সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম বা Done in Good Faith! নতুন বোতলে পুরানো মদের শোষণ কাঠামো

  • মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

খুব কৌতূহল উদ্দীপক একটা বক্তব্য: “পেনাল কোড অনুযায়ী, সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম অপরাধ না। তবে সরল বিশ্বাস যেন সরল বিশ্বাসই হয়, তা নিশ্চিত হতে হবে।”

২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে যত আইন গৃহীত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে পদ্মাসেতু প্রকল্প (ভূমি অধিগ্রহণ) আইন ২০০৯, মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯, ভবঘুরে আইন রহিতপূর্বক ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় (পুনর্বাসন) আইন ২০১১, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২, বন্যপ্রাণী আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১২, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন ২০১৫, স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রভৃতিসহ অন্তত ১৩টি আইনে “সরল বিশ্বাসে কৃত-কাজকর্ম” সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটির সংযুক্তি আছে।

এই অনুচ্ছেদের ভাষা এবং শব্দ চয়ন দেখলে যে কেউ বুঝবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আমলাদের জন্য এটা নিশ্চিতভাবে দায়মুক্তি সংক্রান্ত একটা আইনি অনুচ্ছেদ।

ভাষাটি সব আইনেই প্রায় একই রকম অর্থাৎ কপি এবং পেস্ট: “…সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে, তজ্জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।” এই ধরনের দায়মুক্তির অনুচ্ছেদ ১৮৬০ সালে গৃহীত পেনাল কোডকে সামনে এনে এখন যৌক্তিক করার চেষ্টা হচ্ছে।

ছবি: ভ্লাদিমির কাজানেভস্কি, কার্টুন মুভমেন্ট

উপনিবেশিক আমলের এই পেনাল কোডে “সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম”-কে ইংরেজিতে বলা হয়েছিলো “…done in good faith”। উপনিবেশিক আমলাদের জন্য এরকম অনৈতিক দায়মুক্তি অনুচ্ছেদ সেই সময়ের জন্য যুতসই এবং স্বাভাবিক ছিলো। কেননা সেই উপনিবেশিক আমলের জবাবদিহিবিহীন, অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শোষণ কাঠামো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই ধরনের দায়মুক্তি বিদেশী ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের আমলাদের অপকর্ম পরবর্তী নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন ছিলো!

সেই সময়কালের জবাবদিহিবিহীন, অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কে, কীভাবে নির্ধারণ বা নিশ্চিত করছিলো – কোন কাজ বা কর্মটা “সরল বিশ্বাসে” হয়েছে বা হয়নি? এটা কী বুঝা খুব দুরূহ?

তাহলে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটা দেশে আমলা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য এখন দায়মুক্তির এই অনৈতিক অনুচ্ছেদকে পেনাল কোডের দোহাই দিয়ে কেন যৌক্তিক করা হচ্ছে?

অবশ্য এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপনিবেশিক ভাইসরয়ের আমলের চাইতে এই আমল – জবাবদিহিবিহীন, অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শোষণ ব্যবস্থা – এই তিন বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় মৌলিকভাবে ভিন্ন কিছু উপহার দিতে পারেনি! নাম, পদবী আর গায়ের ভিন্ন রঙ ছাড়া!

ঠিক যেন নতুন বোতলে পুরানো মদের মতই।

সাহেদ, পাপিয়া, সম্রাট প্রমুখদের জন্য যে সব আমলা বা সরকারি কর্মকর্তা যা কিছু করেছে, সবকিছু তাহলে “সরল বিশ্বাসে” করা কাজ! তবে কেন এত হৈ চৈ?

সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম বা Done in Good Faith! নতুন বোতলে পুরানো মদের শোষন কাঠামো…

Posted by Mohammad Tanzimuddin Khan on Saturday, July 18, 2020

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *