প্রিয় দেশবাসী ও বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের সকল সমস্যার মূলে আছে প্রধানত দুইটি সমস্যা। এক হচ্ছে এদেশের সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার হওয়া এবং দুই হচ্ছে লুটপাট ও পাচারকে অব্যাহত ও নিরঙ্কুশ রাখতে দেশের মানুষকে দমন-পীড়ন করা।
বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী তাদের বিদেশী সহযোগীদের নিয়ে এ দুইটি কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য এখানকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা রাষ্ট্রযন্ত্রের এই মডেলটি বানিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এটিকে যেমন ব্যবহার করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশেও বিগত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী যাবত এটা বহাল আছে। রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে এইসব লুটপাট ও নিপীড়ন-নির্যাতন বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা যে মাত্রায় বেড়েছে, শাসকগোষ্ঠী তার নিপীড়নের কলাকৌশলও সেই মাত্রায় বা তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী করে বাড়িয়ে নিয়েছে। এবং যতো দিন যাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই ব্যবস্থা যদি অপরিবর্তিত থাকে, তবে তার মাত্রা ও পরিমাণ ততো বাড়তেই থাকবে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণ বিষয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা হচ্ছে, পুঁজিপতিশ্রেণী কলকারখানা বানিয়ে শ্রমিকদের অল্প মজুরী দিয়ে লাভের বেশীর ভাগটাই নিজেদের জন্য তুলে নেয় এবং এই লভ্যাংশ বা উদ্বৃত্ত মূল্য জমিয়ে তারা আরো কলকারখানা স্থাপন করে, আর এভাবে তারা শ্রমিকদেরকে আরো আরো শোষণ করার একটা চক্র গড়ে তোলে। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, এখানকার শোষকগোষ্ঠীর প্রধান ও প্রভাবশালী অংশটি গঠিত হয়েছে মূলত রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখল, আত্মসাৎ, চুরি, প্রতারণা, ব্যাংক-বীমা জালিয়াতি, চোরাকারবারী, মাদকব্যবসা, মজুতদারী ইত্যাকার নানা কায়দায় পুঁজি সংগ্রহের মাধ্যমে। এবং এইসব কাজ ব্যাপক আকারে তারাই করতে পেরেছে, যারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে বৈধ-অবৈধ পথে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথম দিকে তারা এইসব কাজের বেশীর ভাগটাই করেছে অবৈধ পন্থায়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের টাকা-পয়সা বা ‘পুঁজি’ গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে একের-পর-এক আইন-কানুনকে তাদের স্বার্থে লুটপাটবান্ধর করিয়ে নিয়েছে। এবং এরপর আরো শক্তিশালী হতে হতে এখন এরা নিজেরাই আইন-কানুন বানানোর স্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জ্বালানী খাতের কেনাকাটার দুর্নীতি নিয়ে যাতে কেউ কোনো আদালতে না যেতে পারে তা আইন করে তারা বন্ধ করেছে। এ জন্যেই তথাকথিত কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে তার মালিকদের বছরে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে দিতে হয় রাষ্ট্রকে, যার ব্যবস্থা তারা করেছে রাষ্ট্রের সাথে আইনানুগ চুক্তির মাধ্যমেই ।
বলা যায়, ৯০ সালের পর থেকে তাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তারা একের-পর-এক এমনসব আইন বানাতে সক্ষম হয়েছে, যার কোনোটাই প্রচলিত নৈতিকতা বা কাণ্ডজ্ঞানের সাথে যায় না। এখন তারা নিজেরা যখন যেমন ইচ্ছা তেমন আইনই বানাতে পারে। আর একটা সমাজের প্রচলিত নৈতিকতা-বিরোধী সকল কিছুই যখন আইনানুযায়ী বৈধ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন আইনভাঙা কিংবা আইনকে ফাঁকি দেয়া কিংবা আইনের রক্ষকদের কেনা-বেচা যা কিছুই মানুষের সামনে ঘটুক না কেন, মানুষ তা আর প্রতিরোধ করার কথা ভাবতে পারে না। আইন না মানা, ফাঁকি দেয়া, অন্যপথে সুযোগ নেয়া—এসব তখন সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ থেকে তারাই সবচেয়ে লাভবান হয়, যারা সবচেয়ে বড় আকারে আইন ভাঙার যোগ্যতা রাখে।
বাংলাদেশে এইরকম আইন বানানোর ক্ষমতা আসে মূলত রাষ্ট্রের প্রধান আইনী-দলিল সংবিধান বা শাসনতন্ত্র থেকে। বাংলাদেশের সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয় তখন এটা করা হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে—তিনি যাতে যতদিন ইচ্ছা ততদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারেন এবং ইচ্ছামত দেশ পরিচালনা করার সব ধরণের ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন, সেটা মাথায় রেখে। এটা ছিল তাঁর ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম-নির্যাতন থেকে পাওয়া শিক্ষার একেবারে বিপরীত। তাঁর অবর্তমানে ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে তারাই সেই সংবিধান ও আইনের সুযোগ নিয়েছে। একব্যক্তি বা একপদের কাছে এমন অসীম রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের ফল না দেশের মানুষের জন্য, না ক্ষমতা ভোগকারীদের জন্য, কারো জন্যই ভালো হয়নি—কতিপয় লুটেরা ও পাচারকারী ছাড়া। ষড়যন্ত্র আর সহিংস পথ ছাড়া তাই এখানে ক্ষমতাসীন দল কখনো স্বাভাবিক নির্বাচনীপন্থায় ক্ষমতা ত্যাগ করেনি (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ছাড়া, যখন সংবিধানের নির্বাচন সংক্রান্ত ধারাগুলো স্থগিত ছিল)। তাই ষড়যন্ত্র আর সহিংসতাই হয়ে উঠেছে এখানকার রাজনীতির অপর নাম।
বিগত ৫০ বছরের শাসনকালের পর্যালোচনা থেকে তাই আমরা এটা স্পষ্ট যে, দেশের মানুষকে সম্পদ পাচার এবং জুলুম থেকে বাঁচতে হলে দেশের বিদ্যমান আইনকানুন, বিশেষত রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যেইসব আইনকানুন সম্পর্কযুক্ত, সেগুলির পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগকারীদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমাদের দেশের ৯৯ ভাগ মানুষই এইসব জুলুম, বেঈমানী আর অন্যায় আইন থেকে রেহাই চায়। কিন্তু কি করলে এ অবস্থার অবসান হবে এবং এ অবস্থার পরিবর্তে আমরা কেমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, সে সম্পর্কে তাদের সামনে স্পষ্ট কোনো ছবি নেই। তাই মানুষ হতাশ হয়ে এইসব জঘন্য অপরাধ আর জুলুমের সাথে আপোষ করেই একরকমভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রিয় দেশবাসী ও বন্ধুগণ,
এই অবস্থা থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব রাষ্ট্রচিন্তা তার একটা পরিকল্পনা তাদের ৭ দফায় তুলে ধরেছে। এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে তুলে ধরা হলো:
১ নং দফা
রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম দফা হলো সংবিধান বিষয়ক। রাষ্ট্রচিন্তা সংবিধানের ব্যাপক সংস্কার করতে চায়। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা যে সরকারের প্রধান নির্বাহীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তার পরিবর্তন করে এই দফায় ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। জনগণের ভোটে যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন আর জনগণের টাকায় যারা বেতন-ভাতা-সম্মানী পান তাদের প্রত্যেককে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। মোটকথা, সংবিধানের প্রথম অংশে (ভূমিকা থেকে ৩য় অধ্যায় পর্যন্ত) যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে বলে রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে সেইসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো অংশে (৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) যেইসব বাধা আছে সেগুলো সংস্কার করে সংবিধানকে রাষ্ট্রের ঘোষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপযোগী করতে হবে। এই দফায় রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে তদারকির ক্ষমতা যাতে জনগণের হাতে থাকে, সংবিধানকে তেমনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জনগণকে যে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের পথের সকল বাধা দূর করার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
২ নং দফা
এই দফায় বর্তমানের গণবিরোধী সংসদকে মানুষের পক্ষের আইন বানানোর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমেই ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদকে আইন বানানোর ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সংসদ-সদস্যরা যাতে আইন বানানো ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে না পারে তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এবং সংসদে কথা বলার ক্ষেত্রে সরকারী দল তথা সরকার-প্রধানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কমিয়ে বিরোধী দলের সদস্যগণ যাতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পাবে তার জন্য ‘সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি’ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। সংসদ-সদস্যদের আয়-ব্যয়ের হিসাব ৬ মাস পর পর জনসমক্ষে প্রকাশ এবং বৈধ আয়ের সাথে অসঙ্গতি পেলে সদস্যপদ ও বাড়তি সম্পদ বাতিলের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাবও করা হয়েছে। দলীয় প্রধান যেন একই সাথে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান না হতে পারে সে বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
৩ নং দফা
তৃতীয় দফায় সংসদ নির্বাচনের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায যিনি নির্বাচিত হন, তার চাইতে অনেক বেশী ভোট পান যারা হেরে যান তারা সম্মিলিতভাবে। তাই এ রকম নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয় বা যারা সরকার গঠন করে তার চাইতে বেশী থাকে বিরোধী মতের মানুষ। ফলে সরকারকে প্রথম থেকেই দলের মাস্তান-সন্ত্রাসী আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করতে হয় তাদের শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। রাষ্ট্রচিন্তা এ ব্যবস্থা বদলায়ে এমন একটি ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে যাতে সবার ভোটেরই মূল্যায়ন করা যায়, যাতে যে দল সারাদেশে সম্মিলিতভাবে যতো শতাংশ ভোট পাবে, সেই ভোটের অনুপাতে সংসদে ততো আসন পেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় আমাদের ৩০০ আসনের সংসদে যদি কোনো দল সারাদেশে ১ শতাংশ মানুষের ভোট পায়, তবে সে দল সংসদে ৩টি আসন পাবে। যে দল বা যারা মিলে ৫১ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে তারা সরকার গঠন করবে। কোনো ব্যক্তি যাতে ২ বারের বেশী প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেণ্ট হতে না পারে সে প্রস্তাবও করা হয়েছে এ দফায়।
৪ নং দফা
এ দফায় আইন-আদালত, বিচার ও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন সম্পর্কে প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব নিপীড়নমুলক আইন রয়েছে সেগুলির পরিবর্তন, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তাকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করা, জনগণের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিস্পত্তির যেসব দেওয়ানী-ফৌজদারী আইন রয়েছে সেগুলিকে সহজ করা, পদ্ধতিগত বা প্রসিডিউরাল আইনের সংশোধন করা, জনগণ বা রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট ও আত্মসাতে সহায়ক আইনগুলি বাতিল করা, পুলিশ ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত জনগণের সন্তানদেরকে জনগণের শত্রুতে পরিণত করার উপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করা, উচ্চ আদালতে দলীয় অনুগতদের মধ্য থেকে বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি বাতিল করা এবং উপনিবেশিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে এ দফায়।
৫ নং দফা
এই দফায় অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়া বা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এই রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক আইনকানুনগুলিকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে উৎপাদনের চেয়ে বাণিজ্য এবং প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যের চাইতে লুটপাট সহজ ও নিরাপদ হয়। তাই এদেশের অর্থনীতি কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম দিয়ে চলে না, এটা চলে লুটপাটের নিয়মে। এখানে ব্যাংকের মালিকরা ব্যাংক ডুবায়ে দিয়ে রাষ্ট্রকে ব্যবহার ক’রে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভর্তুকি নিয়ে আবার ব্যাংক চালু করে। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে সরকার-দলীয় লোকদের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ করা হয় এবং তারা ব্যাংক ডুবায়ে দিয়ে নিজেরা আরো ফুলেফেঁপে ওঠে। এখানে অডিটের কোনো মান নাই। ঋণদান, ঋণ মওকুব, খেলাপী, অবলোপন, আত্মসাৎ সবই হয় রাষ্ট্রীয ক্ষমতা ব্যবহার করে। আর্ন্তজাতিক ক্রয়-বিক্রয়, আমদানী-রপ্তানী, সবকিছুকেই সম্পদ পাচারের প্রকাশ্য রুট হিসাবে ব্যবহার করে সরকারের কাছাকাছি মানুষরা। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পরোক্ষ করই প্রধান, যার মাধ্যমে যে যতো গরীব সে তুলনামূলকভাবে ততো বেশী ট্যাক্স দেয়। আর এই ট্যাক্সের টাকা কিভাবে বিলিবণ্টন করলে সরকারের কাছাকাছি লোকদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারার কাজ সহজ হয় তারই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার নাম এখানে বাজেট। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার মতো প্রয়োজনীয় আইন ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নাই। রাষ্ট্রচিন্তা এই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রের পরিবর্তন চা্য়।
৬ নং দফা
এখন সরকার সম্পূর্ণ এককেন্দ্রিক। স্থানীয় সরকার বলে যা আছে তা নামেমাত্র স্থানীয়, প্রকৃতপক্ষে এগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় ইউনিট। আমরা সরকারী দায়িত্বকে দুইভাগে ভাগ করতে চাই। কেন্দ্রীয় সরকার শুধু কেন্দ্রীয কাজ, যেমন আইন প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন-কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে। জনগণের সেবামূলক যেসব দায়িত্ব রাষ্ট্রের পালন করার কথা, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আইন-শৃংখলা ও পরিবেশ রক্ষা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফসলের মূল্য নির্ধারণ—এমন সব কিছুই স্থানীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনে তাদের প্রত্যাহার করবার অধিকার জনগণের কাছে থাকতে হবে।
৭ নং দফা
বর্তমানে ১৮টি মৌলিক অধিকারের ১৭টিই শর্তের শিকলে বাঁধা। এগুলোকে শর্তের শিকলমুক্ত করে পাওয়ার সুযোগ নিরঙ্কুশ করতে হবে। পাশাপাশি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও বিনোদনের অধিকারকেও মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি এবং জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার পরিপন্থী কোনো আইন, আদেশ, ফরমান রাষ্ট্র যাতে জারী না করতে পারে তেমন সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকতে হবে। জাতি, ধর্ম, কাষ্ট, বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চল, ভাষা, সংস্কৃতি, মতবাদ বা বিশ্বাসের জন্য কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কোনোপ্রকার বৈষম্য করতে পারবে না, এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রিয় দেশবাসী ও বন্ধুগণ,
রাষ্ট্রচিন্তার এ প্রস্তাবনাকে আপনাদের কারো কারো কাছে বর্তমান বাস্তবতায় অধিক অগ্রসর বা ব্যাপক বিস্তৃত মনে হতে পারে, আবার বিপরীত দিক থেকে কারো কারো কাছে এ কর্মসূচীকে অত্যন্ত আপোষমূলক বা কারো কারো কাছে বর্তমান শোষণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার কর্মসূচীও মনে হতে পারে। আপনার কাছে যা-ই মনে হোক না কেন, আমরা আপনার সাথে এ কর্মসূচী নিয়ে আলাপ করতে চাই। আপনার প্রস্তাব শুনতে চাই। আপনি এর কেমন সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন চান, রাষ্ট্রচিন্তা আপনার কাছ থেকে তা জানতে চায়। যদি এ কর্মসূচীকে একেবারেই অযৌক্তিক মনে হয় এবং আপনি যদি এর বাইরে অন্য কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচী নিয়ে আলাপ করতে চান রাষ্ট্রচিন্তা তাও শুনতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আলাপ হতে হবে ‘আপনি কেমন বাংলাদেশ চান’ শুধু তা নিয়ে।
কোন নেতা বড় ছিলেন, কোন নেতা ছোট ছিলেন বা কোন আদর্শ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর কাদের কোনো আদর্শ নাই, কোন বিশ্বাস একমাত্র খাঁটি আর কোন নেতার ব্যাখ্যাই একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা অন্যেরা সব ভুল—এইসব নিয়ে রাষ্ট্রচিন্তা এই মুহূর্তে আলাপ করতে চায় না। রাষ্ট্রচিন্তা মনে করে এমন অনেক তর্ক আছে যেগুলো শুনতে বা অংশ নিতে বেশ মজাদার, কিন্তু তার কোনো সমাধান তর্কশাস্ত্রে নাই। রাষ্ট্রচিন্তা সেই আপাত সীমাহীন তর্কে লিপ্ত হতে চায় না। বরং রাষ্ট্রচিন্তা এই মুহূর্তে বিদ্যমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমস্যা কি এবং কি করলে সমস্যাগুলি দূর হতে পারে সুনির্দিষ্টভাবে এটুকু নিয়েই আলাপ করতে চায়। রাষ্ট্রচিন্তা আপনার কাছে যেতে চায়, রাষ্ট্রচিন্তাকে আপনার ভাবনার সঙ্গী করুন।
সবার প্রতি ভালবাসা।
[এ বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত জানতে রাষ্ট্রচিন্তার ওয়েবসাইট থেকে খসড়া প্রস্তাবনা ও গঠনতন্ত্র, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খসড়া নোট, বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা, নির্বাচন প্রসঙ্গে, ইত্যাদি কয়েকটি প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও পুস্তিকা দেখা যেতে পারে।]