- স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্য; ভাষান্তর: সহুল আহমদ
[স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্যের Mission Bengal: A Saffron Experiment গ্রন্থটি গত ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের দিনেই theprint.in সাইটে গ্রন্থটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হয়েছে। স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য্যের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের ঐ নির্বাচিত অংশের অনুবাদটি পূর্বে ‘বোধিচিত্ত’ প্রকাশ করেছে।]
ভারতীয় রেনেসাঁর রঙ্গমঞ্চ হিসাবে উনিশ শতকের বাংলা থেকে যেমন আধুনিক ভারতের বহু জিনিসের উদ্ভব ঘটেছে, তেমনি এটি ছিল হিন্দুত্ব ধারণার জন্মভূমি, যে হিন্দুত্ববাদকে আরএসএস হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হিসাবে ব্যাখ্যা করে। খোদ হিন্দুত্ব শব্দ, ভারত মাতার ধারণা এবং বন্দে মাতরম শ্লোগান সব ছিল বাংলার ফসল যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুরা বিপদে আছে, যে ধারণাটা ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ, সেটার গোড়াও বাংলাতে পাওয়া যাবে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু সমাজের উপর পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে সেই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের উত্থান ঘটেছিল।
ব্রাহ্মধর্ম ছিল একেশ্বরবাদী সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন, এর জন্ম হয়েছিল হিন্দু সমাজের পশ্চিমা শিক্ষার সংস্পর্শে আসার ফলে। এই আন্দোলনই ছিল বাংলার (বা ভারতীয়) নবজাগরণের বীজ। এই আন্দোলন মূর্তিপূজা, ধর্মীয় গ্রন্থ ও অবতারের প্রতি বিশ্বাস, এবং ধর্ম, বর্ণ ও জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্যকে অস্বীকার করেছিল; এটি নানান সংস্কারকে প্রশ্ন করেছিল এবং নারীশিক্ষার পক্ষেও ছিল। ‘ভারতীয় নবজাগরণের জনক’ এবং ‘আধুনিক ভারতের জনক’ রাজা রামমোহন রায় এবং রবী ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে ১৮২৮ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল।
ভারতকে ‘মা’ হিসাবে চিত্রায়ন ও দেখা জনপ্রিয়তা অর্জন করে ১৮৬০ এর দশকে। ‘ভারত মাতা’ শব্দের প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত একটি স্যাটায়ারমূল বাংলা গ্রন্থে: উনবিংশ পুরাণ। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ছদ্মনামে এটি প্রকাশিত হয়। সাধারণত লেখক ও পন্ডিত ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে এর বেনামী লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি বাংলার হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের একজন অংশ ছিলেন। মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সময়কে নিয়ে আলোচনাকালে ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধায় লিখেন যে, ১৮৪০-১৮৭০ সালে কলেজ ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ ‘বাঙালি মনন ও সংস্কৃতির জন্য স্বাস্থ্যকর ছিল না’, এবং পশ্চিমা শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাঙালির মনকে ‘হীনমন্যতা’ (ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স) জড়িয়ে ধরেছিল। তিনি বাঙালি বলতে বাঙালি হিন্দুকেই বোঝাতেন।
১৮৬৭ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি, নাট্যাকার ও সম্পাদক নবগোপাল মিত্র এবং প্রাবন্ধিক রাজনারায়ণ বসুদের নেতৃত্ব হিন্দু মেলা আয়োজিত হয়, যাকে ‘জাতীয় মেলা’ বলেও ডাকা হতো। মেলার উদ্বোধন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথের একটি গান দিয়ে, যেখানে ভারতকে মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে: মলিন মুখ-চন্দ্রমা ভারত তোমারই। ১৮৭০ দশকের শেষাংশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম’ গান লিখেন। এই গানটি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর যুগান্তকারী ও বিতর্কিত সাহিত্যকর্ম আনন্দমঠ-এর অংশ হয়ে যায়। আনন্দমঠ তার সাহিত্যমান এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে যেমন যুগান্তকারী ছিল, তেমনি বিতর্কিত হয়েছিল মুসলিম-বিরোধী মনোভাবের জন্য। পাশপাশি ১৮৮২ সালে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান শাসকদের ইতিহাসকে বাংলার ইতিহাসের অংশ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
‘আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই। সে সকলে যদি কিছু থাকে, তবে যে সকল মুসলমান বাঙ্গালার বাদশাহ, বাঙ্গালার সুবাদার ইত্যাদি নিরর্থক উপাধিধারণ করিয়া, নিরুদ্বেগে শয্যায় শয়ন করিয়া থাকিত, তাহাদিগের জন্ম মৃত্যু গৃহবিবাদ এবং খিচুড়ীভোজন মাত্র। ইহা বাঙ্গালার ইতিহাস নয়, ইহা বাঙ্গালার ইতিহাসের এক অংশও নয়। বাঙ্গালার ইতিহাসের সঙ্গে ইহার কোন সম্বন্ধও নাই। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ইহাতে কিছুই নাই। যে বাঙ্গালী এ সকলকে বাঙ্গালার ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়। আত্মজাতিগৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়।’
তিনি এই প্রবন্ধেই বাংলার নির্মোহ ইতিহাস খোঁজা ও লেখার জন্য বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানান। বাঙালি দ্বারা তিনি আসলে বাংলাভাষাভাষী হিন্দুই বোঝাতেন।
চন্দ্রনাথ বসুর বই হিন্দুত্ব ১৮৯২ সালে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ছাপার হরফে হিন্দুত্ব শব্দ ব্যবহারের প্রথম নজির এই বইয়ে পাওয়া যায়। কলকাতা রিভিউ ১৮৯৪’র (জুলাই, খন্ড ৯৯) সংখ্যাতে আড়াই পৃষ্ঠাব্যাপী এর একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছিল; সেখানে এই বইকে ‘হিন্দু পুনর্জাগরণের কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
যদিও হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ শুরু হয়েছিল পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাল্টা জবাব হিসেবে, তবু এটি ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে মোড় নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করে। প্রাথমিক মনোভাব ছিল যে, হিন্দুরা অধস্তন নয়, তাদেরকে অধীনস্ত করে রাখা যাবে না।
ভারতীয় ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার তাঁর বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৩-১৯০৮) গ্রন্থে লিখেন:
‘ডিরোজিও পর্বে স্বল্পকালের জন্য এই আন্দোলনকে [নবজাগরণ] মনে হয়েছিল এটি হিন্দু জাতপাতের [sectarian] ঐতিহ্যের সাথে আসলেই র্যাডিকাল ছেদ ঘটাতে এবং সত্যই সেকুলার সংস্কৃতি অর্জন করতে যাচ্ছে। … কিন্তু সামনের শতকে দেখা গেলো, বাঙালি ভদ্রলোকের জাগ্রত জাতীয় গর্ব প্রাচীন হিন্দুর গৌরব ও মধ্যযুগে মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিরোধের চিত্রের মধ্যেই শক্তি খুঁজে নিলো। … দেশপ্রেমকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের সাথে মিলিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা গেলো। ‘হিন্দু’ এবং ‘জাতীয়’ সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকলো।’
আনন্দমঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে হাজির হয়। ব্রিটিশদের হটানোর জন্য এই জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের সাথে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনেনি। বইটির প্রথম সংস্করণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের লড়াই থেকে মুসলমানদের একেবারেই বাদ দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় সংস্করণে যদিও শত্রু গোরা, ব্রিটিশ ও সেনা থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘নেড়ে’ ও ‘যবন’ হয়ে যায়। এই দুটো অবমাননাকর শব্দ দ্বারা বাংলার মুসলমানদেরকে বোঝানো হতো।
বাংলাদেশের প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার মতে, বঙ্কিমের মতন আর কেউ বাংলার সমাজ ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করেন নি। ফ্রান্সে রুশোর সোশাল কন্ট্রাক্টের যে প্রভাব তার সাথে কেবল তুলনা করা যেতে পারে বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে আনন্দমঠের প্রভাব। শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গ্রন্থে বঙ্কিমের সাহিত্যমানকে স্বীকার করে নিয়ে ছফা জোর দেন যে, বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তায় তাকে একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে দিয়েছে। ছফা বলেন, ‘বঙ্কিম ক্ষমতাবান লেখকের চেয়েও অধিক কিছু ছিলেন।’ এও বলেন যে, ‘তিনি সর্বপ্রথম একটি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন’ এবং ‘বাংলাদেশ বিভাগ করার জন্য কোনো একজন ব্যক্তিকে দায়ী করতে হয়, তিনি অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’।
এই শতকের শেষ দিকে মহারাষ্ট্র ও বাংলায় বিভিন্ন গোপন বিপ্লবী সংঘের আবির্ভাব ঘটে। এই সংগঠনগুলোর সদস্যরা ছিলেন মূলত ভদ্রলোক, মানে ধনী, উচু জাত এবং শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি; কিন্তু নিচু জাতের সদস্যরাও ছিলেন।
মুসলমানরা এই সংঘগুলোর অংশ ছিল না। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং হেমচন্দ্র কানুনগো এর বিবরণ থেকে দেখা যায় যে মুসলমানদের এতে স্বাগত জানানো হয়নি। গীতা ছুয়ে শপথ গ্রহণ তাঁদের কর্মসূচির একটা অংশ ছিল এবং ‘বন্দে মাতরাম’ ছিল তাঁদের লড়াইয়ের শ্লোগান। বাঘা যতীন, ক্ষুধিরাম বসু থেকে শুরু করে মাস্টারদা সূর্য সেন পর্যন্ত অনেক পূজনীয় বিপ্লবী এই সংঘগুলোর সদস্য ছিলেন, যারা কিনা আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটিশ প্রশাসনকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন।
বিশ শতকের গোড়া থেকে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সম্প্রদায়ের সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করতে মুসলমান অভিজাতদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার সাথে সাথে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ নতুন আকার ধারণ করে।
১৯০৯ সালের জুন থেকে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সম্পাদিত কলকাতা ভিত্তিক ইংরেজি পত্রিকা বেঙ্গলি-তে ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিস অফিসার ইউ.এন. মুখার্জির লেখা ‘Hindu: A Dying Race’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। লেখাগুলো পরে বই আকারেও প্রকাশিত হয়। হিন্দুরা বিপদে আছে, তাদের জেগে উঠা ও পদক্ষেপ গ্রহণের দরকার— এই ধারণার ভিত্তি হিসাবে ইতিহাসবিদরা এই লেখাগুলোকে চিহ্নিত করেন।
মুখার্জি লিখেছেন, ‘বিভিন্ন উপায়ে কোনো জনগোষ্ঠী নিজের দেশ থেকে কমতে কমতে অবশেষে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। আমরাও একই ভাগ্য বরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি’। তিনি তারপর ব্যাখ্যা করেন কীভাবে নিউজিল্যান্ডের মাওরি, যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী ও হিসপানিওলারা বিদেশী আগ্রাসনের মুখে হারিয়ে গিয়েছিল: ‘আমরাও ক্ষীয়মান জাতি। প্রতিটি আদমশুমারিতে এটা ফুটে উঠছে। আনুপাতিকভাবে আমরা দিনকে দিন কমে যাচ্ছি… বছরের পর বছর ধরে হিন্দুদেরকে পিছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যে জমি একদা তাদের দখলে ছিল সেটা আজ মুসলমানরা দখল করে নিচ্ছে। দেশের জনগণের হিস্যায় তাদের অনুপাত ধীরে ধীরে কমছে’।