‘মদিনা’ থেকে উদ্ধৃতাংশ: নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

  • পারভেজ আলম

সম্পাদকীয় মন্তব্য: পারভেজ আলম এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী; রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও লেখালেখির মূল ক্ষেত্র। ২০২০ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘মদিনা’। এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ বা ‘কিশোর বিদ্রোহ’ নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্তব্য ও বিশ্লেষণ রয়েছে। আন্দোলনের দুইবছর পূর্তি উপলক্ষে ‘মদিনা’ থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরা হলো।

স্বাভাবিক জরুরি অবস্থার উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমেই আমরা আসল জরুরি অবস্থাকেও আরও প্রকট করে তুলতে পারি। যখনই আমরা শাসনকে শাসন হিসেবে বলতে ও বুঝতে শিখব, আইনের শাসন নামক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত থাকব না, তখনই আমরা নিজেদের দেখতে পাব নতুন বাংলাদেশ তৈরির ঐতিহাসিক কর্তা হিসেবে। আইন যে সীমানায় গিয়ে আর আইন থাকে না, শাসনে পরিণত হয় সেই সীমানাতেই ঘটে মাহদির আবির্ভাব; আইনের নামে শাসনের বিলুপ্তি ঘটাতে। আমাদের ইতিহাসের কর্তাসুলভ সংগ্রামী তৎপরতার কোনো মুহূর্ত যদি একটি ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক মুহূর্তের সাথে এক বিন্দুতে মিলে যায়, তাহলে তা হবে একটি বাড়তি পাওনা। তখন আমরা এমনকি নতুন সংবিধান লিখে নতুন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের কর্তা এবং সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্যও লাভ করতে পারি। আর এর বাইরেও, অর্থাৎ সংগ্রামের মুহূর্ত বা বিপ্লবের কাল বাদ দিলেও, আগামবেনের লেখায় ভবিষ্যতের কোনো একসময়ে আসল জরুরি অবস্থার স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হওয়ার একধরনের প্রফেসি পাওয়া যায়। যেমন তিনি লিখেছেন- একদিন মানুষ আইন নিয়ে এমনভাবে খেলবে যেভাবে শিশুরা খেলে পরিত্যক্ত জিনিস নিয়ে (স্টেট অব অ্যাকসেপশন ‘৬৪)। মদিনা নামক নগর-রাষ্ট্র কিংবা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের সময় সংশ্লিষ্টরা যেমন আইন নিয়ে খেলেছে, পুরোনো আইন বাতিল করে নতুন আইন তৈরি করেছে, অনেকটা তেমন।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা শিশু-কিশোরদের বিদ্রোহে (নিরাপদ সড়ক আন্দোলন) আমরা দেখছি শিশুরা নিজেরাই আইন প্রয়োগ করছে। অথচ আইন প্রয়োগ করার সার্বভৌম ক্ষমতা তাদের ছিল না। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে তারা বলপ্রয়োগ করে নাই। আগামবেনের ভাষা ধার করে বললে, এই শিশু-কিশোররা বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা নিয়ে একধরনের খেলা করছিল। এই খেলার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে স্বাভাবিকে পরিণত হওয়া অনিয়মগুলো যে স্বাভাবিক নয়, বরং ব্যতিক্রম অবস্থা, সে সত্যটাই সবার সামনে তুলে ধরেছিল। এই শিশু – কিশোররা আরও একটু বড় হলে যে খোদ আইন নিয়েই খেলা করবে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?

(প্রবন্ধ: আসল জরুরি অবস্থা)

নিরাপদ সড়ক চাই, শিল্পী: মিতা মেহেদী, সূত্র: ফেসবুক

আগামবেন সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন- কেমন হতো, যদি ইতিহাসের ফেরেশতা তার মেলে রাখা ডানা দুটি বন্ধ করে ফেলতে পারত?

ইতিহাসের ফেরেশতার কোনো ইতিবাচক মূর্তি কল্পনা করা সহজ কাজ না। তার বদলে বরং আমাদের বাস্তবের বহু হতাশাজনক ছবিই ইতিহাসের ফেরেশতার কথা মনে করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই হাত উঁচু করে আত্মসমর্পন করা ইহুদি শিশু কিংবা বর্তমান সিরিয়ায় ক্যামেরার লেন্স দেখে বিস্ফোরিত ও ক্রন্দনরত চোখ তুলে দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করা শিশুর ছবি চলে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়কার একটি ছবি আমাকে ডানা বন্ধ করে ফেলা ইতিহাসের ফেরেশতার কথা মনে করিয়ে দেয়। একদল পুলিশের বিপরীতে স্কুল ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরের এই ছবিটি অনেকেই দেখেছেন ছবিটি ছেলেদের পেছন থেকে তোলা। ছেলেটার দুই হাত সামনে, বুকের কাছাকাছি। সে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে না টাই ঠিক করছে, না অন্যকিছু, তা বোঝার উপায় নাই। কিন্তু ছবিটি তাকে যে ভঙ্গিমায় ধরে রেখেছে, তাতে মনে হয় সে যেন একদল পুলিশের বিপরীতে ডানা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেছে। ছবিতে সে একাই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের বিপরীতে। ছবির মূল ফোকাস ছেলেটি, পুলিশেরা হাজির অস্পষ্ট একটা দল হিসেবে। কিন্তু এই অস্পষ্টতাই তাদের ও তারা যা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে তাকে তুলে ধরেছে ভালোভাবে। যেভাবে তার পরষ্পরের সাথে মিশে একটা দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের দেহ, ভেস্ট, লাঠি, বন্দুক, হেলমেট, ঢাল মিলেমিশে একাকার হয়ে একটা দমনমূলক যন্ত্রের ছবিই হাজির হয়েছে যেন এ ছবিটি বাংলাদেশের ধ্বংসস্তূপের একটি ছবিও, যার ওপর এই দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে।

আন্দোলনের সময় তোলা ছবি, সংগ্রহ: ইন্টারনেট

বাংলাদেশের শিশু-কিশোদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যাকে অনেকে ‘কিশোর বিদ্রোহ’ নাম দিয়েছেন; তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য এক নাগরিক অধিকারের আন্দোলন বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ওপর যার প্রভাব ও ফলাফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশকে এখন আর পেছনে ফেরানোর কোনো উপায় নাই। যে স্কুল – কলেজের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছিল তারা ফিরে গেছে বটে। কিন্তু তারা এখন থেকে রাস্তায় ফেরত আসতেই থাকবে। কিন্তু এই শিশু – কিশোরদের আন্দোলন পুরো বাংলাদেশেই ঘটে চলা ভাঙা গড়ার সবচেয়ে উদযাপনযোগ্য ঘটনা মাত্র; এক দশক ধরেই আমরা বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে এ ঘটনার বিভিন্ন রূপ দেখতে পেয়েছি। শিশু – কিশোরদের আন্দোলন আমাদের শেষবারের মতো স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে একাত্তরের পর যে বাংলাদেশটা গড়ে উঠেছিল, তার একটা শেষ সময় হাজির হয়ে গেছে। আখেরাত তো সেই সময় যখন মহাসংকট এসে যাবে এবং যেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম স্মরণ করবে। (নাজিয়াত ৩৪-৩৫)। বাংলাদেশের স্কুল – কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আমাদের সামনে কোনো অনন্ত ক্রাইসিস হাজির করে নাই; বরং অল্প সময়ের জন্যও তা হাজির করেছিল একধরনের বিচার। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন এবং মন্ত্রী, মিনিস্টার সবাইকে তারা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এই বিচারের কাঠগড়ায়। তাদের এই আন্দোলনের কারণে আমাদেরই আমাদের বিচার করতে হয়েছে, রায় দিতে হয়েছে। আল্লাহর দূত হয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেন আমাদের বলে গেছে- পাঠ করো তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা), আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্য তুমিই যথেষ্ট (আল ইসরা ১৪)।

ছবি: ডেইলি স্টার, ৫ আগস্ট ২০১৮

শিশুরা নাকি সবাই বেহেশতে যাবে। তাই বেহেশতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে শিশুরা। ধর্ম, বর্ণ, মতাদর্শ তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বড়দের জন্য, তথাকথিত অ্যাডাল্টদের জন্য সেই সুযোগ নাই, দুনিয়ার পঙ্কিলতা তাদের স্পর্শ করে ফেলেছে, তাদের এক পা ইতিমধ্যেই দোজখে। কিন্তু শিশুদের জন্য বেহেশত কখনো অসম্ভবে পরিণত হয় না। নবী বলেছেন, বেহেশতে তিনি মুসলমান আর মুশরিকের সন্তানদের একসাথে দেখেছেন— নবী ইব্রাহিমের সাথে। দুনিয়ার পঙ্কিলতা আর দোজখের আগুন শিশুদের স্পর্শ করতে পারে না বলেই তারা বেহেশতের সংখ্যাগুরু, এমনি চিন্তা ইব্রাহিমি ঐতিহ্যে পাওয়া যায়। আমাদের সময়ের দার্শনিক আগামবেন অনাগত বেহেশতি দুনিয়া হাজির করার সম্ভাবনাও দেখেছেন শিশুর মধ্যে। তবে তিনি যে শিশুর কথা বলেন, তা সবার মধ্যেই আছে। আগামবেনের মতে, মানুষমাত্রই সত্তার দিক থেকে একধরনের আজীবন শিশু। আমাদের সবার ভেতরেই কোনো একটা জায়গায় এই শিশু সর্বদা তার রাজকীয় খেলা জারি রেখেছে। শিশুসুলভ খেলার মাধ্যমেই জন্ম নেয় “সময়”। এবং জন্ম নেয় নানা রকম ভাষা এবং জাতির ধারণা। কিন্তু বহু ভাষা ও জাতির ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে মানুষের পক্ষে কখনোই একই সাথে পরিণত মানুষ হওয়া এবং এই অনন্ত শিশুকে (eternal child) ধরে রাখা সম্ভব হয় না। শুধু শেষ সময়েই মানুষ পারবে একটি সার্বজনীন ও শিশুসুলভ সমাজের জন্ম দিতে। আগামবেনের ভাষায়, “শিশুসুলভ এই সোমরসের কাছে ফেরার যে অকৃত্রিম ডাক মানবতা শোনে, তাকেই বলে চিন্তা– যার মানে, রাজনীতি’ (আইডিয়া ৯৮)। আগামবেন তাই আরও বলেন যে একদিন মানুষ আইন নিয়ে খেলবে তেমনভাবে যেভাবে শিশুরা খেলে পরিত্যক্ত জিনিস নিয়ে, আইনকে তার শরিয়তি অবস্থানে (ক্যানোনিক) ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য নয় বরং তা থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি দেওয়ার জন্য (স্টেট অব অ্যাকসেপশন ৬৪)। আমাদের দেশের শিশু কিশোরেরা যে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সার্বভৌম সহিংসতা সংঘটনের কোনো ক্ষমতা ও প্রয়োজন ছাড়াই আইন প্রয়োগ করতে পেরেছিল, তাও একধরনের খেলাই ছিল ।

বাংলার অনাগত সমাজ হোক শিশুদের সমাজ। যে সমাজে পরিণত মানুষেরাও থাকবে আজীবন শিশু। বিপ্লব করতে গিয়ে তারা রিগ্রেশনে শুকিয়ে মরবে না, রক্ষণশীলতার পুরোহিত হয়ে উঠবে না। তারা খেলবে, গান গাইবে, নাচবে ও সার্ফিং করবে এবং অবশ্যই আইন নিয়ে খেলা করবে ।

(প্রবন্ধ: কেয়ামত, রহমত ও নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা)

গ্রন্থের নাম: মদিনা, 
লেখক: পারভেজ আলম
প্রকাশক: আদর্শ
প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২০
ISBN 9789848040072

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *