করোনাকালে বোরো ধান: রক্তে-বোনা, নাকি আবারও পাকা ধানে আগুন?

  • লেখক: রাখাল রাহা

১.

এই ভূখণ্ডের মানুষ অপরের সবচেয়ে যে ক্ষতির কথাটা চিন্তা করতে পেরেছে তা হচ্ছে কারো পাকা ধানে মই দিয়ে দেওয়া। নিশ্চয় আমাদের মনে আছে, গত বোরো মৌসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকেরা অপরের নয়, নিজের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

অনেক বছর ধরেই তারা ধানসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। এর জন্য বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি রাস্তায় বস্তা-বস্তা ধান-আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি ছিটিয়ে তাদের প্রতিবাদ করতে। এতে অবশ্য রাষ্ট্র বা সরকার তাদের কথা শোনার-বোঝার চেষ্টা খুব একটা করেছে এমন নয়।

কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা আলাদা। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব করোনা-দুর্যোগে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত, স্থবির। আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বে খাদ্য-রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও একটা দেশের সংকটকালে খাদ্যপণ্য দ্রুত আমদানিঁ করা সম্ভব হয় না। আর মহামারি বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্য আমদানিঁ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ এ রকম সময়ে কোনো দেশই তার খাদ্য-নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বৃত্ত পণ্য রফতানি করতে চায় না।

বলা হচ্ছে, করোনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, যেটা হবে দীর্ঘস্থায়ী। আর বাংলাদেশ প্রায় বিশ কোটি মানুষের দেশ, যা গোটা ইউরোপের জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। আমাদের রাস্তায়, স্টেশনে, ঝুঁপড়িতে, বস্তিতে যতো মানুষ থাকে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক দেশে মোট মানুষের সংখ্যাও তত নয়। আর এই বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য-নিরাপত্তা নির্ভর করে মূলত ধান উৎপাদন এবং তার সংগ্রহ ও বণ্টনে, অর্থাৎ কৃষকের ওপর।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার সম্প্রতি বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। কী নতুনত্ব আছে সেই লক্ষ্যমাত্রায়, যা এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হবে?

২.

খেয়াল করি গতবছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সরকারের বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও পদ্ধতিটা।
মোট ক্রয় : ১২ লাখ ৫০ হাজার মে. টন চাল
সময়সীমা : ২৫ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ৩১ আগস্ট
সিদ্ধ চাল : ১০ লাখ মে. টন (৩৬ টাকা কেজি দরে)
আতপ চাল : ১.৫ লাখ মে. টন (৩৫ টাকা কেজি দরে)
ধান : ১.৫ লাখ মে. টন (২৬ টাকা কেজি দরে, ১ লাখ মে. টন চালের সমান ধরে)
[সূত্র: আসন্ন বোরো মৌসুমে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মে.টন চাল এবং ৫০ হাজার মে.টন গম কেনার সিদ্ধান্ত মার্চ ৩১, ২০১৯]

লক্ষ্যণীয় সরকারের নীতিমালায় আসলে ধান কেনার কোনো ব্যবস্থা নেই। সবটাই চাল। চালেরই বিকল্প হিসেবে একটা ক্ষুদ্র অংশ ধান কেনা হয় এবং ধরে নেওয়া হয় ওটুকুতে যতটুকু চাল হবে সেটাই সরকার কিনছে।

৩.

২০১৮ সালের লক্ষ্যমাত্রা ও ক্রয়পদ্ধতিটাও আমরা দেখতে পারি।
মোট ক্রয় : ১০ লাখ মে. টন
সময়সীমা : ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট
সিদ্ধ চাল : ৮ লাখ মে. টন (৩৮ টাকা কেজি দরে)
আতপ চাল : ১ লাখ মে. টন (৩৭ টাকা কেজি দরে)
ধান : ১.৫ লাখ মে. টন (২৬ টাকা কেজি দরে, ১ লাখ মে. টন চালের সমান ধরে)
[সূত্র: চলতি বোরো মৌসুমে ৩৮ টাকা কেজিতে চাল এবং ২৬ টাকায় ধান কিনবে সরকার,এপ্রিল ৮, ২০১৮]

৪.

এবারে ২০২০ বোরো মৌসুমে সরকার কতটা ধান-চাল, কীভাবে কিনতে চাইছে তা আমরা দেখতে পারি।
মোট ক্রয় : ১৭.৫ লাখ মে. টন
সময়সীমা : ২৬ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট (ধান ২৬ এপ্রিল থেকে এবং চাল ৭ মে থেকে)
সিদ্ধ চাল : ১০ লাখ মে. টন (৩৬ টাকা কেজি দরে)
আতপ চাল : ১.৫ লাখ মে. টন (৩৫ টাকা কেজি দরে)
ধান : ৬ লাখ মে. টন (২৬ টাকা কেজি দরে)
[সূত্র: বোরো মৌসুমে সাড়ে ১১ লাখ টন চাল ও ৬ লাখ টন ধান কিনবে সরকার ,এপ্রিল ৭, ২০২০]

৫.

করোনা মহামারিতে প্রায় বিশ্ব যখন অচল-স্থবির, এরকম পরিস্থিতিতে খাদ্য-নিরাপত্তার কথা ভেবে এবারের বোরো সংগ্রহ নীতিমালায় কতটা কী করা হয়েছে, কী করা যেতে পারতো- আমরা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবো।

ক. এই প্রথমবারের মতো ধান কেনার কথা বলা হচ্ছে, যেটা আগে অল্প কিছু চালের বিকল্প হিসেবে যতটুকু ধান লাগে ততটুকুই কেনা হতো। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। কারণ ধান ও চালের সংগ্রহ-প্রক্রিয়া আলাদা। সরাসরি ধান কিনলে প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে বড় কৃষকও সুবিধা পেতে পারে। আর চাল কেনা হয় মূলত আড়তদার ও মিলারদের কাছ থেকে।

খ. গত বছর কিংবা তার আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এবার প্রায় ৪.৫ লাখ মে. টন ধান বেশি কেনা হবে। কিন্তু এই বৃদ্ধি মহাদুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আসলেই কি পর্যাপ্ত? এবারে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মে. টন এবং সরকার বলছে গত বছরের মতো এবারেও বাম্পার ফলন হয়েছে। সুতরাং মোট উৎপাদনের মাত্র ৩%-এর মতো ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা তা এই পরিস্থিতিতে নিতান্ত অপ্রতুল। সত্যিই যদি আমরা এই ভয়াবহ মহামারিসহ সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে চাই তবে মোট উৎপাদনের অন্তত ১০% ধান সংগ্রহ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন গুদাম, অডিটোরিয়াম, প্রয়োজনে স্কুল-কলেজের মিলনায়তনে রাখার বন্দোবস্ত করা দরকার।

গ. গত বছরে ধানের সংগ্রহমূল্য যেটা ধরা হয়েছিল এবারেও সেই একই দরে, অর্থাৎ ২৬ টাকা কেজি দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা যেটা দেখতে পাই, গত বছর কেজি প্রতি ধানের উৎপাদন খরচ ছিল ২২-২৩ টাকা। এবার করোনা পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণে আরও বেড়ে ২৩-২৪ টাকা হতে পারে। উপরন্তু এবারে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সংকট তীব্র হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং এই দর মহামারি মোকাবিলায় প্রান্তিক কৃষকদের আরও প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাবে। এটা প্রতিরোধে ধানের সংগ্রহ মূল্য ন্যূনতম ৩০ টাকা কেজি হওয়া দরকার।

ঘ. গত বছরের তুলনায় এবারে চাল ক্রয়ের পরিমাণ কিছুই বাড়ছে না, অর্থাৎ ১১.৫ লাখ মে. টনই থাকছে। সরকার বলছে তার গুদামে ১৭ লাখ মে. টন চাল মজুদ আছে। এখন যেটা প্রয়োজন এই ১৭ লাখ টন চাল সংকটগ্রস্ত কয়েক কোটি মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় বিতরণ করা এবং একই সঙ্গে নতুন করে আরও অন্তত ১৭ লাখ মে. টন চাল সংগ্রহ করা।

ঙ. গত বছরেও চাল যে মূল্যে ক্রয় করা হয়েছিল এবারেও সেই একই মূল্যে, অর্থাৎ সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা কেজি এবং আতপ চাল ৩৫ টাকা কেজি দরে সংগ্রহ করা হবে। ধানের উৎপাদন খরচ যেহেতু বাড়বে, সুতরাং চালের ক্ষেত্রেও বাড়বে। সুতরাং এই মূল্য ৩ থেকে ৪ টাকা বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই চালের সম্পূর্ণটা বৃহৎ অটোরাইস মিলের পরিবর্তে সারাদেশে এখনো যে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাতাল ব্যবসায়ী অসম প্রতিযোগিতার মধ্যেও টিকে আছে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

চ. গত বছর ধান-চাল একই তারিখে কেনার নির্দেশনা ছিল। এবার ১১ দিন আগে থেকে ধান কেনা হবে। এর সুফল পাওয়া সম্ভব যদি এই ১১ দিন সম্পূর্ণভাবে প্রান্তিক ও মাঝারী কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়।

কিন্তু অতীতে যেটা দেখা গেছে, যে তারিখ থেকে ধান সংগ্রহের কথা বলা হয়, সেই তারিখ থেকে সংগ্রহ করা হয় না, বা খুবই অল্প পরিমাণে সংগ্রহ করা হয়। আর সেগুলোও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ না করে আড়তদার-ফড়িয়া-মিলারদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। এতে বাধ্য হয়ে কৃষক খুবই অল্প দামে বাঁচার তাগিদে আড়তদার-ফড়িয়া-মিলারদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। যেমন গত বছর কৃষকেরা অধিকাংশ ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে মাত্র ১২-১৩ টাকা কেজি দরে, যেখানে তার উৎপাদন খরচই ছিল ২২-২৩ টাকা। সুতরাং তার প্রতি কেজিতে লোকসান হয়েছিল প্রায় ১০ টাকা। সে জন্য কৃষক তার রক্তে-বোনা ধানে আগুন দিয়ে, মহাসড়কে ফেলে প্রতিবাদ করেছিল। এবারে এ অবস্থা হলে তা হবে দেশের জন্য মহাসর্বনাশের।

কিন্তু কেন ধান বা অন্যান্য ফসলের ন্যায্যমূল্য বহুবছর ধরে সরকারগুলো নিশ্চিত করে না এবং এই মহাদুর্যোগকালেও তা না করার আশঙ্কা আমরা দেখতে পাচ্ছি? এর অনেকগুলো কারণের কথা বলা হয়।

একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে দেশে গার্মেণ্ট ও নির্মাণ শিল্পের মতো শিল্পে এবং বিদেশে দাসতুল্য শ্রমিকের যোগান অব্যাহত রাখা। কারণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করলে তা কৃষকের সন্তানকে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পমুখী হওয়ার প্রণোদনা জোগাতে পারে। তার কৃষিবিমুখী প্রবণতা হ্রাস পেলে বহির্মুখী প্রবণতাও কমতে পারে, যেটা বর্তমান অর্থনৈতিক কৌশলের পরিপন্থী।

দ্বিতীয়ত হলো গুটিকয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে ধান ও চালের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে অতি মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেওয়া, যারা ক্ষমতাকাঠামোর সাথে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট।

তৃতীয়ত, ক্রমাগত লোকসানের শিকার করে কৃষককে উন্নয়ন ব্যবসায়ী বা এনজিওদের ধারাবাহিক ঋণের চক্রে ফেলে কালো টাকার মালিক, যারা ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট, তাদের অল্প দামে কৃষিজমি কেনার সুযোগ করে দেওয়া।

চতুর্থত, বিদেশ থেকে কৃষকের সন্তানের পাঠানো টাকাটা যেন কখনোই কৃষিতে বিনিয়োগ করে কৃষক লাভবান হতে না পারে, যাতে করে কৃষকের সন্তানদের ধারাবাহিকভাবে বাইরে দাসশ্রম দিতে যাওয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং কর্মক্ষম থাকা পর্যন্ত সেখানেই থেকে যেতে বাধ্য হয়।

এগুলো খুবই মর্মান্তিক। কিন্তু তারও চেয়ে মর্মন্তুদ পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যদি আমরা এই বোরো মৌসুম, এই বিশ কোটি মানুষের খাদ্য জোগানো কৃষক ও তার রক্তে-বোনা ফসলকে এই মাহামারির কালেও মর্যাদাবান করতে ব্যর্থ হই।

মনে রাখা দরকার, আমরা যদি এবার ৩০ টাকা কেজি দরে ৫০ লাখ মে.টন ধান আর ৪০ টাকা কেজি দরে ২৫ লাখ মে.টন চালও সংগ্রহ করি তাহলেও আমাদের খরচ হবে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা। আর প্রতি বছর আমরা দেশ থেকে পাচার হতে দিই প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর তিন ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করে আমরা বাঁচিয়ে দিতে পারে বিশ কোটি মানুষের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে। সুতরাং যা করার এখনই করতে হবে।

রাখাল রাহা: কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *