সমাধান কি? আর শুরু করতে হবে কোত্থেকে?

  • লেখক: হাসনাত কাইয়ূম

১.

এই যে প্রতিদিন হাজারে-বিজারে সমস্যা পয়দা হয়, একটা নিয়ে কথা বলা শুরু করার আগেই আরেকটা এসে ছোঁ মেরে আপনার মনোযোগ কেড়ে নেয়, এর সমাধান কি?

আপনি গণস্বাস্থ্য’র কিট, এন-৯৫ মাস্ক, ডা. মঈনুলের এম্বুলেন্স না পাওয়া, বিনা পরীক্ষায় মৃত্যু, মৃত্যুর পরে সাম্পল কালেকশন, ত্রাণের চাল চুরি, দলীয় লোকের বাইরে অন্যদের ত্রাণ না দেওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদ হিসাবে ব্যবহার, এই করোনাকালেও স্বাস্থ্য বিভাগের আরো ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ—এমন বিষয়গুলির কোনটা নিয়ে বলবেন আর কোনটা বলবেন না?

আপনি কি প্রত্যেকটা সমস্যা ধরে ধরে আলাপ-বিলাপ-আহাজারি-কান্নাকাটি-আবেদন-নিবেদন রাগ, ক্ষোভ, দেখাবেন? সমাধানের চেষ্টা করবেন? এভাবেই সমস্যার পেছন পেছন ছুটবেন, নাকি এইসব সমস্যার যে উৎসমুখ তা বন্ধ করার জন্য কাজ করবেন?

২.

বাংলাদেশের মূল সমস্যাকে যদি খুব অল্প কথায় প্রকাশ করতে চান তবে সেটা হলো ‘রাষ্ট্রক্ষমতার জবাবদিহিতার’ সমস্যা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা এক পদে কেন্দ্রীভূত, আর এই ক্ষমতা একদিকে সীমাহীন আর অন্যদিকে তার জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নাই। বাংলাদেশের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগসহ সকল ক্ষমতাকেন্দ্র একজনের ইচ্ছাধীন। এখানে রাষ্ট্র-সরকার এবং সরকারী দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। তাই যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন রাষ্ট্রীয় সকল সংস্থা, আইন-কানুন-পুলিশ-মিলিটারী সব এদের অধীনে চলে আসে।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা বা সরকার বদলের কোনো শান্তিপূর্ণ পথ নাই। এখানকার নির্বাচন ব্যবস্থা এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে সরকারী দলকে কখনো নির্বাচনের মাধ্যমে হারানো না যায়। তাই এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চায় এমন দলগুলি মস্তান-চাঁদাবাজ-লুটেরা-খুনী-ধর্ষকদের সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। ফলে এখানে রাজনীতি হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত-গুম-খুন-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজী-লুণ্ঠন ও পাচারের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কাযদা-কানুন আয়ত্বে রাথার মাধ্যম ও কৌশলমাত্র।

৩.

উপরে যে চিত্রটা তুলে ধরা হলো এর কোনটাই কোনো ক্ষমতাসীন দলকে জোরজবরদস্তি করে এখানে করতে হয় না।  রাষ্ট্রকে তার সংবিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে গেলে এ ঘটনাগুলি আপনাতেই ঘটতে পারে। এভাবেই এখানকার রাষ্ট্র পরিচালনার আইন বা সংবিধান বানানো হয়েছে। সেজন্যেই আমরা বলি, এখানকার যা কিছু রাজনৈতিক সমস্যা তার সবই সাংবিধানিক সমস্যা বা শাসনতান্ত্রিক সমস্যা।

তাই এখানে রাষ্ট্র-রাজনীতি-সরকারকে সুস্থ পথে আনার রাজনীতি মানেই সংবিধান ঠিক করার রাজনীতি। সংবিধান ঠিক না করে যারা সব অনিয়ম  ঠিক করার আশ্বাস দেয় সেই আশ্বাস মিথ্যা। তারা তাদের নিজেরদের স্বার্থে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মানুষকে তাদের পেছনে পেছনে ঘোরায়। দেশ বা দেশের মানুষ তাদের বিবেচনায় নাই। গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা এর প্রমাণ হিসাবে আপনাদের সামনে হাজির আছে।

৪.

এখন প্রশ্ন হলো সংবিধান ঠিক করা বা এর সংস্কারই যদি আমাদের করতে হয়, তবে তা কেমন করে করবো? কিংবা এ কাজটা শুরু করবো কোন পয়েন্ট থেকে?

ক) এ কাজটা শুরু করার জন্য প্রথম কাজ হলো নিজে আগে স্পষ্ট হওয়া যে, এখানে যেসব রাজনৈতিক সমস্যা আমরা দেখি তার সবগুলির উৎস হলো সংবিধান। এর জন্য প্রথম কাজ হলো, রাষ্ট্রচিন্তার এই বিশ্লেষণ বা বক্তব্যকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা। এরপর যদি বিশ্লেষণকে যথাযথ বা অন্তত ভাববার উপযোগী বলে মনে হয়, তবে অন্যদেরকেও এ কাজে যুক্ত করা।

খ) বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম অংশের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র সাথে তার বাস্তবায়ন অংশ বা ক্ষমতাকাঠামো অংশের (৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) যে বৈপরীত্য, সেটাই এখানে সকল সমস্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বৈপরীত্য দূর করার জন্য যে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন হবে এবং সেই সংস্কার করার জন্য যে একটি ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন লাগবে সে বিষয়ে স্পষ্ট হওেয়া হলো দ্বিতীয় কাজ।

গ) এটা করার জন্য আমাদের প্রথমে প্রয়োজন হবে মাত্র ২ লক্ষ প্রচারকর্মী বা ভলাণ্টিয়ার, যারা আগামী ৯ মাসের মধ্যে এ বুঝটুকু বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে। এই প্রচারের কাজটি হলো তৃতীয় কাজ।

আমরা যদি এই প্রাথমিক কাজগুলি করতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে নিকট আগামীতে ১৯৭০ সাল বা ১৯৪৬ সালের মতো আরেকটা গণপরিষদ নির্বাচন হবে, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গত ১০০ বছর ধরে এখানকার মানুষ নিজেদের জন্য যেমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে হাজারো রকম লড়াই করেছে, তার একটি পর্বের বিজয় অর্জিত হবে।

মনে রাখুন, একাত্তরে রণাঙ্গনে ১ লক্ষ যুবকের যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করতে যদি ১ বছরও না লেগে থাকে, তবে আজ ২ লক্ষ যুবক এক হলে সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র বানাতে ২ বছরও লাগবে না। এখন ভাবুন, ২ বছরের জন্য পরিকল্পনা করে ২ লক্ষ যুবক মাঠে নামবেন, নাকি বিগত ৫০ বছরের মতো একদলকে সরায়ে আরেকদলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আবারো ব্যবহৃত হবেন। এখনই ভাবার সময়।

লেখক: সংবিধান বিশেষজ্ঞ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *