গত ১৪ই এপ্রিল, ২০২০ তারিখে রাষ্ট্রচিন্তার আয়োজনে দ্বিতীয় ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এবারের বিষয়বস্তু ছিল ‘করোনাকালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা : রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, সংকট এবং উত্তরণের পথ’।
এতে অংশ নেন হেলথ এন্ড হোপ হসপিটালের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী, কম্যুনিটি হাসাপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ‘ডক্টরস ফর পিপল’-এর ডা. হারুন রশীদ, চিকিৎসা টিমের নন-ডাক্তার ভলান্টিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ এবং ‘সাপ্তাহিক’ সম্পাদক সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণবশত তারা উপস্থিত থাকতে পারেননি। রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন হাসনাত কাইয়ূম।
হেলথ এন্ড হোপ হসপিটালের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন তার বক্তব্যে বলেন:
১. মহামারি নিয়ন্ত্রণের দুটি ধরণ আছে: মেডিকেল এবং কমিউনিটি। মেডিকেল মডেলের জন্য যে জাতীয় রসদ সরঞ্জাম দরকার ছিল, যে পরিমাণ টেস্টের দরকার ছিল, স্বাস্থ্য অধিকর্তারা তর্জন-গর্জন করলেও, এসবের ধারে কাছেও তা যায় নি।
২. আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন থেকে মহামারি সংক্রমণের দিকে যাচ্ছি। আমাদের রসদ অপর্যাপ্ত…ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, আইসিউ ডাক্তার, নার্সদের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করলে সব ভেঙ্গে পড়বে।
৩. আমাদের যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাতে স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ মোকাবেলার পরিকল্পনা নেই। ডাক্তাররা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকগুলো সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল লকডাউন করতে হয়েছে। ডাক্তার-নার্সরা যদি কোয়ারেন্টাইনে যায় তাহলে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে। ভেন্টিলেটর যা আছে অনেকগুলোই নষ্ট। আমাদের ব্যবস্থাপনার জন্য সে সর্বব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম দরকার সেটা করা হয়নি।
৪. সরকার দায় এড়াবার জন্য ডাক্তারদের মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কিছুই করা যাবে না। অনেকেই চিকিৎসা অবহেলায় মারা যাচ্ছেন, দোষ পড়ছে ডাক্তারদের ওপর।
৫. এই মুহুর্তে ডাক্তার-নার্সদের ব্রিগেডে ব্রিগেডে ভাগ করতে হবে। চৌদ্দদিন পর পর ব্রিগেড চেঞ্জ হবে। আরেকটি ব্রিগেড কাজ করবে। দ্বিতীয়ত, অনেক ডাক্তার পিপিই পরা সত্ত্বেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মানে, এসব পিপিই সরঞ্জাম মানহীন। স্বাস্থব্যবস্থার সাথে যারা যুক্ত তাদের বাসস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে।
৬. মানুষ জানে না, কই যাবে। পরীক্ষাটা এখনো উপরওয়ালাদের মর্জির উপর নির্ভরশীল। সেখানেও তাদের রাজনীতি মিশে আছে, তারা এটাকে দুনিয়ার সামনে মানইজ্জত আকারে ভাবতেছেন।
৮. পরীক্ষার নিয়ম বদল করতে হবে। বিশ্বজুড়ে তিন রকম টেস্ট করা হচ্ছে। আমাদের এখানে এলাকা ও রোগীর সংখ্যার অনুমান করে কোন টেস্ট কোথায় করতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৯. জরুরি বিষয়, মানুষ ক্ষুধার্ত। যদি সমন্বিত উদ্যোগ না নেয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হবে।
১০. এই করোনা পরবর্তী বিশ্বে নতুন একটা মডেল, প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে উন্নয়ন ও সমাজভাবনাকে সাজাতে হবে। নতুন ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে কীভাবে কৃষক ও শ্রমিকদের উৎপন্ন ধান বা ফসল বন্টন করা যায় তা চিন্তা করতে হবে।
১১. ডাক্তারদের যে মাদার অর্গাইজেশন তারাও দলীয়করণ ও তোষামোদির কারণে শক্তভাবে ভয়েস রেইজ করতে পারেননি।
চিকিৎসা টিমের নন-ডাক্তার ভলান্টিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ তাঁর বক্তব্যে বলেন:
১. ভেবেছিলাম প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া, তাপমাত্রা মাপা, ইত্যাদি করবো; প্রথমে ভেবেছিলাম লোকজন রেসপবন্স করবে না, কিন্তু মানুষ ভীষণ রেসপন্স করছে। ত্রাণের মতোই গুরুত্ব দিচ্ছে। লাইন ধরেই দাঁড়িয়েছে, ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনেই। প্রপার এওয়ারনেস থাকলে এটা ডিল করা সহজ ছিল।
২. মনে হয়েছিল, পরিস্থিতি যেমন দাঁড়াতে পারে, অসুস্থ মানুষের কাছে প্যারাসিটামল পৌঁছে দেয়াটাও বড়ো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এরা যদি আক্রান্ত হয়, অধিকাংশের পক্ষে প্যারাসিটামল জোগাড় করাই কঠিন।
৩. আজ সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করতে আজিমপুর বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়ে দেখলাম প্রিপেইড বিদ্যুত বিলের লাইন। তারা এসেছেন বিদ্যুতের বিল দিতে। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশের কত বাগাড়ম্বর শুনি! কালকেই গ্রীনরোডের ৩০০ এর উপর রিকশাচালক জড়ো হয়ে ছিলেন, কোনো ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানছেন না তারা।
৪. সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ জিনিস যেগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা হয়েছে, আমরা গুটিকয়েক লোক জানি। এগুলোর কোনো প্রচারণাই হয়নি। সরকার কোনো তথ্যই মানুষকে জানায়নি, মানুষের কাছে সঠিক তথ্য নেই।
৫. তথ্য প্রবাহ যদি না থাকে, রাষ্ট্র বা সরকার তখন গুজব তৈরি করে। গুজব তৈরি হয় তথ্য ও সচেতনতা না থাকার ফলে। এই যে সন্তান মাকে বনে রেখে আসছে… কারণ গুজব হচ্ছে, কারো যদি করোনা হয় তাহলে পুলিশ তাকে নির্মূল করে ফেলবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম কার্যকর কোনো তথ্য জানাতে পারেনি মানুষকে।
৬. লকডাউনের যে জেনারেল নীতিমালা, সেটা কার জন্য কিভাবে বাস্তবয়ায়ন করা সম্ভব, সে অনুযায়ী গাইডলাইন তৈরি করা, অনেকগুলো ঘরের মধ্যে একসাথে অনেকেই থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে কি হবে তা নিয়ে কোনো আলাপই হয়নি।
৭. সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, মানুষের মধ্যে যে এওয়ারনেসের ঘাটতি আছে, সেটা বাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। প্রচুর লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না। সরকার প্রদত্ত পিপিই সরঞ্জাম অত্যন্ত নিম্নমানের। যে প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করছে তাদের পূর্বের কাজকারবার প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের আচরণ খুবই অসংবেদনশীল। হজক্যাম্পের কোয়ারেন্টিনের অবস্থা কি ছিল তা আমরা সবাই জানি।
৮. যদি সরকার প্রায়োরিটি না ঠিক করতে পারে, তাহলে এই ত্রাণ বা আমাদের এই প্রচেষ্টা খুবই অপ্রতুল। পলিসি মেকিং-এ ডাক্তারদের নেতৃত্ব নেই। অবশ্য সর্বগ্রাসী পচন সবখানেই লেগেছে।
৯. যারা করোনার চিকিৎসায় জড়িত তাদেরকে নিচু চোখে দেখা হচ্ছে, একেবারে সরকারের তরফ থেকেই। এখানকার মানুষের মধ্যে যে স্যাক্রিফাইসের বোধ ও যে ধরনের মানবসম্পদ রয়েছে তা দিয়ে সহজেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের পলিসি ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
সাংবাদিক ও লেখক গোলাম মোর্তোজা বলেন:
১. রাষ্ট্রের ভেতরেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা। চীনে হয়েছে, ইতালিতে হয়েছে, ইরানে হয়েছে… ফলে এই ধারণা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে জন্মানো দরকার ছিল এটা বাংলাদেশেও আসতে পারে। ট্রাম্প ৬ সপ্তাহ নষ্ট করেছিল, আমরা করেছি ১২ সপ্তাহ। যখন করোনা উহানে ছিল তখন থেকে যদি সতর্ক হতাম … আমরা শুরু থেকেই সরকারের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে সন্দেহ করেছিলাম। তারপরেও ভেবেছিলাম যতটুকু প্রস্তুতির কথা বলছে ততটুকু না হলেও অন্তত অর্ধেক প্রস্তুতি তো থাকবে! বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে আসার পরও আমাদের চিন্তা উদয় হলো না।
২. গুজব ও আতঙ্ক এক জিনিস, সত্য লুকানো আরেক জিনিস। সত্য লুকিয়ে গুজব বন্ধের চেষ্টা করা হলো, আইইডিসিআর এর পক্ষ থেকে।
৩. দুনিয়ায় দুই ধরণের মডেল ছিল; এক. প্রযুক্তিগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে লকডাউন না করে সমাধান করা। যেমন দ. কোরিয়া, তাইওয়ান বা অন্যান্য দেশ করেছে। আর এর বাইরে ছিল লকডাউন করা। যেমন চীন। কিন্তু আমরা লকডাউন করতে পারলাম না। আমাদের বলা উচিৎ ছিল, আপনার যদি জ্বর হয় তাহলে দ্রুত পরীক্ষা করেন। কিন্তু আইডিসিডিআর করেছে উল্টোটা, বলেছে জ্বর সর্দি মানেই করোনা না।
৪. ১৬ কোটি মানুষের জন্য একটা টেস্ট সেন্টার রেখেছে। একইসময়য়ে দক্ষিণ কোরিয়া ‘ড্রাইভ থ্রু’ পদ্ধতিতে টেস্ট কররেছে। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে আপনার টেস্ট রেজাল্ট চলে আসবে। দক্ষিণ কোরিয়া যা করছে আমরা কী তা পারতাম? খোঁজ নিয়ে দেখেছি দ. কোরিয়ার পদ্ধতি মানলে টাকার যে হিসেব তা আমরা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা করিনি। চুপচাপ থাকলাম। আমরা লকডাউন করলাম। কিন্তু ঘোষণা-দিকনির্দেশনা কিছুই দিলাম না। তাঁর আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছি। কিন্তু কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি, অভিভাবকদেরকেও দেয়া হয়নি। ফলে যে যার মতো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো। গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে গার্মেন্টস খোলা ছিল।
৫. ব্যবস্থাপনা এমন এক জায়গায় গেছে সাধারণ জনগণ… বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও এর নিচের মানুষের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। টিভিতে ছয়-সাতটি বিজ্ঞাপন দেখবেন, বলা হচ্ছে ভিটামিন সি খাবেন, কমলার বাস্কেট দেখাচ্ছে! বাংলাদেশের কত অংশ মানুষ অরেঞ্জ খায়? এই বিজ্ঞাপন আমরা প্রচার করছি, তার মানে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের বিবেচনায় নেই।
৬. বলা হচ্ছে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু কতজন স্যানিটাইজারের নাম শুনেছেন? কেন সাবান শব্দটা ব্যবহার করছেন না? কারণ সাধারণ মানুষের সাথে রাষ্ট্রের শ্রেণীবিচ্যুতি। বলা হচ্ছে টিস্যু ব্যবহার করতে। এভাবে বড়োজোর ১ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি।
৭. সামগ্রিক পরিকল্পনা ছাড়া যদি ছয় কোটি মানুষকে ঘরে রাখতে চাই, তাদের খাবার পৌঁছাতে হবে, কিন্তু কোন পরিকল্পনা নেই। ওএমস ১০ টাকা কেজি চাল… কিন্তু যে নিবে তার কাছে ১০ টাকাও নাই, চালের সাথে আরো জিনিসও তো লাগবে, সেগুলো কোথা থেকে আসবে সেই পরিকল্পনা নেই।
৮. করোনা রোগীর চেয়ে চালচোর বেশি হয়ে গেলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো, সেগুলোকে তারা হাসির পাত্র বানিয়ে ফেললো।
৯. এখন উত্তরণের পথ কী? পরশুদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আজকে ডেইলি স্টারের রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি যে, যার কাছ থেকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে, মানে উৎস কি তা এখনো আমাদের আইইডিসিআর জানে না। আমরা যদি উৎস না জানি কীভাবে সংক্রমণ ঠেকাবো?
১০. এখনো বাঁচার পথ আছে, যদি সরকারের তথ্যগুলো সত্য হয়। যদি পর্যাপ্ত কিট থাকে, টেস্ট বাড়াতে হবে। কিন্তু সরকার এটা করবে বলে মনে হয় না। পিপিই আনাও সম্ভব না। প্রচুর চাহিদা।
১১. কানাডা তাদের চীন বিষয়ক অভিজ্ঞদের চীনে নিয়োগ দিয়ে গোডাউন ভাড়া নিয়েছে, সরঞ্জাম কিনছে, সংগ্রহ করছে। চার্টাড প্ল্যান করে কানাডায় সরঞ্জাম নিয়ে আসছে। কানাডায় নেই, কিন্তু আমরা বলছি আমাদের আছে। ভয়ংকর মিথ্যা কথা। সংগ্রহই শুরু হয়নি।
১২. আশার কথা গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কিট। যদি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে উৎপাদন করতে পারে…কিন্তু তাদের প্রতি সরকারের মনোভাব খুবই খারাপ। কোনো ধরণের খোঁজখবর নেয়া হয়নি সরকারের তরফ থেকে, আগ্রহও দেখা যাচ্ছেনা। যদি ড. জাফরুল্লাহকে সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে বাঁচার পথ আছে।
১৩. সরকার কারো কথাই আমলে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। তবুও বলি, আমাদের ডাক্তাররা, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। সরকার সব দোষ ডাক্তারদের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এই পলিসি খুব ভয়ঙ্কর। ডাক্তাররা প্রণোদনা চাইছেন না, শুধু চাইছেন মানসম্মত সুরক্ষা ও পরীক্ষা করার সরঞ্জামাদি। সারা দুনিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে না, দাম বেশি- এসব পুরোপুরি সত্য না। বাংলাদেশের ডাক্তাররা বিদেশে সাফল্য লাভ করছেন। বেসরকারি হাসপাতাল, এনজিওগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটাই পরিবর্তন করতে হবে।
কমিউনিটি হাসাপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ‘ডক্টরস ফর পিপল‘-এর ডা. হারুন রশীদ বলেন:
১. এটা একটা বড়ো ক্রাইসিস, গুচ্ছ গুচ্ছ কাজ সারাদেশে হচ্ছে। কিন্তু সংকটের তুলনায় এটা অনেক কম। দরকার সমন্বিত নেতৃত্ব। না হলে কোনোটাই কাজে লাগবে না।
২. হাসপাতালগুলোর নিজস্ব স্ক্রিনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে, স্থানীয় ডাক্তারদের পরামর্শ জনসাধারণ বেশি মানেন। হাসপাতালে আসতে হবে কি না… তা ফোনালাপ যদি করা যায় সবচেয়ে ভালো। হাইপারটেনশন বা ক্রনিক ডিজিজের পেশেন্টরা ফোনেই ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। জরুরি রোগীরা আসবেন হাসপাতালে। ক্যাটাগরাইজ করতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে করা দরকার। জ্বর হাঁচি-কাশির রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার। বাকিদের আলাদা। যাদের কোভিড হয়েছে তাদের আলাদা, প্রপার চিকিৎসা দিতে হবে, যাদের নন-কোভিড তাদেরও ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায়, না হাসপাতাল কোথায় চিকিৎসা দেয়া দরকার? এগুলোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার ইমিডিয়েটলি। কুর্মিটোলায় সকল ইকুইপমেন্ট নেই। ইমিডিইয়েটলি স্ক্রিনিং বাড়ানো দরকার। বাইরে থেকে জিনিস আনবেন ভালো কথা, কিন্তু ভেতর থেকেও সরবরাহ লাগবে।
৩. এখনো রোগী কম। বেড সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে না। দ্রুতই আক্রান্তের সংখ্যা হাজারে চলে যাবে। যখন আইসোলেশনে থাকবে, পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলা সম্ভব না। রোগীদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার কি হবে? মেডিকেল প্রতিনিধিদের খাদ্য, পথ্য চিকিৎসা সব ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে আক্রান্ত জেলা এখনো খুব কম। ফলে চাইলেই তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।
৪. লকডাউনের সময় দরকার চিন্তা করা কোন জিনিস লাগবে, কোন জিনিস লাগবে না। যেমন হাত ধোয়ার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সাবান কোথা থেকে আসবে? সাবানের কারখানা কি চালু আছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই সব কিছু দেখতে হবে।
৫. জনগণের আস্থার বিষয়টা অর্জন করতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে না পারলে করোনা ভীতি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কেবল প্রনোদণা যথার্থ হবে না। আমাদের এখানে দুই কোটি পরিবার বা এতজন মানুষ আছে যাদের ঘরে খাবার নেই এটা বলতে হবে। তাদেরকে খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।
৬. হাসপাতালের ডাক্তাররা কোয়ারেন্টাইনে। সরকারী ডাক্তারদের বাইরে যারা আছেন তাদেরকে রিক্রুট করতে হবে, তাদেরকে ট্রেইনিং দিতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিকভাবেও প্রস্তুত করতে হবে। সার্বিক প্রস্তুতি লাগবে।
৭. গণস্বাস্থ্য কিট তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভর করার দরকার নেই। অন্যান্য জায়গাতেও আরো কিট উৎপাদন করা দরকার।
৮. লিডারশিপের যে দক্ষতা তা জনগণের বিশ্বাস ও আস্থাসহ থাকতে হবে। আস্থা অর্জন করতে হবে। যদি জনগণকে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা করি, তাহলে বিপদ অবশ্যসম্ভাবী।
পরিশেষে মহামারিকালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিষয়ক এই ভিডিও-কনফারেন্সে সকল বক্তাই মতামত দেন যে সংকটটাকে স্বীকার করতে হবে। মানহীন জিনিসকে সুন্দর মিথ্যা দিয়ে গছিয়ে দিলে চলবে না। জাতীয় সংকটের কালে পার্টিজান মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। জনগণকে দোষ না দিয়ে সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে সমন্বিত উদ্যোগ ও সুষ্ঠু-স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করোনা দুর্যোগ ও এর প্রতিক্রিয়ায় আসন্ন খাদ্য ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করতে হবে বিরাজমান সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে।