বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র মানুষের ফ্লয়েডীয় জীবন

ছবির ব্যক্তির নাম তানজিরুল হক লিমন। পুলিশি নির্যাতনের শিকার লিমন এখন শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। ছবি সূত্র: দেশ রূপান্তর

আমেরিকায় কালোদের চাইলেই মেরে ফেলে যায়। ‘স্ট্যান্ড ইওর গ্রাউন্ড’ নামে এক আইন আছে, যার ফলে কোনো সাদা ব্যক্তির যদি মনে হয় কোনো কালো ব্যক্তি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তাহলে তিনি গুলি চালাতে পারবেন।

পরে হয়তো দেখা গেল, আসলে ওই কালো ব্যক্তিটি নিতান্তই নিরীহ-নিরপরাধ ছিলেন, কিন্তু আদালত ওই সাদা ব্যক্তি কিংবা পুলিশের পক্ষে রায় দিবে, “ঠিক আছে ওই কালো লোকটি নিরীহ ছিল। কিন্তু এই সাদা ব্যক্তিটিই বা কী করবে? তার জন্য তো ওই কালো লোকটি হুমকি হলেও হতে পারত!”

‘হলেও হতে পারত’! শুধু মাত্র এই আন্দাজের উপর ভর করে চাইলে কোন কালো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র কালো হওয়ার ‘অপরাধে’ চাইলে মেরে ফেলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

“ম্যালকম এক্স গ্রাসরুট মুভমেন্ট” নামের একটি সংগঠনের করা রিপোর্ট অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতি ২৮ ঘন্টায় রাষ্ট্রের হাতে একজন করে কৃষ্ণাঙ্গ শিশু,নারী বা পুরুষ নিহত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইম এন্ড জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক অ্যাডাম ল্যাংকফোর্ড এক সমীক্ষায় দেখান ১৯৬৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বিশ্বে সংঘটিত ৪ বা ততোধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এমন গণ গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলোর এক তৃতীয়াংশ ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মোট ৯০ টি ঘটনা ঘটে যা বিশ্বে নজিরবিহীন।

The Mass Shooting Tracker নামক ইন্টারনেটভিত্তিক গ্রুপের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে গণ গুলিবর্ষণের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে আহত হয়েছে ৩৮১৭ জন,নিহত হয়েছে ১৩৪৩ জন।

উল্লেখ্য,সংঘটিত কোন গুলিবর্ষণের ঘটনায় কমপক্ষে ৪ জন আহত হলেই কেবল Tracker সেটিকে Mass shooting বা গণ গুলিবর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং কোন ঘটনায় তিন বা ততোধিক ব্যক্তি নিহত হলেই কেবল এফবিআই তাকে mass killing বা গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে।

আমরা সকলেই জানি,আমেরিকায় বেশিরভাগ সময় পুলিশের গুলিতে একজন বা দুজন নিহত হয়।অর্থাৎ সেসব ঘটনা এই রিপোর্টে আসেনি।

অর্থনৈতিকভাবে উন্নত কোনো রাষ্ট্রে এই হারে মানবহত্যার মত ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পরপরই ট্রেভন মার্টিন নামে এক আফ্রিকান-আমেরিকান কিশোরকে এভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।

যার প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, “Trevon could have been me 35 years ago.” কালো হওয়ার কারণে পয়ত্রিশ বছর আগে আমারও ট্রেভনের মত খুনের শিকার হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

নিচের ছবিটা নরসিংদীর লিমনের। পুলিশের নির্যাতনে হাত-পা হারিয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। ফেসবুকে অনেকেই ছবিটা নতুন করে শেয়ার করছেন।

সেই সূত্রে মনে হলো, আজকে যে ভয়াবহ নিপীড়নমূলক সার্বভৌম ক্ষমতার হাতে বাংলাদেশের মানুষের জৈবিক ও রাজনৈতিক অধিকার বন্দি, যেভাবে এখানে প্রতি মুহুর্তে বধযোগ্য প্রাণ উৎপাদন করা হচ্ছে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ও মতাদর্শিক হাতিয়ারের মাধ্যমে ; এমন একটা পরিস্থিতিতে জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস খুনে প্রতিক্রিয়া দেখানোর রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?

তাৎপর্য এটাই যে, বাংলাদেশের মানুষও আজকে একেকজন সম্ভাব্য জর্জ ফ্লয়েড। জর্জ ফ্লয়েড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘মূলধারা’র মানুষ ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি হোয়াইট আমেরিকান ছিলেন না ফলে নানাবিধ ধর্মীয়-জাতিগত-লিঙ্গগত মাইনরিটিকে নিপীড়ন, ঘৃণা উৎপাদন ও ডিহিউম্যানাইজ করার যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়ে আছে , তিনি তার সর্বশেষ শিকার।

কিন্তু বাংলাদেশে , ধর্মীয়-জাতিগত-লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুরা তো বটেই, এমনকি ধর্মীয় কিংবা/এবং জাতিগত মেজরিটির তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা মানুষেরা যে রাজনৈতিক অধিকারহীন জীবন যাপন করে , যেভাবে গুম-খুন-ক্রসফায়ার-তুলে নিয়ে যাওয়া, হয়রানিমূলক মামলায় জেলে বন্দি থাকে তার সমান্তরাল তুলনা কি পৃথিবীর অন্য কোথাও সম্ভব?

সভা-সমাবেশ-মত প্রকাশের অধিকার এখানে যেভাবে ‘আইনত’ বন্ধ রাখা যায় , তার তুলনা কি পৃথিবীতে আর একটাও আছে?

যেভাবে জরুরি অবস্থাকালীন আপদকালীন ব্যবস্থাকে এখানে ‘স্বাভাবিক’ রুলে পরিণত করা হয়েছে,
সাংবিধানিক শর্তের শৃঙ্খলে বেধে রাখা হয়েছে মৌলিক অধিকারের মতো নি:শর্ত মানবীয় অধিকারকে, ক্রসফায়ারের মতো নৃশংস খুনের আইনগত ভিত্তি দেয়া হয়েছে,

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্দেহ/মনে হওয়ার ভিত্তিতে যেভাবে নাগরিকের দেহতল্লাশী থেকে শুরু করে বাসা-বাড়িতে বিনা পরোয়ানায় অনুপ্রবেশের অধিকার (প্রয়োজনে দরজা ভেঙ্গে) সংরক্ষণ করে, তার নজির গোটা দুনিয়ায় বিরল।

তো , এরকম জৈবিক ও রাজনৈতিক অধিকারহীন নাঙ্গা জীবন যাপন করে বাংলাদেশের মানুষ। তারজন্য এমনকি ফ্লয়েডের মতো ‘মাইনরিটি’ও হতে হয়না তাদের।

রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদী একচেটিয়া সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে এরকম উন্মোচিত নাঙ্গা জীবনের অধিকারীরাই আবার সমাজের জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-লৈঙ্গিকভাবে ভিন্নধর্মীদের ‘অপর’ বর্গে চিহ্নিত করে, বর্ণবাদী সার্বভৌম ক্ষমতার মতাদর্শ সমাজে পুনরুৎপাদন করে এবং সমাজদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মতো বিস্তার ঘটায়।

ফলে নাস্তিক-শিবির-সমকামী এমনকি রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াইরত নাগরিকও সার্বভৌম ক্ষমতার ‘অপর’ ও বধযোগ্য প্রাণ হিশেবে উন্মোচিত হয়।

হবস এর সার্বভৌম লেবিয়াথান যৌক্তিকতা পায় মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থায় ‘প্রত্যেকে প্রত্যকের বিরুদ্ধে’র অজুহাতে।

বাংলাদেশে আমরা সেই পরিস্থিতির একধাপ অবনমন দেখছি : এখানে প্রত্যেকে প্রত্যকের ‘অপর’। আবার সবাই সার্বভৌম ক্ষমতার ‘অপর’।

প্রত্যেকে একেকজন রাজনৈতিক অধিকারহীন সম্ভাব্য জর্জ ফ্লয়েড।

নাকি লিমন?..

৪ জুন ২০২০

সারোয়ার তুষার: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *