- লেখক: হাবিবুর রহমান
গোটা বিশ্ব আজ করোনার থাবায় পর্যদুস্ত। খালি চোখে দেখা যায় না এমন একটি জীবাণুর নিকট আজ অসহায় বিশ্বের তাবৎ ধনী দেশ, মহাপরাক্রমশালি রাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৯০ হাজার প্রাণ, আর আক্রান্ত হয়েছে ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ। আক্রান্ত দেশ ১৮৪টি। এ হিসাব ৯ এপ্রিলের। মৃত্যু ও আক্রান্ত মানুষের এই সংখ্যা প্রায় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অতীতেও নানা রকম জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের বহু জনপদ। মারা গিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তবে কোন মহামারি এমন করে গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেনি। কোটি কোটি মানুষের আয়-উপার্জন বন্ধ। স্থবির বেশিরভাগ দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। অর্থনীতিবিদদের আশংকা মহামন্দার দ্বার প্রান্তে বিশ্ব অর্থনীতি। অন্যদিকে মহামারির প্রতিক্রিয়ায় মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, স্বাস্থ্য ভাবনা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দর্শন, ধর্মীয় কার্যক্রমের ধরন এবং শাসন প্রণালিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বস্তুত বিশ্ব জুড়েই মানুষ এক নতুন উপলব্ধির সামনে দাঁড়িয়ে। যেমনটা ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সরাসরি উপনিবেশ ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটেছিল। বিশ্ব ক্ষমতার ভর কেন্দ্র স্থানান্তর হয়েছিল। তেমনি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আগের পৃথিবী এবং পরের পৃথিবী একরকম থাকবে না। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর ঘটবে, বিশ্ব ক্ষমতার ভর কেন্দ্রের স্থানান্তর হবে, উন্নয়ন ধারনায় মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হবে। বিশ্ব অর্থনীতি আরেকটা বাঁক নিবে যাকে বলে প্যারাডাইম শিফট। দার্শনিক, পণ্ডিত, বিশেষজ্ঞগণ ইতোমধ্যেই তাঁদের আশা ও আশঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে বলা শুরু করেছেন। এসব বক্তব্যের সূত্র ধরে মানবজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে এমন কিছু সম্ভাব্য পরিবর্তন নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো:
ক. আশা
১. মানব দেহকে রোগ প্রতিরোধ সক্ষম রাখা, মুনাফাকেন্দ্রিক ওষুধনীতির পরিবর্তন এবং ক্লায়েন্ট নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলনীতি:
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত এমন রোগীরাই মূলত মারা যাচ্ছেন। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট আছে, তারা করোনায় আক্রান্ত হলেও দ্রুত সেরে ওঠেন। ইতালির হেলথ ইন্সটিটিউট-এর দেয়া তথ্য বলছে, কোভিড-১৯-এর কারণে ১৭ মার্চ পর্যন্ত সেখানে যত লোক মারা গেছে তাদের ৯৯ ভাগের অন্য শারীরিক সমস্যা ছিল।
ওষুধ ও ভ্যাকসিনের উন্নয়ন; গবেষণা-উৎপাদনের ব্যয়বহুল, অকার্যকর ও বাজারকেন্দ্রিক ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। গত ২০ বছরে করোনা ভাইরাস গোত্রের বেশ কয়েকটি ভাইরাস বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করেছে (সার্স, কোভ-২, ইবোলা, জিকা ইত্যাদি), কোভিড-১৯ এর মধ্যে একটি। এই ধারণা অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে সার্স-এর পরিবর্তিত রূপের করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা আছে। সার্স-এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেদক আবিষ্কার সহজ হতো। করোনা ভাইরাস গোত্রের কোনটির যে প্রতিষেদক এখনও আবিষ্কার হল না, এতে উন্নত দেশের সরকারগুলোর চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ সরকারগুলো চেয়েছে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি তা করবে। কিন্তু মুনাফার নিশ্চয়তা না পেলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সংকট মাথায় রেখে ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি করবে না কোন কোম্পানি এবং বাস্তবে তা করেওনি। একইভাবে উন্নত দেশগুলোতে সুরক্ষা সামগ্রী ও চিকিৎসা উপকরণের ভয়াবহ সংকটও মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রকাশ করছে। জনগণের প্রয়োজন মেটানোর চেয়ে মুনাফাকেন্দ্রিক বিদ্যমান ওষুধনীতি পরিবর্তন করার সময় এসেছে। জনগণের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে নয়, রাষ্ট্রের হাতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সফল দেশ কিউবা। একারণে তারা আজ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ। করোনা ভাইরাস দেখা দেয়ার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী শনাক্ত করছেন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। কেউ আক্রান্ত হলে বাড়িতে রেখেই তাকে সেবা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কিনা জানছেন। পুরো দেশবাসী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর নজরদারিতে চলে এসেছে। ফলে নিয়ন্ত্রণে আছে করোনা সংক্রমণ। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৮২ জন চিকিৎসক রয়েছে যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। জনগণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী ও মহাপরাক্রমশালি দেশ থেকে অনেক ভাল অবস্থানে কিউবা, যাকে যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশক ধরে অবরোধ করে রেখেছে। এই দুর্দিনে তারাই উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশে ডাক্তার, চিকিৎসা উপকরণ, দুর্লভ ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করছে। এ মুহূর্তে অন্তত ৫৯টি দেশে ২৯ হাজারের বেশি কিউবান ডাক্তার রয়েছে।
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সফল উদাহরণ ভিয়েতনাম। সরকারিভাবে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ ও রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করার যে কর্মসূচি ভিয়েতনাম বহুদিন ধরে চর্চা করে আসছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সেটি বড় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্য কোভিড-১৯ দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আগেই তারা গোটা দেশটাই লকডাউন করে দেয়। এসব কারণে তাদের পক্ষে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছে।
ক্লায়েন্ট নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পাবলিকমুখী ব্যবস্থায় রূপান্তরের ডাক দিয়েছে করোনা। আগামীতে মুনাফাকেন্দ্রিক ওষুধনীতির বদলে স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধের উন্নয়ন ও উৎপাদনে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য সরকারগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় থাকা ত্রুটিগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী এক নতুন সংস্কার আন্দোলনের জন্ম হতে পারে, যা এমনকি বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনেও রূপ নিতে পারে।
২. প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ কার্যক্রম গতি পাবে:
অবারিত ভোগ ও লাগামহীন মুনাফার উদগ্র নেশায় ইতোমধ্যেই প্রাণ ও প্রকৃতির মহা ক্ষতি করা হয়েছে। জন্ম দেয়া হয়েছে ভোগবাদী সমাজের। দশকের পর দশক ধরে মানুষের সীমাহীন ক্ষুধাকে পরিতৃপ্ত করতে পৃথিবীর বুকে শিল্প কারখানা বা অন্যান্য স্থাপনা ও কৃষি জমির অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ ঘটানো হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ঝোপ-ঝাড়-বনাঞ্চল। বন্যপ্রাণীদের বাধ্য করা হয়েছে গুটিয়ে নিতে। এর ফলে বন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের সংযোগ বেড়েছে। আর এভাবেই সার্স, কোভ-২, ইবোলা, জিকার মতো বন্যপ্রাণীদের দেহে থাকা শত শত অণুজীব মানব দেহে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার লোকালয়ে চলে আসার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতির জৈব-অজৈব শৃঙ্খলা, যা এতদিন মানুষের সুরক্ষা জালের কাজ করেছে তা ভেঙ্গে পড়েছে। এ অবস্থা ভাইরাসজনিত মহামারির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মেরুঅঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বরফ দ্রুত হারে গলা শুরু করেছে। এতে হাজার হাজার বছর আগেকার চাপা পড়া জীবাণুগুলো মুক্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এসব মুক্ত জীবাণুগুলোর মধ্যে মহামারি সৃষ্টি করার জীবাণু থাকার আশংকা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এই আশংকাকে আরও জোরদার করবে যা মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করবে। এতে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে সরকারগুলোর ওপর চাপ বাড়বে।
প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস ও জলবায়ুর পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ভোগবাদী সংস্কৃতি। আগামীতে বৈশ্বিক মহামারির আতংক সমাজকে ভোগের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে।
৩. ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বিকাশের উন্নয়ন, মানুষে মানুষে ও দেশে দেশে বৈষম্য বৃদ্ধিকারী বিশ্বায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে:
আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী হতে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত চুইয়ে পড়ার অর্থনীতি যেখানে একার উন্নতির পথে সবার উন্নতি হবে বলা হয়েছে। প্রকৃতিকে পরাভূত করাই ভাবা হয়েছে সভ্যতা। করোনা দেখাল সকলই গরল ভেল। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত না হলে ব্যক্তি বিশেষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও থাকে না। করোনা ধনী-গরিব মানছে না। ধনী দেশ–গরিব দেশ মানছে না। কোভিড-১৯ ব্যক্তি বিশেষের রোগ নয়, যা শুধু চিকিৎসায় ভাল হবে। এটি একটি সামস্টিক রোগ। তাই একে যৌথ অংশিদারিত্বে, সকল মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে মোকাবেলা করতে হবে এবং তা-ই করতে হচ্ছে। বিশ্ব কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হলেও এধরনের নতুন কোন ভাইরাসজনিত সংক্রমণের আশংকা থেকেই যাবে। ফলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সারা বিশ্বের অস্তিত্ব একসূত্রে গাঁথা – এমন উপলব্ধি মানুষকে যুথবদ্ধতার শক্তি অনুধাবনে সহায়তা করবে। করোনা ভাইরাসের মতো ‘অভিন্ন শত্রু’র বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দলীয় ও মতাদর্শজনিত বিভাজনের বদলে মানুষের ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান উন্নয়ন মডেলের বিশ্বায়ন অল্পসংখ্যকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করছে, মানুষে মানুষে ও দেশে দেশে বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর করছে। প্রকৃত বৈশ্বিক ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় বাঁধা হয়ে আছে। তাই বৈশ্বিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বাঁধা ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী চুইয়ে পড়ার উন্নয়ন নীতির বিশ্বায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
৪. ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাসহ সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও জাতি বিদ্বেষমূলক ভাবাদর্শ দুর্বল হবে এবং মানবিকতার ভাবাদর্শ শক্তিশালী হবে:
মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে তাদের দেশের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ৪২৮ জনের মধ্যে ২৪৩ জন শ্রী পেটালিং মসজিদে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। ওই সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষ জমায়েত হয়। কোম ইরানের সবচেয়ে পবিত্র নগরী হিসেবে খ্যাত। ধর্মপ্রাণ শিয়া মসুলমানের কাছে কোম আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র। ইরানে যেসব স্থানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে এই কোম নগরী তার একটি। ফ্রান্সের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জা থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে কিছু দেশে। এই গির্জায় গিয়েছিলেন এমন আড়াই হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৭ জন মারা গিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় শিনচিওঞ্জি নামক এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর কয়েক শত সদস্য আক্রান্ত হয়েছে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত মোট রোগীর ২৫ ভাগই ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লীর মারকাজ নিজামুদ্দিন মসজিদে অনুষ্ঠিত তাবলীগ জামাত থেকে ছড়িয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটেনে দেখা গেছে হিন্দু ধর্মীয় ইস্কনের সমাবেশ করোনা ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
এভাবে করোনা ভাইরাস পবিত্র ধর্ম, পবিত্র সম্প্রদায়, পবিত্র স্থান নিয়ে মিথগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে। গুড়িয়ে দিয়েছে সাদাকালোর জাত্যাভিমান। ফলে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবাদি উগ্র মতাদর্শ ছড়ানো পূর্বের চেয়ে কঠিন হবে।
৫. তথ্য গোপন বা বিকৃত না করে জনগণকে আস্থায় নেয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করবে রাষ্ট্র, প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা:
চীন সরকার ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই কোভিড-১৯ সম্পর্কে জানতে পারে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ অন্তত ৬০টি নিশ্চিত কেস ছিল। তবে প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা তদন্তের পরিবর্তে চীন সরকার গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো সেন্সর করেছে। এমনকি সার্স এর মতো ভাইরাসের উহানে প্রাদুর্ভাব ঘটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হুইসেল ব্লোয়ারদের দমনও করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীনা অধিদপ্তর ডিসেম্বরের ৫ তারিখেই অজ্ঞাত উৎসের নিউমোনিয়া রোগীর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সতর্কতা জারি করলেও চীনের রাষ্ট্রয়ত্ব কেন্দ্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল জানুয়ারির ৭ তারিখে নভেল করোনা ভাইরাসের কথা নিশ্চিত করেছে। জানুয়ারির ২০ তারিখের আগে চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের তথ্য স্বীকার করেনি। জানুয়ারির ২৩ তারিখে উহান লকডাউন শুরু হয়। যদিও চীনের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো প্রশংসাযোগ্য, তবে চীন যদি আরও আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তবে আরও কম লোক সংক্রমিত হতো বা মৃত্যু হতো ধারণা করা অমূলক নয়। চীনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের জবাবদিহিতা না থাকায় এমনটা হতে পেরেছে মনে করা যায়। এমনটা ইরানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আবার ইতালি, স্পেন বা যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এসব দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। চীন না হয় শুরুতে বুঝতে পারেনি, কিন্তু এসব দেশগুলো তো আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিল? কিন্তু এসব দেশও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে, কালক্ষেপণ করেছে। সরকারগুলো প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয় নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন, উপহাস করেছেন। পরিণাম এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক সংক্রমিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। সহজেই অনুমান করা যায়, সবচেয়ে বেশি লোক মারা যাবে এদেশেই। ইরান বা চীনা রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি ইউরোপ, আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
খ. আশংকা
১. নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাড়বে:
করোনা ভাইরাসের আতংককে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট তথা শাসকেরা এমনসব নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রহণ করা হলে ন্যুনতম বিরোধিতা বা সমালোচনার শিকার হতে হতো। কিন্তু এখন করোনার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’, ‘জরুরি অবস্থা’ ইত্যাদি ছুতোয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা আরও নিরুঙ্কুশ করা হচ্ছে। মানুষের জীবন ও আচরণকে কড়া রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের নিগড়ে শৃঙ্খলিত করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, শৃঙ্খলিত করার নতুন মূল্যবোধ গড়ে তোলা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে গণমানুষের মনোজগতে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি করে। ভীতিকর দিক হল, ভাইরাসসহ যে কোন ‘অশুভ’ শক্তিকে দমন করতে হলে রাষ্ট্রের মহা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা প্রয়োজন এর স্বপক্ষে জনসম্মতি আদায় করার ভাবাদর্শ গড়ে তোলা হচ্ছে। যেন মানুষ নিজেদের ‘কল্যাণের’ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের ছড়ি ঘোরানোকে অনিবার্য মনে করতে পারে। কর্তৃত্ববাদী ও চরম নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের বিষয়টি এখন অনেকটা বাস্তব। আশংকা, করোনা পরবর্তী কালে রাষ্ট্রের এই চরিত্র বহাল থাকবে। যেহেতু কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের স্বপক্ষের মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, এর স্বপক্ষে জনসম্মতি আদায় করা সহজ হবে।
২. ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার প্রযুক্তিগত নজরদারি বা বায়োমেট্রিক সারভেলেন্স অব্যাহত থাকবে ও প্রসার লাভ করবে:
করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত নজরদারির নানা উপকরণ ব্যবহার করেছে বিভিন্ন রাষ্ট্র। যেমন চীন মোবাইল সেটে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে ও চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য জানাতে বাধ্য করেছে। এর ফলে সম্ভাব্য ভাইরাস সংক্রমিতদের দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এবং বিভিন্ন অ্যাপ এর মাধ্যমে নাগরিকদেরকে সক্রমিতদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে টেস্টিং ও স্ক্রিনিং-এর আওতায় আনতে পারা করোনা নিয়ন্ত্রণে ভাল ফল দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানও ট্র্যাকিং অ্যাপ ব্যবহার করেছে এবং ভাল ফল পেয়েছে। অনেকের আশংকা, করোনা সংক্রমণ বন্ধ হলেও নজরদারির এই প্রক্রিয়া চালু থাকবে। কিম্বা নতুন নতুন রাষ্ট্র এধরনের প্রযুক্তি তার নাগরিকের ওপর নজরদারিতে ব্যবহার করবে। এসব রাষ্ট্র নজরদারি ব্যবস্থা চালিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখাবে আগামীতে নতুন কোন ভাইরাসের আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে ইত্যাদি।
৩. বৈষম্য আরও বাড়বে:
প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর দেখা যায় সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য বেড়ে গেছে এবং সুবিধাভোগী শ্রেণি আরও ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। চলমান করোনা দুর্যোগজনিত জরুরি অবস্থা শেষ হলে এবারও আমরা দেখতে পাবো, ধনী এবং যোগাযোগ ও সম্পদে সুবিধা প্রাপ্তরা কতটা ভালভাবে টিকে আছে; আর দুর্বল, দরিদ্র, ঐক্যবদ্ধ নয় – এমন গোষ্ঠীগুলো কতটা দুর্দশায় পড়েছে। সরকারগুলো বিশাল বাজেটের প্রণোদনা ঘোষণা করছে। কিন্তু এসব প্রণোদনার প্রধান সুফল পাবে কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। আবার বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রগুলোতে অসংখ্য মানুষ সরকারি সুবিধার আওতার বাইরে থেকে যায়। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত (ক্ষমতার সকল স্তরে) সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী প্রণোদনার সুফল নিয়ে নেয়। তাই সার্বিকভাবে বৈষম্য বাড়বে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শ্রেণির মধ্যেকার ব্যবধান বৃদ্ধিই শুধু নয়, মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলোর মধ্যেও বৈষম্য বাড়বে।
নোয়াম চমস্কির বক্তব্য দিয়ে এ লেখা শেষ করছি। তা হল, ‘যখন আমরা এ সংকট উতরে যাব, তখন আমাদেরকে হয় খুব ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তৃত্ববাদী হিংস্র রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বেছে নিতে হবে অথবা সমাজের যৌক্তিক পরিবর্তন ঘটবে, মানবিক এক দয়াবান সমাজ তৈরি হবে যেখানে ব্যক্তিগত লাভের তুলনায় সামষ্টিক মানুষের প্রয়োজন গুরুত্ব পাবে’।
লেখক: গবেষক এবং সম্পাদক, রাষ্ট্রচিন্তা জার্নাল।