‘শিক্ষক-সুলভ’ আচরণ!

  • আর রাজী

উগান্ডু দেশের ভার্সিটির টিচারকে কী কী কারণে ভার্সিটি-কর্তৃপক্ষ শাস্তি দিতে পারে, ভার্সিটির আইনে তা বলা আছে। যেমন, একজন টিচার যদি অনৈতিক আচরণ করেন- “মোরাল টারপিচিউড” যাকে বলে, দেখা-শোনা থেকে বুঝেছি- এটা হচ্ছে মেইল-টিচারের সাথে ফিমেইল-স্টুডেন্টের যৌন-সম্পর্ক জাতীয় কিছু একটা ভজকট যদি বেঁধে যায়- তাহলে এই নৈতিক-স্খলনের “প্রসিডিং ড্র” হতে পারে।

আর আছে পরীক্ষা-সংক্রান্ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া। এটিও মোটামুটি বোঝা যায় যে কী কী হলে বা ঘটলে “পরীক্ষায় দুর্নীতি” বলে গণ্য হওয়ার ঝুঁকি আছে।

আর বিচার হতে পারে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করলে, এই বিচার শুরুর জন্য চ্যান্সেলরের অনুমোদন লাগে।

আরেকটা কারণে ভার্সিটি-টিচারদের বিচার করা যায় (যদিও কোনো দিন অমন অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে উঠেছে শুনিনি) আর তার শাস্তি কী হবে তাও স্পষ্ট করা আছে, সে হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট টিচারের আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন জীবন-মান।

আর খুব “অনির্দিষ্ট” একটা অভিযোগে উগান্ডু দেশের ভার্সিটির টিচারদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। যদি কোনো টিচারের বিরুদ্ধে “আন বিকামিং অফ এ টিচার” -এই অভিযোগ ওঠে। অনুমান করি- এরই বাংলা হচ্ছে, “অশিক্ষক-সুলভ আচরণ”! “শিক্ষকের জন্য শোভন নয় এমন আচরণ”- এমন বাঙলাও হতে পারতো।

“শিক্ষক-সুলভ আচরণ” ব্যাপারটা কী তা আজও ধরতে পারিনি। শিক্ষকদের মধ্যে যে আচরণ সুলভ, তাই কি শিক্ষক-সুলভ আচরণ?

উগান্ডু দেশের ভার্সিটিতে যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, টিচারদের মধ্যে সুলভ আচরণগুলো কী?

ভার্সিটি নিয়ে উগান্ডু দেশের লেখকদের যে অ/সামান্য জনপ্রিয় রচনা রয়েছে সে বর্ণনা মতে: নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে, সেদেশে ভার্সিটি টিচারদের মধ্যে সুলভ আচরণ হচ্ছে, ক্ষমতার পদলেহন, ক্ষমতাসীনের চাটুকারিতা, মেরুদণ্ডহীনতা, দীনতা, পদোন্নতি-ছুটিছাটা-চাকুরি নিয়ে ঝামেলার ভয়, পদ-পদবী-সুযোগ-সুবিধার জন্য বিপুল লালসা, বৈদেশিক-স্বীকৃতি, অন্যের বা অন্য ভাষার লেখা চুরি, আত্মভরিতা, আর ক্ষমতা একবার হাতে পেলে, “তোমারটা করে দিব/ওকে ঠেকিয়ে দেব” ইত্যাদি।

বহুল প্রচারিত এই সব আচরণই যেহেতু ভার্সিটি-টিচারদের মধ্যে সুলভ মনে করেন অনেকে- সুতরাং মোটাদাগে এগুলোই ইদানিং কালের “শিক্ষক-সুলভ আচরণ” বলে বিবেচিত হচ্ছে কি?

নিশ্চিত বলতে পারছি না, তবে অনুমান করি, উগান্ডু দেশে এই “আন বিকামিং অফ এ টিচার” ধারণার আমদানি হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে, শিক্ষকদের ভেড়ার পাল হিসেবে দেখার ক্ষমতাধরদের মনোবাসনা থেকে। দেশের সচেতন, জানাশোনা মানুষগুলোকে “সাইজে রাখার” একটা হাতিয়ার হিসেবে বিদেশি শাসকরা যা করছে, উগান্ডু দেশের স্কুল-কলেজের দাতা-মদদদাতারও তা অব্যাহত রাখতে চেয়েছে। কালে কালে ‘উদয়ন পণ্ডিত’দের জেলে পচাতে ব্যবহৃত হয়েছে “শিক্ষক-সুলভ আচরণের” ধারণা।

গেইন স্ট্রেন্থ রেজিস্ট, শিল্পী: ফিরুজ কুতাল, কার্টুন মুভমেন্ট

অনুমান করি, আরও অতীত আছে এর। এক সময় যখন বিহার বা চার্চগুলো শিক্ষাদীক্ষার কাজ করছিল তখন শিক্ষক মানেই তো আসলে ছিলেন ধর্মগুরু। মাদ্রাসাগুলোতেও তো তাই। যিনি শিক্ষক তিনি একজন আদর্শ ধর্মগুরুও বটেন। প্রত্যেক ধর্মের প্রবর্তকই এক এক জন আদর্শ-শিক্ষক হিসেবে মান্য।

কিন্তু ধর্মীয় ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে যখন বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকলো তখনও সম্ভবত সেই ধর্মগুরুদের ছায়া খোঁজার চেষ্টা রয়ে গেল ভার্সিটির শিক্ষকদের কায়ায়। অথচ ততো দিনে সমাজবিদ্যা বা পদার্থের শিক্ষক কেবলই টিচার (ফরাসি ভাষায় professeur), ধর্মগুরু তিনি আর নন। স্টুডেন্টদের কাছে পূর্বতন ধর্মগুরুদের মতোই “আদর্শ” হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হয়তো তাঁর অন্তরে রয়ে গেল কিন্তু আদতে তিনি তা হওয়ার জন্য নিজেকে শুরু থেকে গড়ে তোলেন নাই, তোলার কোনো বস্তুগত কারণও নাই।

ফলে, আজকের দিনের একজন টিচারের মধ্যে যে আচরণ “সুলভ” তাকে কিছুতেই আদর্শ মানতে চাইবেন না স্টুডেন্টরা। ভার্সিটির বাংলা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা বা জেন্ডার স্টাডিজ, প্রাণরসায়ন কিংবা জীববিদ্যা বা যে কোনো বিদ্যার একজন টিচার, স্টুডেন্টদের জীবনাদর্শ হবেন বা তাদের আদর্শ জীবন গড়ে দেবেন- এ এক অদ্ভুত চাওয়া! স্টুডেন্টদের যার যার জীবনাদর্শ তার তার, লেসনদাতা বা টিচিংদাতাদের এ নিয়ে সম্ভবত মাথা ঘামানোর কিছু থাকে না, সমাজও সম্ভবত চায় না ভার্সিটিগুলো কোনো একটা বিশেষ আদর্শ গড়ে দিক স্টুডেন্টদের। যদি তা চাই তো তাহলে তার জন্য তো প্রতিটি ধর্মানুসারীদেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলই, নতুন করে ভার্সিটি গড়ার দরকার হতো না।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, ‘আদর্শ শিক্ষক’ বলে ভার্সিটি যুগে কিছু নাই, থাকতে পারেও না। যেহেতু কোনো আদর্শ বা প্রমিত মান নাই টিচারের সুতরাং কাউকে বা কারও আচরণকে “আন বিকামিং অফ এ টিচার” ঘোষণার সুযোগও নাই। একজন টিচার কোন ভাষায় কথা বলবেন, কী পোষাক পরিধান করবেন ইত্যাদি কিছুই ঠিক করে দেওয়ার উপায় উগান্ডু দেশের মানুষের হাতে নাই। ভার্সিটিগুলো আবার ধর্মের শক্তি বলয়ে যত দিন ফিরে না আসছে, ততোদিনের জন্য আদর্শ-শিক্ষক মৃত, সুতরাং “শিক্ষক-সুলভ আচরণ” ভূতুড়ে এক ধারণা মাত্র।

কিন্তু যাদের হাতে ক্ষমতার দণ্ড থাকে তারা নিজেদের মতো করে “শিক্ষক-সুলভ” চরিত্র দাঁড় করাতে চান। নিজেদের প্রয়োজনেই তা আঁকতেই হয় ক্ষমতাধরদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইয়া বড় আলখাল্লা টাইপ পাঞ্জাবি বা স্যুট-টাই পরা, মৃদু ভাষায় মেদিনীপুরি বাংলা আর বৃটিশ-ইংরেজি বলা, বিনয়ে সর্বদা অবনত, আসল কথা না বলে অনেক কথা বলা, অজস্র সভায় নির্বিষভাবে সকলের জন্য স্তুতিবাক্য আওড়ানো, মধুর মধুর বাজে কথা বলা টিচারের রূপই তাদের কাছে “শিক্ষক-সুলভ”। এমন টিচার পেলে, পুষে রাখেন তারা! প্রচার করেণ এক আদর্শ টিচারের “শিক্ষক-সুলভ আচরাণের” বানোয়াট কাহিনী। এই কল্পের বাইরে যিনি থাকেন তার কপালেই জোটে “শিক্ষক-সুলভ আচরণ” না করার তকমা।

  • আর রাজী: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

'শিক্ষক-সুলভ' আচরণ!উগান্ডু দেশের ভার্সিটির টিচারকে কী কী কারণে ভার্সিটি-কর্তৃপক্ষ শাস্তি দিতে পারে, ভার্সিটির আইনে তা…

Posted by Ar Raji on Thursday, June 18, 2020

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *