সোজার্নার ট্রুথ: নারীবিদ্বেষ ও বর্ণবৈষম্য-বিরোধী পথিকৃৎ আগুন

ব্যকগ্রাউণ্ডের ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া হয়েছে।
  • লেখক: হেলাল মহিউদ্দীন

মার্টিন লুথার কিং-এর বিখ্যাত ভাষণ “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম” (১৯৬৩) এরও ১১২ বছর আগে সমান শক্তিশালী বা তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ “আই’ন্ট আই অ্যা উওম্যান” (১৮৫১) শিরোনামের ভাষণটি দিয়েছিলেন একজন হতদরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ স্বশিক্ষিত ক্রীতদাসী। জন্মনাম ইসাবেল। পরিচিত ছিলেন নিজের দেওয়া সোজার্নার ট্রুথ নামে।

ট্রুথের বাবা-মাও ক্রীতদাস। শৈশবেই পিতাকে হারালেন। স্বাভাবিকভাবেই বিক্রি হতে থাকলেন এক মালিক হতে আরেক মালিকের কাছে। অমানবিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন,ধর্ষিতা হওয়া কিছুই বাদ যায়নি।

তারুণ্যে আরেক ক্রীতদাসের প্রেমে পড়লেন। প্রেমের অপরাধে সেই ক্রীতদাসের মালিক ট্রুথের সামনেই নির্মম নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত করে কোথায় যেন রেখে এসেছিল ক্রীতদাসটিকে। আর দেখা হয়নি দু’জনের। দুই-এক বছর পর প্রেমিকের মৃত্যুর খবর পেলেন ট্রুথ। সেই অসহনীয় যাতনা এবং মানসিক ট্রমা নিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রুথ।

শুধু ক্রীতদাসপ্রথার বিলোপ,নারী-পুরুষের সমানাধিকার, ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকার নিয়েই নয়—বিশেষ সোচ্চার সাহসী কণ্ঠস্বরে সেই সময়েই সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে “কৃষ্ণাঙ্গ” এবং “নারী” ধারণার চুলচেরা গভীর বিশ্লেষণ ছাড়া ভবিষ্যতের নারী-অধিকার আন্দোলন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলিট এবং শ্বেতকায় নারীর অধিকার আন্দোলনই রয়ে যাবে। ট্রুথের ধারণার সত্যতা প্রতিদিনই মিলছে।

১৭০ বছর আগে কীভাবে তিনি ‘ইন্টারসাব্জেক্টিভিটি’র মত সূক্ষ্ম ভাবনা ভাবতে পেরেছিলেন—বর্তমান সময়ের সমাজবিজ্ঞানের জন্য এটি এক গভীর বিস্ময়ের বিষয়। সমাজবিজ্ঞানে “ইন্টারসাব্জেক্টিভিটি” নতুন একটি ধারণা। ইতিহাসবিদ নেল পেইন্টার জানাচ্ছেন— “ইন্টারসাবজেক্টিভিটি”র সেরা ধারণা ট্রুথই দিয়েছেন—“Among blacks are women; among the women, there are blacks.” ‘বর্ণবাদের গভীর যেন নারীরূপেরই প্রতিচ্ছবি,নারীরূপের গভীর যেন বর্ণবাদেরই প্রতিচ্ছবি’—এই সুগভীর ইন্টার্সাবজেকটিভ দর্শনের ধারেকাছেও যেতে পারেননি কিং।

মার্টিন লুথার কিংকে ট্রুথের কণাপরিমাণ দুর্ভোগও সইতে হয়নি। তবুও কিংই লাইমলাইটে। অথচ ট্রুথ কিং-কে বহুদূর ছাড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাণ্ডারি হয়েছিলেন।

আজ ২৯ মে। ১৮৫১ সালের এই দিনটিতেই তিনি অলিখিত ও স্বতঃস্ফূর্ত “আই’ন্ট আই অ্যা উওম্যান” ভাষণটি দিয়েছিলেন।

শিক্ষাদীক্ষা-জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলোতে ট্রুথ আলোচিত হচ্ছেন। আমেরিকা ও ইউরোপে তিনি ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে স্থান পেয়েছেন, এবং পাচ্ছেন। তাঁর নামে স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠকেন্দ্র,লাইব্রেরি ইত্যাদির নামকরণও হয়েছে। তাঁর ছবিসহ যুক্তরাষ্ট্রের দশ ডলারের বিল বাজারে আসবে এই বছরই।

কিং-এর গুরুত্বকে খাটো করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ট্রুথ-এর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটিকে স্মরণের প্রেক্ষাপটে উদ্দেশ্য এই কথাটি বলা যে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান এবং জেন্ডার স্টাডিজের আলোচনায় ট্রুথ-এর অন্তর্ভুক্তিও প্রয়োজন।

  • হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *