সুলতানের রুহানিয়াত: ‘বন্যার পর’ ও ‘আদম সুরত’

  • পারভেজ আলম

সম্পাদকীয় মন্তব্য: বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতান (এস এম সুলতান) ১০ আগস্ট ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী পারভেজ আলম বিভিন্ন সময়ে এস এম সুলতানের আঁকা ছবিকে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, এবং পাঠ হাজির করেছেন। সুলতানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পারভেজ আলমের দুটো ছোট লেখা ব্লগে প্রকাশিত হলো।

এস এম সুলতান

এস এম সুলতানের আঁকা ‘আফটার দা ফ্লাড’ তথা ‘বন্যার পর’ ছবিটা প্রথম দেখার পর ছবির নাম ও বিষয়বস্তু আমাদেরকে একরকম দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারন বাংলাদেশে বন্যার পরবর্তী যেই ধরণের ছবি (ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং, ভিডিও) দেখতে আমরা অভ্যস্ত এই ছবিটি সেই অভ্যস্ততাকে ধাক্কা দেয়, ভেঙেচুরে ফেলে। আমরা বন্যার দেশের মানুষ। বন্যা শুধু নদীর দু কুল ছাপিয়ে ধ্বংসই করে না; নিয়ে আসে পলি মাটি, নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। তবে মাঝেমাঝেই এই বন্যা বড় বেশি বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। এইরকম প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসাবে পরিচিত বন্যা পরবর্তি ধ্বংসস্তুপ, মানুষ ও গবাদি পশুর লাশ আর তারমধ্যে কোনমতে টিকে থাকার লড়াই করে যাওয়া দূর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের দুঃখ, কষ্ট আমাদের পত্রিকা, টেলিভিশনের খবরে এবং শিল্পীদের ক্যামেরা অথবা তুলিতে বারবার উঠে এসেছে। এই দিক থেকে সুলতানের ‘আফটার দা ফ্লাড’ অনন্য। ছবিটিতে ক্ষেতের পানির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে থাকা মানুষের দেহ বন্যা পরবর্তি সময়ের একটা প্রতিরূপ হাজির করে বটে, কিন্তু এই দেহগুলো ধ্বংস অথবা দূর্ভিক্ষ কবলিত নয়। ছবিটিতে নারী, শিশু ও পুরুষরা বরং সুলতানের ট্রেডমার্ক স্বাস্থ্যবান কৃষিজীবী মানুষ; যেমন এদেশের মানুষের হওয়ার কথা। তাদের মধ্যে একটা আয়েশী ব্যাপার আছে, তারা শুয়ে আছে অল্প ডোবা ধান ক্ষেতের মধ্যে। বন্যা হয়েছে কিন্তু এই কৃষক অথবা তাদের কৃষিকর্ম ধ্বংস হয় নাই। এই বন্যা পরবর্তি ছবির কাহিনী ধ্বংস ও মৃত্যুর নয়, বরং বন্যাকবলিত প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা সুখি ও আয়েশী জীবনের কাহিনী। সুলতানের আঁকা বন্যা মৃত্যু নিয়ে আসা প্রলয় নয়, বরং আরো নতুন উদ্যোমে বেঁচে ওঠার মতো একধরনের কেয়ামত (পুনরুত্থান)।

সুলতানের আঁকা ‘আফটার দা ফ্লাড’

তবে ছবিটির নাম এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে ইব্রাহিমি ধর্মীয় ঐতিহ্যের যে প্রবল ছাপ, তা অগ্রাহ্য করলে ছবিটির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বলে মনে করি। ইব্রাহিমি ধর্মীয় ঐতিহ্যে পৃথিবীর ইতিহাসকে ভাগ করা হয় নূহ নবীর সময়কার বন্যার পূর্বের (বিফোর দা ফ্লাড) এবং পরবর্তি (আফটার দা ফ্লাড), এই দুই ভাগে। সরলরৈখিক সময়ের দিক থেকে বিচার করলে এই কাহিনির ছাচ হলো – শুরুতে একটা বেহেশতের মতো দুনিয়া মানুষের অন্যায় অবিচারে কলুষিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এবং ধ্বংসের পর আবার নতুন করে প্রাণের বিকাশ হওয়া (পূনরুত্থান)। পুরো পৃথিবীর ইতিহাস না হয়ে এই ছাচের মধ্যে একটা জাতির বিশেষ সময়ের ইতিহাসকে বিবেচনা করা যায়, একটা মানুষের নিজের জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ানোর যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার আলোকেও বিবেচনা করা যায়। এটা হওয়া অসম্ভব না যে সুলতান তার ছবিটির নাম ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে রেনেসার সময়কার ডাচ শিল্পী হায়েরোনিমাস বশ্চ-এর আঁকা একটি বিখ্যাত ছবির কথা স্মরণ করেছিলেন। বশ্চের আঁকা ছবিটি একটি ট্রিপ্টিচ, মানে তিনটি প্যানেলে একটি ধারাবাহিক কাহিনীর উপস্থাপন। বর্তমানে ছবিটির নাম দেয়া হয়েছে – দা গার্ডেন অফ আর্থলি ডিলাইট। কিন্তু অতীতে এর কোন নাম ছিল না। এবং ইউরোপে এই ছবিটি বিখ্যাত নূহের বন্যা পূর্ববর্তি (বিফোর দা ফ্লাড) সময়কার চিত্রায়ন হিসাবে।

Hieronymus Bosch, The Garden of Earthly Delights

আহমদ ছফার মতে সুলতান রেনেসার শিল্পীদের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন, যদিও তিনি ফর্মের দিক থেকে পাশ্চাত্য ঘরানা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। এবং যেহেতু নুহের বন্যা পূর্ববর্তি দুনিয়ার থিমে আঁকা রেনেসার এই ছবিটি পাশ্চাত্যে খুবি বিখ্যাত তাই বহু বছর পাশ্চাত্যে কাটানো সুলতানের পক্ষে এই ছবিটির সাথে পরিচিত থাকা খুবি স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আর ইব্রাহিমি ধর্মীয় ঐতিহ্যের থিম বা ছাচে ছবি আঁকার ব্যাপারে সুলতানের যে আগ্রহ ছিল সেটা তার অনেক ছবিতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তার ‘দা ফার্স্ট প্লান্টেশন’ এই ধরণের ছবির মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত। সুলতানের ছবির মধ্যে থাকা ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক ভাবের বিষয়টা তার ছাত্ররাও দাবি করে থাকেন। তবে সুলতানের বন্যা পরবর্তি এবং বশ্চের বন্যা পূর্ববর্তি পেইন্টিং-এর মধ্যে সম্পর্ক হয়তো ছবিগুলোর কন্টেন্টের মধ্যেই আছে, বিশেষ করে বশ্চের দ্বিতীয় প্যানেলে বহু মানুষ এবং দেহের উপস্থিতি জীবনের যে জয়গান হাজির করে তার সাথে সুলতানের আফটার দা ফ্লাডে বহু মানুষের উপস্থিতির মাধ্যমে জীবনের জয়গানের উপস্থাপনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়াটা আমার কাছে কষ্টসাধ্য মনে হয় নাই।

তবে একটা ছবির বিষয় যেখানে বন্যার পূর্ববর্তি অবস্থার আরেকটা ছবি সেখানে বন্যার পরবর্তি অবস্থার। বশ্চের ছবির একটা ধারাবাহিক কাহিনী আছে – প্রথম প্যানেলে আদনের বাগানে আল্লাহর সান্নিধ্যে আদম হাওয়ার নির্বিবাদ জীবন। দ্বিতীয় প্যানেলে আদম হাওয়ার বংশধরদের দুনিয়ায় জীবনের জয়গান এবং দুনিয়াতেই একধরণের বেহেশতের হাজিরা দেখা যায়। তৃতীয় প্যানেলটি হাজির করে এক জরাজির্ণ দুনিয়া, মানুষের অন্যায় অনাচারে যা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্তমানে এই তৃতীয় প্যানেলটির মধ্যে অনেকে অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দুনিয়ার প্রতিরূপও দেখতে পান। যেমন বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিবেশবাদী একটিভিস্ট লিওনার্দো ডিক্যাপরিও একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন ‘বিফোর দা ফ্লাড’ নামে। এই ডকুমেন্টারিতে তিনি বশ্চের ছবিটি ব্যবহার করেছেন এবং তৃতীয় প্যানেলটিকে হাজির করেছেন বর্তমান দুনিয়ার অবস্থা বোঝানোর জন্যে। এই তৃতীয় প্যানেলটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে থাকা বাংলাদেশের অবস্থা বোঝানোর জন্যেও ব্যবহার করা যায়।

কিন্তু আমাদেরতো সুলতান আছে। তিনি বন্যার পূর্বের ছবি আঁকেন নাই। বন্যার পরের ছবি এঁকেছেন। পুরাতন কোন হারিয়ে যাওয়া বেহেশতের স্বপ্ন দেখান নাই। প্রতিনিয়ত লড়াই করা, প্রতিনিয়ত কেয়ামতের মধ্যে থাকা অর্থাৎ ‘পুনরুত্থানের জীবন’ এঁকেছেন। ডিক্যাপরিও হলিউডের মানুষ। পাশ্চাত্যের পরিবেশবাদী একটিভিস্টরা যেটা করেন আর কী, বিপর্যয়ের ঘনঘটার কথা বলেন। আমাদেরও তা বলা উচিৎ বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে। কিন্তু আমরাই তো এই বিপর্যয়ের ফ্রন্টিয়ার। ষোল কোটি মানুষ আর লাখো লাখো রিফিউজির দেশ, নূহের মহাবন্যার মতো দূর্যোগের মুখোমুখি থেকেও কয়লা পোড়ানো, নিউক্লিয়ার প্লান্ট বানানো শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। আমাদের বসবাস বিপর্যয়ের মধ্যেই। সদা সর্বদা পুনরুত্থানের মধ্যে যদি আমরা নিজেদেরকে আবিস্কার করতে পারি, তবেই আমরা জীবিত। নতুবা আমাদের কাহিনী কেবলই ধ্বংস আর মৃত্যুর কাহিনী।

এস এম সুলতানের আঁকা 'আফটার দা ফ্লাড' তথা 'বন্যার পর' ছবিটা প্রথম দেখার পর ছবির নাম ও বিষয়বস্তু আমাদেরকে একরকম ধন্দে…

Posted by পারভেজ আলম on Thursday, November 22, 2018
ফেসবুক স্ট্যাটাস, ২২ নভেম্বর ২০১৮

তারেক মাসুদ প্রথম সুলতানকে নিয়ে সিনেমা বানানোর সময় তার খসরা নাম ঠিক করেছিলেন “রেবেল এঞ্জেল” বা বিদ্রোহী ফেরেশতা। আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যের পরিসরে যে ঘরানার মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতার জোয়ার তৈরি হয়েছিল, তাতে শয়তান চরিত্রটিকে নতুন করে চিত্রায়ন করার একটা প্রয়াস ছিল। এই সময়ই আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন “শয়তানের জবানবন্দী”। মাসুদের নিজের ভাষায়, তিনি এই নামটি ঠিক করার ক্ষেত্রে সুলতানের বোহেমিয়ান বিদ্রোহী ধরণের জীবনকে মাথায় রেখেছিলেন। মানে ঐ সময় পত্র পত্রিকায় সুলতানকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন। ফলে সুলতানকে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন একধরণের বিদ্রোহী ফেরেশতা ধরণের রোমান্টিক ইমেজের মধ্যে।

কিন্তু সিনেমাটি বানাতে গিয়ে যে কয়েক বছর তিনি সুলতানের সঙ্গ লাভ করতে পেরেছিলেন, সেই সময়ে তিনি এমন কিছু বাতেনি জ্ঞান লাভ করেন যা সুলতান সংক্রান্ত শিল্প সমালোচকদের আলোচনার মধ্যে পাওয়া যাবেনা। এবং সুলতানের সংসর্গের ফলেই শেষে তিনি সিনেমাটির নাম দিলেন ‘আদম সুরত’। এই নাম সুলতানের ছবিতে হাজির থাকা রুহানিয়াতকে ধরতে পারে সবচাইতে ভালভাবে। সুলতানতো দিনশেষে আদম তথা মানব সুরতকে ধরতে চেয়েছেন ক্যানভাসের মধ্যেই, এক সার্বিক ধারণাকে হাজির করতে চেয়েছেন বাঙালি বিশেষের দেহের মধ্যে। আদম সুরত একটি দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা। আল্লাহ্‌ মানুষকে নিজ সুরত বা ছবিতে তৈরি করেছেন, এই দার্শনিক প্রকল্পটি এই ধারণাটির মধ্যে ধরা পড়ে। আদম সুরত তাই আল্লার সুরত নির্দেশক একটি ধারণাও বটে। ইবনে আরাবীর মত গ্রহণ করলে আদম সুরত আর আল্লার নামসমূহ একি জিনিস। যার মধ্যে আল্লার সব নামের জ্ঞান আছে, তারমধ্যেই আদম সুরত প্রকাশ পায় – তিনিই আল ইনসান আল কামিল। সব মানুষের মধ্যে এমন জ্ঞানের সম্ভাবনা থাকলেও, সব মানুষের পক্ষেই তা অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে আদম সুরত সবার মধ্যে প্রকাশ না পেলেও, সবার মধ্যেই তা বিরাজমান থাকে সম্ভাবনা হিসাব। অর্থাৎ সব মানুষই সম্ভাব্য আল ইনসান আল কামিল। কার মধ্যে ও কিভাবে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে, তার চাইতে আমাদের এই সময়ে – আমাদের কাছে আদম সুরতের এই সম্ভাবনা হিসাবে হাজির থাকার বাস্তবতাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এস এম সুলতানের ছবিগুলোতে এই সম্ভাবনার দিগন্ত আঁকা হয়েছে খোদ আদম তথা মানুষের দেহের রিপ্রেজেন্টেশনকে কেন্দ্রে রেখে। সুলতানের ছবিতে মানবদেহের পেশির বাহুল্য যে অস্বাভাবিকতা নিয়ে হাজির তা সেই শুদ্ধ সম্ভাবনাকেই চিত্রায়ন করার চেষ্টা করে, যা সবসময়ই থেকে যায় বাস্তবায়নের বাইরে। দেহের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফেটে পড়তে চাওয়া, বেড়িয়ে আসতে চাওয়া যে সম্ভাবনাকে সুলতান এঁকেছেন, তা মানুষের মধ্যে হাজির থাকা অসীম এবং শুদ্ধ সম্ভাবনারই উপস্থাপন, যাকে ‘বাস্তবতা’ দিয়ে উপস্থাপন করা যায়না কারন তাতে তা সসীম ও অশুদ্ধতায় পর্যবশিত হতে বাধ্য। পেশিকে জাহের করার মাধ্যমে তিনি তারমধ্যে সম্ভাবনাকে বাতেন রেখেছেন – উপস্থাপনার খাতিরে। সুলতানের শৈল্পিক প্রয়াসটা ছিল তাই ক্যানভাস ও রঙের সীমার মধ্যে মানুষের অসীম ও শুদ্ধ সম্ভাবনাকে ধরবার চেষ্টা। তারেক মাসুদ এই অন্তর্গত সম্ভাবনাকেই ইংরেজিতে বলেছেন “দা ইনার স্ট্রেন্থ”, যা আদম সুরত সিনেমাটির ইংরেজি নাম। কোন একজন পাশ্চাত্য সমালোচক একদা ‘ভাইটালিটি’ শব্দটাও ব্যবহার করেছিলেন।

সুলতানের আঁকা ‘প্রথম বৃক্ষরোপন’

তারেক মাসুদ সিনেমার পোস্টারে এই আদম সুরত ধারণাটিকে তুলে ধরতে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন সুলতানের আঁকা “প্রথম বৃক্ষরোপন” ছবিটি। তার সাক্ষাৎকার থেকে পরিষ্কার হয় যে সুলতানের সঙ্গ থেকেই বোধহয় তিনি জানতে পেরেছিলেন যে এই ছবিটির চরিত্রের কেন্দ্রে রয়েছে আদি পিতা আদম। কিন্তু আদম সুরত সিনেমাটি আমার খুব পছন্দের হলেও, পোস্টারটি নয়। কারন মাসুদ এই পোস্টারে শুধু বাবা আদমের ছবিটুকুই রেখে দিয়েছেন। কেটে দিয়েছেন তার দুই পাশে হাজির থাকা বাকী দুই চরিত্রকে। বাবা আদমের পেছনে একপাশে দুই হাত উচু করে যে বিবি হাওয়া তথা মা আদম দাঁড়িয়ে আছেন (হয়তো পানির কলসি বহন করে আসছেন, কিন্তু কোন এক কারনে সুলতান তা বাতেন রেখেছেন), তাকে কেন বাদ দেওয়া হল? আদম সুরততো কেবল পুরুষের সুরত নয়। সুলতান নিজেও কেবল পুরুষ দেহেই আদম সুরত ধরতে চান নাই, নারী দেহেও চেয়েছেন। তার আঁকা নারীদেহগুলাও স্বাস্থ্যবান ও পেশিবহুল, তাদের স্তনগুলাও ধারণ করে রেখেছে অসীম সম্ভাবনা। কিন্তু খোদ মা আদমকেই তারেক মাসুদ তার পোস্টারে রাখেন নাই, এর ফলে এই পোস্টারে প্রথম বৃক্ষরোপন ছবিটিকে খন্ডিত করার মাধ্যমে তার অর্থকেও সংকুচিত করেছে। তারপরও, তারেক মাসুদের চিন্তা ও শিল্পের মধ্যে সুলতানের উপস্থাপনের ব্যাপারটা যে বিদ্রোহী ফেরেশতা থেকে আদম সুরতে এসে ঠেকেছিল, এই ঘটনার মধ্যে তার নিজের রুহানি সফরেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ধরা পড়ে।

এই ছবির সবচাইতে রহস্যময় চরিত্র অবশ্য ডানাওয়ালা নারীর ছবিটি। তাকে দেখে কিউপিডের নারী সংস্করণ মনে হয়। আবার একটা অপ্সরা ভাব ও ভঙ্গিমাও আছে। কিন্তু এই চরিত্রটিকে সাকিনা ছাড়া অন্য কিছুর রিপ্রেজেন্টেশন বলে আমার মনে হয় না। বেহেশত থেকে পতিত হওয়ার পরেও আদম তথা মানুষের মাঝে আল্লাহ ফিরে এসেছিলেন, এই দুনিয়ায় তার সাকিনা প্রকাশ করার মাধ্যমে। সাকিনা একটি স্ত্রী লিঙ্গ বাচক শব্দ। যার কারনে সাকিনাকে আল্লাহর প্রকাশের নারীরূপ (মানুষের ভাষায়) বলে মনে করার প্রচলন আছে সুফি ও কাব্বালাপন্থীদের মধ্যে। এই ছবিতে আমরা আদম ও হাওয়াকে দেখি এই দুনিয়ায় প্রকৃতির প্রতিপালকের ভূমিকায়, রুবুবিয়াতের খলিফা হিসাবে। আদমের পাশেই রাখা একটি পাথরের অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি এই দুনিয়ার বুক বিদির্ণ করেছেন। অস্ত্রটি হাজির আছে মানুষের ধ্বংসাত্মক চরিত্রের, তথা ‘ফানা’ ঘটাবার স্বভাবটি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুনিয়ার বুকে তৈরি করা ঐ গর্তে আদম রোপন করছেন একটি বৃক্ষের চারা। হাওয়া এগিয়ে আসছেন পানি ঢালবেন বলে। ফানা আর বাকার মাঝের এই মুহূর্তেই হাজির হয়েছে সাকিনা, এই দুনিয়ায় আদমের মধ্যে রবের রুবুবিয়াতের সিফাত ঘোষণা করতে, পতিত মুসাফির মানব জাতির এই মুসাফির জীবনেও সুকুনের ঘোষণা করতে। এবং এইটাই, সুলতানের হাতে পৃথিবীর প্রথম বৃক্ষরোপনের চিত্রায়ন। এবং হয়ত আদম সুরতেরও সবচাইতে আর্চটিপিকাল একটি উপস্থাপন। আদম, হাওয়া ও সাকিনা, এই তিনের সমাহারে দুনিয়ার বুকে প্রতিপালনের প্রকাশ – এই পুরো চিত্রটিই আদম সুরতের এই আর্চটিপিকাল উপস্থাপন।

তারেক মাসুদ প্রথম সুলতানকে নিয়ে সিনেমা বানানোর সময় তার খসরা নাম ঠিক করেছিলেন "রেবেল এঞ্জেল" বা বিদ্রোহী ফেরেশতা। আশির…

Posted by পারভেজ আলম on Monday, August 10, 2020
ফেসবুক স্ট্যাটাস, ১০ আগস্ট ২০২০
  • পারভেজ আলম: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *