‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ প্রসঙ্গে

  • লিখেছেন হাসনাত কাইয়ুম

‘কনফেসনাল স্টেটমেন্ট’ বা অভিযুক্তের ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ একটা লিগ্যাল টার্ম । ইংরেজি ‘কনফেসন’ শব্দটি একটি ধর্মীয় রিচ্যুয়ালের সাথেও যুক্ত। ধারণা করা যায় ধর্ম থেকেই আইন, বিশেষত সাক্ষ্য আইন, এই ধারণাটি ধার করেছিলো । এখনো আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের আগে শপথ পাঠ করার একটা নিয়ম চালু আছে । কিছুদিন আগেও এইসব শপথ যার যার ধর্ম অনুযায়ীই সাক্ষীরা পাঠ করতো। আদালতে ন্যায় বিচার হয়, এই ধারণাটি যে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে এরও একটি বড় কারণ এই যে, আমাদের অধিকাংশ মানুষের ন্যায়ের ধারণা ধর্ম থেকে উদ্ভূত এবং আইন-আদালত এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে যে তারা সেই ন্যায়ই প্রতিষ্ঠা করে থাকে ।

মানুষের ন্যায়ের ধারণা, ধর্মের ন্যায় এবং আইনি ন্যায়ের মধ্যে যে পার্থক্য আছে আমাদের পণ্ডিতেরা সেটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, এমনটা খুব একটা চোখে পড়ে না।

এইসব ন্যায় এবং অন্যায় নিয়ে এইখানে বড়ো আকারে তর্ক না করেও এটুকু বলা যায়, কনফেসন বা কনফেসনাল স্টেটমেন্ট বলতে এমন এক ধরনের জবানবন্দীর কথা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যা অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন প্রকার ভয়-ভীতি-লোভ বা প্রতারণার শিকার না হয়ে অপরাধ-বোধ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় সত্য জানানোর মানসিক তাড়না থেকে স্বতঃ:প্রণোদিত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়ে করে থাকে।

এই ধরনের জবানবন্দী রেকর্ড করার আগে কি ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের করতে হবে তার নির্দেশনা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় বিস্তারিতভাবে বলা আছে । আর এইসব জবানবন্দী কখন, কতোটা, কিভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বা হবে না সেসব বিষয়ে সাক্ষ্য আইনের ২৪-৩০ ধারার মধ্যে নির্দিষ্ট করে বলা আছে । এইসব ধারা -উপধারায় একটি কথাই বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে কাউকে ভয়-ভীতি-নিপীড়ন-নির্যাতন বা প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ানো যাবে না, দিলে বা নিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না ।

এসব ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ । সংবিধানের ৩৫(৪)এ বলা হয়েছে “কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না । ”

এতসব বিধি নিষেধ এবং সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতার পরেও যে পুলিশ রিমান্ড থেকে ফিরেই অভিযুক্তরা হরহর করে খুন-খারাবি,-ধর্ষণ-লুণ্ঠন, সবকিছুর দায় নিজের কাঁধে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে এর কারণ কি ? পুলিশরা কি গির্জার পাদ্রির চেয়েও মানুষকে ধর্মে ফেরানোতে অনেকবেশী কার্যকর নাকি অন্য কিছু ?! এর গূঢ় রহস্য কি আমরা সবাই জানি না ? আমরা কি এই আইনের সংস্কারের জন্য কথা বলেছি ? সকলের জানাশোনা, সকলের চোখের সামনে সংঘটিত মিথ্যার উপর দাঁড়ানো যে বিচারিক ব্যবস্থা সেই মিথ্যা-ব্যবস্থা দিয়ে আপনি সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলবেন আর সমাজ অপরাধমুক্ত হয়ে যাবে এটা কি আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *