ধান-রক্ষা যখন দেশ-রক্ষা: কিছু প্রস্তাব

  • লেখক: আলতাফ পারভেজ

করোনা মোকাবেলা ক্রমেই ক্রমে ক্ষুধা মোকাবেলার রূপ নিবে। কারণ দুটোকেই এক সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার জন্য এবং সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধে  মানুষকে যার যার অবস্থানে দীর্ঘসময় আটকে রাখতে রুটি-রুজির নিশ্চয়তা লাগবে।

পুরো দেশের রুটি-রুজির জন্য এসময় প্রধান এক প্রতিরক্ষা বর্ম বোরো ফসল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটা আসবে। সবুজ ক্ষেতগুলো আস্তে আস্তে লাল হবে এখন।

কিন্তু কৃষক ফসল কাটবে কীভাবে? ফসল রাখবে কোথায়? বিক্রি করবে কীভাবে? এই ধান-চাল নিয়ে দেশের অন্যরা কী ভাবছে? সিদ্ধান্তগুলো এ মাসেই নিতে হবে। নেয়া জরুরি। 

কিছু প্রস্তাব এখানে তুলে ধরা হলো। আলাপ-আলোচনা/মতবিনিময়ের জন্য। কোন কথা চূড়ান্ত ভাবার দরকার নেই।

ধানকাটা প্রসঙ্গে

প্রায় ৪৭-৪৮ লাখ হেক্টরে বোরো আবাদ হয়। বিপুল এই ধান স্বল্প সময়ে দ্রুত কাটা কষ্টকর হতে পারে লক-ডাউনের কারণে। কিছু জেলা লক-ডাউন আছে। আরও হয়তো হবে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্থ। তাহলে ধান কাটবে কারা? 

ভালো একটা বিকল্প হতে পারে গ্রামে গ্রামে স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি। সকল রাজনৈতিক দল এই স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনে নামতে পারে। কয়েক সপ্তাহ সময় আছে এর মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকদের করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধানকাটার প্রশিক্ষণ দিয়ে দেয়া যায় অনলাইনে ফেসবুক ব্যবহার করে এবং ইউটিউবে ভিডিও ছেড়ে। 

স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রুপ আকারে কৃষকদের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রামে গ্রামে রুটিন তৈরি করে ধান কেটে দিবে। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণরা ৯ মাস যুদ্ধ করেছিল দেশের জন্য। এবারও তরুণরা ২-৩ সপ্তাহ নিজেদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাটতে পিছপা হবে না। এমনকি মাড়াইয়েও তারা সাহায্য করতে পারবে। সবই হবে স্বাস্থ্যকরণীয় মেনে।

এরকম কাজের সময় কৃষক পরিবারগুলো স্বেচ্ছাসেবকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এই ঘটনা অনায়াসে একটা জাতীয় গৌরবময় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

ধান বিক্রি প্রসঙ্গে

ধানকাটা ও মাড়াইয়ের পরই কৃষকদের মাঝে ধান বিক্রির চাপ তৈরি হয়। তাঁদের টাকা দরকার হয়। কিন্তু এবার বাজার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আবার এবারের এই ধান-চাল জাতীয় সম্পদের চেয়েও বেশি কিছু। সুতরাং সরকারকে বিপুল ধান কিনতে প্রস্তুত থাকতে হবে। 

সরকার ইতোমধ্যে ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে ১৭ লাখ টন। এটা বহুগুণ বাড়ানো লাগতে পারে। কারণ সরকারকে করোনাকালে বহু মানুষকে বিপুল চাল দিতে হবে।

প্রশ্ন উঠেছে, সরকার বিপুল ধান-চাল কিনে রাখবে কোথায়? আসলে সরকার কৃষকদের টাকা দিয়ে ধান নিজের কাছে নেয়ার এখনি দরকার নেই। বরং প্রশাসনিক তালিকা তৈরি করে ঐ ধান কৃষকদের কাছেই রেখে দেয়া যেতে পারে। সরকার ধাপে ধাপে এই ধান-চাল নিতে পারে। ফলে একদিকে পরিবহনের দরকার হবে না, আবার কৃষকের টাকার চাহিদা কমবে, এবং সরকারের হিসাবের খাতাতেও ধান থাকার একটা নিশ্চয়তা তৈরি হবে।

কৃষক ধান রাখবে কোথায়?

এটা একটা জরুরি প্রশ্ন। সরকার যদি ধান কৃষকদের কাছেই রাখে এবং কৃষক যদি নিজেরাও বাকি ধানের বড় অংশ ধরে রাখে তাহলে সেগুলো রাখা হবে কোথায়? এক্ষেত্রে প্রস্তাব করছি,

[ক] উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব অডিটরিয়াম এবং পতিত স্কুলঘর আছে সেগুলো দ্রুত ধানের গুদামে পরিণত করে ফেলা হোক; প্রাইভেট কমিউনিটি সেন্টারগুলোও এ কাজের জন্য ভাড়া নেয়া যায় ২-৩ মাসের জন্য।

[খ] কৃষকদের প্রণোদনা আকারে টিন ও আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণ বিনামূল্যে দিলে কৃষকরাই বাড়িতে ছোট ছোট নতুন গুদামঘর তৈরি করে নিতে পারবে;

[গ] প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বা ইউনিয়ন অফিসগুলোর সামনে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বড়ো বড়ো মাঠে অস্থায়ী ধান গুদাম তৈরি করাও দুরূহ কোন কাজ নয়। কৃষকরাই পালা করে এসব গুদামের নিরাপত্তায় কাজ করতে রাজি থাকবে।

ধানের গুদামঘর তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনা কারিগরী দিক থেকে কঠিন কোন কাজ নয়।

কৃষক প্রণোদনা প্রসঙ্গে

এমুহূর্তে বোরো ওঠার পরপরই আবার কৃষক পরবর্তী মওসুমের ধান আবাদে নামবে বিভিন্ন অঞ্চলে। কোথাও কোথাও পাটও লাগানো হবে। তবে এবার যাতে পাট কমিয়ে ধানই বেশি লাগায় সেজন্য কৃষকদের বাড়তি সহায়তার আশ্বাস এখনি ঘোষণা করে দেয়া উচিত। এটা হতে পারে বীজে ও সারে বড় অংকের ভর্তুকি।

বিএডিসির বীজের পাশাপাশি প্রাইভেট বীজ ব্যবসায়ীদের থেকে বীজ কিনে নিয়ে এবং সারের মূল্য আরও কমিয়ে সরকার ভর্তুকি মূল্যে সেটা কৃষকদের দিলে পরবর্তী মওসুমের ধান আবাদে বাড়তি উৎসাহ তৈরি হবে। বর্তমান বোরোর পাশাপাশি আরও একটি মওসুমের ধান যদি এভাবে নিরাপদ করা যায়- তাহলে করোনাযুদ্ধের বড় এক অংশ সহজে সামাল দেয়া যাবে।

ধান থেকে চাল তৈরি প্রসঙ্গে

ধান থেকে চাল তৈরির সব বড় মিলকে আগামী কয়েক মাস সরকারের নিবিড় নজরদারিতে রেখে কাজে লাগাতে হবে। এটাকে একরূপ আংশিক জাতীয়করণও বলা যেতে পারে। সরকার তার ক্রয়কৃত ধান এসব মিল থেকে নির্ধারিত দাম দিয়ে চাল করিয়ে নিবে এবং নিয়মিত বিতরণ করে যাবে।

এছাড়া স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট যেসব চাতাল রয়েছে– [যেগুলোর তালিকা রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনে] সেগুলোকে বিনাসুদে ঋণ দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজে লাগানো দরকার হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় চাল বাজার স্থিতিশীল থাকবে। 

স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল থাকলে এবং সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ধান-চাল থাকলে মানুষকে এলাকায় রেখে করোনা টেস্ট করা সহজ হয়ে যাবে। 

বলাবাহুল্য, উপরোক্ত সবগুলো পদক্ষেপই স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থাকে চালু রেখে আপতকালীন সম্পূরক ব্যবস্থা হিসেবে প্রস্তাব করা হচ্ছে।

আলতাফ পারভেজ: লেখক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *