- পারভেজ আলম
ফরাসি দার্শনিক জিল দ্যলুজের একটা বিখ্যাত লেখা আছে “সোসাইটি অফ কন্ট্রোল নামে” (বাংলা অনুবাদ)। মিশেল ফুকো বর্ণিত ডিসিপ্লিনারি সোসাইটি বা শৃঙ্খলার সমাজের ধারণা যে আমাদের সময়ে যথেষ্ট না, তা তিনি এই লেখায় তুলে ধরেছেন এবং প্রস্তাব করেছেন যে আমাদের সময়কার সমাজ আসলে সোসাইটি অফ কন্ট্রোল তথা নিয়ন্ত্রণের সমাজ। এইটা নিঃসন্দেহে খুবি গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রবন্ধ, বিশেষ করে আমাদের এই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সমাজকে বোঝার জন্যে। ডিজিটাল টেকনোলোজির গাণিতিক ভাষা যে এখন সব ধরণের নিয়ন্ত্রণের পেছনকার সাধারণ ভাষা, এই ব্যাপারটার দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, যা আমার কাছে খুবি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যদিও নব্বইয়ের শুরুর দিকে তিনি এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন, কিন্তু আমাদের সময়ে এর গুরুত্ব আরো বেড়েছে। কিন্তু এই প্রবন্ধটাতেই দ্যলুজ এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা এই প্রবন্ধে হাজির থাকা তার দূরদৃষ্টির পাশাপাশি তার খণ্ডিত ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিও বুঝতে আমাদের সহযোগিতা করে। যেমন, তিনি লিখেছিলেন যে নিয়ন্ত্রণের সমাজে কারখানাকে প্রতিস্থাপন করেছে কর্পোরেশন। এইটা ঠিক যে নিও লিবারালিজমের সূচনা থেকেই ইউরোপ আমেরিকায় অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কায়িক শ্রমের কাজগুলা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলার কারখানাতে আউটসোর্স করে দিয়ে দুনিয়ার বড় বড় নগরগুলা হয়ে উঠেছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলার অফিসসর্বস্ব এলাকা। কিন্তু কারখানাগুলাকে প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে কর্পোরেট অফিস, এমন কথা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির দেশ বাংলাদেশের একজন মানুষের কাছে আজগুবি মনে হওয়া স্বাভাবিক। মানে, দ্যলুজের এই কথারে পাত্তা দেয়ার কিছু নাই, তা বলছিনা। যা বোঝা দরকার তা হইল যে, এক্ষেত্রে দ্যলুজের চিন্তার দিগন্ত সীমাবদ্ধ। তার চিন্তায় হাজির থাকা পুঁজিবাদী দুনিয়ার বাইরের ব্যাপার হইল বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলা (এমনকি এক্ষেত্রে পুঁজিবাদের ভাগারের মর্যাদাটাও তিনি আমাদেরকে দেন নাই)। অবশ্য, পাশ্চাত্যের বড় শহরগুলারে বাইরে যে বিরাট সংখ্যক শ্রমিক কারখানা হারাইছে, কিন্তু কর্পোরেট বাবু হইতে পারে নাই (যারা সাম্প্রতিক দুনিয়ায় উগ্র ডানপন্থার দিকে ঝুকে গেছেন, যেমনঃ ট্রাম্প সমর্থকদের বড় অংশ), তাদের বাস্তবতাও দ্যলুজের এই মন্তব্যে ধরা পড়েনা।
কিন্তু এই প্রবন্ধ এই মুহূর্তে আমাদের জন্যে একটা ছুতা। দ্যলুজের চিন্তার দিগন্ত যে বিভিন্ন সময়ে প্যারিস নগরের সীমানাটুকুর বাইরে বিস্তৃত হইতে পারে নাই, তা বলবার ছুতা। এই সমস্যা তার একার ছিল তা না। ফুকোরও ছিল। প্যারিসের বাইরের দুনিয়া যদিবা তারা কিছুটা দেখতে পাইতেন, পাশ্চাত্যের বাইরের দুনিয়া তাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাইতো বেশিরভাগ সময়। আর যখনি তারা পাশ্চাত্যের বাইরে তাকাইতেন, তখন প্রায়ই তাকাইতেন একরকম রোমান্টিক দৃষ্টিতে (এই কারণেই ইরানি বিপ্লব, মাওবাদ ইত্যাদি বিচারের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তা অতোটা ক্রিটিকাল ছিল না যতোটা ক্রিটিকাল ছিল আধুনিকতা ও পুঁজিবাদের বিচারের ক্ষেত্রে)। পূর্বপুরুষের কলোনিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করলেও তারা প্রাচ্যের বিভিন্ন বিষয়ে রোমান্টিসাইজেশন ও ফ্যান্টাসাইজেশন ছাড়তে পারেন নাই। দ্যলুজ আর গাতারির নম্যাডোলজি এক্ষেত্রে একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হইতে পারে। কান্ট একদা দর্শনের বাইরে থাকা মানুষদের নিন্দা করে দাবি করেছিলেন যে দর্শনের বাইরের দুনিয়া হইল একটা মরুভূমির ন্যায় যেখানে বেদুয়িনরা থাকে। নম্যাড বা বেদুয়িন কথাটা এক্ষেত্রে তিনি নিন্দাসুচক অর্থে ব্যবহার করেছেন। কান্টের এই বক্তব্যের বিপরীতে নিজেদের দাঁড় করাতে গিয়ে দ্যলুজ আর গাতারি আমাদের রবী ঠাকুরের মতো “ইহার চেয়েও হতেম যদি আরব বেদুয়িন” ধরণের কাব্যিক কল্পনার উপরে তাদের নতুন দার্শনিক চিন্তা দাঁড় করাইতে চাইলেন। যা এমনিতে খুবি সাহসী কাজ ছিল, এবং প্রচণ্ড রকম সৃষ্টিশীল। উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তায় নম্যাডোলজি তাই একটি প্রভাবশালী তাত্ত্বিক অবস্থান। এই তত্ত্ব এমন এক ডিটেরিটোরিয়ালাইজেশনের প্রস্তাব করে যার মাধ্যমে সবকিছুকেই, এমনকি আমাদের আত্মপরিচয় এবং কর্তাসত্তাকেও সদা সীমানাভাঙা সফরের মধ্যে থাকা ব্যাপার হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। নম্যাডোলজির দার্শনিক সম্ভাবনা অস্বীকার করবার উপায় নাই। কিন্তু বাস্তবতাতো এই যে, সারা দুনিয়ার সীমান্ত ভাঙতে এবং আত্মপরিচয় ও কর্তাসত্তার ক্ষেত্রে নিরাপদ সফরে থাকতে সক্ষম পাশ্চাত্যের নম্যাডিক এলিট সমাজের পক্ষেই এই চিন্তা অনুধাবন করা সহজ বেশি। এবং বাস্তবতাতো এই যে, পাশ্চাত্য মেটাফিজিক্স ও সিভিলাইজেশনের বাইরের যে এলাকা, যেখানে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেখানে দ্যলুজ বা গাতারির কল্পনার মতো আমরা ডিফারেন্স সওয়ারী কোন অশ্বারোহী নই, রবী ঠাকুরের কবিতার মতো আমাদের “চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন” হয়না।
বরং যে মরুভূমিতে আমরা জন্মগ্রহণ করি তা এক জেলখানাও বটে। অথবা একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। কিংবা স্নোপিয়ার্সার নামক ট্রেনটার লেজের দিকে থাকা বগিগুলা – টেইল। আমাদেরতো বেদুয়িন হওয়ার স্বাধীনতাই নাই, পাশ্চাত্যের নম্যাডিক এলিটদের ফ্যান্টাসিগুলা আমাদের সংগ্রামের সাথে যায় না অতোটা। মূলত এই কারণেই, বাংলাদেশে উত্তর-আধুনিক চিন্তা প্রভাবিত যে এলিটেরা (যারা ইউরোপীয়দের মতোই নম্যাডিক এলিট) আবার একিসাথে জনগণকে উৎসাহিত করেন আপন বন্দিদশাকে স্বাধীনতা ভাবতে, বা সস্তা জাতিবাদ ধরণের ভারত বিরোধিতায় মত্ত হইতে, তাদের চিন্তা আমার রিপালসিভ মনে হয়। এবং এই কারণেই আমি মদিনা বইতে হাজির করেছি – হাজেরাবাদ। বইটার প্রথম প্রবন্ধ, যাতে মহানবীর হিজরতকে উপজীব্য করা হয়েছে, তা আসলে দ্যলুজ ও গাতারির নম্যাডোলজির একটা প্রতিক্রিয়াও। প্রবন্ধের শেষদিকে এই ব্যাপারটা খোলাসা করেছি। অনন্ত উন্নয়ন, অপ্রতিরোধ্য প্রগতি আর সদা সফরের মধ্যে থাকা কর্তাসত্তার ধারণা পাশ্চাত্যের নম্যাডিক এলিট, এই দুনিয়ার শাসক শ্রেণীর মতাদর্শ হইতে পারে। তারাতো ডিফারেন্সের ঘোড়ায় চড়েই আজকাল দুনিয়া শাসন করেন। কিন্তু আমাদেরতো সাকিনা দরকার। বনি ইসরায়েল এবং বনি ইসমায়েলের যেমন মরুভূমির যাযাবর জীবনে সাকিনার দরকার পড়েছিল। মরুভূমিতে পথ চিনে নেয়ার জন্যে নবী ইব্রাহিমের যেমন সাকিনার দরকার পড়েছিল। মরুভূমিতে জন্ম নেয়া হাজেরার সন্তানদের প্রতিনিধি ইসলামের নবী যখন গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যখন তার পিছে ধাওয়া করে আসছিল ক্ষমতাধর জালেমেরা, তখন তার যেমন সাকিনার দরকার পড়েছিল। ইয়াজিদের সেনাপতি, কারবালার ভিলেইন ইবনে যিয়াদকে পরাজিত করবার সময় যেমন সাকিনার দরকার পড়েছিল। প্রগতির এই অপ্রতিরোধ্য রেলগাড়ির লেজের দিকে থাকা ক্যাম্পের মতো বগিগুলার বাসিন্দা আমরা যারা, আমাদেরও তেমন সাকিনা দরকার। অনন্ত সফর বা প্রগতির মতাদর্শ আমাদের নয়। বরং অনন্ত অর্থ তথা অর্থহীনতার এই সময়ে, এই কাঁটাতারঘেড়া মরুভূমিতে, সাকিনা আমাদের অর্থের ভরসা।
এইটা ঠিক যে আমরা যারা হাজেরার সন্তান, আমরা অনেকে ট্রেনের টেইলটাতে আবদ্ধ থাকিনা। আমরা থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, এমনকি ফার্স্ট ক্লাসেও কেউ কেউ চলাচল করতে পারি। এই ট্রেনের ইঞ্জিন চালু রাখতেই আমাদের দরকার পড়ে তাদের, যারা সামনের দিকে থাকে। কিন্তু, আমরা যেখানেই যাইনা কেন, যেখানেই থাকিনা কেন, আমাদের চোখ কান খোলা থাকে। আমরা ভুলিনা আমরা কারা। কোথায় আমাদের জন্ম হয়েছে, কোন অন্ধকারে হারায়া গেছে আমাদের ভাই ও বোনেরা, বন্ধু ও কমরেডরা। প্রতিটা ব্যর্থ বিপ্লবকে ওয়াক্ত ধরে নিয়ে আমরা বানাইতে থাকি আমাদের গোপন ক্যালেন্ডার। আমাদের মায়েরাতো স্রেফ আমাদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে সাফা আর মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি করে পুরা জীবন পার করে দিয়েছেন। টেইলের অন্ধকারের বাইরে তারা যান নাই, মুক্তির সূর্যের আলো তারা দেখেন নাই কোনদিন। কিন্তু আমরা যেখানেই যাই, আমাদের মা,ভাই, বোন ও কমরেডদের চোখ ও মুখ হয়ে থাকি। আমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হই না। একটা পোস্ট-হিউম্যান দুনিয়াতেও আমরা মানুষ হওয়ার লড়াই করি। এবং, হিউম্যানিটি উইল ফিল আওয়ার বেলিজ ওয়ান ডে, হোয়েন উই ইট দা রিচ অফ স্নোপিয়ার্সার, ওয়ান থাউজেন্ডস এন্ড ওয়ান কার’স লং।
হাজেরাবাদ
জিন্দাবাদ
*হাজেরাবাদ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ইসলামের ইতিহাসের রিভিশনিস্ট পণ্ডিত পেট্রিসিয়া ক্রোন। কিন্তু তার ব্যবহারের মধ্যে একধরণের কন্সপায়রেসির টোন হাজির ছিল। আমি অন্যদিকে হাজেরাবাদ কথাটি ব্যবহার করছি পাশ্চাত্য উত্তর-আধুনিক দর্শনের বিপরীতে।