মহামারির কালে শাসকেরা ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করে

  • লেখক: অ্যান্না অ্যাপলবাম ,ভাষান্তর: সারোয়ার তুষার

[অনুবাদকের ভূমিকা: মার্কিন সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ অ্যান্না অ্যাপলবাম গত ২৩শে মার্চ২০২০-এ The Atlantic সংবাদমাধ্যমে  When Disease Comes, Rulers grab More Powers শিরোনামে একটি আর্টিকেল লেখেন। এই আর্টিকেলে তিনি করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে কীভাবে ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করছে ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহ তার বিবরণ দিয়েছেন। মহামারির কালে মানুষ যখন চরম নিরাপত্তাহীন ও উদ্বেগের মধ্যে দিন যাপন করছেরাষ্ট্রগুলো তখন নজরদারির নিত্যনতুন কৌশল রপ্ত করছেসংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে মানুষের জীবনযাপনকে স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করার আয়োজন সম্পন্ন করেছে।

এই আর্টিকেলে তিনি দেখিয়েছেন মানুষের সামনে যদি ভালোমন্দ বাছাই এর উন্মুক্ত সুযোগ থাকেতাহলে মানুষ নিজ স্বার্থেই পরিস্থিতি অনুযায়ী ভূমিকা পালন করে এবং সার্ভেইলেন্সের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত করোনা ভাইরাসের মতো সংকট মোকাবেলা করামানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করা নয়। মানুষ যেন চাইলেই প্রয়োজনে সার্ভেইলেন্স সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসতে পারে সেরকম ব্যবস্থাও থাকা উচিত।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সেইসব দেশই সাফল্য অর্জন করেছে যারা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেছে মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। যেসকল রাষ্ট্র তথ্য গোপন করেছেপরিস্থিতিকে অস্বীকার করেছেতারা সবচাইতে বাজে অবস্থা পার করছে।

অ্যান্না অ্যাপলবামের এই আর্টিকেলটি অনুবাদ করতে গিয়ে হাঙ্গেরির সরকারের এই ক্ষমতা কেন্দ্রীভবনটা খেয়াল করছিলাম বাংলাদেশের বাস্তবতায়।

হাঙ্গেরির সরকার করোনার উছিলায় পার্লামেন্টে এমন এক বিল পাশ করেছে, যা দেশটাতে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে সরকার প্রধান ভিক্টর ওর্বানের হাতে সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। তিনি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত যেকোন আইন প্রণয়ন করতে পারবেন আইনপ্রণেতাদের পরামর্শ ছাড়াই, যেকোন প্রচলিত আইনকে অস্বীকার করতে পারবেন। নির্বাচন, গণভোট স্থগিত থাকবে।

এমন কোন বক্তব্য বা তথ্য পেশ করা যাবেনা যা ‘বিশৃঙ্খলা’, ‘অস্থিতিশীলতা’ তৈরি করতে পারে। করলে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এমনকি কোয়ারেন্টাইন না মানলেও কারাদণ্ড। কিন্তু সত্য-মিথ্যা কে ঠিক করবে তার কোন উল্লেখ নাই। বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের উছিলায় যদি বিরোধী দলের লোকজনকে আটকে রাখা হয়, তা ঠেকানোর কোন উপায়ও নাই।

এমনকি সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির যেকোন সমালোচনাই ‘মিথ্যা’, ‘বিশৃঙ্খলা’র আওতায় পড়তে পারে।

অন্য সময়ে হাঙ্গেরির বিরোধি দল একব্যক্তির হাতে এত নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান করার প্রতিবাদ করত। এখন সময় ভিন্ন। কেউই ‘জাতীয় শত্রু’ হিশেবে চিহ্নিত হতে চায় না।

এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কিন্তু কোনভাবেই বোঝার উপায় নাই যে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে করোনা মোকাবেলায় হাঙ্গেরির প্রস্তুতি সবচেয়ে কম ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতাকে আরো কেন্দ্রীভূত করার কোন সুযোগকেই হাতছাড়া করা যাবেনা!

হাঙ্গেরির পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মেলাচ্ছিলাম। আমরা কত সুখে আছি! আমাদের কোন ‘বিশেষ আইন’ পাশ বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়না। ফেসবুক পোস্ট দেয়ায় শিক্ষক-প্রভাষক বরখাস্ত হচ্ছে, করোনা মোকাবেলায় সরকারের ‘সমন্বিত উদ্যোগ’ এর অংশ হিশেবে অলরেডি স্ব-ইচ্ছায় অধীন টেলিভিশন মিডিয়াগুলোর উপর ‘গুজব’ দমনে নজরদারি চলছে।

র‍্যাবের সাইবার মনিটির টিম সক্রিয়। এখনো পর্যন্ত ‘গুজব’ প্রচারের কারণে ৫০ জনকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-আমলারা মানুষের সাথে নির্মম অমানবিক আচরণ করছে। ‘না বুঝে’ কোন ফেসবুক পোস্ট লাইক-কমেন্ট করলেই নাকি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারের প্রাথমিক ভাষ্য ছিল দেশে কোন করোনা নাই। জ্বর-সর্দি-শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে ‘উন্নয়নবিরোধী’ মানুষজন। অথচ বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের চতুর্থ তথা সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়ে আছে।

সরকারের দাবি অনুযায়ী আমাদের এখানে পরিস্থিতি একদম ‘স্বাভাবিক’! কোন গোলযোগ নেই! কোন ঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’ নেই!

যারা কিছু হলেই দেশে জরুরি অবস্থা চায়, তাদের উচিত হাঙ্গেরির ঘোষিত জরুরি অবস্থার সাথে বাংলাদেশের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার তুলনা করে দেখা এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’র যে ডিসকোর্স হাজির হয় উপলব্ধি করা।

আসলে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবেই প্রধান নির্বাহির কাছে একচেটিয়া ক্ষমতা ন্যস্ত করা আছে। তিনি চাইলে এই ক্ষমতা যেকোন ভাবেই ব্যবহার করতে পারেন। কোন ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র দোহাই দিতে হয়না। এরকম একচেটিয়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতা একব্যক্তির হাতে সাংবিধানিকভাবে ন্যস্ত করার নজির পৃথিবীতে খুব বেশি পাওয়া যায়না।

করোনাকালে জনস্বাস্থ্য, কৃষি এবং আসন্ন সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে সমাজের দরিদ্র অংশের কথা মাথায় রাখা দরকার সর্বাগ্রে। এই দুইক্ষেত্রেই আমরা সরকারের চরম উদাসীনতা এবং ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি। সরকারি দলের সাথে জড়িতদের ত্রাণের বস্তা লুট করতে দেখছি। অথচ মানুষকে নিপীড়ন-অত্যাচার করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরম দানবীয় চেহারাও প্রত্যক্ষ করছি।

মহামারি, দুর্ভিক্ষের কালে সমাজকে শক থেরাপি দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আরো সুদৃঢ় করাই আপাতদৃষ্ট্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান কাজ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সবমিলিয়ে করোনা নয়যেন বাংলাদেশের মানুষকেই দমন করতে চায় রাষ্ট্র। মহামারির অজুহাতে সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রকে আরও প্রবল করতে চায়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রথম উপায় হলো সমাজ রূপান্তরকামী রাজনৈতিক কর্মীঅ্যাক্টিভিস্টদের রাষ্ট্র সম্পর্কিত বোঝাপড়া আরও তীক্ষ্ণ করা এবং ভিন্নভাবে সমাজসম্পর্ক ভাবতে পারার মতো সংকল্পরূপকল্প।]

মূল প্রবন্ধ

গত ১৩ ই মার্চ— যেমনটি ঘটেছিল— আমার স্বামী পোলিশ মহাসড়কে গাড়ি চালাতে চালাতে খবর চালু করল এবং জানতে পারল যে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সীমানা বন্ধ করে দেয়া হবে। ও আমাকে তৎক্ষণাৎ ফোন করল। কয়েক মিনিট পরেই আমি লন্ডন থেকে ওয়ারশের টিকিট কিনলাম। আমি সেখানে সব সময় থাকি না, তবে আমার স্বামী পোলিশ, আমার নিজের একমাত্র বাড়িটি পোল্যান্ডের এক পল্লী গ্রামে এবং আমি সেখানে যেতে চাইছিলাম। পরের দিন সকালে, ওয়ারশের ফ্লাইট ছাড়া হিথ্রো বিমানবন্দর বলতে গেলে একেবারেই ফাঁকা ছিল, যা আবার বাণিজ্যিক ট্রিপের মাধ্যমে নিজ দেশে ফিরতে চাওয়া মানুষে ঠাসা ছিল । চেক-ইন করার সময় এজেন্টরা কোনো পোলিশ পাসপোর্ট বা রেসিডেন্স ডকুমেন্ট ছাড়া যাত্রীদের বোর্ডিং করতে দিচ্ছিল না । তারপরে কেউ একজন বুঝতে পেরেছিল যে, নতুন নিয়মগুলো কেবল মধ্যরাতে কার্যকর হয়েছে । আমি একজন স্টুয়ার্ড এবং দুই নন-পোলিশ যাত্রীর কথোপকথন শুনতে পেলাম : ‘আপনি বুঝতে পারছেন যে আপনি আবার ফ্লাইটে চড়তে পারবেন না এবং লম্বা সময়ের জন্য ওয়ারশে আটকা পড়তে পারেন…।’

একই দিনে, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সদ্য কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে ফোন করে তাকে বিমানবন্দরে যেতে বলেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পরে সে বন্ধুবান্ধবের সাথে থাকার পরিকল্পনা করছিল । কিন্ত আমরা তাকে বার্লিনে যাওয়ার শেষ ফ্লাইটের সাথে সংযোগকৃত লন্ডনের শেষ ফ্লাইটগুলোর একটিতে উঠে পড়তে আধঘণ্টার একটা নোটিশ দিয়েছিলাম। রবিবার, সে ইউরোপে অবতরণের করতে করতেই, পোল্যান্ড তার সীমান্ত সমস্ত গণপরিবহন প্রবেশের ক্ষেত্রে বন্ধ করে দিয়েছিল। সে বার্লিন থেকে পোলিশ-জার্মান সীমান্তের একটি শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট আন ডের ওদার (Frankfurt an der Oder) যাওয়ার ট্রেন ধরেছিল। তারপরে সে স্টেশন থেকে বেরিয়ে লাগেজসহ হাঁটতে শুরু করেছিল যেন শীতল যুদ্ধের সময়ে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের সিনেমা। সে রোডব্লক ও বন্দুকধারী সৈনিক দেখতে পেল । আমার স্বামী তাকে সীমান্তের অপর পাশ থেকে রিসিভ করল ।

পোল্যান্ডই সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া প্রথম কিংবা শেষ ইউরোপীয় দেশ ছিল না। প্রায় এক ডজন ইউরোপীয় দেশ বর্তমানে সীমান্ত চলাচল বন্ধ কিংবা নাটকীয়ভাবে শিথিল করে রেখেছে। এছাড়াও, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুক্ত-চলাচল অঞ্চল – শেঙ্গেন (Schengen) অঞ্চল- বর্তমানে অ-ইউরোপীয় নাগরিকদের প্রবেশ বন্ধ রেখেছে। এই নাটকীয় সীমান্ত বন্ধের মেডিকেল প্রমাণাদি বিব্রতকর: ২০১৪ সালে ইবোলা সংকট নিয়ে কাজ করেছিলেন জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের প্রাক্তন কর্মী অ্যামি পোপ, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, ওবামা প্রশাসন তৎকালীন পশ্চিম আফ্রিকার যাত্রীদের সীমান্ত বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করেছিল, যদিও ‘বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে এটি করতে বারণ করেছিল কারণ এতে করে রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যাবে।’ সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই সীমান্ত বন্ধ করে দিলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের গতি কমিয়ে দিতে পারে এবং বিমানবন্দর, নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে আক্রান্ত মানুষের ভিড় বাড়াতে পারে। এইভাবে সীমান্ত বন্ধ করে দিলে আসলে বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না তবে ‘সুনিশ্চিত’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এমন ভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। গত জানুয়ারিতে চীন থেকে আগত ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ট্রাম্প এবং এই সিদ্ধান্ত তিনি সহ তার প্রশাসনকে এই ভ্রান্ত ধারণায় উপনিত করেছিল যে তারা COVID-19 ভাইরাসকে রুখে দিয়েছে। আসলে তারা রুখতে পারেনি।

পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে, এই আকস্মিক, আপাতদৃষ্টিতে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। পোলিশ নাগরিকরা এখন সর্বত্র আটকা পড়েছে এবং তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার চার্টার ফ্লাইট ( রাষ্ট্রীয় লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে ফ্লাইট) এর ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে। ইউক্রেন, বেলারুশ এবং বাল্টিক দেশসমূহের বাড়ি ফিরতে চাওয়া ট্রাক চালক থেকে শুরু করে ট্যুরিস্ট পর্যন্ত হাজার হাজার নাগরিককে— তাদের গাড়ি সহকারে পোলিশ-জার্মান সীমান্তে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তারা খোলা ময়দানকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করেছে কারণ সীমান্তরক্ষীরা নন-পোলিশদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছিল। আটকে পড়া এই মানুষদের জার্মান রেড ক্রস খাবার, পানীয় এবং কম্বল সরবরাহ করেছিল।

এইসব কঠোর, নাটকীয় কোনো পদক্ষেপই পোল্যান্ডে ভাইরাসটির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেনি। মহামারিটি কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই সংক্রমিত হতে শুরু করেছিল এবং এখনো সংক্রমিত হচ্ছে। তবে বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও— সম্ভবত বিশৃঙ্খলার কারণেই— সীমান্তের এই চিরুনি অভিযান অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাষ্ট্র ‘কিছু’ কাজ তো অন্তত করছে! এবং অনাগত সংকটে এই ‘কিছু’ই হবে আশ্রস্থল!

স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময়ে আগ্রাসী এবং অতিউৎসাহী সরকারি হস্তক্ষেপের নজির নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে বরাবরই, মহামারি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিস্তার ঘটিয়েছে। ১৩৪৮ সালে যখন প্লেগ মহামারিতে মৃত্যু ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ জুড়ে, ভেনিসের কর্তৃপক্ষ শহরের বন্দর বন্ধ করে দিয়েছিল যেন প্লেগ-উপদ্রুত অঞ্চল থেকে আগত জাহাজগুলো ভেনিসে প্রবেশ করতে না পারে এবং সব ভ্রমণকারিকে ৩০ দিনের জন্য সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য করেছিল, যা অবশেষে ৪০ দিনে গড়ায়; সেই থেকেই ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির উৎপত্তি। তারও কয়েক শতাব্দী পরে রানি প্রথম এলিজাবেথের মুখ্যমন্ত্রী উইলিয়াম সেসিল এই মহামারিকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে এমন একটি আইন প্রণয়ন করেছিলেন যা অসুস্থদের ছয় সপ্তাহের জন্য নিজ গৃহে বাধ্যতামূলক বন্দি রাখার অনুমোদন দিয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। কয়েক বছর পরে এইসব পদক্ষেপের সমালোচনা করে এবং এগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে ‘প্লেগ আইন ১৬০৪’ প্রণীত হয়েছিল।

অন্তত যখন মানুষ আতঙ্কিত ছিল, তারা মেনে চলেছে। প্রায়ই যখন লোকেরা মৃত্যুর ভয়ে থাকে, তারা ভুল বা সঠিকভাবে, যেভাবেই হোক, এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে যেগুলো তাদের রক্ষা করবে বলে তারা বিশ্বাস করে। যদি এমনকি এতে তাদের স্বাধীনতা কিছুটা খর্বও হয়। এমন সব পদক্ষেপ অতীতেও জনপ্রিয় ছিল। উদারনৈতিক, মুক্তিমুখী, গণতন্ত্রী এবং সকল ধরনের স্বাধীনতাপ্রেমীদের উচিত হবে না নিজেদের বোকা বানানো। এমন পদক্ষেপ এখনো জনপ্রিয় হবে।

কিছু কিছু ইউরোপীয় দেশে, আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাপক পরিমাণে সামাজিক সম্মতি সহকারে সেইসব প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখছি। ইতালি সম্পূর্ণ লক-ডাউনে গেছে। নিতান্তই অপরিহার্য মনে হওয়া খাতগুলো বাদে বাদবাকি সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় চলাচল রোধ করতে রোডব্লক করা আছে, পাবলিক পার্ক, খেলার মাঠ বন্ধ আছে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাইরে থাকা হাজার হাজার মানুষকে ইতালির পুলিশ জরিমানা করেছে। গত মঙ্গলবার থেকে প্যারিস একইভাবে কঠোর লকডাউনে ছিল। কোনো ফর্ম পূরণ না করে আপনি বাড়ি ছাড়তে পারবেন না; মানুষ যেন নিয়ম ভঙ্গ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য এক লক্ষ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গত সপ্তাহের বুধবার, একদিনেই ফরাসি পুলিশ অযথা বাইরে থাকার কারণে চার হাজার জরিমানা করেছে।

হ্যাঁ, এই পদক্ষেপগুলো নির্মম। কিন্তু মানুষ এখন এসব পদক্ষেপকে জরুরি মনে করছে। এই মুহূর্তে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কন্টি প্রত্যেক ১০ ইতালীয়র মধ্যে ৭ জনের সমর্থন উপভোগ করছেন। ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিবিদদের অবিশ্বাস করে এমন কোনো দেশে এই সংখ্যা অভূতপূর্ব। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন করোনার বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে ‘যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছেন এবং এই ধরনের আগ্রাসী মনোভাব ও ভাষা তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয় সমর্থন পাইয়ে দিয়েছে।

পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, কোনো কোনো দেশ আরও মারাত্মক পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকেছে। গত শুক্রবার, হাঙ্গেরি সরকার সংসদে একটি বিল প্রেরণ করেছে যা প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওর্বানকে “জরুরি অবস্থা”র অজুহাতে স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রদান করবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, আইনপ্রণেতাদের পরামর্শ ছাড়াই তিনি চাইলে যেকোনো আইন তার ইচ্ছামাফিক উপেক্ষা করতে পারবেন। নির্বাচন ও গণভোট স্থগিত থাকবে। কোয়ারেন্টিন ভঙ্গ করা ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হবে, অর্থাৎ কারাদণ্ডের মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য। মিথ্যা তথ্য ছড়ানো অথবা ‘বিশৃঙ্খলা’, ‘অস্থিতিশীলতা’ তৈরি করতে পারে এমন কোনো তথ্য পরিবেশন করাও আইনত দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু কে ‘মিথ্যা’কে সংজ্ঞায়িত করবে তা অস্পষ্ট। এই আইনের ভাষা এতটাই অস্পষ্ট যে সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির যেকোনো সমালোচনাই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এইসব ব্যবস্থার কোনোটাই কিন্তু এই সত্য প্রকাশ করছে না যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মহামারির মোকাবেলায় হাঙ্গেরি সবচাইতে অপ্রস্তুত, কারণ দেশটির জাতীয়তাবাদী সরকারের নীতিসমূহ ডাক্তারসহ বহু শিক্ষিত মানুষকেই দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল।

স্বাভাবিক সময়ে, হাঙ্গেরির সরকার বিরোধীরা একব্যক্তিতে সমস্ত ক্ষমতার কাছাছোলা সমর্পনকে কোনোভাবেই সমর্থন করত না, বিশেষত এমন একটি আইন যা সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে ডিজাইন করা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে, এমনকি সরকারের বিরোধীদের অনেকেও সরকারকে সমর্থন জানাবেন। হাঙ্গেরিয়ান বিশ্লেষক পিটার ক্রেকো আমাকে বলেছিলেন, “তাদের সজাগ থাকার সমস্ত সিস্টেমকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলছিলেন, ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের এই মুহূর্তে, কেউই নিজেকে ‘দেশদ্রোহী’ কিংবা কোনোভাবে হাঙ্গেরিয়ানদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ক্ষতি করছে এমনভাবে হাজির করতে চায় না। প্রত্যেকেই জাতি ও রাষ্ট্রের আবশ্যিক ‘মঙ্গলে’ বিশ্বাস রাখতে চায়।

ইজরায়েলেও একই রকম আকস্মিক রূপান্তর ঘটছে। নির্বাচনে হেরেও প্রধানমন্ত্রীত্বে বহাল থাকা বেনজামিন নেতানিয়াহু জরুরি আদেশ জারি করেছেন যা তাকে নিজের অপরাধের বিচারের সূচনা স্থগিত সুযোগ করে দিয়েছে এবং যা বিরোধী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নবনির্বাচিত ইসরাইলি সংসদকে কার্যকর হতে বাধা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে কোনো তদারকি ছাড়াই তিনি নিজেকে নজরদারি করার বিপুল নতুন ক্ষমতাও দিয়েছেন। সন্ত্রাসীদের ট্র্যাক করার জন্য ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠান ও কৌশলগুলো এখন ব্যবহৃত হবে কোয়ারেন্টিন আনুগত্য পর্যবেক্ষণে। সাধারণ নাগরিকদের ক্রিয়াকলাপ, চলাফেরার অনুসরণ করতে এবং তাদের তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে নজর রাখার জন্যও এসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে। তবে ইজরায়েলি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কখনোই এই নজরদারি কার্যক্রম কিংবা নেতানিয়াহুর স্ব-প্রণোদিত ক্র‍্যাকডাউনের কোনটাই মেনে নিবেনা। ইজরায়েলি পত্রিকা হা’আরেজ (Haaretz) ইতিমধ্যেই এসব পদক্ষেপকে ‘করোনা ক্যু’ হিশেবে অভিহিত করেছে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত ইজরায়েলিরা ভীত থাকবে, জনসংখ্যার অপর অংশ এসব পদক্ষেপ মেনে নিবে।

সহনাগরিকদের এমন প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আমেরিকানদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের ফেডারাল সিস্টেম আমাদের কিছু সুবিধা দেয়: কোয়ারেন্টিন ক্ষমতা একেক রাজ্যে একেক রকম এবং এই ক্ষমতা খুব সম্ভবত প্রয়োগ করবে রাজ্য পুলিশ, ফেডারেল নিরাপত্তা বাহিনী নয়। তবে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন যে তিনি বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার চেয়ে ভান করতে বেশি পছন্দ করেন। টেস্ট কিট এবং মাস্কের ব্যাপক উৎপাদনের চাইতে সীমান্ত বন্ধ কর‍তে বেশি পছন্দ করেন। আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তাঁর এ ধরনের কীর্তিকলাপের তালিকা বেশ দীর্ঘ: ইউক্রেন কেলেঙ্কারি আমাদের সামনে উন্মোচন করেছিল আইনের শাসনের প্রতি ট্রাম্পের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই এবং মুলার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে তিনি থোড়াই পরোয়া করেন। তিনি ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক কারণে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং তার একটি শক্তিশালী মোসাহেবগোষ্ঠী আছে যারা তার সকল কর্মকাণ্ডের বন্দনায় মেতে থাকে। আসন্ন সপ্তাহ বা মাসগুলোতে খুব সম্ভবত তিনি নিজের আরও ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হাঙ্গেরির ওর্বান এবং ইজরায়েলে নেতানিয়াহুর মতোই এই সংকটকে ব্যবহার করবেন এবং ফক্স নিউজ তাকে সমর্থন করবে। অনেক আমেরিকানও তাই করবে।

পলিটিকো জানিয়েছে, বিচার বিভাগ ইতোমধ্যেই কংগ্রেসের কাছে বিনা বিচারে আমেরিকানদের আটক করার ক্ষমতা চেয়েছে, যদিও এই ধরনের ক্ষমতা দূরবর্তী কারণেও প্রয়োজনীয় নয়। এই আইনজীবীদের মধ্যে যারা এসব পদক্ষেপ এবং এমন আরও অনাগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন, তারা তাদের নির্বাচনী ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে যাচ্ছেন।

ভিন্ন এক দুনিয়ায় অন্য ধরনের রাষ্ট্রপতির অধীনে মার্কিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাজ করার আরও ভালো সুযোগ বিরাজ করত। গণউদ্বেগ কাটানোর আরও ভালো উপায় থাকত। জনগণের ভালো-মন্দ তদারকি করা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা, আইনের শাসনকে স্থগিত না করার আরও কার্যকরী পথ উন্মুক্ত থাকত। দক্ষিণ কোরিয়া, একটি প্রতিশ্রুতিশীল গণতন্ত্র, করোনভাইরাস রোগীদের এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে অ্যাপস ব্যবহার করছে, কিন্তু এজন্য তাকে সংসদ স্থগিত করতে হয়নি। জনস্বাস্থ্যে ডেটা এবং আচরণগত বিজ্ঞানের ব্যবহারকে উৎসাহিত করে এমন একটি সংস্থা সার্গো ফাউন্ডেশনের সেমা সগাইয়ার উল্লেখ করেছেন যে প্রযুক্তিকে অন্য উপায়েও কাজে লাগানো যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, COVID-19 এর প্রাদুর্ভাব পর্যবেক্ষণ করা যেন কোয়ারান্টিন লকডাউনগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকা বা শহরে সীমাবদ্ধ রাখা যায় এবং এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোর চাপিয়ে দেয়া কাছাছোলা শাটডাউন এড়ানো সম্ভব। মহামারি শেষ হয়ে গেলে নাগরিকদের ট্র‍্যাকিং সিস্টেম থেকে লগ আউট করার অধিকার প্রদান করে স্বচ্ছ উপায়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহারও করতে পারা উচিত।

পোল্যান্ডে, সরকার এই ধরনের অত্যাধুনিক কৌশল প্রয়োগ করা থেকে এখনো অনেক দূরে এবং পুরানো পদ্ধতিগুলোই এখনো বলবৎ আছে। আমাদের গ্রামীণ জেলার স্থানীয় পুলিশ নিয়মিত ফোন করছে, আমাদের বাড়ির সবাই যেন ঘরেই থাকে তা নিশ্চিত করতে। বিদেশফেরত প্রত্যেকের জন্যই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পুলিশের আচরণ বেশ নম্র। আমি বুঝতে পারি যে তারা তাদের কাজটাই করছে এবং এর উদ্দেশ্য মানুষকে নিরাপদ রাখা। তবে আমি বা তাদের তালিকায় থাকা অন্য কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব না, মহামারি দূর হওয়ার পরে, সংকটকালে কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত নতুন ক্ষমতা খর্ব করা সম্ভব হবে কিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *