ক ) যেই রাষ্ট্রের আইন যতো কঠোর, সেই রাষ্ট্রে অপরাধ ও হিংস্রতার মাত্রা ও তীব্রতা ততো বেশী । এটুকু বোঝার জন্য দিগগজ পণ্ডিত, আইন বিশারদ বা অপরাধবিজ্ঞানের বিশিষ্ট শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজন নাই । আপনি শুধুমাত্র গুগল ব্রাউজ করে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের অপরাধ, শাস্তি, জেল ও ফাঁসির তুলনামূলক ডাটাগুলো চেক করলে নিজেই এর সত্যাসত্য বের করে ফেলতে পারবেন । আর এইটুকু পরিশ্রমও যদি না করতে চান তাহলে আমেরিকার পুলিশ কেন আমাদের পুলিশদের চাইতেও খারাপভাবে কালোদের গুলি করে মারে আর তাদের জেল কেন মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীতে ভরা থাকে অথচ নেদারল্যান্ড কেন বন্দীর অভাবে জেল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়- এ প্রশ্নটা শুধু মাথায় নেন, উত্তর পেয়ে যাবেন ।
খ) অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের যে কয়টা মৌলিক পার্থক্য আছে তার মধ্যে একটা হলো অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ প্রায় অতুলনীয়ভাবে বেশী সাহসী । মানুষের সাহস এতো বেশী যে সে নিজেকে পর্যন্ত খুন করতে পারে । মানুষ তার রাগ, জেদ, অভিমান, স্বপ্ন বা আদর্শের জন্য হরহামেশাই জীবনের ঝুঁকি নেয়, এমনকি অনেকে আত্মবিধ্বংসীও হয় । মানুষকে তাই ভয় দেখিয়ে পরাস্ত করার চিন্তার গোড়াতেই সমস্যা আছে ।
গ) আইন মানা, আইন মেনে চলা মানুষের মৌলিক প্রবণতাগুলোর একটা । অধিকাংশ মানুষ নিজে নিজেই আইন মেনে চলে । বলা ভালো, একটা সমাজে সেটাই আইন হিসাবে চালু করা সম্ভব হয়, যেটা মেনে চলার জন্য সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে মনে প্রস্তুত থাকে । শাস্তির বিধান করা হয় মানুষের কাছে সমাজের অনুমোদনের সীমারেখাটা স্পষ্ট করার জন্য । শাস্তি কঠোর হলে অপরাধ বন্ধ হবে – এ ধারণাটা উৎপাদন এবং বিপনন করেছে সেইসব অপরাধী বা অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকেরা যারা রাষ্ট্রীয় লুটপাটের জন্য নিপীড়নকে বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে ।
ঘ) পরিষ্কার করা প্রয়োজন আইন দুই প্রকার : এক প্রকার হলো, এক নাগরিকের সাথে অপর নাগরিকের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যেটা প্রধানত দেওয়ানী আর ফৌজদারি বলে পরিচিত । আর অন্য প্রকারটি হলো রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক নির্ধারণ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ।
ঙ) সাধারণভাবে প্রথম ধরনের আইনের বেলায় অর্থাৎ নাগরিকেরা নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের প্রচলিত সম্পর্করীতি থেকে উদ্ভূত নিয়মগুলোকে আইন হিসাবে গ্রহণ এবং মেনে চলায় অভ্যস্ত থাকে । এ ধরনের আইনের বেলায় মানুষের শিক্ষা,সংস্কৃতি,পারিবারিক ও সামাজিক গঠন কাঠামোর ভূমিকা বলপ্রয়োগের চেয়ে অনেকবেশী গুরুত্ব বহন করে ।
চ ) কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের আইন আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভবের সাথে সম্পর্কিত । রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা দখলকারীদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য যে সব জনপীড়নমূলক আইন-কানুন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সেসবকে অমান্য করতে চায় । আর এ অমান্য করার যে প্রবণতা এটাকে কঠোর হাতে দমনের জন্যই কঠোর আইনের পক্ষে দার্শনিক-বুদ্ধিজীবীদের মাঠে নামাতে হয় রাষ্ট্রকে । যদিও কঠোর আইন শেষ পর্যন্ত সমাজ-রাষ্ট্রের কোন দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ করে না কিন্তু আপদ-বিপদ বাড়ানোর মাধ্যমে রাষ্ট্র আপৎকালীন সমাধান হিসাবে এ ধরনের বলপ্রয়োগ ও কঠোর আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয় ।
ছ) আমরা যে ধরনের রাষ্ট্রে বসবাস করি সে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ঔপনিবেশিকতার উদরে কিন্তু সে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-যন্ত্র দিয়েই শাসন করতে হচ্ছে দু-দুবার স্বাধীনতার জন্য লড়ে জয়ী হয়েছে এমন একটা জনগোষ্ঠীকে । ফলে রাষ্ট্রের প্রতিপদে, প্রতি স্তরে, মিথ্যা- জালিয়াতি- বেঈমানি আর বিকৃতির রমরমা । সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় ‘রাষ্ট্র’ বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যকার বিবাদ নিষ্পত্তি কিংবা একটি আপোষ ফর্মুলার ফল কিন্তু আমাদের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিষয়টা পুরোপুরি উল্টা । এখানে রাষ্ট্র নিজে বিবাদ উৎপন্ন করার এবং বিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার সবচাইতে বড় প্রতিষ্ঠান । এখানে ভিন্নতা বা পার্থক্যকে বিরোধ, বিরোধকে বিদ্বেষ এবং বিদ্বেষকে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রু বা প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমুহকে ব্যবহার করার জন্য যে মতাদর্শ, শক্তি, এবং আইন-কানুন বানানো হয় সে প্রক্রিয়াকেই রাজনীতি বলা হয় ।
জ) এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার আইন মানে কোন না কোন ব্যক্তি বা তার পরিবারের পছন্দের লাঠিয়াল, খুনি, প্রতারক, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারকারীদের মদদ দেয়ার বিধি বিধান । এইসব বিধি বিধান অতি অবশ্যসম্ভাবীরূপে হিংস্র, বিভেদমূলক এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী । কিন্তু রাষ্ট্রের আয়নায় উল্টো এটাই দেখানো সহজ যে সমাজে হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ায় রাষ্ট্র তা কঠোর এবং হিংস্রভাবে দমন করতে নৈতিকভাবে বাধ্য । এইভাবে হিংসার উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনই তাকে কঠোর থেকে কঠোর রাষ্ট্রকাঠামোর বৈধতা দিয়ে যেতে থাকে ।
এই পিশাচ প্রক্রিয়ার হাত থেকে বাঁচতে হলে তাই এ হিংসা এবং বিভেদ উৎপাদনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোন বিকল্প নেই ।