- সৈয়দ নিজার
কয়েকদিন আগে সুলতানের জন্মদিন গেছে। সুলতানের শিল্প বিষয়ক কিছু তথ্য এবং একটি ভুল পাঠ নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে পারেনি। আজ যখন সময় হল, তখন দেখলাম বাজারের পুরাতন এক গায়েবি পাঠ খানিকটা নতুন মোড়কে হাজির হয়েছে। তাই ভাবলাম সেই আলোচনাটাও যুক্ত করা যেতে পারে।
(১) একটি তথ্য:
সুলতান পঞ্চাশের দশকে দেশে ফেরার পর ১৯৬৮ সালে আবার কিছুদিনের জন্য করাচিতে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কিছু ড্রইং এবং চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। করাচিতে তিনি তার বন্ধু পাকিস্তানের শিল্পী আহমদ সাঈদ নাগীর বাসায় ছিল। সেই সময়কার কিছু ড্রইং এবং চিত্র নাগীর সংগ্রহ ছিল। এই বছর সেই সংগ্রহের কিছু ছবি নিউইয়র্কের নিলামে বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ছবি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক সুলতান প্রেমিক সংগ্রহ করেছেন। উনার নাম ইচ্ছাকৃতভাবে উল্লেখ করছি না। তবে যে মূল্যে ছবিগুলো বিক্রি হচ্ছে, তা জেনে মনে হল বাংলাদেশের অনেকেই ছবি গুলো কিনতে পারতেন। তাতে হয়তো বা সুলতান গবেষণায় অনেক সহায়তা হত। বিশেষত, একটি ফিগারের ড্রয়িং এর ক্ষেত্রে, সেটা আমাদেরকে উত্তর-পূর্বের সুলতানের ফিগার গুলো বুঝতে সহায়তা করতো। যাই হোক এখানে আমি দু-একটি ছবি যুক্ত করেছি আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
(২) একটি ভুল পাঠ:
আমি বেশ কয়েক বছর ধরে দাবি করেছিলাম উত্তর-পূর্বে সুলতানের চিত্রকর্ম গুলোর মধ্যে বিউপনিবেশায়ন এর প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু, পঞ্চাশের দশকে যে হাতে গোনা কয়েকটা ছবি আমরা পাই, সেগুলো ইউরোপীয় অভিব্যক্তিবাদী ধাঁচের ছবি। কিন্তু, গত বছরের শেষের দিকে প্রকাশিত লটে হায়েক এবং সংযুক্ত সন্দর্শনের এক লেখায় আমার এই দাবিকে খানিকটা বর্ধিত করেছেন। তারা দাবি করেছে, পঞ্চাশের দশকে সুলতানের শিল্পকর্মের মধ্যে বিউপনিবেশায়নের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। লেখাটি ছাপা হয়েছে খুব নামকরা একটা জারনালে থেকে। তাদের লেখার পক্ষে খুব একটা শক্তিশালী কোনো যুক্তি খাড়া করতে পারেননি।
১৯৫২ সালের দিকে সুলতান রকফেলা ফাউন্ডেশন বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে তিনি বেশকিছু জলরং এর মধ্যে অভিব্যক্তিবাদী ধাঁচের ছবি আঁকেন, যার একটা প্রদর্শিত হয়েছে বিলাতে। ১৯৫২ সালের ক্যাটালগ তা উল্লেখ আছে। এই ছবিটা, যুক্তরাষ্ট্রের ফুর্টনিতে আঁকা। এ ছবি অভিব্যক্তিবাদী ধাঁচের। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় যে ছবিগুলো অংকন করেছিলেন সেগুলোর একটা বড় অংশ বাংলাদেশের সামদানী পরিবারের সংগ্রহে আছে। সেগুলো থেকেও স্পষ্ট, সুলতানের পঞ্চাশের দশকের চিত্রকর্মে বিউপনিবেশায়নের কোন চিহ্ন লক্ষ করা যায় না। তাই আমার মনে হয়, তাদের পাঠ ভুল।
(৩) গায়েবি পাঠ:
সুলতান এর উপরে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তারেক মাসুদ। তথ্যচিত্র নাম দিয়েছিল ‘আদম সুরত’। তারেক মাসুদের সুলতান পাঠ অনেকাংশই অপরিপক্ক, গবেষণার কোনো নজির নেই। সুলতান একটা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, তিনি পাত্রের আকার বিবেচনায় নিয়ে পানি ঢালতেন। যার পাত্রের যে এ আকার তিনি দ্রুত তা বুঝে সেই পরিমাণ পানি ঢালতেন। তা বুঝা যায় সুলতানের ইন্টারভিউ গুলো পড়লে। সম্ভবত সবচেয়ে পরিপক্ষ ইন্টারভিউ নিয়েছেন, অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান। ইন্টারভিউটা পর মনে হয়েছিল, তিনি আরেকটু দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিলেই পারতেন। তার ইন্টারভিউতেই সুলতানের প্রকল্পটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই যারা সুলতান নিয়ে আগ্রহী, তাদের শাহাদুজ্জামানের ইন্টারভিউটা পাঠ করা উচিত।
যাই হোক, এখন আসি তারেক মাসুদের তথ্যচিত্র প্রসঙ্গে। কেন তিনি তথ্যচিত্রের নাম আদম সুরত দিয়েছিলেন তা আমি জানিনা তবে তার ইংলিশ করেছিলেন ‘ইনার স্ট্রেন্থ’ । বাংলা এবং ইংরেজি নামের বিস্তর ফারাক আছে। আদম শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়, আদি পিতা আদম অর্থাৎ নাম অর্থে; অথবা মানুষ জাতি অর্থাৎ শ্রেণীর নাম অর্থে। তারেক মাসুদ তার তথ্যচিত্রের পোস্টারে সুলতানের ১৯৭৫ সালে আঁকা ‘প্রথম বৃক্ষরোপনের’ অংশবিশেষ ব্যবহার করেছিলেন। এই পোস্টটা দেখে অনেক লোকই ভেবেছিল, এই ছবির নাম আদম সুরত। আর সুলতান আদি পিতা আদম এর ছবি এঁকেছে। তারেক মাসুদের তথ্যচিত্র এত প্রভাবশালী ছিল যে সুলতানের এই ছবির নাম প্রথম বৃক্ষরোপণ থেকে আদম সুরত হয়ে গিয়েছিল। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগ প্রথম বৃক্ষরোপণ এর আদলে দেয়াল ভাস্কর তৈরি করে তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘আদম সুরত’। তো বুঝতেই পারছেন, তারেক মাসুদের তথ্যচিত্র কতটা প্রতাপধরী। তারেক মাসুদ হয়তোবা, ‘মানুষের চেহারা’ অর্থাৎ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চেহারা অর্থে আদম সুরত নামটি হওয়ার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একটি গায়েবি পাঠ তৈরি হয়েছিল, সুলতান আদি পিতা আদমের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আদি পিতা যে কৃষক বা শিকারি ছিলেন এই তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না, যতটুকু জানি ফল ফল খেয়েই জীবন যাপন করেছেন। সুলতান অনেক ইন্টারভিউতে বলেছেন, এই ছবি হচ্ছে প্রথম কৃষকের ছবি, যে মাটির বুকে প্রথম বীজ বপন করছে, সে প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। নিজের ভাগ্যের নির্মাতা নিজেই হচ্ছে, সে প্রকৃতি এবং ঈশ্বরের উপর আর নির্ভরশীল নয়। আর সেই মুহূর্ত লক্ষ্য করছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এক পরী।
এই গায়েবি পাঠ সত্য আরেক মাত্রা পেয়েছে এক ভ্রান্তির কারণে। ১৯৮৬ সালে, সুলতান ‘হত্যাযজ্ঞ’ নামে চিত্র এঁকে ছিলেন। সুবীর চৌধুরী আল্লাদ করে সেই ছবির ইংরেজি নাম দিয়েছিলেন ‘after the flood’। সুবীর চৌধুরী নিজের লেখা উল্লেখ করেছেন, তিনি যে এই ছবির ইংরেজি নাম দিয়েছেন ‘after the flood’। সুবীর চৌধুরীর দেয় নাম বইয়ের কোন এক পৃষ্ঠায় চাপা পড়েছিল। খুব একটা বেশি লোক জানতো না। ২০১৭ সালে, মুস্তাফা জামান ডেইলি স্টারে সুলতান নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। মোস্তফা জামান এক আলাপে আমাকে বলেছিলেন, তিনি লেখা সাথে কোন ছবি পাঠান নি। কিন্তু পত্রিকার ছবি প্রয়োজন ছিল, তাই তারা কিছু ছবি লেখাটিতে যুক্ত করে দিয়েছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ১৯৮৬ সালে আঁকা হত্যাযজ্ঞ। ইংরেজি পত্রিকা, ছবির ইংরেজি নাম প্রয়োজন, তাই সুবীর চৌধুরীর আল্লাদ করে দেয়া ইংরেজি নাম ‘after the flood’ ব্যবহার করেছিল। সদ্য দেখলাম হত্যাযজ্ঞ ছবির নামের ভুল ইংরেজি অনুবাদের কারণে গায়েবি পাঠ নতুন মাত্রা পেয়েছে। হত্যাযজ্ঞ ছবিটা হয়ে উঠেছে নুহের মহাপ্লাবনের গল্প। শুধু গুগোল আর কল্পনা মিশাইলেই যা হয়।
ফেসবুক: ১৯-০৮-২০২০