Union, ‘EU Human Rights Guidelines on Freedom of Expression Online and Offline’ <https://www.consilium.europa.eu/uedocs/cms_data/docs/pressdata/EN/foraff/142549.pdf>.

৪৮. Centre for Law and Democracy, Briefing Note Series: Freedom of Expression (2015) <https://www.deslibris.ca/ID/245812> accessed 10 October 2020.

৪৯. Handyside v United Kingdom 5 (ECHR).

৫০. UN General Assembly (n 48), Article 19(1).

৫১. Rakhim Mavlonov and Shansiy Sa’di v Uzbekistan [2009] CCPR/C/95/D/1334/2004; M O’Flaherty, ‘Freedom of Expression: Article 19 of the International Covenant on Civil and Political Rights and the Human Rights Committee’s General Comment No 34’ (2012) 12 Human Rights Law Review 627, 19.

৫২. Rakhim Mavlonov and Shansiy Sa’di v. Uzbekistan (n 51).

৫৩. Robert W Gauthier v Canada [1999] CCPR/C/65/D/633/1995.

৫৪. ibid.

৫৫. [2006] CCPR/C/85/D/1180/2003.

৫৬. [2005] CCPR/C/83/D/1128/2002.

৫৭. UNHRC, ‘Concluding Observations on the Seventh Periodic Report of the United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland’ <https://www.refworld.org/docid/5645a59c4.html>.

৫৮. ‘Sampadak Parishad Condemns Arrest of Journalists under Digital Security Act’ The Daily Star (30 June 2020) <https://www.thedailystar.net/sampadak-parishad-condemns-arrest-journalists-under-digital-security-act-1922973> accessed 3 December 2020.

৫৯. UNHRC, Report of the Special Rapporteur on the Promotion and Protection of the Right to Freedom of Opinion and Expression: Addendum, Communications to and from Governments 2011 [A/HRC/17/27]; UN General Assembly, Promotion and protection of the right to freedom of opinion and expression 2011 [A/66/290].

৬০. UN General Assembly Promotion and protection of the right to freedom of opinion and expression (n 61).

৬১. ‘Bangladesh: Analysis of the Digital Security Act’ (ARTICLE 19) <https://www.article19.org/resources/bangladesh-analysis-of-the-digital-security-act/> accessed 20 November 2020.

৬২. Van Vechten Veeder, ‘The History and Theory of the Law of Defamation. I’ (1903) 3 Columbia Law Review 546.

৬৩. Macaulay (n 9), Note R: On the Chapter of Defamation, para 10.

৬৪. ‘East-India Company’s Charter. (Hansard, 10 July 1833)’ <https://api.parliament.uk/historic-hansard/commons/1833/jul/10/east-india-companys-charter> accessed 27 June 2020.

৬৫. Kartik Kalyan Raman, ‘Utilitarianism and the Criminal Law in Colonial India: A Study of the Practical Limits of Utilitarian Jurisprudence’ (1994) 28 Modern Asian Studies 739.

৬৬. ibid.

৬৭. Macaulay (n 9), Note A.

৬৮. Gunther Weiss A., ‘The Enchantment of Codification in the Common-Law World’ (2000) 25 Yale J. Int’l L. <Available at: https://digitalcommons.law.yale.edu/yjil/vol25/iss2/8>; Lindsay Farmer, ‘Reconstructing the English Codification Debate: The Criminal Law Commissioners, 1833–45’ (2000) 18 Law and History Review 397; Elizabeth Kolsky, ‘Codification and the Rule of Colonial Difference: Criminal Procedure in British India’ (2005) 23 Law and History Review 631.

৬৯. Kolsky (n 70).

৭০. Muhammad Mahbubur Rahman, Criminal Sentencing in Bangladesh: From Colonial Legacies to Modernity (Brill Nijhoff 2017) 106.

৭১. ibid.

৭২. ibid.

৭৩. ibid.

৭৪. See Marc Galanter, ‘The Displacement of Traditional Law in Modern India*’ (1968) 24 Journal of Social Issues 65.

৭৫. Kolsky (n 70).

৭৬. David Skuy, ‘Macaulay and the Indian Penal Code of 1862: The Myth of the Inherent Superiority and Modernity of the English Legal System Compared to India’s Legal System in the Nineteenth Century’ (1998) 32 Modern Asian Studies 513.

৭৭. Borhan Uddin Khan and Quazi Mahfujul Hoque Supan, Encyclopedic Compendium of the Laws of Bangladesh, vol 1 (Bangladesh Legal Aid and Services Trust 2002).

৭৮. The Penal Code, s 295A.

৭৯. Rahman (n 72).

৮০. Rajeev Dhavan, ‘Kill Them for Their Bad Verses: On Criminal Law and Punishment’ in Rani D Shankardass (ed), Punishment and the Prison: Indian and International Perspectives (Sage Publicatins 1999).

৮১. See Jill C Bender, The 1857 Indian Uprising and the British Empire (Cambridge University Press 2016).

৮২. ‘The Press Act of India 1910’, s 4 <https://www.legalcrystal.com/act/134062/press-act-1910-complete-act> accessed 26 June 2020.

৮৩. See Heike Jung, ‘The Renaissance of the Victim in Criminal Policy: A Reconstruction of the German Campaign’’ in Roger G Hood, Lucia Zedner and Andrew Ashworth (eds), The criminological foundations of penal policy: essays in honour of Roger Hood (Oxford University Press 2003).

৮৪. The Penal Code, s 499, First Exception.

৮৫. Shamsuddin Ahmed and Others vs. The State and another (n 37). The High Court in this case affirmed that: The Constitution of Bangladesh also allows some liberty and freedom to make free and fair criticism of any religion or faith.

৮৬. Shahnaz Parvin, ‘Five Major Incidents in Bangladesh Surrounding Fake News’ BBC News Bangla (14 November 2018) <https://www.bbc.com/bengali/news-46126648> accessed 27 June 2020.

৮৭. Shakhawat Liton, ‘Bangladesh: Abuse of Cyber Law Finds No Limit’ (International Press Institute, 25 July 2018) <https://ipi.media/bangladesh-abuse-of-cyber-law-finds-no-limit/> accessed 28 June 2020.

৮৮. ‘Final Report on Whether Specific Provisions of Civil Remedy Can Be Formulated Regarding Defamation’ (n 19), para 23.

৮৯. Subramanian Swamy V. The Union of India (n 5).

৯০. The Code of Criminal Procedure.

৯১. ‘Final Report on Whether Specific Provisions of Civil Remedy Can Be Formulated Regarding Defamation’ (n 19), para 24.

৯২. The Information and Communication Technology Act, s 20.

৯৩. Defamation contains in this chapter.

৯৪. The Digital Security Act 2018.

৯৫. ibid, s 2(P).

৯৬. ibid.

৯৭. ‘Bangladesh: Analysis of the Digital Security Act’ (n 63).

৯৮. ibid 19.

৯৯. The Digital Security Act.

১০০. UN Human Rights Committee (HRC) (n 6).

১০১. The Digital Security Act.

১০২. ibid.

  • প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের বর্ষ ৬ সংখ্যা ১, অক্টোবর ২০২১ – তে প্রকাশিত হয়েছে।
  • ইয়ামিন রহমান : সহকারি অধ্যাপক, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
  • রিয়াসাত আজমী : প্রভাষক, আইন বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি- বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *