প৬ই মে ২০২০
বিষয়: র্যাব-৩ পরিচয়ে সাদা পোশাকে রাষ্ট্রচিন্তা ও দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির সদস্য দিদারুল ভুঁইয়াকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং বর্তমান বাংলাদেশ।
বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ আজ করোনার চেয়ে ভয়াবহ এক দুর্য়োগে বহুদিন ধরে আক্রান্ত। এখানের মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। কয়েকমাস আগে সাংবাদিক কাজলকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন আগে মিথ্যে নাটক সাজিয়ে তাকে ভারতের সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার দেখানোর মাধ্যমে তা যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষকে স্তম্ভিত করেছে, ঠিক তখই রাষ্ট্রচিন্তা এবং দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির সদস্য দিদারুল ভুঁইয়াকে সাদা পোশাকে র্যাব-৩ এর পরিচয়ে গতকাল গতকাল ৫ই মে সন্ধ্যায় ইফতারির ঠিক আগে কিছু মানুষ কালো মাইক্রোবাসে করে এসে র্যাব-৩ পরিচয়ে তার চ-৫১/১, উত্তর বাড্ডার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির প্রথম প্রতিবেদন যেটা ৩০ তারিখে প্রকাশ করা হয়েছিল সেখান থেকে দারিদ্য হার অনুযায়ী কুড়িগ্রাম-দিনাজপুরসহ অন্যান্য দরিদ্র জেলায় বরাদ্দের নিম্নহার বিষয়ে তিনি বিভিন্ন গ্রুপে পোষ্ট দিয়েছিলেন। এরপর তা কয়েকদিন ধরে বেশ আলোচিত হওয়ায় তার পোষ্ট প্রথমে ডিলিট করা হয়। এবং পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে আজ সন্ধ্যায় র্যাব-৩ এর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির সদস্য হিসাবে আছেন ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, কথাসাহিত্যিক রাখাল রাহা, প্রফেসর সাঈদ ফেরদৌস, প্রফেসর নাসির আহমেদ, অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম, অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান, প্রফেসর আনু মোহাম্মদ, অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, প্রফেসর বখতিয়ার আহমেদ, অধ্যাপক আর রাজী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা , অ্যাডভোকেট ড. কাজী জাহেদ ইকবাল, উন্নয়নকর্মী জাকির হোসেন, গবেষক মাহা মির্জা, গবেষক হাসিবউদ্দিন হোসেন, অ্যাক্টিভিষ্ট বাকী বিল্লাহসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আরো অনেকে।
বন্ধুগণ,
শুধু দিদারুল ভুঁইয়াকে নয়, তার মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার সিপিইউ সহ অন্যান্য জিনিসপত্রও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গতকাল থেকে তার মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন প্রযুক্তিবিদ এবং তিন সন্তানের বাবা। দেশের নানা সংকটে তিনি কথা বলেন। বর্তমান করোনা দুর্যোগে দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্যপণ্য যোগাড় করা, বিতরণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। দেশকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন পরিবর্তন চাই-এর তিনি অন্যতম সংগঠক।
তার পরিবার ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ থেকে গতকাল রাতেই র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে গেলে তাদেরকে বলা হয়েছে তারা এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। র্যাব-১ থেকেও এ বিষয়ে অস্বীকার করা হয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের পর তারা সেখান থেকে তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড্ডা থানায় জিডি করতে যান। অনেক বাকবিতণ্ডার পর পুলিশ জিডি নিতে বাধ্য হলেও থানার ভিতরে শুধু তার ভাইকে প্রবেশ করতে দেন এবং পরিকল্পিতভাবে জিডিতে লেখা হয়, দিদারুল ভুইয়া বাসার বাইরে কাজে যান এবং এরপর আর ফিরে আসেননি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, নাগরিকদের করের টাকায় চলা পুলিশের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।
আমরা এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অবিলম্বে তাকে অক্ষত শরীরে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার দাবী জানানোর সাথে সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
প্রিয় বন্ধুগণ,
আপনারা জানেন, পিপলস রিপাবলিক বা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র জনগণ গঠন করে এবং এ ধরণের রাষ্ট্রের মালিকও হয় জনগণ। কিন্তু আমাদের সংবিধান বা শাসনতন্ত্রে নানা কথার আড়ালে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিকানা এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, আর তাকে রাখা হয়েছে সকল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। পিপলস রিপাবলিকে রাষ্ট্র আর সরকার এক নয়, এদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য থাকে। এখানে সরকার যদি রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন না মানে, তখন মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিকার পায়। তাই পিপলস রিপাবলিকে একটি দল ক্ষমতায় গেলেই অন্যান্য দল বা জনগণের উপর যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দমন-পীড়ন করতে পারে না। কিন্তু আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র আর সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। এখানে যে সরকার, সে-ই রাষ্ট্র! যার দল ক্ষমতায়, আইন-আদালত, কোর্ট-কাচারী, পুলিশ-মিলিটারী সবই তাদের করায়ত্বে! উপরন্তু এখানে ব্রিটিশ আমলের প্রজা-শাসনের সকল আইন স্বাধীন দেশের নাগরিকের উপর প্রয়োগের সকল ব্যবস্থা জারি রাখা হয়েছে। তাই এখানে আইন থাকলেও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তার প্রয়োগ হয় না, আর সরকার চাইলে বিনা দোষে যাকে-তাকে যখন-তখন হয়রানি-হেনস্তা, এমনকি খুন পর্যন্ত করতে পারে। তারই নানা রূপ আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে বাংলাদেশে দেখে আসছি।
প্রিয় বন্ধুগণ!
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র আর সরকার কোনো নেতা-নেত্রী বা মন্ত্রী-এমপি বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর টাকায় চলে না, বরং তারা সবাই জনগণের কষ্ট-ঘামে উপার্জিত টাকায় চলে। আর এই টাকা তারা কে কতটুকু কোথায় কিভাবে খরচ খরছে তার স্বচ্ছতার জন্য রাষ্ট্রে অডিটর অ্যাÐ কম্পট্রোলার জেনারেল নামক একটি পদ থাকে, যাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে সেই ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত নেই। সেজন্যে এখানে ব্যাংক-বীমা-আন্তর্জাতিক ক্রয়বিক্রয়সহ উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ-নেতার বেশে লুটেরারা বিভিন্ন সুবিধাজনক আইন বানায়ে দেশের জনগণের কষ্টের অর্জন প্রতিদিন লুটপাট ও পাচার করে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। অন্যদিকে এখানে মানুষ যদি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণেও ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ তবে তার জেল ও জরিমানা দুটোই হয়। আর এগুলো নিয়ে কোনো নাগরিক কথা বললে বা লিখলে তাকে এ গুম-খুন এবং হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি, প্রচারমাধ্যম, যাদের রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, যাদের স্বাধীনতার কথা সারা দুনিয়া জুড়ে নিশ্চিতের কথা বলা হয়, তারাও এখানে কি ভয়ঙ্কর রকমভাবে গুম-খুন হয়রানির ভয়ে থাকেন তা নতুন করে দৃষ্টান্ত দিয়ে উল্লেখ করার কিছু নেই।
প্রিয় বন্ধুগণ,
আমাদের বুঝতে হবে, একটা দেশ যত সুন্দরই হোক, এর মানুষ যেমনই হোক, দেশ পরিচালনার আইন-কানুন, সংবিধান, সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি ভালো না হয়, তাহলে কোনো সতর্কতাই আমাদেরকে, আমাদের সন্তান-সন্ততিকে নিরাপদ ও সুখী রাখতে পারবে না। এ যুগে একা একা ভালো থাকার কোনো পথ নাই। তাই হয় আমাদের এই দেশ-রাষ্ট্র-সমাজকে সুস্থ করতে হবে, আর না হয় অপরাধীদের সাথে থেকে, অপরাধীদের নেতা হয়ে, অথবা অপরাধীদের অনুগ্রহে বেঁচে থাকতে হবে।
প্রিয় বন্ধুগণ,
৭১ সালে যুদ্ধ করে আমাদের পূর্বসূরীরা সবচেয়ে কঠিন কাজ এই দেশটিকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। আর আমাদের বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব হলো, তাঁরা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশটি স্বাধীন করেছিলেন, যেমন রাষ্ট্র তৈরী করার অঙ্গীকার করেছিলেন, যার কিছুটা সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশে আছে, তা বাস্তবায়নের উপযোগী ক্ষমতাকাঠামো এবং আইন-কানুন বানানো।
দিদারুল ভুঁইয়া সেই স্বপ্নের একজন সৈনিক। সেই স্বপ্ন আজ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ভীত হয়ে তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে রক্ষা পেতে চাইছে। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা এদেশের মানুষ কোনো স্বপ্ন দেখলে তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার পর্যন্ত করতে পারে।
আমরা বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বলতে চাই, অবিলম্বে দিদারুল ভুঁইয়ার সুস্থ শরীরে তার পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে। যারা এই ধরণের কাজের সাথে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। নতুবা পরবর্তী পরিস্থিতির দায় বহন করতে যারা এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর জন্য দায়ী তারা থাকবেন, বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষ নয়।
রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভুঁইয়াকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত দেওয়ার দাবীতে রাষ্ট্রচিন্তা ঘোষিত কর্মসুচি:
- আজ বুধবার থেকে দিদারুল ভুঁইয়াকে ফেরত দেওয়ার দাবীতে অনলাইন প্রতিবাদ জানানোর জন্য বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানকারী সকলকের প্রতি আহবান জানানো যাচ্ছে।
- দিদারুল ভুঁইয়া কে সাদা পোশাকে, বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে আজকে ৬ মে রাত দশটায় বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী সকল বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণে অনলাইন প্রতিবাদ।
- আজকের মধ্যে দিদারুল ভুঁইয়াকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত দেওয়া না হলে আগামী কাল সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পরিবার, রাষ্ট্রচিন্তা, অপরাপর সংগঠন ও সকল সাধারন মানুষের অংগ্রহণে মানববন্ধন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন:
হাসনাত কাইয়ুম,
রাখাল রাহা,
ফরিদুল হক,
সারোয়ার তুষার,
দিদারুল ভুইয়ার স্ত্রী দিলশানারা অপর্ণা,
বড় ছেলে দিপ্ত ইসলাম
হানিফ বাংলাদেশী ছাড়া আরো অনেকে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর কার্টুনিস্ট কিশোর আহমদের গ্রেফতার এবং লেখক, সাংবাদিক, এক্টিভিস্টসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে র্যাব কর্তৃক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার সংবাদ পাওয়া যায়। রাষ্ট্রচিন্তা দিদারুল ভূঁইয়া, আহমেদ কবির কিশোর, মোশতাক আহমদসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় আটক সকল নাগরিকের মুক্তি দাবি করছে।
রাষ্ট্রচিন্তা
কক্ষ নং ২০৪, ইব্রাহীম ম্যানশন, ১১ পুরানা পল্টন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ০১৮১৬ ০১১ ২১৪